শহরের সব কিছুই আছে, নেই শুধু মানুষ
বেশ গোছানো একটি শহর। এ শহরে ১৩ হাজারের বেশি এপার্টমেন্ট। ১৫টি প্রাইমারি স্কুল, একটি হাসপাতাল, ১০টি জিম, ৩৫টি খেলার মাঠ, একটা রেলওয়ে স্টেশন, ১৬৭টি বাস। বর্ণনা শুনে মনে হচ্ছে বেশ জাঁকজমক তো এ শহরটার। তাহলে শহরবাসী নিশ্চয়ই খুব সুখে আছে। প্রতিদিন এ শহরে বয়ে যায় মানুষের স্রোত। চলে অফিস। পাশাপাশি চলে মানুষের ঘর-সংসার।যা ভাবা হচ্ছে তা কিন্তু মোটেও সত্যি নয়। কেননা এ শহরে কোনো মানুষ বসবাস করে না। কী, চমকে উঠলেন? তা চমকানোর মতোই কথা। এ শহরের রাস্তাঘাট, দালানকোঠা সব কিছুই এখন পরিত্যক্ত। এ শহর ছেড়ে মানুষ চলে গেছে মাত্র দু’দিনে। গেরস্থালির জিনিসপত্র, শিশুদের খেলনা, পড়ে আছে সব। শহরটির নাম প্রিপায়াত। চেরনোবিল আণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কর্মীদের থাকার জন্য মূলত এ শহর তৈরি করা হয়েছিল। এ রকম শহর পৃথিবীতে আরো আছে। তাদের মধ্যে প্রিপায়াতের আয়ু সবচেয়ে কম। সরকারিভাবে এটিকে শহর হিসেবে ঘোষণা করা হয় ১৯৭৯ সালে। আর ২৬ এপ্রিল ১৯৮৬-তে চেরনোবিল দুর্ঘটনার দু’দিনের মধ্যে এ শহর ভূতের শহর হয়ে যায়।পৃথিবীতে যতগুলো ভূতের শহর বা গোস্ট টাউন দাঁড়িয়ে আছে তার মধ্যে প্রাচীনতম হলো, আমাদের ছেলেবেলায় পড়া লাস্ট ডেজ অফ পম্পেইর সেই পম্পেই। পম্পেই ছিল রোমানদের প্রমোদনগর। ৭৯ খ্রিস্টাব্দে মাউন্ট ভিসুভিয়াসের অগুœ্যৎপাতের ফলে শেষ হয়ে যায় এ শহর, পাশাপাশি কুড়ি হাজার বাসিন্দা। যেদিন এ মহাপ্রলয় ঘটেছিল তার আগের দিনই পম্পেই পালন করেছে রোমান অগ্নিদেবতার পূজোর উৎসব ভালকানালিয়া। বহু শতাব্দী কয়েক হাজার টন ছাইয়ের তলায় চাপা থাকার পর এ শহর আবিষ্কার হয় ১৫৯৯ সালে। এত বছর ছাইয়ের তলায় থাকার ফলে এ শহরের ওপর প্রকৃতির আর কোনো আক্রমণ হতে পারেনি।অবিকৃত রয়ে গেছে অনেক রাস্তাঘাট, পোশাক-আশাক, সুরাপাত্র। এমনকি শুকিয়ে বিক্রি করা ফল। আজ সেখানে বছরে প্রায় পঁচিশ লাখ টুরিস্ট যান। পম্পেই পেয়েছে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের সম্মান।স্মরণযোগ্য যে, এ দুটো ভূতের শহর তৈরি হয়েছে প্রাকৃতিক বা মনুষ্যকৃত দুর্ঘটনায়। অবশ্য সব সময় তা হয় না। নামিবিয়া তখন জার্মান কলোনি। মরুভূমির মধ্যে দিয়ে রেললাইন পাতছে জার্মানরা। ১৯০৮ সালে কাজ করতে করতে সেখানে হঠাৎ এক কর্মী পেয়ে গেল একটি হীরে। সে অবশ্য সেটিকে হীরে বলে চিনতে পারেনি। সে সেটা দেখায় জার্মান রেল ইন্সপেক্টরকে। ব্যস, জার্মানরা বুঝে গেল ওখানে অনেক হীরে পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। রাতারাতি গজিয়ে উঠল শহর। তার নাম হলো কোলম্যানস্কোপ, আফ্রিকান ভাষায় যার মানে কোলম্যানের পাহাড়। ওইখানে জনি কোলম্যান নামে এক গাড়োয়ান বালির ঝড় উঠেছে দেখে যাত্রীসহ গাড়ি ফেলে রেখে পালিয়ে গিয়েছিল দিনকয়েক আগে, কপালজোরে তার নাম রয়ে গেল ইতিহাসে।এ শহরে স্কুল, থিয়েটার, ক্যাসিনো, হাসপাতাল, বলরুম তো ছিলই, এছাড়া ছিল এক্স-রে কেন্দ্র। যা দক্ষিণ গোলার্ধে প্রথম। আফ্রিকার প্রথম ট্রাম চলেছিল এ শহরেই। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই এর দুর্দিন শুরু হয়। কারণ, এলাকার হিরে ফুরিয়ে আসছিল। ১৯৫৪ সালে সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত হয়ে যায় কোলম্যানস্কোপ। আজ এটি পর্যটকদের বেড়াবার জায়গা। জানা যায়, মানুষ চলে আসার পর দখল নিয়েছে মরুভূমি। জার্মান কায়দায় তৈরি সব বাড়ির একতলার মেঝে এখন একহাঁটু বালির তলায়। চ্যাপলিনের ছবি গোল্ড রাশের কথা নিশ্চয় মনে আছে। বাস্তবে সেই গোল্ড রাশের ফলে তৈরি হয়েছিল বারকারভিল। সান ফ্রান্সিসকোর উত্তরে আর শিকাগোর পশ্চিমে কারিবু পর্বতমালার পশ্চিম ধার ঘেঁষে ছিল এ শহর। ১৮৬১ সালে ইংল্যান্ডের কেমব্রিজশায়ারের বাসিন্দা বিলি বারকার এখানে পেয়ে গেল প্রায় ৩৭ হাজার আউন্স, মানে এক হাজার কেজি সোনা। খবর ছড়াতেই রাতারাতি গড়ে উঠল শহর। সব থেকে বেশি ব্যবসা করল চিনেরা। মুদিখানা থেকে শুরু করে গাঁইতি-শাবল সবেরই চিনে দোকান বসে গেল।
– ইনকিলাব