বিভিন্ন ধর্ম ও মতবাদ

হিন্দু ধর্ম

অনেক আগ থেকে বহু দীনের চর্চা কেন্দ্র হিসেবে ভারতবর্ষ প্রসিদ্ধ। এখানে চর্চা করা সকল ধর্মকেই হিন্দুধর্ম বলা হয়, কখনো নির্দিষ্ট কতিপয় ধর্মের উপর হিন্দু নাম প্রয়োগ করা হয়।

হিন্দুধর্ম কতক আকিদা, চিন্তা ও প্রথার নাম, যুগযুগ ধরে যা চলে আসছে। তার থেকে একাধিক স্বতন্ত্র ধর্ম সৃষ্টি হয়, যা অন্যান্য দেশে বিস্তার লাভ করে।

হিন্দুদের ইলাহ:

হিন্দুদের ইলাহ তিনটি সত্তা বা উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত:

১. ব্রহ্মা: অর্থ সৃষ্টিকারী।

২. বিষ্ণু: সংরক্ষণকারী।

৩. শিব: ধ্বংসকারী।

এতদ সত্ত্বেও তারা বলে: এ তিনটি সত্তা মূলত এক। তারা বিশ্বাস করে ব্রহ্মা হচ্ছে ইলাহ, তার থেকে ব্রহ্মাধর্মও নামকরণ করা হয়।

হিন্দুদের নিকট ইবাদত:

হিন্দুদের ইবাদত দু’প্রকার:

১. ব্রাহ্মনদের ইবাদত, তাদেরকে পণ্ডিত ও সন্ন্যাসী বলা হয়: তারা নিজের নফসকে কষ্ট দিয়ে ও দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ইবাদত করে, যার চূড়ান্ত লক্ষ্য ব্রহ্মা ইলাহের সাথে একাকার হওয়া, অর্থাৎ তাদের নফস তার অংশে পরিণত হবে।

তারা তাদের সিয়াম রেখে ও পবিত্র কিতাব পাঠ করে জীবন শেষ করে। তারা কখনো জঙ্গলে উলঙ্গ জীবন-যাপন করে, বিভিন্ন প্রকার কঠিন ইবাদত আঞ্জাম দেয়, (যার একটি যোগশাস্ত্র)। তারা বিয়ে করে না এবং দুনিয়ার কোনো অংশের মালিক হয় না।

অলৌকিক ঘটনা ও কারামত প্রমাণ করার জন্য তারা জাদু ও ভ্যাল্কিভাজি শিক্ষা করে, অতঃপর এগুলোকে তারা ব্রহ্মা প্রদত্ত বিশ্বাস করে।

তারা উত্তরাধিকার সূত্রে বিভিন্ন প্রকার ইবাদত শিখে, প্রত্যেক ধর্মীয় শিক্ষক একদল মুরিদকে তার বিশেষ তরিকার উপর দীক্ষা দেয়, মুরিদের পক্ষে মুরব্বির বিরোধিতা কিংবা তার উপর প্রশ্ন করার কোনো অধিকার নেই।

২. সাধারণদের ইবাদত: তারা প্রত্যেক বস্তুর ইবাদত করে, যেমন গাছ, পাথর ও চতুষ্পদ জন্তু। তাদের কেউ অপরিচিত পথিক অথবা তার গাড়িকে সেজদা করে, তাদের কেউ মাকড়সা ও অণুকে সেজদা করে, তাদের পছন্দের প্রত্যেক বস্তুকে তারা সেজদা ও ইবাদত করে। হিন্দুদের পবিত্র কিতাব বলে, সৃষ্টিকর্তা ইলাহ তাদেরকে মূর্তি তৈরি ও তার ইবাদতের নির্দেশ দিয়েছেন। তাদের ধর্মগ্রন্থ আরও বলে: মূর্তিগুলো তাদেরকে বড় ইশ্বরের ইবাদতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

সম্মিলিত ইবাদত:

তাদের নিকট সম্মিলিত মাবুদ হচ্ছে গাভী, সাধারণ ও বিশেষ ব্যক্তি সবাই গাভীর ইবাদতের ব্যাপারে একমত।

হিন্দুরা গাভীকে প্রচুর সম্মান করে, এমন কি তারা সম্মান করে তার মলকেও। ভারতের সাবেক নেতা গান্ধি, যাকে তৃতীয় বিশ্ব ও জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলোর নেতা গণ্য করা হয়, তিনি স্পষ্ট বলেছেন:

“আমি গাভীর ইবাদত করি এবং বিশ্বের সামনে তার ইবাদতের পক্ষাবলম্বন করি…”।

হিন্দুদের পবিত্র কিতাব:

হিন্দুদের পবিত্র কিতাবকে বেদ বলা হয়। এগুলো কতক কবিতা, আর্তনাদ ও আকুতির নাম, তার কতক ধর্মীয় ব্যক্তিরা পাঠ করে, কতক সবাই পাঠ করে। অনুরূপ তাতে রয়েছে তাবিজ ও জাদু, যা গণকরা করামত প্রকাশ, উপকার হাসিল ও অনিষ্ট দূর করার জন্যে শিক্ষা করে।

হিন্দুদের গুরুত্বপূর্ণ আকিদা:

১. রূহের পুনরায় দেহধারণ বা পুর্নজন্ম: তার অর্থ হচ্ছে বিভিন্ন ধাপে রূহসমূহের এক শরীর থেকে অপর শরীরে স্থানান্তর হওয়া। হিন্দুরা বিশ্বাস করে, মানুষ যখন মারা যায় তার রূহ অপর শরীরে প্রত্যাবর্তন করে, কখনো জীব-জন্তুর শরীরে—উদাহরণস্বরূপ—। এ ধাপে কেউ ভাগ্যবান হয়, কেউ হয় হতভাগা তার পূর্বের আমলের উপর ভিত্তি করে, কিন্তু দ্বিতীয় ধাপে সে বুঝতে পারে না প্রথম ধাপে তার কি হয়েছিল, এভাবে ধাপে ধাপে স্থানান্তর হতে থাকে, এক সময় পরিচ্ছন্ন ও নিষ্পাপ হয়ে ব্রহ্মার সাথে একাকার হওয়ার উপযুক্ত হয়।

২. ব্রহ্মার সাথে একাকার হওয়া: হিন্দুরা বিশ্বাস করে, সবচেয়ে মহান লক্ষ্য রূহকে শরীরের নাপাক থেকে পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন করা, যেন সে ব্রহ্মার সাথে একাকার ও তার একটি অংশে পরিণত হতে সক্ষম হয়।

এ জন্য সূফী সন্ন্যাসীরা নিজেদের নফসকে শাস্তি ও তার পরিশুদ্ধতার জন্য পরিশ্রম করে, যেন একধাপে সে এ লক্ষ্যে উন্নীত হতে সক্ষম হয়।

৩. ওহি অস্বীকার করা: হিন্দুরা প্রচলিত অহিতে বিশ্বাস করে না, তারা বিশ্বাস করে ইলহাম ও কাশফকে। তারা বিশ্বাস করে, যে নির্জনে একান্ত হয়, নিজেকে অভুক্ত রাখে ও শাস্তি দেয়, তাকে ইলমে বাতিন দ্বারা ধন্য ও তার উপর স্থায়ী হাকিকত উন্মুক্ত করা হয়।

৪. প্রাণীর গোস্ত ভক্ষণ হারাম করা: তাদের একটি গোষ্ঠী প্রাণীর গোস্ত ভক্ষণ করে না। এটা বৈরাগ্য ও নফসকে শাস্তি দেওয়ার একটা অংশ। তারা ধারণা করে, মানুষের রূহানী ও আধ্যাত্মিক হওয়ার জন্য জরুরি রূহ জাতীয় কিছু না খাওয়া।

অনুরূপ তাদের শরীয়ত বার্ধক্যকালে ব্রাহ্মনের জন্য মানুষের সাথে থাকা হারাম করে, তার উপর ফরয করে নির্জনে ও জঙ্গলে বসবাস করা এবং গাছ থেকে পড়া ফল ব্যতীত কিছু না খাওয়া, আমৃত্যু চুল ও নখ না কাটা।

হিন্দুদের এক বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে: মৃতদের শরীর পোড়ানো।

হিন্দু সমাজের বিভিন্ন স্তর:

হিন্দু শরীয়ত বলে, মানুষ চারটি স্বতন্ত্রভাবে বিভক্ত, প্রত্যেক ভাগের জন্যই রয়েছে বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও অবশ্য করণীয়।

এ ভাগের কারণ:

হিন্দুরা বিশ্বাস করে, ইলাহ (ব্রহ্মা) নিজের নফস থেকে মানুষ সৃষ্টি করেছেন, তাদের কাউকে সৃষ্টি করেছেন বাহু থেকে, কাউকে সৃষ্টি করেছেন রান থেকে, কাউকে সৃষ্টি করেছেন পা থেকে, এভাবে মানুষের চিরন্তন চারটি ভাগ হয়:

১. ব্রাহ্মণ: ব্রহ্মা তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন মুখ থেকে, তারা ধর্মীয় ব্যক্তি ও গণক হবেন, এটাই তাদের নিকট সর্বোচ্চ স্তর।

২. ক্ষত্রিয় : তারা হলেন বাদশাহ, বিচারক ও সেনাবাহিনী, তাদেরকে ব্রহ্মা বাহু থেকে সৃষ্টি করেছেন।

৩. বৈশ্য: তারা হলেন ব্যবসায়ী, কৃষক ও বিভিন্ন কর্মজীবী, তাদেরকে ব্রহ্মা রান থেকে সৃষ্টি করেছেন।

৪. শূদ্র: তারা হল অচ্ছুত স্তরের, তাদেরকে ব্রহ্মা অন্যান্য সকল স্তরের মানুষের সেবার জন্য সৃষ্টি করেছেন। তারা বিশ্বাস করে ব্রহ্মা তাদেরকে পা থেকে সৃষ্টি করেছেন।

 

অধ্যয়নের জন্য মূল পাঠ

ভারতের নেতা গান্ধি ‘আমার মা গাভী’ শিরোনামে বলেন:

“নিশ্চয় গাভীর পক্ষাবলম্বন, যা ভারতীয়রা জরুরি করেছে, এটা হল ভারতের পক্ষ থেকে বিশ্বের প্রতি উপহার। এটা মূলত মানুষ ও প্রাণীর মাঝে ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের অনুভূতি। ভারতীয় মতবাদ বিশ্বাস করে, গাভী মানুষের মা, বাস্তবেও সে মা।

নিশ্চয় ভারতীয়দের জন্য গাভী ভালো বন্ধু, সেই ভারতের উত্তম সুরক্ষা। আমি যখন গাভী দেখি তখন মনে করি না একটি প্রাণী দেখছি, কারণ আমি গাভীর ইবাদত করি এবং তার ইবাদতের পক্ষ নেই পুরো বিশ্বের সামনে।

আমার মা গাভী আমার প্রকৃত মা অপেক্ষা কয়েক গুণ শ্রেষ্ঠ, প্রকৃত মা এক অথবা দু’বছর আমাদেরকে দুধ দেয়। তার বিনিময়ে সে জীবনভর আমাদের সেবা দাবি করে, কিন্তু গাভী মা আমাদেরকে সর্বদা দুধ দেয়, তার বিনিময়ে সে আমাদের নিকট কিছুই তলব করে না স্বাভাবিক খাবার ব্যতীত। প্রকৃত মা যখন অসুস্থ হয় আমাদের উপর অনেক টাকার বোঝা চাপিয়ে দেয়, কিন্তু গাভী মা যখন অসুস্থ হয় আমরা তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছুই হারাই না।

প্রকৃত মা যখন মারা যায় তার শবদাহে বড় অংকের টাকা খরচ হয়, পক্ষান্তরে আমাদের গাভী মা যখন মারা যায়, তখন আমাদের উপকার করে, যেমন জীবিত থাকাবস্থায় আমাদের উপকার করত। কারণ আমরা তার শরীরের প্রত্যেক অংশ থেকে উপকৃত হই, এমন কি হাড্ডি ও চামড়া থেকেও…

আমি মায়ের সম্মান কমানোর জন্য এ কথা বলছি না, কিন্তু সে কারণ উল্লেখ করছি, যা আমাকে গাভীর ইবাদতের প্রতি আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছে।

নিশ্চয় লাখো হিন্দু গাভীকে ইবাদত ও সম্মান প্রদর্শন করছে, আমি নিজেকে সেসব হিন্দুদের একজন গণ্য করি”।[1]

 

লেখক: ড. সফর ইবনে আব্দুর রহমান আল-হাওয়ালি
অনুবাদ : সানাউল্লাহ নজির আহমদ
সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া


 

[1] ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন ধর্ম, ড. আহমদ শিবলি, (পৃ.৬০), সংগৃহীত ইংরেজি দৈনিক (জার্নাল বাহাপান), বুম্বাই , নভেম্বর সংখ্যা: (১৯৬৩ই.)

মন্তব্য করুন

Back to top button