ইমান/আখলাককুরআনের কথা

তোমাদের অর্থহীন শপথের জন্য আল্লাহ তোমাদেরকে ধরবেন না (বাক্বারাহ: ২২৪-২২৫)

আজকাল আমরা কথায় কথায় এমন সব শপথ নেই, যেগুলো আমাদের মধ্যে অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, নিজেদের মধ্যে মিলমিশ করতে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। যেমন ধরুন, একদিন এক আত্মীয়ের অন্যায় কাজে আপনি রেগে গিয়ে মনে মনে বললেন, “আল্লাহর ﷻ কসম! আমি যদি কোনোদিন আর এর কোনো উপকার করেছি।” এই শপথের কারণে আপনি রমজানে তাকে আর যাকাত দিলেন না, অথচ সে ছিল আপনার কাছ থেকে যাকাত পাওয়ার সবচেয়ে বড় দাবীদার। আবার অনেকে মন মতো কিছু না হলে এমন সব শপথ নেন, যা ভয়ঙ্কর। যেমন, ছেলে নিজে পছন্দ করে মেয়ে বিয়ে করে এনেছে দেখে, ছেলের মা অপমানে মুখ বুঝে কোনোমতে বিয়ের অনুষ্ঠানটা পার করেছে। মেয়ে-পক্ষের দাওয়াতে মুরগির রান না দেওয়াতে সে রেগে গজ গজ করে বলেছে, “আল্লাহর ﷻ কসম! এই মেয়েকে আমি কোনোদিন মেনে নিবো না।” এরপর থেকে সেই শপথের কথা রাখার জন্য শাশুড়ি কোনোদিন বউয়ের সাথে হাসিমুখে, ভদ্রভাবে কথা বলে না। সব কথায় একটা খোঁচা, একটা ধমক থাকবেই, পাছে আবার শপথ ভেঙ্গে যায়।

এই ধরনের শপথের ব্যাপারে আল্লাহ ﷻ আমাদেরকে কঠিনভাবে বলেছেন—

 

আল্লাহর নামে নেওয়া শপথকে বাঁধা হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেবে না তোমাদের সৎকাজ, আত্মসংযম এবং মানুষের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার মধ্যে। আল্লাহ সব শোনেন, সব জানেন। [আল-বাক্বারাহ ২২৪]

প্রথমত, আল্লাহর ﷻ পবিত্র নাম নিয়ে কোনো অন্যায় কাজের শপথই করার কথা না। এই ধরনের শপথ যারা করে, তাদের কাছে আল্লাহর ﷻ নাম নেওয়াটা একটা খেলা হয়ে গেছে। তারা কথায় কথায় আল্লাহর ﷻ পবিত্র নাম মুখে আনার দুঃসাহস দেখায়।

 

এই আয়াতে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দ রয়েছে, যা যাবতীয় ভালো কাজের সমষ্টি নির্দেশ করে। প্রথমে এসেছে تَبَرّ তাবার্‌রা, যা এসেছে بِرّ বির্‌র থেকে। এর অর্থ যাবতীয় ভালো কাজের দায়িত্ব যেমন বাবা-মা’র যত্ন নেওয়া, নিকটাত্মীয়, অভাবী, এতিমদের দেখাশোনা করা, ভালো কাজে নিজের সম্পদ ব্যায় করা ইত্যাদি।[৭][৫] আমরা যেন আল্লাহর ﷻ নামে শপথ নিয়ে কোনো আত্মীয়ের সাথে সম্পর্ক নষ্ট না করি। কোনো অভাবী মানুষকে তাড়িয়ে না দেই। কোনো ইসলামি সংগঠনের কারো সাথে তিক্তকর ঘটনা ঘটেছে বলে সংগঠনকে আর কোনো ধরনের সাহায্য করা বন্ধ করে না দেই।

এরপরে এসেছে تَتَّقُوا۟ তাত্তাকু, যা এসেছে ٱتَّقَىٰ ইত্তাক্বা থেকে, এর অর্থ আত্মসংযম। আল্লাহ ﷻ সবসময় আমাকে দেখছেন, শুনছেন, এই ভয়ে খারাপ কাজ থেকে দূরে থাকা।[৭][৫] যেমন, একদিন মসজিদে কোনো এক মুসল্লি আপনার নামাজ পড়ার ধরন নিয়ে কিছু বলল। তারপর শুরু হয়ে গেল কে ঠিক, কে ভুল, এনিয়ে তর্ক। একসময় আপনি উত্তেজিত হয়ে বললেন, “আল্লাহর ﷻ কসম, এই মসজিদে যদি আর কোনোদিন এসেছি।” — এরপর থেকে আপনি কোনোদিন আর মসজিদে যান না। মাঝে মধ্যে যাওয়ার কথা মনে হলেও নিজেকে বোঝান যে, শপথ করে ফেলেছেন, সেই শপথ কীভাবে ভাঙ্গা যায়? — এইধরনের শপথ ভুল। এগুলো ভেঙ্গে ফেলে কাফফারা আদায় করতে হবে।[১৭]

আর সবশেষে এসেছে تُصْلِحُوا۟ তুসলিহু, যা এসেছে أَصْلَحَ আসলাহা থেকে, এর অর্থ কোনো ভুল বা খারাপ কিছু  সংশোধন করা, যেটা যেভাবে থাকাটা উচিত সেভাবে রাখা, মানুষের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা।[৭][৫] যেমন, আপনি একদিন আত্মীয়ের সাথে ঝগড়ার সময় বললেন, ‘আল্লাহর ﷻ কসম, আর কোনোদিন যদি তোমাদের বাসায় এসেছি।’ —এরপর থেকে আপনাকে তারা দাওয়াত দিলেও আপনি আর যান না, পাছে আপনার শপথ ভেঙ্গে যায়। ফোন করলে গলার স্বরে কৃত্রিম দুঃখ টেনে বলেন, ‘আর বলবেন না, আমি ওইদিন ঝগড়ার সময় রাগের মাথায় আল্লাহর ﷻ কসম করে বলেছিলাম যে, আর কোনোদিন আপনার বাসায় যাবো না। এখন কসম ভেঙ্গে কীভাবে যাই বলেন? আমার যাওয়ার অনেক ইচ্ছা, কিন্তু…’ — এইসব শপথ অর্থহীন। এগুলো ভেঙ্গে ফেলে কাফফারা আদায় করতে হবে।[১৭]

আল্লাহর ﷻ নামে শপথ করে এই সব ভালো কাজ থেকে দূরে থাকা হচ্ছে আল্লাহ ﷻ নাম নিয়ে তামাশা করার শামিল। কেউ যদি এই ধরনের শপথ করেও থাকে, তার সেই শপথ মানার কোনো বৈধতা নেই। আল্লাহ ﷻ এই আয়াতটি শেষ করেছেন সাবধানবাণী দিয়ে: “আল্লাহ সব শোনেন, সব জানেন।” আল্লাহর ﷻ পবিত্র নাম নিয়ে যে তামশা করবে, তাদেরকে আল্লাহ ﷻ ছেড়ে দেবেন না।

 

তোমাদের অর্থহীন শপথের জন্য আল্লাহ তোমাদেরকে ধরবেন না। কিন্তু যে শপথ তোমরা মনে প্রাণে করেছো, সেগুলোর জন্য তিনি তোমাদেরকে ধরবেন। আল্লাহ ﷻ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, অত্যন্ত ধৈর্যশীল। [আল-বাক্বারাহ ২২৫]

কিছু আরবদের মধ্যে একটা বদভ্যাস আছে, তারা কথায় কথায় ‘ওয়াল্লাহি!’ বলে, যা আমাদের ‘খোদার কসম!’ ধরনের কথাবার্তা। আমরা অনেকেই কথায় কথায় ‘খোদার কসম দোস্ত, আমি কালকেই তোমার বইটা ফেরত দিবো’, ‘আল্লাহর ﷻ কসম, কালকে যদি খেলায় হারি, তাহলে আমার মাথা কামিয়ে ফেলবো’ ইত্যাদি সাধারণ কথাবার্তায় আল্লাহর ﷻ নামের শপথ নেই। এখন এই ধরনের কথা শুনে কেউ যদি বলে, ‘দেখুন, আপনি আল্লাহর ﷻ কসম নিয়েছেন, কিন্তু তারপরে আপনি খেলায় হেরেছেন, সুতরাং আপনি একজন মুনাফিক। আপনাকে ইসলামি আইন অনুসারে চাবকানো হবে, না হয় কাফফারা দিতে হবে … ’ — এধরনের সিরিয়াস হওয়ার দরকার নেই। আল্লাহ ﷻ বলে দিয়েছেন যে, তিনি এই ধরনের ফালতু কথার শপথ নিয়ে আমাদেরকে জবাব দিতে বলবেন না। এই সব শপথ রাখতে না পারলে তার কাফফারা দেওয়ার দরকার নেই। বরং তিনি শুধুমাত্র সেই শপথগুলোর ব্যাপারেই আমাদেরকে জিগ্যেস করবেন, যেগুলো আমরা ঠাণ্ডা মাথায়, চিন্তা ভাবনা করে করেছি। আল্লাহ ﷻ অত্যন্ত ক্ষমাশীল। তাঁর ﷻ পবিত্র নামকে এভাবে ফালতু কথায় ব্যবহার করার পরও তিনি ﷻ মাফ করে দেন। তিনি ﷻ অত্যন্ত ধৈর্যশীল। আমাদের এই সব ছ্যাবলামি তিনি ﷻ ধৈর্যের সাথে দিনের পর দিন সহ্য করেন।

এখন মনে হতে পারে, আল্লাহর ﷻ নামে ছাড়া অন্য কিছুর নামে শপথ নেওয়াটাই বোধহয় ভালো হবে, তাহলে আল্লাহর ﷻ নামের অবমাননা করার ঝুঁকি থাকবে না। যেমন, ‘মায়ের কসম!’, ‘আমার বাচ্চার কসম!’, ‘আমি মাটি ছুঁয়ে বলছি!’ ইত্যাদি। এগুলো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আল্লাহ ﷻ ছাড়া আর অন্য কিছুর শপথ করা নিষিদ্ধ। শুধুমাত্র আল্লাহর ﷻ নামে, বা তার কোনো গুণের উল্লেখ করে শপথ করা যাবে, আর কোনো কিছুর নামে নয়।

তবে সবসময় সত্য কথা বলা এবং সবসময় কথা দিয়ে কথা রাখা ইসলামে বাধ্যতামূলক। এর বিপরীত করলে কবিরা গুনাহ হয়। কু’রআনে আল্লাহ ﷻ কমপক্ষে তিনবার আমাদেরকে কথা দিয়ে কথা রাখতে বলেছেন। তারপরেও কেউ যদি প্রয়োজন মনে করে শপথ করার, তাহলে আল্লাহ ﷻ ছাড়া আর অন্য কারো বা কিছুর শপথ করা যাবে না। একজন সত্যিকারের মুসলিমের নিজে থেকে শপথ করার দরকার হওয়ার কথা না। সে সবসময়ই সত্যি কথা বলে, কথা দিয়ে কথা রাখে। তবে কোনো পরিস্থিতি যদি দাবি করে শপথ করার, বা কোনো কিছুর গুরুত্ব বোঝানোর জন্য কেউ যদি শপথ করে, তাহলে ইসলামের নিয়ম মধ্যে থেকে শপথ করতে হবে। পরিস্থিতির দাবি ছাড়া কথায় কথায় শপথ করা মানুষের অন্তঃসারশূন্যতাই নির্দেশ করে।

– ওমর আল জাবির


[১] বাইয়িনাহ এর কু’রআনের তাফসীর।

[২] ম্যাসেজ অফ দা কু’রআন — মুহাম্মাদ আসাদ।

[৩] তাফহিমুল কু’রআন — মাওলানা মাওদুদি।

[৪] মা’রিফুল কু’রআন — মুফতি শাফি উসমানী।

[৫] মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word Meaning of The Quran

[৬] সৈয়দ কুতব — In the Shade of the Quran

[৭] তাদাব্বুরে কু’রআন – আমিন আহসান ইসলাহি।

[৮] তাফসিরে তাওযীহুল কু’রআন — মুফতি তাক্বি উসমানী।

[৯] বায়ান আল কু’রআন — ড: ইসরার আহমেদ।

[১০] তাফসীর উল কু’রআন — মাওলানা আব্দুল মাজিদ দারিয়াবাদি

[১১] কু’রআন তাফসীর — আব্দুর রাহিম আস-সারানবি

[১২] আত-তাবারি-এর তাফসীরের অনুবাদ।

[১৩] তাফসির ইবন আব্বাস।

[১৪] তাফসির আল কুরতুবি।

[১৫] তাফসির আল জালালাইন।

[১৬] লুঘাতুল কুরআন — গুলাম আহমেদ পারভেজ।

[১৭] তাফসীর আহসানুল বায়ান — ইসলামিক সেন্টার, আল-মাজমাআহ, সউদি আরব

[১৮] কু’রআনুল কারীম – বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর — বাদশাহ ফাহাদ কু’রআন মুদ্রণ কমপ্লেক্স

[৩৬৬] Swearing by the life of Allaah is permissible – islamqa.info. (2016). Islamqa.info. Retrieved 8 May 2016, from https:/islamqa.info/en/122729

[৩৬৭] What is the ruling on one who swore on the Mushaf (Qur’an) when he was not in a state of purity? – islamqa.info. (2016). Islamqa.info. Retrieved 10 May 2016, from https:/islamqa.info/en/203252

মন্তব্য করুন

Back to top button