নাসারা বা খৃস্টান
সকল রাসূল তাওহীদ নিয়ে এসেছেন, তাদের মধ্যে ঈসা ইবনে মারয়াম অন্যতম, তাকে আল্লাহ বনি ইসরাইলের নিকট প্রেরণ করেন। আল্লাহ তাকে মূসা আলাইহিস সালাম ও মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দু’টি বড় দু’টি রিসালাতের মাঝে যোগসূত্র হিসেবে প্রেরণ করেন:
১. প্রথমত ঈসা আলাইহিস সালামের সম্পর্ক মূসা ‘আলাইহিস সালামের রিসালাতের সাথে, যেমন আল্লাহ তাকে বনি ইসরাইলের জন্য খাসভাবে প্রেরণ করেন, তাকে তাওরাতের সত্যারোপকারী ও মূসা আলাইহিস সালামের শরীয়তের সংস্কারক বানান।
২. দ্বিতীয়ত ঈসা আলাইহিস সালামের সম্পর্ক মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রিসালাতের সাথে, যিনি জগতের জন্য রহমতস্বরূপ, ঈসা আলাইহিস সালাম তার নাম ও সিফাতসহ আগাম সংবাদ প্রদান করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ وَإِذۡ قَالَ عِيسَى ٱبۡنُ مَرۡيَمَ يَٰبَنِيٓ إِسۡرَٰٓءِيلَ إِنِّي رَسُولُ ٱللَّهِ إِلَيۡكُم مُّصَدِّقٗا لِّمَا بَيۡنَ يَدَيَّ مِنَ ٱلتَّوۡرَىٰةِ وَمُبَشِّرَۢا بِرَسُولٖ يَأۡتِي مِنۢ بَعۡدِي ٱسۡمُهُۥٓ أَحۡمَدُۖ فَلَمَّا جَآءَهُم بِٱلۡبَيِّنَٰتِ قَالُواْ هَٰذَا سِحۡرٞ مُّبِينٞ ٦ ﴾ [الصف: ٦]
“আর যখন মারয়াম পুত্র ঈসা বলেছিল, ‘হে বনী ইসরাইল, নিশ্চয় আমি তোমাদের নিকট আল্লাহর রাসূল। আমার পূর্ববর্তী তাওরাতের সত্যায়নকারী এবং একজন রাসূলের সুসংবাদদাতা যিনি আমার পরে আসবেন, যার নাম আহমদ’। অতঃপর সে যখন সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ নিয়ে আগমন করল, তখন তারা বলল, ‘এটাতো স্পষ্ট জাদু”।[1]
ঈসা আলাইহিস সালামকে আল্লাহ তা‘আলা স্পষ্ট দলিল ও অকাট্য প্রমাণসহ বনি ইসরাইলের নিকট প্রেরণ করেন। তাদের মাঝে আল্লাহর বিধান মোতাবিক ফয়সালা করার জন্য তিনি তার উপর ইঞ্জিল নাযিল করেন। ঈসা আলাইহিস সালামের অনুসারীরা মূলত ইয়াহূদী জাতির একটি অংশ ছিল, আর ইয়াহূদীরা ছিল রোম সম্রাজ্যের অনুগত জাতিসমূহের একটি জাতি।
ঈসার অনুসারীদের দমন-পীড়ন:
ইয়াহূদীরা ঈসার রিসালাতকে কঠিনভাবে অস্বীকার করে, তাকে খুব খারাপ অপবাদ দেয়, তাকে ও তার সাথী যারা ইয়াহূদী থেকে তার অনুসারী হয়েছে তাদেরকে তারা হত্যার ষড়যন্ত্র করে, । তারা রোম শাসকের নিকট ঈসা আলাইহি সালামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে, যার ফলে হত্যার উদ্দেশ্যে শাসক তাকে গ্রেফতার ও শূলে চড়াতে উদ্বুদ্ধ হয়, কিন্তু আল্লাহ তাকে মুক্তি দেন ও উপরে তাকে উঠিয়ে নেন, আর মুনাফিক গোয়েন্দার উপর তার সাদৃশ্য নাযিল করেন, ফলে রোম শাসক তাকেই ক্রুশে চড়ায়। আল্লাহ তা‘আলা মাসীহ সম্পর্কে বলেন:
﴿ وَمَا قَتَلُوهُ وَمَا صَلَبُوهُ وَلَٰكِن شُبِّهَ لَهُمۡۚ وَإِنَّ ٱلَّذِينَ ٱخۡتَلَفُواْ فِيهِ لَفِي شَكّٖ مِّنۡهُۚ مَا لَهُم بِهِۦ مِنۡ عِلۡمٍ إِلَّا ٱتِّبَاعَ ٱلظَّنِّۚ وَمَا قَتَلُوهُ يَقِينَۢا ١٥٧ ﴾ [النساء : ١٥٧]
“অথচ তারা তাকে হত্যা করেনি এবং তাকে ক্রুশে চড়ায়নি, বরং তাদেরকে ধাঁধায় ফেলা হয়েছিল। আর নিশ্চয় যারা তাতে মতবিরোধ করেছিল, অবশ্যই তারা তার ব্যাপারে সন্দেহের মধ্যে ছিল। ধারণার অনুসরণ ছাড়া এ ব্যাপারে তাদের কোন জ্ঞান নেই। আর এটা নিশ্চিত যে, তারা তাকে হত্যা করে নি”।[2]
রোম শাসকরা প্রায় তিন শতাব্দী যাবত ইয়াহূদীদের প্ররোচনা ও সহায়তায় ঈসা আলাইহিস সালামের অনুসারীদের বিভিন্ন শাস্তি দেয়, কখনো হত্যা করে, যা খৃস্টান ইতিহাসে অনেক ঘটনা ও পরিণতির জন্ম দেয়, তন্মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে:
১. আল্লাহর নাযিলকৃত ইঞ্জিল খোয়া যাওয়া। আর যারা সে ইঞ্জিলে ঈমান এনেছিল তাদের শতধা বিচ্ছিন্ন হওয়া। এ পরিস্থিতির ফলে ঈসার অনুসারী অনেকে তার থেকে গোপনে শুনা ও পৌঁছা কথা সত্যাসত্য যাচাই ছাড়া লিপিবদ্ধ করে। এ লিপিগুলোই পরবর্তীতে বিবিধ ইঞ্জিল নামে অভিহিত হতে থাকে।
২. অদ্ভুত মতবাদ ও চিন্তা প্রকাশ করে মিথ্যা ও অমূলক ধারণাসমূহ ঈসার সাথে সম্পৃক্ত করা হয়। ঈসার অনুসারীদের পক্ষে সম্ভব ছিল না এ কঠোর দমন-পীড়ন অবস্থায় তার প্রতিবাদ করা কিংবা সেসব মতবাদ যে মিথ্যা তা যথাযথভাবে খণ্ডানো।
কঠিন সেই পরিস্থিতিতে যেসব মতবাদ তৈরি হয় তার মাঝে শৌল, যার আরেক উপাধি ‘পল’, তার মতবাদটি অধিক প্রসিদ্ধি লাভ করে।
পল:
খৃস্টান ও সমসাময়িক অন্যান্য গবেষক ও ঐতিহাসিকগণ প্রায় একমত যে, বর্তমানে পরিচিত খৃস্ট ধর্মের প্রকৃত প্রবর্তক হচ্ছে ‘পল’।
এতে কোনো দ্বিমত নেই যে, ইয়াহূদীদের মধ্যে ‘পল’ প্রথম অবস্থায় ঈসার উপর ঈমান আনয়নকারী মুমিনদের সাথে শত্রুতা ও তাদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহণে সবচেয়ে কঠিন ছিল। খোদ পলের পত্রাবলিতে তা লিখিত রয়েছে। কিন্তু সে হঠাৎ খৃস্ট-ধর্মে দীক্ষিত হয় ও তা গ্রহণ করে এবং সে বড় রাসূলে পরিণত হয়, যেমন তার সম্পর্কে তারা বলে থাকে।
প্রকৃতপক্ষে তার খৃস্টান হওয়া সুদূর প্রসারী ইয়াহূদী চক্রান্তের অংশ ছিল, সে ভেতর থেকে খৃস্টান ধর্ম ধ্বংস করা শুরু করে, যা ইচ্ছা তাই সে রহিত করে এবং যা ইচ্ছা তা-ই সে যোগ করে, অথচ সে ঈসা মাসীহ এর সাক্ষাত পায় নি এবং তাকে সে দেখেও নি, তবে সে দাবি করে যে, মাসীহ তার নিকট ওহি পাঠায় অতঃপর অধিকাংশ খৃস্টান তাকে সত্য বলে বিশ্বাস করে এবং ‘প্রেরিত পল’ হিসেবে আখ্যা দেয়। পরবর্তীতে তার পত্রগুলোই তাদের মুকাদ্দাস কিতাব বা পবিত্র কিতাব হিসেবের অংশে পরিগণিত হয়। প্রকৃতপক্ষে ‘পল’ ইয়াহূদী দার্শনিক প্লটিনাস এর গড়া মতবাদে বিশ্বাসী ছিল, যা নিওপ্লেটোনিজম নামে পরিচিত। প্লটিনাস তার এ মতবাদ দু’টি দর্শন থেকে গ্রহণ করে: একটি হিন্দু দর্শন ও অপরটি গ্রীক দর্শন।
নাসারাদের আকিদার সারাংশ:
১. ভুল ও প্রায়শ্চিত্ত:
বিকৃত খৃস্ট মতবাদ বিশ্বাস করে যে, আদম যখন বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করে ভুলে পতিত হয়, তখন মানব জাতি তার প্রায়শ্চিত্ত করা ও তার থেকে মুক্তিদাতার মুখাপেক্ষী হয়। তখন আল্লাহ তা‘আলা বনি আদমের উপর রহম করেন ও তার একমাত্র সন্তানকে প্রেরণ করেন—আল্লাহ তাদের অপবাদ থেকে পবিত্র—, যেন তাকে শূলে চড়িয়ে হত্যা করা হয় পাপের প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে। তাই প্রত্যেক মানুষের বিশ্বাস করা জরুরি মাসিহ আল্লাহর সন্তান, মানব জাতির মুক্তিদাতা ও তাদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত-কারী। তাই খৃস্টানরা ক্রুশকে পবিত্র জানে এবং সেটা তাদের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত হয়।
২. ত্রিত্ববাদ:
খৃস্টানরা সবাই একমত যে, আল্লাহ তিন সত্তা। তিন সত্তাকে তারা তিনটি উকনুম বলে। সে তিন উকনুম হচ্ছে, পিতা, সন্তান ও রুহুল কুদস। অতঃপর তালা বলে: তিনজন মিলে একজন।
কিন্তু উকনুমের অর্থ কি এ নিয়ে তারা দ্বিমত করে, দ্বিমত করে প্রত্যেক উকনুমের স্বভাব ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে। এ কারণে তারা প্রায় দুই হাজার বছর ধরে একগ্রুপ অপর গ্রুপকে কাফের বলে ও একগ্রুপ অপর গ্রুপকে লানত করে।
ইউরোপীয় ইতিহাস সাক্ষী যে, তাদের পরস্পর এসব বিরোধের শিকার মৃত ব্যক্তিদের পরিমাণ সে সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে গেছে কয়েকগুণে, তাদের থেকে যে সংখ্যা মুসলিম, ইয়াহূদী ও অগ্নিপূজকদের হাতে মারা গেছে।
আশ্চর্য হচ্ছে এ বিরোধের মূল কারণ ত্রিত্ববাদের হাকিকত না জানা, তাদের কতক আলেম এমনও বলেন, কিয়ামতের দিন যখন তিনি বিকশিত হবেন সেই সময় ব্যতীত তার হাকিকত জানা সম্ভব নয়।
৩. মধ্যস্থতা সাব্যস্তকরণ, হালাল ও হারাম করা:
বিকৃত খৃস্টধর্ম ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহ ও সৃষ্টির মাঝে মধ্যস্থতায় বিশ্বাস করে। উপাস্য ও উপাসকের মাঝে মধ্যস্থতা করাই ধর্মীয় ব্যক্তিদের গুরু দায়িত্ব। তাদের মাধ্যমে একজন ব্যক্তির খ্রিস্টান হওয়া, অপরাধ স্বীকার করা, সালাত ও কুরবানি পেশ করা সম্পন্ন হয়। এভাবে ধর্মীয় ব্যক্তিরা মূলত তাগুতে পরিণত হয়, তারা মানুষকে গোলাম বানায়। আল্লাহর বিধান তোয়াক্কা না করে তারা অনুসারীদেরকে হালাল-হারাম ফয়সালা দেয়, আল্লাহ বলেন:
﴿ٱتَّخَذُوٓاْ أَحۡبَارَهُمۡ وَرُهۡبَٰنَهُمۡ أَرۡبَابٗا مِّن دُونِ ٱللَّهِ وَٱلۡمَسِيحَ ٱبۡنَ مَرۡيَمَ وَمَآ أُمِرُوٓاْ إِلَّا لِيَعۡبُدُوٓاْ إِلَٰهٗا وَٰحِدٗاۖ لَّآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَۚ ٣١﴾ [التوبة: 31]
“তারা আল্লাহকে ছেড়ে তাদের পণ্ডিত ও সংসার-বিরাগীদের রব হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং মারয়ামপুত্র মাসীকেও। অথচ এক আল্লাহ ব্যতীত কারো ইবাদত করার নির্দেশ তাদেরকে প্রদান করা হয়নি”।[3]
তারা তাদের পণ্ডিত ও সংসার বিরাগীদের কিভাবে ইবাদত করত, তার ব্যাখ্যায় নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “হারাম ও হালালের ব্যাপারে তাদের আনুগত্য করা”। আদি ইবনে হাতিম থেকে প্রসিদ্ধ হাদিসে এরূপ এসেছে। খৃস্টানরা এখনো যদি কোনো বিষয় হারাম অথবা হালাল করার মধ্যে স্বার্থ দেখে, তারা বাবা ও ধর্মীয় ব্যক্তিদের নিকট তার আবেদন জানায়। অতঃপর বাবারা ইঞ্জিল বিরোধী বিল পাশ করেন।
তাদের এসব নীতি কতগুলো খারাপ পরিণতির জন্ম দিয়েছে, যেমন: পাপমোচন সনদ প্রচলন করা, দীর্ঘ যুগ ধরে ইলম, অধ্যয়ন ও লিখার দায়িত্ব ধর্মীয় ব্যক্তিরা কুক্ষিগত করে রাখা।
৪. তাদের নিকট অবস্থিত তথাকথিত ‘কিতাবুল মুকাদ্দাস’ এর উপর ঈমান রাখা, যেমন (ওল্ড টেস্টামেন্ট ও নিউ টেস্টামেন্ট)। অর্থাৎ তাওরাত, বিভিন্ন পত্র ও ইঞ্জিলসমূহ। এ ব্যাপারে আমরা অচিরেই আলোচনা করছি:
খৃস্টানদের পবিত্র কিতাবসমূহ:
খৃস্টানদের নিকট ‘মুকাদ্দাস কিতাব’ দু’প্রকার গ্রন্থকে বুঝায়:
১. আল-‘আহদুল কাদিম বা ওল্ড টেস্টামেন্ট: অর্থাৎ তাওরাত ও তার বর্ধিতাংশ বিভিন্ন আসফার, পূর্বে যার আলোচনা হয়েছে।
২. আল-‘আহদুলি জাদিদ বা নিউ টেস্টামেন্ট: অর্থাৎ চারটি ইঞ্জিল ও বিভিন্ন পত্র, যার অধিংকাশ লিখেছে ‘পল’ ও তার ছাত্ররা।
চার ইঞ্জিল:
খৃস্টানদের নিকট শত্তুরের অধিক ইঞ্জিল রয়েছে, তবে তাদের অধিকাংশের নিকট চারটি ইঞ্জিল স্বীকৃত:
১. লুক এর ইঞ্জিল: লুক হচ্ছে ‘পল’ এর ছাত্র ও সাথী, সে এটাকে গ্রীক ভাষায় লিখেছে।
২. মথি এর ইঞ্জিল : তিনি এটা ইবরানি ভাষায় লিখেন, কিন্তু গ্রীক ভাষা ব্যতীত তার অস্তিত্ব নেই, কে ইবরানি থেকে গ্রীক ভাষায় অনুবাদ করেছে তা অজ্ঞাত।
৩. মার্কস এর ইঞ্জিল: মার্কস এটা গ্রীক ভাষায় লিখেন, কিন্তু তার লেখক আসলে মার্কস নাকি অন্য কেউ এ ব্যাপারে তারা দ্বিমত করেন।
৪. যোহন এর ইঞ্জিল: এর লেখক সম্পর্কেও তারা দ্বিমত করেন, তবে তারা সবাই একমত যে, মাসীহের উলুহিয়াত প্রমাণ করার জন্যই যোহন এ ইঞ্জিলটি লিখেছেন। এটাই সর্বশেষ ইঞ্জিল।
বস্তুত ঈসার অনেক পর এসব ইঞ্জিল লিখা হয়, অনুবাদের মাধ্যমে এক ভাষা থেকে অপর ভাষায় রূপান্তিত হয়, ইংরেজি দ্বিতীয় শতাব্দীর আগে এসব ইঞ্জিল সম্পর্কে কেউ জানত না।
৩২৫ই. সনে বহু ইঞ্জিল থেকে এ চারটি ইঞ্জিল মনোনীত করা হয়, অন্যান্য সকল ইঞ্জিল পুড়িয়ে ফেলা ও ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
খৃস্টানদের দাবি হচ্ছে, এগুলো আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহির মাধ্যমে নাযিলকৃত, কিন্তু যে এসব দেখবে কোনো সন্দেহ করবে না যে, এগুলো আল্লাহর পক্ষ থেকে নয়। অনেক ক্ষেত্রে তা বিপরীত ও পরস্পর বিরোধী। প্রত্যেক লেখক তার লেখনীতে স্বীয় আকিদা, অথবা তার নিকট যে ইতিহাস ও জীবন চরিত পৌঁছেছে তাই লিখেছেন। এগুলো কী নির্ভরযোগ্য সূত্রে পেয়ে লিখেছেন, না তারা নিজেরা রচনা করেছেন তার কিছুই জানা যায় না।
ঈসা মাসীহ এর একটি জীবনী গ্রন্থ পাওয়া যায়, যার নাম (ইঞ্জিলে বারনাবা বা বার্নাবাসের ইঞ্জীল), এ গ্রন্থটি অন্যান্য সকল গ্রন্থ থেকে পৃথক। কুরআন ও সুন্নায় মাসিহ ঈসা সম্পর্কে যে আলোচনা এসেছে, তার সাথে এ কিতাবের রয়েছে সবচেয়ে বেশি মিল। এতে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে স্পষ্টভাবে ঈসা মাসীহ এর র সুসংবাদ রয়েছে। কিন্তু অন্ধ গোঁড়ামি খৃস্টান ধর্মীয় ব্যক্তিদের এ ইঞ্জিল অস্বীকারকারী বানিয়েছে, তারা বিনা দলিলে তার শুদ্ধতা অস্বীকার করে।
আকানিমুন নাসারা বা ‘খৃস্টানদের তিনসত্তা’র উপর লিখিত কিতাব: (ক্যাথলিক ও অর্থোডক্সদের নিকট ঈমানের নীতি)
৩২৫ খৃস্টাব্দে নিসিয়ায় খৃস্টানরা প্রথম বিশ্ব গির্জা সম্মেলন অনুষ্ঠান করে, সেখানে তারা ঈমানের সাধারণ নীতি প্রকাশ করে, ক্যাথলিক বর্ণনায় তার ঘোষণা নিম্নরূপ:
“আমরা এক ইলাহের প্রতি ঈমান আনি। প্রত্যেক বস্তু নিয়ন্ত্রণকারী পিতা, দৃশ্য ও অদৃশ্য প্রত্যেক বস্তু সৃষ্টিকারী। এক রব যীশুর প্রতি ঈমান আনয়ন করি, মাসীহ ইবনে আল্লাহ, বাবার থেকে জন্ম। পিতার উপাদান থেকে একমাত্র জন্ম বা সৃষ্টি। ইলাহ থেকে ইলাহ, সত্য ইলাহের নূর থেকে নূর, ভূমিষ্ঠ তবে সৃষ্ট নয়, জাওহার বা উপাদানের ক্ষেত্রে বাবার সমতুল্য, যার জন্য আসমান ও জমিনের প্রত্যেক বস্তু সুপ্রতিষ্ঠিত। তিনি আমাদের মুক্তির জন্য অবতরণ ও শরীর ধারণ করেন। আমাদের ভালোবাসেন, আমাদের জন্য কষ্ট স্বীকার ও মৃত্যু বরণ করেন। তিনি তৃতীয় দিনে দাঁড়ান ও আসমানে চলে যান। সেখান থেকে তিনি আগমন করবেন যেন জীবিত ও মৃতরা তার আনুগত্য করে ও রুহুল কুদসকে বিশ্বাস করে। যারা বলে, এমন একটা সময় ছিল যখন তিনি ছিলেন না, তার জন্মের পূর্বে তার অস্তিত্ব ছিল না, তাকে অনস্তিত্ব থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে, অথবা তিনি বস্তু থেকে অথবা তিনি (আল্লাহ ব্যতীত) অন্য উপাদান থেকে, অথবা তিনি আল্লাহর সন্তান মখলুক, অথবা তিনি পরিবর্তন উপযোগী বা পরিবর্তনশীল, তারা খ্রিস্টান ধর্মের প্রতিনিধিত্বকারী সকল গির্জার পক্ষে থেকে অভিশপ্ত”।[4]
অর্থোডক্সদের বর্ণনায় তার ঘোষণা নিম্নরূপ:
“আমরা এক ইলাহ ও সবকিছু নিয়ন্ত্রণকারী পিতার প্রতি ঈমান আনয়ন করি, যিনি আসমান ও জমিন এবং দৃশ্য ও অদৃশ্য যাবতীয় বস্তুর স্রষ্টা। আমরা এক রব আল্লাহর সন্তান যীশু মাসির উপর ঈমান আনয়ন করি। তিনি সকল যুগের পূর্বে পিতা থেকে জন্ম একমাত্র সন্তান। নূর থেকে নূর, সত্য ইলাহ থেকে সত্য ইলাহ, ভূমিষ্ঠ তবে সৃষ্ট মখলুক নয়, উপাদানের বিবেচনায় পিতার ন্যায়, যার জন্য প্রত্যেক বস্তু সুপ্রতিষ্ঠিত, যিনি আমাদের জন্য ও আমাদের মুক্তির জন্য আসমান থেকে অবতরণ করেন, মারইয়াম থেকে রুহুল কুদুসে শরীরত্ব গ্রহণ করেন। তিনি ভালো বাসেন ও আমাদের পক্ষে বিলাতিস নাবতির যুগে শূলে চড়েন, কষ্ট ভোগ করেন, কবরস্থ হন এবং তৃতীয় দিন মৃতদের থেকে দণ্ডায়মান হন, যেমন কিতাবে রয়েছে। তিনি আসমানে চড়ে যান ও তার পিতার ডান পাশে বসেন। তিনি স্বীয় সম্মানে পুনরায় আসবেন, যেন জীবিত ও মৃতরা আনুগত্য করে, তার রাজত্বের কোনো ক্ষয় ও বিনাশ নেই”।[5]
লেখক: ড. সফর ইবনে আব্দুর রহমান আল-হাওয়ালি
অনুবাদ : সানাউল্লাহ নজির আহমদ
সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
[1] সূরা সাফ: (৬)
[2] সূরা নিসা: (১৫৭)
[3] সূরা তাওবা: (৩১)
[4] আলকিস ইলয়াস মিকার রচিত: ‘ইমানি’ কিতাব থেকে সংগৃহীত।
[5] সংগৃহীত ‘অর্থোডক্স গীর্জার আকিদার উপর ইমানী মূলনীতির সারাংশ’ কিতাব থেকে। রচনা: হাবিব জারজিস।
আসসালামু’য়ালাইকুম,আমাদের দেশে অনেক ধর্মীয় মাসিক ম্যাগাজিন আছে।আমরা কোনগুলো পড়বো যদি দয়া করে একটু উল্লেখ করে দিতেন ভালো হত।