প্রাচীন/ঐতিহাসিক নিদর্শন

উট : আল্লাহর সৃষ্টির একটি নিদর্শন

যুগে যুগে সাধারণ মানুষ নবীদের কাছে তাদের সত্যবাদিতার প্রমাণ হিসেবে অলৌকিক জিনিস দাবি করেছে। মহান আল্লাহ তায়ালা তার জবাবে বিভিন্ন প্রাকৃতিক নিদর্শনাবলি মানুষকে মনোযোগ দিয়ে দেখতে বলেছেন। যেমন মেঘ থেকে বৃষ্টি হওয়া, পাহাড় সৃষ্টি, গাছ থেকে ফল হওয়া, মায়ের পেটে মানবশিশুর বিকাশ। তেমনি একটি নিদর্শনের কথা তিনি বলেছেন মরুভূমির উট (সূরা গাসিয়া, আয়াত-১৭) এর শারীরিক গঠন ও চালচলন মরুভূমির জন্য খুবই উপযোগী এবং মহান সৃষ্টিকর্তার এক অপূর্ব নিদর্শন।

এর বৈশিষ্ট্যগুলো সংক্ষেপে নিম্নরূপ :

কুঁজ : চর্বি দিয়ে পূর্ণ থাকে, যার উচ্চতা ৩০ ইঞ্চি ও ওজন ৩৬ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। এটা তার খাদ্যভাণ্ডার যার বদৌলতে সে এক মাস খাবার ছাড়া এবং দুই-তিন সপ্তাহ পানি ছাড়া চলতে পারে। এ অবস্থায় তার ৩৩ শতাংশ পর্যন্ত শরীরের ওজন কমতে পারে। অথচ একই রকম পরিস্থিতিতে মানুষের ৮ শতাংশ ওজন কমলে ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে সে মৃত্যুবরণ করতে পারে।

মাথা : অন্য গৃহপালিত প্রাণীর তুলনায় ছোট, কোনো শিং নেই, ছোট কান এবং বড় বড় চোখ যা অনেক দূরে এবং বিভিন্ন দিকে দেখতে পারে। (মরুভূমির জন্য উপযোগী)

ঘাড় : লম্বা ও বাঁকা যেন উঁচু গাছের নাগাল পেতে পারে।

মুখ : মুখে কোনো গ্রন্থি নেই এবং খুবই শক্ত যা মরুভূমির কাঁটাযুক্ত গাছ খেতে পারে। ওপরের ঠোট ভাগ করা, যা পৃথকভাবে খোলা ও বন্ধ করা যায়। (কাঁটাযুক্ত গাছ বাছার ক্ষেত্রে সহায়ক)

চোখের ভ্রু : চোখের ভ্রু খুব ঘন এবং দুই স্তরের লম্বা আইল্যাশ আছে, যা চোখকে মরুভূমির বালু থেকে রক্ষা করে।

নাকের ছিদ্র : বেশ মাংসল। সম্ভবত একমাত্র প্রাণী, যা ইচ্ছামতো খুলতে ও বন্ধ করতে পারে, যা মরুঝড়ে ধুলাবালু থেকে প্রতিরোধ করে।

চর্ম : বেশ পুরু এবং শক্তভাবে নিচে টিস্যুর সাথে সংযুক্ত, যা সূর্যরশ্মি প্রতিফলিত করে এবং মরুভূমির প্রচণ্ড তাপ থেকে শরীরকে সুরক্ষা দেয়। বেশির ভাগ স্তন্যপায়ীর শরীরের চর্বি সমস্ত দেহে চামড়ার নিচে ছড়ানো থাকে। উটের চামড়ার নিচে চর্বি থাকে না, যা ঘাম নিঃস্বরণ ও শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।

পায়ের পাতা : দুটি শক্ত আঙুলের ওপর ভর করে হাঁটে। আঙুলের সাথে চারটি চর্বিযুক্ত বল সংযুক্ত যা হাঁটার সময় ছড়িয়ে পড়ে এবং বালুর ভেতর পা আটকে যাওয়া প্রতিরোধ করে।

লম্বা পা : মরুভূমির উত্তপ্ত বালুর গরম থেকে আরোহীকে দূরে রাখে। এর চলার ভঙ্গি অন্য চতুষ্পদ জন্তু থেকে আলাদা। এক সাইটের দুই পা একই সময় সামনে যায় তারপর অন্য সাইডের দুই পা সামনে যায়, যা মরুভূমির বালুতে চলতে সহায়ক। উটের পা খুবই শক্তিশালী, যার ফলে সে এক হাজার পাউন্ড ওজন বহন করতে পারে। দিনে ১০০ মাইল পর্যন্ত হাঁটতে পারে এবং ঘণ্টায় ২৫ মাইল দৌড়াতে পারে।

জিহ্বা : জিহ্বার ওপরে ও চারপাশে ছোট অসংখ্য শক্ত papillae দিয়ে ঢাকা, যেন মরুভূমির কাঁটাযুক্ত খাবারে তা ক্ষতবিক্ষত না হয়।

পাকস্থলী : পাকস্থলী তিন প্রকোষ্টবিশিষ্ট। অন্যান্য জাবরকাটা প্রাণীর পাকস্থলী চার প্রকোষ্টের। উটের তিনটি প্রকোষ্ট কেন তার কারণ জানা যায়নি।

কিডনি : খুবই শক্তিশালী। প্রস্রাবে পানি খুব কম বের হয় এবং তা ঘন সিরাপের মতো।

মল : এত শুকনা যে, তা দিয়ে আগুন জালানো যায় (পানিশূন্য)।

ব্রেইন : ঘাড়ে rate mirabile নামক আরটারি ও ভেইনের সংমিশ্রণ আছে, যা শরীরের অতিরিক্ত তাপমাত্রাতেও ব্রেইনের তাপমাত্রাকে সূক্ষ্মভাবে নিয়ন্ত্রণ করে ঠাণ্ডা রাখে।

লোহিত কণিকা : স্তন্যপায়ীর লোহিত কণিকা গোলাকার। শুধু উটের লোহিত কণিকা ডিম্বাকৃতির, যা পানিশুন্য অবস্থায় রক্ত চলাচলে সহায়তা করে। এর আবরণীও বেশ মজবুত, যা অল্প সময়ে উট অনেক পানি পান করলে যে osmotic variation হয়, তা সহ্য করার ক্ষমতা রাখে ও আবরণী ফেটে যায় না।

শরীরের তাপমাত্রা : বাইরের তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে উটের শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। (সর্বোচ্চ ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত) এটাই হচ্ছে প্রধান উপায়, যার মাধ্যমে উট মরুভূমিতে তার শরীরের পানি সংরক্ষণ করে থাকে। মরুভূমির চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ায় উটের শরীরের তাপমাত্রা রাতে ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে আসে এবং দিনে ৪১ ডিগ্রি পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়।

পানিশূন্যতা : উটের বেলায় খুব কম পানি রক্ত থেকে বের হয়, ফলে রক্ত তরল থাকে। উট ৩০ শতাংশ পর্যন্ত পানিশূন্যতায় চলাচলে সক্ষম, উটের শরীরের পানি পূরণের ক্ষমতাও প্রচণ্ড। একমাত্র উটই এক মিনিটে ১০-২০ লিটার পানি পান করতে সক্ষম। পানিশূন্যতায় অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় উট শ্বাস-প্রশ্বাস কম নিয়ে থাকে, যাতে পানি শরীর থেকে বের হতে না পারে।

উটের নাকের ঝিল্লিতে নিঃশ্বাসের সাথে নির্গত অনেক জলীয়বাষ্প আটকে যায় এবং শরীরে আবার ফিরে আসে। এভাবে নিঃশ্বাসের মাধ্যমে যে পানি নির্গত হয় তা কমে আসে।

উটের দুধ : বেদুইনদের পছন্দনীয় পানীয়। গরুর দুধের চেয়ে বেশি পুষ্টিকর, এতে পটাসিয়াম, আয়রন এবং গরুর দুধের চেয়ে তিনগুণ ভিটামিন সি আছে। উটের দুধ মানুষের ভিটামিন সি’র চাহিদা পূরণ করে থাকে। পানিশূন্য অবস্থায় মরুভূমিতে দীর্ঘ পথ চলার পরও উটের দুধে পানির পরিমাণ হ্রাস পায় না। উট শাবক যথেষ্ট দুধ পান করার পরও উটনী চার থেকে ৯ লিটার অতিরিক্ত দুধ দিয়ে থাকে। উট মরু অঞ্চলের মানুষের জন্য দুধ, গোশত ও বাহন এই তিনটি কাজেই উপকারী জন্তু হিসেবে বিবেচিত।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা : গরু এবং ছাগলের তুলনায় উটের রোগ অনেক কম হয়ে থাকে। এর Immune system খুবই ব্যতিক্রমধর্মী। এর Immunoglobulin দিয়ে যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয় তাতে লাইট চেইন থাকে না। এটা কিভাবে মরুভূমির কঠিন পরিবেশে উটের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ঠিক রাখে তা এখনো জানা যায়নি। ‘তোমাদেরকে খুবই কম জ্ঞান দান করা হয়েছে’। (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত-৮৫)
উটের বিশেষ ব্যবহারিক বৈশিষ্ট্য : উট অতি প্রত্যুষে মরুভূমির বালু গরম হওয়ার আগে মাটিতে বসে। বসার সময় পাগুলো শরীরের নিচে বিছিয়ে দেয় যেন মাটি থেকে তাপ শরীরে আসতে না পারে।

সে সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে, যাতে শরীরের ন্যূনতম অংশ উত্তপ্ত হয়।

একপাল উট বিশ্রাম করার সময় পাশাপাশি শুয়ে থাকে, যেন শরীরের অল্প অংশ তাপ গ্রহণ করতে পারে। শরীরের উচ্চ তাপমাত্রাতেও এর metabolic rate স্বাভাবিক থাকে।

উপরের আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারি, উটকে মরুভূমির কঠিন পরিবেশে চলার জন্য বিশেষভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে। একজন বুদ্ধিমান লোকের জন্য উটের অপূর্ব সৃষ্টি তার মহান স্রষ্টাকে চেনার জন্য যথেষ্ট। ‘নিশ্চয়ই আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে এবং রাত ও দিনের আবর্তণে বুদ্ধিমান লোকদের জন্য নিদর্শন রয়েছে’। (সূরা আলে ইমরান, আয়াত-১৯০)

লেখক : কর্নেল (অব:) অধ্যাপক ডা. জেহাদ খান (প্রবন্ধকার)

১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

Back to top button