ইসলামের পরিচয়

মুসলিম বিশ্বের ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক হালচাল

আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব

যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন  ভিত্তিক একটি প্রসিদ্ধ সামাজিক গবেষণা সংস্থা ‘পিউ রিসার্চ সেন্টার’। গত বছর  এপ্রিলে ২২৬ পৃষ্ঠার একটি দীর্ঘ সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশ করে।[1] দু’দফায় ২০০৮-০৯ এবং ২০১১-১২ মোট চার বছর ধরে ৩৯টি মুসলিম অধ্যুষিত দেশে  আশিরও অধিক ভাষায় ৩৮০০০-এর বেশী মৌখিক সাক্ষাৎকার গ্রহণের মাধ্যমে সমীক্ষাটি  চালানো হয়। এতে বিভিন্ন পেশা ও শ্রেণীর মুসলমানদেরকে মৌলিক ৭টি ক্যাটাগরিতে প্রশ্ন  করা হয়, যেখান থেকে এমন কিছু বিষয় উঠে এসেছে, যা সত্যিই চমকপ্রদ ও আগ্রহউদ্দীপক  এবং সেই সাথে উদ্বেগজনকও বটে। বিশেষতঃ এতে মাঠ পর্যায়ে আধুনিক মুসলিম বিশ্বের  ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান ও হালচাল সম্পর্কে একটা সাধারণ চিত্র ফুটে  উঠেছে। এই সমীক্ষার কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলেম-ওলামা এবং ইসলামী সমাজনেতাদের  জন্য চিন্তার খোরাক হ’তে পারে, যা তাঁদের কাছে নতুনভাবে কর্মপরিকল্পনা তৈরীর দাবী  রাখে। নিম্নে সমীক্ষার উল্লেখযোগ্য অংশসমূহ উল্লেখ করা হ’ল।

১. ইসলামী শরী‘আহ আইন :

            বলার  অপেক্ষা রাখে না যে, আধুনিক মুসলিম বিশ্বের সমাজ ও রাজনীতিতে সেক্যুলারিজম,  মানবতাবাদ, সংশয়বাদ ইত্যাদি নাস্তিক্যবাদী চিন্তাধারা অতিশয় বিস্তৃতভাবে ছড়িয়ে  পড়েছে। সাথে সাথে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব এবং সেক্যুলার মিডিয়া সমূহের প্রোপাগান্ডায়  ইসলামোফোবিয়া বর্তমান বিশ্বের অন্যতম একটি আলোচিত প্রপঞ্চ। পরিস্থিতি অনেক  ক্ষেত্রে এমন দাঁড়িয়েছে যে, এক শ্রেণীর মুসলমান স্বীয় ধর্মপরিচয় নিয়েই বিব্রত।  এতদসত্ত্বেও বিস্ময়করভাবে এই সমীক্ষায় দেখা গেছে মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোতে  অধিকাংশ মুসলমানই তাদের দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থায় ইসলামী শরী‘আহ আইনের প্রয়োগ দেখতে  চেয়েছেন। মজার ব্যাপার হ’ল এই রিপোর্ট অনুযায়ী আমাদের বাংলাদেশে শতকরা ৮২ ভাগ  মুসলমান, শরী‘আহ আইনকে দেশের শাসনতন্ত্র হিসাবে দেখতে চান। এছাড়া আফগানিস্তানে ৯৯  ভাগ, মালয়েশিয়া ৮৬ ভাগ, পাকিস্তানে ৮৪ ভাগ, মধ্যপ্রাচ্যের ইরাকে ৯১ ভাগ,  ফিলিস্তীনে ৮৯ ভাগ, উত্তর আফিকার মরক্কোতে ৮৩ ভাগ, মিসরে ৭৪ ভাগ এবং সাব-সাহারান  আফ্রিকার নাইজারে ৮৬ ভাগ, জিবুতিতে ৮২ ভাগ মানুষ রাষ্ট্রীয়ভাবে শরী‘আহ আইন কামনা  করেন। উল্লেখ্য যে, সঊদী আরব, সুদান, ভারত ও ইরানে এই সমীক্ষাটি গ্রহণ করা হয়নি  নিরাপত্তাহীনতার কারণে।

            তালিকায় দেখানো হয়েছে  সামগ্রিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার ৮৪ ভাগ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ৭৭ ভাগ, মধ্যপ্রাচ্য ও  উত্তর আফ্রিকার ৭৪ ভাগ, সাব-সাহারান আফ্রিকার ৬৪ ভাগ মুসলমান ইসলামী শরী‘আহ আইন  বাস্তবায়নের পক্ষপাতী। তবে এ সংখ্যাটা উত্তর-পূর্ব ইউরোপে এবং মধ্য-এশিয়ায় অনেক  কম। যথাক্রমে মাত্র ১৮% এবং ১২%। সেই সাথে বিস্ময়করভাবে ইসলামী খেলাফতের সর্বশেষ  রাজধানী তুরস্কে এই সংখ্যাটা মাত্র ১২%। এমনকি সেখানে অন্ততঃ ৭৬% মুসলমান মনে করেন  যে, পারিবারিক ও সম্পত্তি বিষয়ক বিচার-আচারের জন্যও শারঈ আদালতের বিশেষ প্রয়োজন  নেই। উল্লেখ্য যে, ১৯২০ সালে সেক্যুলারিস্ট আন্দোলনের সময় সে দেশ থেকে শারঈ আদালত  বিলুপ্ত করা হয়।

            পরিসংখ্যানে আরো দেখা  গেছে, যেসব দেশে ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম হিসাবে ঘোষিত হয়েছে, সেসব দেশেই সমর্থকের  সংখ্যাটা বেশী। তবে কিরগিজিস্তান (৩৫%), লেবানন (২৯%), তাজিকিস্তান (২৭%)-এর মত  পাঁড় ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রেও সমর্থনের হারটা একেবারে কম নয়।

            শরী‘আহ আইনের সমর্থকদের  বয়সের একটা হিসাবও দেয়া হয়েছে এখানে। তাতে দেখা যায় সমর্থকদের অধিকাংশই বয়স্ক তথা  পঁয়ত্রিশোর্ধ। পাকিস্তানে আবার পুরুষদের তুলনায় নারী সমর্থকদের সংখ্যা শতকরা ১৬  ভাগ বেশী। আরেকটি বিষয় হ’ল, মতামতদাতাদের মধ্যে শিক্ষিত ও অশিক্ষিতের হারে বিশেষ  তারতম্য নেই।

            ২. আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস  :

            শরী‘আহ আইনকে  রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠায় সমর্থন থাক বা না থাক, অধিকাংশ মুসলিম দেশে প্রায়  শতভাগের কাছাকাছি মুসলমান আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসকেই ভাল মানুষ হওয়ার এবং মানবিক  মূল্যবোধ অর্জনের জন্য প্রধান এবং আবশ্যকীয় শর্ত হিসাবে মনে করেন। এই সংখ্যা  দক্ষিণ এশিয়ায় ৯৪ ভাগ, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় ৯১ ভাগ, দক্ষিণ এশিয়ায় ৮৭  ভাগ, আফ্রিকায় ৭০ ভাগ এবং মধ্য-এশিয়ায় ৬৯ ভাগ। কট্টর ধর্মনিরপেক্ষ উত্তর-পূর্ব  ইউরোপেও এই সংখ্যা ৬১ ভাগ। কেবলমাত্র আলবেনিয়া (৪৫%) এবং কাজাখস্তানেই (৪১%) এই  হিসাবটি শতকরা ৫০ ভাগের কম। বাংলাদেশেরও শতকরা ৮৯ ভাগ মানুষ একজন মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন  মানুষ হ’তে গেলে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসকে অপরিহার্য মনে করেন।                  

            ৩. চূরির শাস্তি (হুদূদ)  :     

            মুসলিম দেশগুলিতে  সাধারণভাবে শরী‘আহ আইনের পক্ষে জনসমর্থন থাকলেও নির্দিষ্টভাবে শরী‘আহ আইনের কোন কোন  ধারার ব্যাপারে বেশ কিছু তারতম্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন চূরির শাস্তিতে হাত কর্তন  করা সমর্থন করেন কি-না এমন প্রশ্নে বাংলাদেশের  শতকরা ৫০ ভাগ মানুষই ইতিবাচক মন্তব্য করেছেন। এছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে  পাকিস্তানে ৮৮ ভাগ, আফগানিস্তানে ৮১ ভাগ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মালয়েশিয়াতে ৬৬ ভাগ,  থাইল্যান্ডে ৪৬ ভাগ, ইন্দোনেশিয়াতে ৪৫ ভাগ, মধ্যপ্রাচ্যের ফিলিস্তীনে ৭৬ ভাগ,  মিসরে ৭০ ভাগ, মধ্য এশিয়ার কিরগিজিস্তানে ৫৪ ভাগ, তুরস্কে ৩৫ ভাগ, উত্তর-পূর্ব  ইউরোপের আলবেনিয়াতে ৪৩ ভাগ, রাশিয়াতে ৩৯ ভাগ মতামতদাতা এই আইনকে সমর্থন করেছেন।

            ৪. রজম বা পাথর নিক্ষেপে  হত্যা (হুদূদ) :

            ব্যভিচারের শাস্তি  হিসাবে রজম বা পাথর নিক্ষেপে হত্যা করাকে সমর্থন করেন কি-না এই প্রশ্নে  আশ্চর্যজনকভাবে বিশ্বের ২০টি মুসলিম দেশের ১০টিতেই অর্ধেকের বেশী মানুষ সমর্থনসূচক  মন্তব্য করেছেন। সবচেয়ে বেশী অগ্রসর পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের মতামতদাতারা।  পাকিস্তানের ৮৯ ভাগ এবং আফগানিস্তানের ৮৫ ভাগ মানুষ এই আইনকে জোর সমর্থন করেছেন।  বাংলাদেশেও এই আইনের সমর্থক প্রায় ৫৫ ভাগ। এছাড়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মালয়েশিয়াতে  ৬০ ভাগ, থাইল্যান্ডে ৫১ ভাগ, ইন্দোনেশিয়াতে ৪৮ ভাগ, মধ্যপ্রাচ্যের ফিলিস্তীনে ৮৪ ভাগ,  মিসরে ৮১ ভাগ, জর্ডানে ৬৭ ভাগ, মধ্যএশিয়ার তাজিকিস্তানে ৫১ ভাগ, তুরস্কে ২৯ ভাগ  এবং উত্তর-পূর্ব ইউরোপের রাশিয়াতে ২৬ ভাগ, কসভো ও আলবেনিয়াতে ২৫ ভাগ,  বসনিয়া-হার্জেগোভিনাতে ২১ ভাগ মতামতদাতা রজমের শাস্তিকে সমর্থন করেছেন। বর্তমানে  পরজীবী মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অব্যাহত অপপ্রচারণা সত্ত্বে্ও রজমের শাস্তির পক্ষে  এমন স্ফীত সমর্থন সত্যিই বেশ কৌতূহল সৃষ্টি করে।

            ৫. মুরতাদের শাস্তি  মৃত্যুদন্ড (হুদূদ) :

            এক্ষেত্রেও ২০টি দেশের  মধ্যে অন্ততঃ ৬টি দেশের অর্ধেকের বেশী জনগণ মুরতাদের শাস্তি মৃত্যুদন্ডকে আবশ্যক  মনে করেন। সর্বাধিক সমর্থন দেখা গেছে মিসরে ৮৬ ভাগ এবং জর্ডানে ৮২ ভাগ। দক্ষিণ  এশিয়ায় পাকিস্তানে ৭৯ ভাগ, আফগানিস্তানে ৭৬ ভাগ মানুষ এই আইন সমর্থন করলেও  বাংলাদেশে এই সংখ্যাটা একটু কম, শতকরা ৪৪ ভাগ। এছাড়া মালয়েশিয়ায় ৬২ ভাগ,  ইন্দোনেশিয়ায় ১৮ ভাগ, বসনিয়া-হার্জেগোভিনা ও রাশিয়ায় ১৫ ভাগ এবং আলবেনিয়ার ৮ ভাগ  মানুষ এই আইন সমর্থন করেন। মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে কেবল তাজিকিস্তানেই এক-পঞ্চমাংশ  মানুষ (২২%) এই আইনের সমর্থক। বাকি দেশগুলোতে এ সংখ্যা এক-দশমাংশেরও কম।  স্বাভাবিকভাবেই এই ধর্মনিরপেক্ষতার জয়জয়কারের যুগে এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে এত  সমর্থন থাকাটা বেশ বিস্ময়করই বটে।

            ৬. বহুবিবাহ :

            আধুনিক বিশ্বে বহুবিবাহ  মানুষের চোখে একটি গর্হিত অপরাধে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে আধুনিকতার দাবীদার  পাশ্চাত্য সমাজব্যবস্থায় এটা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। কিন্তু পিউ সেন্টারের সমীক্ষায়  দেখা গেছে, অধিকাংশ মুসলিম দেশের একটি বড় অংশ একে নৈতিকভাবে সমর্থন করেছেন।  সাব-সাহারান আফ্রিকার দেশগুলোতে এই সমর্থনের ভাগটা সবচেয়ে বেশী। নাইজারে ৮৭ ভাগ,  সেনেগালে ৮৬ ভাগ, মালি ৭৪ ভাগ, ক্যামেরুনে ৬৭ ভাগ এবং নাইজেরিয়া ও তাঞ্জানিয়াতে ৬৩  ভাগ মানুষ বহুবিবাহ গ্রহণযোগ্য মনে করেন। তবে জিবুতি, লাইবেরিয়া, ইথিওপিয়ার  দেশগুলোতে সমর্থনের হারটা ৫০ ভাগের কম। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতেও বহুবিবাহ প্রায়  একচেটিয়া সমর্থিত। তবে তিউনিসিয়ায় এই সমর্থনের হার মাত্র ৩৩ ভাগ। দক্ষিণ এশিয়াতে  সমর্থনের ভাগটা তুলনামূলক বেশ কম। বাংলাদেশে ৫৬ ভাগ মানুষ বহুবিবাহের প্রতি  অনিচ্ছুক মনোভাব দেখিয়েছেন। এই সংখ্যাটা পাকিস্তানেও ৪২ ভাগ। তবে মজার ব্যাপার হ’ল  দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার থাইল্যান্ডে ৬৬ ভাগ এবং মালয়েশিয়াতে ৪৯ ভাগ মানুষ বহুবিবাহের  সমর্থক। আর পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাবাধীন মধ্যএশিয়া এবং উত্তর-পূর্ব ইউরোপের  দেশগুলোতে স্বাভাবিকভাবে বহুবিবাহের প্রতি সমর্থন অনেক কম। তুরস্কে ৭৮ ভাগ মানুষই  বহুবিবাহকে নাকচ করেছেন। তবে রাশিয়াতে বিস্ময়করভাবে ৩৭ ভাগ মানুষ এখনো বহুবিবাহ  সমর্থন করেন। বলা বাহুল্য, যারা সমর্থন করেছেন তাদের বড় অংশই পুরুষ। নারীরা প্রায়  একচেটিয়াভাবে নেতিবাচক মত পোষণ করেছেন। কেবল আফ্রিকার নারীরা এক্ষেত্রে বেশ  সহনশীল।

            ৭. স্বামী-স্ত্রীর  সম্পর্ক :

            পুরুষ ও নারীর সম্পর্কের  প্রশ্নে প্রাকৃতিকভাবেই পুরুষের উপর অভিভাবকত্বের দায়দায়িত্ব বর্তায়। কিন্তু  আধুনিক যুগে এই প্রাকৃতিক ব্যাপারটিকে কটাক্ষ করে ‘পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা’  নামক নিন্দার্থে ব্যবহৃত একটি পরিভাষা আবিষ্কার করা হয়েছে। যার মূলে হ’ল নারীর উপর  পুরুষের অভিভাবকত্ব ক্ষমতাকে রহিত বা খর্ব করা। মানবাধিকার সংস্থাগুলো ‘নারীর  ক্ষমতায়নে’র নামে এ ব্যাপারে খুব জোরেশোরে প্রচারণা চালিয়ে আসছে। এতদসত্ত্বেও এই  সমীক্ষায় দেখা গেছে, মুসলিম দেশগুলোতে প্রায় শতভাগ মানুষই মনে করেন স্ত্রীকে  অবশ্যই তার স্বামীর আনুগত্য করা উচিত। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে ৮৮ ভাগ মানুষই এই  মতের সমর্থক। মালয়েশিয়ায় ৯৬ ভাগ, ইন্দোনেশিয়ায় ৯৩ ভাগ এবং থাইল্যান্ডে ৮৯ ভাগ  মানুষ স্ত্রীর উপরে স্বামীর অভিভাবকত্বকে সমর্থন করেন। মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর  আফ্রিকার দেশগুলোতেও পরিস্থিতি একই রকম। কেবল জর্ডানে এবং লেবাননে এই সমর্থনটা ৮০  ভাগের নীচে। অনুরূপভাবে মধ্যএশিয়ার দেশগুলোতে সমর্থনের হার ৭৫ ভাগের উপরে। কেবল  তুরস্কে (৬৫%) এবং কাজাকিস্তানে (৫১%) সমর্থন খানিকটা কম। আর ইউরোপের নিকটবর্তী  দেশ রাশিয়াতে ৬৯ ভাগ, বসনিয়াতে ৪৫ ভাগ এবং আলবেনিয়াতে ৪০ ভাগ মানুষ স্ত্রীর উপর  স্বামীর কর্তৃত্বকে আবশ্যক বলে মত প্রকাশ করেছেন।

            ৮. সম্পত্তিতে  ছেলে-মেয়ের সমান ভাগ :

            সম্পত্তিতে ছেলে-মেয়ের  সমান ভাগ দেয়া উচিত কি-না এ প্রশ্নে অবশ্য মুসলিম সমাজে যথেষ্ট বিভক্তি দেখা গেছে।  দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপ এবং মধ্যএশিয়ার অধিকাংশেরই মত হ’ল সম্পত্তিতে ছেলে-মেয়ের সমবণ্টনই  থাকা উচিত। এমনকি তুরস্কে ৮৮ ভাগ মানুষই এই নীতির পক্ষে। তবে কিছুটা  ব্যতিক্রমীভাবে উজবেকিস্তানে ৫০ ভাগ এবং কিরগিজিস্তানে ৪৬ ভাগ মানুষ সমবণ্টনের  পরিবর্তে শরী‘আত অনুযায়ী প্রাপ্য হারে বণ্টন করার পক্ষপাতী। দক্ষিণ এশিয়ার  ইন্দোনেশিয়া (৭৬%) এবং থাইল্যান্ডের (৬১%) অধিকাংশ মানুষ সমবণ্টনে বিশ্বাসী হ’লেও  বেশ লক্ষণীয়ভাবে মালয়েশিয়ায় ৬৪ ভাগ মানুষ শরী‘আত মোতাবেক বণ্টনেই বিশ্বাসী। আবার  পাকিস্তানে ৫৩ ভাগ মানুষ সমবণ্টনের সমর্থক হ’লেও পার্শ্ববর্তী দেশ আফগানিস্তানে ৭০  ভাগ এবং বাংলাদেশে ৫৪ ভাগ মানুষ শরী‘আহ মোতাবেক বণ্টনেই আস্থাশীল। মধ্যপ্রাচ্য এবং  উত্তর আফ্রিকার চিত্র অবশ্য ভিন্ন। সেখানকার সব দেশেরই অধিকাংশ মানুষ শরী‘আহ  মোতাবেক বণ্টনকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তবে ফিলিস্তীনে ৪৩ ভাগ মানুষ, মিসরে ২৬ ভাগ  এবং মরক্কো ও তিউনিসিয়ায় ১৫ ভাগ মানুষ এখনো নারী-পুরুষ সমবণ্টনের সমর্থক রয়েছেন।

            ৯. ব্যক্তিজীবনে রাসূল  (ছাঃ)-এর সুন্নাতের প্রভাব :

            সমীক্ষায় প্রশ্ন করা  হয়েছিল যে, তাদের জীবনে নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর শিক্ষা তথা সুন্নাতের প্রভাব  কতটুকু আছে? এ প্রশ্নের জবাবে প্রায় সব দেশেরই অধিকাংশ মুসলমান বলেছেন, তাদের  জীবনে কম-বেশী রাসূল (ছাঃ)-এর দেখানো পথ তথা সুন্নাতের প্রভাব আছে। বিশেষতঃ দক্ষিণ  এশিয়ার মুসলমানরাই এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশী অগ্রসর। বাংলাদেশে ৮৪ ভাগ মানুষই তাদের  জীবনে রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাতের প্রভাব স্বীকার করেছেন। যাদের মধ্যে ৪৬ ভাগই মনে  করেন এই প্রভাবটা তাদের জীবনে অনেক বেশী। অনুরূপভাবে পাকিস্তানে ৮৭ ভাগ এবং  আফগানিস্তানে ৯৭ ভাগ মানুষ এ প্রভাবের কথা উল্লেখ করেছেন। পূর্বের দেশ থাইল্যান্ডে  ৮৭ ভাগ মানুষ একই মত ব্যক্ত করেছেন। যাদের ৭০ ভাগই আবার উল্লেখ করেছেন এই প্রভাবটা  তাদের উপর খুব জোরালো। ইন্দোনেশিয়ায় ৮৩ ভাগ এবং মালয়েশিয়ায় ৭৬ ভাগ মানুষ একই কথা  বলেছেন। মধ্যপ্রাচ্যে বিস্ময়করভাবে এই সংখ্যাটা বেশ কম। সর্বাধিক ইরাকে (৮২%) ও  মরক্কোতে (৮১%) এই সংখ্যাটি বেশী হ’লেও লেবানন (৫৬%), ফিলিস্তীন (৬১%), জর্ডান  (৪৭%) এবং মিসরে (৫৬%) তা উল্লেখযোগ্য হারে কম। আবার মধ্যএশিয়ার মুসলমানরা এ  ব্যাপারে বেশ অগ্রসর। কেবল কাজাখস্তান (৩৮%) বাদে সেখানকার বাকি দেশগুলোতে তা  শতকরা ৫০ ভাগের উপরে। তবে তুরস্কে এই সংখ্যাটা ৭৬% হওয়াটা জরীপের অন্যান্য হিসাবের  তুলনায় একটু অবিশ্বাস্যই মনে হয়। তবে দুঃখজনক  হ’লেও সত্য যে, উত্তর-পূর্ব ইউরোপের মুসলিম দেশ কসোভো এবং আলবেনিয়ার মাত্র ২০ ভাগ  মুসলমান মনে করে তাদের জীবনে রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাতের কোন দৃশ্যমান প্রভাব রয়েছে।

            ১০. ইসলামই একমাত্র  জান্নাতে প্রবেশের মাধ্যম :

            ৩৪টি মুসলিম দেশের  মুসলমানদেরকে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, জান্নাতে প্রবেশের জন্য কেবল ইসলামই কি একমাত্র  অনুসরণীয় ধর্ম, না-কি অন্যান্য ধর্মানুসারীরাও জান্নাতে যেতে পারে? তাতে দেখা গেছে,  দক্ষিণ এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় শতভাগ মানুষই বিশ্বাস করেন যে, জান্নাতে  প্রবেশ করতে গেলে ইসলাম অনুসরণের কোন বিকল্প নেই। বাংলাদেশে ৮৮ ভাগ এবং পাকিস্তানে  ৯২ মানুষ এই বিশ্বাস পোষণ করেন। অনুরূপভাবে মালয়েশিয়াতে ৯৩ ভাগ, ইন্দোনেশিয়া ও  থাইল্যান্ডে ৮৭ ভাগ মুসলমান এই ধারণায় বিশ্বাসী। মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় শতভাগ মানুষ  ইসলামকে নিরংকুশ অনুসরণীয় ধর্ম বলে বিশ্বাস করে। কেবল তিউনিসিয়া ও লেবাননে  যথাক্রমে ২৪ ও ২৭ ভাগ মানুষ মনে করে ইসলামের পরিবর্তে অন্য ধর্ম অনুসরণ করলেও  জান্নাতে যাওয়া যাবে। সাব-সাহারান আফ্রিকার মুসলমানদের মধ্যেও এ ব্যাপারে তেমন কোন  সন্দেহ নেই। কেবল ধারার বিপরীতে মোজাম্বিক ও চাদের মত কিছু দেশে যথাক্রমে ৪৪ ও ৪৯  ভাগ মানুষ ধারণা করে যে, অন্য ধর্মের অনুসারীরাও জান্নাতে যেতে পারে। মধ্যএশিয়া  এবং উত্তর-পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতেও মুসলমানরা এ ব্যাপারে মোটামুটি সচেতন যে  ইসলামই একমাত্র সত্য ধর্ম। কিন্তু কিরগিজিস্তানের ৪৯ ভাগ এবং বসনিয়ার ৩৬ ভাগ  মুসলমানের ধারণায় এখনও এই গলদ রয়ে গেছে যে, অন্যান্য ধর্মানুসারীও জান্নাতে যাবে।

            ১১. ধর্ম ও বিজ্ঞানের সম্পর্ক  :

            ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যকার  সম্পর্কের প্রশ্নেও অধিকাংশ মুসলিমের ধারণা মোটামুটি স্পষ্ট। জরিপ চালানো ২৩টি  দেশের মাত্র দু’টি দেশ লেবানন ও তিউনিসিয়ায় শতকরা ৫০ ভাগের বেশী মানুষের ধারণা  ধর্ম ও বিজ্ঞান সাংঘর্ষিক। বাকি দেশগুলোর অধিকাংশ মানুষই মনে করেন ধর্ম ও  বিজ্ঞানের মধ্যে কোন বিভেদ নেই। তবে অনাকাংখিতভাবে বাংলাদেশে অন্ততঃ ৪৫ ভাগ  মুসলমানের মতে ধর্ম ও বিজ্ঞানের অনেক বিষয়েই সংঘাত রয়েছে। এই হারটি তুলনামূলকভাবে  অন্যান্য মুসলিম দেশ থেকে একটু বেশীই।

            ১২. বিবর্তনবাদে বিশ্বাস  :

            জরীপে অত্যন্ত হতাশাজনক  চিত্র দেখা গেছে বিবর্তনবাদের প্রশ্নে। ২২টি মুসলিম দেশের ১৩টিতেই অধিকাংশ মুসলমান  বিশ্বাস করে যে, মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীসমূহ সময়ের ব্যবধানে বিবর্তিত হয়ে  বর্তমান রূপ ধারণ করেছে। মাত্র চারটি দেশে এর বিপরীত ধারণা পোষণকারীদের সংখ্যা  বেশী। আফগানিস্তান, তাজিকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া ও ইরাক)। এমনকি বাংলাদেশে শতকরা ৫৪  ভাগ মানুষ বিবর্তনবাদে বিশ্বাসী বলে জরীপে উঠে এসেছে। এটা সত্যিই উদ্বেগজনক।                                   

            ১৩. নিজ দেশের চলমান আইন  সম্পর্কে ধারণা :

            অধিকাংশ মুসলমানই মনে  করেন যে, তাদের দেশ ইসলামী আইন অনুসরণ করে না। দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের দেশ বসনিয়ায়  ৬৮ ভাগ, রাশিয়ায় ৬১ ভাগ এবং কসোভোয় ৫৯ ভাগ মানুষ তাদের দেশে ইসলামী আইনের অনুসরণ  করা হয় না বলে মন্তব্য করেন। মধ্যএশিয়ার পরিস্থিতিও প্রায় একই রকম। কাজাখস্তানে ৭২  ভাগ, আজারবাইজানে ৬৯ ভাগ এবং কিরগিজিস্তানে ৫৪ ভাগ মানুষ মনে করেন তাদের দেশে  ইসলামী আইনের প্রয়োগ নেই। তবে তাজিকিস্তানে ৫১ ভাগ মানুষ ধারণা করেন কিছুটা হ’লেও  তাদের দেশ ইসলামী আইন অনুসরণ করে। মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোতে চিত্র  কিছুটা ভিন্ন। যেমন ইরাকে ৫৬ ভাগ, মরক্কোতে ৫৪ ভাগ মানুষ তাদের দেশে ইসলামী আইনের  যথেষ্ট প্রয়োগ আছে মনে করলেও জর্ডানে ৫৭ ভাগ, তিউনিসিয়ায় ৫৬ ভাগ, ফিলিস্তীনে ৫৯  ভাগ, মিসরে ৫৬ ভাগ এবং লেবাননে ৭৯ ভাগ মানুষ বলেছেন তাদের দেশ ইসলামী আইন অনুসরণ  করছে না। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মালয়েশিয়াতে ৫৮ ভাগ এবং ইন্দোনেশিয়ায় ৫৪  ভাগ মানুষ তাদের দেশ মোটামুটিভাবে ইসলামী আইন মোতাবেক পরিচালিত হচ্ছে মন্তব্য  করলেও বাংলাদেশে ৪৯ ভাগ এবং পাকিস্তানে ৪৫ ভাগ মানুষ মনে করে তাদের দেশে ইসলামী  আইন নেই। শুধুমাত্র আফগানিস্তানের তুলনামূলক ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে। সেখানে ৮৮ ভাগ  মানুষ মনে করে তাদের দেশ ইসলামী আইন মোতাবেক পরিচালিত।

            ১৪. বিচারব্যবস্থায় শরী‘আহ  আইনের অনুসরণ :

            অধিকাংশ দেশের  মুসলমানরাই তাদের দেশে শরী‘আহ আইন না থাকা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। বিশেষতঃ  দক্ষিণ এশিয়াতে এই অনুভূতির প্রকাশটা বেশী দেখা গেছে। যেমন পাকিস্তানে ৯১ ভাগ,  আফগানিস্তানে ৮৪ ভাগ এবং বাংলাদেশে ৮৩ ভাগ মানুষই এ ব্যাপারে তাদের ক্ষোভ ও  অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। অনুরূপভাবে মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকারও অধিকাংশ মানুষ  মনে করে তাদের দেশে শরী‘আহ আইনের অনুসরণ না থাকাটা খুব খারাপ একটা দিক। ফিলিস্তীনে  ৮৩ ভাগ, মরক্কোতে ৭৬ ভাগ, ইরাকে ৭১ ভাগ, জর্ডানে ৬৯ ভাগ, মিসরে ৬৭ ভাগ, তিউনিসিয়ায়  ৫৪ ভাগ এবং লেবাননে ৩৮ ভাগ মানুষ এ ব্যাপারে অসন্তুষ্ট। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার  মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ায় ৬৫ ভাগ মানুষ এ ব্যাপারে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।  তবে মধ্যএশিয়ার অধিকাংশ মানুষ এ ব্যাপারে ভাল-মন্দ কোন মতামত ব্যক্ত করেননি। কেবল  কিরগিজিস্তান (৪৭%) এবং তাজিকিস্তানে (৩২%) উল্লেখযোগ্য সংখ্যকের মতে শরী‘আহ আইন  অনুসরণ না করাটা মন্দ ব্যাপার। অনুরূপই অবস্থা উত্তর-পূর্ব ইউরোপেরও। এমনকি  দুঃখজনকভাবে বসনিয়া-হার্জেগোভিনা এবং কসোভোয় ৫০ ভাগ মুসলমানই মনে করেন শরী‘আহ আইন  না থাকাতে বরং ভালই হয়েছে। খানিকটা ব্যতিক্রম রাশিয়ার মুসলমানরা। তাদের ৪২ ভাগ কোন  মতামত প্রকাশ না করলেও ৪৭ ভাগ আবার মনে করেন শরী‘আহ আইন না থাকাটা ভালো তো নয়ই,  বরং মন্দের কারণ হয়েছে।

            ১৫. গণতন্ত্র :      

            গণতন্ত্রের প্রশ্নে  অবশ্য ৩৭টি মুসলিম দেশের মধ্যে ৩১টিতেই অন্ততঃ অর্ধেক মানুষ ইতিবাচক অবস্থান গ্রহণ  করেছে। এ সংখ্যাটা আবার সাব-সাহারান আফ্রিকা অঞ্চলেই বেশী। এ অঞ্চলের দুই-তৃতীয়াংশ  মানুষই গণতন্ত্রের সমর্থক। যেমন ঘানায় ৮৭ ভাগ, জিবুতি, কেনিয়া ও সেনেগালে ৭৯ ভাগ  এবং চাদে ৭৭ ভাগ মানুষ একজন শক্তিশালী একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রধানের চেয়ে  গণতান্ত্রিক সরকারকেই বেশী গ্রহণযোগ্য মনে করেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতেও গণতন্ত্রের  সমর্থন বেশ উল্লেখযোগ্য। মালয়েশিয়ায় ৬৭ ভাগ, থাইল্যান্ডে ৬৪ ভাগ এবং ইন্দোনেশিয়ায়  ৬১ ভাগ মানুষ গণতন্ত্রকামী। অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়ার পরস্থিতি যথেষ্ট ভিন্ন।  পাকিস্তানে ৫৬ ভাগ এবং আফগানিস্তানে ৫১ ভাগ মানুষ গণতান্ত্রিক সরকারের পরিবর্তে  শক্তিশালী একনায়কতন্ত্রকেই বেশী পসন্দ করেন। কেবল বাংলাদেশই সেক্ষেত্রে ব্যতিক্রম।  এখানকার প্রায় ৭০% মানুষ গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার সমর্থক। মধ্যপ্রাচ্যেও  গণতন্ত্রের প্রাধান্য যথেষ্ট লক্ষণীয়। লেবাননে ৭১%, তিউনিসিয়ায় ৭৫%, মিসর ও  ফিলিস্তীনে ৫৫% এবং ইরাকে ৫৪% মানুষ গণতন্ত্রে আস্থাশীল। মধ্যএশিয়ায় তাজিকিস্তানে  ৭৬%, তুরস্কে ৬৭% মানুষ গণতন্ত্র সমর্থন করলেও গণতন্ত্রবিরোধীদের সংখ্যাও নিতান্ত  কম নয়। এমনকি কিরগিজিস্তানে ৬৪ ভাগ মানুষই গণতন্ত্রের পরিবর্তে একনায়কতন্ত্রের  সমর্থক। অনুরূপভাবে উত্তর-পূর্ব ইউরোপের রাশিয়া এবং বসনিয়াতেও বেশীর ভাগ মুসলমান  গণতন্ত্রের পরিবর্তে একনায়কতন্ত্রকামী।    

            ১৬. রাজনীতিতে ধর্মীয় নেতাদের প্রভাব :

            গণতন্ত্রের প্রতি  অধিকাংশ মুসলিম দেশে সমর্থন দেখা গেলেও ধারার বিপরীতে মতামতদাতাদের অধিকাংশই মনে  করেন রাজনীতিতে ধর্মীয় নেতাদের প্রভাব কমবেশী থাকা উচিত। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার  মালয়েশিয়াতে ৮২ ভাগ এই মত পোষণ করেন। যাদের মধ্যে ৪১ ভাগই মনে করেন এই প্রভাবটা  খুব জোরালোভাবেই থাকা উচিত। অনুরূপভাবে ইন্দোনেশিয়াতেও ৭৫ ভাগ মানুষ তা-ই মনে  করেন। দক্ষিণ এশিয়ার আফগানিস্তানে ৮২ ভাগ এবং বাংলাদেশে ৬৯ ভাগ মানুষ রাজনীতিতে  ধর্মীয় নেতাদের প্রভাবকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করলেও বিস্ময়করভাবে পাকিস্তানে এই  সংখ্যাটা মাত্র ৫৪%। যার মধ্যে ২৭ ভাগই আবার মনে করেন এই প্রভাব কম থাকাই বরং ভাল।  মধ্যপ্রাচ্যেও ধর্মীয় নেতাদের প্রতি যথেষ্ট আস্থা দেখা গেছে। জর্ডানে ৮০ ভাগ,  মিসরে ৭৫ ভাগ, ফিলিস্তীনে ৭২ ভাগ, তিউনিসিয়ায় ৫৮ ভাগ এবং ইরাকে ৫৭ ভাগ মানুষ  ধর্মীয় নেতাদের রাজনৈতিক ভূমিকা কামনা করেন। তবে যথারীতি মধ্যএশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব  ইউরোপে এই প্রবণতা কম। কেবল রাশিয়ায় (৫৮%) এবং কিরগিজিস্তানে (৪৬%) এর প্রতি  সমর্থন জানিয়েছেন। তুরস্কে এই সংখ্যাটা ৩৬%। 

            এছাড়া উক্ত সমীক্ষায় আরো অনেক বিষয় এসেছে, তবে গুরুত্ব  বিবেচনায় এ কয়টিই উল্লেখ করা হ’ল। উপরোক্ত ফলাফল থেকে সাধারণভাবে যে চিত্রটি ফুটে  উঠেছে তা থেকে এতটুকু স্পষ্টভাবেই প্রতীয়মান হয় যে, মুসলিম সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার  এই চূড়ান্ত অধঃপতনের যুগেও বিশ্বের অধিকাংশ মুসলমানের অন্তরে ঈমানের প্রভাব রয়েছে।  সাম্প্রতিক অতীতে এবং বর্তমান যুগে নিয়মিতভাবে ইসলাম বিরোধী নানা মতবাদ-মতাদর্শের  আবির্ভাব ঘটা এবং কাফির-মুশরিক শক্তি কর্তৃক মুসলমানদেরকে ইসলাম থেকে দূরে সরানোর  নানা কলা-কৌশল অবলম্বন করা সত্ত্বেও যে ইসলামকে মানুষের হৃদয় থেকে মুছে ফেলা যায়নি।  এটা বেশ আশান্বিত হওয়ার মত ব্যাপার।

            এটা সত্য যে, মুসলিম সমাজে আজ এমন হাযারো কর্মকান্ডের ভুরি  ভুরি নযীর বিদ্যমান, যা বিশুদ্ধ আক্বীদা-আমলের মানদন্ডে একেবারেই অগ্রহণযোগ্য এবং  ঈমানবিধ্বংসী। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের বিশ্বাসের গভীরতম প্রদেশে দ্বীনের প্রতি  ভালবাসার স্থানটা এখনও পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ রয়ে গেছে। আর সেটারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এই  জরীপে। সেজন্য রিপোর্টটি বের হওয়ার পর অধিকাংশ সেক্যুলার মিডিয়ায় গভীর হতাশা  ব্যক্ত করা হয়েছে। বিশেষ করে বেশীর ভাগ মুসলমান রাষ্ট্রব্যবস্থায় ইসলামী শরী‘আহ  আইন এবং বিচারিক আদালতে ব্যভিচারী ও মুরতাদের শাস্তি হিসাবে মৃত্যুদন্ডকে সমর্থন  করাটা তাদের জন্য ব্যাপক উদ্বেগের কারণ হয়েছে। বলা বাহুল্য, সাময়িক একটি জরীপের  ফলাফল কোন বিষয়ে চূড়ান্ত ধারণা দেয় না। তবুও এটুকু নিশ্চয় করে বলা যেতে পারে যে,  জরীপে প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক মৌলিক ইসলামী আইন-বিধানের প্রতি আমভাবে মুসলিম সমাজের  বৃহত্তর অংশের সমর্থনটা খুব ইতিবাচক একটি বিষয়। বিশেষতঃ ইসলামী আদর্শ ও  আইন-বিধানকে যারা সমাজ ও রাষ্ট্রীয় অঙ্গনে প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করছেন, তাদের  জন্য অনুপ্রেরণাদায়ক। এই মুহূর্তে ইসলামী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের জন্য উপরোক্ত  বিষয়গুলিকে সামনে রেখে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আগামীর পরিকল্পনা সাজিয়ে নেয়া প্রয়োজন।  প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট একটি কর্মপরিকল্পনাকে সামনে রেখে সালাফে ছালেহীনের মানহাজ  অনুসরণে বিশুদ্ধ দ্বীনের দাওয়াতকে সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়া। প্রয়োজন শিক্ষা,  মিডিয়া, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি প্রভাবশালী প্রাইভেট সেক্টরগুলিতে দাওয়াতের ভিত্তিকে  আরো মযবূত করা। প্রয়োজন সমাজ ও রাষ্ট্রনেতাদেরকে দ্বীনের বিশুদ্ধ দাওয়াতের সরাসরি  আওতায় নিয়ে আসার জন্য অধিকতর প্রচেষ্টা গ্রহণ করা। সর্বোপরি একতাবদ্ধ হয়ে ইখলাছের  সাথে প্রত্যেকেই যদি আমরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে দ্বীনের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ  স্বীকারে প্রস্ত্তত হই, তবে সেদিন খুব বেশী দূরে নয়, যেদিন আল্লাহর যমীনে আল্লাহর  দ্বীন প্রতিষ্ঠা লাভের পথ সুগম হয়ে উঠবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদের সেই তাওফীক দান  করুন- আমীন!

           



               


               

                  * এমএস  (হাদীছ), উছূলুদ্দীন বিভাগ, ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি, ইসলামাবাদ,  পাকিস্তান।

                  [1]. The  Worlds Muslims : Religion, Politics and Society (Pew Research Center, Washington DC,  2013, 226 pages), Published on April 30, 2013.

               

           

image

মন্তব্য করুন

Back to top button