সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ

নেপালের হিম্মত আমরা কোথায়?

ফিদেল কাস্ট্রোর কিউবা যেমন শক্তিধর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পাত্তা না দিয়েও মাথা উঁচু করে আছে; নেপালও যেন সে পথেই হাঁটছে। প্রতিবেশী ভারতকে থোড়াই কেয়ার করছে। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে হাজারো সংকটের মধ্যে থাকলেও প্রতিবেশী বড় দেশ ভারতের দাদাগিরি মানছে না। হিম্মতওয়ালা রাজনীতিকদের সাহসী সিদ্ধান্তে সে দেশের জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। এক বছর ধরে ওষুধ ও জ্বালানি সংকটে বিপর্যয়কর অবস্থায় মুখে পড়েছে দেশটি। দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠনগুলো এ নিয়ে ভারতের তীব্র সমালোচনা করছে। অথচ সিদ্ধান্তে অটল নেপাল। দেশটির জনগণের বক্তব্য হলো আমার দেশ, সিদ্ধান্ত আমার; অন্যের দাদাগিরি মানব না। সীমান্ত দিয়ে তেল, ওষুধের ট্রাক ঢুকতে না দিলে তোমাদের টিভি চ্যানেল দেখব না।

খবরটি দিয়েছে বিবিসি ও এনডি টিভি। নেপালের রাজনীতি নিয়ে নাক গলানোর অভিযোগে ভারতের সব টিভি চ্যানেল বন্ধ করে দিয়েছে নেপাল। ভারতীয় পণ্যের ওপর দীর্ঘদিন থেকে নির্ভরশীল থাকা নেপালের ক্যাবল অপারেটর সমিতি বলছে, ভারত তাদের সীমান্তে জ্বালানিসহ অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বোঝাই ট্রাক চলাচল করতে না দেয়ার প্রতিবাদে তারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নেপালের নতুন সংবিধানকে ঘিরে ভারতের সাথে দেশটির বিরোধের মধ্যেই নেপালে এ ঘটনা ঘটল। ৪২টি ভারতীয় স্যাটেলাইট চ্যানেলের সম্প্রচার হতো নেপালে। হিন্দু ধর্মাবলম্বী হওয়ায় দেশটির দর্শকদের কাছে ভারতীয় চ্যানেলগুলো ছিল খুবই জনপ্রিয়। কিন্তু নেপালের বহু মানুষ মনে করেন ভারত তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নাক গলাচ্ছে। গত বছর নেপাল পার্লামেন্ট সংবিধান সংশোধন করে হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র থেকে ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হয়েছে। এতে দিল্লি অসন্তুষ্ট হয়ে সীমান্ত দিয়ে নেপালে পণ্য পাঠানো বন্ধ করে দেয়। নেপালিদের মধ্যে বিরোধ বাধানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। নেপালের নতুন সংবিধান নিয়ে যেহেতু ভারত সন্তুষ্ট নয়; সেজন্যই প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ভারত পণ্য চলাচল বন্ধ করেছে এমনটাই মনে করেন নেপালের নাগরিকরা। পাল্টা প্রতিবাদ হিসেবে ভারতীয় চ্যানেলগুলো ব্ল্যাকআউট করে দেয়া হয়। প্রশ্ন হলো দিল্লির দাদাগিরির জবাব নেপালের মতো ছোট দেশ দিতে পারলে আমরা পারছি না কেন?

ভারতের প্রস্তাব মতো নেপাল হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র না থাকায় সীমান্ত দিয়ে পণ্য আনা-নেয়া বন্ধ করে দেয়া হয় এক বছর আগে। এতে বিপদে পড়লেও নেপাল মাথা নত করেনি। উল্টো নেপাল ভারতের সব টিভি চ্যানের বন্ধ করে দিয়েছে। অথচ বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের হাজারো সমস্যা। দিল্লির শাসকরা নিত্যদিন দাদাগিরি করছে। তিস্তার পানি চুক্তি যুগের পর যুগ ধরে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। অথচ ভারততে ট্রানজিট দেয়া হয়েছে। টিপাইমুখে বাঁধ দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে, বাংলাদেশের ওপর নিয়ে বিদ্যুৎ লাইন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, ওয়ার্কপারমিট ছাড়া হাজার হাজার ভারতীয় বাংলাদেশে কাজ করছে, তিস্তার উজানে গজলডোবায় বাঁধ দিয়ে অন্যায়ভাবে পানি তুলে নিয়ে যাচ্ছে, বাংলাদেশের নিজস্ব সম্পদ ফেনি নদীর পানির ওপর ভাগ বসিয়েছে, কারণে-অকারণে প্রায় নিত্যদিন সীমান্ত বাংলাদেশীদের হত্যা করছে। এমনকি বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে নাক গলাচ্ছে। আমাদের এক কোটি প্রবাসী যে রেমিটেন্স দেশে পাঠাচ্ছেন তার এক-তৃতীয়াংশ নিয়ে যাচ্ছে বৈধ-অবৈধভাবে এখানে থাকা ভারতীয়রা। অথচ আমাদের নেতানেত্রীদের এসব নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। উল্টো নেতা-নেত্রীদের মধ্যে দিল্লি তোষণের প্রতিযোগিতা চলছে।

সন্ত্রাসবাদকে উস্কে দেয়ার অভিযোগে সম্প্রতি ভারতীয় নাগরিকের মালিকানাধীন পিস টিভির প্রচারণা সরকার বন্ধ করে দিয়েছে। আইন-শৃংখলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সিদ্ধান্তের পর তথ্য মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশে পিস টিভির সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, মন্ত্রিসভা কমিটির সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে ডাউন লিংকের শর্ত ভঙ্গ করায় বিদেশি ফ্রি-টু-এয়ার টিভি চ্যানেল পিস টিভির ডাউন লিংকের অনুমতি বাতিল করা হলো। বাংলাদেশের আলেম সমাজ ও সাধারণ জনগণ এতে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন। তবে যে কারণ দেখিয়ে পিস টিভির সম্প্রচার বন্ধ করা হলো সে প্রক্রিয়ায় কি ভারতের অন্যান্য চ্যানেলগুলো বন্ধ করা যায় না? কারণ ওইসব চ্যানেল সংস্কৃতির নামে বাংলাদেশে অপসংস্কৃতি ছড়াচ্ছে। ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশে হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি প্রচার করছে। এতে আমাদের নতুন প্রজন্ম, পরিবারের মা, বোন, খালারা কুটিলতা, জটিলতা, ঠকবাজি ও বিরোধের শিক্ষা নিচ্ছে। প্রশ্ন হলো ভারতের অন্যান্য চ্যানেলগুলো কি বাংলাদেশের প্রচারণায় ডাউন লিংকের শর্ত মেনে চলছে?

২০১৪ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশে ভারতীয় তিনটি টিভি চ্যানেল (স্টার জলসা, স্টার প্লাস ও জি বাংলা) সম্প্রচার বন্ধের দাবি জানিয়ে সুপ্রিমকোর্টে একটি রিট করা হয়। ৭ দিনের মধ্যে ওই চ্যানেলগুলো বন্ধের ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ চেয়ে রিট করেন আইনজীবী সৈয়দা শাহীন আরা লাইলী। ওই রিট আবেদনে ৭ দিনের মধ্যে ওই তিনটি চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধে নির্দেশ চাওয়ার পাশাপাশি তা বাস্তবায়নে প্রতিবেদন দুই সপ্তাহের মধ্যে আদালতে দাখিল করার আরজি জানানো হয়। একই সঙ্গে ভারতীয় চ্যানেল বাংলাদেশে সম্প্রচার না করতে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, সে বিষয়েও রুল চাওয়া হয়। আবেদনকারীর পক্ষে আইনজীবী একলাছ উদ্দিন ভূইয়া ওই চ্যানেলগুলোর কুফল তুলে ধরে বলেন, বাংলাদেশের কোনো টিভি চ্যানেল ভারতে সম্প্রচার করা হয় না। কিন্তু ভারতীয় বিভিন্ন টিভি চ্যানেল বাংলাদেশে অবাধ সম্প্রচারের ফলে দেশের যুবসমাজ ধ্বংসের সম্মুখীন। স্টার জলসায় ‘বোঝে না সে বোঝে না’ সিরিয়ালে পাখি চরিত্রে অভিনয়কারীর পোশাকে (পাখি ড্রেস) আকৃষ্ট হয়ে কিনতে না পেরে বাংলাদেশে একাধিক কিশোরী আত্মহত্যা করেছে। এ ব্যাপারে আদালতও নির্দেশনা দেয়। কিন্তু ওই মামলা চাপা পড়ে গেছে। ফলে ভারতীয় চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে সাংস্কৃতির আগ্রাসন অব্যাহত রয়েছে। শুধু তাই নয়, ইদানিং ভারতীয় শিল্পীদের ভাড়া করে এনে দেশের চ্যানেলগুলোতে নিত্যদিন গান গাওয়ানো হচ্ছে। বিশেষ করে দেশ টিভি নামের একটি চ্যানেলের গানের অনুষ্ঠানে শতকরা ৯০ ভাগ শিল্পীকে কোলকাতা থেকে নিয়ে আসা হয়। পাশাপাশি যৌথ প্রযোজনার নামে বাংলাদেশের সিনেমায় ভারতীয় শিল্পীদের প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। ছবি নির্মাণে ভারতের এক প্রদেশ থেকে অন্য প্রদেশের মধ্যে যেমন শিল্পীদের ব্যবহার করা হয়; যৌথ প্রযোজনায় ছবি নির্মাণের নামে ঢাকা ও কোলকাতার মধ্যেও তেমন বিনিময় ঘটছে। ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলোতে কি ধরনের অনুষ্ঠান প্রচার হয় তা সবার জানা। দেশি সংস্কৃতির বদলে মুসলিম দেশের কোটি কোটি দর্শককে হিন্দুয়ানি কালচারে আকৃষ্ট করার দায় কি শুধু দর্শকদের?

ভারতীয় চ্যানেলগুলোই কি শুধু বিনোদন দেয়? বিনোদন হচ্ছে আপেক্ষিক বিষয়। সবাই সবকিছুতে বিনোদন পান না। কে কিসে বিনোদন পাবেন সেটা নির্ভর করে তার রুচিবোধ ও মন-মর্জির ওপর। পারিপার্শ্বিকতা, পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেমন একজন কবি কবিতা লিখে আনন্দ পান। বই পড়া যাদের নেশা তারা বই পড়ে মজা পান। একজন বিজ্ঞানী নতুন কিছু আবিষ্কারে আনন্দ পান। বিজ্ঞান অনুরাগীরা সেই বিষয়ে পড়ে আনন্দ পান। একজন সাহিত্যিক প্রতিনিয়তই নতুন কিছু লেখার চেষ্টা করেন। গায়ক আনন্দ পান গান করে। সাংবাদিক নতুন সংবাদের সন্ধানে থাকেন। এটাই তাদের আনন্দ। কেউ যাত্রাপালা পছন্দ করেন; আবার কেউ মঞ্চনাটক পছন্দ করেন। কেউ সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখে মজা পান, কেউ খেলা দেখে মজা পান। এসব নির্ভর করে রুচিবোধের ওপর। ভারতীয় চ্যানেলগুলোতে সিরিয়াল ও নাটকের নামে যা দেখানো হয় তা কি সত্যিই বিনোদন? একটি নাটকে একজন নারী নিজের গয়না চুরি করে বা লুকিয়ে রেখে আরেকজনকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছেন। একজন আরেকজনের ক্ষতি করার চেষ্টায় অনবরত লেগে থাকছেন। কোলকাতার চ্যানেলগুলোর সিরিয়ালে ষড়যন্ত্র, কুটিলতা, ভ্যারামো, মিথ্যাবাদিতা, পাপাচার, অন্যের ক্ষতিসাধন করা, লিভ টুগেদার করা, ছেলেমেয়েদের বেলেল্লাপনায় উৎসাহ দেয়া কি বিনোদনের খোরাক? ভারতীয় চ্যানেলগুলোর বছরের পর বছর ধরে চলা সিরিয়ারের মূল বিষয়বস্তু যখন পারিবারিক কূটচাল তখন এই নাটক দেখে মানুষের মনের অবস্থা কেমন হতে পারে? বউ-শাশুড়ির মনোমালিন্য আমাদের সমাজে আছে। তবে সেটা স্টার জলসা, জি বাংলার নাটকের মতো এতটা নয়। বউয়ের রান্না করা খাবারে অতিরিক্ত লবণ দিয়ে বদনাম করানো আমাদের সমাজে প্রচলিত না। ওই সব চ্যানেলের এমন সিরিয়ালের কূটচাল দেখে আমাদের মা-খালা, বোন-ভাবীরা নিজেরা আকৃষ্ট হচ্ছে।

ধর্মগত কারণে ভারতীয় সংস্কৃতিতে আকৃষ্ট হয়ে পড়া নেপাল সাহস দেখিয়ে ভারতীয় চ্যানেল বন্ধ করে দিয়েছে। নেপালের অধিকাংশ নাগরিক হিন্দু ধর্মাবলম্বী। ভারতের চ্যানেলগুলোতে হিন্দুত্ববাদী সংস্কৃতি প্রচার করা হয়। তারপরও অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ওপর হস্তক্ষেপের চেষ্টা এবং সীমান্তে ওষুধ, জ্বালানি, খাদ্যের ট্রাক চলাচল করতে না দেয়ায় নেপাল ভারতীয় সব টিভি চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ করে দিয়েছে। সে দেশের নাগরিকরাও একাট্টা। ভারতীয় আগ্রাসনের মুখে এবং দেশের ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশ হওয়ার পরও আমরা কেন হিন্দুত্ববাদী সংস্কৃতির প্রচারক ভারতীয় চ্যানেলগুলো বর্জন করতে পারছি না? আমাদের দুর্বলতা কোথায়? নেপালিদের দেশপ্রেম আছে আমাদের নেই? নাকি আমরা নেপালিদের মতো সাহসী নই? সাহসী না হলে ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করলাম কীভাবে? বাস্তবতা হলো আমাদের দেশের জনগণ দেশপ্রেমী কিন্তু দেশে হিম্মতওয়ালা রাজনীতিকের বড়ই অভাব। (আংশিক সম্পাদিত)

ইনকিলাব

মন্তব্য করুন

Back to top button