রামাযান ও ছিয়াম

রোজা এবং তাক্বওয়া

পবিত্র রামাদান মাস আমাদের মাঝে উপস্থিত। সিয়াম সাধনা তথা রোজা রাখার অনন‍্য ইবাদাতে আমরা সবাই মগ্ন হয়ে পড়বো। অন‍্য যে কোন ইবাদাত পদ্ধতির সাথে রোজার গুরুত্বপূর্ণ পার্থক‍্যটি হচ্ছে, একজন রোজাদার দিনরাত্রির প্রতিটি মুহূর্ত আল্লাহর ইবাদাতের স্বাদ অনুভব করতে থাকেন। সার্বক্ষণিক ইবাদাতের অতুলনীয় এ অনুভবটি দীর্ঘ একমাস ধরে বিরাজ করতে থাকে। সার্বক্ষণিক ইবাদাতের এ অনুভব থেকে যথাযথ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারলে একজন মানুষ বছরের অবশিষ্ট এগার মাস আল্লাহর বিশুদ্ধ বান্দাহতে পরিণত হয়ে পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠবে। পবিত্র কুর’আনের সূরা বাকারার ১৮৩ আয়াতে মহান আল্লাহতা’য়ালা রোজার বিধানের উদ্দেশ‍্য বর্ণনা করে বলছেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমাদের জন‍্য রোজার বিধান দেয়া হয়েছে, যেমন দেয়া হয়েছিল হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর, যাতে তোমরা তাক্বওয়া অর্জন করতে পার।” আয়াতটির শেষ বাক‍্যাংশ ‘যাতে তোমরা তাক্বওয়া অর্জন করতে পার’, আরবীতে বলা হয়েছে ‘লা’আল্লাকুম তাত্তাক্বুন’। ‘লা’আল্লা’ কথাটির তিনটি অর্থ আছে, ‘যাতে’, ‘আশা করা যায়’ এবং ‘সম্ভবতঃ’। অনুবাদকগণ একেকজন একেকটি ব‍্যবহার করেছেন। তিনটি অর্থের মধ‍্যে একটি অনিশ্চিতি আছে, অর্থাৎ তাক্বওয়া অর্জিত হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। 

‘তাক্বওয়া’ শব্দটিও বেশ অস্পষ্ট। সাধারণভাবে এটির অনুবাদ ‘আল্লাহভীতি’ করা হয়। কিন্তু তাতে শব্দটির প্রকৃত তাৎপর্য় অনুধাবন করা যায় না। শব্দটির অনুবাদে আরো লেখা হয়ঃ ‘পরহেযগারী’, ‘সাবধানতা’, ‘আত্ম-সংযম’, ‘পাপ থেকে দূরে থাকা’, ‘আল্লাহর ব‍্যাপারে সাবধানী হওয়া’, ‘ধর্মভীরুতা’, ইত‍্যাদি। মূল বক্তব‍্য স্পষ্ট করে তুলে ধরার লক্ষ‍্যে কুরআনের একই অনুবাদ গ্রন্থে ‘তাক্বওয়া’ শব্দ থেকে উৎপন্ন বিভিন্ন শব্দের অনুবাদে প্রায়শঃই ভিন্ন ভিন্ন শব্দ লেখা হয়ে থাকে। পবিত্র কুরআনে মূল শব্দ ‘ওয়াক্বইয়ুন’ থেকে উৎপন্ন তাক্বওয়া, মুত্তাক্বী, তাত্তাক্বুন, ওয়াত্তাক্বুল্লাহ, ইত‍্যাদি শব্দ কুরআনে ২ শত ৫০ বারের বেশি বিভিন্ন অর্থে ব‍্যবহৃত হয়েছে। ইবনে কাসীর তাক্বওয়ার ব‍্যাখ‍্যায় বলেন অপছন্দনীয় কাজ পরিহার করাই হচ্ছে তাক্বওয়া। তাক্বওয়ার শাব্দিক অর্থ আত্মরক্ষা করা। অর্থাৎ আল্লাহর ক্রোধ থেকে আত্মরক্ষা করা; আল্লাহর অপছন্দনীয় কাজ করে তাঁর ক্রোধে পতিত হওয়া থেকে আত্মরক্ষা করাই হচ্ছে তাক্বওয়া। কুরআনের বিভিন্ন স্থানে কিছু কিছু আদেশ কঠোরভাবে পালনের নির্দেশ দেয়ার সাথে সাথে আল্লাহ ‘ওয়াত্তাক্বুল্লাহ’ বলে আল্লাহর ক্রোধ থেকে আত্মরক্ষা করার জন‍্য বিশেষভাবে সাবধান করে দিয়েছেন। বাক‍্যাংশটির প্রায় সকল অনারব অনুবাদে ‘আল্লাহকে ভয় করো’ লেখা হয়েছে।

শব্দটির এ অস্পষ্টতা কেবল অনারব পাঠকদের বেলায় সৃষ্টি হয় মনে করার কোন কারণ নেই। একদা হযরত উমার (রাঃ) হযরত কা’বুল আহবারকে (রাঃ) তাক্বওয়ার ব্যাখ্যা দিতে অনুরোধ করেছিলেন। তিনি উত্তরে বলেছিলেন, “আপনি কি কখনো কন্টকাকীর্ণ পথ অতিক্রম করেছেন?” জবাবে উমার (রাঃ) বললেন, “হ্যাঁ।” “আপনি তখন কী করেছিলেন?” তিনি বললেন, “আমি সাবধানতা অবলম্বন করে ঐ পথ দ্রুতগতিতে অতিক্রম করেছিলাম।” হযরত কা’ব (রাঃ) বললেন, “এটাই তাক্বওয়া। ” তফসীরে ইমাম বগভী। উমার (রাঃ) এর এ ঘটনাটি থেকে ধারণা করা যায়, তাক্বওয়া শব্দটি আরব পাঠকদের কাছেও সমানভাবে অস্পষ্ট। বর্ণিত ঘটনায় তাক্বওয়ার ব‍্যাখ‍্যা থেকে আমরা বুঝি কাঁটার আঘাত থেকে, তথা পাপকর্মের মোহনীয় হাতছানি থেকে, আল্লাহতা’য়ালার ক্রোধ-অসন্তুষ্টি থেকে আত্মরক্ষা করাই হচ্ছে তাক্বওয়া।

সূরা বাকারার দ্বিতীয় আয়াত তথা কুর’আনে বক্তব‍্য পেশ শুরু হয়েছে তাক্বওয়ার কথা বলে। আল্লাহ’তায়ালা বলছেন, “এটি সেই গ্রন্থ যাতে কোন সন্দেহ নেই; এটি মুত্তাক্বীদের (তাক্বওয়াসম্পন্ন) জন‍্য পথ নির্দেশনা।” অতঃপর তৃতীয় আয়াত থেকে পঞ্চম আয়াত পর্যন্ত মুত্তাক্বীদের প্রাথমিক পরিচয় দেয়া হয়েছেঃ (১) তারা গায়েবের উপর ঈমান আনে, (২) নামাজ কায়েম করে, (৩) আল্লাহর দেয়া রিযিক থেকে তারা মানব-কল‍্যাণে ব‍্যয় করে, (৪) তারা পূর্বে নাযিল হওয়া গ্রন্থ ও নবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর উপর যা কিছু নাযিল হয়েছে তার উপর ঈমান আনে এবং (৫) তারা আখিরাতের উপর নিশ্চিত বিশ্বাস রাখে। সূরা বাকারার ১৭৭ আয়াতে আল্লাহতা’য়ালা মুত্তাক্বীদের পরিচয় দিতে গিয়ে জানাচ্ছেন, (১) যারা আল্লাহর উপর, কিয়ামাতের দিনের উপর, ফেরেশতাদের উপর, নবী-রাসূলগণের উপর ঈমান আনে, (২) যারা আল্লাহকে ভালবেসে আত্মীয়স্বজন-ইয়াতীম-মিসকীন-মুসাফির-সহায়হীন-শৃঙ্খলিতদের মুক্তির জন‍্য নিজের সম্পদ ব‍্যয় করে, ও (৩) যারা নামাজ কায়েম করে, (৪) যাকাত আদায় করে, (৫) কোন প্রতিশ্রুতি দিলে তা পূরণ করে; (৬) যারা দুঃখে-দুর্দিনে-বিপদে-সংগ্রামে ধৈর্য ধারণ করে, তারাই হচ্ছে সত‍্যপন্থি এবং তারাই হচ্ছে মুত্তাক্বী।

সূরা আলে ইমরানের ১৩৪-১৩৫ আয়াতে আল্লাহতা’য়ালা মুত্তাক্বীদের পরিচয় দিচ্ছেনঃ (১) যারা সচ্ছল এবং (২) অসচ্ছল অবস্থায় মানব-কল‍্যাণে ব‍্যয় করে, (৩) ক্রোধ দমন করে এবং (৪) মানুষের অপরাধ ক্ষমা করে এবং (৫) যারা ভুলক্রমে কোন অশ্লীল কাজ কিংবা নিজের উপর জুলুম করে ফেলার সাথে সাথে আল্লাহর কাছে পাপ মার্জনার জন‍্য ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং সজ্ঞানে ঐ কাজের পুনরাবৃত্তি করেনা, তারাই মুত্তাক্বী। এসব মুত্তাক্বীরাই তাদের প্রভুর ক্ষমাপ্রাপ্তি এবং ঐ বেহেশতের জন‍্য প্রতিযোগিতা করে যার বিস্তৃতি আসমান থেকে জমিন পর্যন্ত। সূরা আন-আমএর ১৫১ এবং ১৫২ আয়াতে আল্লাহতা’য়ালা দশটি নির্দেশনা প্রদান করেছেন, এগুলি হচ্ছেঃ (১) আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা যাবে না, (২) পিতামাতার সাথে সদাচরণ করতে হবে, (৩) দারিদ্রের কারণে সন্তান হত‍্যা করা যাবে না, (৪) গোপন অশ্লীল কাজ এবং (৫) প্রকাশ‍্য অশ্লীল কাজের কাছেও যাওয়া যাবে না, (৬) যথার্থ কারণ ছাড়া প্রাণ হত‍্যা করা যাবে না, (৭) সদুদ্দেশ‍্য ছাড়া ইয়াতীমের সম্পদের কাছেও যাওয়া যাবে না, (৮) ওজন পরিমাপ ত্রুটিবিহীনভাবে করতে হবে, (৯) কথা বলার সময় সঠিক ন‍্যায‍্য কথাই বলতে হবে এমনকি তা যদি কোন আত্মীয়ের বিরুদ্ধেও যায়, (১০) আল্লাহর নামে দেয়া যে কোন প্রতিশ্রুতি অবশ‍্যই পূরণ করতে হবে। অতঃপর আন-আমএর ১৫৩ আয়াতে আল্লাহ জানাচ্ছেন এগুলোই সিরাতুল মুস্তাকীম লাভের উপায়, অতএব মানুষ যেন এগুলোই অনুসরণ করে; তিনি এসব নির্দেশনা দিয়েছেন যাতে মানুষ তাক্বওয়া অর্জন করতে পারে।

সূরা বনী ইসরাইলের ২২ থেকে ৩৮ আয়াতে ১৪টি আদেশ-নিষেধ রয়েছে। বলা হয়ে থাকে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মিরাজে গিয়ে আদেশ-নিষেধগুলো নিয়ে এসেছিলেন। এগুলি হচ্ছেঃ (১) আল্লাহ ছাড়া আর কারো ইবাদাত করা যাবে না; (২) পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করতে হবে, তাঁদের সাথে কখনো কোন রূঢ় আচরণ করা যাবে না, তাঁদের জন‍্য দোয়ার কথাও আল্লাহ এখানে শিখিয়ে দিয়েছেন; (৩) আত্মীয়স্বজন, অভাবগ্রস্থ এবং মুসাফিরের হক আদায় করতে হবে; (৪) অপব‍্যয় করা যাবে না, অপব‍্যয়কারী শয়তানের ভাই আর শয়তান তার প্রভুর কাফের; (৫) নিজেই আল্লাহর অনুগ্রহপ্রার্থী থাকা অবস্থায় কোন যাচ্ঞাকারী-প্রার্থীকে বিমুখ করতে হলে কোমল ভাষায় কথা বলতে হবে; (৬) একেবারে ব‍্যয়কুণ্ঠ হওয়া যাবে না আবার একেবারে মুক্তহস্তও হওয়া যাবে না; (৭) দারিদ্রের ভয়ে সন্তান হত‍্যা করা যাবে না; (৮) যিনা-ব‍্যভিচারের কাছেও যাওয়া যাবে না, এটি অশ্লীল কাজ; (৯) প্রাণ হত‍্যা করা যাবে না; (১০) সদুদ্দেশ‍্য ছাড়া ইয়াতীমের সম্পদের কাছেও যাওয়া যাবে না; (১১) ওয়াদা-প্রতিশ্রুতি প্রতিপালন করতে হবে; (১২) ওজন-পরিমাপ যথাযথভাবে করতে হবে; (১৩) যে বিষয়ে (কথা, গুজব, অপবাদ, তথ‍্য, অথবা যে কোন বিষয়) কোন জ্ঞান নেই, সে বিষয়ের পিছনে ছিদ্রান্বেষণে রত হওয়া যাবে না; চোখ, কান এবং অন্তকরণ সবকিছুর কার্যাবলীর জন‍্য জবাবদিহি করতে হবে; (১৪) অহংকার করা যাবে না। এ নির্দেশনাসমূহের মধ‍্য যেগুলো মন্দ সেগুলো আল্লাহর দৃষ্টিতে অত‍্যন্ত ঘৃণিত-গর্হিত।

সূরা ফুরকানের ৬৩ আয়াত থেকে ৭৪ আয়াতে একইরকমভাবে বারটি নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছেঃ (১) আল্লাহর প্রকৃত বান্দাহরা পৃথিবীতে বিনীতভাবে চলাফেরা করে; (২) যাহেল-মুর্খরা তাদেরকে (অসৌজন‍্যমূলকভাবে বা অসদুদ্দেশ‍্যে) সম্বোধন করলে তারা সালাম জানিয়ে সরে যায়; (৩) তারা তাদের প্রতিপালকের উদ্দেশ‍্যে সেজদাবনত ও দণ্ডায়মান থেকে রাত্রি অতিবাহিত করে; (৪) জাহান্নামের আগুন থেকে আত্মরক্ষার জন‍্য তারা বিনীতভাবে তাদের পালনকর্তার কাছে প্রার্থনা করে; (৫) তারা অমিতব‍্যয়ী নয় আবার কৃপণতাও করেনা, বরং মধ‍্যপন্থা অবলম্বন করে থাকে; (৬) তারা আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করে না; (৭) সঙ্গত কারণ ব‍্যতীত তারা কোন প্রাণ হত‍্যা করে না; (৮) তারা ব‍্যভিচার করে না; (৯) ভুলক্রমে কোন অন‍্যায় কাজ করে ফেললে তারা তাওবা করে এবং ঐ কাজ আর কখনো করে না বরং পূর্ণ ঈমানের সাথে সৎকর্ম করতে থাকে এবং অসৎকর্ম থেকে সম্পূর্ণরূপে ফিরে আসে; (১০) তারা কখনো মিথ‍্যা কথা বলে না, মিথ‍্যা সাক্ষ‍্য দেয় না; (১১) তারা অর্থহীন সকল ক্রিয়াকলাপ পরিহার করে চলে; (১২) আল্লাহর বাণীর প্রতি তারা অন্ধ ও বধির সদৃশ আচরণ করে না। তারা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে, ‘তাদের স্ত্রী এবং সন্তানেরা যেন তাদের নয়ন জুড়িয়ে দেয় এবং আল্লাহ যেন তাক্বওয়াসম্পন্নদের মধ‍্যে তাদেরকে আদর্শস্বরূপ করে দেন।’

উপরে বিভিন্ন সূরার বিভিন্ন আয়াতের সূত্রে যে বক্তব‍্য তুলে ধরা হয়েছে, তা কিন্তু সংশ্লিষ্ট আয়াতসমূহের অনুবাদ নয়। বরং অত‍্যন্ত সংক্ষেপিত মূল নির্দেশনাটুকু এখানে উল্লেখ করা হয়েছে। উল্লিখিত বিভিন্ন সূরার বিভিন্ন আয়াতে প্রদত্ত নির্দেশনাগুলোকে একসাথে সাজানো যাকঃ (১) আল্লাহর উপর ঈমান আনতে হবে; আল্লাহর সাথে কোনভাবেই কোন শরীক স্থাপন করা যাবে না; গায়েবের উপর ঈমান আনতে হবে। গায়েব বলতে আল্লাহসহ মানুষের জ্ঞান-বোধ-বুদ্ধির অগম‍্য (ফেরেশতা, বেহেশত, দোযখ, কিয়ামাত, ইত‍্যাদি) সবকিছুর উপর ঈমান আনতে হবে। (২) নবীগণের উপর ঈমান আনতে হবে। (৩) কুর’আনসহ পূর্বে নাযিল হওয়া সকল আসমানী কিতাবের উপর ঈমান আনতে হবে, অর্থাৎ এ গ্রন্থগুলোর প্রতিটি বাণী আল্লাহরই বাণী। (৪) আখিরাতের দিনের উপর পূর্ণ বিশ্বাস রাখতে হবে। (৪) নামাজ কায়েম করতে হবে। (৫) সুনির্দিষ্ট খাতে ফরজ হিসাবে যাকাত আদায় করতে হবে, (৬) এছাড়াও আল্লাহর প্রতি অন্তরে গভীর ভালবাসা পোষণ করে সচ্ছল-অসচ্ছল সর্বাবস্থায় অসহায়-নিঃস্ব-ভাগ‍্যাহতদেরকে এবং মানবকল‍্যাণের লক্ষ‍্যে সাদাকাহ দিতে হবে। (৭) মা-বাবার সাথে সদাচরণ করতে হবে, তাঁদের মনে কখনো আঘাত দেয়া যাবে না, তাদের জন‍্য আল্লাহ-নির্দেশিত পন্থায় নিয়মিত দোয়া করতে হবে। (৮) ওয়াদা-প্রতিশ্রুতির বরখেলাপ করা যাবে না। (৯) বিপদে-দুঃখে-দুর্দিনে-সংগ্রামে সকল অবস্থায় আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা এবং নির্ভরশীলতা সহকারে ধৈর্য ধারণ করতে হবে। (১০) কোন কারণে মনে ক্রোধের উদ্রেক হলে, এটি শয়তানের উসকানি-অনুপ্রেরণা বিবেচনা করে এবং আল্লাহর নির্দেশ হিসাবে ক্রোধকে কঠোরভাবে দমন করতে হবে। (১১) ক্ষমাশীলতা আল্লাহতা’য়ালা মহান গুণসমূহের অন‍্যতম; যে অন‍্যের অপরাধ ক্ষমা করে না, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন না; আল্লাহর ক্ষমা লাভের আশায় অন‍্যের অপরাধ ক্ষমা করে দেয়ার এ মহান গুণ অর্জন করতে হবে। (১২) শয়তান মানুষকে সর্বক্ষণ অন‍্যায়-অশ্লীল কাজ করার জন‍্য কুপ্ররোচনা-উৎসাহ দিয়ে চলেছে; শয়তানের কুপ্ররোচনায় ভুলক্রমে কখনো কোন অন‍্যায় অশ্লীল কাজ করে ফেললে সাথে সাথে আল্লাহর কাছে তাওবাহ করতে হবে এবং গুনাহ মাফের জন‍্য দোয়া করতে হবে; তাওবাহ হবে এমন যেন একই গুনাহর কাজের কোন পুনরাবৃত্তি ব‍্যক্তির জীবনে আর না ঘটে। (১৩) দারিদ্র বা অন‍্য যে কোন কারণেই হোক সন্তান হত‍্যা করা যাবে না। (১৪) গোপন অশ্লীল বা প্রকাশ‍্য অশ্লীল কাজের কাছেও যাওয়া যাবে না। (১৫) যিনা-ব‍্যভিচারের কাছেও যাওয়া যাবে না। (১৬) আল্লাহ যে সমস্ত কারণে হত‍্যা বৈধ করেছেন, ঐ সমস্ত কারণ ব‍্যতীত অন‍্য কোন কারণে মানুষ হত‍্যা করা যাবে না। (১৭) সদুদ্দেশ‍্য ছাড়া অন‍্য কোন কারণে ইয়াতীমের সম্পদের কাছেও যাওয়া যাবে না। (১৮) ওজন-পরিমাপ ত্রুটিহীনভাবে করতে হবে। এটি ব‍্যাপক অর্থবোধক একটি নির্দেশনা। শুধু দাঁড়িপাল্লা বা গজ-ফুট মাপার ফিতার কথা এখানে বলা হয় নি। প্রত‍্যেক মানুষ তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে একটি দাঁড়িপাল্লা বহন করে চলেছে। অফিসের কাজে ফাঁকি দিলে ওজনে কম দেয়া হলো; কাজের বিনিময়ে বেতন নেয়া সত্বেও ঘুষ নিলে ওজনে ফাঁকি দেয়া হয়; যে কোন চুক্তি-প্রতিশ্রুতির বরখেলাপ করলে কার্যত ওজনে কারচুপি করা হয়; সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব পালন না করলেও ওজনে কারচুপি করা হয়; খাদ‍্যসহ যে কোন পণ‍্যে ভেজাল মেশানো বস্তুতঃ ওজনে ফাঁকি দেয়ারই নামান্তর; দাম বাড়ানোর উদ্দেশ‍্যে পণ‍্য গুদামজাত করে ন‍্যায‍্য দাম থেকে ক্রেতাকে বঞ্চিত করাও ওজনে ফাঁকি দেয়া বৈকি। (১৯) কথা বলার সময় সঠিক-ন‍্যায‍্য কথা বলতে হবে, সেটি যদি কোন নিকটাত্মীয়ের বিরুদ্ধেও যায়। সূরা নিসার ১৩৫ আয়াতে বলা হয়েছে, ব‍্যক্তির নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ‍্য দেয়ার ক্ষেত্রেও সঠিক-ন‍্যায‍্য কথা বলতে হবে। কখনো কোন মিথ‍্যার আশ্রয় নেয়া যাবে না। (২০) ওয়াদা-প্রতিশ্রুতি অবশ‍্যই পালন করতে হবে। (২১) অপচয় করা যাবে না। অপচয়কারী শয়তানের ভাই। ধূমপানসহ সকল অপব‍্যয় অপচয় আসলে শয়তানি কাজ। (২২) দয়া-করুণাপ্রার্থীকে বিমুখ করতে হলে কোমলভাবে কথা বলতে হবে। শক্তের ভক্ত নরমের যম, এমন আচরণ পরিহার করতে হবে। সর্বশক্তিমান আল্লাহই শিক্ষা দিচ্ছেন দুর্বলের প্রতি আচরণ কেমন হওয়া উচিত। (২৩) যে বিষয়ে কোন জ্ঞান নেই, সে বিষয়ে মুখরোচক আলোচনা সমালোচনায় লিপ্ত হওয়া যাবে না। পরচর্চা, পরনিন্দা, গুজব রটনা, মি‍থ‍্যা অপবাদ রটনা, ইত‍্যাদি সম্পূর্ণ পরিহার করতে হবে। (২৪) কথা-কর্ম-চিন্তায় কোন প্রকার অহংকার প্রদর্শন করা যাবে না। মানুষের সবসময় মনে রাখা উচিত, ক্ষমতায় তার চাইতে অনেক উঁচুতে আল্লাহতা’য়ালার অবস্থান। (২৫) জীবন যাপনে বিনয়ী হতে হবে। কখনো দুর্ব‍্যবহার বা অসৌজন‍্যমূলক আচরণের মুখোমুখি হলে সৌজন‍্যের সাথে সালাম জানিয়ে ঐ স্থান থেকে চলে যেতে হবে। (২৬) রাত্রের উল্লেখযোগ‍্য সময় আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ‍্যে নামাজে দীর্ঘ কিয়াম এবং দীর্ঘ সেজদায় অতিবাহিত করতে হবে। (২৭) জাহান্নামের আগুন থেকে পরিত্রাণের জন‍্য আল্লাহর কাছে প্রতিনিয়ত প্রার্থনা করতে হবে। (২৮) মানবকল‍্যাণে ব‍্যয়কে আল্লাহ উৎসাহিত করেন। কিন্তু সকল ব‍্যয়ের ক্ষেত্রে মধ‍্যপন্থা অবলম্বন আল্লাহর নির্দেশ; অমিতব‍্যয়ী বা ব‍্যয়কুণ্ঠ হওয়া যাবে না। (২৯) অর্থহীন কোন কর্ম ব‍্যক্তি নিজে করবে না, এর সাথে জড়িত হবে না এবং কেউ এমন কোন কর্ম করলে তার সহযোগী হওয়া যাবে না। (৩০) আল্লাহর বাণীর প্রতি অন্ধ ও বধিরের মতো আচরণ করা যাবে না। আল্লাহর বাণী কিংবা হুকুম শুনলাম, কিন্তু বুঝতে চেষ্টা করলাম না অথবা বুঝলেও অনুসরণ করলাম না এমন আচরণ করা যাবে না।

কুর’আনের পাঁচটি সূরার পাঁচটি স্থানে আল্লাহতা’য়ালা কিছু করণীয় ও বর্জনীয় কাজের নির্দেশনা দিয়ে জানাচ্ছেন মুত্তাক্বীরাই এগুলো অনুসরণ করে। সবগুলোকে একত্রিত করে আমরা ত্রিশটি নির্দেশনা পেয়েছি। তাক্বওয়ার তাৎপর্য অনুধাবনে আমাদের যে সমস‍্যা হচ্ছিল, মহান আল্লাহ স্বয়ং সে সমস‍্যার সমাধান করে দিয়েছেন। তিনি জানাচ্ছেন, কিছু কাজ, হারাম বিবেচনায়, করা থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকা এবং অপর কিছু কাজ, কল‍্যাণকর-পুণ‍্যময় বিবেচনায়, করার জন‍্য তৎপর থাকাই হচ্ছে তাক্বওয়া। একই রকম নির্দেশনা এবং আরো ভিন্ন অনেক নির্দেশনাও কুরআনের অন‍্যান‍্য স্থানে আছে। একজন মানুষ যখন নামাজ কায়েমে দাঁড়ায় তখন পার্থিব সকল কাজ থেকে সে নিজেকে বিরত রাখে। কিন্তু নামাজের সময়টুকু অতি অল্প। নামাজ শেষ করেই মানুষ পার্থিব বিভিন্ন কাজে লেগে যায়। অনেক ক্ষেত্রে মানুষ তখন আল্লাহর হুকুম প্রতিপালনের কথা ভুলে যায় এবং প্রায়শঃই হুকুমের ব‍্যত‍্যয় ঘটিয়ে ফেলে। রমজান মাসটা একটি ব‍্যতিক্রম মাস। রোজা রাখা যে কোন ব‍্যক্তি কেবল সেহরী থেকে ইফতারের সময় নয়, বরং এ মাসের দিন-রাত্রির প্রতিটি মুহূর্ত আল্লাহর ইবাদাতের স্বাদ পেতে থাকে। মন থেকে কুভাবনা-কুচিন্তা অনেকখানি উবে যায়। অন‍্যায় কখনো করে ফেললেও মনের মধ‍্যে একটা শংকা, একটা দ্বিধা সর্বক্ষণ কাজ করতে থাকে। সুতরাং আল্লাহর হুকুম বিধি-নিষেধ প্রতিপালনের শ্রেষ্ঠ মাসতো এ রমজান মাসই। আল্লাহ তাই অত‍্যন্ত যথার্থভাবে জানিয়েছেন সিয়াম তথা রোজার এ বিধান দেয়া হয়েছে, যাতে মানুষ তাক্বওয়া অর্জনে (করণীয় ও বর্জনীয় নির্দেশনা প্রতিপালনে) সচেষ্ট হতে পারে।

সবশেষে দুটি হাদীসের সংক্ষিপ্তসার উল্লেখ করা যাক। সহীহ মুসলিমে আবু হুরাইরার (রাঃ) বর্ণনা। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) একদিন সাহাবাবৃন্দের কাছে জানতে চাইলেন, তাঁর উম্মাতে মধ‍্যে দরিদ্র ব‍্যক্তি কে। জবাবে সাহাবাবৃন্দ বললেন যার ধন-সম্পদ নেই সে দরিদ্র। নবীজী (সাঃ) জানালেন তাঁর উম্মাতের ঐ ব‍্যক্তিই দরিদ্রতম, যে কিয়ামাতের দিন সালাত-সাওম-যাকাতের বিপুল পুণ‍্য নিয়ে উপস্থিত হবে। কিন্তু সে পৃথিবীতে কাউকে গালি দিয়েছিল, কারো উপর মিথ‍্যা দোষারোপ করেছিল, কারো ধন-মাল আত্মসাৎ করেছিল, কারো রক্তপাত করেছিল, কাউকে অকারণে মারধর করেছিল। তার সমস্ত পুণ‍্য এসব মজলুমদের দেয়ার পরও তার গুনাহ শেষ হবে না। তখন মজলুমদের কিছু কিছু পাপ তার উপর চাপিয়ে দেয়া হবে। পরিশেষে সালাত-সাওম-যাকাতের বিপুল পুণ‍্য নিয়ে আসা ব‍্যক্তি জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। অপর হাদীসটি সহীহ বুখারী থেকে সংগৃহীত, এটিও আবু হুরাইরা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, যে ব‍্যক্তি রোজা রেখে খারাপ কথা এবং খারাপ কাজ পরিত‍্যাগ করে না, (রোজার নামে) তার আহার-পানীয় পরিত‍্যাগ আল্লাহর কাছে অপ্রয়োজনীয়।

যে মানুষটি ওজনে কম দেয়, সে সবসময় নিশ্চিত করতে চায় সে নিজে যেন কখনো ওজনে না ঠকে। আবার যে ঘুষ খায়, তার কাছে কেউ ঘুষ দাবী করলে সে ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। যে অশ্লীল কাজে লিপ্ত হয়, সে কখনো চায় না তার স্ত্রী-কন‍্যারা অন‍্যের অশ্লীলতার শিকার হবে। যে নিজে কাজে ফাঁকি দেয়, তার অধীনস্থরা তার ব‍্যক্তিগত কাজে ফাঁকি দেবে এটা সে সহ‍্য করে না। কোন চোর তার নিজের ঘরও একই রকমভাবে চুরি হোক এটি চায় না। কোন খুনী চায় না তাকেও অন‍্য কেউ খুন করুক। উপরে যে নির্দেশনাসমূহের তালিকা করা হয়েছে, সেটি বারে বারে পড়েও এমন একটি নির্দেশনা পাওয়া যাবে না, যেটি আল্লাহ তাঁর নিজের স্বার্থে মানুষকে করতে বলেছেন। এগুলো এবং কুরআনে উদ্ধৃত অন‍্যান‍্য নির্দেশনা পরিপালনে আল্লাহর কোন লাভ বা ক্ষতি নেই। এগুলি পরিপালনের মাধ‍্যমে মানুষ নিজের জন‍্য যা চায়, অন‍্যের জন‍্যও তাই চাইতে শিখবে; মানুষ বিশুদ্ধ মানুষে পরিণত হয়ে উঠবে; তাক্বওয়াসম্পন্ন মানুষে পরিণত হয়ে উঠবে; আল্লাহর পছন্দনীয় মানুষে পরিণত হয়ে উঠবে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সিয়াম সাধনার এ মাসে একাগ্রতার সাথে তাক্বওয়াচর্চার তাওফিক দান করুন। আমীন!

 

– মুহাম্মদ জামালুদ্দীন

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button