অবৈধ, সন্ত্রাসী রাষ্ট্র “ইসরাইল” এর ইতিহাস
ইতিহাস:
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুর্কি অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর প্যালেস্টাইন বা ফিলিস্তিন সহ বেশিরভাগ আরব এলাকা চলে যায় ইংল্যান্ড- ফ্রান্সের ম্যান্ডেটে। ১৯১৭ সালের দোসরা নভেম্বর বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার জেমস বালফোর ইহুদীবাদীদেরকে লেখা এক পত্রে ফিলিস্তিনী ভূখন্ডে একটি ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেন। বেলফোর ঘোষণার মাধমে প্যালেস্টাইন এলাকায় ইহুদিদের আলাদা রাষ্ট্রের সম্ভাবনা উজ্জল হয় এবং বিপুলসংখ্যক ইহুদি ইউরোপ থেকে প্যালেস্টাইনে এসে বসতি স্থাপন করতে থাকে।
১৯০৫ থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিনে ইহুদীদের সংখ্যা ছিল মাত্র কয়েক হাজার। কিন্তু ১৯১৪ সাল থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত বৃটিশদের সহযোগিতায় ফিলিস্তিনে ইহুদীদের সংখ্যা ২০ হাজারে উন্নীত হয়। এরপর প্রকাশ্যে ফিলিস্তিনে ইহুদী অভিবাসীদের ধরে এনে জড়ো করা শুরু হলে ১৯১৯ থেকে ১৯২৩ সাল নাগাদ ফিলিস্তিনে ইহুদীদের সংখ্যা ৩৫ হাজারে পৌঁছে যায়। ১৯৩১ সালে ইহুদীদের এই সংখ্যা প্রায় ৫ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ১ লাখ ৮০ হাজারে পৌঁছায়। এভাবে ফিলিস্তিনে ইহুদী অভিবাসীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তে থাকে এবং ১৯৪৮ সালে সেখানে ইহুদীদের সংখ্যা ৬ লাখে উন্নীত হয়।
১৯১৮ সালে বৃটেনের সহযোগিতায় গুপ্ত ইহুদী বাহিনী “হাগানাহ” গঠিত হয়। এ বাহিনী ইহুদীবাদীদের অবৈধ রাষ্ট্র তৈরির কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রথমে ফিলিস্তিনী জনগণের বিরুদ্ধে ইহুদীবাদীদের সহায়তা করা হাগানাহ বাহিনীর দায়িত্ব হলেও পরবর্তীকালে তারা সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসী বাহিনীতে পরিণত হয়। ফিলিস্তিনী জনগণের বাড়িঘর ও ক্ষেতখামার দখল করে তাদেরকে ফিলিস্তিন থেকে বিতাড়িত করা এবং বাজার ও রাস্তাঘাটসহ জনসমাবেশ স্থলে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ফিলিস্তিনীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে তাদের বিতাড়নের কাজ ত্বরান্বিত করা ছিল হাগানাহ বাহিনীর কাজ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিনী ভূখন্ডকে দ্বিখন্ডিত করা সংক্রান্ত ১৮১ নম্বর প্রস্তাব গৃহীত হয়। জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে দ্বিখন্ডিত করার প্রস্তাব পাশ করে নিজেদের মাতৃভূমির মাত্র ৪৫ শতাংশ ফিলিস্তিনীদের এবং বাকি ৫৫ শতাংশ ভূমি ইহুদীবাদীদের হাতে ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এভাবে ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইসরায়েল স্বাধীনতা ঘোষণা করে।
আর বর্তমানে সে আমেরিকার মদদে একের পর এক অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যায়নাবাদীরা তা দেখেও না দেখার ভান করছে। ধিক বিশ্ব সম্প্রদায় ধিক।
ইসরাইলের পারমানবিক অবস্থা:
ষাটের দশকে দেশটি পারমাণবিক বোমার অধিকারী হয়। সে বছর মিসরসহ আরব দেশগুলোর সঙ্গে ইসরাইলের সর্বাত্মক যুদ্ধ বেধে যায়। যুদ্ধের শুরুতেই ইসরাইলের নেগেভ মরুভূমিতে পারমাণবিক প্রকল্প গুঁড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা ছিল মিসরীয় বাহিনীর। কিন্তু প্রেসিডেন্ট কর্নেল জামাল আবদুন নাসের পরিকল্পনাটি বাতিল করে দেন। ভেবেছিলেন, ইসরাইল তখনো পারমাণবিক বোমা বানাতে পারে নি। তাই নেগেভ মরুভূমিতে দিমোনা প্রকল্প গুঁড়িয়ে দেয়া হবে অর্থহীন। কিন্তু তিনি জানতেন না যে, ইতোমধ্যেই ইসরাইল দু’টি পারমাণবিক বোমা বানিয়ে ফেলেছে এবং বোমা দু’টি নিক্ষেপের জন্য প্রস্তুতও করে রেখেছে।
১৯৭৩ সালে তৃতীয় আরব-ইসরাইল যুদ্ধেও মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো বিজয়ী হতে পারে নি। এ যুদ্ধেও ইসরাইলের বিজয়ের মূলে ছিল দেশটির পারমাণবিক অস্ত্র। যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য ইসরাইল ১৩টি পারমাণবিক অস্ত্র প্রস্তুত করে রেখেছিল। প্রতিটি বোমার ক্ষমতা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের হিরোশিমায় নিক্ষিপ্ত আণবিক বোমার সমান। যুদ্ধে মিসরীয় বাহিনী সিনাই এবং সিরীয় বাহিনী গোলান রণাঙ্গনে ইসরাইলি প্রতিরক্ষা ব্যুহ বারলেভ লাইন তছনছ করে দিয়ে বন্যার মতো ধেয়ে আসতে থাকলে প্রধানমন্ত্রী মিসেস গোল্ডামায়ার পারমাণবিক বোমা ব্যবহারের অনুমোদন দেন।
জন্ম থেকেই পরমাণু খায়েস:
জন্মের পর থেকেই ইসরাইলি নেতৃবৃন্দ উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, বৈরি আরব শক্তি পরিবেষ্টিত অবস্থায় পারমাণবিক অস্ত্রই হচ্ছে রাষ্ট্র হিসাবে ইসরাইলের টিকে থাকার গ্যারান্টি। ১৯৪৮সালে ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই দেশটি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির প্রচেষ্টায় জড়িত হয়ে পড়ে। ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে বহু মেধাবী ইহুদি বিজ্ঞানী ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে অভিবাসী হিসাবে বসতি স্থাপন করেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন আর্নেস্ট ডেভিড বার্গম্যান। তিনিই হলেন ইসরাইলের পারমাণবিক বোমার জনক। ইসরাইলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন গুরিয়নের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও উপদেষ্টা বার্গম্যান পরামর্শ দেন যে, পারমাণবিক জ্বালানি হতে পারে ইসরাইলের অপ্রতুল প্রাকৃতিক সম্পদ এবং দুর্বল সামরিক শক্তির একটি বিকল্প। পারমাণবিক বোমা তৈরি করা ছিল এ পরিকল্পনার অংশ। ১৯৪৮ সালের গোড়ার দিকে ইসরাইলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ইহুদি বিজ্ঞানীরা ইউরেনিয়াম মজুদের জন্য নেগেভ মরুভূমি খুঁজে বের করেন। ১৯৫০ সাল নাগাদ তারা বিরশেবার কাছে ও সিডনে নিন্মমানের ইউরেনিয়াম মজুদ খুঁজে পান। ১৯৪৯ সাল নাগাদ বিজ্ঞান বিষয়ক ওয়াইজম্যান ইন্সটিটিউট সক্রিয়ভাবে পারমাণবিক গবেষণাকে সমর্থন করে। ইসরাইল সরকারের ব্যয়ে পারমাণবিক প্রকৌশল ও পদার্থ বিজ্ঞান অধ্যয়নের জন্য প্রতিশ্রুতিশীল ইসরাইলি ছাত্ররা বিদেশে গমন করে। ১৯৫২ সালে ইসরাইল গোপনে আণবিক শক্তি কমিশন প্রতিষ্ঠা করে। আণবিক শক্তি কমিশন প্রতিষ্ঠার মধ্যদিয়েই ইসরাইলের পারমাণবিক কর্মসূচির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়।
অন্য দেশের অবদান
ফ্রান্সের অবদান:
১৯৪৯ সালে ফরাসি আণবিক শক্তি কমিশনের সদস্য ও বার্গম্যানের বন্ধু পরমাণু বিজ্ঞানী ফ্রান্সিস পেরিন ওয়াইজম্যান ইন্সটিটিউট পরিদর্শন করেন। তিনি ফ্রান্সের সাচলে’তে একটি নয়া পারমাণবিক গবেষণা স্থাপনায় ইসরাইলি বিজ্ঞানীদের যোগদানে আমন্ত্রণ জানান। পরবর্তীকালে দু’টি দেশে একটি যৌথ গবেষণা সংস্থা স্থাপন করা হয়। ১৯৮৬ সালে পেরিন প্রকাশ্যে স্বীকার করেন যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটন ও কানাডায় কর্মরত ফরাসি বিজ্ঞানীদের বলা হয়েছিল, গোপনীয়তা রক্ষা করতে পারলে তারা ফ্রান্সে তাদের জ্ঞান ব্যবহার করতে পারবেন। একই যুক্তিতে ফরাসি বিজ্ঞানী পেরিন ইসরাইলের কাছে পারমাণবিক উপাত্ত পাচার করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের লস আলামোস ন্যাশনাল গবেষণাগারে একজন ইসরাইলি বিজ্ঞানী কাজ করতেন এবং তিনিই প্রত্যক্ষভাবে স্বদেশে পারমাণবিক জ্ঞান পাচার করেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্রান্সের পারমাণবিক গবেষণা সামর্থ্য সীমিত হয়ে পড়ে। পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে ফ্রান্স ও ইসরাইল পারমাণবিক ক্ষেত্রে একে অপরকে ঘনিষ্ঠভাবে সহযোগিতা করেছে। ইসরাইলি বিজ্ঞানীরা ফ্রান্সের মারকিউলে’তে জি- প্লুটোনিয়াম উৎপাদন রিঅ্যাক্টর ও ইউপি-১ পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ প্রকল্প নির্মাণে সহায়তা করেছিলেন। হেভি ওয়াটার উৎপাদন ও লোগ্রেড ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ সংক্রান্ত দু’টি ইসরাইলি প্যাটেন্ট থেকে ফ্রান্স লাভবান হয়েছিল। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের গোড়ার দিকে ফ্রান্স ও ইসরাইলের মধ্যে বহুক্ষেত্রে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল।
ইসরাইলকে প্লুটোনিয়াম বিযুক্তকরণ প্রযুক্তিসহ ইএল-৩ টাইপের ১৮ মেগাওয়াট শক্তিসম্পন্ন একটি ফরাসি গবেষণা রিঅ্যাক্টর সরবরাহে দু’টি দেশের মধ্যে ১৯৫৭ সালের অক্টোবরে চুক্তি হয়। পরে এ রিঅ্যাক্টরের ক্ষমতা আনুষ্ঠানিকভাবে ২৪ মেগাওয়াটে উন্নীত করার ঘোষণা দেয়া হলেও প্রকৃতপক্ষে তার ক্ষমতা ছিল অনেক বেশি। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত এক রিপোর্টে প্রকাশ পায়, এ রিঅ্যাক্টরের ক্ষমতা ছিল ১২৫-১৫০ মেগাওয়াট। শুধু প্লুটোনিয়াম উৎপাদনের জন্য এ রিঅ্যাক্টরের ক্ষমতা এতটুকু বাড়ানো হয়েছিল। কিভাবে রিঅ্যাক্টরের ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছিল তা অজানাই থেকে যায়।
আমেরিকার সহযোগিতা:
১৯৬১ সালে দিমোনা রিঅ্যাক্টর নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের সম্পর্কে টানাপোড়েন দেখা দেয়। যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণে ইসরাইলের যুক্তি মেনে নেয়। তবে গোপনে চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখে। সুপরিচিত মার্কিন পদার্থবিজ্ঞানী ইউজেন ওয়াগনার ও আই আই রাভিকে নামমাত্র পরিদর্শনের অনুমতি দিলেও প্রধানমন্ত্রী বেন গুরিয়ন নিয়মিত আন্তর্জাতিক পরিদর্শনের অনুমতি দানে অব্যাহতভাবে অস্বীকৃতি জানাতে থাকেন। যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের কাছ থেকে এ স্বীকৃতি আদায় করে যে, সে শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে তার পারমাণবিক কর্মসূচি ব্যবহার করবে এবং বছরে দু’বার মার্কিন পরিদর্শকদের পরিদর্শনের অনুমতি দেবে। ১৯৬২ সালে এ পরিদর্শন শুরু হয় এবং ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। মার্কিন পরিদর্শকরা ইসরাইলের পারমাণবিক স্থাপনার শুধু বহিঃভাগই পরিদর্শন করেন। কিন্তু স্থাপনার ভূগর্ভস্থ অংশ পরিদর্শনের বাইরে থেকে যায়। ভূগর্ভের উপরিভাগে ভুয়া কন্ট্রোল রুম ছিল। কিন্তু ভূগর্ভে প্রবেশ করার পথগুলো পরিদর্শনকালে গোপন রাখা হতো। সিঁড়িগুলো ইটের আস্তরণ দিয়ে ঢেকে রাখা হতো। ইসরাইলি পারমাণবিক স্থাপনায় পরিদর্শনের তথ্যও গোপন রাখা হতো।
সুয়েজ সংকট:
১৯৫৬ সালের অক্টোবরে মিসরের বিরুদ্ধে সুয়েজ খাল-সিনাই অপারেশনের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে ফ্রান্স ও ইসরাইল একে অপরকে সহযোগিতা করেছে। ব্রিটেনও এ অপারেশনের সঙ্গে জড়িত ছিল। সুয়েজ সংকটই হচ্ছে ইসরাইলের পারমাণবিক বোমা তৈরির ভ্রূণ। ১৯৫৫ সালে চেকোশ্লোভাকিয়ার সঙ্গে মিসর অস্ত্র চুক্তি সম্পাদন করায় ইসরাইল উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে। এ চুক্তির ফলে মিসর সোভিয়েত ব্লকের তৈরি সমরাস্ত্রে তিনগুণ শক্তিশালী হয়ে যায়। প্রেসিডেন্ট নাসের ১৯৫৩ সালে তিরান প্রণালী বন্ধের নির্দেশ দেয়ার পর ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনগুরিয়ন রাসায়নিক ও পারমাণবিকসহ অন্যান্য অপ্রচলিত অস্ত্র তৈরির নির্দেশ দেন। সুয়েজ খাল অপারেশনের ছয় সপ্তাহ আগে পারমাণবিক রিঅ্যাক্টর নির্মাণে সহযোগিতার জন্য ইসরাইল ফ্রান্সের দ্বারস্থ হয়। ইসরাইলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক শিমন পেরেজ (বর্তমানে প্রেসিডেন্ট) ও বার্গম্যান ফরাসি আণবিক শক্তি কমিশনের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ১৯৫৬ সালের সেপ্টেম্বরে তারা একটি পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ রিঅ্যাক্টর স্থাপনে প্রাথমিক সমঝোতায় পৌঁছেন। দু’টি দেশ প্যারিসের বাইরে একটি গোপন বৈঠকে চূড়ান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করে। এ বৈঠকেই সুয়েজ খাল অপারেশনের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়।
১৯৫৬ সালের ২৯ অক্টোবর সুয়েজ খাল অপারেশন শুরু হয়। অপারেশন ফ্রান্স ও ব্রিটেনের জন্য পুরোপুরি বিপর্যয়ের হলেও ইসরাইলের জন্য ছিল একটি সামরিক বিজয়। ৪ নভেম্বরের মধ্যে ইসরাইল গোটা সিনাই উপদ্বীপ দখল করে নেয়। ৬ নভেম্বর সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের তীব্র চাপের মুখে যুদ্ধবিরতি হয়। সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী বুলগানিন ও প্রেসিডেন্ট ক্রুশ্চেভ হুমকি দেন যে, সিনাই থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করা না হলে ইসরাইলে পারমাণবিক হামলা চালানো হবে। সোভিয়েত হুমকিতে মর্মাহত হয় ফ্রান্স।
ইসরাইলের লুকোচুরি:
আজ পর্যন্ত যতগুলো দেশ পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হয়েছে তাদের প্রত্যেকেই পারমাণবিক পরীক্ষা চালিয়েছে। কিন্তু পারমাণবিক পরীক্ষা ছাড়া ইসরাইল পরমাণু শক্তিধর হলো কিভাবে? প্রাথমিক পর্যায়ে ফ্রান্স ও ইসরাইলের মধ্যে যে ধরনের পারমাণবিক সহযোগিতা ছিল তাতে পারমাণবিক ডিভাইস পরীক্ষা করার প্রয়োজন ছিল না। ফ্রান্স ও ইসরাইলের মধ্যকার সহযোগিতামূলক সম্পর্ক ছিল মূলত প্লুটোনিয়ামের উন্নয়ন। তবে এ বাস্তবতা সত্ত্বেও ইসরাইল বোমা নির্মাণোপযোগী প্রচুর ইউরেনিয়াম মজুদ করেছিল। ইউরেনিয়ামের সাহায্যে তৈরি পারমাণবিক বোমা পরীক্ষা করার প্রয়োজন নেই। একটি বিশ্বস্ত সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে একজন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, ১৯৬০ সালে ফ্রান্সের পরমাণু পরীক্ষার মাধ্যমে একটি নয়, দু’টি পারমাণবিক শক্তির জন্ম হয়েছিল। একটি ছিল ফ্রান্স নিজে এবং আরেকটি ইসরাইল। ফ্রান্সের পরমাণু পরীক্ষাকালে বেশ কয়েকজন ইসরাইলি পর্যবেক্ষক ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন।
ফ্রান্স একসময় ইসরাইলকে সহায়তা প্রদান বন্ধ করে দেয়। এরপর ইসরাইল নিজের পথ নিজেই দেখে। যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও চীন- এ পাঁচটি দেশের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ প্ল্যান্ট ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ার অ্যাপোলোতে ছিল ‘নিউক্লিয়ার মেটেরিয়ালস এন্ড ইকুয়িপমেন্ট কর্পোরেশন’ (নুমেক) নামে একটি ক্ষুদ্র জ্বালানি রড ফেব্রিকেশন প্ল্যান্ট। ১৯৬৫ সালে মার্কিন সরকার এ কর্পোরেশনের সভাপতি ড. জালম্যান শাপিরোকে অতি সমৃদ্ধ ২০০ পাউন্ড ইউরেনিয়াম খোয়া যাবার জন্য অভিযুক্ত করে। মার্কিন আণবিক শক্তি কমিশন, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ, ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) ও অন্যান্য সরকারি সংস্থা ঘটনাটি তদন্ত করে। কিন্তু তদন্তে কি পাওয়া গেলো তা কেউ প্রকাশ করেনি। অনেকেই বিশ্বাস করেন, ১৯৬৫ সালের কোনো এক সময় ইসরাইল এ ২০০ পাউন্ডের সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম লাভ করেছিল। কোনো কোনো সূত্র জানিয়েছে, মোসাদ এজেন্ট রাতি আইতান ও জোনাথন পোলার্ড এ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম ইসরাইলে পাচার করেছিলেন।
অপারেশন প্লামবাট:
১৯৬৭ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর ফ্রান্স ইসরাইলকে ইউরেনিয়াম সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। সাবেক ফরাসি ঔপনিবেশ গ্যাবন, নাইজার ও মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র থেকে এ ইউরেনিয়াম সরবরাহ পাঠানো হতো। নেগেভে ফসফেট খনি থেকে ইসরাইল সামান্য পরিমাণ ইউরেনিয়াম সংগ্রহ করেছিল। আর্জেন্টিনা ও দক্ষিণ আফ্রিকা থেকেও ইউরেনিয়াম সংগ্রহ করা হয়। একটি গোপন অভিযানের মাধ্যমে ইসরাইল ‘ইয়েলো কেক’ হিসাবে পরিচিত ইউরেনিয়াম অক্সাইড সংগ্রহ করেছিল। একটি জার্মান কোম্পানি এবং ভূমধ্যসাগরে একটির পর একটি জাহাজ পরিবর্তনের মাধ্যমে তারা ২শ’ টন ইয়েলো কেক সংগ্রহ করে। পাচারকারীরা ৫৬০ টন ওজনের তেলের ড্রামের গায়ে ‘প্লামবাট’ শব্দটি এঁটে দেয়। ‘প্লামবাট’ মানে সীসা। অর্থাৎ তেলের ড্রামে ‘সীসা’ বহন করা হচ্ছে। জার্মান সরকার ইসরাইলের কাছে ইউরেনিয়াম পাচারে সরাসরি জড়িত ছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আরবদের বিরাগভাজন হওয়ার ভয়ে দেশটি এ কথা কখনো প্রকাশ করেনি।
প্রেসিডেন্ট নাসেরের ভুল:
১৯৬৭ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধের আগে ও পরে মিসর সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে পারমাণবিক বোমা লাভে ব্যর্থ প্রয়াস চালায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন আশানুরূপ পারমাণবিক ছত্রচ্ছায়া না দেয়ায় প্রেসিডেন্ট নাসের ঘোষণা করেন, মিসর তার নিজস্ব পারমাণবিক কর্মসূচি গ্রহণ করবে। ১৯৬৫ ও ১৯৬৬ সালে নাসেরের বাগাড়ম্বর এবং দিমোনা প্ল্যান্টের উপর দিয়ে মিসরীয় বিমান উড্ডয়নে সৃষ্ট উত্তেজনার ফলে ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধ বেধে যায়। যুদ্ধের শুরুতে মিসরীয় বাহিনীর দিমোনা প্রকল্পে হামলার একটি পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু নাসের এ পরিকল্পনা বাতিল করে দেন। তার ধারণা ছিল যে, ইসরাইল ১৯৬৮ সালের আগে পারমাণবিক বোমা বানাতে সক্ষম হবে না। কিন্ত তার ধারণা ছিল ভুল। ইসরাইল দু’টি পারমাণবিক বোমা তৈরি করার ১০ দিন পর যুদ্ধে নামে। ভূখণ্ডগত দখল সংহত করার কোনো পরিকল্পনা যদি নাসেরের থেকে থাকতো তাহলে তিনি তা করতে পারতেন ইসরাইলের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র আসার আগে। ততক্ষণে নাসেরের দু’সপ্তাহ দেরি হয়ে গিয়েছিল।
ইসরাইলের পরমাণু ডকট্রিন:
পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করে ইসরাইল এ অস্ত্র ব্যবহারের একটি ডকট্রিন বা দিকনিদের্শনাও প্রণয়ন করে। এতে উল্লেখ করা হয়, আরবগণ ইসরাইলের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা দখল করে নিলে অথবা ইসরাইলের বিমান বাহিনী ধ্বংস করে দিলে কিংবা ইসরাইলি শহরগুলোতে ব্যাপকভাবে রাসায়নিক ও জীবাণু হামলা চালালে কিংবা আরবরা পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করলে ইসরাইল পাল্টা পারমাণবিক আঘাত হানবে। ১৯৭১ সালে ইসরাইল হাই-স্পিড ইলেক্ট্রোনিক টিউব ক্রাইটন ক্রয় শুরু করে। ১৯৮০ সালে রিচার্ড স্মিথ নামে একজন আমেরিকান ৮১০ ক্রাইটন ইসরাইলে পাচার করেন। পাচার করতে গিয়ে তিনি ধরা পড়ে যান। তার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগে তিনি উধাও হয়ে যান এবং তেলআবিবে গিয়ে উঠেন। ইসরাইল এ ঘটনার জন্য ক্ষমা চায় এবং জানায়, চিকিৎসা গবেষণায় এ ক্রাইটন ব্যবহার করা হবে। ইসরাইল ৪৬৯ ক্রাইটন ফেরত দেয়। কিন্তু বাদবাকি ক্রাইটন অপ্রচলিত অস্ত্র পরীক্ষায় ব্যবহার করা হয়। ১৯৭২ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে জেরিকো-২ ক্ষেপণাস্ত্রের উপাদানও চুরি করা হয়। ইসরাইলের জেরিকো ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণ হচ্ছে তার পারমাণবিক সামর্থ্যের প্রমাণ। কারণ জেরিকো ক্ষেপণাস্ত্র থেকে প্রচলিত যুদ্ধাস্ত্র নিক্ষেপ করা সম্ভব নয়।
পরমাণু বোমা নিক্ষেপের সিদ্ধান্ত:
১৯৭৩ সালের ৬ অক্টোবর মিসর ও সিরিয়া একযোগে ইসরাইলে হামলা চালায়। এ আকস্মিক হামলার মুখে ইসরাইলের নিয়মিত সৈন্যরাই ছিল শুধু ডিউটিতে। রিজার্ভ সৈন্যরা না থাকায় ইসরাইলের প্রতিরক্ষা লাইন ভেঙ্গে পড়ে। ৭ অক্টোবর সকাল নাগাদ গোলান মালভূমিতে ইসরাইলের কোনো কার্যকর প্রতিরোধ ছিল না। সিরীয় সৈন্যরা গোলান উপত্যকার প্রান্তসীমায় পৌঁছে যায়। এ সংকট ইসরাইলকে দ্বিতীয়বার পারমাণবিক সতর্কতার দিকে ঠেলে দেয়। আরবদের অগ্রাভিযানের মুখে ইসরাইলী প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল মোশে দায়ান ইসরাইল রাষ্ট্রের আসন্ন পতনের প্রতি ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী গোল্ডামায়ারকে সতর্ক করে দেন যে,’থার্ড টেম্পল’ অর্থাৎ ইসরাইল রাষ্ট্র ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ইসরাইলিরা তাদের রাষ্ট্রকে যেমন টেম্পল বলে আখ্যয়িত করে তেমনি তাদের পারমাণবিক বোমার সাংকেতিক নামও ‘টেম্পল’। ৮ অক্টোবর রাতে প্রধানমন্ত্রী গোল্ডামায়ার ও তার মন্ত্রিসভা পারমাণবিক বোমা ব্যবহারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ইসরাইল ২০ কিলোটন ক্ষমতাসম্পন্ন ১৩টি পারমাণবিক বোমা সংযোজন করে। কোনো কোনো সূত্র বলছে, ইসরাইল যেসব বোমা প্রস্তুত করেছিল সেগুলো ছিল সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম বোমা। সিরীয় ও মিসরীয় লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার জন্য ফ্যান্টম বোমারু বিমানে পারমাণবিক বোমা তোলা হয় এবং জেরিকো ক্ষেপণাস্ত্র পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত করা হয়।
৯ অক্টোবর সকালে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারকে ইসরাইলের পারমাণবিক হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত সম্পর্কে অবহিত করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র বিমানযোগে দ্রুত ইসরাইলে সামরিক সহায়তা প্রেরণের সিদ্ধান্ত নেয়। একইদিন ইসরাইলি বিমানগুলো সামরিক সহায়তা নিয়ে ওয়াশিংটন থেকে যাত্রা করে। ৯ অক্টোবর ইসরাইলের রিজার্ভ সৈন্যরা অগ্রবর্তী অবস্থানে ছুটে গেলে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। ১১ অক্টোবর গোলানে ইসরাইলের পাল্টা হামলায় সিরীয় অগ্রযাত্রা থেমে যায়। ১৫ ও ১৬ অক্টোবর ইসরাইলি সৈন্যরা সুয়েজখাল অতিক্রম করে সিনাইয়ে প্রবেশ করে এবং মিসরের থার্ড আর্মিকে ঘেরাও করে ফেলে। এ সময় পশ্চাৎভাগ অরক্ষিত হয়ে পড়ায় ইসরাইলি সৈন্যরা সুয়েজ খালের পূর্ব তীরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার মুখোমুখী হয়। ১৪ অক্টোবর প্রথম মার্কিন বিমান সাহায্য নিয়ে এসে হাজির হয়। আমেরিকার তৈরি ট্যাংক বিধ্বংসী টিওডব্লিউ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের প্রশিক্ষণ গ্রহণে ইসরাইলি কমান্ডোরা যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়ার ফোর্ট বেনিংয়ে ছুটে যায়। গোলানে চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য এসব ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে তারা মার্কিন সি-১৩০ হারকিউলিস বিমানে ফিরে আসে। মার্কিন কমান্ডাররা তদানীন্তন পশ্চিম জার্মানির ঘাঁটিতে মজুদ ক্ষেপণাস্ত্র ভাণ্ডার নিঃশেষ করে ইসরাইলে পাঠান। মার্কিন সামরিক সহায়তা প্রদানের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তদানীন্তন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিসিঞ্জার মিসরীয় প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সা’দাতকে বলেছিলেন, ইসরাইল পারমাণবিক হামলা শুরু করার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। তাই তাকে পারমাণবিক হামলা থেকে বিরত রাখার জন্য প্রচলিত সামরিক সহায়তা দেয়া হয়।
সোভিয়েত হুমকি:
আরব-ইসরাইল যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা ছিল খুবই অস্পষ্ট। ১৮ অথবা ২৩ অক্টোবর একটি সোভিয়েত যুদ্ধজাহাজ মিসরের আলেকজান্দিয়া বন্দরে এসে নোঙ্গর ফেলে। নভেম্বরের শেষ নাগাদ জাহাজটি এ বন্দরে অবস্থান করে। কিন্তু কোনো সমরাস্ত্র খালাস করা হয় নি। সন্দেহ নেই, আরবদের প্রতি সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিশ্রুতি রক্ষার স্বার্থে এবং ইসরাইলের পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকিকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়ার জন্যই এ জাহাজ এসেছিল। ২৪ অক্টোবর সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক লিউনিদ ব্রেঝনেভ সুয়েজ খালের পূর্ব তীরে বিচ্ছিন্ন মিসরীয় সৈন্যদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য সোভিয়েত ছত্রী সেনা পাঠানোর হুমকি দেন এবং সাতটি সোভিয়েত ছত্রী ডিভিশনকে সতর্কতাবস্থায় থাকার নির্দেশ দেন। পরে প্রমাণ পাওয়া গেছে, সোভিয়েত ইউনিয়ন পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র সজ্জিত সাবমেরিনও পাঠিয়েছিল। মিসরে সোভিয়েত পারমাণবিক উপস্থিতির জবাবে পরের দিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন বিশ্বব্যাপী মার্কিন স্থাপনায় পারমাণবিক সতর্কতা ঘোষণা করেন। একই সঙ্গে ইসরাইলে তৃতীয়বারের মতো পারমাণবিক সতর্কতা ঘোষণা করা হয়। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী গোল্ডামায়ার যুদ্ধবিরতিতে রাজি হলে এ সংকট কেটে যায়।
ইসরাইলের পরমাণু পরীক্ষা:
একটি প্রশ্ন জাগা খুবই স্বাভাবিক যে, ইসরাইল পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করে থাকলে বিস্ফোরণ ঘটালো না কেন? কয়েকভাবে এ প্রশ্নের জবাব দেয়া যায়। প্রথমত, পুরনো পদ্ধতিতে সংযোজিত পারমাণবিক বোমা পরীক্ষা করার প্রয়োজন হয় না। গবেষকগণ পরমাণু অস্ত্রের উপকরণগুলো আলাদা আলাদাভাবে পরীক্ষা করতে পারেন এবং ব্যাপকভাবে কম্পিউটারেও এ পরীক্ষা করা যায়। ১৯৬০ সালে ফ্রান্স যে পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল ইসরাইল তা থেকে পর্যাপ্ত তথ্য পেয়েছিল। তাছাড়া, পঞ্চাশ ও ষাট দশকে যুক্তরাষ্ট্র যেসব পরমাণু পরীক্ষা চালিয়েছিল, সেগুলো থেকেও ইসরাইলের তথ্য পাওয়ার সুযোগ ছিল অবারিত। শুধু তাই নয়, ভূগর্ভে পারমাণবিক পরীক্ষা চালালেও তা শনাক্ত করা কঠিন। সাবেক পশ্চিম জার্মানির আর্মি ম্যাগাজিন ‘ওয়ারটেকনিক’ ১৯৭৬ সালে এক রিপোর্টে জানিয়েছিল, ১৯৬৩ সালে নেগেভে ইসরাইল পরমাণু পরীক্ষা চালায়। অন্যান্য সূত্র জানায়, ১৯৬৬ সালে নেগেভের আল-নকিব-এ ইসরাইল পরমাণু পরীক্ষা চালিয়েছে। মার্কিন উপগ্রহে ১৯৭৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ভারত মহাসাগরে একটি উজ্জ্বল আভা ধরা পড়ে। ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয়, এ আভা ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইসরাইলের যৌথ পারমাণবিক বিস্ফোরণের দৃশ্য। মার্কিন উপগ্রহে যে দৃশ্যটি ধরা পড়ে তা ছিল তৃতীয় পরমাণু বিস্ফোরণের। তবে প্রথম দু’টি বিস্ফোরণের দৃশ্য ধরা পড়ে নি। কারণ তখন আকাশ ছিল মেঘা”ছন্ন। দুর্ঘটনাক্রমে তৃতীয় বিস্ফোরণের দৃশ্যটি ধরা পড়ে যায়। কারণ তখন আকাশ ছিল মেঘমুক্ত। ১৯৯৮ সালের জুনে ইসরাইলি পার্লামেন্ট নেসেটের একজন সদস্য সে বছরের ২৮ মে আইলাতের কাছে ভূগর্ভে পরমাণু বিস্ফোরণের জন্য সরকারকে অভিযুক্ত করেন। মিসরও একই ধরনের অভিযোগ করেছিল।
ইরাকী পরমাণু স্থাপনায় হামলা:
ইসরাইল শুধু আমেরিকার পরমাণু বোমা তৈরির উপাত্ত সংগ্রহেই আগ্রহী ছিল তা নয়, তারা আমেরিকার গোয়েন্দা তথ্য লাভেও ছিল তৎপর। ইসরাইলিরা দেখতে পায়, তারা সোভিয়েত ইউনিয়নেরও টার্গেট। আমেরিকান বংশোদ্ভূত ইসরাইলি গোয়েন্দা জোনাথন পোলার্ড মার্কিন উপগ্রহে তোলা সোভিয়েত ইউনিয়নের উপাত্ত সংগ্রহ করেন। এ উপাত্ত পেয়ে ইসরাইল সোভিয়েত শহরগুলোকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করে। এ থেকে এটাই বুঝা যায়, সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রতিশোধমূলক হামলা চালানোর ইচ্ছাও ইসরাইল পোষণ করতো। ইসরাইল ১৯৮১ সালের ৭ জুন ইরাকের ওসিরাকে তামুজ-১ রিঅ্যাক্টরে ঝটিকা হামলা চালায়। এ হামলায় ইসরাইল মার্কিন উপগ্রহে তোলা ছবি ব্যবহার করে। ইরাকের ওসিরাক প্ল্যান্টে হামলায় ৮টি এফ-১৬ ও ৬টি এফ-১৫ অংশগ্রহণ করে। দুই হাজার পাউন্ডের ১৫টি বোমা নিক্ষেপ করা হয়। ষোড়শ বোমাটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে নিকটবর্তী একটি হলে গিয়ে পড়ে। পৃথিবীতে এটাই ছিল কোনো রিঅ্যাক্টরের উপর বহিঃশক্তির প্রথম হামলা।
ইসরাইল পরমাণু অস্ত্রের জোরে আরবদের বিরুদ্ধে অন্তত দু’টি যুদ্ধে জয়লাভ করেছে, ইরাকের পরমাণু স্থাপনা উড়িয়ে দিয়েছে। তার পরমাণু খায়েশের উপায় ও উপকরণ যুগিয়েছে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রবক্তা আমেরিকা, ফ্রান্স, নরওয়ে, বর্ণবাদী দক্ষিণ আফ্রিকা, জার্মানি প্রভৃতি দেশ যারা নিজের বেলায় ষোল আনা আর পরের বেলায় “আহা আহা মানবতা, গনতন্ত্র” বলে গলা ফাটায়। এসব দেশের সহায়তায় ক্ষুদ্র সন্ত্রাসী দেশ ইসরাইল পরাক্রমশালী পরমাণু শক্তির অধিকারী।
যদি অন্যান্য দেশের পরমাণু অস্ত্র রাখা মানবতা বিরোধী কর্মকাণ্ড হয়, তাহলে আমেরিকা, ফ্রান্স, রাশিয়া, জার্মানি, ভারত, পাকিস্তান পরমাণু অস্ত্র মজুদ রাখে কোন যুক্তিতে বা কোন মানবতার উপকারে?
(তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, ইন্টারনেট)