ইসলামের কতিপয় সামাজিক বিধান
মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধ হয়েই তাকে বাস করতে হয়। সমাজে একে অপরের সহযোগী হয়ে জীবনের পথ চলতে হয়। তাই সামাজিক জীবনে পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানবতার দ্বীন ইসলাম এ ব্যাপারে বিস্তারিত বিধি-বিধান বর্ণনা করেছে।
ইসলাম যেমনিভাবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে নফল ছিয়াম, যিকির, তাসবীহ-তাহলীলের মত ইবাদতে উৎসাহ দিয়েছে, তেমনি সমাজের মানুষের কল্যাণে কাজ করাকেও ইবাদত হিসাবে ঘোষণা করেছে। কিন্তু এ সকল সামাজিক কার্যক্রমে অনেক দ্বীনদার মানুষকেও তৎপর দেখা যায় না। তাই এ ব্যাপারে কুরআন-সুন্নাহর আলোকে কিছুটা আলোকপাত করা হ’ল-
আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে বলেন,
لَيْسَ الْبِرَّ أَنْ تُوَلُّوا وُجُوهَكُمْ قِبَلَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ وَلَكِنَّ الْبِرَّ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالْكِتَابِ وَالنَّبِيِّينَ وَآتَى الْمَالَ عَلَى حُبِّهِ ذَوِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَالسَّائِلِينَ وَفِي الرِّقَابِ وَأَقَامَ الصَّلَاةَ وَآتَى الزَّكَاةَ وَالْمُوفُونَ بِعَهْدِهِمْ إِذَا عَاهَدُوا وَالصَّابِرِينَ فِي الْبَأْسَاءِ وَالضَّرَّاءِ وَحِينَ الْبَأْسِ أُولَئِكَ الَّذِينَ صَدَقُوا وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُتَّقُونَ
‘সৎকর্ম শুধু এই নয় যে, তোমরা পূর্ব ও পশ্চিমে মুখ ফিরাবে বরং সৎ কাজ হ’ল, যে ঈমান আনবে আল্লাহর উপর, পরকালের উপর, ফেরেশতাদের উপর এবং সমস্ত কিতাব ও নবী-রাসূলগণের উপর। আর সম্পদ ব্যয় করবে তারই মহববতে আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম মিসকীন, মুসাফির, ভিক্ষুক ও মুক্তিকামী ক্রীতদাসদের জন্য। আর যারা ছালাত প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত আদায় করে এবং যারা কৃতপ্রতিজ্ঞা পালনকারী এবং অভাবে, রোগে-শোকে ও যুদ্ধের সময় ধৈর্য ধারণকারী; তারাই সত্যাশ্রয়ী এবং তারাই আল্লাহভীরু’ (বাক্বারাহ ১৭৭)।
আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা মুত্তাক্বী তথা আল্লাহভীরুদের গুণাবলীতে একদিকে যেমন ঈমান ও ছালাতের মত মৌলিক ইবাদতের কথা উল্লেখ করেছেন, তেমনি অন্যদিকে তিনি যাকাত এবং সমাজের অসহায় নিঃস্বদের সাহায্য-সহায়তার মত সামাজিক কার্যক্রমের কথাও উল্লেখ করেছেন। এ থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, ব্যক্তিগত ইবাদত-বন্দেগীর পাশাপাশি সামাজিক দায়িত্ব পালনও ইবাদত হিসাবে গণ্য হবে। নিম্নে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সামাজিক বিষয় আলোচিত হ’ল।
(১) অসহায়দের সাহায্য-সহায়তা : সমাজের বিধবা, ইয়াতীম ও দুঃস্থদের সাহায্য-সহযোগিতা করা বড় ইবাদত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, السَّاعِى عَلَى الأَرْمَلَةِ وَالْمِسْكِيْنِ كَالْمُجَاهِدِ فِىْ سَبِيْلِ اللهِ وَأَحْسِبُهُ قَالَ وَكَالْقَائِمِ لاَ يَفْتُرُ وَكَالصَّائِمِ لاَ يُفْطِرُ ‘যে ব্যক্তি বিধবা ও মিসকীনদের সমস্যা সমাধানের জন্য ছুটোছুটি করে সে যেন আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে লিপ্ত। বর্ণনাকারী বলেন, আমার মনে হয় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একথাও বলেছেন, সে যেন ঐ ব্যক্তির ন্যায় যে সারা রাত ছালাত আদায় করে এবং সারা বছরই ছিয়াম পালন করে’।[1]
(২) রোগীর খোঁজ-খবর নেয়া : সমাজের কেউ অসুস্থ হ’লে তার খোঁজ-খবর নেয়া একজন মুসলিমের অন্যতম দায়িত্ব। রুগ্ন ব্যক্তির দেখা-শোনার বিষয়টি ইসলামী শরী‘আত অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, أَطْعِمُوا الْجَائِعَ وَعُوْدُوا الْمَرِيْضَ وَفُكُّوا الْعَانِىَ- ‘ক্ষুধার্তকে খাদ্য দান কর, রুগ্ন ব্যক্তির দেখাশুনা কর এবং বন্দীকে মুক্ত কর’।[2] অন্যত্র তিনি বলেন, عُوْدُو الْمَرِيْضَ، وَاةَّبِعُوا الْجَنَائِزَ، ةُذَكِّرُكُمُ الْآخِرَةَ ‘রুগ্ন ব্যক্তিকে দেখতে যাবে এবং জানাযার অনুসরণ করবে (কাফন-দাফনে অংশগ্রহণ করবে), তাহ’লে তা তোমাকে আখেরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দিবে’।[3] এটা বিরাট পূণ্যের কাজও বটে। নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, إِنَّ الْمُسْلِمَ إِذَا عَادَ أَخَاهُ الْمُسْلِمَ لَمْ يَزَلْ فِىْ خُرْفَةِ الْجَنَّةِ حَتَّى يَرْجِعَ ‘একজন মুসলিম যখন তার কোন রুগ্ন মুসলমান ভাইকে দেখতে যায় তখন সে যেন জান্নাতের বাগানে ফল আহরণ করতে থাকে, যতক্ষণ না সে ফিরে আসে’।[4] অন্য বর্ণনায় এসেছে, مَنْ عَادَ مَرِيْضًا لَمْ يَزَلْ فِىْ خُرْفَةِ الْجَنَّةِ. قِيْلَ يَا رَسُوْلَ اللهِ وَمَا خُرْفَةُ الْجَنَّةِ قَالَ جَنَاهَا ‘কোন ব্যক্তি যখন রোগীকে দেখতে যায়, তখন সে জান্নাতের উদ্যানে ফল আহরণ করতে থাকে। বলা হ’ল, হে রাসূল (ছাঃ)! খুরফা কি? তিনি বললেন, জান্নাতের ফল’।[5] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ عَادَ مَرِيْضًا خَاضَ فِى الرَّحْمَةِ، حَتَّى إِذَا قَعَدَ اسْتَقَرَّ فِيْهَا. ‘যদি কোন ব্যক্তি কোন রুগীর পরিচর্যা করে, সে রহমতের মধ্যে ডুব দেয়, এমনকি সে যখন সেখানে বসে পড়ে, তখন তো রীতিমতো রহমতের মধ্যেই অবস্থান করে’।[6]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরো বলেন, مَنْ عَادَ مَرِيْضًا أَوْ زَارَ أَخًا لَهُ فِى اللهِ نَادَاهُ مُنَادٍ أَنْ طِبْتَ وَطَابَ مَمْشَاكَ وَتَبَوَّأْتَ مِنَ الْجَنَّةِ مَنْزِلاً. ‘কোন ব্যক্তি কোন রুগ্ন ব্যক্তির পরিচর্যা করলে অথবা আল্লাহর উদ্দেশ্যে তার কোন ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করলে, একজন আহবানকারী (অন্য বর্ণনায় রয়েছে আল্লাহ তা‘আলা) তাকে ডেকে ডেকে বলে, তুমি উত্তম কাজ করেছ, তোমার পদচারণা উত্তম হয়েছে এবং জান্নাতে তুমি একটি ঘর তৈরি করে নিয়েছ’।[7] অন্য হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
مَا مِنْ مُسلِمٍ يَعُوْدُ مُسْلِمًا غُدْوَةً إِلاَّ صَلَّى عَلَيْهِ سَبْعُوْنَ أَلْفَ مَلَكٍ حَتَّى يُمْسِىَ وَإِنْ عَادَه عَشِيَّةً إِلاَّ صَلَّى عَلَيْهِ سَبْعُوْنَ أَلْفَ مَلَكٍ حَتَّى يُصْبِحَ وَكَانَ لَه خَرِيْفٌ فِىْ الْجَنَّةِ.
‘এমন কোন মুসলমান নেই যে সকাল বেলা কোন মুসলমান রোগীকে দেখতে যায়, তার জন্য সন্ধ্যা পর্যন্ত সত্তর হাযার ফেরেশতা দো‘আ না করে। আর সন্ধ্যা বেলা কোন রোগী দেখতে যায়, সকাল পর্যন্ত তার জন্য সত্তর হাযার ফেরেশতা দো‘আ না করে। আর তার জন্য জান্নাতে একটি ফলের বাগান সুনির্ধারিত করে দেয়া হয়’।[8]
(৩) শোকাহতকে সান্ত্বনা প্রদান : সমাজের কোন ব্যক্তি কোন দুর্ঘটনায় পতিত হ’লে তার পাশে দাঁড়ানো, তাকে সান্ত্বনা প্রদান করা ও আশার বাণী শোনানো বিরাট ছওয়াবের কাজ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَا مِنْ مُؤْمِنٍ يُعَزِّى أَخَاهُ بِمُصِيْبَةٍ إِلاَّ كَسَاهُ اللهُ سُبْحَانَهُ مِنْ حُلَلِ الْكَرَامَةِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ- ‘যে ব্যক্তি তার মুমিন ভাইকে বিপদে সান্ত্বনা প্রদান করবে, আল্লাহ তা‘আলা ক্বিয়ামতের দিন তাকে সম্মানের পোশাক পরিধান করাবেন’।[9]
(৪) মৃতব্যক্তির পরিবার-পরিজনের জন্য খাদ্য সরবরাহ : কোন ব্যক্তি মারা গেলে তার পরিবার-পরিজন শোকে মুহ্যমান থাকে। ঐ সময় পাড়া-প্রতিবেশীদের কর্তব্য হ’ল তাদেরকে খাদ্য সরবরাহ করা। মুতার যুদ্ধে জা‘ফর (রাঃ) শহীদ হ’লে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছাহাবীদেরকে বলেছিলেন, اصْنَعُوا لآلِ جَعْفَرٍ طَعَامًا فَقَدْ أَتَاهُمْ مَا يَشْغَلُهُمْ أَوْ أَمْرٌ يَشْغَلُهُمْ ‘তোমরা জা‘ফরের (রাঃ) পরিবারের জন্য খাদ্যের ব্যবস্থা কর, কেননা আজ তাদের প্রতি এমন জিনিস বা এমন বিষয় এসেছে, যা তাদেরকে ব্যস্ত রেখেছে’।[10]
(৫) প্রতিবেশীর খবর রাখা ও তার সাথে ভাল ব্যবহার করা : পাড়া-প্রতিবেশীর খোঁজ-খবর নেয়া একজন মুসলিমের কর্তব্য। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন,
وَاعْبُدُوا اللهَ وَلاَ تُشْرِكُوْا بِهِ شَيْئًا وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا وَبِذِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِيْنِ وَالْجَارِ ذِي الْقُرْبَى وَالْجَارِ الْجُنُبِ وَالصَّاحِبِ بِالْجَنْبِ–
‘আল্লাহর ইবাদত কর তাঁর সাথে কাউকে শরীক করো না। পিতা-মাতার সাথে সৎ ব্যবহার কর এবং নিকটাত্মীয়, ইয়াতীম, মিসকীনদের সাথে ভাল ব্যবহার কর। নিকট প্রতিবেশী ও দূর প্রতিবেশী এবং সহকর্মীদের সাথে ভাল ব্যবহার কর’ (নিসা ৩৬)।
প্রতিবেশীর সাথে সদাচরণ করা সম্পর্কে বহু হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। যেমন- রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, وَاللهِ لاَ يُؤْمِنُ وَاللهِ لاَ يُؤْمِنُ وَاللهِ لاَ يُؤْمِنُ قَالُوا وَمَا ذَاكَ يَا رَسُولَ اللهِ قَالَ الْجَارُ لاَ يَأْمَنُ جَارُهُ بَوَائِقَهُ ‘আল্লাহর কসম! সে মুমিন নয়, আল্লাহর কসম! সে মুমিন নয়, আল্লাহর কসম! সে মুমিন নয়। জিজ্ঞেস করা হ’ল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! কে সেই ব্যক্তি? তিনি বললেন, যার অন্যায় থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদ থাকে না’।[11] অন্য হাদীছে এসেছে, مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَلاَ يُؤْذِ جَارَهُ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ্ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন তার প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়’।[12]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, لَيْسَ الْمُؤْمِنُ بِالَّذِيْ يَشْبَعُ وَجَارُهُ جَائِعٌ إِلَى جَنْبِهِ ‘যে ব্যক্তি তৃপ্তি সহকারে পেটপুরে খায়, অথচ তার পাশেই তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকে সে ঈমানদার নয়’।[13] অন্য হাদীছে এসেছে, لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مَنْ لاَ يَأْمَنُ جَارُهُ بَوَائِقَهُ. ‘সে ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না যার অনিষ্ট থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদ নয়’।[14]
রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, مَا يُوْصِيْنِي بِالْجَارِ حَتَّى ظَنَنْتُ أَنَّهُ سَيُوَرِّثُهُ ‘জিবরীল (আঃ) এসে আমাকে প্রতিবেশীর ব্যাপারে অবিরত উপদেশ দিতে থাকতেন। এমনকি মনে হ’ত যে, হয়তো তিনি প্রতিবেশীকে সম্পদের অংশীদার বানিয়ে দিবেন’।[15]
রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, أَوَّلُ خَصْمَيْنِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ جَارَانِ ‘কিবয়ামতের মাঠে প্রথম যে বাদী বিবাদীর বিচার হবে তারা হচ্ছে দুই প্রতিবেশী’।[16]
ইসলাম প্রতিবেশীদের প্রতি কর্তব্য পালনে এবং তাদের খোঁজ-খবর রাখতে মুসলিমকে সদা উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করেছে। যেমন- রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, يَا نِسَاءَ الْمُسْلِمَاتِ لاَ تَحْقِرَنَّ جَارَةٌ لِجَارَتِهَا وَلَوْ فِرْسِنَ شَاةٍ ‘হে মুসলিম মহিলাগণ! কোন প্রতিবেশী যেন তার প্রতিবেশীকে তুচ্ছ মনে না করে, এমনকি ছাগলের পায়ের ক্ষুর হ’লেও প্রতিবেশীর নিকট পাঠাবে’।[17] তিনি আরো বলেন, يَا أَبَا ذَرٍّ إِذَا طَبَخْتَ مَرَقَةً فَأَكْثِرْ مَاءَهَا وَتَعَاهَدْ جِيرَانَكَ ‘হে আবূ যার! যখন তুমি তরকারী রান্না কর, তখন একটু বেশী পানি দিয়ে ঝোল বেশী করো এবং তোমার প্রতিবেশীর হক্ব পৌঁছে দাও’।[18]
প্রতিবেশীর যেন কোন অসুবিধা না হয়, ইসলাম সেদিকে লক্ষ্য রাখতে বলেছে। এমনকি নিজের ক্ষতি হলেও প্রতিবেশীর সুযোগ-সুবিধা করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, لاَ يَمْنَعْ أَحَدُكُمْ جَارَهُ أَنْ يَغْرِزَ خَشَبَةً فِي جِدَارِهِ ‘এক প্রতিবেশী যেন অপর প্রতিবেশীকে দেয়ালের সাথে খুঁটি গাড়তে নিষেধ না করে’।[19]
(৬) ঋণ প্রদান : জীবনে চলতে গিয়ে অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল ব্যক্তিতো বটেই, এমনকি সচ্ছল ব্যক্তিরও কখনো কখনো ঋণ গ্রহণের প্রয়োজন হ’তে পারে। এ অবস্থায় যার নিকট ঋণ প্রদানের মত অর্থ থাকবে তার দায়িত্ব হ’ল ‘করযে হাসানা’ বা সুদমুক্ত ঋণ প্রদান করে তার মুসলিম ভাইকে সহায়তা করা। এতে অনেক ছওয়াব রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَا مِنْ مُسْلِمٍ يُقْرِضُ مُسْلِمًا قَرْضًا مَرَّتَيْنِ إِلاَّ كَانَ كَصَدَقَتِهَا مَرَّةً ‘যদি কোন মুসলিম ব্যক্তি তার অপর কোন মুসলিম ভাইকে (টাকা-পয়সা) দুইবার ঋণ প্রদান করে তবে তার আমলনামায় এ অর্থ একবার ছাদাক্বা করে দেয়ার ছওয়াব লিখা হবে’।[20]
(৭) সমস্যাগ্রস্তের সমস্যা সমাধান করা : সমাজের কোন লোক যখন সমস্যায় আক্রান্ত হয় তখন সকলের কর্তব্য হ’ল তাকে এ বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, وَمَنْ فَرَّجَ عَنْ مُسْلِمٍ كُرْبَةً فَرَّجَ اللهُ عَنْهُ كُرْبَةً مِنْ كُرُبَاتِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ ‘যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের কোন দুঃখ দূর করবে তার বিনিময়ে আল্লাহ তা‘আলা ক্বিয়ামতের দিন তার দুঃখ দূর করে দিবেন’।[21] রাসূল (ছাঃ) আরো বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোন মুমিনের পার্থিব দুঃখ-কষ্ট দূর করবে, আল্লাহ ক্বিয়ামতে তার দুঃখ-কষ্ট দূর করবেন। যে ব্যক্তি কোন সংকটাপন্ন ব্যক্তির সংকট নিরসন করবে, আল্লাহ তার দুনিয়া ও আখিরাতের যাবতীয় সংকট নিরসন করে দিবেন। যে ব্যক্তি কোন মুসলিমের দোষ-ত্রুটি গোপন রাখে, আল্লাহ দুনিয়া ও আখিরাতে তার দোষ-ত্রুটি গোপন রাখবেন। আর আল্লাহ ততক্ষণ পর্যন্ত বান্দার সাহায্য করে থাকেন, যতক্ষণ পর্যন্ত বান্দা নিজ ভাইয়ের সাহায্যে রত থাকে’।[22]
অপর এক হাদীছে রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘প্রত্যেক মুসলমানের উপর ছাদাক্বা করা ওয়াজিব। একজন প্রশ্ন করলেন, যদি কারো সে সামর্থ্য না থাকে, তবে কি হবে? … ছাহাবাদের পর্যায়ক্রমিক প্রশ্নের উত্তরে এক পর্যায় তিনি বলেন, فَيُعِيْنُ ذَا الْحَاجَةِ الْمَلْهُوْفَ ‘তাহ’লে কোন দুঃখে বা বিপদে পতিত ব্যক্তিকে সাহায্য করবে’।[23]
(৮) ন্যায়সঙ্গতভাবে বিচার-ফয়ছালা করা : সমাজে কোন বিষয়ে কোন বিবাদ দেখা দিলে ন্যায়সঙ্গতভাবে এর সমাধান করা ইসলামের নির্দেশ। এতে ছাদাক্বার ছওয়াব পাওয়া যায়। বিবাদ ফায়ছালার জন্য আল্লাহর নির্দেশ, إِنَّمَا الْمُؤْمِنُوْنَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُوْا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ وَاتَّقُوا اللهَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُوْنَ. ‘নিশ্চয়ই মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই। সুতরাং তোমাদের ভাইদের মধ্যে মীমাংসা করে দাও। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। আশা করা যায় তোমরা রহমতপ্রাপ্ত হবে’ (হুজুরাত ৪৯/১০)। অন্যত্র মহান আল্লাহ এ ব্যাপারে সীমা অতিক্রমকারীর বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগেরও নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন,وَإِنْ طَائِفَتَانِ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ اقْتَتَلُوْا فَأَصْلِحُوْا بَيْنَهُمَا فَإِنْ بَغَتْ إِحْدَاهُمَا عَلَى الْأُخْرَى فَقَاتِلُوا الَّتِيْ تَبْغِيْ حَتَّى تَفِيْءَ إِلَىْ أَمْرِ اللَّهِ فَإِنْ فَاءَتْ فَأَصْلِحُوْا بَيْنَهُمَا بِالْعَدْلِ وَأَقْسِطُوْا إِنَّ اللهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِيْنَ. ‘মুমিনদের দুই দল দ্বন্দ্বে লিপ্ত হ’লে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দিবে; আর তাদের একদল অপর দলের বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ি করলে যারা বাড়াবাড়ি করে তাদের বিরুদ্ধে তোমরা যুদ্ধ করবে, যতক্ষণ না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে। যদি তারা ফিরে আসে, তাহ’লে তাদের মধ্যে ন্যায়সঙ্গতভাবে ফায়ছালা করে দিবে এবং সুবিচার করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সুবিচারকারীদের ভালবাসেন’ (হুজুরাত ৪৯/৯)।
বিবাদ মীমাংসার বিষয়টি ইসলামী শরী‘আতে অত্যন্ত গুরুত্ব পূর্ণ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِأَفْضَلَ مِنْ دَرَجَةِ الصِّيَامِ وَالصَّلاَةِ وَالصَّدَقَةِ؟ ‘আমি কি তোমাদেরকে ছিয়াম, ছালাত ও ছাদাক্বার চেয়ে উত্তম মর্যাদাকর বিষয় সম্পর্কে খবর দেব না? ছাহাবীগণ বললেন, অবশ্যই হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেন, إِصْلاَحُ ذَاتِ الْبَيْنِ. ‘বিবাদমান বিষয়ে মীমাংসা করা’।[24]
মুসলিম ভাইদের মাঝে বিবাদমান বিষয় মীমাংসা করে দিলে ছওয়াব পাওয়া যায়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, تَعْدِلُ بَيْنَ الاِثْنَيْنِ صَدَقَةٌ ‘তোমার দুই ব্যক্তির মধ্যে ন্যায়সঙ্গতভাবে বিচার-ফায়ছালা করা একটি ছাদাক্বা’।[25]
(৯) সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ : সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করা অন্যতম সামাজিক দায়িত্ব। সম্মিলিতভাবে এ দায়িত্ব পালন করতে হয়। এতে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন হয়। এ ব্যাপারে ইসলামের কঠোর নির্দেশ রয়েছে। সৎকাজের আদেশ দান ও অসৎকাজের নিষেধ করা সম্পর্কে আল্লাহ রাববুল আলামীন বলেন,وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُوْنَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُوْنَ بِالْمَعْرُوْفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ ‘তোমাদের মধ্যে এমন একটা দল থাকতে হবে, যারা মানুষকে কল্যাণের দিকে ডাকবে এবং ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায় থেকে নিষেধ করবে। তারাই হবে সফলকাম’ (আলে-ইমরান ১০৪)।
এ কাজের প্রশংসা করে মহান আল্লাহ বলেন, وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ يَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوْفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَيُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَيُطِيعُونَ اللهَ وَرَسُولَهُ أُولَئِكَ سَيَرْحَمُهُمُ اللهُ إِنَّ اللهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ ‘মুমিন পুরুষ ও নারী তারা পরস্পরের বন্ধু শুভাকাঙ্খী। তারা ভালকাজের আদেশ করে এবং মন্দকাজের নিষেধ করে। তারা আল্লাহকে মান্য করে, তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে। তারা এমন মানুষ যাদের প্রতি আল্লাহ দয়া করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়’ (তওবা ৭১)।
লোকমান হাকীম তার ছেলেকে বলেন, ‘হে আমার পুত্র! ছালাত কায়েম কর, ভালকাজের আদেশ দাও, মন্দকাজের নিষেধ কর। আর যে বিপদই আসুক না কেন তাতে ধৈর্য ধারণ কর। এ কাজগুলি এমন যাতে খুব বেশী বেশী তাকীদ করা হয়েছে’ (লোকমান ১৭)।
আমর বিল মা‘রূফ ওয়াহি আনিল মুনকার তথা সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ না করার পরিণতি সম্পর্কে বহু হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, وَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ لَتَأْمُرُنَّ بِالْمَعْرُوفِ وَلَتَنْهَوُنَّ عَنِ الْمُنْكَرِ أَوْ لَيُوشِكَنَّ اللَّهُ أَنْ يَبْعَثَ عَلَيْكُمْ عِقَابًا مِنْهُ ثُمَّ تَدْعُونَهُ فَلاَ يُسْتَجَابُ لَكُمْ ‘ঐ সত্ত্বার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ! তোমরা অবশ্যই সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করতেই থাকবে অন্যথা আল্লাহ তা‘আলা তাঁর পক্ষ থেকে তোমাদেরকে কঠোর আযাব দ্বারা পাকড়াও করবেন। অতঃপর তোমরা তাঁকে ডাকবে কিন্তু তিনি তোমাদের ডাকে সাড়া দিবেন না’।[26]
জারীর ইবনু আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, যখন কোন মানুষ কোন সম্প্রদায়ের মাঝে পাপের কাজ করে। এ সময় তারা বাধা প্রদান না করে, তাহ’লে আল্লাহ তাদের মরণের পূর্বে তাদের সকলের উপর বিপদ চাপিয়ে দিবেন’।[27]
অন্য হাদীছে এসেছে, আবু বকর ছিদ্দীক (রাঃ) বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, إِنَّ الْقَوْمَ إِذَا رَأَوُا الْمُنْكَرَ فَلَمْ يُغَيِّرُوْهُ عَمَّهُمُ اللهُ بِعِقَابٍ- ‘যখন কোন সম্প্রদায় শরী‘আত বিরোধী কোন কাজ দেখবে এবং তা হ’তে বাধা প্রদান করবে না, তখন আল্লাহ তাদের সকলকে শাস্তি প্রদান করেন’।[28]
নু‘মান ইবনু বাশীর (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘অন্যায়কারী ও অন্যায় দেখে যে ব্যক্তি বাধা প্রদান করে না এমন ব্যক্তিদ্বয়ের উদাহরণ হচ্ছে ঐ সম্প্রদায়ের মত। যে সম্প্রদায় একটি নৌকায় আরোহনের জন্য লটারী করেছে। এতে তাদের কিছু হয়েছে উপর তলার যাত্রী এবং কিছু হয়েছে নীচ তলার। নীচ তলার লোকেরা উপর তলায় পানি আনতে যায়। এতে উপর তলার লোকদের কষ্ট হয়। তখন নীচ তলার লোকেরা কুড়াল দিয়ে পানি বের করার জন্য নৌকার তলা ছিদ্র করতে উদ্ধত হয়। তারপর উপর তলার লোক এসে বলে, তোমাদের কি হয়েছে, তোমরা এমন করছ কেন? তখন তারা বলল, আমরা নীচ তলা থেকে পানি আনতে গেলে তোমাদের কষ্ট হয়। আবার আমাদের পানিরও খুব দরকার। (এ কারণে নৌকার তলা ছিদ্র করে পানি বের করব।) উপরের লোকেরা যদি তাদের কুড়ালটি নিয়ে নেয় এবং তাদেরকে একাজ থেকে বারণ করে তাহ’লে তারা তাদেরকে বাঁচাবে এবং নিজেদেরকেও বাঁচাবে। আর যদি তাদেরকে ছেড়ে দেয়, বাধা না দেয়, তাহ’লে তাদেরকে ডুবিয়ে ধ্বংস করবে এবং নিজেদেরকেও ধ্বংস করবে’।[29] এ হাদীছ দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, যারা অন্যায় করে এবং যারা অন্যায় দেখে বাধা দেয় না, তারা উভয়ই পাপী। তাদের উভয়ের অপরাধ সমান।
অন্যায়কে বাধা দানের পদ্ধতি সম্পকে হাদীছে এসেছে, আবু সাঈদ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমাদের যে কোন ব্যক্তি যে কোন অন্যায় কাজ দেখবে সে যেন তা বল প্রয়োগে বাধা প্রদান করে। এভাবে সম্ভব না হ’লে মুখে বাধা প্রদান করবে। সম্ভব না হ’লে সে অন্যায়কে ঘৃণা করবে। আর অন্তরে ঘৃণা করে বাধা প্রদান করা কাজটি সবচেয়ে দুর্বল ঈমানের পরিচয়’।[30]
যদি আমরা ইসলামের উপরোক্ত সামাজিক বিধানগুলো মেনে চলি তাহলে আমরা একটি সুন্দর সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারব এবং আমরা অশেষ পুণ্যেরও ভাগী হব। মহান আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন। আমীন!
– মুহাম্মাদ ইমদাদুল্লাহ
ভাল পোস্ট