ইসলামিক প্রোগ্রাম

শীতের কথা

১.

বেশ ক-বছর আগের কথা। সারিয়াকান্দির একটি চরে গিয়েছিলাম বন্যার্তদের জন্য সামান্য কিছু সহায়তা নিয়ে। নৌকায় যাচ্ছি। বুক পানিতে শত শত মানুষ দাঁড়িয়ে। বড় বড় কিছু এনজিওর ব্যানারও দেখা গেল আশেপাশে।নৌকা থেকে চিড়া,গুড়,পানি, স্যালাইন ইত্যাদি ছুঁড়ে ছুঁড়ে দেওয়া হচ্ছে। যে যা পাচ্ছে লুফে নিয়ে সাঁতরে গ্রামের দিকে চলেযাচ্ছে।দাতারাও নৌকা ঘুরিয়ে চলে যাচ্ছেন- বেশদায়িত্ব পালন হল। সাথে থাকা এক ভাই আমাদের ভাণ্ডার খুলতে চাইলে বাধা দিলাম- “একটু ভিতরে যাই চলেন, আরেকটু দেখা যাক।”

ঘাটে নৌকা ভেড়ানো হল।

চর বলতে যা বোঝায় তার অবশিষ্ট আর কিছুই বাকি নেই। রাস্তারএদিক-ওদিক তল্পি-তল্পাসহ সবাই শুয়ে-বসে।কারো কারো খাটের নিচে ত্রানের বস্তার ছোটখাটো গুদাম চোখে পড়ার মতো। কারো কারো একটা কি দুটো, কারো অনেক বেশি।এরা গ্রামের ঢোকার পথটাতে দাঁড়িয়ে থাকে, নৌকা দিয়ে আসা ত্রাণ লুফে নিয়ে সাঁতরে পাড়ে রেখে আবারও গিয়ে ঠাঁয়দাঁড়িয়ে থাকে বুক-পানিতে—বেদনার্তবদনে, ছলছল নয়নে।

ফলাফল?

গ্রামের অতিবৃদ্ধ, অন্ধ লোকগুলো প্রায় দু-দিন যাবত উপোস আছে। ত্রাণ সংগ্রহের ইঁদুর দৌড়ে এরা নামতে পারেনি। সাঁতরে পানিতে নামার সামর্থ্য নেই যে এদের।

পৃথিবী জুড়ে “How to reach the unreach” নিয়ে এতো তোলপাড়ের কারণ সেদিন বেশ বুঝেছিলাম। ত্যালা মাথায় তেল সবাই ঢালে। ত্যালা মাথাওয়ালা জোর করে তেল জোগাড় করে আনেও বটে। যার আছে সে পেট পুরে খেয়ে বাহু ফুলিয়ে আরও চাইবে, চাইতেই থাকবে। আর যার নেই, সে কোণেই পড়ে থাকে। ফলে যাদের দিন বদলের জন্য এত চেষ্টা তারা দীন-হীনই থেকে যায়। এটা আমাদের আয়েশি সোশ্যাল ওয়ার্কের ফল, ফসল। চীন মৈত্রী সম্মেলনে ফাণ্ড রেইজিং সেহরি নাইট আয়োজন হয়, চিজ কেক খেয়ে এবং খাইয়ে মানবিকতা ভালোই রক্ষা হয়। কিন্তু চরের কাদায় হাঁটতে গেলে যে ভারী কষ্ট।

ঢাকার মহাসড়কে আমরা আকাশ দেখি না। দেখি ‘অপ্রতিরোধ্য গতিতে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়া’। কিন্তু আমাদের সফরের অভিজ্ঞতাগুলো অন্য এক বার্তা দেয়। বারো ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রার জলঢাকার প্রত্যন্ত গ্রামে মাদরাসার ছোট্ট ইয়াতিম ছেলেটাকে যখন দেখবেন শুধু একটা পাঞ্জাবি আর গেঞ্জি গায়ে ঢুলে ঢুলে কুর’আন পড়ছে, বিশ্বাস করুন আপনার চোখের পানি আপনি ধরে রাখতে পারবেন না। নিজের চামড়ার জ্যাকেটের জন্য নিজের কাছেই লজ্জা লাগবে। এমন জায়গাতে আমরা গিয়েছি যেখানে মা এবং মেয়ে দুজনের একটিমাত্র পোশাক। ঘর হতে বেরুতে গেলে তাদের পালা করে বেরুতে হয়। আমরা দেখেছি কীভাবে মানুষ এবং মানুষের বাচ্চা কীভাবে গরু এবং ছাগলের সাথে একই ঘরে রাত কাটায়। এই হনুমধ্য আয়ের দেশটাতেই গতশীতে কত জন শরীরটা একটু আগুনে তাঁতাতে গিয়ে আগুন লেগে পুড়ে গেছে জানেন? এ দেশে কোটি কোটি টাকা খরচ করে পতাকা ওড়ানোর বিশ্ব রেকর্ডহয়, আবার দুশ টাকার শাড়ি আনতে গিয়ে পায়ের তলায় ভর্তা হয়ে মানুষ মারা যায়। শীত আসলেই মানুষ মারা যাবে—এটাই স্বাভাবিক, এভাবেই না জনসংখ্যা কমবে।

এমনটাই কী চলতে থাকবে? চলতে থাকা উচিত?

২.

আপনার সামর্থ্য সামান্য, সময় কম, সীমাবদ্ধতা হাজারো। সব মানি। কিন্তু আপনার সাহায্য করার মানসিকতাটা আছে তো? আপনার ড্রাইভারের বাড়ি ঠাকুরগাঁতে—তার মায়ের জন্য তো একটি গরম জামা পাঠাতে পারেন, তার বাবার জন্য একটা কম্বল। সামর্থ্য থাকলে তার আর কিছু গরীব আত্মীয়স্বজনদের জন্য আরো কিছু।

সম্ভব হলে যান উত্তরাঞ্চলের কোনো এক গ্রামে। দেখেন গরীব মানুষেরা কীভাবে থাকে। অনুভব করতে পারবেন শীত কাকে বলে। শীতের পিঠানা হোক; কিন্তু ঐ হতদরিদ্র পরিবারটি ঠিকই আপনাকে টিমটিমে কুপি বাতির নিচে মোটা চালের ভাত আর মরিচ ভর্তার দাওয়াত দেবে। সামর্থ্য থাকলে ডিমের সালুন। এটাই ওদের আন্তরিকতা। ওদের পিঠের নিচে ঘুমানোর জন্য নরম গদি নেই, খড়ের বিছানা সম্বল। ওদের এলিওন মহিষের গাড়ি, পালসার নীলম সাইকেল। নয়ত দুটি পা। দুটি সারাটি দিন কাটানোর পরে আপনি বুঝতে পারবেন আপনি কত ভালো আছেন, থাকেন।

এ তো গেল নিজের আত্মোপলব্ধি। ওদের জন্য আপনি কী করতে পারেন?

রসুল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের জানিয়েছেন শীতের তীব্রতার কামড়ের সাথে জাহান্নামের শীতল অংশটির সম্পর্ক আছে।[1] ব্যাপারটা এমন নয় যে দুনিয়ার শীত দুনিয়াতেই শেষ। যে জাহান্নামের একটিমাত্র নিঃশ্বাসের সাথে দুনিয়ার সবচেয়ে ভয়াবহ শীত তুলনীয়, সেখানে জাহান্নামে কী শীত অপেক্ষা করছে? এদিকে জারীর ইবনু আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে লোক মানুষের প্রতি দয়া-অনুগ্রহ প্রদর্শন করে না তাকে আল্লাহ তা’আলাও দয়া করেন না।[2]

আল্লাহর দয়া ছাড়া কী আমরা জাহান্নাম থেকে বাঁচতে পারব? জান্নাতে যেতে পারব? দুনিয়ার লেপের ওম কয়দিনের?

আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে কোনো মুসলিমের পার্থিব বিপদাপদের মধ্যে একটি বিপদও দূর করে দেয়, আল্লাহ তা’আলা তার পরকালের বিপদাপদের কোনো একটি বিপদ দূর করে দিবেন। যে লোক দুনিয়াতে অন্য কারো অভাব দূর করে দেয়, তার দুনিয়া ও আখিরাতের অসুবিধাগুলোকে আল্লাহ তা’আলা সহজ করে দেবেন।[3]

৩.

শীতে উত্তরাঞ্চলে কম্বল বিলি করার অভিজ্ঞতা আমাদের অনেক দিনের। কিন্তু আমরা দেখেছি বাজার থেকে কেনা ৬০০-৭০০ টাকার দুপরতের কম্বলগুলোও খুব ভালো ওম দেয় না। শেষমেশ আমরা নিজেরাই শুরু করি কম্বল তৈরি করার কাজ। আলহামদুলিল্লাহ, একটি-দুটি থেকে শুরু করতে করতে এখন আমাদের ছোট্ট একটা কম্বল কারখানা আছে বগুড়ার ধুনটে। ঝুট কাপড় থেকে তৈরি করা জোড় কম্বল। দুপরতের ভাজে ভাজে কাপড় থাকে অনেক – ফলে কম্বলটা কাজ করে লেপের মতো। এই কম্বলগুলো আমরা খোলা বাজারে বিক্রি করি ৫০০ টাকা করে। তবে যদি কেউ বিতরণ করতে চান তার জন্য ১০০ টাকা ছাড় দিই আমরা।

আপনার যে কয়টি কেনার সামর্থ্য আছে কেনেন, বিলি করেন। যদি দেখেন আপনার সামর্থ্য সীমিত কিন্তু ঐ গ্রামটিতে অনেক গরীব তাহলে একটা তালিকা করে আনেন। আমরা তালিকা অনুযায়ী তদারক করে দেখব, তারপর তাদের হাতে একটা টোকেন দিয়ে আসব। এরপরে আপনি নিজেই সময় করে চলেন কম্বল নিয়ে—তাদের হাতে তুলে দেন। দেখবেন ভোগের চেয়ে ভাগাভাগিতে সুখ বেশী।

এ মাসের ১৮ তারিখ থেকে শুরু হচ্ছে সরোবরের কম্বল বিতরণ ১৪৩৭ ইন শা আল্লাহ । আমরা বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে কম্বল, শীতবস্ত্র বিতরণ করি। এই বিতরণে যারা আমাদের সঙ্গী হতে চান তাদের যারা আমাদের সাথে সশরীরে যেতে চান তারা জানাতে পারেন:

https:/goo.gl/Uauf7Q

মানুষের সীমাবদ্ধতা থাকে আমরা বুঝি। যারা ইচ্ছে থাকলেও যেতে পারছেন না তারা আমাদের সাথে শরীক হতে পারেন আর্থিকভাবে। ৪০০ টাকা দিয়ে একটি কম্বল কিনে দিলে আমরা চেষ্টা করব হকদার মানুষদের কাছে পৌছে দিতে। আপনার কী ধরণের কম্বল পছন্দ সেটা সরোবরের দোকানে এসে বেছে দিতে পারেন। যাদের জন্য নগদ অর্থ হাতবদল করা কঠিন তারা ব্যাংকে দিতে পারেন। তবে অবশ্যই আপনাদের নাম, টাকার পরিমাণ অর্থাৎ কম্বলের সংখ্যাটা জানিয়ে দেবেন ০১৮৬১০০৫৫৫৫ নম্বরে।

A/C name: Shorobor, A/C number: 3556 901 001127

Pubali Bank Limited, Islami Banking Window, Principal Branch, Dhaka

যাদের পক্ষে সেটাও কঠিন তারা বিকাশ করেও কম্বলের দাম দিতে পারেন। ০১৮৬১০০৫৫৫৫ আমাদের মার্চেন্ট নম্বর। তবে অবশ্যই একটি মেসেজে আপনার নাম, কম্বলের পরিমাণ এবং টাকার অঙ্ক নিশ্চিত করতে হবে।

উল্লেখ্য সরোবর কম্বল কারখানার কম্বল বিক্রির লভ্যাংশ থেকে বহু মানুষের হালাল রিযকের পাশাপাশি একটি মাদ্রাসার শিক্ষকদের বেতনসহ অন্যান্য খরচ নির্বাহ করা হয়। মানুষকে শীত থেকে রক্ষার পাশাপাশি এই সামাজিক ব্যবসাটা দিয়ে আমরা সুদ এবং বেকারত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করি।

রসুল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন অর্ধেক খেজুর দিয়ে হলেও জাহান্নাম থেকে বাঁচতে[4]। সুতরাং, সম্পদের সীমাবদ্ধতা যেনঅন্য মানুষকে সাহায্য করার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র দ্বিধা-সংশয়ের সৃষ্টি করতে না পারে।

“যারা স্বীয় ধন-সম্পদ ব্যয় করে, রাত্রে ও দিনে, গোপনে ও প্রকাশ্যে। তাদের জন্যে তাদের সওয়াব রয়েছে তাদের পালনকর্তার কাছে। তাদের কোন আশংঙ্কা নেই এবং তারা চিন্তিত-ও হবে না।” [সূরা আল বাকারাঃ২৭৪]

আমরা যেন আত্মত্যাগের বিনিময়ে আল্লাহসুবহানাহুতায়ালার নিকটবর্তী হতে পারি। আমিন।

 

সরোবর

________

[1]সহীহ আল বুখারী ৫৩৭, সহীহ মুসলিম ৬১৭।

[2]সুনানে তিরমিযি ১৯২২

[3]ইবনু মাজাহ (১২২৫), মুসলিম, সুনানে তিরমিযি ১৯৩০

[4]সুনানে নাসাঈ ২৫৫২

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

Back to top button