ইতিহাস

ইয়ারমূক যুদ্ধ

আব্দুর রহীম

ভূমিকা : ৬৩৪ খ্রিষ্টাব্দের  সেপ্টেম্বর মাসে আজকের সিরিয়ার সীমান্তবর্তী ইয়ারমূকের ময়দানে মুসলিম ও খ্রিষ্টান  বাহিনীর মধ্যে ছয়দিনের এক সিদ্ধান্তকারী যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। যাতে মুসলিম বাহিনী  ঐতিহাসিক বিজয় লাভ করে। যার ফলে এতদঞ্চল থেকে রোমক শাসনের পরিসমাপ্তি ঘটে এবং  ইসলামী শাসনের সূচনা হয়। সিরিয়া, ইরাক, ফিলিস্তীন, জর্ডানসহ মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ  এলাকা ইসলামী খেলাফতের অধীনস্ত হয়ে যায়। পরবর্তীতে এই সমস্ত এলাকার সকল নাগরিক  ইসলামী সাম্য ও ন্যায়বিচারে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম কবুল করে। অদ্যাবধি এতদঞ্চলের সবাই  মুসলিম।

            সৃষ্টির প্রতি সৃষ্টির দাসত্বকে উৎখাত করে স্রষ্টার প্রতি সৃষ্টির দাসত্ব  কায়েম করতে, বাতিলকে পরাভূত করে হককে প্রতিষ্ঠিত করতে এবং দুনিয়াতে যালিমকে পদানত  করে ন্যায়-ইনছাফ ও সাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ইসলামের জিহাদ সমূহ সংঘটিত হয়।  মানবতার নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) ও পরবর্তীতে খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলে ছাহাবীগণ  নিজেদের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে জিহাদে অংশগ্রহণ করেছেন। ঈমানী দৃঢ়তা ও আল্লাহ্র  প্রতি অকৃত্রিম নির্ভরশীলতার কারণে এসব যুদ্ধে তাঁরা বিজয় লাভ করেছেন। ইয়ারমূক  তেমনি এক ঐতিহাসিক মহাযুদ্ধের নাম।

            আবুবকর (রাঃ)-এর খেলাফতকালের (১১-১৩ হিঃ) শেষদিকে রোম বিজয়ের সূচনা হয় এবং ওমর (রাঃ)-এর খেলাফতকালের (১৩-২৩ হিঃ) শুরুর  দিকেই এ বিজয় সম্পন্ন হয়। ইয়ারমূক ছিল অন্যতম এক মহাসমর, যা ইসলামী খেলাফত ও রোম  সম্রাট তথা বাইজেন্টাইন খ্রিষ্টানদের মধ্যে সংঘটিত হয়েছিল।

            ইয়ারমূকের পরিচয় : ইয়ারমূক একটি উপত্যকার নাম। যা ইয়ারমূক নদীর  তীরে অবস্থিত। ইয়ারমূক একটি নদী যার উৎপত্তি হয়েছে হাওরান পাহাড় থেকে। এটি সিরিয়া  ও ফিলিস্তীন সীমান্তের কোল ঘেঁষে দক্ষিণে জর্দানের নিম্নভূমিতে পতিত হয়ে মৃত সাগরে  গিয়ে মিলিত হয়েছে। জর্দান নদীতে পতিত হওয়ার পূর্বে ৪৩ কি.মি. দূরত্বের একটি  প্রশস্ত উপত্যকা রয়েছে যার তিন দিকে উঁচু উঁচু পাহাড় বেষ্টিত। আর একদিক তথা বাম  দিক ফাঁকা ময়দান, যেখানে ইয়ারমূক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। রোমক সৈন্যরা এ প্রশস্ত স্থানে  অবস্থান গ্রহণ করে, যা তাদের বিশাল সেনাবাহিনীর জন্য উপযুক্ত ছিল। অপরপক্ষে মুসলমানগণ  দক্ষিণে তিন পাহাড় বেষ্টিত প্রশস্ত স্থান থেকে বেরুবার পথে অবস্থান গ্রহণ করেন। এর  ফলে রোমক সৈন্যদের বের হওয়ার একমাত্র রাস্তাটি বন্ধ হয়ে যায়। এতে তাদের পিছু হটার  বা পালাবার কোন পথ অবশিষ্ট ছিল না।

            সময়কাল : ৫ই রজব ১৩ হিজরী মোতাবেক ২রা সেপ্টেম্বর ৬৩৪ খ্রিষ্টাব্দে  এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মুসলমানদের সেনাপতি ছিলেন খালিদ বিন ওয়ালীদ (রাঃ) ও রোমকদের সেনাপ্রধান ছিল মাহান বা বাহান।

            সৈন্যসংখ্যা : রোমকদের  সৈন্য সংখ্যা ছিল দুই লক্ষ চল্লিশ হাযার। আশি হাযার অগ্রগামী সৈন্য, যাদের মধ্যে চল্লিশ  হাযার মৃত্যুর জন্য শিকল পরিহিত এবং চল্লিশ হাযার মাথায় পাগড়ী পরিহিত, আশি হাযার  পদাতিক ও আশি হাযার অশ্বারোহী। অপরদিকে মুসলমান সৈন্যের মধ্যে সাতাশ হাযার আগে  থেকে সেখানে অবস্থান করছিল। পরে খালিদ বিন ওয়ালীদ (রাঃ) ইরাক থেকে নয় হাযার সৈন্য  সহ সেখানে গিয়ে যোগদান করলে সর্বসাকুল্যে মুসলিম সৈন্য দাঁড়ায় ৩৬ হাযারে। কোন কোন ঐতিহাসিক বলেন, মুসলমানদের সৈন্যসংখ্যা ছিল  চল্লিশ হাযার। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর এক হাযার ছাহাবী এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন।  যাদের মধ্যে বদরী ছাহাবী ছিলেন একশত জন।[1]

            ঘটনাপ্রবাহ : হযরত আবুবকর (রাঃ) সিরিয়া অভিযানে খালিদ বিন সাঈদ (রাঃ)-এর  নেতৃত্বে একদল সৈন্য প্রেরণ করেন। কিন্তু তারা পরাজিত হয়ে ফিরে আসে। এতে খলীফার  সিরিয়া বিজয়ের আগ্রহ বহুগুণ বেড়ে যায় এবং বিশাল সৈন্যের সমন্বয়ে গঠিত বাহিনী নিয়ে  তা বিজয়ের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। আমর ইবনুল আছ (রাঃ)-কে একটি ব্যাটালিয়ন গঠন করে  ফিলিস্তীনের পথে রওয়ানা হওয়ার নির্দেশ দেন। ইয়াযীদ বিন আবু সুফিয়ানকে তলব করে তাকে  একটি ব্যাটালিয়নের দায়িত্ব দিলেন। যাদের মধ্যে সুহায়েল বিন আমর (রাঃ) সহ মক্কার বড়  বড় যোদ্ধারা ছিলেন। তার সাথে তার ভাই মু‘আবিয়ার নেতৃত্বে আরো কিছু সৈন্যের সমাবেশ  ঘটালেন। অপর দিকে খালিদ বিন সাঈদের সাথে থাকা সৈন্যের নেতৃত্ব দানের দায়িত্ব অর্পণ  করলেন শুরাহবীল ইবনু হাসানাহ-এর উপর। অন্যদিকে এক বিশাল বাহিনীর সমাবেশ ঘটিয়ে তার  দায়িত্ব দিলেন আবু ওবায়দা ইবনুল জার্রাহ (রাঃ)-এর উপর। তিনি প্রত্যেক বাহিনীর জন্য  নির্দিষ্ট পথ বাতলিয়ে দিয়ে সে পথে চলার নির্দেশ প্রদান করলেন। এই নির্দেশের ফলে  আমর ইবনুল আছ ও আবু ওবায়দা ইবনুল জার্রাহ (রাঃ) আয়লা শহ্রের উপরদিয়ে মু‘রিকার পথ  ধরে এবং ইয়াযীদ বিন মু‘আবিয়া শুরাহবীল ইবনু হাসানাহ্কে সাথে নিয়ে তাবূকিয়ার পথ ধরে  সিরিয়া রওয়ানা হ’লেন। সেখানে পৌঁছলে আবু ওবায়দা জাবিয়ায়, ইয়াযীদ বালক্বায়, শুরাহবীল  জর্দানে এবং আমর ইবনুল আছ ইরবা নামক স্থানে অবতরণ করলেন।[2]

            রোমক সৈন্যদের প্রতি বাইজেন্টাইন সম্রাটের উপদেশ  : সম্রাট হিরাক্লিয়াস  ছিলেন একজন বিজ্ঞ মানুষ। নবী করীম (ছাঃ)-এর পত্র পাওয়ার পর ইসলাম গ্রহণ করার ইচ্ছা  পোষণ করেন। কিন্তু তার রাজত্ব, পদ এবং সেনাবাহিনীর ভয় তাকে ইসলাম গ্রহণে বাধা দেয়।  রোমকরা মুসলমানদের উপস্থিতি টের পেয়ে সম্রাট হিরাক্লিয়াসের কাছে পত্র লিখে তাকে  অবহিত করে। তখন তিনি আল-কুদ্সে অবস্থান করছিলেন। তিনি উপদেশ দিয়ে বললেন, আমি মনে  করি, তোমরা মুসলমানদের সাথে সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হবে। আল্লাহ্র কসম! তাদেরকে সিরিয়ার  অর্ধেক প্রদান করে তোমাদের জন্য রোম সহ তার অর্ধেক রেখে চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়া উত্তম  হবে পুরো সিরিয়া ও রোমের অর্ধেক তাদের দখলে চলে যাওয়ার চাইতে। এই উপদেশ সৈন্যদের  খুশী করতে পারল না। বরং তারা মনে করল, সম্রাট দুর্বল হয়ে পড়েছেন এবং বিজয়ী মুসলিম  যোদ্ধাদেরকে দেশ হস্তান্তর করে দিবেন। পরাজিত হওয়ার আশংকা থাকা সত্ত্বে্ও বাধ্য  হয়ে সম্রাট হিরাক্লিয়াস মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং  সৈন্যদের একত্রিত করে হিমছে পাঠালেন। সেখানে ২ লক্ষ ৪০ হাযার সৈন্যের বিশাল এক  সমাবেশ ঘটল। তাদেরকে চারটি ব্যাটালিয়নে ভাগ করা হ’ল। যাতে তারা মুসলমানদের চারটি  দলের মোকাবেলা করে তাদেরকে দুর্বল করে ফেলে   এবং মুসলমানরা তাদের অন্য ব্যাটালিয়নকে সাহায্য করার বদলে নিজেদের নিয়ে  ব্যস্ত থাকে।[3]

            মুসলমানদের যুদ্ধের প্রস্ত্ততি : রোমকদের বিশাল সৈন্যের সমাবেশ দেখে মুসলমান  সৈন্যদের মাঝে ভীতির সঞ্চার হ’লে তারা করণীয় জানতে চেয়ে আমর ইবনুল আছ (রাঃ)-এর  নিকট পত্র লিখলেন। তিনি উত্তরে বললেন, আমাদের এখন করণীয় ঐক্যবদ্ধ হওয়া। আমরা সবাই  ঐক্যবদ্ধ হ’লে সৈন্যসংখ্যা কম হবার কারণে পরাজিত হব না।[4] আমর ইবনুল আছ আবুবকর (রাঃ)-এর নিকট পত্র লিখে সাহায্য  চাইলে  তিনি আমর ইবনুল আছ (রাঃ)-এর মত উত্তর দিয়ে লিখলেন, ‘তোমরা তো এমনই যাদেরকে  কমসংখ্যক সৈন্য পাঠিয়ে সাহায্য করা যায় না। তোমাদেরকে অন্তত দশ হাযার সৈন্য দিয়ে সাহায্য করা হবে।  আর যদি শত্রুরা দক্ষিণ দিক থেকে আসে তাহ’লে আরো অধিক সৈন্য পাঠিয়ে সাহায্য করা  হবে। অতএব তোমরা দক্ষিণ দিকের শত্রুদের ব্যাপারে সতর্ক থাকবে এবং ইয়ারমূকে গিয়ে  নিজ নিজ নেতার নেতৃত্বে মিলিত হবে এবং পাশাপাশি অবস্থান নিবে। পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না।[5]

            আবুবকর (রাঃ) আমর ইবনুল  আছের পত্রের প্রেক্ষিতে বড় বড় ছাহাবীদের নিয়ে পরামর্শ বৈঠকে বসলেন। প্রত্যেকে নিজ  নিজ বিচার-বুদ্ধি ও বিচক্ষণতা অনুযায়ী পরামর্শ দিলেন। অবশেষে আবুবকর (রাঃ) বললেন,  আমি খালিদ বিন ওয়ালীদের মাধ্যমে খ্রিষ্টানদের শয়তানী কুমন্ত্রণা হ’তে মুসলমানদের  রাখব।[6]

            খলীফা আবুবকর (রাঃ) ইরাকে অবস্থানকারী সেনাপতি খালিদ  বিন ওয়ালীদের কাছে এই মর্মে পত্র লিখলেন যে, সেখানে একজন প্রতিনিধি নিযুক্ত করে  চৌকস সৈন্যদের নিয়ে সিরিয়া চলে যাবে। খালিদ মুছান্না বিন হারেছার হাতে ইরাকের  দায়িত্ব অর্পণ করতে দ্বিধাবোধ করছিলেন। এটা বুঝতে পেরে মুছান্না বললেন, আল্লাহ্র  কসম! আমি কেবল খলীফা আবুবকর (রাঃ)-এর নির্দেশ বাস্তবায়ন করার জন্য এখানে অবস্থান  করব। আল্লাহ্র কসম! আমি নবী করীম (ছাঃ)-এর ছাহাবীগণ ব্যতীত অন্য কারো সাহায্যের  প্রত্যাশা করি না। এ কথা শুনে খালিদ তাকে শান্ত করলেন এবং নারী ও দুর্বল পুরুষদের  মদীনায় পাঠিয়ে দিলেন। যাতে মুছান্না যুদ্ধের সময় তাদের নিরাপত্তা নিয়ে ব্যস্ত না  থাকেন।[7] সেনাপতি খালিদ তার সাথে থাকা রাসূল (ছাঃ)-এর  ছাহাবীদের সহ নয় হাযার সৈন্য নিয়ে সিরিয়া অভিমুখে রওয়ানা হ’লেন। পাঁচ দিন পথ চলার  পর তারা ১৩ হিজরীর রবীউল আখের মাসের শেষ দিকে ইয়ারমূকে পৌঁছলেন। পথিমধ্যে তিনি  তাদাম্মুর, বাহ্রা, কারাকের ও বছরা শহ্র জয় করলেন এবং মুসলমানদের সুসংবাদ জানালেন।  এবার মুসলমানদের সৈন্য সংখ্যা দাঁড়াল ছত্রিশ হাযারে।[8]

            খালিদ বিন ওয়ালীদ (রাঃ) ময়দানে এসে বুঝতে পারলেন  যে, মুসলমান সৈন্যরা পাঁচটি দলে বিভক্ত হয়ে পাঁচজন সেনাপতির নেতৃত্বে যুদ্ধ করবে।  তিনি এ বিষয়ে তাদের সতর্ক করে দিয়ে বললেন, এটা আল্লাহ্র দিন সমূহের অন্যতম দিন। এ  দিনে কারো অহংকার এবং স্বেচ্ছাচারিতা কাম্য নয়। তোমরা খালেছ অন্তরে জিহাদ কর।  তোমাদের আমল সমূহ দ্বারা আল্লাহ্র সন্তুষ্টি কামনা কর। কেননা এমন দিন আর নাও আসতে  পারে। তোমরা অন্য দলের উপর নির্ভর করে সুশৃঙ্খলভাবে কোন সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে  যুদ্ধ করতে পারবে না। আর এটা বৈধ নয় এবং উচিতও নয়। আর তোমাদের পিছনে যিনি আছেন  তিনি জানতে পারলে তোমাদের মাঝে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবেন। অতএব খলীফা যেভাবে  নির্দেশ দিয়েছেন সেভাবে কাজ কর। তারা বলল, তাহ’লে আমাদের করণীয় কী? তিনি বললেন,  সকল সৈন্য একজন নেতার নেতৃত্বে যুদ্ধ করবে। পাঁচজন সেনাপতির দায়িত্বে পাঁচ দিন  যুদ্ধ চলবে, তবে প্রতিদিন একজনের নেতৃত্বে চলবে। আর এভাবে  যুদ্ধ চলতে থাকবে। তারা খালিদ বিন ওয়ালীদ  (রাঃ)-কে প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব অর্পণ করল। খালিদ বিন ওয়ালীদ তাদেরকে উৎসাহিত  করে বক্তব্য দিলেন। কারণ ইতিপূর্বে কয়েক মাস অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। সৈন্যরা অনেকটা  হীনবল হয়ে পড়েছিল।[9]

            সৈন্য বিন্যস্তকরণ : মুসলিম সেনাপতি সৈন্যদের প্রধানত তিন ভাগে ভাগ  করলেন। যাদের নাম দিলেন ক্বালব (প্রধান), মায়মানাহ (ডান বাহু) ও মায়সারাহ (বাম বাহু)।  ক্বালব তথা প্রধান অংশের দায়িত্ব দিলেন আবু ওবায়দা ইবনুল জার্রাহ (রাঃ)-কে, ডান  বাহুর দায়িত্ব দিলেন আমর ইবনুল আছ (রাঃ)-কে এবং বাম বাহুর দায়িত্ব দিলেন ইয়াযীদ  বিন আবু সুফিয়ানকে।[10] আর ছত্রিশ হাযার সৈন্যকে ছত্রিশটি ছোট ছোট দলে  ভাগ করলেন এবং প্রত্যেক হাযারের জন্য একজন দক্ষ সেনাপতিকে দায়িত্ব অর্পণ করলেন।  এভাবে সৈন্যরা যুদ্ধের জন্য প্রস্ত্তত হয়ে গেল। সেনাপতি খালিদ এভাবে সেনা বিন্যাসের  মাধ্যমে মুসলমানদের মন থেকে সৈন্য স্বল্পতার ভয় দূর করার চেষ্টা করলেন। তারপরেও  একজন বলে ফেলল, মুসলমানদের তুলনায় রোমকরা  কতইনা বেশী! একথা শুনে খালিদ (রাঃ) রেগে গিয়ে বললেন, মুসলমানদের তুলনায় রোমকরা  কতইনা কম? সৈন্যের আধিক্য নির্ভর করে আল্লাহ্র সাহায্য প্রাপ্তির উপর। আর সৈন্যের স্বল্পতা  বিবেচিত হবে পরাজয়ের অপমান ও গ্লানির উপর।[11] সেনাপতি খালিদ মুসলমান  সৈন্যদের উপদেষ্টা নিয়োগ করতেও ভুলে যাননি। সৈন্যদের বিন্যস্ত করার পর আবুদ্দারদা  (রাঃ)-কে বিচারক হিসাবে, আবু সুফিয়ান (রাঃ)-কে উপদেশদাতা হিসাবে, কুবাছ ইবনু  আশয়ামকে পর্যবেক্ষক হিসাবে ও মিক্বদাদ (রাঃ)-কে জিহাদের আয়াত সমূহ পাঠকারী হিসাবে  নিয়োগ দান করলেন। ঐতিহাসিক ইবনু জারীর ত্বাবারী বলেন, বদর যুদ্ধের পর থেকে যুদ্ধের  সময় জিহাদের সূরা পাঠ করা সুন্নাত হিসাবে জারি হয়ে যায়। পরবর্তীতে লোকেরা এর উপর  অটল ছিল।[12]

            সৈন্যদের প্রতি উপদেশ : (১) আবু সুফিয়ান সৈন্যদের মাঝে হেঁটে হেঁটে  উপদেশ দিয়ে বললেন, ‘হে মুসলমানগণ! তোমরা আরব, অথচ এখন পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন  এবং আমীরুল মুমিনীন ও মুসলমানদের সাহায্য থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছ। আল্লাহ্র  কসম! তোমরা তো এক বিরাট সংখ্যক সৈন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে এসেছ। তাদের ক্রোধ তোমাদের  উপর খুব কঠিন হবে। কারণ তোমরা তাদেরকে, তাদের দেশ ও নারীদেরকে সঙ্গহীন করেছ।  আল্লাহ্র কসম! সত্যিকারার্থে যুদ্ধে অংশগ্রহণ ও কষ্টদায়ক ভূমিতে ধৈর্যধারণ ব্যতীত  তিনি তোমাদেরকে এ জাতি হ’তে মুক্তি দান করবেন না এবং তোমরা আল্লাহ্র সন্তুষ্টিও  অর্জন করতে পারবে না। সাবধান! এটা আবশ্যকীয় সুন্নাত। জন্মভূমি তোমাদের পিছনে, আর  তোমাদের মাঝে ও আমীরুল মুমিনীন সহ মুসলিম জামা‘আতের মাঝে এক বিরাট মরুভূমি। এখানে  ধৈর্যধারণ ব্যতীত কারো জন্য কোন দুর্গ নেই, নেই কোন নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল।  আল্লাহ্র প্রতিশ্রুতি পূরণের আশা করাই হ’ল নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল। সুতরাং তোমরা  তরবারীর মাধ্যমে এবং পরস্পরকে সহযোগিতার মাধ্যমে নিজেদেরকে রক্ষা কর। এটাই হবে  তোমাদের রক্ষাকবচ’। অতঃপর তিনি নারীদের কাছে গিয়ে তাদের উপদেশ দিয়ে ফিরে এসে  বললেন, হে ইসলামের অনুসারীরা! উদ্ভূত পরিস্থিতি কেমন তোমরা তা দেখছ। এটা রাসূল  (ছাঃ)-এর আনীত দ্বীন। জান্নাত তোমাদের সামনে এবং শয়তান ও জাহান্নাম তোমাদের পিছনে’।

            এভাবে আবু সুফিয়ান (রাঃ) সৈন্যদের কাতারে তাঁর  নিজ স্থানে ফিরে গেলে (২) আবু হুরায়রা (রাঃ) দাঁড়িয়ে গিয়ে বললেন, হে লোক সকল!  তোমরা আনতনয়না জান্নাতের হূরের দিকে এবং জান্নাতুন নাঈমে তোমাদের রবের সান্নিধ্য  লাভের দিকে ছুটে এসো। তোমরা আজ যেখানে অবস্থান করছ, সেটা তার কাছে অনেক প্রিয়  স্থান। জেনে রেখো! ধৈর্যশীলদের জন্য বিশেষ মর্যাদা রয়েছে।[13]

            অতঃপর (৩) আবূ ওবায়দাহ (রাঃ) উপদেশ দিতে গিয়ে  বলেন, ‘হে আল্লাহ্র বান্দাগণ! তোমরা আল্লাহকে সাহায্য কর, আল্লাহ তোমাদের সাহায্য  করবেন এবং তোমাদের পদযুগলকে দৃঢ় রাখবেন। হে মুসলিম সেনাবাহিনী! তোমরা ধৈর্যধারণ  কর। কেননা ধৈর্য কুফরী থেকে বাঁচার, আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের এবং লজ্জা নিবারণের  উপায়। তোমরা তোমাদের যুদ্ধের সারি থেকে সরে যাবে না। কাফেরদের দিকে এক ধাপও অগ্রসর  হবে না এবং আগ বেড়ে তাদের সাথে যুদ্ধের সূচনাও করবে না। শত্রুদের দিকে বর্শা তাক  করে থাকবে এবং বর্ম দিয়ে আত্মরক্ষা করবে। তোমাদেরকে যুদ্ধের নির্দেশ না দেয়া  পর্যন্ত তোমরা মনে মনে আল্লাহ্র যিকির করতে থাকবে’।[14]

            এ বক্তব্যগুলো শোনার পর মুসলমানদের মাঝে নতুন  প্রাণের সঞ্চার হ’ল। তাদের মধ্যে নতুন উদ্দীপনা দেখা গেল। তারা জান্নাত লাভের আশায়  পাগলপারা হয়ে গেল। অনেকে উদ্দীপনামূলক কবিতা আবৃত্তি শুরু করল।

            অপর দিকে খ্রিষ্টান  পাদ্রীরা একমাস ধরে তাদের সৈন্যদের উদ্দীপনামূলক বক্তব্য প্রদান করে তাদেরকে  উজ্জীবিত করেছিল। এছাড়া তাদের প্রতি দশজন সৈন্যকে এক শিকলে বেঁধে দেওয়া হয়েছিল এবং  কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করেছিল। যাতে কেউ পালিয়ে যেতে না পারে এবং পালালেও  কাঁটাতারে গিয়ে আটকা পড়ে। ইমাম যাহাবী বলেন, রোমকরা নিজেদেরকে লোহার শিকলে এক সাথে  পাঁচ ও ছয় জন করে বেঁধেছিল যাতে তারা পলায়ন করতে না পারে। অতঃপর আল্লাহ যখন তাদেরকে  পরাস্ত করলেন, তখন তাদের এক একজন তার সাথে বাঁধা সকলকে টেনে নিয়ে ইয়ারমূক নদীতে  পড়া শুরু করল। অবশেষে তাদেরকে টেনে আনা হ’ল একটি উপত্যকায়। যেখানে পড়ে থাকা আহত  সৈন্যগুলিকে অসংখ্য ঘোড়া পদদলিত করে হত্যা করেছিল।[15]

            একটানা ছয় দিন যুদ্ধ চলল। সেনাপতি খালিদ, যুবায়ের  ইবনুল আওয়াম ও ইকরিমা বিন আবু জাহল বীর দর্পে যুদ্ধ করে বহু রোমক সৈন্য হত্যা  করলেন। হিশাম বিন উরওয়া তার পিতা হ’তে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, ইয়ারমূকের দিন  মুসলমানগণ আমার পিতা যুবায়েরকে বলল, আপনি কি রুদ্রমূর্তি ধারণ করবেন না, যাতে  আপনাকে দেখে আমরাও যুদ্ধংদেহী হ’তে পারি। তখন তিনি বললেন, আমি রুদ্রমূর্তি ধারণ  করলে তোমরা আমাকে মিথ্যারোপ করবে। তারা বলল, না আমরা তা করব না। তখন তিনি শত্রুদের  উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তিনি তাদের কাতার ভেদ করে ভিতরে ঢুকে পড়লেন। সে সময় তার সাথে  কেউ ছিল না। অতঃপর ফিরে আসার সময় তারা তার ঘোড়ার লাগাম ধরে তার কাঁধে বদর যুদ্ধে  আঘাতপ্রাপ্ত স্থানের দু’পাশে দু’টি প্রচন্ড আঘাত করল। উরওয়া বলেন, আমি ছোট থাকা  অবস্থায় ঐ ক্ষতস্থানগুলোতে আঙ্গুল ঢুকিয়ে খেলা করতাম। যুবায়ের (রাঃ) তার দশ বছরের পুত্র  আব্দুল্লাহ বিন যুবায়েরকে এ যুদ্ধে নিয়ে গিয়েছিলেন।  তিনি  তাকে   ঘোড়ায়  আরোহণ  করিয়ে

            অন্য একজনের হাতে তার নিরাপত্তার দায়িত্ব অর্পণ  করেন।

            রোমক সেনাপতির ইসলাম গ্রহণ : জুরজাহ (جرجه) ছিলেন বাইজেন্টাইন  সৈন্যদের অন্যতম সেনাপতি। দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহবান জানিয়ে তিনি মুসলিম বাহিনীর দিকে  এগিয়ে এলেন। খালিদ বিন ওয়ালীদ (রাঃ) তার মুকাবিলা করার জন্য বীরদর্পে বের হ’লেন।  যুদ্ধের পূর্বে উভয়ের মাঝে দীর্ঘক্ষণ সংলাপ হ’ল। যার ফলাফল দাঁড়াল তিনি ইসলাম  গ্রহণ করলেন এবং মাত্র দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করে মুসলমানদের পক্ষে যুদ্ধ করে  শাহাদত বরণ করলেন (ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলায়হে রাজে‘ঊন)। ইবনু জারীর  ত্বাবারী বলেন, জুরজাহ তার কাতার থেকে বের হয়ে যুদ্ধরত দু’দলের মাঝে এসে দ্বন্দ্বযুদ্ধ  করার জন্য মুসলিম সেনাপতি খালেদকে আহবান জানালেন। খালেদ তার স্থানে আবু ওবায়দা  (রাঃ)-কে দায়িত্ব দিয়ে তার ডাকে সাড়া দিলেন। অতঃপর তারা দু’কাতারের মধ্যে অবস্থান  নিলেন। একজনের ঘোড়ার কাঁধ অন্যজনের ঘোড়ার সাথে ঠেকে যাচ্ছিল। কিন্তু একজন অন্যজনকে  আঘাত করছিলেন না। বরং তাদের মধ্যে সংলাপ চলছিল। জুরজাহ বললেন, হে খালেদ! তুমি  আমাকে সত্য বলবে, মিথ্যা বলবে না। কারণ স্বাধীন ব্যক্তি মিথ্যা বলে না। তুমি আমাকে  ধোঁকা দিবে না। কারণ সম্মানী ব্যক্তি কাউকে ধোঁকা দেয় না। বল তো আল্লাহ কি তোমাদের  নবীর উপর আকাশ থেকে তরবারী নাযিল করেছিলেন যেটা তিনি তোমাকে দান করেছেন? ফলে যে  জাতির বিরুদ্ধে তুমি এ তরবারী কোষমুক্ত কর তাদেরই পরাস্ত করে ফেল? খালেদ বললেন,  ঘটনা এমনটি নয়।

            জুরজাহ বলল, তাহ’লে তোমার নাম সাইফুল্লাহ  (আল্লাহ্র তরবারী) কিভাবে হ’ল? খালেদ বললেন, আল্লাহ তা‘আলা আমাদের মাঝে একজন নবী  পাঠিয়েছিলেন। তিনি আমাদেরকে ইসলামের পথে আহবান করলেন। আমরা তাঁর থেকে অনেক দূরে  চলে গেলাম। পরে আমাদের কেউ তাঁকে বিশ্বাস করল, কেউ তাঁকে অস্বীকার করল এবং তাঁর  প্রতি মিথ্যারোপ করল। আর আমি তাদের মধ্যে ছিলাম যারা তাঁকে মিথ্যারোপ করেছিল এবং  তাঁর থেকে দূরে সরে গিয়েছিল। এমনকি আমি তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধও করেছি। অতঃপর আল্লাহ  আমাদেরকে হেদায়াত দান করলেন। ফলে  আমরা  ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করলাম। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে বললেন, ‘তুমি  আল্লাহ্র তরবারী সমূহের মধ্যে একটি তরবারী, যা তিনি মুশরিকদের বিরুদ্ধে কোষমুক্ত  করেছেন। তিনি আমার জন্য আল্লাহ্র সাহায্যের দো‘আ করলেন। তারপর থেকে আমার নাম ‘সাইফুল্লাহ’  (আল্লাহ্র তরবারী) হয়ে গেল। এখন আমি মুসলমানদের মধ্যে মুশরিকদের বিরুদ্ধে সর্বাধিক  কঠিন ব্যক্তি।

            জুরজাহ বললেন, তুমি আমাকে  সত্যই বলেছ। সে আবার প্রশ্ন করল, হে খালেদ! তোমরা আমাকে কিসের দিকে দাওয়াত দিচ্ছ?

            খালেদ বললেন, ‘আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই এবং  মুহাম্মাদ (ছাঃ) তাঁর বান্দা ও রাসূল’ একথার সাক্ষ্য দেওয়া এবং তিনি আল্লাহ্র পক্ষ  থেকে যা নিয়ে এসেছেন তার স্বীকৃতি দেওয়ার প্রতি আহবান জানাচ্ছি।

            জুরজাহ বললেন, যে তোমাদের দাওয়াত কবুল করবে না  তার পরিণতি কি হবে? খালেদ (রাঃ) বললেন, সে জিযিয়া প্রদান করবে এবং এর মাধ্যমে  নিজেদের জান-মালের নিরাপত্তা লাভ করবে।

            জুরজাহ  বললেন, যদি সে জিযিয়া প্রদান না করে? খালেদ (রাঃ) বললেন, আমরা তাদের বিরুদ্ধে  যুদ্ধের ঘোষণা প্রদান করব। অতঃপর তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করব।

            জুরজাহ  বললেন, আজকে যারা তোমাদের এ দ্বীন কবুল করে তোমাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে তাদের  মর্যাদা কি হবে? খালেদ (রাঃ) বললেন, আল্লাহ প্রদত্ত ফরয বিধান পালনের ক্ষেত্রে  আমাদের মধ্যকার সম্মানী-অসম্মানী, প্রথমে ইসলাম গ্রহণকারী পরে ইসলাম গ্রহণকারী  সবার মর্যাদা সমান।

            জুরজাহ বললেন, হে খালেদ! আজকে যে ইসলাম গ্রহণ  করবে সে কি তোমাদের মতই নেকী ও পুরস্কার পাবে? খালেদ (রাঃ) বললেন, হ্যাঁ বরং বেশী  পাবে। জুরজাহ বললেন, সে পুরস্কার পাওয়ার  ক্ষেত্রে কিভাবে তোমাদের সমকক্ষ হবে, অথচ তোমরা অগ্রগামীদের অন্তর্ভুক্ত?

            খালেদ (রাঃ) বললেন, আমরা এ দ্বীনে প্রবেশ করেছি।  আমরা নবীর জীবদ্দশায় তাঁর হাতে বায়‘আত গ্রহণ করেছি। আকাশ থেকে তাঁর কাছে অহী আসত।  তিনি আমাদেরকে তা শুনাতেন। তিনি আমাদেরকে বিভিন্ন নিদর্শন দেখাতেন। অতএব সেই  ব্যক্তি আমাদের সমকক্ষ যে আমাদের মত তাঁকে দেখেছে ও  তাঁর কথা শুনেছে। কিন্তু আমরা যেসব বিস্ময়কর  ঘটনা দেখেছি ও শুনেছি তোমরা তা দেখনি ও শোননি। এক্ষণে যে তোমাদের মধ্য হ’তে খালেছ  নিয়তে এ দ্বীন কবুল করবে, সে আমাদের থেকেও উত্তম হবে।

            জুরজাহ বলল, আল্লাহ্র নামে তুমি আমাকে সত্য কথা  বলেছ, আমাকে ধোঁকা দাওনি এবং আমার সাথে প্রতারণাও করনি। খালেদ (রাঃ) বললেন,  আল্লাহ্র কসম! আমি তোমাকে সত্য বলেছি। তোমার প্রতি বা অন্য কারো প্রতি আমার কোন  বিদ্বেষ নেই। আর আল্লাহ তা‘আলা তো তোমার জিজ্ঞাসিত বিষয়ে অভিভাবক।

            জুরজাহ বললেন, তুমি সত্য বলেছ। অতঃপর ঢাল নিচে  নামিয়ে খালেদের কাছাকাছি হয়ে বললেন, আমাকে ইসলামের দীক্ষা দাও, আমি ইসলাম গ্রহণ করব।  অতঃপর খালেদ বিন ওয়ালীদ (রাঃ) তাকে সাথে নিয়ে তাঁবুতে গেলেন এবং তার গোসলের  ব্যবস্থা করলেন। অতঃপর ইসলাম গ্রহণ করে জুরজাহ দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করলেন। এরই  মধ্যে রোমকরা জুরজাহকে খালেদের দলভুক্ত মনে করে তাদের উপর প্রচন্ড হামলা করল। মুসলিম  সৈন্যরা পলায়ন করতে বাধ্য হ’ল। ইকরিমা বিন আবু জাহল ও হারেছ ইবনু হিশাম দু’জন  খালিদের তাঁবুর নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন, তারা তাদের প্রতিহত করলেন। ইকরিমা যখন  মুসলমানদের ফিরে আসতে দেখলেন তখন তিনি বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে  বহু স্থানে যুদ্ধ করেছি। আর আজকে তোমাদের থেকে পলায়ন করব? অতঃপর তিনি ঘোষণা করলেন,  তোমাদের মধ্যে কে আছ যে মৃত্যুর জন্য আমার হাতে বায়‘আত করবে? এ ঘোষণা শুনে হারেছ  ইবনু হিশাম, যিরার বিন আযওয়ার সহ মুসলমানদের চারশ’ অশ্বারোহী সৈন্য বায়‘আত গ্রহণ করলেন।  অতঃপর তারা খালেদ বিন ওয়ালীদের তাঁবুর সামনে থেকে রোমক সৈন্যদের আহত করে তাড়িয়ে  দিতে সক্ষম হ’লেন। যিরার বিন আযওয়ার (রাঃ) ব্যতীত তারা সকলে শাহাদাত বরণ করলেন।[16] পুনরায় রোমকদের ফিরে আসতে দেখে সেনাপতি খালেদ  জুরজাহকে সাথে নিয়ে ঘোড়ায় আরোহণ করে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তখন রোমকরা মুসলমানদের  মধ্যে ঢুকে যুদ্ধ করছিল। তিনি লোকদের ডেকে সমবেত করলেন। তৎক্ষণাৎ রোমকরা তাদের  স্থানে ফিরে গেল। সেনাপতি খালিদ (রাঃ) জুরজাহকে সাথে নিয়ে বীরদর্পে রোমকদের দিকে  এগিয়ে গেলেন এবং সকাল হ’তে সন্ধ্যা পর্যন্ত উভয়ে তাদের বিরুদ্ধে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করলেন।  এরই মধ্যে জুরজাহ শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করলেন। অথচ ইসলাম গ্রহণের পর  দু’রাক‘আতের বেশী ছালাত আদায় করার সুযোগ তাঁর হয়নি।[17]

            যিরার বিন আযওয়ার (রাঃ)  বলেন, সকাল হ’লে ইকরিমা বিন আবু জাহল ও আমর বিন ইকরিমাকে খালেদের কাছে আহত অবস্থায়  আনা হ’ল। তখন তিনি ইকরিমার মাথা তার উরুর উপর ও তারই ছেলে আমর ইবনু ইকরিমার মাথা  তার পায়ের নলার উপর রেখে তাদের চেহারার হাত বুলাতে থাকলেন এবং মুখের মধ্যে পানির  ফোঁটা ঢালতে থাকলেন। এক পর্যায়ে তারা তার পায়ের উপর মাথা রেখেই শাহাদাত বরণ করলেন (ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলায়হে রাজে‘ঊন)[18]

            পারস্পরিক সহমর্মিতার বিরল  দৃষ্টান্ত : ইসলাম গ্রহণের ফলে মুসলমানদের মধ্যে সহমর্মিতা, পারস্পরিক ভালবাসা, নিজের  উপর অন্যকে প্রাধান্য দেয়া ও নিজের পসন্দনীয় বিষয়কে অন্যের জন্য পসন্দ করা এ সকল  গুণের একত্র সমাহার ঘটেছিল। এ গুণাবলীই তাদেরকে বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে  দিয়েছিল। যুদ্ধের ময়দানে জীবন হারানোর আশংকা থাকা সত্ত্বেও তারা নিজের উপর অন্যকে  প্রাধান্য দিয়েছেন। যুদ্ধের সময় হুযায়ফা (রাঃ) আহতদের মধ্যে তার চাচাতো ভাইকে  খুঁজতে থাকেন। তার সাথে ছিল সামান্য পানি। হুযায়ফার চাচাতো ভাইয়ের শরীর দিয়ে অবিরত  ধারায় রক্ত ঝরছিল। তার অবস্থা ছিল আশংকাজনক। হুযায়ফা (রাঃ) তাকে বললেন, তুমি কি  পানি পান করবে? সে হ্যঁা সূচক ইঙ্গিত করল। আহত সৈন্যটি হুযায়ফার কাছ থেকে পানি পান  করার জন্য পাত্র হাতে নিতেই তার পাশে এক সৈন্যকে পানি পানি বলে চিৎকার করতে শুনল।  পিপাসার্ত ঐ সৈনিকের আর্তনাদ শুনে তিনি আগে তাকে পানি পান করানোর জন্য হুযায়ফাকে  ইঙ্গিত দিলেন। অতঃপর হুযায়ফা তার নিকট গিয়ে তার হাতে পানির পাত্র দিলে তিনি পাত্র  উপরে তুলে ধরতেই পাশ থেকে অন্য একজন সৈন্যের চিৎকার শুনতে পেলেন। তখন তিনি পানি  পান না করে হুযায়ফা (রাঃ)-কে বললেন, তার দিকে দ্রুত ছুটে যাও এবং সে পানি পান করার  পর কিছু অবশিষ্ট থাকলে আমাকে দিয়ো। হুযায়ফা আহত সৈন্যটির কাছে গিয়ে দেখলেন, তিনি  মারা গেছেন। অতঃপর দ্বিতীয় জনের কাছে ফিরে এসে দেখলেন, তিনি মারা গেছেন। অতঃপর  চাচাতো ভাইয়ের কাছে ফিরে আসলে দেখেন তিনিও শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করে  জান্নাতবাসী হয়েছেন। পানির পাত্রটি তখনও হুযায়ফার হাতে। এতটুকু পানি। অথচ তা পান  করার মত এখন আর কেউ বেঁচে নেই। যাদের পানির প্রয়োজন ছিল তারা আরেক জনের পানির  পিপাসা মিটাবার জন্য এতই পাগলপরা ছিলেন যে, অবশেষে কেউ সে পানি পান করতে পারেননি।  অথচ সবারই প্রাণ ছিল ওষ্ঠাগত।[19] একেই বলে ‘মৃত্যুর দুয়ারে  মানবতা’।

            মদীনা থেকে পত্র প্রেরণ : ইবনুল আছীর  বলেন, মাহমিয়া ইবনু যানীম নামক এক দূত খলীফার পক্ষ থেকে পত্র নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে  আগমন করলে সৈন্যরা তার নিকট মদীনার খবর জানতে চায়। সে তাদেরকে বলে, মদীনা নিরাপদ ও  নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা রয়েছে। অথচ সে আবুবকর (রাঃ)-এর মৃত্যুর সংবাদ ও খালেদ বিন  ওয়ালীদ (রাঃ)-কে সেনাপতির দায়িত্ব থেকে অপসারণ করে তদস্থলে আবু ওবায়দা ইবনুল  জার্রাহ (রাঃ)-কে নিযুক্তির সংবাদ নিয়ে এসেছিল। অতঃপর দূত খালেদের সাথে সাক্ষাৎ করে  গোপনে আবুবকর (রাঃ)-এর মৃত্যু সংবাদ জানাল এবং খলীফা ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ)-এর  পক্ষ থেকে প্রেরিত পত্রখানা হস্তান্তর করল। সেনাপতি খালেদ সৈন্যদের কিছু না জানিয়ে  পত্রখানা সংরক্ষণ করলেন। কারণ এমন সময় আবুবকর (রাঃ)-এর মৃত্যুর সংবাদ ও সেনাপতির  পদ থেকে খালেদের অপসারনের খবর সৈন্যদের মাঝে বিশৃংখলা সৃষ্টি করতে পারে।[20]

            এরপর সেনাপতি খালেদ রোমকদের  বাম বাহুর উপর হামলা করলেন, যারা মুসলিম বাহিনীর উপর ডান বাহুর উপর হামলা করছিল।  প্রচন্ডভাবে আক্রমণ করে তিনি ৬ (ছয়) হাযার রোমক সৈন্য হত্যা করলেন। অতঃপর মুসলিম  সৈন্যদের কাছে ফিরে এসে বললেন, আল্লাহ্র কসম! কোন উর্বর-অনুর্বর ও কংকরময় ভূমিও  তাদের দখলে থাকবে না। তোমরা তো তা অবলোকন করছ। আর আমি আশা করি আল্লাহ তোমাদেরকে  তাদের উপর বিজয় দান করবেন। এ কথা বলে তিনি ১০০ (একশত) অশ্বারোহী নিয়ে ১০০০ (এক  হাযার) রোমক সৈন্যের উপর আক্রমণ করলেন। ক্ষণিকের মধ্যে তিনি তাদের ছত্রভঙ্গ করতে  সক্ষম হ’লেন। মুসলিম সৈন্যরা তাদের উপর হামলা করে তাদের অনেককে হত্যা ও অনেককে  বন্দি করলেন।[21]

            মুসলমানেরা যোহ্র ও আছরের  ছালাত ইশারায় আদায় করলেন। খালিদ স্বীয় পদাতিক বাহিনী নিয়ে শত্রুপক্ষের উপর হামলা  করলেন। এমনকি তাদের ভিতরে ঢুকে পড়লেন। তাদের বীরত্ব দেখে রোমকরা ভীত হয়ে পড়ল।  অবশেষে তাদের অশ্বারোহী বাহিনী পলায়ন করল। মুসলিম সৈন্যরা তাদের জন্য পথ খুলে দিল।  ফলে তারা শহ্রে বিপর্যস্ত হয়ে ঘুরাঘুরি করতে লাগল। অশ্বারোহী বাহিনী তাদের অনুসরণ  করল। সেনাপতি খালিদের শাণিত হামলার সামনে তারা তাঁর খননকৃত ওয়াকূছাহ নামক খন্দকের  (গভীর নালা) দিকে পিছু হটতে বাধ্য হ’ল এবং পঙ্গপালের আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়ার ন্যায়  তারা শিকলবদ্ধ অবস্থায় উক্ত গর্তে নিক্ষিপ্ত হ’তে লাগল। যখন তাদের একজন পড়ছিল তখন  শিকলে বাঁধা সবাই পড়ে যাচ্ছিল। যুদ্ধের ময়দানে নিহত সৈন্য ব্যতীত এভাবে সেখানে  তাদের এক লক্ষ বিশ হাযার সৈন্য নিহত হ’ল। যাদের আশি হাযার ছিল বিশেষ বাহিনীর সদস্য  ও চল্লিশ হাযার ছিল সাধারণ সৈন্য। বিজয় না আসা পর্যন্ত মুসলমানেরা এদিন তাদের  মাগরিব ও এশার ছালাত বিলম্বিত করেন।[22]

            সেনাপতি খালিদের বীরত্বের  ফলে রোমকরা পিছনে হটতে বাধ্য হচ্ছিল। তারপরেও এভাবে ছয় দিন ধরে যুদ্ধ চলল। প্রথম  চারদিন যুদ্ধের ভয়াবহতা ব্যাপক রূপ ধারণ করেছিল। সৈন্যদের কণ্ঠস্বর নিচু হয়ে পড়েছিল।  তরবারীর ঝংকার ও ঘোড়ার হ্রেসা ধ্বনি ব্যতীত কিছুই যেন শোনা যাচ্ছিল না। তারপরেও  আবু সুফিয়ানের হুংকার থেমে যায়নি। সাঈদ ইবনুল মুসাইয়িব (রহঃ) বলেন, ইয়ারমূকের দিন  আবু সুফিয়ান (রাঃ)-এর মত হুংকার আর কারো শোনা যায়নি। তার ছেলের পতাকাতলে যুদ্ধরত  অবস্থায় তিনি বলছিলেন, এটি আল্লাহ্র দিন সমূহের মধ্যে অন্যতম একটি দিন। হে আল্লাহ!  তুমি তোমার বান্দাদের উপর সাহায্য নাযিল কর।[23] যুদ্ধ যখন ভয়াবহ রূপ ধারণ  করল, তখন মুসলমান সৈন্যরা রোমকদেরকে যুদ্ধের জন্য এক গহীন উপত্যকায় টেনে আনতে  সক্ষম হ’ল। যখন তাদের একজন নিহত বা আহত হচ্ছিল তখন তাদের দশজনই চলে আসছিল। অতঃপর  গর্তে পতিত হচ্ছিল। এভাবে দশ হাযার রোমক সৈন্য সেখানে নিপতিত হয়েছিল, যাদেরকে  ঘোড়ার সাহায্যে পদদলিত করে হত্যা করা হয়েছিল।[24]

            ফলাফল : এ যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী বিজয়ী হয়। কোন কোন বর্ণনা মতে, রোমকদের এক লক্ষ  বিশ হাযারেরও বেশী সৈন্য নিহত হয়।[25]অপরপক্ষে  মুসলমানদের মাত্র তিন হাযার সৈন্য শহীদ হন। যাদের মধ্যে সাঈদ ইবনু হারব, নাঈম  আন-নাহহাম, নযর ইবনু হারেছ ও উমায়ের ইবনু হিশামের মত বড় বড় ছাহাবায়ে কেরাম ছিলেন।  রোমক সৈন্যরা পলায়ন করে দামেশকে আশ্রয় নেয়। তখন সম্রাট হিরাক্লিয়াস হিমছে অবস্থান  করছিলেন। পরাজয়ের সংবাদ শুনে তিনি রোম থেকে পলায়ন করে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের  রাজধানী কনস্টানটিনোপলে চলে যান। ইবনুল আছীর বলেন, সম্রাট হিরাক্লিয়াস পলায়নের সময়  সিরিয়ার দিকে মুখ করে বলেছিলেন, হে সিরিয়া তোমাকে সালাম! এরপর তোমার এ ভূমিতে আর  আমরা সমবেত হব না। কোন রোমক তোমার ভূমিতে কখনও নিরাপদে ফিরে আসবে না।[26] এরপর মুসলিম বাহিনী জর্ডানের দিকে অগ্রসর হয় এবং  তা জয় করে দামেশক জয়ের জন্য রওয়ানা হয়। সেখানে গিয়ে তারা তা অবরোধ করেন। অবশেষে  দামেশক জয় করেন। বেঁচে যাওয়া রোমক সৈন্যরা তাদের সকল সম্পদ রেখে পলায়ন করে। ফলে সেগুলো  মুসলমানদের গণীমতের মালে পরিণত হয়। যার পরিমাণ ছিল অনেক। যা বণ্টনের পর দেখা গেল  প্রত্যেক অশ্বারোহী এক হাযার পাঁচ দিরহাম থেকে এক হাযার পাঁচশ দিরহাম পর্যন্ত  পেয়েছেন।[27]

            রোমকদের দৃষ্টিতে মুসলমানদের বিজয়ের কারণ : মুসলমানদের ধৈর্য, ন্যায়পরায়ণতা, মিথ্যার প্রতি  ঘৃণা, সৎ কাজের আদেশ, অসৎ কাজে বাধা প্রদান এগুলো তাদের বিজয়ী হ’তে সহায়তা করে।  ইয়াকূত হামাবী বলেন, আল্লাহ ইয়ারমূকের যুদ্ধে এক বীরের (খালিদ বিন ওয়ালীদ) মাধ্যমে  মুসলমানদের সাহায্য করেন। পরাজিত রোমান সৈন্যরা ইনত্বাকিয়ায় সম্রাট হিরাক্লিয়াসের  দরবারে সমবেত হ’ল। তিনি তাদের কিছু লোককে ভিতরে ডেকে বললেন, তোমাদের ধ্বংস হোক,  তোমরা আমাকে বল, যাদের সাথে তোমরা যুদ্ধ করলে তারা কি তোমাদের মত মানুষ নয়? তারা  বলল, হ্যাঁ। তিনি বললেন, সংখ্যায় তোমরা বেশী না তারা বেশী? তারা বলল, আমরাই বেশী।  তিনি বললেন, তাহ’লে তোমাদের কি হয়েছে যে, তোমরা পরাস্ত হ’লে? তারা কোন উত্তর দিল  না। তখন তাদের মধ্য হ’তে এক বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে বলল, আমি এর জবাব দিচ্ছি। আর তাহ’ল-  মুসলমানরা যখন আক্রমণ করে তখন তারা ধৈর্যের সাথে লড়াই করে। তারা মিথ্যা বলে না এবং  মিথ্যারোপও করে না। আর যখন আমরা হামলা করি তখন ধৈর্য ধারণ করি না বরং মিথ্যারোপ  করি। তারা লোকদের সৎকাজের আদেশ দেয় এবং অসৎ কাজে বাধা প্রদান করে। তারা মনে করে  তাদের নিহতরা জান্নাতে যাবে এবং জীবিতরা বিজয়ী বেশে পুরস্কার ও গণীমত নিয়ে ফিরে  যাবে। তিনি বললেন, হে বৃদ্ধ! তুমি সত্য বলেছ, অবশ্যই আমি তোমাদেরকে এই এলাকা হ’তে  বিতাড়িত করব। তোমাদের সাহচর্যের আমার কোন প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন নেই আমার এক  বিচক্ষণ জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার। তখন বৃদ্ধ বলল, আল্লাহ্র কসম দিয়ে বলছি, আপনি  দুনিয়ার জান্নাত সিরিয়া আরবদের জন্য ছেড়ে দিয়ে চলে যাবেন না। কোন ওযরও পেশ করবেন  না।

            তিনি বললেন, তোমরা দামেশক, ফাহল ও হিমছ সহ  বিভিন্ন স্থানে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছ, কিন্তু সবখান থেকেই পলায়ন করেছ।  অথচ তাদের সাথে সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হওনি। বৃদ্ধ বলল, নক্ষত্রের মত অসংখ্য সৈন্য  পাশে থেকেও আপনি কি পলায়ন করবেন? খ্রিষ্টানদের কাছে আপনি কী ওযর পেশ করবেন? তখন  সম্রাট শান্ত হ’লেন এবং তাদেরকে রোম, আর্মেনিয়া ও কনস্টান্টিনোপলের পথে যুদ্ধে  পাঠালেন এবং বললেন, হে সৈন্যরা! আরবরা কেবল সিরিয়া জয় করে ক্ষান্ত হবে না। বরং ওরা  তোমাদের শেষ ভূমিটুকুও দখল করে নিবে। তোমাদের সন্তান ও নারীদেরকে বন্দি করবে এবং রাজার  সন্তানদেরকে দাস করে রাখবে। অতএব তোমরা তোমাদের সম্মান রক্ষা কর, রক্ষা কর তোমাদের  রাজাকে। এরপর তাদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাঠালেন। তারা পরাস্ত হওয়ার সংবাদ  পেলে তিনি বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা  দেওয়ার পূর্বে এক উঁচু স্থানে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, হে সিরিয়া! তোমাকে বিদায়ী সালাম!  তোমার এ ভূমিতে আর কখনো আমাদের ফিরে আসা হবে না। এরপর নিজের প্রতি আক্ষেপ করে  বললেন, তোমার জন্য ধ্বংস! কোন ভূমিই তোমার উপকারে আসল না। অসংখ্য সৈন্য তোমার কোন  উপকার করতে পারল না! এই উর্বর সবুজ-শ্যামল ভূমি শত্রুর বিরুদ্ধে কোন কাজে লাগল না।[28]

            যুদ্ধে নারীদের ভূমিকা : এ যুদ্ধে বহু নারী  অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করার পাশাপাশি আহতদের সেবা করেছিলেন।  আসমা বিনতে ইয়াযীদ (রাঃ) তার তাঁবুতে থেকে সাতজন রোমক সৈন্যকে হত্যা করেছিলেন।[29] আসমা বিনতে আবুবকর (রাঃ)  তার স্বামী যুবায়েরকে দারুণভাবে উৎসাহিত করেছিলেন।[30] ইবরাহীম নাখঈকে নারীদের  জিহাদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হ’লে তিনি বলেন, তারা রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে যুদ্ধে অংশ  গ্রহণ করত এবং আহতদের সেবা করত ও যোদ্ধাদের পানি পরিবেশন করত। কিন্তু তাদের কারো  শাহাদত বরণের কথা আমি শুনিনি। যখন রোমক বাহিনী মুসলমানদের ঘিরে ফেলেছিল, তখন কুরাইশ  নারীরা ইয়ারমূকের দিন তরবারী হাতে নিয়ে যুদ্ধ করেছিল।[31] ইবনু কাছীর বলেন,  ইয়ারমূকের যুদ্ধে মুসলিম রমণীগণ অংশগ্রহণ করে বহু রোমক সৈন্যকে হত্যা করেন। তারা  ময়দান থেকে পলায়নপর মুসলিম সৈন্যদের প্রহার করে বলছিলেন, তোমরা কোথায় পালাচ্ছ? আর  আমাদেরকে সেবা করার জন্য আহবান করছ? তখন পলায়নপর মুসলিম সৈন্যরা যুদ্ধের ময়দানে  ফিরে যায়। আমর ইবনুল আছ (রাঃ)ও পলায়নকারীদের মধ্যে ছিলেন। তিনি সহ আরো চারটি দল  যখন পলায়ন করে পশ্চাতের নারী সৈন্যদের নিকট পেঁŠছলেন,  তখন তারা তাদেরকে ভৎর্সনা করল ও অপমান করল। ফলে তারা পুনরায় যুদ্ধের ময়দানে ফিরে  গেলেন।[32]

            যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পর মুসলিম বাহিনী যখন সিরিয়ার  রাজধানী দামেশক অবরোধ করল, তখন খালিদ বিন ওয়ালীদ (রাঃ) খলীফা ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব  (রাঃ) কর্তৃক প্রেরিত পত্রের বিষয়বস্ত্ত প্রকাশ করলেন। যেখানে আবুবকর (রাঃ)-এর  মৃত্যু সংবাদ ও তাকে অপসারণ করে  আবু  ওবায়দা ইবনুল জার্রাহ (রাঃ)-কে প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব অর্পণ করার কথা লিখিত ছিল।  আবুবকর (রাঃ) জুমাদাল আখেরাহ মাসের মাঝামাঝি সময়ে সিরিয়া বিজয়ের মাত্র দশ দিন  পূর্বে মৃত্যুবরণ করেন।[33] অতঃপর সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালীদ (রাঃ) সব  দায়িত্ব নতুন সেনাপতিকে বুঝিয়ে দিয়ে সাধারণ সৈনিকে পরিণত হ’লেন।

            শিক্ষণীয় বিষয় : এক সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে কুরায়েশ ও সম্মিলিত আরব বাহিনীর  নেতা আবু সুফিয়ান, ‘এই উম্মতের ফেরাঊন’ বলে খ্যাত আবু জাহ্ল-এর পুত্র ইকরিমা, যারা  ৮ম হিজরীতে মক্কা বিজয়ের সময় মুসলমান হন, ইসলামের জন্য তাদের  অতুলনীয় বীরত্ব ও ত্যাগের মহিমা তাদের পিছনের  সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে। জাহেলী যুগে যারা সেরা ছিলেন ইসলামী যুগে তারাই সেরা ছিলেন।  আক্বীদা পরিবর্তনের মাধ্যমে মানুষের জীবনের যে আমূল পরিবর্তন ঘটে, এটাই তার বাস্তব  প্রমাণ। ইসলামের জিহাদ তাই মূলতঃ আক্বীদা পরিবর্তনের জিহাদ।

            আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়  হ’ল আমীরের প্রতি আনুগত্য। কিংবদন্তীতুল্য সেনাপতি খালেদ বিন ওয়ালীদ যুদ্ধ  চলাকালীন সময়ে বরখাস্ত হওয়া সত্ত্বেও সহজভাবে উক্ত নির্দেশ মেনে নেন। বিশ্ব  ইতিহাসে অতুলনীয় এই আনুগত্যের কারণেই প্রথম যুগের মুসলমানদের পক্ষে বিশ্ব জয় করা  সম্ভব হয়েছিল।

            উপসংহার : চিরন্তন সত্য হ’ল  মুসলমানগণ কখনো সংখ্যাধিক্য বা আধুনিক অস্ত্রের ব্যবহার কিংবা অনুকূল জায়গায় অবস্থান  করে যুদ্ধ করার ফলে বিজয় লাভ করেননি। বরং তাদের অটুট ঈমানী শক্তি, আল্লাহ্র উপর  অবিচল আস্থা ও আল্লাহ্র পক্ষ থেকে সাহায্য নাযিল হওয়ায় তারা বিজয় লাভ করেছেন।  অন্যথায় ইয়ারমূকের যুদ্ধে দুই লক্ষ চল্লিশ হাযার প্রশিক্ষিত সৈন্যের বিরুদ্ধে  মাত্র চল্লিশ হাযার সৈন্যের যুদ্ধে জয়লাভ করা সহজ ব্যাপার ছিল না। আল্লাহ তা‘আলা  বলেন, ‘তোমরা হীনবল হয়ো না, চিন্তান্বিত হয়ো না, তোমরাই বিজয়ী যদি তোমরা মুমিন হও’ (আলে ইমরান ৩/১৩৯)

            কালপরিক্রমায় দেড় হাযার বছর পর সেই সিরিয়া ও ফিলিস্তীন  এখন যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত। প্রতিদিন সেখানে নিহত হচ্ছে শত শত মুসলমান। হত্যাকারী ও  নিহত ব্যক্তি কেউ জানে না কেন সে যুদ্ধ করছে, কেনই বা সে নিহত হচ্ছে। যে যার মত  সেখানে আপন আপন শক্তি প্রদর্শন করে চলেছে। আর মানবতার এক চরম বিপর্যয় ঘটিয়ে চলেছে  অবিরতভাবে। তার মধ্যে এমন একটি পক্ষের উত্থান ঘটেছে যারা কিনা সরাসরি ‘খিলাফত’  ঘোষণা করে যুদ্ধ পরিচালনা করছে। কিন্তু তাদের যুদ্ধনীতিতে ‘খিলাফত’ ব্যবস্থা তথা  ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার কোন চিহ্ন নেই, বরং রয়েছে তাতার-মোঙ্গলদের মত  ঠান্ডা মাথার হিংস্রতা ও সীমাহীন বর্বরতা। আল্লাহ্র পথে জিহাদের দুর্জয় প্রতিরোধ  সংগ্রামের পরিবর্তে রয়েছে নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ আর সাধারণ মানুষের রক্ত নিয়ে  হোলিখেলা। দেড় হাযার বছর পূর্বে ইয়ারমূকের যুদ্ধের বিজয়ী মুসলিম সেনাবাহিনীকে খ্রিষ্টান  সম্রাট হিরাক্লিয়াস অভিহিত করেছিলেন ‘বিচক্ষণ জাতি’ হিসাবে। আর আজকের এই তথাকথিত  মুজাহিদ তথা উগ্রবাদীরা সারা বিশ্বের কাছে চিহ্নিত হয়েছে একটি ঘৃণিত পশুশক্তি  হিসাবে। এখানেই পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে যায় সত্যসেবী মরণজয়ী মুজাহিদ আর চরমপন্থী খুনীদের  মধ্যে। আল্লাহ রাববুল আলামীন আমাদের সকলকে সত্যসেবীদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার তাওফীক  দান করুন। ইয়ারমূকের ময়দানে মুসলিম বাহিনী সেদিন যে ত্যাগ ও বীরত্ব দেখিয়েছিল, সেই  ঈমানী দৃঢ়তা ও আদর্শিক মহত্তবব নিয়ে বিশ্বের বুকে আবারও সেই হারানো মর্যাদার আসনে  মুসলমানদের অধিষ্ঠিত হওয়ার তাওফীক আল্লাহ দান করুন। আমীন!           

           



               


               

                  [1]. তারীখ ইবনু  জারীর ত্বাবারী ২/৩৩৬; ৩/৩৯৪

               

             

                  [2]. ইবনুল আছীর,  আল-কামিল ফিত-তারীখ, ২/৪০৬

             

             

                  [3]. ইবনুল আছীর ২/৪০৬; মুহাম্মাদ হোসাইন হায়কাল, আছ-ছিদ্দীক্ব আবুবকর, পৃঃ ২৮৫

             

             

                  [4]. তারীখ ইবনু  জারীর ত্বাবারী ৩/৩৯২; ইবনুল আছীর ২/৪০৬

             

             

                  [5]. ইবনুল আছীর  ২/৪০৬; ইবনু আসাকির, তারীখু  দিমাশক ২/১৬২

             

             

                  [6]. ইবনু কাছীর,  আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৭/৫

             

             

                  [7]. ইবনুল আছীর  ২/৪০৬

             

             

                  [8]. সামী বিন আব্দুল্লাহ আল-মাগলূছ, আত্বলাসুল খলীফা  আবুবকর ছিদ্দীক্ব (রাঃ), পৃঃ ৯৫।

             

             

                  [9]. আলী বিন নায়েফ, আল-মুফাছছাল ফী আহকামিল হিজরাহ ২/১৭১

             

             

                  [10]. তারীখ ইবনু  জারীর ত্বাবারী ২/৩৩৬

             

             

                  [11]. ইবনুল আছীর  ২/৪১২

             

             

                  [12]. ইবনু জারীর  ত্বাবারী ৩/৩৯৭

             

             

                  [13]. আল-বিদায়াহ  ওয়ান নিহায়াহ ৭/৯

             

             

                  [14]. ঐ, ৭/৮-৯

             

             

                  [15]. যাহাবী,  তারীখুল ইসলাম ৩/১৩৯-১৪০

             

             

                  [16]. ইবনু জারীর  ত্বাবারী ৩/৪০১।

             

             

                  [17]. ঐ,  ৩/৩৯৮-৪০০

             

             

                  [18]. ঐ, ২/৩৩৮

             

             

                  [19]. আল-বিদায়াহ  ওয়ান নিহায়াহ, ৭/৮-১১ প্রভৃতি দ্রঃ

             

             

                  [20]. ইবনুল আছীর,  আল কামিল ফিত-তারীখ ২/২৬০

             

             

                  [21]. ড.  মুহাম্মাদ সাইয়িদ ওয়াকীল, জাওলাতুন তারীখিয়াহ ফী ‘আছরিল খুলাফা-ইর রাশেদীন, পৃঃ ৬৭

             

             

                  [22]. ইবনু জারীর  ত্বাবারী ৩/৪০০

             

             

                  [23]. ইবনু হাজার  আসক্বালানী, আল-মাতালিবুল ‘আলিয়াহ, হা/৪১৪৮ ‘মানাক্বিব’ অধ্যায়, ‘আবু সুফিয়ানের মর্যাদা’ অনুচ্ছেদ

             

             

                  [24]. তারীখুল  ইসলাম ৩/১৩৯-১৪০

             

             

                  [25]. ইবনু জারীর  ত্বাবারী ৩/৪০০

             

             

                  [26]. আল-কামিল  ফিত-তারীখ ২/৩৪১-৩৪২

             

             

                  [27]. ইবনু জারীর  ত্বাবারী ৩/৪০০; হায়কাল, পৃঃ ৩০৩।

             

             

                  [28]. ইয়াকূত  হামভী, মু‘জামুল বুলদান ৩/২৮০

             

             

                  [29]. সুনানু সাঈদ ইবনু মানছূর, হা/২৭৮৭, কিতাবুল জিহাদ;  মু‘জামুল কাবীর হা/৪০৩

             

             

                  [30]. ইবনু সা‘দ,  আত-ত্বাবাকাতুল কুবরা ৮/২৫৩ পৃঃ

             

             

                  [31]. মুছান্নাফ  আব্দুর রাযযাক হা/৯৬৭৩।

             

             

                  [32]. আল-বিদায়াহ  ওয়ান নিহায়াহ, ৭/১৩-১৪

             

             

                  [33]. ইবনু জারীর  ত্বাবারী ৩/৩৯৪।

             

           

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button