হযরত মূসা ও হারূণ (আঃ) – ৩
পূর্বের অংশ পড়ুন: হযরত মূসা ও হারূণ (আ:) – ২
পবিত্র ভূমির পরিচিতি :
বিভিন্ন রেওয়ায়াত অনুযায়ী বায়তুল মুক্বাদ্দাস সহ সমগ্র শাম অর্থাৎ সিরিয়া অঞ্চল পবিত্র ভূমির অন্তর্গত। আমাদের রাসূল (ছাঃ) কর্তৃক শাম পবিত্র ভূমি হওয়ার বিষয়ে বর্ণিত হয়েছে।[41] আবহাওয়াগত দিক দিয়ে সিরিয়া প্রাচীন কাল থেকেই শস্য-শ্যামল এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে সমৃদ্ধ এলাকা হিসাবে খ্যাত। জাহেলী যুগে মক্কার ব্যবসায়ীগণ নিয়মিত ভাবে ইয়ামন ও সিরিয়ায় যথাক্রমে শীতকালে ও গ্রীষ্মকালে ব্যবসায়িক সফরে অভ্যস্ত ছিল। বলা চলে যে, এই দু’টি সফরের উপরেই মক্কাবাসীদের জীবিকা নির্ভর করত। সূরা কুরায়েশ-য়ে এ বিষয়ে উল্লেখিত হয়েছে।
আল্লাহ সূরা বনু ইস্রাঈলের ১ম আয়াতে এই এলাকাকে بَارَكْنَا حَوْلَهُ বা ‘বরকতময় এলাকা’ বলে অভিহিত করেছেন। এর বরকত সমূহ ছিল দ্বিবিধ: ধর্মীয় ও পার্থিব। ধর্মীয় দিকে বরকতের কারণ ছিল এই যে, এ অঞ্চলটি হ’ল, ইবরাহীম, ইয়াকূব, দাঊদ, সুলায়মান, ঈসা (আঃ) সহ কয়েক হাযার নবীর জন্মস্থান, বাসস্থান, কর্মস্থল ও মৃত্যুস্থান। মূসা (আঃ)-এর জন্ম মিসরে হ’লেও তাঁর মৃত্যু হয় এখানে এবং তাঁর কবর হ’ল বায়তুল মুক্কাদ্দাসের উপকণ্ঠে। নিকটবর্তী তীহ্ প্রান্তরে মূসা, হারূণ, ইউশা‘ প্রমুখ নবী বহু বৎসর ধরে তাওহীদের প্রচার ও প্রসার ঘটিয়েছেন। তাঁদের প্রচারের ফল অন্ততঃ এটুকু ছিল এবং এখনও আছে যে, আরব উপদ্বীপে কোন নাস্তিক বা কাফির নেই।
অতঃপর পার্থিব বরকত এই যে, সিরিয়া অঞ্চল ছিল চিরকাল উর্বর এলাকা। এখানে রয়েছে অসংখ্য ঝরণা, বহমান নদ-নদী এবং অসংখ্য ফল-ফসলের বাগ-বাগিচা সমূহ। বিভিন্ন সুমিষ্ট ফল উৎপাদনের ক্ষেত্রে এ অঞ্চলটি সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে বলা যায় অতুলনীয়। একটি হাদীছে এসেছে, দাজ্জাল সমগ্র পৃথিবীতে বিচরণ করবে কিন্তু চারটি মসজিদে পৌঁছতে পারবে না; বায়তুল্লাহ, মসজিদে নববী, বায়তুল মুক্বাদ্দাস ও মসজিদে তূর’।[42]
মূসা (আঃ)-এর আগমনকালে বায়তুল মুক্বাদ্দাস সহ সমগ্র শাম এলাকা আমালেক্বা সম্প্রদায়ের অধীনস্থ ছিল। তারা ছিল কওমে ‘আদ-এর একটি শাখা গোত্র। দৈহিক দিক দিয়ে তারা ছিল অত্যন্ত সুঠাম, বলিষ্ঠ ও ভয়াবহ আকৃতি বিশিষ্ট। তাদের সাথে যুদ্ধ করে বায়তুল মুক্বাদ্দাস অধিকার করার নির্দেশ মূসা (আঃ) ও তাঁর সম্প্রদায়কে আল্লাহ দিয়েছিলেন। হযরত ইয়াকূব (আঃ)-এর মিসরে হিজরতের পর কেন‘আন সহ শাম এলাকা আমালেক্বাদের অধীনস্থ হয়। আয়াতে বর্ণিত ‘রাজ্যাধিপতি বানিয়েছেন’ বাক্যটি ভবিষ্যদ্বাণী হ’তে পারে, যার সম্পর্কে মূসা (আঃ) আল্লাহর নিকট থেকে নিশ্চিত ওয়াদা পেয়েছিলেন। তবে শর্ত ছিল যে, তারা জিহাদ করে কেন‘আন দখল করবে। অর্থাৎ আল্লাহর উপরে ভরসা করে জিহাদে অগ্রসর হ’লে তারা অবশ্যই জয়লাভ করবে। যেভাবে ফেরাঊনের বিরুদ্ধে তারা অলৌকিক বিজয় অর্জন করেছিল মাত্র কিছুদিন পূর্বে।
অতঃপর ‘তাদেরকে এমন সব বস্ত্ত দেওয়া হয়েছে, যা বিশ্বের কাউকে দেওয়া হয়নি’ বলতে তাদের দেওয়া ধর্মীয় নেতৃত্ব ও সামাজিক নেতৃত্ব উভয়কে বুঝানো হয়েছে, যা একত্রে কাউকে ইতিপূর্বে দেওয়া হয়নি। এটাও ভবিষ্যদ্বাণী হ’তে পারে, যা তাদের বংশের পরবর্তী নবী দাঊদ ও সুলায়মানের সময়ে পূর্ণতা লাভ করেছিল। তাদের সময়েও এটা সম্ভব ছিল, যদি নাকি তারা নবী মূসা (আঃ)-এর নেতৃত্বে জিহাদে বেরিয়ে পড়ত। কিন্তু হতভাগারা তা পারেনি বলেই বঞ্চিত হয়েছিল।
নবুঅত-পরবর্তী ৪র্থ পরীক্ষা : বায়তুল মুক্বাদ্দাস অভিযান
আল্লাহ পাক মূসা (আঃ)-এর মাধ্যমে বনু ইস্রাঈলকে আমালেক্বা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে জিহাদ করে শাম দখল করতে বলেছিলেন। সাথে সাথে এ সুসংবাদও দিয়েছিলেন যে, শামের ভূখন্ড তাদের ভাগ্যে লেখা হয়ে গেছে (মায়েদাহ ৫/২১)। কাজেই তোমাদের বিজয় সুনিশ্চিত। কিন্তু এইসব বিলাসী কাপুরুষেরা আল্লাহর কথায় দৃঢ় বিশ্বাস আনতে পারেনি।
মূসা (আঃ) আল্লাহর নির্দেশ পালনের জন্য বনী ইস্রাঈলকে সাথে নিয়ে মিসর থেকে শাম অভিমুখে রওয়ানা হ’লেন। যথা সময়ে তাঁরা জর্দান নদী পার হয়ে ‘আরীহা’ (أريحة) পৌঁছে শিবির স্থাপন করলেন। এটি ছিল পৃথিবীর প্রাচীনতম মহানগরী সমূহের অন্যতম, যা জর্দান নদী ও বায়তুল মুক্বাদ্দাসের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। যা আজও স্বনামে বিদ্যমান রয়েছে। মূসা (আঃ)-এর সময়ে এ শহরের অত্যাশ্চর্য জাঁক-জমক ও বিস্তৃতি ইতিহাসে বর্ণিত হয়েছে।
শিবির স্থাপনের পর মূসা (আঃ) বিপক্ষ দলের অবস্থা ও অবস্থান পর্যবেক্ষণের জন্য ১২ জন সর্দারকে প্রেরণ করলেন। যারা ছিলেন হযরত ইয়াকূব (আঃ)-এর বারো পুত্রের বংশধরগণের ‘বারোজন প্রতিনিধি, যাদেরকে তিনি আগেই নির্বাচন করেছিলেন স্ব স্ব গোত্রের লোকদের দেখাশুনার জন্য’ (মায়েদাহ ৫/১২)। তারা রওয়ানা হবার পর বায়তুল মুক্বাদ্দাস শহরের উপকণ্ঠে পৌঁছলে বিপক্ষ দলের বিশালদেহী বিকট চেহারার একজন লোকের সঙ্গে সাক্ষাত হয়। ইস্রাঈলী রেওয়ায়াত সমূহে লোকটির নাম ‘আউজ ইবনে ওনুক’ (عوج بن عنق) বলা হয়েছে এবং তার আকার-আকৃতি ও শক্তি-সাহসের অতিরঞ্জিত বর্ণনা সমূহ উদ্ধৃত হয়েছে (ইবনু কাছীর)। যাই হোক উক্ত ব্যক্তি একাই বনু ইস্রাঈলের এই বার জন সরদারকে পাকড়াও করে তাদের বাদশাহর কাছে নিয়ে গেল এবং অভিযোগ করল যে, এই লোকগুলি আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মতলব নিয়ে এসেছে। বাদশাহ তার নিকটতম লোকদের সাথে পরামর্শের পর এদের ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত নেন এই উদ্দেশ্যে যে, এরা গিয়ে তাদের নেতাকে আমালেক্বাদের জাঁক-জমক ও শৌর্য-বীর্যের স্বচক্ষে দেখা কাহিনী বর্ণনা করবে। তাতে ওরা ভয়ে এমনিতেই পিছিয়ে যাবে। পরবর্তীতে দেখা গেল যে, বাদশাহর ধারণাই সত্যে পরিণত হয়েছিল। এই ভীত-কাপুরুষ সর্দাররা জিহাদ দূরে থাক, ওদিকে তাকানোর হিম্মতও হারিয়ে ফেলেছিল।
বনু ইস্রাঈলের বারো জন সর্দার আমালেক্বাদের হাত থেকে মুক্ত হয়ে স্বজাতির কাছে ফিরে এল এবং আমালেক্বাদের বিস্ময়কর উন্নতি ও অবিশ্বাস্য শক্তি-সামর্থ্যের কথা মূসা (আঃ)-এর নিকটে বর্ণনা করল। কিন্তু মূসা (আঃ) এতে মোটেই ভীত হননি। কারণ তিনি আগেই অহী প্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং বিজয় সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন। সেমতে তিনি গোত্রনেতাদের যুদ্ধ প্রস্ত্ততি গ্রহণের নির্দেশ দিলেন এবং আমালেক্বাদের শৌর্য-বীর্যের কথা অন্যের কাছে প্রকাশ করতে নিষেধ করলেন। কিন্তু দেখা গেল যে, ইউশা‘ বিন নূন ও কালেব বিন ইউক্বেন্না ব্যতীত বাকী সর্দাররা গোপনে সব ফাঁস করে দিল (কুরতুবী, ইবনু কাছীর)। ফলে যা হবার তাই হ’ল। এই ভীতু আরামপ্রিয় জাতি একেবারে বেঁকে বসলো।
قَالُوا يَا مُوسَى إِنَّ فِيهَا قَوْماً جَبَّارِيْنَ وَإِنَّا لَنْ نَدْخُلَهَا حَتَّى يَخْرُجُوا مِنْهَا فَإِن يَّخْرُجُوا مِنْهَا فَإِنَّا دَاخِلُونَ- (المائدة ২২)-
‘তারা বলল, হে মূসা! সেখানে একটি প্রবল পরাক্রান্ত জাতি রয়েছে। আমরা কখনো সেখানে যাব না, যে পর্যন্ত না তারা সেখান থেকে বের হয়ে যায়। যদি তারা সেখান থেকে বের হয়ে যায়, তবে নিশ্চিতই আমরা সেখানে প্রবেশ করব’ (মায়েদাহ ৫/২২)। অর্থাৎ ওরা চায় যে, মূসা (আঃ) তার মু‘জেযার মাধ্যমে যেভাবে ফেরাঊনকে ডুবিয়ে মেরে আমাদের উদ্ধার করে এনেছেন, অনুরূপভাবে আমালেক্বাদের তাড়িয়ে দিয়ে তাদের পরিত্যক্ত অট্টালিকা ও সম্পদরাজির উপরে আমাদের মালিক বানিয়ে দিন। অথচ আল্লাহর বিধান এই যে, বান্দাকে চেষ্টা করতে হবে এবং আল্লাহর উপর ভরসা করতে হবে। কিন্তু বনু ইস্রাঈলরা এক পাও বাড়াতে রাযী হয়নি। এমতাবস্থায়
قَالَ رَجُلاَنِ مِنَ الَّذِيْنَ يَخَافُوْنَ أَنْعَمَ اللهُ عَلَيْهِمَا ادْخُلُوْا عَلَيْهِمُ الْبَابَ فَإِذَا دَخَلْتُمُوْهُ فَإِنَّكُمْ غَالِبُوْنَ وَعَلَى اللهِ فَتَوَكَّلُوْا إِنْ كُنْتُم مُّؤْمِنِيْنَ- (المائدة ২৩)-
‘তাদের মধ্যকার দু’জন আল্লাহভীরু ব্যক্তি (সম্ভবতঃ পূর্বের দু’জন সর্দার হবেন, যাদের মধ্যে ইউশা‘ পরে নবী হয়েছিলেন), যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছিলেন, তারা বলল, (মূসা (আঃ)-এর আদেশ মতে) ‘তোমরা ওদের উপর আক্রমণ করে (শহরের মূল) দরজায় প্রবেশ কর। (কেননা আমাদের নিশ্চিত বিশ্বাস যে,) যখনই তোমরা তাতে প্রবেশ করবে, তখনই তোমরা অবশ্যই জয়ী হবে। আর তোমরা আল্লাহর উপরে ভরসা কর, যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাক’ (মায়েদাহ ৫/২৩)।
কিন্তু ঐ দুই নেককার সর্দারের কথার প্রতি তারা দৃকপাত করল না। বরং আরও উত্তেজিত হয়ে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে মূসা (আঃ)-কে উদ্দেশ্য করে বলল,يَا مُوسَى إِنَّا لَنْ نَدْخُلَهَا أَبَداً مَا دَامُوْا فِيهَا، فَاذْهَبْ أَنتَ وَرَبُّكَ فَقَاتِلا، إِنَّا هَاهُنَا قَاعِدُوْنَ- (المائدة ২৪)- ‘হে মূসা! আমরা কখনোই সেখানে প্রবেশ করব না, যতক্ষণ তারা সেখানে আছে। অতএব তুমি ও তোমার পালনকর্তা যাও এবং যুদ্ধ কর গে। আমরা এখানেই বসে রইলাম’ (মায়েদাহ ৫/২৪)। নবীর অবাধ্যতার ফলস্বরূপ এই জাতিকে ৪০ বছর তীহ্ প্রান্তরের উন্মুক্ত কারাগারে বন্দী থাকতে হয় (মায়েদাহ ৫/২৬)। অতঃপর এইসব দুষ্টমতি নেতাদের মৃত্যুর পর পরবর্তী বংশধররা হযরত ইউশা‘ বিন নূন (আঃ)-এর নেতৃত্বে জিহাদ করে বায়তুল মুক্বাদ্দাস পুনর্দখল করে (কুরতুবী, ইবনু কাছীর)।
বনু ইস্রাঈলের এই চূড়ান্ত বেআদবী ছিল কুফরীর নামান্তর এবং অত্যন্ত পীড়াদায়ক। যা পরবর্তীতে প্রবাদবাক্যে পরিণত হয়ে গেছে। বদরের যুদ্ধের সময়ে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) কিছুটা অনুরূপ অবস্থায় পতিত হয়েছিলেন। অপর্যাপ্ত ব্যবস্থাপনা ও ক্ষুৎ-পিপাসায় কাতর অল্প সংখ্যক সবেমাত্র মুহাজির মুসলমানের মোকাবেলায় তিনগুণ শক্তিসম্পন্ন সুসজ্জিত বিরাট কুরায়েশ সেনাবাহিনীর আগমনে হতচকিত ও অপ্রস্ত্তত মুসলমানদের বিজয়ের জন্য যখন নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) আল্লাহর নিকটে সাহায্য প্রার্থনা করছিলেন, তখন মিক্বদাদ ইবনুল আসওয়াদ আনছারী (রাঃ) দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে বলেছিলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কস্মিনকালেও ঐকথা বলব না, যা মূসা (আঃ)-এর স্বজাতি তাঁকে বলেছিল, فَاذْهَبْ أَنْتَ وَرَبُّكَ فَقَاتِلاَ إِنَّا هَاهُنَا قَاعِدُوْنَ- ‘তুমি ও তোমার প্রভু যাও যুদ্ধ করগে। আমরা এখানে বসে রইলাম’ (মায়েদাহ ৫/২৪)। বরং আমরা আপনার ডাইনে, বামে, সামনে ও পিছনে থেকে শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করব। আপনি নিশ্চিন্তে যুদ্ধের প্রস্ত্ততি গ্রহণ করুন’। বিপদ মুহূর্তে সাথীদের এরূপ বীরত্বব্যঞ্জক কথায় আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) অত্যন্ত প্রীত হয়েছিলেন।[43]
ইউসুফ হ’তে মূসা পর্যন্ত দীর্ঘ চার/পাঁচশ’ বছর মিসরে অবস্থানের পর এবং নিজেদের বিরাট জনসংখ্যা ছাড়াও ফেরাঊনীদের বহু সংখ্যক লোক গোপনে অনুসারী হওয়া সত্ত্বেও এবং মূসা (আঃ)-এর মত শক্তিশালী একজন নবীকে পাওয়া সত্ত্বেও বনু ইস্রাঈলকে কেন রাতের অন্ধকারে মিসর থেকে পালিয়ে আসতে হ’ল? অতঃপর পৃথিবীর কোথাও তারা আর স্থায়ীভাবে একত্রে বসবাস করতে পারেনি, তার একমাত্র কারণ ছিল ‘জিহাদ বিমুখতা’। এই বিলাসী, ভীরু ও কাপুরুষের দল ‘ফেরাঊন ও তার দলবলের ভয়ে এতই ভীত ছিল যে, তাদের নিষ্ঠুরতম নির্যাতনের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করত না। বরং মূসা (আঃ)-এর কাছে পাল্টা অভিযোগ তুলতো যে, তোমার কারণেই আমরা বিপদে পড়ে গেছি’। যেমন সূরা আ‘রাফ ১২৯ আয়াতে এ বিষয়ে স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। ‘অথচ ঐ সময় মিসরে মুসলমানের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ১০ থেকে ২০ শতাংশ ছিল’।[44]
মিসর থেকে বেরিয়ে বায়তুল মুক্বাদ্দাস নগরী দখলের জন্যও তাদেরকে যখন জিহাদের হুকুম দেওয়া হ’ল, তখনও তারা একইভাবে পিছুটান দিল। যার পরিণতি তারা সেদিনের ন্যায় আজও ভোগ করছে। বস্ত্ততঃ বিলাসী জাতি ভীরু হয় এবং জিহাদ বিমুখ জাতি কখনোই কোথাও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না।
মূসা (আঃ)-এর জীবনের এই শেষ পরীক্ষায় দৃশ্যত: তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন বলে অনুমিত হ’লেও প্রকৃত অর্থে তিনি ব্যর্থ হননি। বরং তিনি সকল যুগের ঈমানদারগণকে জানিয়ে গেছেন যে, কেবল মু‘জেযা বা কারামত দিয়ে দ্বীন বিজয়ী হয় না। তার জন্য প্রয়োজন আল্লাহর উপরে দৃঢ় বিশ্বাসী একদল মুমিনের সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা। আর এটাই হ’ল জিহাদ। ৪০ বছর পর যখন তারা পুনরায় জিহাদে নামল, তখনই তারা বিজয়ী হ’ল। যুগে যুগে এটাই সত্য হয়েছে।
ফিলিস্তীন দখলকারী ‘জাববারীন’ তথা আমালেক্বা সম্প্রদায়ের শক্তিশালী নেতারা মূসা (আঃ) প্রেরিত ১২ জন প্রতিনিধিকে ফেরৎ পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেনি। কারণ তারা মূসা (আঃ)-এর মু‘জেযার কারণে ফেরাঊনের সসৈন্যে সাগরডুবির খবর আগেই জেনেছিল। অতএব মূসা (আঃ)-এর বায়তুল মুক্বাদ্দাস অভিযান বন্ধ করার জন্য তারা বাঁকা পথ তালাশ করল। তারা অত্যন্ত গোপনে বনু ইস্রাঈলের ঐ সময়কার একজন নামকরা সাধক ও দরবেশ আলেম বাল‘আম ইবনে বা‘ঊরার (بلعم بن باعوراء) কাছে বহু মূল্যবান উপঢৌকনাদিসহ লোক পাঠাল। বাল‘আম তার স্ত্রীর অনুরোধে তা গ্রহণ করল। অতঃপর তার নিকটে আসল কথা পাড়া হ’ল যে, কিভাবে আমরা মূসার অভিযান ঠেকাতে পারি। আপনি পথ বাৎলে দিলে আমরা আরও মহামূল্যবান উপঢৌকনাদি আপনাকে প্রদান করব। বাল‘আম উঁচুদরের আলেম ছিল। যে সম্পর্কে তার নাম না নিয়েই আল্লাহ বলেন,
وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ الَّذِي آتَيْنَاهُ آيَاتِنَا فَانسَلَخَ مِنْهَا فَأَتْبَعَهُ الشَّيْطَانُ فَكَانَ مِنَ الْغَاوِيْنَ- (الأعراف ১৭৫)-
‘আপনি তাদেরকে শুনিয়ে দিন সেই লোকটির অবস্থা, যাকে আমরা আমাদের নিদর্শন সমূহ দান করেছিলাম। অথচ সে তা পরিত্যাগ করে বেরিয়ে গেল। আর তার পিছনে লাগল শয়তান। ফলে সে পথভ্রষ্টদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল’ (আ‘রাফ ৭/১৭৫)।
কথিত আছে যে, বাল‘আম ‘ইসমে আযম’ জানত। সে যা দো‘আ করত, তা সাথে সাথে কবুল হয়ে যেত। আমালেক্বাদের অনুরোধ ও পীড়াপীড়িতে সে অবশেষে মূসার বিরুদ্ধে দো‘আ করল। কিন্তু তার জিহবা দিয়ে উল্টা দো‘আ বের হ’তে লাগল যা আমালেক্বাদের বিরুদ্ধে যেতে লাগল। তখন সে দো‘আ বন্ধ করল। কিন্তু অন্য এক পৈশাচিক রাস্তা সে তাদের বাৎলে দিল। সে বলল, বনু ইস্রাঈলগণের মধ্যে ব্যভিচার ছড়িয়ে দিতে পারলে আল্লাহ তাদের উপরে নারায হবেন এবং তাতে মূসার অভিযান বন্ধ হয়ে যাবে’। আমালেক্বারা তার পরামর্শ গ্রহণ করল এবং তাদের সুন্দরী মেয়েদেরকে বনু ইস্রাঈলের নেতাদের সেবাদাসী হিসাবে অতি গোপনে পাঠিয়ে দিল। বড় একজন নেতা এফাঁদে পা দিল। আস্তে আস্তে তা অন্যদের মধ্যেও সংক্রমিত হ’ল। ফলে আল্লাহর গযব নেমে এল। বনু ইস্রাঈলীদের মধ্যে প্লেগ মহামারী দেখা দিল। কথিত আছে যে, একদিনেই সত্তর হাযার লোক মারা গেল। এ ঘটনায় বাকী সবাই তওবা করল এবং প্রথম পথভ্রষ্ট নেতাকে প্রকাশ্যে হত্যা করে রাস্তার উপরে ঝুলিয়ে রাখা হ’ল। অতঃপর আল্লাহর গযব উঠে গেল। এগুলি ইস্রাঈলী বর্ণনা।=(কুরতুবী ও ইবনু কাছীর উভয়ে এ ঘটনা বর্ণনা করেছেন উক্ত আয়াতের শানে নুযূল হিসাবে। আয়াতের মর্মে বুঝা যায় যে, ঘটনার কিছু সারবত্তা রয়েছে। যদিও সত্য বা মিথ্যা আল্লাহই ভালো জানেন। – লেখক)।
সম্ভবতঃ সম্প্রদায়ের নেতাদের ক্রমাগত অবাধ্যতা, শঠতা ও পাপাচারে অতিষ্ঠ হ’য়ে এবং একসাথে এই বিরাট জনশক্তি বিনষ্ট হওয়ায় মূসা (আঃ) বায়তুল মুক্বাদ্দাস অভিযানের সংকল্প পরিত্যাগ করেন।
তীহ্ প্রান্তরে ৪০ বছরের বন্দীত্ব বরণ :
মূসা (আঃ)-এর প্রতি অবাধ্যতা ও জিহাদ থেকে বিমুখ হওয়ার শাস্তি স্বরূপ বনু ইস্রাঈলগণকে মিসর ও শাম-এর মধ্যবর্তী একটি উন্মুক্ত প্রান্তরে দীর্ঘ ৪০ বছরের জন্য বন্দী করা হয়। তাদের অবাধ্যতায় বিরক্ত ও হতাশ হয়ে নবী মূসা (আঃ) আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করেন,
قَالَ رَبِّ إِنِّي لا أَمْلِكُ إِلاَّ نَفْسِي وَأَخِيْ فَافْرُقْ بَيْنَنَا وَبَيْنَ الْقَوْمِ الْفَاسِقِيْنَ- (المائدة ২৫)-
‘হে আমার পালনকর্তা! আমি কোন ক্ষমতা রাখি না কেবল আমার নিজের উপর ও আমার ভাইয়ের উপর ব্যতীত। অতএব আপনি আমাদের ও পাপাচারী কওমের মধ্যে ফায়ছালা করে দিন’ (মায়েদাহ ৫/২৫)। জবাবে আল্লাহ বলেন,
قَالَ فَإِنَّهَا مُحَرَّمَةٌ عَلَيْهِمْ أَرْبَعِيْنَ سَنَةً يَّتِيْهُوْنَ فِي الأَرْضِ فَلاَ تَأْسَ عَلَى الْقَوْمِ الْفَاسِقِيْنَ- (المائدة ২৬)-
‘এদেশটি (বায়তুল মুক্বাদ্দাস সহ শামদেশ) চল্লিশ বছর পর্যন্ত তাদের জন্য নিষিদ্ধ করা হ’ল। এ সময় তারা ভূপৃষ্ঠে উদ্ভ্রান্ত হয়ে ফিরবে। অতএব তুমি অবাধ্য কওমের জন্য দুঃখ করো না’ (মায়েদাহ ৫/২৬)। تَاهَ يَتِيْهُ تِيْهًا অর্থ গর্ব করা, পথ হারিয়ে ঘোরা ইত্যাদি। এখান থেকেই উক্ত প্রান্তরের নাম হয়েছে ‘তীহ্’ (تِيْه)। বস্ত্ততঃ এই উন্মুক্ত কারাগারে না ছিল কোন প্রাচীর, না ছিল কোন কারারক্ষী। তারা প্রতিদিন সকালে উঠে মিসর অভিমুখে রওয়ানা হ’ত। আর সারাদিন চলার পর রাতে আবার সেখানে এসেই উপস্থিত হ’ত, যেখান থেকে সকালে তারা রওয়ানা হয়েছিল। কিন্তু কোনভাবেই তারা অদৃশ্য কারা প্রাচীর ভেদ করে যেতে পারত না। এভাবে চল্লিশ বছর পর্যন্ত হতবুদ্ধি অবস্থায় দিগ্বিদিক ঘুরে এই হঠকারী অবাধ্য জাতি তাদের দুনিয়াবী শাস্তি ভোগ করতে থাকে। যেমন ইতিপূর্বে নূহ (আঃ)-এর অবাধ্য কওম দুনিয়াবী শাস্তি হিসাবে প্লাবণে ডুবে নিশ্চিহ্ন হয়েছিল। বস্ত্ততঃ চল্লিশ বছরের দীর্ঘ সময়ের মধ্যে হারূণ ও মূসা (আঃ)-এর তিন বছরের বিরতিতে মৃত্যু হয়। অতঃপর শাস্তির মেয়াদ শেষে পরবর্তী নবী ইউশা‘ বিন নূন-এর নেতৃত্বে জিহাদের মাধ্যমে তারা বায়তুল মুক্কাদ্দাস জয়ে সমর্থ হয় এবং সেখানে প্রবেশ করে। বর্ণিত হয়েছে যে, ১২ জন নেতার মধ্যে ১০ জন অবাধ্য ও ভীরু নেতা এরি মধ্যে মারা যায় এবং মূসার অনুগত ইউশা‘ ও কালেব দুই নেতাই কেবল বেঁচে থাকেন, যাদের হাতে বায়তুল মুক্বাদ্দাস বিজিত হয় (কুরতুবী, ইবনু কাছীর, তাফসীর মায়েদাহ ২৬)।
নবীর সঙ্গে যে বেআদবী তারা করেছিল, তাতে আল্লাহর গযবে তাদের ধ্বংস হয়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু আল্লাহ পাক হয়ত এ জাতিকে আরও পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন এবং আল্লাহর অপার অনুগ্রহপুষ্ট একটি জাতি নিজেদের অবাধ্যতা ও হঠকারিতার ফলে কিভাবে আল্লাহর অভিসম্পাৎগ্রস্ত হয় এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত চিরস্থায়ী লাঞ্ছনার শিকার হয়, পৃথিবীর মানুষের নিকটে দৃষ্টান্ত হিসাবে তা পেশ করতে চেয়েছিলেন। ঠিক যেভাবে দৃষ্টান্ত হয়েছে ফেরাঊন একজন অবাধ্য ও অহংকারী নরপতি হিসাবে। আর তাই বনু ইস্রাঈলের পরীক্ষার মেয়াদ আরও বর্ধিত হ’ল। নিম্নে তাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহের কিছু নিদর্শন বর্ণিত হ’ল।-
১. মেঘ দ্বারা ছায়া প্রদান :
ছায়াশূন্য তপ্ত বালুকা বিস্তৃত মরুভূমিতে কাঠফাটা রোদে সবচেয়ে প্রয়োজন যেসব বস্ত্তর, তন্মধ্যে ‘ছায়া’ হ’ল সর্বপ্রধান। হঠকারী উম্মতের অবাধ্যতায় ত্যক্ত-বিরক্ত মূসা (আঃ) দয়াপরবশ হয়ে আল্লাহর নিকটে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রার্থনা নিবেদন করেছেন। দয়ালু আল্লাহ তাঁর দো‘আ সমূহ কবুল করেছেন এবং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে তাঁর বিশেষ রহমত সমূহ নাযিল করেছেন। তন্মধ্যে একটি হ’ল উন্মুক্ত তীহ্ প্রান্তরের উপরে শামিয়ানা সদৃশ মেঘমালার মাধ্যমে শান্তিদায়ক ছায়া প্রদান করা। যেমন আল্লাহ এই অকৃতজ্ঞ জাতিকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, وَظَلَّلْنَا عَلَيْكُمُ الْغَمَامَ ‘স্মরণ কর সে কথা, যখন আমরা তোমাদেরকে ছায়া দান করেছিলাম মেঘমালার মাধ্যমে’ (বাক্বারাহ ২/৫৭)।
২. ঝর্ণাধারার প্রবাহ :
ছায়ার পরেই গুরুত্বপূর্ণ বস্ত্ত হ’ল পানি। যার অপর নাম জীবন। পানি বিহনে তৃষ্ণার্ত পিপাসার্ত উম্মতের আহাজারিতে দয়া বিগলিত নবী মূসা স্বীয় প্রভুর নিকটে কাতর কণ্ঠে পানি প্রার্থনা করলেন। কুরআনের ভাষায়,
وَإِذِ اسْتَسْقَى مُوْسَى لِقَوْمِهِ فَقُلْنَا اضْرِبْ بِعَصَاكَ الْحَجَرَ فَانْفَجَرَتْ مِنْهُ اثْنَتَا عَشْرَةَ عَيْناً قَدْ عَلِمَ كُلُّ أُنَاسٍ مَّشْرَبَهُمْ كُلُوْا وَاشْرَبُوْا مِن رِّزْقِ اللهِ وَلاَ تَعْثَوْا فِي الأَرْضِ مُفْسِدِيْنَ- (البقرة ৬০)-
‘আর মূসা যখন স্বীয় জাতির জন্য পানি চাইল, তখন আমি বললাম, তোমার লাঠি দিয়ে পাথরের উপরে আঘাত কর। অতঃপর তা থেকে বেরিয়ে এলো (১২টি গোত্রের জন্য) ১২টি ঝর্ণাধারা। তাদের সব গোত্রই চিনে নিল (অর্থাৎ মূসার নির্দেশ অনুযায়ী নির্ধারণ করে নিল) নিজ নিজ ঘাট। (আমি বললাম,) তোমরা আল্লাহর দেওয়া রিযিক খাও আর পান কর। খবরদার যমীনে ফাসাদ সৃষ্টি করে বেড়িয়ো না’ (বাক্বারাহ ২/৬০)।
বস্ত্ততঃ ইহুদী জাতি তখন থেকে এযাবত পৃথিবী ব্যাপী ফাসাদ সৃষ্টি করেই চলেছে। তারা কখনোই আল্লাহর কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেনি।
৩. মান্না ও সালওয়া খাদ্য পরিবেশন :
মরুভূমির বুকে চাষবাসের সুযোগ নেই। নেই শস্য উৎপাদন ও বাইরে গিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ। কয়েকদিনের মধ্যেই মওজুদ খাদ্য শেষ হয়ে গেলে হাহাকার পড়ে গেল তাদের মধ্যে। নবী মূসা (আঃ) ফের দো‘আ করলেন আল্লাহর কাছে। এবার তাদের জন্য আসমান থেকে নেমে এলো জান্নাতী খাদ্য ‘মান্না ও সালওয়া’- যা পৃথিবীর আর কোন নবীর উম্মতের ভাগ্যে জুটেছে বলে জানা যায় না।
‘মান্না’ এক প্রকার খাদ্য, যা আল্লাহ তা‘আলা বনু ইস্রাঈলদের জন্য আসমান থেকে অবতীর্ণ করতেন। আর তা ছিল দুধের চেয়েও সাদা এবং মধুর চেয়েও মিষ্টি। আর ‘সালওয়া’ হচ্ছে আসমান থেকে আগত এক প্রকার পাখি।[45] প্রথমটি দিয়ে রুটি ও দ্বিতীয়টি দিয়ে গোশতের অভাব মিটত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, الْكَمْأَةُ مِنَ الْمَنِّ ‘কামআহ হ’ল মান্ন-এর অন্তর্ভুক্ত’।[46] এতে বুঝা যায় ‘মান্ন’ কয়েক প্রকারের ছিল। ইংরেজীতে ‘কামআহ’ অর্থ করা হয়েছে ‘মাশরূম’ (Mashroom)। আধুনিক গবেষণায় বলা হয়েছে যে, মান্ন একপ্রকার আঠা জাতীয় উপাদেয় খাদ্য। যা শুকিয়ে পিষে রুটি তৈরী করে তৃপ্তির সাথে আহার করা যায়। ‘সালওয়া’ একপ্রকার চড়ুই পাখি, যা ঐসময় সিনাই এলাকায় প্রচুর পাওয়া যেত। ব্যাঙের ছাতার মত সহজলভ্য ও কাই জাতীয় হওয়ায় সম্ভবত একে মাশরূম-এর সাথে তুলনীয় মনে করা হয়েছে। তবে মাশরূম ও ব্যাঙের ছাতা সম্পূর্ণ পৃথক জিনিস। কয়েক লাখ বনু ইস্রাঈল কয়েক বছর ধরে মান্না ও সালওয়া খেয়ে বেঁচে ছিল। এতে বুঝা যায় যে, মান্ন ছিল চাউল বা গমের মত কার্বো-হাইড্রেট-এর উৎস এবং সালওয়া বা চড়ুই জাতীয় পাখির গোশত ছিল ভিটামিন ও চর্বির উৎস। সব মিলে তারা পরিপূর্ণ খাবার নিয়মিত খেয়ে বেঁচে থাকতে সক্ষম হয়েছিল। দক্ষিণ ইউরোপের সিসিলিতে, আরব উপদ্বীপের ইরাকে ও ইরানে, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতবর্ষে মান্না জাতীয় খাদ্য উৎপন্ন হয়।[47] অবাধ্য বনু ইস্রাঈলরা এগুলো সিরিয়ার তীহ্ প্রান্তরে ৪০ বছরের বন্দী জীবনে বিপুলভাবে পেয়েছিল আল্লাহর বিশেষ রহমতে। ঈসার সাথী হাওয়ারীগণ এটা চেয়েছিল (মায়েদাহ ৫/১১২-১১৫)। কিন্তু পেয়েছিল কি-না, তা নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি।
দুনিয়ায় বসেই জান্নাতের খাবার, এ এক অকল্পনীয় অনির্বচনীয় আনন্দের বিষয়। কিন্তু এই হতভাগারা তাতেও খুব বেশীদিন খুশী থাকতে পারেনি। তারা গম, তরকারি, ডাল-পেঁয়াজ ইত্যাদি খাওয়ার জন্য পাগল হয়ে উঠলো। যেমন আল্লাহ বলেন,
… وَأَنْزَلْنَا عَلَيْكُمُ الْمَنَّ وَالسَّلْوَى كُلُوْا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ وَمَا ظَلَمُوْنَا وَلَـكِنْ كَانُوْا أَنْفُسَهُمْ يَظْلِمُوْنَ- (البقرة ৫৭)-
‘… আমরা তোমাদের জন্য খাবার পাঠিয়েছি ‘মান্না’ ও ‘সালওয়া’। (আমরা বললাম) এসব পবিত্র বস্ত্ত তোমরা ভক্ষণ কর (কিন্তু ওরা শুনল না, কিছু দিনের মধ্যেই তা বাদ দেওয়ার জন্য ও অন্যান্য নিম্নমানের খাদ্য খাবার জন্য যিদ ধরলো)। বস্ত্ততঃ (এর ফলে) তারা আমার কোন ক্ষতি করতে পারেনি, বরং নিজেদেরই ক্ষতি সাধন করেছে’ (বাক্বারাহ ২/৫৭)।
আল্লাহ তাদের উদ্দেশ্যে বলেন,
وَإِذْ قُلْتُمْ يَا مُوْسَى لَن نَّصْبِرَ عَلَىَ طَعَامٍ وَاحِدٍ فَادْعُ لَنَا رَبَّكَ يُخْرِجْ لَنَا مِمَّا تُنْبِتُ الأَرْضُ مِنْ بَقْلِهَا وَقِثَّآئِهَا وَفُوْمِهَا وَعَدَسِهَا وَبَصَلِهَا قَالَ أَتَسْتَبْدِلُوْنَ الَّذِيْ هُوَ أَدْنَى بِالَّذِيْ هُوَ خَيْرٌ؟ إِهْبِطُوْا مِصْراً فَإِنَّ لَكُمْ مَّا سَأَلْتُمْ وَضُرِبَتْ عَلَيْهِمُ الذِّلَّةُ وَالْمَسْكَنَةُ وَبَآؤُوْا بِغَضَبٍ مِّنَ اللهِ، ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ كَانُوْا يَكْفُرُوْنَ بِآيَاتِ اللهِ وَيَقْتُلُوْنَ النَّبِيِّيْنَ بِغَيْرِ الْحَقِّ ذَلِكَ بِمَا عَصَوْا وَكَانُوْا يَعْتَدُوْنَ- (البقرة ৬১)-
‘যখন তোমরা বললে, হে মূসা! আমরা একই ধরনের খাদ্যের উপরে কখনোই ধৈর্য ধারণ করতে পারব না। কাজেই তুমি তোমার প্রভুর নিকটে আমাদের পক্ষে প্রার্থনা কর তিনি যেন আমাদের জন্য এমন খাদ্য-শস্য দান করেন, যা জমিতে উৎপন্ন হয়; যেমন তরি-তরকারি, কাকুড়, গম, রসুন, ডাল, পেঁয়াজ ইত্যাদি। মূসা বললেন, তোমরা উত্তম খাদ্যের বদলে এমন খাদ্য পেতে চাও যা নিম্নস্তরের? তাহ’লে তোমরা অন্য কোন শহরে চলে যাও। সেখানে তোমরা তোমাদের চাহিদা মোতাবেক সবকিছু পাবে’ (বাক্বারাহ ২/৬১)।
৪. পার্শ্ববর্তী জনপদে যাওয়ার হুকুম ও আল্লাহর অবাধ্যতা :
বনু ইস্রাঈলগণ যখন জান্নাতী খাদ্য বাদ দিয়ে দুনিয়াবী খাদ্য খাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে যিদ ধরে বসলো, তখন আল্লাহ তাদের পার্শ্ববর্তী জনপদে যেতে বললেন। যেখানে তাদের চাহিদামত খাদ্য-শস্যাদি তারা সর্বদা প্রাপ্ত হবে। উক্ত জনপদে প্রবেশের সময় আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করার জন্য তিনি কতগুলি আদব ও শিষ্টাচার মান্য করার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু তারা তাতে কর্ণপাত করল না। যেমন আল্লাহ বলেন,
وَإِذْ قُلْنَا ادْخُلُوْا هَـذِهِ الْقَرْيَةَ فَكُلُوْا مِنْهَا حَيْثُ شِئْتُمْ رَغَداً وَادْخُلُوا الْبَابَ سُجَّداً وَّقُوْلُوْا حِطَّةٌ نَّغْفِرْ لَكُمْ خَطَايَاكُمْ وَسَنَزِيْدُ الْمُحْسِنِيْنَ- (البقرة ৫৮)-
‘আর যখন আমরা বললাম, তোমরা প্রবেশ কর এ নগরীতে এবং এতে যেখানে খুশী খেয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে বিচরণ কর এবং নগরীর ফটক দিয়ে প্রবেশ করার সময় সিজদা কর ও বলতে থাক (হে আল্লাহ!) ‘আমাদিগকে ক্ষমা করে দাও’- তাহ’লে আমরা তোমাদের অপরাধসমূহ ক্ষমা করে দেব এবং সৎকর্মশীলদের আমরা সত্বর অতিরিক্তভাবে আরও দান করব’ (বাক্বারাহ ২/৫৮)। কিন্তু এই অবাধ্য জাতি এতটুকু আনুগত্য প্রকাশ করতেও রাযী হয়নি। তাদেরকে শুকরিয়ার সিজদা করতে বলা হয়েছিল এবং আল্লাহর নিকটে ক্ষমা চেয়ে ‘হিত্ত্বাহ’ (حطة) অর্থাৎ حُط ذنوبنا অথবাاحطط عنا ذنوبنا حطة ‘আমাদের পাপসমূহ পুরোপুরি মোচন করুন’ বলতে বলতে শহরে প্রবেশের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বেআদবীর চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে তারা হিত্ত্বাহ-এর বদলে ‘হিন্ত্বাহ’ (حنطة) অর্থাৎ ‘গমের দানা’ বলতে বলতে এবং সিজদা বা মাথা নীচু করার পরিবর্তে পিছন দিকে পিঠ ফিরে প্রবেশ করল।[48] এর মাধ্যমে তারা নিজেদেরকে আল্লাহ পূজারীর বদলে পেটপূজারী বলে প্রমাণ করল।
এখানে هذه القرية বা ‘এই নগরী’ বলতে বায়তুল মুক্বাদ্দাসকে বুঝানো হয়েছে। যার ব্যাখ্যা মায়েদাহ ২১ আয়াতে এসেছে, الأَرْضَ الْمُقَدَّسَةَ বলে। তীহ্ প্রান্তরে ৪০ বছর বন্দী জীবন কাটানোর পর নবী ইউশা‘ বিন নূন-এর নেতৃত্বে জিহাদের মাধ্যমে তারা বিজয় লাভ করে ও নগরীতে প্রবেশ করে (ইবনু কাছীর)। এভাবে তাদের দীর্ঘ বন্দীত্বের অবসান ঘটে।
অথচ যদি প্রথমেই তারা মূসার হুকুম মেনে নিয়ে জিহাদে অবতীর্ণ হ’ত, তাহ’লে তখনই তারা বিজয়ী হয়ে নগরীতে প্রবেশ করত। কিন্তু নবীর অবাধ্যতা করার কারণেই তাদের ৪০ বছর কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হ’ল। পরিশেষে তাদেরকে সেই জিহাদই করতে হ’ল, যা তারা প্রথমে করেনি ভীরুতা ও কাপুরুষতার কারণে। বস্ত্ততঃ ভীরু ব্যক্তি ও জাতি কখনো সম্মানিত হয় না। উল্লেখ্য যে, বায়তুল মুক্বাদ্দাসের উক্ত প্রধান ফটককে আজও ‘বাব হিত্ত্বাহ’ (باب حطة) বলা হয়ে থাকে (কুরতুবী)।
আল্লাহ বলেন,
فَبَدَّلَ الَّذِيْنَ ظَلَمُواْ قَوْلاً غَيْرَ الَّذِيْ قِيْلَ لَهُمْ فَأَنْزَلْنَا عَلَى الَّذِيْنَ ظَلَمُوْا رِجْزاً مِّنَ السَّمَاءِ بِمَا كَانُوْا يَفْسُقُوْنَ- (البقرة ৫৯)-
‘অতঃপর যালেমরা সে কথা পাল্টে দিল, যা তাদেরকে বলতে বলা হয়েছিল। ফলে আমরা যালেমদের উপর তাদের অবাধ্যতার কারণে আসমান থেকে গযব নাযিল করলাম’ (বাক্বারাহ ২/৫৯)। তবে সেটা যে কি ধরনের গযব ছিল, সে বিষয়ে কুরআন পরিষ্কার করে কিছু বলেনি। ইতিহাসও এ ব্যাপারে নীরব। তবে সাধারণতঃ এগুলি প্লেগ-মহামারী, বজ্রনিনাদ, ভূমিকম্প প্রভৃতি হয়ে থাকে। যা বিভিন্ন নবীর অবাধ্য উম্মতদের বেলায় ইতিপূর্বে হয়েছে।
হিনত্বাহ ও হিত্ত্বাহ বলার মাধ্যমে আল্লাহ বস্ত্তবাদী ও আদর্শবাদী দু’প্রকার মানুষের পার্থক্য তুলে ধরেছেন। বস্ত্তবাদীরা বস্ত্ত পাওয়ার লোভে মানবতাকে ও মানব সভ্যতাকে ধ্বংস করে। পক্ষান্তরে ধার্মিক ও আদর্শবাদীরা তাদের ধর্ম ও আদর্শ রক্ষার জন্য বস্ত্তকে উৎসর্গ করে। ফলে মানবতা রক্ষা পায় ও মানব সভ্যতা স্থায়ী হয়। বাস্তবিক পক্ষে সে যুগ থেকে এ যুগ পর্যন্ত বিভিন্ন নামে বস্ত্তবাদীগণ মানবতার ধ্বংসকারী হিসাবে নিজেদেরকে চিহ্নিত করেছে। ১ম ও ২য় বিশ্বযুদ্ধ এবং বর্তমানের ইরাক ও আফগানিস্তানে স্রেফ তেল লুটের জন্য তথাকথিত গণতন্ত্রী, ধর্মনিরপেক্ষ ও বস্ত্তবাদী রাষ্ট্রগুলির নেতাদের হুকুমে টন কে টন বোমা মেরে লাখ লাখ নিরীহ বনু আদমের হত্যাকান্ড এরই প্রমাণ বহন করে। অথচ কেবলমাত্র ধর্মই মানবতাকে বাঁচিয়ে রাখে।
তওরাতের শব্দগত ও অর্থগত পরিবর্তন :
ইহুদীরা তাদের এলাহী কিতাব তওরাতের শাব্দিক পরিবর্তন নবী মূসা (আঃ)-এর জীবদ্দশায় যেমন করেছিল, অর্থগত পরিবর্তনও তারা করেছিল। যেমন মূসা (আঃ) যখন তাদের ৭০ জন নেতাকে সাথে নিয়ে তূর পাহাড়ে গেলেন। অতঃপর আল্লাহর গযবে মৃত্যুবরণ করে পুনরায় তাঁর রহমতে জীবিত হয়ে ফিরে এল, তখনও এই গর্বিত জাতি তওরাত যে আল্লাহর নাযিলকৃত গ্রন্থ এ সাক্ষ্য দেওয়ার সাথে সাথে একথাও জুড়ে দিল যে, আল্লাহ তা‘আলা সবশেষে একথাও বলেছেন যে, তোমরা যতটুকু পার, আমল কর। আর যা না পার তা আমি ক্ষমা করে দিব’। অথচ এটা ছিল সম্পূর্ণ বানোয়াট কথা। তাদের এই মিথ্যা সাক্ষ্যের ফলে লোকেরা বলে দিল যে, তওরাতের বিধান সমূহ মেনে চলা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
তখনই আল্লাহর হুকুমে ফেরেশতাগণ তূর পাহাড়ের একাংশ উপরে তুলে ধরে তাদের হুকুম দিলেন, হয় তোমরা তওরাত মেনে নাও, না হয় ধ্বংস হও। তখন নিরুপায় হয়ে তারা তওরাত মেনে নেয়।[49]
মূসা (আঃ)-এর মৃত্যুর পরেও তওরাত, যবূর ও ইঞ্জীল গ্রন্থগুলিতে তারা অসংখ্য শব্দগত ও অর্থগত পরিবর্তন ঘটিয়েছে। ফলে এই কিতাবগুলি আসল রূপে কোথাও আর পৃথিবীতে অবশিষ্ট নেই। ইহুদীদের তওরাত পরিবর্তনের ধরন ছিল তিনটি। এক. অর্থ ও মর্মগত পরিবর্তন, যা উপরে বর্ণিত হয়েছে। দুই. শব্দগত পরিবর্তন যেমন আল্লাহ বলেন, مِّنَ الَّذِينَ هَادُواْ يُحَرِّفُونَ الْكَلِمَ عَن مَّوَاضِعِهِ، ‘ইহুদীদের মধ্যে একটা দল আছে, যারা আল্লাহর কালামকে (যেখানে শেষনবীর আগমন সংবাদ ও তাঁর গুণাবলী সম্বন্ধে বর্ণিত হয়েছে) তার স্বস্থান হ’তে পরিবর্তন করে দেয়’ (নিসা ৪/৪৬; মায়েদাহ ৫/১৩, ৪১)। এই পরিবর্তন তারা নিজেদের দুনিয়াবী স্বার্থে শাব্দিকভাবে এবং মর্মগতভাবে উভয়বিধ প্রকারে করত। ‘এভাবে তারা কখনো শব্দে, কখনো অর্থে এবং কখনো তেলাওয়াতে (মুখ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে) পরিবর্তন করত। পরিবর্তনের এ প্রকারগুলি কুরআন ও হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। আজকাল পাশ্চাত্যের কিছু সংখ্যক খ্রীষ্টানও একথা কিছু কিছু স্বীকার করে’।[50]
আল্লাহর কিতাবের এইসব পরিবর্তন তাদের মধ্যকার আলেম ও যাজক শ্রেণীর লোকেরাই করত, সাধারণ মানুষ যাদেরকে অন্ধ ভক্তির চূড়ান্ত স্তরে পৌঁছে দিয়েছিল। যেমন আল্লাহ বলেন,
وَيْلٌ لِّلَّذِيْنَ يَكْتُبُوْنَ الْكِتَابَ بِأَيْدِيْهِمْ ثُمَّ يَقُوْلُوْنَ هَـذَا مِنْ عِنْدِ اللهِ لِيَشْتَرُوْا بِهِ ثَمَناً قَلِيْلاً- (البقرة ৭৯)-
‘ধ্বংস ঐসব লোকদের জন্য যারা নিজ হাতে কিতাব লিখে বলত, এটি আল্লাহর পক্ষ হ’তে অবতীর্ণ হয়েছে- যাতে এর বিনিময়ে তারা সামান্য অর্থ উপার্জন করতে পারে’ (বাক্বারাহ ২/৭৯)।
আল্লাহ বলেন, سَمَّاعُونَ لِلْكَذِبِ أَكَّالُونَ لِلسُّحْتِ ‘এইসব লোকেরা মিথ্যা কথা শোনাতে এবং হারাম ভক্ষণে অভ্যস্ত’ (মায়েদাহ ৫/৪২)। জনগণ তাদের কথাকেই সত্য ভাবত এবং এর বিপরীত কিছুই তারা শুনতে চাইত না। এভাবে তারা জনগণের রব-এর আসন দখল করেছিল। যেমন আল্লাহ বলেন, اتَّخَذُواْ أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَاباً مِّنْ دُونِ اللهِ ‘তারা তাদের আলেম ও দরবেশগণকে ‘রব’ হিসাবে গ্রহণ করেছিল আল্লাহ্কে বাদ দিয়ে’ (তওবাহ ৯/৩১)। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, إِنَّهُمْ لَمْ يَأمُرُوْهُمْ أَنْ يَّسْجُدُوْا لَهُمْ وَلَكِنْ أَمَرُوْهُمْ بِمَعْصِيَةِ اللهِ فَأَطَاعُوْهُمْ فَسَمَّاهُمُ اللهُ بِذَالِكَ أَرْبَاباً- ‘তারা তাদেরকে সিজদা করতে বলত না বটে। কিন্তু মানুষকে তারা আল্লাহর অবাধ্যতামূলক কাজের নির্দেশ দিত এবং তারা তা মেনে নিত। সেকারণ আল্লাহ তাদেরকে ‘রব’ বলে আখ্যায়িত করেন’। খৃষ্টান পন্ডিত ‘আদী বিন হাতেম যখন বললেন যে, لَسْنَا نَعْبُدُهُمْ ‘আমরা আমাদের আলেম-দরবেশদের পূজা করি না’। তখন তার জবাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, أَلَيْسَ يُحَرِّمُوْنَ مَا أحَّل اللهُ فَتُحَرِّمُوْنَهُ وَ يُحِلُّوْنَ مَا حَرَّمَ اللهُ فَتُحِلُّوْنَهُ ‘তারা কি আল্লাহকৃত হালালকে হারাম এবং হারামকে হালাল করে না? আর তোমরাও কি সেটা মেনে নাও না? ‘আদী বললেন, হাঁ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, فَتِلْكَ عِبَادَتُهُمْ ‘সেটাই তো ওদের ইবাদত হ’ল’।[51]
গাভী কুরবানীর হুকুম ও হত্যাকারী চিহ্নিত করণ :
বনু ইস্রাঈলের জনৈক যুবক তার একমাত্র চাচাতো বোনকে বিয়ে করে তার চাচার অগাধ সম্পত্তির একক মালিক বনতে চায়। কিন্তু চাচা তাতে রাযী না হওয়ায় সে তাকে গোপনে হত্যা করে। পরের দিন বাহ্যিকভাবে কান্নাকাটি করে চাচার রক্তের দাবীদার সেজে কওমের নেতাদের কাছে বিচার দেয়। কিন্তু সাক্ষীর অভাবে আসামী শনাক্ত করা যাচ্ছিল না। ইতিমধ্যে মূসা (আঃ) অহী মারফত জেনে গিয়েছিলেন যে, বাদী স্বয়ং আসামী এবং সেই-ই একমাত্র হত্যাকারী। এমতাবস্থায় সম্প্রদায়ের নেতারা এসে বিষয়টি ফায়ছালার জন্য মূসা (আঃ)-কে অনুরোধ করল। মূসা (আঃ) তখন আল্লাহর হুকুম মোতাবেক যে ফায়ছালা দিলেন, সে বিষয়ে আল্লাহ বলেন, وَإِذْ قَتَلْتُمْ نَفْساً فَادَّارَأْتُمْ فِيْهَا وَاللهُ مُخْرِجٌ مَّا كُنْتُمْ تَكْتُمُوْنَ ‘যখন তোমরা একজনকে হত্যা করে পরে সে সম্পর্কে একে অপরকে দায়ী করছিলে। অথচ আল্লাহ তা প্রকাশ করে দিলেন, যা তোমরা গোপন করতে চাচ্ছিলে’ (বাক্বারাহ ২/৭২)। কিভাবে আল্লাহ সেটা প্রকাশ করে দিলেন, তার বিবরণ নিম্নরূপ:
‘যখন মূসা স্বীয় কওমকে বললেন, আল্লাহ তোমাদেরকে একটা গাভী যবেহ করতে বলেছেন। তারা বলল, আপনি কি আমাদের সাথে উপহাস করছেন? তিনি বললেন, জাহিলদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া থেকে আমি আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করছি’ (বাক্বারাহ ৬৭)। ‘তারা বলল, তাহ’লে আপনি আপনার পালনকর্তার নিকটে আমাদের জন্য প্রার্থনা করুন, যেন তিনি বলে দেন, গাভীটি কেমন হবে? তিনি বললেন, আল্লাহ বলেছেন গাভীটি এমন হবে, যা না বুড়ী না বকনা, বরং দু’য়ের মাঝামাঝি বয়সের হবে। এখন তোমাদের যা আদেশ করা হয়েছে, তা সেরে ফেল’ (৬৮)। ‘তারা বলল, আপনার প্রভুর নিকটে আমাদের পক্ষ থেকে প্রার্থনা করুন যে, গাভীটির রং কেমন হবে। তিনি বললেন, আল্লাহ বলেছেন, গাভীটি হবে চকচকে গাঢ় পীত বর্ণের, যা দর্শকদের চক্ষু শীতল করবে’ (৬৯)। ‘লোকেরা আবার বলল, আপনি আপনার প্রভুর নিকটে আমাদের পক্ষে প্রার্থনা করুন, যাতে তিনি বলে দেন যে, গাভীটি কিরূপ হবে। কেননা একই রংয়ের সাদৃশ্যপূর্ণ গাভী অনেক রয়েছে। আল্লাহ চাহে তো এবার আমরা অবশ্যই সঠিক দিশা পেয়ে যাব’ (৭০)। ‘তিনি বললেন, আল্লাহ বলেছেন, সে গাভীটি এমন হবে, যে কখনো ভূমি কর্ষণ বা পানি সেচনের শ্রমে অভ্যস্ত নয়, সুঠামদেহী ও খুঁৎহীন’। ‘তারা বলল, এতক্ষণে আপনি সঠিক তথ্য এনেছেন। অতঃপর তারা সেটা যবেহ করল। অথচ তারা (মনের থেকে) তা যবেহ করতে চাচ্ছিল না’ (বাক্বারাহ ২/৬৭-৭১)।
আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর আমি বললাম, যবেহকৃত গরুর গোশতের একটি টুকরা দিয়ে মৃত ব্যক্তির লাশের গায়ে আঘাত কর। এভাবে আল্লাহ মৃতকে জীবিত করেন এবং তোমাদেরকে তাঁর নিদর্শন সমূহ প্রদর্শন করেন। যাতে তোমরা চিন্তা কর’ (বাক্বারাহ ২/৭৩)।
বলা বাহুল্য, গোশতের টুকরা দিয়ে আঘাত করার সাথে সাথে মৃত লোকটি জীবিত হ’ল এবং তার হত্যাকারী ভাতিজার নাম বলে দিয়ে পুনরায় মারা গেল। ধারণা করা চলে যে, মূসা (আঃ) সেমতে শাস্তি বিধান করেন এবং হত্যাকারী ভাতিজাকে হত্যার মাধ্যমে ‘ক্বিছাছ’ আদায় করেন।
কিন্তু এতবড় একটা অলৌকিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করেও এই হঠকারী কওমের হৃদয় আল্লাহর প্রতি অনুগত হয়নি। তাই আল্লাহ বলেন, ثُمَّ قَسَتْ قُلُوْبُكُمْ مِّنْ بَعْدِ ذَلِكَ فَهِيَ كَالْحِجَارَةِ أَوْ أَشَدُّ قَسْوَةً ‘অতঃপর তোমাদের হৃদয় শক্ত হয়ে গেল। যেন তা পাথর, এমনকি তার চেয়েও শক্ত… (বাক্বারাহ ২/৭৪)।
গাভী কুরবানীর ঘটনায় শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ :
(১) এখানে প্রথম যে বিষয়টি ফুটে উঠেছে, সেটি এই যে, আল্লাহর উপরে পূর্ণরূপে ভরসা করলে অনেক সময় যুক্তিগ্রাহ্য বস্ত্তর বাইরের বিষয় দ্বারা সত্য প্রকাশিত হয়। যেমন এখানে গরুর গোশতের টুকরা মেরে মৃতকে জীবিত করার মাধ্যমে হত্যাকারী শনাক্ত করানোর ব্যবস্থা করা হ’ল। অথচ বিষয়টি ছিল যুক্তি ও স্বাভাবিক জ্ঞানের বিরোধী।
(২) মধ্যম বয়সী গাভী কুরবানীর মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে যে, নৈতিকভাবে মৃত জাতিকে পুনর্জীবিত করতে হ’লে পূর্ণ নৈতিকতা সম্পন্ন ঈমানদার যুবশক্তির চূড়ান্ত ত্যাগ ও কুরবানী আবশ্যক।
(৩) নবী-রাসূলগণের আনুগত্য এবং তাঁদের প্রদত্ত শারঈ বিধান সহজভাবে মেনে নেওয়ার মধ্যেই জাতির মঙ্গল নিহিত। বিতর্কে লিপ্ত হ’লে বিধান কঠোর হয় এবং আল্লাহর গযব অবশ্যম্ভাবী হয়। যেমন বনু ইস্রাঈলগণ যদি প্রথম নির্দেশ অনুযায়ী যেকোন একটা গাভী যবেহ করত, তবে তাতেই যথেষ্ট হ’ত। কিন্তু তারা যত বেশী প্রশ্ন করেছে, তত বেশী বিধান কঠোর হয়েছে। এমনকি অবশেষে হত্যাকারী চিহ্নিত হ’লেও আল্লাহর ক্রোধে তাদের হৃদয়গুলো পাথরের মত শক্ত হয়ে গেছে।
(৪) এই গুরুত্বপূর্ণ ও শিক্ষণীয় ঘটনাকে চির জাগরুক করে রাখার জন্য আল্লাহ পাক গাভীর নামে সূরা বাক্বারাহ নামকরণ করেন। এটিই কুরআনের ২৮৬টি আয়াত সমৃদ্ধ সবচেয়ে বড় ও বরকতমন্ডিত সূরা। এই সূরার ফযীলত বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, তোমরা তোমাদের গৃহগুলিকে কবরে পরিণত করো না। নিশ্চয়ই শয়তান ঐ ঘর থেকে পালিয়ে যায়, যে ঘরে সূরা বাক্বারাহ পাঠ করা হয়’।[52] এ সূরার মধ্যে আয়াতুল কুরসী (২৫৫ নং আয়াত) রয়েছে, যাকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ‘শ্রেষ্ঠতম’ (اعظم) আয়াত বলে বর্ণনা করেছেন।[53]
নবী মূসা (আঃ)-এর সঙ্গে বারবার বেআদবী ও অবাধ্যতার পরিণামে এবং আল্লাহর আয়াত সমূহকে অস্বীকার ও পরবর্তীতে নবীগণকে অন্যায় ভাবে হত্যার কারণে আল্লাহ তাদের উপরে চিরস্থায়ী গযব ও অভিসম্পাৎ নাযিল করলেন। আল্লাহ বলেন, وَضُرِبَتْ عَلَيْهِمُ الذِّلَّةُ وَالْمَسْكَنَةُ وَبَآؤُوْا بِغَضَبٍ مِّنَ اللهِ ‘আর তাদের উপরে লাঞ্ছনা ও পরমুখাপেক্ষিতা আরোপিত হ’ল এবং তারা আল্লাহর রোষানলে পতিত হ’ল’ (বাক্বারাহ ২/৬১)।
ইবনু কাছীর বলেন, এ লাঞ্ছনা ও অবমাননার প্রকৃতি হ’ল, ইহুদীরা সর্বদা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অপরের দাসত্বের শৃংখলে আবদ্ধ থাকবে। এ মর্মে সূরা আলে ইমরানে আল্লাহ বলেন, ضُرِبَتْ عَلَيْهِمُ الذِّلَّةُ أَيْنَ مَا ثُقِفُواْ إِلاَّ بِحَبْلٍ مِّنَ اللهِ وَحَبْلٍ مِّنَ النَّاسِ ‘তাদের উপরে লাঞ্ছনা আরোপিত হ’ল যেখানেই তারা অবস্থান করুক না কেন। তবে আল্লাহ প্রদত্ত ও মানব প্রদত্ত মাধ্যম ব্যতীত’ (আলে ইমরান ৩/১১২)। ‘আল্লাহ প্রদত্ত মাধ্যম’ বলতে বুঝানো হয়েছে, যাদেরকে আল্লাহ নিজ চিরন্তন বিধান অনুযায়ী আশ্রয় ও অভয় দিয়েছেন। যেমন শিশু ও রমণীকুল এবং এমন সাধক ও উপাসকগণ, যারা যুদ্ধ-বিগ্রহ থেকে দূরে থাকেন। এরা নিরাপদে থাকবে। অতঃপর ‘মানব প্রদত্ত মাধ্যম’ হ’ল, অন্যের সাথে শান্তি চুক্তির মাধ্যমে নিরাপত্তা লাভ করা, যা মুসলমান বা অন্য যেকোন জাতির সাথে হ’তে পারে। যেমন বর্তমানে তারা আমেরিকা ও পাশ্চাত্য শক্তি বলয়ের সাথে গাটছড়া বেঁধে টিকে আছে।
ইহুদীদের উপর চিরস্থায়ী গযব নাযিলের ব্যাপারে সূরা আ‘রাফে আল্লাহ বলেন,
وَإِذْ تَأَذَّنَ رَبُّكَ لَيَبْعَثَنَّ عَلَيْهِمْ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ مَن يَّسُوْمُهُمْ سُوْءَ الْعَذَابِ إِنَّ رَبَّكَ لَسَرِيْعُ الْعِقَابِ وَإِنَّهُ لَغَفُوْرٌ رَّحِيْمٌ- (الأعراف ১৬৭)-
‘স্মরণ কর সে সময়ের কথা, যখন তোমার প্রভু জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, নিশ্চয়ই তিনি তাদের (ইহুদীদের) উপরে প্রেরণ করতে থাকবেন ক্বিয়ামত পর্যন্ত এমন সব শাসক, যারা তাদের প্রতি পৌঁছাতে থাকবে কঠিন শাস্তিসমূহ। নিশ্চয়ই তোমার প্রভু দ্রুত বদলা গ্রহণকারী এবং নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (আ‘রাফ ৭/১৬৭)।
উপরোক্ত আয়াত সমূহের আলোকে আমরা ইহুদীদের উপরে বিগত ও বর্তমান যুগের লাঞ্ছনা ও অবমাননার দীর্ঘ ইতিহাস পর্যালোচনা করতে পারি। তবে এখানে এতটুকু বলা আবশ্যক যে, হাযার বছর ধরে বসবাসকারী ফিলিস্তীনের স্থায়ী মুসলিম নাগরিকদের তাড়িয়ে দিয়ে ১৯৪৮ সাল থেকে বৃটেন, আমেরিকা, রাশিয়া প্রমুখ অশুভ শক্তি বলয়ের মাধ্যমে যবরদস্তিমূলকভাবে প্রতিষ্ঠিত তথাকথিত ‘ইস্রাঈল’ নামক রাষ্ট্র মূলতঃ কোন রাষ্ট্রই নয়। বরং মধ্যপ্রাচ্যের তৈলভান্ডার নিজেদের করায়ত্তে রাখার জন্য বৃহৎ শক্তিবর্গের বিশেষ করে আমেরিকা ও বৃটেনের ঘাঁটি বা অস্ত্রগুদাম মাত্র। বৃহৎ শক্তিগুলো হাত গুটিয়ে নিলে তারা একমাসও নিজের শক্তিতে টিকতে পারবে কি-না সন্দেহ। এতেই কুরআনী সত্য حَبْلٍ مِّنَ النَّاسِ বা ‘মানব প্রদত্ত মাধ্যম’-এর বাস্তব রূপ প্রকাশিত হয়। ইনশাআল্লাহ এ মাধ্যমও তাদের ছিন্ন হবে এবং তাদেরকে এই পবিত্র ভূমি মুসলমানদের হাতে ছেড়ে দিয়ে অন্যত্র চলে যেতে হবে অথবা ইসলাম কবুল করে শান্তিতে বসবাস করতে হবে।
এ ঘটনাটি বনু ইস্রাঈলের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। বরং ঘটনাটি ব্যক্তিগতভাবে মূসা (আঃ)-এর সঙ্গে জড়িত। পিতা ইবরাহীম (আঃ) সহ বড় বড় নবী-রাসূলগণের জীবনে পদে পদে পরীক্ষা দিতে হয়েছে। মূসা (আঃ)-এর জীবনে এটাও ছিল অনুরূপ একটি পরীক্ষা। যে পরীক্ষায় জ্ঞানীদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ রয়েছে। আনুষঙ্গিক বিবরণ দৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে, ঘটনাটি তীহ্ প্রান্তরের উন্মুক্ত বন্দীশালায় থাকাকালীন সময়ে ঘটেছিল। ঘটনাটি নিম্নরূপ:
ছহীহ বুখারী ও মুসলিমে হযরত উবাই বিন কা‘ব (রাঃ) প্রমুখাৎ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হ’তে বর্ণিত হাদীছ হ’তে[54] এবং সূরা কাহফ ৬০ হ’তে ৮২ পর্যন্ত ২৩টি আয়াতে বর্ণিত বিবরণ থেকে যা জানা যায়, তার সংক্ষিপ্ত সার নিম্নে বিবৃত হ’ল।-
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, একদিন হযরত মূসা (আঃ) বনু ইস্রাঈলের এক সভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন। এমন সময় জনৈক ব্যক্তি প্রশ্ন করল, লোকদের মধ্যে আপনার চেয়ে অধিক জ্ঞানী কেউ আছে কি? ঐ সময়ে যেহেতু মূসা ছিলেন শ্রেষ্ঠ নবী এবং তাঁর জানা মতে আর কেউ তাঁর চাইতে অধিক জ্ঞানী ছিলেন না, তাই তিনি সরলভাবে ‘না’ সূচক জবাব দেন। জবাবটি আল্লাহর পসন্দ হয়নি। কেননা এতে কিছুটা অহংকার প্রকাশ পেয়েছিল। ফলে আল্লাহ তাঁকে পরীক্ষায় ফেললেন। তাঁর উচিৎ ছিল একথা বলা যে, ‘আল্লাহই সর্বাধিক অবগত’। আল্লাহ তাঁকে বললেন, ‘হে মূসা! দুই সমুদ্রের সংযোগস্থলে অবস্থানকারী আমার এক বান্দা আছে, যে তোমার চেয়ে অধিক জ্ঞানী’। একথা শুনে মূসা (আঃ) প্রার্থনা করে বললেন, হে আল্লাহ! আমাকে ঠিকানা বলে দিন, যাতে আমি সেখানে গিয়ে জ্ঞান লাভ করতে পারি’। আল্লাহ বললেন, থলের মধ্যে একটি মাছ নিয়ে নাও এবং দুই সমুদ্রের সঙ্গমস্থলের (সম্ভবতঃ লোহিত সাগর ও ভূমধ্যসাগরের মিলনস্থল) দিকে সফরে বেরিয়ে পড়। যেখানে পৌঁছার পর মাছটি জীবিত হয়ে বেরিয়ে যাবে, সেখানেই আমার সেই বান্দার সাক্ষাৎ পাবে’। মূসা (আঃ) স্বীয় ভাগিনা ও শিষ্য (এবং পরবর্তীকালে নবী) ইউশা‘ বিন নূনকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। পথিমধ্যে এক স্থানে সাগরতীরে পাথরের উপর মাথা রেখে দু’জন ঘুমিয়ে পড়েন। হঠাৎ সাগরের ঢেউয়ের ছিটা মাছের গায়ে লাগে এবং মাছটি থলের মধ্যে জীবিত হয়ে নড়েচড়ে ওঠে ও থলে থেকে বেরিয়ে সাগরে গিয়ে পড়ে। ইউশা‘ ঘুম থেকে উঠে এই বিস্ময়কর দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেন। কিন্তু মূসা (আঃ) ঘুম থেকে উঠলে তাঁকে এই ঘটনা বলতে ভুলে গেলেন। অতঃপর তারা আবার পথ চলতে শুরু করলেন এবং একদিন একরাত চলার পর ক্লান্ত হয়ে এক স্থানে বিশ্রামের জন্য বসলেন। অতঃপর মূসা (আঃ) নাশতা দিতে বললেন। তখন তার মাছের কথা মনে পড়ল এবং ওযর পেশ করে আনুপূর্বিক সব ঘটনা মূসা (আঃ)-কে বললেন এবং বললেন যে, ‘শয়তানই আমাকে একথা ভুলিয়ে দিয়েছিল’ (কাহফ ১৮/৬৩)। তখন মূসা (আঃ) বললেন, ঐ স্থানটিই তো ছিল আমাদের গন্তব্য স্থল।
ফলে তাঁরা আবার সেপথে ফিরে চললেন। অতঃপর সেখানে পৌঁছে দেখতে পেলেন যে, একজন লোক আপাদ-মস্তক চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। মূসা (আঃ) তাকে সালাম করলেন। লোকটি মুখ বের করে বললেন, এদেশে সালাম? কে আপনি? বললেন, আমি বনু ইস্রাঈলের মূসা। আপনার কাছ থেকে ঐ জ্ঞান অর্জন করতে এসেছি, যা আল্লাহ আপনাকে বিশেষভাবে দান করেছেন’।
খিযির বললেন, আপনি আমার সাথে ধৈর্য ধারণ করতে পারবেন না হে মূসা! আল্লাহ আমাকে যে জ্ঞান দান করেছেন, তা তিনি আপনাকে দেননি। পক্ষান্তরে আপনাকে তিনি যে জ্ঞান দান করেছেন, তা আমাকে দেননি’। মূসা বললেন, ‘আল্লাহ চাহেন তো আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন এবং আমি আপনার কোন আদেশ অমান্য করব না’ (কাহফ ১৮/৬৯)। খিযির বললেন, ‘যদি আপনি আমার অনুসরণ করেনই, তবে কোন বিষয়ে আমাকে প্রশ্ন করবেন না, যে পর্যন্ত না আমি নিজে সে সম্পর্কে আপনাকে কিছু বলি’।
(১) অতঃপর তাঁরা চলতে লাগলেন। কিছু দূর গিয়ে নদী পার হওয়ার জন্য একটা নৌকা পেলেন। অতঃপর নৌকা থেকে নামার সময় তাতে ছিদ্র করে দিলেন। শারঈ বিধানের অধিকারী নবী মূসা বিষয়টিকে মেনে নিতে পারলেন না। কেননা বিনা দোষে অন্যের নৌকা ছিদ্র করে দেওয়া স্পষ্টভাবেই অন্যায়। তিনি বলেই ফেললেন, ‘নিশ্চয়ই আপনি একটা গুরুতর মন্দ কাজ করলেন’। তখন খিযির বললেন, আমি কি পূর্বেই বলিনি যে, ‘আপনি আমার সাথে ধৈর্য ধারণ করতে পারবেন না’। মূসা ক্ষমা চাইলেন। ইতিমধ্যে একটা কালো চড়ুই পাখি এসে নৌকার এক প্রান্তে বসল এবং সমুদ্র থেকে এক চঞ্চু পানি তুলে নিল। সে দিকে ইঙ্গিত করে খিযির মূসা (আঃ)-কে বললেন, علمي و علمك و علم الخلائق فى علم الله إلا مقدار ما غمس هذا العصفور منقاره ‘আমার ও আপনার এবং সমস্ত সৃষ্টিজগতের জ্ঞান মিলিতভাবে আল্লাহর জ্ঞানের মুকাবিলায় সমুদ্রের বুক থেকে পাখির চঞ্চুতে উঠানো এক ফোঁটা পানির সমতুল্য’।[55]
(২) তারপর তাঁরা সমুদ্রের তীর বেয়ে চলতে থাকলেন। কিছু দূর গিয়ে তাঁরা সাগরপাড়ে খেলায় রত একদল বালককে দেখলেন। খিযির তাদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর ও বুদ্ধিমান ছেলেটিকে ধরে এনে নিজ হাতে তাকে হত্যা করলেন। এ দৃশ্য দেখে মূসা আৎকে উঠে বললেন, একি! একটা নিষ্পাপ শিশুকে আপনি হত্যা করলেন? এ যে মস্তবড় গোনাহের কাজ’। খিযির বললেন, আমি তো পূর্বেই বলেছিলাম, আপনি ধৈর্য ধারণ করতে পারবেন না’। মূসা আবার ক্ষমা চাইলেন এবং বললেন, ‘এরপর যদি আমি কোন প্রশ্ন করি, তাহ’লে আপনি আমাকে আর সাথে রাখবেন না’ (কাহফ ১৮/৭৫)।
(৩) ‘অতঃপর তারা চলতে লাগলেন। অবশেষে যখন একটি জনপদে পৌঁছলেন, তখন তাদের কাছে খাবার চাইলেন। কিন্তু তারা তাদের আতিথেয়তা করতে অস্বীকার করল। অতঃপর তারা সেখানে একটি পতনোন্মুখ প্রাচীর দেখতে পেয়ে সেটাকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিলেন। তখন মূসা বললেন, আপনি ইচ্ছা করলে তাদের কাছ থেকে এর বিনিময়ে পারিশ্রমিক নিতে পারতেন’। খিযির বললেন هَذَا فِرَاقُ بَيْنِي وَبَيْنِكَ سَأُنَبِّئُكَ بِتَأْوِيلِ مَا لَمْ تَسْتَطِعْ عَلَيْهِ صَبْراً ‘এখানেই আমার ও আপনার মধ্যে সম্পর্কচ্ছেদ হ’ল। এখন যেসব বিষয়ে আপনি ধৈর্য ধারণ করতে পারেননি, আমি সেগুলির তাৎপর্য বলে দিচ্ছি’ (কাহফ ১৮/৭৮)।
প্রথমতঃ নৌকা ছিদ্র করার বিষয়। সেটা ছিল কয়েকজন মিসকীন দরিদ্র ব্যক্তির। তারা এ দিয়ে সমুদ্রে জীবিকা অন্বেষণ করত। আমি সেটিকে ছিদ্র করে দিলাম এজন্য যে, ঐ অঞ্চলে ছিল এক যালেম বাদশাহ। সে বলপ্রয়োগে লোকদের নৌকা ছিনিয়ে নিত’। নিশ্চয়ই ছিদ্র নৌকা সে নিবে না। ফলে দরিদ্র লোকগুলি নৌকার সামান্য ত্রুটি সেরে নিয়ে পরে তাদের কাজে লাগাতে পারবে।
দ্বিতীয়তঃ বালকটিকে হত্যার ব্যাপার। তার পিতা-মাতা ছিল ঈমানদার। আমি আশংকা করলাম যে, সে বড় হয়ে অবাধ্য হবে ও কাফের হবে। যা তার বাপ-মায়ের জন্য ফিৎনার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তাই আমি চাইলাম যে, দয়ালু আল্লাহ তার পিতা-মাতাকে এর বদলে উত্তম সন্তান দান করুন, যে হবে সৎকর্মশীল ও বিশুদ্ধ চরিত্রের অধিকারী। যে তার পিতা-মাতাকে শান্তি দান করবে’।
তৃতীয়তঃ পতনোন্মুখ প্রাচীর সোজা করে দেওয়ার ব্যাপার। উক্ত প্রাচীরের মালিক ছিল নগরীর দু’জন পিতৃহীন বালক। ঐ প্রাচীরের নীচে তাদের নেককার পিতার রক্ষিত গুপ্তধন ছিল। আল্লাহ চাইলেন যে, বালক দু’টি যুবক হওয়া পর্যন্ত প্রাচীরটি খাড়া থাক এবং তারা তাদের প্রাপ্য গুপ্তধন হস্তগত করুক। (খিযির বলেন,) وَمَا فَعَلْتُهُ عَنْ أَمْرِىْ ‘বস্ত্ততঃ আমি নিজ ইচ্ছায় এ সবের কিছুই করিনি’ (কাহফ ১৮/৮২)।
(১) বড় যুলুম থেকে বাঁচানোর জন্য কারু উপরে ছোট-খাট যুলুম করা যায়। যেমন নৌকা ছিদ্র করা থেকে এবং বালকটিকে হত্যা করা থেকে প্রমাণিত হয়। তবে শরী‘আতে মুহাম্মাদীতে এগুলি সবই সামাজিক বিধি-বিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। বিশেষ করে হত্যাকান্ডের মত বিষয় একমাত্র রাষ্ট্রানুমোদিত বিচার কর্তৃপক্ষ ব্যতীত কারু জন্য অনুমোদিত নয়। (২) পিতা-মাতার সৎকর্মের ফল সন্তানরাও পেয়ে থাকে। যেমন সৎকর্মশীল পিতার রেখে যাওয়া গুপ্তধন তার সন্তানরা যাতে পায়, সেজন্য খিযির সাহায্য করলেন। তাছাড়া এ বিষয়েও ইঙ্গিত রয়েছে যে, আলেম ও সৎকর্মশীলগণের সন্তানদের প্রতি সকলেরই স্নেহ পরায়ণ হওয়া কর্তব্য। (৩) মানুষ অনেক সময় অনেক বিষয়কে ভাল মনে করে। কিন্তু সেটি তার জন্য ক্ষতির কারণ হয়। যেমন আল্লাহ বলেন,
عَسَى أَن تَكْرَهُوْا شَيْئاً وَهُوَ خَيْرٌ لَّكُمْ وَعَسَى أَن تُحِبُّوْا شَيْئاً وَهُوَ شَرٌّ لَّكُمْ وَاللهُ يَعْلَمُ وَأَنتُمْ لاَ تَعْلَمُون- (البقرة ২১৬)-
‘তোমরা অনেক বিষয়কে অপসন্দ কর। অথচ সেটি তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আবার অনেক বিষয় তোমরা ভাল মনে কর, কিন্তু সেটি তোমাদের জন্য ক্ষতিকর। বস্ত্ততঃ আল্লাহই প্রকৃত অবস্থা জানেন, তোমরা জানো না’ (বাক্বারাহ ২/২১৬)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, لايَقْضِى اللهُ للمؤمن من قضاءٍ الا كان خيرًا له ‘আল্লাহ তার মুমিন বান্দার জন্য যা ফায়ছালা করেন, তা কেবল তার মঙ্গলের জন্যই হয়ে থাকে’।[56]
(৪) অতঃপর আরেকটি মৌলিক বিষয় এখানে রয়েছে যে, মূসা ও খিযিরের এ শিহরণমূলক কাহিনীটি ছিল ‘আগাগোড়া একটি বিশেষ প্রশিক্ষণের বহিঃপ্রকাশ’। থলের মধ্যেকার মরা মাছ জীবিত হয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে সাগরে চলে যাওয়া যেমন সাধারণ নিয়ম বহির্ভূত বিষয়, তেমনি আল্লাহ পাক কোন ফেরেশতাকে খিযিরের রূপ ধারণ করে মূসাকে শিক্ষা দেওয়ার জন্যও পাঠিয়ে থাকতে পারেন। যাকে তিনি সাময়িকভাবে শরী‘আতী ইলমের বাইরে অলৌকিক ও অতীন্দ্রিয় জ্ঞান দিয়ে পাঠিয়েছিলেন, যা মূসার জ্ঞানের বাইরে ছিল। এর দ্বারা আল্লাহ মূসা সহ সকল মানুষের জ্ঞানের স্বল্পতার কথা জানিয়ে দিয়েছেন।
(৫) বান্দার জন্য যে অহংকার নিষিদ্ধ, অত্র ঘটনায় সেটাই সবচেয়ে বড় শিক্ষণীয় বিষয়।
কুরআনে তাঁকে عَبْداً مِّنْ عِبَادِنَا ‘আমাদের বান্দাদের একজন’ (কাহফ ১৮/৬৫) বলা হয়েছে। বুখারী শরীফে তাঁর নাম খিযির (خضر) বলে উল্লেখ করা হয়েছে’। সেখানে তাঁকে নবী বলা হয়নি। জনশ্রুতি মতে তিনি একজন ওলী ছিলেন এবং মৃত্যু হয়ে গেলেও এখনও মানুষের বেশ ধরে যেকোন সময় যেকোন মানুষের উপকার করেন। ফলে জঙ্গলে ও সাগর বক্ষে বিপদাপদ থেকে বাঁচার জন্য আজও অনেকে খিযিরের অসীলা পাবার জন্য তার উদ্দেশ্যে মানত করে থাকে। এসব ধারণার প্রসার ঘটেছে মূলতঃ বড় বড় প্রাচীন মনীষীদের নামে বিভিন্ন তাফসীরের কেতাবে উল্লেখিত কিছু কিছু ভিত্তিহীন কল্পকথার উপরে ভিত্তি করে।
যারা তাকে নবী বলেন, তাদের দাবীর ভিত্তি হ’ল, খিযিরের বক্তব্য وَمَا فَعَلْتُهُ عَنْ أَمْرِيْ ‘আমি এসব নিজের মতে করিনি’ (কাহফ ১৮/৮২)। অর্থাৎ সবকিছু আল্লাহর নির্দেশে করেছি। অলীগণের কাশ্ফ-ইলহাম শরী‘আতের দলীল নয়। কিন্তু নবীগণের স্বপ্নও আল্লাহর অহী হয়ে থাকে। যেজন্য ইবরাহীম (আঃ) স্বীয় পুত্রকে যবেহ করতে উদ্যত হয়েছিলেন। অতএব বালক হত্যার মত ঘটনা কেবলমাত্র নবীর পক্ষেই সম্ভব, কোন অলীর পক্ষে আদৌ নয়। কিন্তু সেখানেও প্রশ্ন থেকে যায় যে, নবী কখনো শরী‘আত বিরোধী কাজ করতে পারেন না। ঐ সময় শরী‘আতধারী নবী ও রাসূল ছিলেন হযরত মূসা (আঃ)। আর সে কারণেই খিযিরের শরী‘আত বিরোধী কাজ দেখে তিনি বারবার প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছিলেন। এ ব্যাপারে সবাই একমত যে, খিযির কোন কেতাবধারী রাসূল ছিলেন না, বা তাঁর কোন উম্মত ছিল না।
এখানে আমরা যদি বিষয়টিকে কুরআনের প্রকাশ্য অর্থের উপরে ছেড়ে দিই এবং তাঁকে ‘আল্লাহর একজন বান্দা’ হিসাবে গণ্য করি, যাঁকে আল্লাহর ভাষায় آتَيْنَاهُ رَحْمَةً مِنْ عِندِنَا وَعَلَّمْنَاهُ مِن لَّدُنَّا عِلْماً ‘আমরা আমাদের পক্ষ হ’তে বিশেষ রহমত দান করেছিলাম এবং আমাদের পক্ষ হ’তে দিয়েছিলাম এক বিশেষ জ্ঞান’ (কাহফ ১৮/৬৫)। তাহ’লে তিনি নবী ছিলেন কি অলী ছিলেন, তিনি এখনো বেঁচে আছেন, না মারা গেছেন, এসব বিতর্কের আর কোন অবকাশ থাকে না। যেভাবে মূসার মায়ের নিকটে আল্লাহ অহী (অর্থাৎ ইলহাম) করেছিলেন এবং যার ফলে তিনি তার সদ্য প্রসূত সন্তান মূসাকে বাক্সে ভরে সাগরে নিক্ষেপ করতে সাহসী হয়েছিলেন (ত্বোয়াহা ২০/৩৮-৩৯) এবং যেভাবে জিব্রীল মানুষের রূপ ধরে এসে রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে ছাহাবীগণকে দ্বীনের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন[57] একই ধরনের ঘটনা মূসা ও খিযিরের ক্ষেত্রে হওয়াটাও বিস্ময়কর কিছু নয়।
মনে রাখা আবশ্যক যে, লোকমান অত্যন্ত উঁচুদরের একজন জ্ঞানী মানুষ ছিলেন। তাঁর জ্ঞানপূর্ণ উপদেশসমূহ কুরআনে বর্ণিত হয়েছে এবং তার নামে একটি সূরা নাযিল হয়েছে। কিন্তু তিনি নবী ছিলেন না। লোকমানকে আল্লাহ যেমন বিশেষ ‘হিকমত’ দান করেছিলেন (লোকমান ৩১/১২)। খিযিরকেও তেমনি বিশেষ ‘ইল্ম’ দান করেছিলেন (কাহফ ১৮/৬৫)। এটা বিচিত্র কিছু নয়।
(১) মূসা (আঃ)-এর সিন্দুক ও নবীগণের ছবি :
বাক্বারাহ ২৪৮ : إِنَّ آيَةَ مُلْكِهِ أَن يَّأْتِيَكُمُ التَّابُوْتُ ‘তাদের নবী (শ্যামুয়েল) তাদেরকে বললেন (ত্বালূতের) রাজা হওয়ার নিদর্শন এই যে, তোমাদের নিকটে সেই ‘তাবূত’ (সিন্দুক) আসবে…।’
এখানে তাবূত-এর ব্যাখ্যায় (ক) তাফসীর জালালাইনে বলা হয়েছে, الصندوق كان فيه صور الأنبياء، أنزله الله على أدم- ‘সেই সিন্দুক, যা আল্লাহ আদম (আঃ)-এর উপরে নাযিল করেন এবং যার মধ্যে রয়েছে নবীদের ছবিসমূহ’। (খ) তাফসীর কাশশাফে বলা হয়েছে, التابوت هي صورة كانت فيه من زبرجد أو ياقوت لها رأس كرأس الهر وذنب كذنبه وجناحان ‘উক্ত তাবূত হ’ল একটি মূর্তি, যার মধ্যে যবরজদ ও ইয়াকূত মণি-মুক্তা সমূহ রয়েছে। উক্ত তাবূতের মাথা ও লেজ মদ্দা বিড়ালের মাথা ও লেজের ন্যায়, যার দু’টি ডানা রয়েছে।’ (গ) তাফসীর বায়যাবীতে বলা হয়েছে, وفيه صورة الأنبياء من آدم إلى محمد ‘তাতে নবীগণের ছবি রয়েছে আদম (আঃ) থেকে মুহাম্মাদ (ছাঃ) পর্যন্ত।’
(ঘ) ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ প্রকাশিত বঙ্গানুবাদ কুরআন শরীফে (পৃঃ ৬৩ টীকা ১৭০) বলা হয়েছে, ‘বিধর্মীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা কালে হযরত মূসা (আঃ) ইহা সম্মুখে স্থাপন করিতেন’।
উপরে বর্ণিত কোন ব্যাখ্যাই কুরআন ও হাদীছ সম্মত নয়। বরং প্রকৃত কথা এই যে, এটি হ’ল আল্লাহর হুকুম মোতাবেক মূসা (আঃ)-এর তৈরী সেই সিন্দুক, যার মধ্যে তাঁর লাঠি, তাওরাত এবং তাঁর ও হারূণ (আঃ)-এর পরিত্যক্ত অন্যান্য পবিত্র বস্ত্তসমূহ সংরক্ষিত ছিল। বনু ইস্রাঈলগণ এটিকে বরকত হিসাবে ও বিজয়ের নিদর্শন হিসাবে মনে করত।
(২) তাওরাতের পৃষ্ঠা সমূহ :
আ‘রাফ ১৪৫ : وَكَتَبْنَا لَهُ فِي الْأَلْوَاحِ مِنْ كُلِّ شَيْءٍ مَّوْعِظَةً وَّتَفْصِيْلاً لِّكُلِّ شَيْءٍ ‘আমরা তার (মূসা) জন্য ফলকে (তাওরাতে পৃষ্ঠাসমূহে) সকল বিষয়ে উপদেশ ও স্পষ্ট ব্যাখ্যাসমূহ লিখে দিয়েছি’। এর ব্যাখ্যায় তাফসীরে জালালাইনে বলা হয়েছে, أي ألواح التوراة وكانت من سدر الجنة أو زبرجد أو زمرد سبعة أو عشرة ‘অর্থাৎ তাওরাতের ফলক সমূহ, যা ছিল জান্নাতের পত্র সমূহ বা যবরজাদ অথবা যুমুর্রুদ, যা ছিল ৭টি অথবা ১০টি’। অথচ এসব কথার কোন ভিত্তি নেই। ঐ ফলকগুলির সংখ্যা কত ছিল, কি দিয়ে তৈরী ছিল, কতটুকু তার দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ছিল, কি দিয়ে ও কিভাবে সেখানে লেখা ছিল, এগুলি বিষয় জানা বা তার উপরে ঈমান আনার কোন বাধ্যবাধকতা আমাদের উপরে নেই। কুরআন-হাদীছ এবিষয়ে চুপ রয়েছে। আমরাও এ বিষয়ে চুপ থাকব। বস্ত্ততঃ এগুলি স্রেফ ইস্রাঈলী কল্পকাহিনী মাত্র।
মূসা ও ফেরাঊনের কাহিনীতে শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ :
১. আল্লাহ যালেম শাসক ও ব্যক্তিদেরকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অবকাশ দিয়ে থাকেন। কিন্তু তারা সংশোধিত না হ’লে সরাসরি আসমানী বা যমীনী গযব প্রেরণ করেন অথবা অন্য কোন মানুষকে দিয়ে তাকে শাস্তি দেন ও যুলুম প্রতিরোধ করেন। যেমন আল্লাহ উদ্ধত ফেরাঊনের কাছে প্রথমে মূসাকে পাঠান। ২০ বছরের বেশী সময় ধরে তাকে উপদেশ দেওয়ার পরেও এবং নানাবিধ গযব পাঠিয়েও তার ঔদ্ধত্য দমিত না হওয়ায় অবশেষে সাগরডুবির গযব পাঠিয়ে আল্লাহ তাদেরকে সমূলে উৎখাত করেন।
২. দুনিয়াদার সমাজনেতারা সর্বদা যালেম শাসকদের সহযোগী থাকে। পক্ষান্তরে মযলূম দ্বীনদার ব্যক্তিগণ সর্বদা দ্বীনদার সমাজ সংস্কারক নেতৃত্বের মুখাপেক্ষী থাকে।
৩. দুনিয়া লোভী আন্দোলন নিজেকে অপদস্থ ও সমাজকে ধ্বংস করে। পক্ষান্তরে আখেরাত পিয়াসী আন্দোলন নিজেকে সম্মানিত ও সমাজকে উন্নত করে। যেমন দুনিয়াদার শাসক ফেরাঊন নিজেকে ও নিজের সমাজকে ধ্বংস করেছে এবং নিজে এমনভাবে অপদস্থ হয়েছে যে, তার নামে কেউ নিজ সন্তানের নাম পর্যন্ত রাখতে চায় না। পক্ষান্তরে মূসা (আঃ)-এর দ্বীনী আন্দোলন তাঁকে ও তাঁর ঈমানদার সাথীদেরকে বিশ্ব মাঝে স্থায়ী সম্মান দান করেছে।
৪. দুনিয়াতে যালেম ও মযলূম উভয়েরই পরীক্ষা হয়ে থাকে। যালেম তার যুলুমের চরম সীমায় পৌঁছে গেলে তাকে ধ্বংস করা হয়। অনুরূপভাবে মযলূম সর্বাবস্থায় আল্লাহর উপরে ভরসা করলে নির্দিষ্ট সময়ে তাকে সাহায্য করা হয়। অধিকন্তু পরকালে সে জান্নাত লাভে ধন্য হয়।
৫. দ্বীনদার সংস্কারককে সর্বদা আল্লাহর সাহায্যের উপরে নির্ভরশীল থাকতে হয় এবং কথায় ও আচরণে সামান্যতম অহংকার প্রকাশ করা হ’তে বিরত থাকতে হয়। মূসা ও খিযিরের ঘটনায় আল্লাহ এ প্রশিক্ষণ দিয়ে সবাইকে সেকথা বুঝিয়ে দিয়েছেন।
৬. অহীর বিধানের অবাধ্যতা করলে আল্লাহর রহমতপ্রাপ্ত জাতিও চিরস্থায়ী গযবের শিকার হ’তে পারে। বনু ইস্রাঈলগণ তার জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ। নবীগণের শিক্ষার বিরোধিতা করায় তাদের উপর থেকে আল্লাহর রহমত উঠে যায় এবং তারা চিরস্থায়ী গযব ও লাঞ্ছনার শিকার হয়। ব্যক্তির ক্ষেত্রেও এটি একইভাবে প্রযোজ্য। ইস্রাঈলী দরবেশ আলেম বাল‘আম বা‘ঊরার ঘটনা এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
৭. জিহাদ বিমুখ জাতি কখনোই সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে দুনিয়ায় বাঁচতে পারে না। আর সেকারণেই মিসরীয় জনগণের ১০ হ’তে ২০ শতাংশ হওয়া সত্ত্বেও বনু ইস্রাঈলগণকে রাতের অন্ধকারে সেদেশ ছেড়ে পালিয়ে আসতে হয়। অতঃপর জিহাদে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করায় তারা তাদের পিতৃভূমি বায়তুল মুক্বাদ্দাস অধিকারে ব্যর্থ হয়। যার শাস্তি স্বরূপ দীর্ঘ চল্লিশ বছর যাবত তীহ প্রান্তরের উন্মুক্ত কারাগারে তারা বন্দীত্ব বরণে বাধ্য হয়। অবশেষে নবী ইউশা-র নেতৃত্বে জিহাদ করেই তাদের পিতৃভূমি দখল করতে হয়।
৮. সংস্কারককে জাতির নিকট থেকে লাঞ্ছনা ভোগ করতে হয়। দুনিয়ায় তাঁর নিঃস্বার্থ সঙ্গী হাতে গণা কিছু লোক হয়ে থাকে। তাঁকে স্রেফ আল্লাহর উপরে ভরসা করেই চলতে হয়। বিনিময়ে তিনি আখেরাতে পুরস্কৃত হন ও পরবর্তী বংশধরের নিকটে যুগ যুগ ধরে প্রেরণার উৎস হয়ে থাকেন। যেমন মূসার প্রকৃত সাথী ছিলেন তার ভাই হারূণ ও ভাগিনা ইউশা‘ বিন নূন। বাকী অধিকাংশ ছিল তাকে কষ্ট দানকারী ও স্বার্থপর সাথী । মূসা (আঃ) তাই দুঃখ করে তার কওমকে বলেন, لِمَ تُؤْذُوْنَنِيْ وَقَد تَّعْلَمُوْنَ أَنِّيْ رَسُوْلُ اللهِ إِلَيْكُمْ ‘কেন তোমরা আমাকে কষ্ট দাও? অথচ তোমরা জানো যে, আমি তোমাদের নিকটে আল্লাহর প্রেরিত রাসূল’ (ছফ ৬১/৫)।
উপসংহার :
মূসা ও হারূণ (আলাইহিমাস সালাম)-এর দীর্ঘ কাহিনীর মাধ্যমে নবীদের কাহিনীর একটা বিরাট অংশ সমাপ্ত হ’ল। হারূণ ও মূসার জীবনীতে ব্যক্তি মূসা ও গোষ্ঠী বনু ইস্রাঈলের উত্থান-পতনের যে ঘটনাবলী বিবৃত হয়েছে, তা রীতিমত বিষ্ময়কর ও শিহরণ মূলক। একই সাথে তা মানবীয় চরিত্রের তিক্ত ও মধুর নানাবিধ বাস্তবতায় মুখর। সমাজ সংস্কারক ও সমাজ সচেতন যেকোন পাঠকের জন্য এ কাহিনী হবে খুবই শিক্ষণীয় ও তাৎপর্যমন্ডিত। এক্ষণে আমাদের উচিত হবে এর আলোকে সমাজ সংস্কারে ব্রতী হওয়া এবং গভীর ধৈর্যের সাথে আমাদের স্ব স্ব পরিবার, সমাজ ও জাতিকে অহি-র বিধানের আলোকে গড়ে তোলা। আল্লাহ আমাদের সুপথ প্রদর্শন করুন- আমীন!