ইসলামের পরিচয়

দুর্নীতি ও ইসলামের দৃষ্টিতে তার প্রতিকার

দুর্নীতি ও তা থেকে উত্তরণের উপায়

‘দুর্নীতি’ শব্দটি নেতিবাচক। এটির ইতিবাচক শব্দ ‘নীতি’। দুর্নীতি শব্দের আভিধানিক অর্থ: রীতি বা নীতিবিরূদ্ধ আচরণ, কুনীতি, অসদাচরণ ও নীতিহীনতা ইত্যাদি। এর আরবী প্রতিশব্দ আল-ফাসাদ বা আল-ইফসাদ এবং ইংরেজি প্রতিশব্দ corruption।

দুর্নীতি বলতে নীতি বা আইন বিরুদ্ধ কাজকেই বুঝানো হয়। দুর্নীতির কোনো সাধারণ বা নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে যদি কোনো পক্ষ শুধু তার একক অথবা অপর পক্ষের/পক্ষসমূহের যৌথ আর্থিক অথবা বৈষয়িক স্বার্থ লাভের উদ্দেশ্যে অন্য কোনো পক্ষের/পক্ষসমূহের ক্ষতি সাধনের মাধ্যমে আইন পরিপন্থী কাজে লিপ্ত হয়, তাহলে ঐ কাজকে দুর্নীতি বলে চিহ্নিত করা হয়। এ সম্পর্কে Oxford advanced Learners dictionary তে বলা হয়েছে  Willing to use their power to do dishonest or illegal things in return money or to get an advantage.

ইচ্ছাকৃতভাবে নিজ ক্ষমতা, অর্থ প্রাপ্তি বা কোনো অবৈধ সুযোগ প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে অসৎ বা কোনো অসঙ্গত কাজে ব্যবহার করাকে বলা হয় দুর্নীতি।

দুর্নীতি সংজ্ঞা প্রসংগে Social work dictionary তে বর্ণিত হয়েছে,    Corruption is in political and public service administration, the abuse of office for personal gain usually through bribery, extortion, influence padding and special treatment given to some citizens and not to others.

“রাজনৈতিক ও সরকারী প্রশাসনে দুর্নীতি বলতে সাধারণত ঘুষ, বল প্রয়োগ বা ভীতি প্রদর্শন, প্রভাব বা ব্যক্তি বিশেষকে বিশেষ সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে অফিস আদালতকে ব্যক্তিগত স্বার্থ লাভের জন্য অপব্যবহার করাকে বুঝায়।”

এ সম্পর্কে ভারতীয় সমাজ বিজ্ঞানী রামনাথ শর্মা বলেন, In corruption a person willfully neglected his specified duty in order to have an undue advantage. “অবৈধ সুযোগ-সুবিধা লাভের জন্য কোনো ব্যক্তির নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালনে ইচ্ছাকৃত অবহেলা-ই-দুর্নীতি।” এছাড়া Transparency international এর অভিমত হলো, corruption is the abuse of public office for private gain “ব্যক্তিগত স্বার্থ লাভের জন্য গণপ্রশাসনের অপব্যবহারকেই দুর্নীতি বলা হয়।

দুর্নীতির মাধ্যমে দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিরা লাভবান হলেও সামগ্রিকভাবে সমাজ ও অর্থনীতির উপর এর মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। তাই সার্বিক বিচারে দুর্নীতি সব সময়ই নেতিবাচক ও পরিত্যাজ্য। সুতরাং সরকারি-বেসরকারি সকল পর্যায়ে ঘুষ, বলপ্রয়োগ বা ভীতি প্রদর্শন বা ব্যক্তি বিশেষের অবৈধ ও অসংগত সুবিধা গ্রহণ এবং নীতি বিরুদ্ধ সকল কাজকেই দুর্নীতি বলা হয়।

বর্তমানে বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ জীবন যাত্রার প্রায় সকল ক্ষেত্রে দুর্নীতি এক মহা বিপর্যয়কর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। এ জঘন্য ব্যাধির করাল গ্রাসে সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ক্রমশ অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে। বর্তমান সমাজে দুর্নীতির অবস্থান এতই শক্তিশালী যে দেশের সাধারণ মানুষ দুর্নীতির কাছে অসহায় হয়ে একে তাদের ভাগ্য বলে মেনে নিয়েছে। গত ৪০ বছরে বাংলাদেশ পর পর তিনবার দুর্নীতির জন্য বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছে। transparency International এর রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশ ২০০১, ২০০২, ২০০৩, ২০০৪, ২০০৫  এ পাঁচ বছরে বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। দুর্নীতি এখন শুধু কোনো এক সেক্টরের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল স্তরে দুর্নীতি মাকড়সার জালের মত বিস্তার লাভ করেছে। এ সম্পর্কে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ২০০৮ সালের ১৮ জুন প্রকাশিত রিপোর্টে  বলা হয়েছে, ২০০৬ সালের জুন থেকে ২০০৭ সালের জুন পর্যন্ত সময়কালে সার্বিকভাবে দেশের ৬৬.৭ শতাংশ পরিবার সেবা গ্রহণ করার সময় কোনো না কোনো ধরনের দুর্নীতির শিকার হয়েছে। ৪২.১ শতাংশ পরিবারকে ঘুষ দিতে হয়েছে। জাতীয়ভাবে প্রদত্ত মোট ঘুষের পরিমাণ প্রায় ৫৪৭৪ কোটি টাকা।এসব ঘুষ ও দুর্নীতিতে জড়িত রয়েছেন মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সচিব, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা থেকে শুরু করে মন্ত্রণালয় ও সরকারের নিম্নপদস্থ কর্মকর্তা কর্মচারী প্রায় সকলেই। শীর্ষ স্থানীয় দুর্নীতিগ্রস্থ সেবা খাতগুলোর মধ্যে শিক্ষাখাত অন্যতম। এ খাতে ২০০৮ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী বছরে ১১৭ কোটি টাকার ঘুষ লেনদেন হয়েছে।

দুর্নীতি একটি সামাজিক অভিশাপ। কোনো জাতির ধ্বংসের পূর্বে তাদের মধ্যে দুর্নীতি মহামারীর মত বিস্তার লাভ করে থাকে। আল্লাহ তা‘আলা বিভিন্ন যুগে পৃথিবীর বিভিন্ন জাতিকে শাস্তি দেওয়ার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে আল-কুরআনে বলেন:

﴿ٱلَّذِينَ طَغَوۡاْ فِي ٱلۡبِلَٰدِ ١١ فَأَكۡثَرُواْ فِيهَا ٱلۡفَسَادَ ١٢ فَصَبَّ عَلَيۡهِمۡ رَبُّكَ سَوۡطَ عَذَابٍ ١٣ إِنَّ رَبَّكَ لَبِٱلۡمِرۡصَادِ ١٤ ﴾ [الفجر: ١١،  ١٤]

“যারা দেশে সীমালঙ্ঘন করেছে এবং তাতে বড় বেশি দুর্নীতি করেছে, তখন তাদের ওপর তোমার প্রভু শাস্তির কশাঘাত হানলেন। নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক গভীরভাবে পর্যবেক্ষণে রেখেছেন।” (আল-কুরআন, ৮৯: ১১-১৪)

এই আয়াতে বলা হচ্ছে যে, যখন দেশে দেশে আইন ও অধিকারের সীমা লঙ্ঘিত হয়, মহান আল্লাহর বিধানের বিরুদ্ধাচরণ করা হয় এবং এই দুর্নীতি বিস্তারের ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হয় অর্থাৎ দুর্নীতি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়ে তখন আল্লাহ তা‘আলা ওই দেশ ও জাতির ওপর নারাজ হন এবং তাদেরকে নানাভাবে শাস্তি দেন।

সাধারণত পাপী বান্দাদেরকেই সমাজে পাপের পরিণাম ভোগ করতে হয়, কিন্তু যখন কোনো পাপ আল্লাহর বান্দাগণ প্রকাশ্যে সর্বত্র চর্চা করতে থাকে তখন আল্লাহ তা‘আলা চাবুক মারার মত ভয়াবহ শাস্তি দিয়ে থাকেন। এ জন্যই কুরাআনে বলা হয়েছে سَوۡطَ عَذَابٍ  বা শাস্তির চাবুক।

আজ সমাজের সর্বস্তরে দুর্নীতির দাপট দেখতে পাই। কোনো কাজে নিয়ম-নীতি বা আইনের বিধি-বিধান না মেনে নিজের স্বার্থে বেপরোয়া কাজ করে যাওয়াকে এক কথায় দুর্নীতি বলে। আইনের ফাঁকি দিয়ে কখনও কখনও আল্লাহর বান্দাগণ তার পেশীশক্তির প্রভাব খাটিয়ে নিজের মতলব হাসিল করে থাকে। বর্তমানে আমরা দেখতে পাই, অবৈধ সিন্ডিকেট বা অসৎ ফায়দা হাসিলের জন্য ব্যবসায়িক দুষ্টচক্র সৃষ্টি করে দ্রব্যমূল্য বাড়ানো হচ্ছে, খাদ্য, ওষুধ, নির্মাণ সামগ্রীসহ নানা ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সকল ভোগ্যপণ্যে ভেজাল মিশিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে। চাকুরীতে নিয়োগের ক্ষেত্রে অথবা সরকারী-বেসরকারী অফিসে কোনো সুবিধা লাভের ক্ষেত্রে ঘুষের লেনদেন এখন অলিখিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরীক্ষায় নকল, ভোট কারচুপি, দলিল দস্তাবেজে জালিয়াতি, শিক্ষাকে বাণিজ্য বানানো, অবৈধ দখলদারী, অযোগ্য লোককে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব প্রদান, আর্থিক অনিয়ম ইত্যাদি সকল প্রকার দুর্নীতি ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছে। ইসলাম এসব কিছুকেই হারাম ঘোষণা করেছে। আল্লাহ তা‘আলা আল-কুরআনে বহুবার অন্যের অধিকার নষ্ট করাকে হারাম ঘোষণা করেছেন। সহজ ও সঠিক পথ অনুসরণ করার হুকুম দিয়েছেন। আমরা প্রতি সালাতে সূরা ফাতিহা পাঠের সময় বলি:

﴿ ٱهۡدِنَا ٱلصِّرَٰطَ ٱلۡمُسۡتَقِيمَ ٦ ﴾ [الفاتحة: ٦]

“আমাদের সরল সঠিক পথে পরিচালনা করুন।” [সূরা আল-ফাতেহা: ৬]

মহান আল্লাহ আরও বলেন:

﴿ ۞إِنَّ ٱللَّهَ يَأۡمُرُكُمۡ أَن تُؤَدُّواْ ٱلۡأَمَٰنَٰتِ إِلَىٰٓ أَهۡلِهَا وَإِذَا حَكَمۡتُم بَيۡنَ ٱلنَّاسِ أَن تَحۡكُمُواْ بِٱلۡعَدۡلِۚ إِنَّ ٱللَّهَ نِعِمَّا يَعِظُكُم بِهِۦٓۗ إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ سَمِيعَۢا بَصِيرٗا ٥٨ ﴾ [النساء: ٥٨]

“নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন আমানত তার হকদারকে প্রত্যার্পণ করতে। আর তোমরা যখন মানুষের মধ্যে বিচার করবে তখন ন্যায়পরায়ণতার সাথে বিচার করবে। আল্লাহ তোমাদেরকে যে উপদেশ দেন তা কতই না উৎকৃষ্ট! নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা। (আল-কুরআন, ৪: ৫৮)

মহান আল্লাহ আরও বলেন:

﴿ وَلَا تَلۡبِسُواْ ٱلۡحَقَّ بِٱلۡبَٰطِلِ وَتَكۡتُمُواْ ٱلۡحَقَّ وَأَنتُمۡ تَعۡلَمُونَ ٤٢ ﴾ [البقرة: ٤٢]

“আর তোমরা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশ্রিত করো না এবং জেনে শুনে সত্য গোপন করো না।” (আল-কুরআন, ২:৪২)

ভেজাল, জালিয়াতি ও সকল সামাজিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে মহান আল্লাহর এই হুকুম আমাদের মেনে চলতেই হবে। কারণ, বহু আয়াতে অমান্যকারীদের জন্য শাস্তির বাণী উচ্চারিত হয়েছে।

মহান আল্লাহ বলেন:

﴿ وَلَا تَأۡكُلُوٓاْ أَمۡوَٰلَكُم بَيۡنَكُم بِٱلۡبَٰطِلِ وَتُدۡلُواْ بِهَآ إِلَى ٱلۡحُكَّامِ لِتَأۡكُلُواْ فَرِيقٗا مِّنۡ أَمۡوَٰلِ ٱلنَّاسِ بِٱلۡإِثۡمِ وَأَنتُمۡ تَعۡلَمُونَ ١٨٨ ﴾ [البقرة: ١٨٨]

“তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের অর্থ-সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না এবং মানুষের ধন-সম্পত্তির কিছু অংশ জেনে-শুনে অন্যায়ভাবে গ্রাস করার উদ্দেশ্যে তা বিচারকদের কাছে পেশ করো না।” (আল-কুরআন, ২:১৮৮)

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

﴿ وَلَا تَعۡتَدُوٓاْۚ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يُحِبُّ ٱلۡمُعۡتَدِينَ ١٩٠ ﴾ [البقرة: ١٩٠]

“তোমরা সীমালঙ্ঘন করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমালঙ্ঘণকারীদের ভালবাসেন না।” (আল-কুরআন, ২: ১৯০)

এই সীমা আইনের সীমা, ধর্মের সীমা, অধিকারের সীমা বা ধৈর্যের সীমা হতে পারে। হতে পারে তা ক্ষেতের আইল অথবা রাস্তার দুপাশের সীমানা, নদীর তীর অথবা বাড়ী-ঘর নির্মাণের আইনগত সীমানা। ব্যক্তিগত ও সামাজিক আচরণের সীমাও এর আওতায় আসতে পারে।

এ জন্যই প্রত্যাশার সীমা ছাড়িয়ে লোভে পড়ে হালাল রুজি ছেড়ে হারাম সম্পদ অর্জনও সীমালঙ্ঘন বটে।

মহান আল্লাহ আরো বলেন:

﴿ فَكُلُواْ مِمَّا رَزَقَكُمُ ٱللَّهُ حَلَٰلٗا طَيِّبٗا وَٱشۡكُرُواْ نِعۡمَتَ ٱللَّهِ إِن كُنتُمۡ إِيَّاهُ تَعۡبُدُونَ ١١٤ ﴾ [النحل: ١١٤]

আল্লাহ তোমাদের হালাল ও পবিত্র যা দিয়েছেন তা হতে আহার কর এবং আল্লাহর অনুগ্রহ ও নি‘আমতের জন্য শোকর কর। যদি তোমরা কেবল তাঁরই ইবাদত করে থাক। (আল-কুরআন, ১৬: ১১৪)

দেখুন, এখানে মহান আল্লাহর একনিষ্ঠ ইবাদতের সাথে হালাল রুজির সম্পর্ক কীভাবে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ যা কিছু নি‘আমত হিসেবে আমাদেরকে দিয়েছেন তাতে সন্তুষ্ট থেকে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করলে যে তা এক আল্লাহর ইবাদতের পরিপন্থী হয় তা এই আয়াতে মহান আল্লাহ সতর্ক করে দিয়েছেন। পেশীশক্তির প্রদর্শন বা অবৈধভাবে মানুষের অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে যারা বীরদর্প করে তাদের উদ্দেশ্যে মহান আল্লাহ বলেন:

﴿ وَلَا تُصَعِّرۡ خَدَّكَ لِلنَّاسِ وَلَا تَمۡشِ فِي ٱلۡأَرۡضِ مَرَحًاۖ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخۡتَالٖ فَخُورٖ ١٨ ﴾ [لقمان: ١٨]

 “অহঙ্কারবশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না এবং পৃথিবীতে উদ্ধতভাবে বিচরণ করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো উদ্ধত, অহঙ্কারীকে পছন্দ করেন না।” (আল-কুরআন, ৩১:১৮)

তিনি আরও বলেন:

﴿ وَلَا تَمۡشِ فِي ٱلۡأَرۡضِ مَرَحًاۖ إِنَّكَ لَن تَخۡرِقَ ٱلۡأَرۡضَ وَلَن تَبۡلُغَ ٱلۡجِبَالَ طُولٗا ٣٧ ﴾ [الاسراء: ٣٧]

 “ভূ-পৃষ্ঠে দম্ভভরে বিচরণ করো না; তুমি তো কখনও পদভারে ভূ-পৃষ্ঠকে খণ্ড বিখণ্ড করতে পারবে না এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না।” (আল-কুরআন, ১৭: ৩৭)

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«من غش فليس منا»

‘যে ব্যক্তি জালিয়াতি বা সঠিক তথ্য গোপন করল সে আমাদের সমাজভুক্ত নয়।”

তিনি আরও বলেন:

«لا يرحم الله من لا يرحم الناس»

“যে লোক মানুষের প্রতি দয়া করে না, আল্লাহ তার ওপর দয়া করে না[1]।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন:

«المؤمن غر كريم والفاجر خب لئيم»

“মু’মিন ব্যক্তি সদয় ও ভদ্রস্বভাবের হয়ে থাকে আর পাপীষ্ট ব্যক্তি প্রতারক ও নীচ প্রকৃতির হয়ে থাকে[2]।”

দুর্নীতিও এক ধরনের ধোকাবাজি যা মানুষের হক নষ্ট করে এবং প্রকৃত হকদার প্রতারিত হয়ে থাকে। তাই দুর্নীতি করা জাহান্নামী বান্দাদের কাজ।

আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বর্ণনা করেন:

«نهينا أن يبيع حاضر لباد»

“আমাদেরকে গ্রামের উৎপাদিত পণ্য এককভাবে খরিদ করে নিয়ে শহুরেদের কাছে বিক্রয় (অবৈধ সিন্ডিকেট বা ব্যবসায়িক দুষ্টু চক্র) ব্যবস্থা (তৈরী করতে) নিষেধ করা হয়েছে[3]।”

অপর হাদীসে বর্ণিত হয়েছে:

«لَا يَبِيعُ حَاضِرٌ لِبَادٍ، دَعُوا النَّاسَ يَرْزُقُ اللَّهُ بَعْضَهُمْ مِنْ بَعْضٍ»

“কোনো শহরবাসী (এককভাবে অবৈধ সিন্ডিকেট বা ব্যবসায়িক দুষ্টু চক্র করে) গ্রামবাসীর পণ্য বিক্রি করবে না। মানুষকে ছাড় দাও; যাতে তারা একে অপরের মধ্যে স্বাধীন লেনদেন করে রিযিক হাসিল করতে পারে[4]।”

এ ছাড়া সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম দালালী করে পণ্যের দাম বাড়ানোকে প্রতারণামূলক কাজ বলেছেন এবং নিষিদ্ধ করেছেন। অনুরূপভাবে দালালের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে কৃষককে ঠকানোও নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন[5]।”

বস্তুত: দুর্নীতি একটি অনেক বড় গুণাহ। এ থেকে ফিরে আসার একমাত্র পথ হচ্ছে আখিরাতের চিন্তা করে মহান আল্লাহর সতর্কবাণী ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক যে সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে তা কলব-এ ধারণ করে দেশের ভাল মানুষ তথা মহান আল্লাহর ভাল বান্দা হওয়ার চেষ্টা করা। এটা আমাদের সকলেরই দায়িত্ব।

মহান আল্লাহ বলেন:

﴿ بَلَىٰۚ مَنۡ أَسۡلَمَ وَجۡهَهُۥ لِلَّهِ وَهُوَ مُحۡسِنٞ فَلَهُۥٓ أَجۡرُهُۥ عِندَ رَبِّهِۦ وَلَا خَوۡفٌ عَلَيۡهِمۡ وَلَا هُمۡ يَحۡزَنُونَ ١١٢ ﴾ [البقرة: ١١٢]

“হ্যাঁ, যে কেউ আল্লাহর নিকট সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করে এবং সৎকর্মপরায়ণ হয় তার বিনিময় তার প্রতিপালকের নিকট রয়েছে এবং তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না।” (আল-কুরআন, ২:১১২)

অনেক সময় জিন জাতীয় শয়তানের সাথে মানুষ জাতীয় শয়তান মিলিত হয়ে মানুষকে হারাম পথে নিয়ে যাবার জন্য মনের মধ্যে আবেদন সৃষ্টি করে। এই খান্নাস থেকে আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। সূরা নাস-এ মহান আল্লাহ বলেন:

﴿ قُلۡ أَعُوذُ بِرَبِّ ٱلنَّاسِ ١ مَلِكِ ٱلنَّاسِ ٢ إِلَٰهِ ٱلنَّاسِ ٣ مِن شَرِّ ٱلۡوَسۡوَاسِ ٱلۡخَنَّاسِ ٤ ٱلَّذِي يُوَسۡوِسُ فِي صُدُورِ لنَّاسِ ٥ مِنَ ٱلۡجِنَّةِ وَٱلنَّاسِ 6  ﴾ [الناس]

“বলুন (হে রাসূল!) আমি আশ্রয় প্রার্থনা করছি মানুষের প্রতিপালকের, মানুষের আধিপতির, মানুষের মা’বুদ এর নিকট, আত্মগোপনকারী কুমন্ত্রণাদাতার অনিষ্ট থেকে; যে কুমন্ত্রণা দেয় মানুষের অন্তরে; জিনের মধ্য হতে এবং মানুষের মধ্য হতে।” (আল-কুরআন, ১১৪:১-৬)

এই কুমন্ত্রণার স্বরূপ অন্য আয়াতে এসেছে:

﴿ ٱلشَّيۡطَٰنُ يَعِدُكُمُ ٱلۡفَقۡرَ وَيَأۡمُرُكُم بِٱلۡفَحۡشَآءِۖ وَٱللَّهُ يَعِدُكُم مَّغۡفِرَةٗ مِّنۡهُ وَفَضۡلٗاۗ وَٱللَّهُ وَٰسِعٌ عَلِيمٞ ٢٦٨ ﴾ [البقرة: ٢٦٨]  “শয়তান তোমাদেরকে দারিদ্রের ভয় দেখায় এবং অশ্লীলতার নির্দেশ দেয়। আর আল্লাহ তোমাদেরকে তাঁর ক্ষমা ও অনুগ্রহের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। আর আল্লাহ প্রাচুর্যময় ও সর্বজ্ঞ।” (আল-কুরআন, ২:২৬৮)

এখানে শয়তান ভয় দেখায় যে, তুমি দুর্নীতি করে উপার্জন না করলে দরিদ্র হয়ে যাবে এবং অনেক অর্থ-বিত্ত থাকলে অনেক স্ফুর্তি করতে পারবে। ঠিক এর বিপরীত মহান আল্লাহ ওয়াদা করেছেন যে, তিনি বান্দাহকে ক্ষমা করে দেবেন সে পবিত্র হয়ে যায় এবং অনুগ্রহ তথা হালাল রুজি দেবেন যাতে সে দরিদ্র হয়ে না যায়। আয়াতের শেষে মহান আল্লাহ নিজেকে প্রাচুর্যময় বলে বুঝিয়েছেন যে, আল্লাহর ভান্ডারে কোনো কিছুর অভাব নেই। তিনি হালাল উপার্জনের মাধ্যমে প্রচুর অর্থবিত্তের অধিকারী করে কাউকে বাদশাহও বানাতে পরেন। এরপর তিনি নিজেকে আলীম বা সর্বজ্ঞ বলে জানিয়ে দিয়েছেন, কে কীভাবে বড়লোক হয় আল্লাহ সবই জানেন। তিনি জানেন, হালাল রুজিতে যে কী বরকত!

কাজেই সৎ উপার্জনে আল্লাহর অনুগ্রহ থাকে। আর অসৎপথে উপার্জন দুনিয়া ও আখিরাতে লাঞ্ছনা, অপমান ও দুঃখ বয়ে নিয়ে আসে। মহান আল্লাহর ওয়াদা ফেলে কোনো মুমিন শয়তানের ভয়ে মিথ্যে ওয়াদার পথে পা বাড়াতে পারে না।

কাজেই আসুন! আমরা সমাজের সর্বস্তর থেকে দুর্নীতি দূর করার দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করি এবং এ লক্ষ্যে কাজ করি। আল্লাহ আমাদেরকে তাওফীক দিন, আমীন।

– ড. মোঃ আব্দুল কাদের


[1] হাদীসটি জাবির ইবন আব্দুল্লাহ থেকে বর্ণিত, ইমাম আল- বুখারী, আল-আদাবুল মুফরাদ, অনুচ্ছেদ: ৫৩)

[2] আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু  থেকে বর্ণিত, ইমাম আল-বুখারী, আল- আদাবুল মুফরাদ, অনুচ্ছেদ: ১৯৭)

[3] বুখারী, হাদীস নং ২১৬১।

[4] তিরমিযী, হাদীস নং ১২২৩।

[5] ইমাম মুসলিম, সহীহ মুসলিম, খ. ১০, পৃ. ১৬৪: ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বর্ণিত হাদীস।

২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

আরও দেখুন
Close
Back to top button