বিভিন্ন ধর্ম ও মতবাদ

সূফীবাদ

সূফিয়াহ صوفية শব্দটি সুফিয়া سوفيا শব্দ থেকে গৃহীত, গ্রীক ও পুরাতন হিন্দি ভাষায় তার অর্থ আল-হিকমাহ বা ‘হিকমত’। এ সুফিয়া শব্দ থেকেই فيلاسوفيا ফাইলাসুফিয়া ও فيلسوف ফাইলাসূফ[1] শব্দদ্বয়ের উৎপত্তি, তার অর্থ محب الحكمة বা হিকমত প্রেয়সী বা জ্ঞান প্রেমিক, যেরূপ ثير صوفية (সির সূফিয়াহ) শব্দের অর্থ ইলাহের সাথে সম্পৃক্ত হিকমত। সূফীবাদ একাল ও সেকালের প্রসিদ্ধ এক মাযহাব।

হিন্দুরা সূফিয়াহ শব্দটি ব্রাহ্মন সন্ন্যাসী ও তাদের আধ্যাত্মিক পণ্ডিতদের জন্য ব্যবহার করে, যারা তাদের ধারণাপ্রসূত হিকমত ও মারেফাতের তালাশে বন-জঙ্গলে উলঙ্গ ঘুরে। তাদের লক্ষ্য হচ্ছে আল্লাহর সাথে একাকার হওয়া ও আল্লাহর মাঝে বিলীন হয়ে যাওয়া। অথচ আল্লাহ তাদের বিশেষণ থেকে পবিত্র।[2]

হিজরি দ্বিতীয় শতাব্দীর পূর্বে ইসলামে এ পরিভাষা—অর্থাৎ সুফিয়াহ পরিভাষা—শুনা যায় নি, সে সময়ে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন কতক ব্যক্তির জন্য এ শব্দটি ব্যবহার করা হত, যারা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সাহাবিদের আদর্শের বিপরীত ইবাদতের ময়দানে বৈরাগ্যতা গ্রহণ করেছিল।

রাবিদের মান নির্ণয়কারী (জারহ ও তাদিলের) আলেমগণ ও বিভিন্ন ফেরকার উপর লেখকগণ তাদেরকে যিন্দিক বলতেন। তাদের কতিপয়ের ইসলামের সাথে বিন্দুমাত্র সম্পর্কে ছিল না। তারা ছিল অখ্যাত, অপরিচিত সন্ন্যাসী, জমিনে ঘুরে বেড়াত এবং গুহা ও জন-মানবহীন স্থানে বাস করত।

তৃতীয় ও চতুর্থ শতাব্দীতে সূফীবাদ ব্যাপক বিস্তার লাভ করে, তখনো তার অনুসারীদের যিন্দিক বলা হত, এ জন্য তাদেরকে বহুবার বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়, যাদের বিচার হয় তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, জুনাইদ, নুরী, জুন্নুন মিসরি , আবার তাদের কাউকে হত্যাও করা হয়েছে যেমন হাল্লাজ।

পঞ্চম হিজরিতে আবু হামিদ আল-গাযালির প্রকাশ ঘটে (মৃ.৫০৫হি.), তিনি ইসলামি বিশ্বে সূফীবাদ বিস্তার ও তাকে ইসলামি পোশাক দান করেন।

গাযালি ছিলেন সুখ্যাতিসম্পন্ন ও প্রসিদ্ধির অধিকারী ফকীহ ও মুতাকাল্লিম বা কালাম শাস্ত্রবিদ। তিনি স্বীয় লেখনীতে ফিকহ, কালামশাস্ত্র ও তার পূর্বের সূফীদের কুসংস্কারের সংমিশ্রণ ঘটান, যেমন মুহাসিবি ও আবু তালিব মক্কী। তার সাথে নিজস্ব মত ও দর্শন যুক্ত করেন, এভাবে তাসাউফ বিস্তার লাভ করে এবং মানুষও তা গ্রহণ করে নেয়।

তাসাউফ বিস্তারের কারণ:

তাসাউফ বিস্তারে প্রধান কারণ ছিল, সে সময় মুসলিম উম্মাহ বাতেনিদের বিদ্রোহ ও রাফেদিদের শাসনের দাপটে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল, আহলে সুন্নাহর আলেমগণ রাফেদি রাষ্ট্রসমূহের পক্ষ থেকে নির্যাতনের শিকার হতে থাকে, অপর দিকে সভ্যতা ও সংস্কৃতির ময়দানে মু‘তাযিলা, মুতকাল্লিম বা কালামশাস্ত্রবিদ ও বাতেনিদের মোকাবিলা করতে থাকে, এ সুযোগে সূফীবাদ নিম্নশ্রেণির লোকদের মধ্যে তার থাবা বিস্তার করতে থাকে।

তার সাথে যোগ হয় প্রাচ্যের ইসলামি জগতে খৃস্টীয় হামলার আঘাত, ফলে বাতিলপন্থীদের সংখ্যা বেড়ে যায় ও সকল বাতিল ফেরকা প্রত্যেক ময়দানে পুরোদমে উজ্জীবিত হয়।

অনেকটা অনিচ্ছাকৃতভাবে তাসাউফ বিস্তারে ভূমিকা রাখে: ইলমে কালামের প্রচার, কারণ তাতে ছিল শুষ্কতা, দুর্বোধ্যতা, বিবেক ও বুদ্ধিকে বিচারক মানা ও গবেষণায় মগ্ন হওয়া, তখন মানুষেরা দেখল তাসাউফে তার থেকে নিষ্কৃতি রয়েছে, কারণ তাতে রয়েছে দার্শনিক জটিলতাহীন কাশফ, স্বপ্ন ও ইলহামের উপর নির্ভরতা… এভাবে তারা তাসাউফকে ইলমে কালাম ও তার ধারকদের থেকে মুক্তি হিসেবে গ্রহণ করে।

তাসাউফ কি শুধু মুসলিমদের মাঝে সীমাবদ্ধ?

ধর্ম ও মাযহাবের উপর গবেষণা পরিচালনাকারীগণ এ বিষয়ে একমত যে, তাসাউফ বিশ্বজনিন দর্শন ও সাধারণ মানবিক মনোবৃত্তি। যা সকল ধর্ম ও সকল জায়গায় পাওয়া যায়। উদ্দেশ্য, উপকরণ, দলেদলে ভাগ ও বিপরীতমুখী আকিদা বিবেচনায় তাসাউফের সবচেয়ে বেশি মিল হিন্দু ধর্মের সাথে।

সূফীবাদ বিভিন্ন নাম ও বিভিন্ন তরিকায় ইউরোপ, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য জায়গায় বিস্তার লাভ করেছে, এখনো করছে।

ইসলামের সাথে সম্পৃক্ত তাসাউফও বিভিন্ন তরিকা ও বিপরীতমুখী বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত, পাঠকদের সুবিধার্থে আমরা তা দু’ভাগে ভাগ করছি:

তাসাউফের প্রকারসমূহ:

প্রথমত: কট্টরপন্থী তাসাউফ

কট্টরপন্থী তাসাউফের অনুসারী সূফীরা বাড়াবাড়ির কারণে ইসলাম থেকে বের হয়ে গিয়েছে, (অথবা ইসলামেই প্রবেশ করেনি, তবে ইসলামি পোশাক পরেছে ইসলামকে ধ্বংস করার নিমিত্তে অথবা মুসলিমদের শাস্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার উদ্দেশ্যে), এ প্রকার তাসাউফের দু’টি ধারা রয়েছে:

১. দার্শনিক তাসাউফ:

দার্শনিক তাসাউফ গ্রীক ও হিন্দু দর্শন শাস্ত্রের উপর নির্ভরশীল, তার ধারকেরা বাতেনিদের নিকটবর্তী, তারা দর্শন শাস্ত্রের ভিত্তিতে ইলাহ ও পৃথিবী সংক্রান্ত বিষয়ে সাধনা করে, এ জন্য দেখি তাদের লেখনী দর্শন শাস্ত্রের পরিভাষায় পরিপূর্ণ, যেমন: (আকল কুললি, নাফসুল কুল্লিয়াহ, ‘আরদ, জাওহার, সূরাহ ও হায়উলি)।[3]

তারা ইত্তেহাদ (সৃষ্টির সাথে স্রষ্টার একাকার হওয়া) ও ওয়াহদাতুল ওজুদে (সর্বেশ্বরবাদে) বিশ্বাসী। ইসলামের সাথে সম্পৃক্ত তাদের প্রসিদ্ধ ব্যক্তিত্ব হচ্ছে: ইবনে আরাবি ও ইবনুল ফারিদ।

২. বৈরাগী তাসাউফ:

বৈরাগ্যতার সাথে সম্পৃক্ত করে বৈরাগী তাসাউফ বলা হয়, এ তাসাউফকে বৌদ্ধিশ তাসাউফও বলা হয়। এ প্রকার তাসাউফ শারীরিক ব্যায়াম, নির্জনতা, পরিশ্রম ও ধ্যানের উপর নির্ভরশীল। বৈরাগী সূফীরা বৌদ্ধদের সাথে অধিক সাদৃশ্যপূর্ণ। কুমন্ত্রণা, হৃদয়ে জাগ্রত ভাবনা ও প্রবৃত্তকে দমন করার জন্য তারা জমিনে বিচরণ করে ও নির্জনে একান্ত হয়ে সাধনা করে। তারা নেচে-গেয়ে কবিতা আবৃত্তি, গল্প-কাহিনী ও জিকির চর্চা করে। অনুরূপ তারা গুরুত্বারোপ করে অস্বাভাবিক ঘটনা ও কারামতের প্রতি, এসবের জন্য তারা জাদু ও জিনদের ব্যবহার করে।

এ গোষ্ঠীর আকিদা অনেক, যেমন: হুলুল (আল্লাহ কারও শরীরে প্রবেশ করা), ইত্তেহাদ (আল্লাহ তার সৃষ্টির সাথে একীভূত হওয়া বা সৃষ্টি তার স্রষ্টার সাথে একীভূত হওয়া), ওহদাতুল ওজুদ (সর্বেশ্বরবাদ বা সবকিছুতে আল্লাহ আছেন বিশ্বাস করা) ও তাফউয়িদ। তাফউয়িদ অর্থ, আল্লাহ তা‘আলা পৃথিবী পরিচালনার দায়িত্ব তথাকথিত কুতুব ও আউলিয়াদের সোপর্দ করেন।

ইসলামি বিশ্বের অধিকাংশ সূফীবাদী মতাদর্শে বিশ্বাসী বিভিন্ন তরীকার সূফীরা এ মতাদর্শে বিশ্বাসী, তবে তাদের মাঝে কিছু ভিন্নতা রয়েছে, তাদের কারো সাথে প্রথম প্রকার তাসাউফের অনেক মিল দেখা যায়। অতএব তাসাউফ এক চিন্তা ও মতাদর্শে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এক ব্যাপক আদর্শ ও বিপরীতমুখী বিভিন্ন তরিকার সমন্বয়। সূফীরা একই সময়ে বিপরীতমুখী বিভিন্ন আকিদায় বিশ্বাস করে।

দ্বিতীয়ত: বিদ‘আতি তাসাউফ:

বর্তমান ও পূর্বের যুগে অনেক মুসলিম ভালো নিয়তে তাসাউফের সাথে সম্পৃক্ত হয়, তাদের ধারণা এটা এক পরিভাষা, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সাহাবিদের আদর্শের উপর তার ব্যবহার হয়, যেমন মুরাকাবাহ (আত্মপর্যবেক্ষণ), মুহাসাবাহ (আত্মসমালোচনা), আখিরাতের প্রতি উৎসাহ ও দুনিয়ার প্রতি নির্মোহ। তবে তাসাউফের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তির পক্ষে ছোট কিংবা বড় বিদ‘আত থেকে মুক্ত থেকে তা চর্চা করা প্রায় অসম্ভব। তাদের অধিকাংশের আকিদা আল্লাহর সিফাৎ ও তাকদীর সম্পর্কে সঠিক নয়, দুনিয়া ও অন্যান্য বিষয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি যথাযথ নয়। তাই উম্মতের আকিদা, ইলম ও সভ্যতা বিনষ্ট হওয়ার পেছনে এর প্রভাব সুস্পষ্ট।

যে মুসলিম বিশুদ্ধ আকিদা ও ইবাদতের অধিকারী, তার পক্ষে বৈধ নয় তাসাউফ কিংবা অন্য কোনো দলের সাথে সম্পৃক্ত হওয়া, তার সম্পর্ক হবে ইসলাম ও সুন্নতের সাথে, যেমন আমরা পূর্বে বলেছি।

বিভিন্ন ফিরকার সাথে তাসাউফের সম্পর্ক:

তাসাউফের সাথে শিয়াদের সম্পর্ক অধিক। শিয়া ও তাসাউফ ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তাসাউফের খুব কম শায়খই রয়েছে যার সম্পর্ক আহলে বাইতের সাথে নেই। সূফীরা তাই দাবি করে শিয়ারা যা দাবি করে, যেমন ইলমে বাতিন, দুনিয়ায় কর্তৃত্ব করা ইত্যাদি। শিয়ারা যেমন তাদের ইমামদের ইবাদত করে অনুরূপ সূফীরাও তাদের পীরদের ইবাদত করে।

বাস্তব কথা হচ্ছে, বর্তমান ও অতীতকালের পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের গবেষকগণ ঘোষণা করেছেন, কট্টরপন্থী তাসাউফ, কট্টরপন্থী শিয়া ও বাতেনি সম্প্রদায় মূলত এক বস্তুর তিনটি শাখা, অথবা একই বস্তুর তিনটি বাহ্যিক রূপ, যার উদ্দেশ্যও এক, অর্থাৎ ভেতর থেকে ইসলামকে ধ্বংস করা।

সূফীদের তরিকা ও তার রুকন:

সূফীদের নিকট ‘তরিকা’ হচ্ছে একটি পদ্ধতির প্রতীক, যার উপর বিচরণ করে ইবাদতকারী স্বীয় মা‘বুদ পর্যন্ত পৌঁছায়।

তরিকায় চলাচলের হিসেবে সূফীর তিনটি স্তর রয়েছে:

১. মুরিদ: সূচনাকারী, যে শায়খ থেকে গ্রহণ করে।

২. সালেক: যে ব্যক্তি অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার জন্যে বিভিন্ন ব্যায়াম ও মুজাহাদায় রত হয়।

৩. ওয়াসিল: অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনকারী, অভীষ্ট লক্ষ্য হচ্ছে আল্লাহতে বিলীন হওয়া অথবা তার সাথে একাকার হওয়া। কট্টরসূফীরা বিশ্বাস করে ওয়াসিলদের থেকে আল্লাহর আদেশ-নিষেধ ও বিধান রহিত হয়ে যায়, কারণ সালাত, যাকাত ও সওমের উদ্দেশ্য হচ্ছে… তাদের ধারণায়: আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছা, যে পৌঁছে গেছে তার এসবের প্রয়োজন নেই।

তরিকার রুকনসমূহ:

এক: শায়খ

(সূফীদের মতে) কেউ একাকী কখনো আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম নয়, সূফীদের নিকট শায়খ শুধু শিক্ষার মাধ্যম কিংবা এক উসিলা নয় পিতা কিংবা শিক্ষকের মত, বরং সে ঈমান ও গ্রহণীয় হওয়ার মাধ্যম।

এ জন্য শায়খের নিঃশর্ত আনুগত্য করা জরুরি, শায়খের সামনে মুরিদ এমন হবে যেমন গোসল দাতার সামনে মৃত লাশ। মুরিদের পক্ষে শায়খের উপর আপত্তি করা কিংবা প্রশ্ন করা বৈধ নয়, শায়খ যত খারাপ অথবা হারাম কর্ম করুক, যদিও সে প্রশ্ন উদিত হয় মুরিদের নিজের অন্তরের অন্তস্থলে, বরং তার সামনে প্রকাশ্যে ও গোপনে আত্মসমর্পণ করাই জরুরি।

মুরিদের কর্তব্য শায়খের আদেশ, জিকির ও নির্দেশিত সালাত পরিপালন ও অনুসরণ করা, তার করামত প্রচার করা এবং তার পক্ষে প্রতিরোধ করা।

দুই: নির্জনতা

প্রকৃত সূফীর জন্য নির্জনতা খুব জরুরি, হোক সেটা ঘরের কোণে, কিংবা ময়দানে কিংবা জঙ্গলে। অন্ততপক্ষে নির্জনতা অর্জনের জন্য চেহারা ও মাথার উপর মোটা কাপড় মুড়িয়ে মানুষ থেকে আড়াল হবে, দীর্ঘ সময় জিকিরে মশগুল থাকবে ও প্রত্যেক বস্তু থেকে স্বীয় অন্তরকে খালি করবে।

সূফী নির্জনতায় মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়, এমন কি জুমা ও জামা‘আত থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়, নির্দিষ্ট সিয়াম ও নির্দিষ্ট জিকিরে লিপ্ত হয়, যতক্ষণ না কাশফের দ্বার উন্মুক্ত ও জ্ঞানের বারি বর্ষণ হয়।

তিন: ফাতহ ও মুকাশাফাহ

লাগাতার নির্জনতা ও যিকিরের ফলে ফাতহ ও মুকাশাফাহ হাসিল হয়। ফাতহ ও মুকাশাফার প্রকাশ ঘটে বিভিন্নভাবে, কখনো সরাসরি ডাক ও সম্বোধনের মাধ্যমে, যা সূফী শুনতে পায়, অথবা আকৃতি ধারণ করে, যা সূফী নিজের সমানে দেখতে পায়, অথবা সূফীর হাতে অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে ইত্যাদি, যার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, এগুলো শয়তানি ইশারা, অথবা শয়তানি আওয়াজ ও শয়তানি কর্ম।

চার: করামত

সূফীর ওলি হওয়ার জন্য কারামত জরুরি, যেমন প্রত্যেক নবীর জন্য মু‘জিযা জরুরি। সূফীরা ওলি হওয়ার প্রমাণস্বরূপ অনেক করামত দাবি করে, কতক মিথ্যা ও কতক বানোয়াট, কতক দীর্ঘ সাধনার ফল, অথবা জাদু ও শয়তান থেকে সাহায্য গ্রহণ করার ফল অথবা গোপন কোনো প্রতারণা।

কতক সূফী বাতাসে উড়ে, অথবা পানিতে হাঁটে, অথবা নিজেকে জখম করে অথচ তার কোনো ক্ষতি হয় না, অথবা দীর্ঘ দিন যাবত পানাহার ত্যাগ করে… আর দাবি করে এটা তার ওলি হওয়ার কারামাত।

তাসাউফ যে পথভ্রষ্ট ও ইসলাম থেকে বিচ্যুত এগুলো তার স্পষ্ট প্রমাণ, কারণ সবচেয়ে বড় ওলি ছিলেন নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথীগণ (সাহাবীগণ), অথচ তাদের থেকে এ জাতীয় কোনো কারামত প্রকাশ পায় নি।

আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত সত্য কারামত বিশ্বাস করে, সবচেয়ে বড় করামত হচ্ছে, মানুষের কুরআন ও হাদিসকে আঁকড়ে ধরা, বিদ‘আত ও অশ্লীলতা থেকে তার দূরে থাকা, জিহাদ ও আল্লাহর দিকে আহ্বান করা এবং কষ্টের উপর ধৈর্য ধারণ করা।

এসব অস্বাভাবিক ঘটনা সম্পর্কে জানা জরুরি যে, ফিরআউন, হিন্দু ও ইয়াহূদীরা এ জাতীয়, বরং এর চেয়ে বড় জাদু কর্ম আঞ্জাম দেয়। অতএব সুন্নতকে আঁকড়ে ধরা ও তাকওয়ার সাধনা ব্যতীত যা কিছু প্রকাশ পায় সেটা যদি বিলায়েত তথা ওলি হওয়ার মাপকাঠি হয়, তাহলে ওলি, জাদুকর ও ভেলকিবাজির মাঝে কোনো পার্থক্যই নেই।

সূফীদের গুরুত্বপূর্ণ আকিদা:

১. হুলুল (কোনো নির্দিষ্ট সৃষ্টিতে প্রবিষ্ট হওয়া), ইত্তেহাদ (স্রষ্টা ও সৃষ্টি এক হওয়া) ও ফানা (স্রষ্টায় লীন হওয়া)র আকিদা, হিন্দু ও বৌদ্ধদের ন্যায়।

২. কুরআন ও সুন্নাহ থেকে (তথাকথিত) হাকিকত ও মারেফাত হাসিল হবে না, বরং সেটা অর্জন হবে কাশফ, অথবা ইলমে লাদুন্নি (বাতেনি ইলম), ইলহাম ও রুচির মাধ্যমে। (অর্থাৎ সূফীদের নিকট ওহির অর্থ ব্যাপক, ওহি শুধু নবীদের মাঝে সীমাবদ্ধ নয়, বরং সকল ওলির উপরও ওহি হয়)।

৩. তাদের আকিদা, তরিকার শেষ প্রান্তে যে পৌঁছে ও ইয়াকিন হাসিল করে তার থেকে ইবাদত ও বিধি-নিষেধ রহিত হয়।

৪. আল্লাহর বিলায়েত (ওলিত্ব) দাবি করা, তাদের অনেকের দৃষ্টিতে নবীদের উপর ওলিদের মর্যাদা। তাদের সর্বশেষ ওলি সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর অগ্রাধিকার প্রাপ্ত। আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে প্রত্যেক যুগে তাদের অনেকে দাবি করেছে সেই সর্বশেষ ওলি। এতদসত্ত্বেও সূফীরা সবার সাথে সম্পর্ক কায়েম করে ও সবাইকে পবিত্র জানে।

৫. কারামতের দাবি করা ও তার দ্বারা চ্যালেঞ্জ ছোড়া।

৬. অদৃশ্য ব্যক্তিদের উপর ঈমান আনা, যেমন আকতাব, আওতাদ, নুকাবা ও নুজাবা… ইত্যাদি।

তারা বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ তা‘আলা জগতের কর্তৃত্ব ও পরিকল্পনার দায়িত্ব তাদের নিকট প্রদান করেছেন, অথচ আল্লাহ এসব কুসংস্কার থেকে পবিত্র।

সূফীরা এ জন্য তাদেরকে আহ্বান করে, তাদের নিকট প্রার্থনা করে, তাদের জন্য বিভিন্ন মাযার ও পবিত্র স্থান তৈরি করে, যেন মানুষ বরকত ও দো‘আর জন্য সেখানে যায়।

৭. বিদ‘আত ও কুসংস্কার দ্বারা ইবাদত করা: সূফীরা নির্জনতা গ্রহণ করে ও নিজেদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ওযিফা ও জিকির নির্ধারণ করে নেয়, যা তারা বিশেষ মুহূর্তে হাজারো বার পাঠ করে, আর তারা মনোযোগ বৃদ্ধি, তাযকিয়াহ ও নৈকট্য লাভের জন্য নাচ-গান করে।

৮. সূফীরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে বাড়াবাড়ি করে, যেমন শিয়ারা আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু সম্পর্কে, বৌদ্ধরা বৌদ্ধ সম্পর্কে আর খৃস্টানরা ঈসা আলাইহি সালাম সম্পর্কে বাড়াবাড়ি করে।

একটি উদাহরণ: সূফীদের ধারণা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বপ্রথম সৃষ্টি, আল্লাহ তা‘আলা তাকে স্বীয় নূর থেকে সৃষ্টি করেছেন,—আল্লাহ তাদের এসব বাজে বিশেষণ থেকে অনেক উর্ধ্বে—তারা আরও বলে থাকে যে, তিনি সকল গায়েব জানেন, তার হাতে রয়েছে আসমান ও জমিনের চাবি। তারা নির্দিষ্ট কতক দরূদ তৈরি করে তার দ্বারা তার উপর দরূদ পাঠ করে, যার অর্থ বাড়াবাড়ি ও অতিরঞ্জনে পূর্ণ।

আরেকটি উদাহরণ: সূফীরা আল্লাহ ব্যতীত নবীকে আহ্বান করে ও তার নিকট আশ্রয় চায়। তারা আকতাব ও সকল অদৃশ্য পুরুষকেও আহ্বান করে।

উম্মতে মুসলিমার উপর তাসাউফের প্রভাব:

উম্মতে মুসলিমার আকিদা ও জীবনে তাসাউফের ব্যাপক প্রভাব পড়েছে, তন্মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে:

১. সূফীরা যে শির্ক ও মৃত ব্যক্তির ইবাদত ইসলামে দাখিল করিয়েছে তার দ্বারা তাওহিদুল ইবাদাহ ব্যাপকভাবে ধ্বংস ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এগুলো শিয়া ও সূফীরা ইসলামে প্রবেশ করিয়েছে মূলত বৌদ্ধদের থেকে, যা উবাইদি (তথাকথিত ফাতেমী) শাসনামলে মিসর, মরক্কো ও প্রাচ্যে রাফেদি রাজ্যসমূহে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল।

২. তারা হুলূল, ইত্তেহাদ ও আল্লাহকে মখলুকের সাথে তুলনা করে তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহ এবং তাওহিদুল আসমান ও সিফাতকে ব্যাপকভাবে ধ্বংস করে, যেমন: তাদের বড়দের কতক বাণী: (আমি আল্লাহ), (আমার পবিত্রতা, আমার পবিত্রতা, আমার শান কি মহান), (জুব্বার ভিতরে আল্লাহ ব্যতীত কেউ নেই)।

তাছাড়া সুন্দর চেহারা ও সুন্দর আকৃতির প্রতি তাদের প্রেম সর্বজন বিদিত, তাদের ধারণা আল্লাহ তাতে প্রবেশ করে, অথবা এটা আল্লাহর সৌন্দর্যের প্রকাশ, অথচ আল্লাহ তাদের এসব বিশেষণ থেকে কতই না পবিত্র!

৩. উম্মতে ইসলামিয়াকে বিভক্ত ও বিভিন্ন ফেরকার সাথে সম্পৃক্ত করা। বস্তুত সূফীদের পরস্পর বিরোধী অনেক তরিকা রয়েছে, তার সাথে অনেক মুসলিম সম্পৃক্ত হয়ে নিজেরা শতধা বিভক্ত হয়ে পড়ে, যেমন কাদেরিয়া, রিফা‘ঈয়াহ, তিজানিয়্যাহ, সাযেলিয়াহ, নকশেবন্দিয়াহ, মিরগানিয়াহ, আহমাদিয়া—আহমদ বাদাওয়ীর সাথে সম্পৃক্ত—, প্রত্যেক তরিকার রয়েছে পৃথক ওযিফা, জিকির, ইবাদত ও বিশেষ দরূদ। প্রত্যেক তরিকা দাবি করে তারা একাই সত্য ও সঠিক পথের উপর, বরং প্রত্যেক তরিকা আবার বিভিন্ন ফেরকা ও অনেক তরিকায় বিভক্ত।

৪. জিহাদ ত্যাগ করা: বরং সাধারণভাবে আমল পরিত্যাগ করা: সূফীরা জিহাদ ও আমল ত্যাগ করার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে, ইতিহাস সাক্ষী, কতক সূফী তাতারিদের বাগদাদে প্রবেশ করার সময় সাহায্য করেছিল, বর্তমান ইউরোপীয় উপনিবেশদের সাহায্য করছে তারাই।

৫. ইলমি জীবনকে ধ্বংস করা: শারীরিক সাধনা, নির্জনতা, ওযিফা ও নানা ওরসে সূফীদের মনোযোগ সীমাবদ্ধ। এসব কারণে তারা ইলম থেকে দূরে থাকে, অধিকন্তু ইলমের প্রতি তাদের তাচ্ছিল্য তো আছেই, যেমন তারা ইলমকে বলে: ইলমে জাহির, ইলমুল ওরাক, অথবা ইলমুর রুসুম ইত্যাদি।

তাছাড়া সূফীরা কাশফ ও ইলহামের প্রতি গুরুত্বারোপ করে চিন্তা শক্তি, ইজতিহাদ ও বিবেকের ক্রিয়াশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে ব্যাপকভাবে।

৬. ইসলামি সভ্যতার পতন ঘটানো: পূর্বে উল্লেখিত কর্মকাণ্ডের সাথে সূফীরা তাদের নিঃস্বতা, ভিক্ষাবৃত্তি ও কল্পনাপ্রসূত কতক উসিলা যোগ করে ইসলামি সভ্যতাকে নিম্নমুখী ও পতনের দিকে ঠেলে দেয়, যার নামকরণ করে তারা: হুজুব, তাবিজ ও হুসুন ইত্যাদি। যাতে তারা কল্যাণ আহরণ ও অকল্যাণ প্রতিহত করার বিশ্বাস করে থাকে।

৭. সূফীরা কতক আকিদা ও শারয়ী পরিভাষার অর্থ পরিবর্তন করে, যেমন: তাওয়াককুল, যুহুদ, কাদর। তাদের নিকট এগুলো পরিবর্তিত হয়ে রূপান্তরিত হয় পরনির্ভরতা, ভিক্ষাবৃত্তি ও অক্ষমতায়।

সূফীদের নিকট ওহদাতুল ওজুদ:

ইবনে আরাবি[4] বলে: “আল্লাহর সুন্দর নামের একটি হচ্ছে: ‘আল-আলীয়্যূ’ (অর্থ সুউচ্চ), কার উপর উচ্চ? অথচ সেখানে তিনি ব্যতীত কেউ নেই, তিনি সুউচ্চ নিজে নিজেই,, অথবা কিসের তুলনায় সুউচ্চ? সেখানে তো তিনিই তিনি। অতএব তার নিজের জন্যই নিজের উচ্চতা, আর তিনি ওজুদ বা অস্তিত্ব হিসেবে হুবহু অস্তিত্বশীল বা মওজুদ। অতএব মূসাম্মা বা নামযুক্ত বস্তু মুহদাসাত[5] বা সৃষ্টজীব, নিজে নিজে সুউচ্চ, আর সুউচ্চ আল্লাহ ব্যতীত কেউ নয়। তিনি সুউচ্চ, তবে তার উচ্চতা তুলনামূলক নয়, কারণ অনস্তিত্ব অস্তিত্বের গন্ধ পায়নি, সে অস্তিত্বশীল বস্তুতে একাধিক আকৃতিতে ঠিকই, কিন্তু মূল বস্তু এক, যেমন সমষ্টিগত বস্তুর ভেতর থেকে একটি বস্তু সমষ্টির বিচারে এক। অতএব নামের মধ্যে আধিক্য থাকা, বস্তুত নাম সম্পর্ক, নাম অনস্তিত্বশীল, অথচ তাও আইন (মূল বস্তু), যা প্রকৃত সত্তা। অতএব তিনি নিজের অপেক্ষায় সুউচ্চ, কারো তুলনায় নয়।

যেমন তুমি বল: তিনি, তিনি নয়, তুমি, তুমি নয়।

খাররায[6] বলেন: তিনি হকের চেহারার এক চেহারা, হকের জবানের এক জবান, যা নিজের সম্পর্কে বলে: আল্লাহর পরিচয় বর্ণনা করা যায় না তবে তার উপর দু’টি বিপরীত বস্তুর হুকুম প্রয়োগ করা ব্যতীত। তিনি প্রথম তিনি শেষ, তিনি প্রকাশ্য তিনি অপ্রকাশ্য। যা প্রকাশ হয় তার মূল সত্তা তিনি, তার প্রকাশ অবস্থায় যা অদৃশ্য তার মূল সত্তাও তিনি। সেখানে কেউ নেই যে তাকে দেখে তিনি ব্যতীত, সেখানে কেউ নই যে তার থেকে অদৃশ্য হয়, তিনি নিজের জন্য প্রকাশ্য, নিজের থেকেই অদৃশ্য। তিনি আবু সাইদ আল-খাররায ও অন্যান্য মখলুকেরই নাম”।[7]

 

লেখক: ড. সফর ইবনে আব্দুর রহমান আল-হাওয়ালি
অনুবাদ : সানাউল্লাহ নজির আহমদ
সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া


 

[1] এর অর্থ দার্শনিক। [সম্পাদক]

[2] দেখুন: মাউদুউল হিন্দুসিয়াহ’: (পৃ.১০১)

[3] সূরাহ হচ্ছে বাহ্যিক দৃশ্য, হায়উলি হচ্ছে উপাদান ধাতু, যেমন চেয়ার হচ্ছে সূরাহ আর তার কাঠ হচ্ছে হায়উলি।

[4] তার পুরো নাম: মুহাম্মদ ইবনে আলি আল-হাতেমি আত-তাঈ, উপাদি ‘মুহিউদ্দিন ইবনে আরাবি’, মৃত (৬৩৮হি.), সূফীরা তাকে পবিত্র জানে ও খুব সম্মান করে, তাকে শায়খে আকবার বলা হয়।

[5] মুহদাসাত অর্থ মাখলুকাত।

[6] আবু সাঈদ খাররায সূফীদের আগের যুগের ইমাম।

[7] ফুসুসুল হিকাম: (পৃ.৭৬-৭৭), মিসর থেকে ছাপা।

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

২টি মন্তব্য

    1. সূফীবাদ বা তাসাউফ নিয়ে এই আটিকেল থেকে অনেক কিছু জানতে পারলাম বুঝতে পারলাম ধন্যবাদ লেখক কে। তবে আমি যতটুকু বুঝলাম বা দেখলাম সূফীবাদ বা সূফী দর্শন নিয়ে মুক্তিধারা ডট কম http://www.muktidhara.com প্রচুর পরিমাণ জ্ঞানগর্ভ আলোচনা হয়েছে। http://muktidhara.com/%e0%a6%b8%e0%a7%82%e0%a6%ab%e0%a7%80-%e0%a6%93-%e0%a6%b8%e0%a7%82%e0%a6%ab%e0%a7%80%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%a6/

মন্তব্য করুন

Back to top button