হজ্জ ও ওমরাহ

মীক্বাত, ইহরাম বাঁধার নিয়ম ও ইহরামের পর নিষিদ্ধ বিষয় সমূহ

মীক্বাত  (مواقيت الحج)

মীক্বাত  (مواقيت الحج) : ইহরাম বাঁধার স্থানকে ‘মীক্বাত’ বলা হয়। মীক্বাত পাঁচটি :(১) মদীনা বাসীদের জন্য ‘যুল হুলাইফা’ যা মদীনা থেকে প্রায় ১০ কিঃমিঃ দক্ষিণ-পূর্বে এবং মক্কা থেকে উত্তর-পশ্চিমে ৪৫০ কিঃ মিঃ দূরে অবস্থিত (২) শাম বা সিরিয়া বাসীদের জন্য ‘জুহ্ফা’ যা মক্কা থেকে উত্তর-পশ্চিমে ১৮৩ কিঃ মিঃ দূরে অবস্থিত। বর্তমানে এর নিকটবর্তী ‘রাবেগ’ নামক স্থান থেকে ইহরাম বাঁধা হয় (৩) ইরাক বাসীদের জন্য ‘যাতু ‘ইর্ক্ব’ যা মক্কা থেকে সোজা উত্তরে ৯৪ কিঃ মিঃ দূরে অবস্থিত (৪) নাজ্দ বাসীদের জন্য ‘ক্বারনুল মানাযিল’ যা মক্কা থেকে উত্তর-পূর্বে ৭৫ কিঃ মিঃ দূরে অবস্থিত। যাকে এখন ‘আস-সায়লুল কাবীর’ বলা হয় (৫) পাক-ভারত উপমহাদেশ ও ইয়ামন বাসীদের জন্য ইয়ালামলাম পাহাড়। যা মক্কা থেকে সোজা দক্ষিণে ৯২ কিঃ মিঃ দূরে অবস্থিত। যার নিকটবর্তী ‘আস-সা‘দিয়াহ’ থেকে এখন ইহরাম বাঁধা হচ্ছে। জেদ্দা হ’তে উত্তরে মক্কা অভিমুখী আল-লাইছ সড়কে অবস্থিত এই স্থানে বর্তমানে ‘মীক্বাত মসজিদ’ স্থাপিত হয়েছে।

উল্লেখ্য যে, মক্কা থেকে জেদ্দা ৭৩ কিঃমিঃ দক্ষিণে এবং নিকটবর্তী ‘ইয়ালামলাম’ মীক্বাতের মধ্যে অবস্থিত। তাই এখানকার অধিবাসীগণ এখান থেকেই ইহরাম বাঁধবেন।

‘যারা এইসব মীক্বাত এলাকার অধিবাসী অথবা যারা এগুলি অতিক্রম করেন, তারা হজ্জ বা ওমরাহর জন্য এসব স্থান থেকে ইহরাম বাঁধবেন। কিন্তু যারা এসব মীক্বাত-এর অভ্যন্তরীণ অঞ্চলে বসবাস করেন, তারা স্ব স্ব অবস্থান থেকে ইহরাম বাঁধবেন। একইভাবে মক্কাবাসীগণ মক্কা থেকে ইহরাম বাঁধবেন’।[1]

জ্ঞাতব্য : (১) মক্কায় অবস্থানকারীগণ হজ্জের ইহরাম স্ব স্ব অবস্থান থেকে বাঁধবেন। কিন্তু ওমরাহর ইহরাম বাঁধার জন্য তাঁরা হারাম এলাকার বাইরে যাবেন ও সেখান থেকে ওমরাহর ইহরাম বেঁধে আসবেন। এজন্য সবচেয়ে নিকটবর্তী হ’ল ৬ কিঃমিঃ উত্তরে ‘তান‘ঈম’ এলাকা। বিদায় হজ্জের সময় ওমরাহর ইহরাম বাঁধার জন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আয়েশা (রাঃ)-কে তার ভাই আব্দুর রহমানের সাথে এখানে পাঠিয়েছিলেন।[2]

(২) মদীনা থেকে মক্কায় হজ্জ বা ওমরাহর জন্য আসতে গেলে মদীনা হ’তে প্রায় ১০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে ‘যুল হুলাইফা’ থেকে ইহরাম বাঁধতে হয়। স্থানটি বর্তমানে মসজিদ ও গোসলখানা দ্বারা সুশোভিত। ‘হুলাইফা’ বনু জাশাম গোত্রের একটি কুয়ার নাম। অথচ এটি বিদ‘আতীদের মাধ্যমে ‘আবইয়ারে আলী’ বা ‘আবারে আলী’ অর্থাৎ আলীর কুয়া সমূহ নামে পরিচিত হয়েছে। বলা হয়ে থাকে যে, আলী (রাঃ) জিন হত্যা করে উক্ত কুয়ায় নিক্ষেপ করেছিলেন।[3] এগুলি অতিভক্তদের ভিত্তিহীন কল্পকাহিনী মাত্র।

(৩) যদি কেউ ভুলক্রমে বা অনিচ্ছাকৃতভাবে মীক্বাত অতিক্রম করেন ও অন্যত্রে ইহরাম বাঁধেন, তাতে তিনি মাফ পাবেন। কিন্তু আলস্য বশে করলে তার উপর ফিদ্ইয়া স্বরূপ একটি বকরী কুরবানী ওয়াজিব হবে। যা তিনি মক্কায় গিয়ে যবহ করে ফকীর-মিসকীনদের মধ্যে বিতরণ করে দিবেন। যদি তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে মীক্বাত অতিক্রম করেন, তাহ’লে তাকে ফিরে এসে পুনরায় মীক্বাত থেকে ইহরাম বাঁধতে হবে।

(৪) যদি কোন বিমান বা পরিবহন তাকে মীক্বাতের সংকেত দিবে না বলে আশংকা হয়, তাহ’লে বিমানে ওঠার আগেও ইহরাম বাঁধতে পারবেন। তবে এযুগে সময়ের হিসাব জানা খুবই সহজ। অতএব ঢাকা থেকে জেদ্দায় বিমান অবতরণের আধা ঘণ্টা আগে বিমানেই ইহরাম বেঁধে নিবেন।

(৫) যদি অন্য উদ্দেশ্যে কেউ মক্কায় এসে থাকেন, অতঃপর হজ্জ বা ওমরাহ করতে চান, তাহ’লে হারামের বাইরে তান‘ঈম বা জি‘ইর্রানাহ প্রভৃতি এলাকায় গিয়ে তিনি ইহরাম বেঁধে আসবেন।

ইহরাম বাঁধার নিয়ম  (طريقة الإحرام) :

(১) ইহরামের পূর্বে ওযূ বা গোসলের মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জন করা উত্তম। তবে শর্ত নয়। মহিলাগণ নাপাক অবস্থাতেও ইহরাম বাঁধতে পারবেন (২) পুরুষদের জন্য সাদা সেলাই বিহীন লুঙ্গী ও চাদর পরিধান করা। মহিলাদের জন্য যেকোন ধরনের শালীন পোষাক পরিধান করা, যা পুরুষদের পোষাকের সদৃশ নয়। (৩) দেহে সুগন্ধি ব্যবহার করা। তবে পোষাকে নয়।

যে কোন ফরয ছালাতের পরে কিংবা ‘তাহিইয়াতুল ওযূ’ দু’রাক‘আত নফল ছালাতের পরে ইহরাম বাঁধা চলে। তবে ইহরাম বাঁধার সাথে ছালাতের কোন সম্পর্ক নেই।[4]

المحرمات في حالة الإحرام

ইহরামের পর নিষিদ্ধ বিষয় সমূহ

হজ্জ ও ওমরাহর ইহরাম ছালাতে তাকবীরে তাহরীমার ন্যায়। ফলে ইহরাম বাঁধার পর মুহরিমের জন্য অনেকগুলি বিষয় নিষিদ্ধ থাকে। যেমন (১) সুগন্ধি ব্যবহার করা (২) স্ত্রী-পুরুষ উভয়ের জন্যই মাথার চুল এবং যে কোন উপায়ে শরীরের যে কোন স্থানের পশম উঠানো ও হাত-পায়ের নখ কাটা (৩) পশু-পক্ষী বা যেকোন প্রাণী শিকার করা। এমনকি শিকার ধরতে ইশারা-ইঙ্গিতে সহযোগিতা করা। তবে ক্ষতিকর জীবজন্তু যেমন সাপ, বিচ্ছু, ইঁদুর, ক্ষ্যাপা কুকুর, মশা, উকুন ইত্যাদি মারার অনুমতি রয়েছে[5] (৪) যাবতীয় যৌনাচার, বিবাহের প্রস্তাব, বিবাহের আক্বদ বা যৌন আলোচনা করা (৫) পুরুষের জন্য পাগড়ী, টুপী ও রুমাল ব্যবহার করা। তবে প্রচন্ড গরমে ছায়ার জন্য বা বৃষ্টিতে ছাতা বা ঐরূপ কিছু ব্যবহার করায় দোষ নেই (৬) পুরুষের জন্য কোন প্রকারের সেলাই করা কাপড় যেমন জুববা, পাঞ্জাবী, শার্ট, গেঞ্জি, মোযা ইত্যাদি পরিধান করা। তবে তালি লাগানো ইহরামের কাপড় পরায় দোষ নেই (৭) মহিলাদের জন্য মুখাচ্ছাদন ও হাত মোযা ব্যবহার করা। তবে পর পুরুষের সামনে চেহারা ঢেকে রাখা ওয়াজিব (৮) ঝগড়া-বিবাদ করা এবং শরী‘আত বিরোধী কোন বাজে কথা বলা ও বাজে কাজ করা।

উপরোক্ত কাজগুলির মধ্যে কেবল যৌনমিলনের ফলেই ইহরাম বাতিল হবে। বাকীগুলির জন্য ইহরাম বাতিল হবে না। তবে ফিদইয়া ওয়াজিব হবে। অবশ্য যদি ভুলে কিংবা অজ্ঞতাবশে কিংবা বাধ্যগত কারণে অথবা ঘুম অবস্থায় কেউ কিছু করে ফেলে, তাতে কোন গোনাহ নেই বা ফিদ্ইয়া নেই।

² উপরোক্ত নিষিদ্ধ বিষয় সমূহের উদ্দেশ্য হ’ল মুহরিমকে দুনিয়াবী সাজ-সজ্জা থেকে মুক্ত হ’য়ে পুরাপুরি আল্লাহমুখী করা। পুরুষের জন্য সেলাই বিহীন কাপড় পরিধানের উদ্দেশ্য হ’ল সকল জৌলুস ও প্রদর্শনী থেকে মুক্ত হ’য়ে আল্লাহর জন্য খালেছ ও নিবেদিতপ্রাণ হওয়া।

 


[1]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২৫১৬, ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে। মীক্বাত-এর উদ্দেশ্য: হজ্জে আগত দূরদেশীগণ যাতে দূরের সফর থেকে এসে মীক্বাত থেকে ইহরাম বেঁধে নতুন উদ্যম নিয়ে মক্কায় উপস্থিত হ’তে পারেন। তবে মদীনাবাসীদের জন্য মীক্বাত সবচেয়ে দূরে হবার কারণ সম্ভবতঃ এই যে, ইসলাম গ্রহণে এবং তার প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় মদীনাবাসীদের আগ্রহ, অবদান ও মর্যাদা সবার উপরে। এটি শেষনবী (ছাঃ)-এর হিজরতের স্থান ও প্রথম জনপদ যারা ঈমান এনেছিল। ক্বিয়ামতের পূর্বে সারা বিশ্ব থেকে ঈমান গুটিয়ে মদীনায় আশ্রয় নিবে। তাদের ঈমানী জাযবা অন্য সবার চেয়ে বেশী ছিল এবং থাকবে ইনশাআল্লাহ। তাই তাদের জন্য ইহরাম অবস্থায় দূর থেকে মক্কায় আসা কষ্টকর হবে না।

[2]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২৫৫৬, ২৬৬৭।

[3]. মিরক্বাত ৫/২৬৯ পৃঃ।

[4]. শায়খ আবদুল্লাহ বিন জাসের, আহকামুল হজ্জ (রিয়াদ: ৩য় সংস্করণ ১৪১২/১৯৯২) পৃঃ ৭০-৭৫।

[5]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২৬৯৮-৯৯।

মন্তব্য করুন

Back to top button