মায়মূনা কবরস্থান যিয়ারতের হুকুম
কবরস্থানটির পরিচয়:
মায়মূনা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে এ কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে যার ফলে একে ‘মায়মূনা কবরস্থান’ বলা হয়।
তিনি হলেন: মায়মূনা বিনতে হারেস আল-হিলালিয়া। উম্মুল মুমিনীন (মুমিনদের জননী)। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে সপ্তম হিজরীতে উমরাতুল কাজা সম্পাদনের পর বিবাহ করেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে যে স্থানে বিবাহ করেন সে স্থানেই ৫৭ হিজরীতে তিনি মারা যান।
আল-ফাসী বলেন, মক্কা ও তার সন্নিকটে আমি জানি এমন কোনো ব্যক্তির কবর নেই, যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহচর্য লাভ করেছেন এ কবরটি ব্যতীত। অবশ্য পরবর্তীরা পূর্ববর্তীদের দ্বারা পরিচিত হয়। মক্কা ও আল জমূমের মধ্যবর্তী বর্তমান ‘নাওয়ারিয়া’ মহল্লায়, তান‘ঈম মসজিদের উত্তরে ১১.৫ কি.মি. দূরত্বে মদীনা রোডের পার্শ্বে এ কবরস্থানটি অবস্থিত।
কবরস্থানটি যিয়ারতের হুকুম ও যিয়ারতকারী সেখানে কী বলবে?
এ কবরস্থানের অন্যান্য কবরস্থানের চেয়ে ভিন্ন কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। সুতরাং অন্য কবরস্থানে যা বৈধ এখানেও তা বৈধ।
কবর যিয়ারত সাধারণত সর্বস্থানেই শরী‘তসম্মত, কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
«زُورُوا الْقُبُورَ فَإِنَّهَا تُذَكِّرُ الْمَوْتَ»
“তোমরা কবর যিয়ারত কর কেননা তা নিশ্চয় মৃত্যুকে স্মরণ করিয়ে দেবে।” (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৯৭৬)
যে ব্যক্তি মক্কায় অবস্থান করবে এমন পুরুষদের জন্য এ কবরস্থান যিয়ারত করা শরী‘আতসম্মত। পক্ষান্তরে মহিলাদের ক্ষেত্রে আলিমদের মতের বিশুদ্ধতম মত হলো তাদের জন্য কবর যিয়ারত করা শরী‘আতসম্মত নয়। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
«لَعَنَ اللَّهُ زَوَّارَاتِ الْقُبُورِ»
“আল্লাহ তা‘আলা বেশি বেশি কবর যিয়ারতকারী মহিলাদের প্রতি লা‘নত করুন।” (আবু দাউদ ত্বায়ালিসী, হাদীস নং ২৪৭৮।)
কবর যিয়ারতের হাদীসগুলো দ্বারা যিয়ারতের ব্যাপারে স্পষ্ট হয় যে, কবর যিয়ারতের দ্বারা মুসলিমগণ তিনটি উপকার পেয়ে থাকে:
(১) কবর দেখে মৃত্যুকে স্মরণ হয়, তাতে মুসলিমগণ যেন সৎ আমল করে এবং কবরের জন্য প্রস্তুতি নেয়। আর এটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী:
«فَزُورُوهَا فَإِنَّهَا تُذَكِّرُ الآخِرَةَ»
“তোমরা কবর যিয়ারত কর; কেননা তা পরকালকে স্মরণ করিয়ে দিবে।” (তিরমিযী, হাদীস নং ১০৫৪)
(২) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ। কেননা কবর যিয়ারত একটি সুন্নাত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবর যিয়ারত করেছেন। সুতরাং মুসলিমগণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণের সওয়াব অর্জন করবে এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হুকুমে সাড়া দেওয়ারও সাওয়াব অর্জন করবে যেমন তিনি বলেন, زُورُوهَا অর্থাৎ তোমরা কবর যিয়ারত কর।
(৩) তার মুসলিম ভাইদের জন্য দো‘আ করে তাদের প্রতি ইহসান ও সহানুভূতি প্রদর্শন। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সহীহভাবে যিয়ারতের যে সব দো‘আর শব্দমালা সাব্যস্ত হয়েছে ও তিনি তাঁর সাহাবীদেরকে যা শিক্ষা দিয়েছেন তাতে মুসলিমদের মৃতদের জন্য দো‘আ যুক্ত রয়েছে, যা তাদের জন্য উপকারী এবং তারা ইনশাআল্লাহ তা হতে উপকৃত হবেন। আর কবর যিয়ারতকারী তার ভাইয়ের জন্য দো‘আ ও তাদের প্রতি ইহসান করার সাওয়াব অর্জন করবেন।
মুসলিমগণ যখন কবরস্থান যিয়ারত করবে, তার উচিত সে যেন শরী‘আতসম্মত বৈধ সীমায় অবস্থান করে তা যিয়ারত করে। সুতরাং সে মৃতের জন্য শরী‘আতে বর্ণিত দো‘আ দ্বারাই যিয়ারত করবে। অতএব সে বলবে:
«السَّلَامُ عَلَيْكُمْ أَهْلَ الدِّيَارِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُسْلِمِينَ، وَإِنَّا، إِنْ شَاءَ اللهُ لَلَاحِقُونَ،وَيَرْحَمُ اللهُ الْمُسْتَقْدِمِينَ مِنَّا وَالْمُسْتَأْخِرِينَ، أَسْأَلُ اللهَ لَنَا وَلَكُمُ الْعَافِيَةَ»
“হে মুমিন-মুসলিম কবরবাসীগণ, আপনাদের প্রতি সালাম, নিশ্চয় আমরাও ইনশাআল্লাহ আপনাদের সাথে মিলিত হব। আপনারা যারা অগ্রগামী হয়েছেন ও যারা পরবর্তীতে আসবে, আল্লাহ তাদের প্রতি রহম করুন! আমরা আমাদের ও আপনাদের জন্য নিরাপত্তা চাই।” (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৯৭৪, ৯৭৫।)
উল্লিখিত শব্দমালায় মৃতের জন্য দো‘আ এসেছে।
তৃতীয়ত: কোনো কোনো যিয়ারতকারী যেসব সুন্নাত পরিপন্থী বিষয়ে লিপ্ত হয়:
কবর যিয়ারতকারীর উচিৎ, সে যেন তার যিয়ারতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতী পদ্ধতি পালন করে এবং সে সব বিষয়ে পতিত হওয়া থেকে সতর্ক হয় যা হবে সুন্নাত পরিপন্থী ও তাকে তা গুনাহতে পতিত করবে বা তাতে তার নেকী কমে যাবে। নিম্নে এমন কতিপয় শরী‘আত পরিপন্থী বিষয় উল্লেখ করা হলো যাতে কোনো কোনো যিয়ারতকারী পতিত হয়ে থাকে; যেন যিয়ারতকারীগণ সেগুলোতে পতিত হওয়া থেকে বাঁচতে পারে:
১। কবরস্থানে গিয়ে মৃতদের উসীলা করা, তাদের নিকট ফরিয়াদ করা ও তাদের নিকট সুপারিশ তলব করা।
২। কবরের সম্মুখে দীর্ঘক্ষণ দণ্ডায়মান হয়ে থাকা, বিনয়-নম্রতা প্রকাশ করা ও এমন বিশ্বাসে নীরবতা পালন যে, এমন করা শরী‘আত নির্দেশিত আদবের অন্তর্ভুক্ত। এসব হলো, বাড়াবাড়ি ও কবরবাসীদের ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘন করা। কবরবাসীর সাথে এমন করা শির্কের উসীলা ও মাধ্যম।
৩। কবরবাসীর জন্য সিজদা ও রুকু করা, অথচ সাজদাহ ও রুকু ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং তা আল্লাহ ব্যতীত কারো জন্য করা জায়েয নয়।
৪। কবরস্থানের ভিতরে-বাইরে কবুতরের জন্য এমন বিশ্বাসে শস্য দানা নিক্ষেপ করা যে, তাতে রয়েছে নেকী ও প্রতিদান। বিশেষ করে তা কবুতরকে খাওয়ানোর মধ্যে বা তাতে বরকত রয়েছে এমন বিশ্বাস। এমন কর্ম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করেন নি, না কোনো সাহাবী করেছেন আর না করেছেন কোনো তাবে‘ঈ বা সালাফে সালেহীন। সুতরাং তা হলো দীনের মধ্যে নব আবিস্কৃত বিদ‘আত। অনুরূপ এতে খাদ্যের অবমাননা ও পথিককে কষ্ট দেওয়া হয়।
৫। সেখানে উচ্চস্বরে বিলাপ করা, মুখে মারা বা গাল চাপড়ানো ইত্যাদি। আর সর্বজনবিদীত এসব কর্ম হারাম; বরং কবীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। (আল-মাক্কীর আযযাওয়াজের: ১/৩০৬)
৬। সালাতে কবরকে সামনে করা এবং এ সালাতের “সালাতে যিয়ারা” নামকরণ করা অথচ কবরের দিকে নামায আদায় উলামায়ে কিরামের ঐকমত্যে হারাম।
৭। সম্মিলিতভাবে সেখানে দো‘আ ও যিকির করা, অথচ তা এমন আমল যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করেন নি, না করেছেন তাঁর সাহাবীগণ না তাবে‘ঈগণ।
৮। কবর হতে চুম্বন-স্পর্শ করার জন্য বা বরকত বা রোগ মুক্তি কামনায় অন্য কিছুর সাথে মিশানোর জন্য মাটি গ্রহণ করা।
৯। কবরবাসীকে নিজের হাজত পূরণ ও তাদের দ্বারা বালা-মুসীবত দূর করার জন্য বিভিন্ন ম্যাসেজ প্রদান করা।
১০। কবরের সাথে বরকত হাসিলের জন্য সুতা ও নেকড়া প্যাঁচানো এবং দরজা ও জানালায় তালা লাগান।
১১। অনুরূপ বরকত গ্রহণের জন্য কবরস্থানের দেয়াল, দরজা ও তার মধ্যে যে জিনিস রয়েছে তা স্পর্শ করা।
১২। কোন কোনো কবরে পয়সা দেওয়া অথচ তা হলো আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নামে মান্নতের অন্তর্ভুক্ত।
১৩। ফাতেহাখানী, কুলখানী, সূরা ইয়াসীন ও সূরা বাকারার শেষ দু‘আয়াত পাঠ করে মৃতের রূহের জন্য বখশে দেওয়া।
১৪। বরকত গ্রহণের আশায় নখ, চুল, দাঁত কবরে পুঁতে রাখা।
১৫। কবরবাসীর নৈকট্য অর্জনের জন্য কবরে আতর, গোলাপ জল ছিটানো। অথচ এটি আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নৈকট্য অর্জন করার অন্তর্ভুক্ত যা হারাম, জায়েয নয়।
অনুবাদক: মুহাম্মাদ আব্দুর রব আফ্ফান