খেলাধুলা ও শরীরচর্চায় ইসলামী মূলনীতি
ইসলাম ফিতরাত তথা প্রকৃতির ধর্ম। ইসলাম প্রকৃতিবান্ধব; প্রকৃতির অনুকূল সব কিছুই সমর্থন করে, যাবৎ না তা মানুষের ইহ বা পরকালীন ক্ষতির কারণ হয়। শরীরচর্চায় শরীরের উপকার আছে বলে ইসলাম বরাবরই একে উৎসাহিত করে। অলস অকর্মণ্য স্থানুদের ইসলাম পছন্দ করে না। খোদ মানুষের স্রষ্টা আল্লাহ তা‘আলা পছন্দ করেন কর্মচঞ্চল, সজীব, প্রাণবন্ত বলিষ্ঠ ঈমানদারকে। দেখুন কুরআনেই এর প্রমাণ রয়েছে।
মূসা আলাইহিস সালামের ঘটনা আমরা জানি। তিনি ফেরাউনের কবল ছেড়ে শু‘আইব আলাইহিস সালামের এলাকায় গেলেন। তাঁর দুই মেয়েকে পশুদের পানি পান করাতে সহযোগিতা করলেন। মেয়ে দুটি নবী মূসা আলাইহিস সালামের নৈতিক সততা ও শারীরিক শক্তিমত্তা উভয়ই খেয়াল করেছেন। আল্লাহর নবীর বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমতী কন্যা হিসেবে তাই বাবার কাছে এসে তাদের একজন পিতাকে প্রস্তাব দিলেন- আল্লাহর ভাষায় :
‘নারীদ্বয়ের একজন বলল, ‘হে আমার পিতা, আপনি তাকে মজুর নিযুক্ত করুন। নিশ্চয় আপনি যাদেরকে মজুর নিযুক্ত করবেন তাদের মধ্যে সে উত্তম, যে শক্তিশালী বিশ্বস্ত।’ {সূরা আল-কাসাস, আয়াত : ২৬}
মূসা আলাইহিস সালামের শারীরিক শক্তি ও কর্মক্ষমতার প্রশংসার এ শব্দগুলো আল্লাহ তা‘আলাই তাঁর বাণীতে তুলে ধরেছেন। তেমনি আল্লাহর নবীর কণ্ঠেও আমরা এর সমর্থন খুঁজে পাই। আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
‘শক্তিশালী মুমিন আল্লাহর কাছে উত্তম ও অধিক প্রিয় দুর্বল মুমিনের চেয়ে।’ [মুসলিম : ৬৯৭৫]
তাই সাধারণভাবে ইসলামে শরীরচর্চা একটি বৈধ ও উত্তম কাজ। এর দ্বারা বেশ কিছু মহৎ লক্ষ্য অর্জিত হয়। যেমন শরীরচর্চার মাধ্যমে ইসলামের জন্য জীবনবাজি রেখে জিহাদের প্রশিক্ষণের কাজ হয়, দেহে প্রফুল্লতার সঞ্চার হয় এবং প্রাণশক্তি বৃদ্ধি পায়। খেলাধুলার গুরুত্ব এখন অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। কারণ, শরীরচর্চার খেলাধুলা এখন মাঠের ধুলা ছেড়ে জাতীয়তা, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতিসহ বহু কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। বর্তমানকালে নানা ধরনের খেলার প্রচলন ঘটেছে। এসবে শরীয়ত পরিপন্থি নানা বিষয়াদি যোগ হয়েছে- হয়তো খেলার নিয়মকানুনে নয়তো তার চর্চায়। ফলে খেলাধুলা বিষয়ে ইসলামের মূলনীতিগুলো জেনে নেয়া কর্তব্য।
মোটা দাগে বললে যে কোনো খেলা বৈধ হবার জন্য তাতে নিম্নোক্ত শর্তগুলো উপস্থিত থাকতে হবে :
১. ধর্মীয় জরুরী কর্তব্য পালন থেকে উদাসীন না করা :
কোনো খেলা বৈধ হতে হলে তার মধ্যে এ বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে যে তার নেশার ঘোর যেন আল্লাহর কোনো ফরয বিধান পালনের কথা দিব্যি ভুলিয়ে না দেয়। খেলার ছলে যেন ফরয ছুটে না যায়। যেমন কোনো ফরয নামাজের সময় খেলাধুলা করা। কারণ সবার জানা কথা যে এ সময় কোনো ক্রিড়া-কৌতুকের অনুমতি নেই। এ ক্ষেত্রে এটি আল্লাহর যিকির তথা সালাত থেকে উদাসীনকারী হিসেবে গণ্য হবে, যা তার বৈধতা হরণ করে নেবে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
‘আর মানুষের মধ্য থেকে কেউ কেউ না জেনে আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য অনর্থক কথা খরিদ করে, আর তারা ঐগুলোকে হাসি-ঠাট্টা হিসেবে গ্রহণ করে; তাদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাকর আজাব।’ {সূরা লুকমান, আয়াত : ৬}
২. শরীয়তের মহৎ লক্ষ্যের প্রতি খেয়াল রাখা :
আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসীমাত্রেই জানেন, পৃথিবীতে আমাদের আগমন অহেতুক নয়। পৃথিবীতে আমাদের জীবন লক্ষ্যহীন নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘আর জিন ও মানুষকে কেবল এজন্যই সৃষ্টি করেছি যে তারা আমার ইবাদাত করবে।’ {সূরা আয-যারিয়াত, আয়াত : ৫৬}
আরেক জায়গায় আল্লাহ বলেন,
‘যিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন যাতে তিনি তোমাদেরকে পরীক্ষা করতে পারেন যে, কে তোমাদের মধ্যে আমলের দিক থেকে উত্তম। আর তিনি মহাপরাক্রমশালী, অতিশয় ক্ষমাশীল।’ {সূরা আল-মুলক, আয়াত : ২}
অতএব খেলার লক্ষ্য যেন উদ্দেশ্যহীন খেলায়ই সীমাবদ্ধ না থাকে। খেলাটি হতে হবে হয়তো ইসলামের জন্য জীবনবাজি রেখে জিহাদের প্রস্তুতি হিসেবে- যেটি ইসলামের শরীরচর্চার সর্বোচ্চ লক্ষ্য অথবা শারীরিক সক্ষমতা অর্জন, কর্মস্পৃহা বৃদ্ধি বা বৈধ চিত্তবিনোদনের উদ্দেশ্যে। এসব উদ্দেশ্য সামনে রেখে শরীরচর্চা করলে সেটিও আখেরাতের জন্য পুণ্য বয়ে আনবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিহাদের প্রস্তুতি হিসেবে এ কুস্তিযুদ্ধ ও ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতাকে উৎসাহিত করেছেন। মুমিনের জীবনে খেলা শুধু খেলা নয়, উদ্দেশ্য থাকবে শারীরিক শক্তি সঞ্চয় করে তা আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী এবং ইসলামের জন্য লড়াইয়ে তা কাজে লাগানো। নিয়তের বদৌলতে অনেক পার্থিব কাজও আখিরাতের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে। যেমন, উমর ইবন খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
‘নিশ্চয় কাজের ফলাফল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল।’ [বুখারী : ১)]
৩. সতর আবৃত থাকা এবং যৌন সুড়সুড়িদায়ক না হওয়া :
অন্য সময়ের মতো খেলাধুলার সময়ও সতর ঢাকা ওয়াজিব। অথচ অনেক খেলায় ফিতনা উসকে দেবার মতো সতর খোলা থাকে। যেমন ফুটবল খেলায় পুরুষের উরুর অর্ধেক বা তারও বেশি অংশ খোলা থাকে। সাঁতার খেলা, বিচ (সমুদ্রতীরের) খেলা ও প্রভৃতি খেলাধুলায় প্রায় উলঙ্গ হতে হয়। আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
‘তুমি নিজের উরু উন্মুক্ত করো না এবং কোনো জীবিত বা মৃত ব্যক্তির উরুর দিকে দৃষ্টি দিও না।’ [আবূ দাউদ : ৪০১৭; শায়খ আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন, দেখুন সহীহুল জামে : ৭৪৪১]
কিছু খেলা আছে যা কেবলই মেয়েদের জন্য, কিন্তু ওসবে শরীয়তনিষিদ্ধ অঙ্গশোভা প্রদর্শিত হয়। অথচ নারীর জন্য সতর অনাবৃত করা চাই তা পুরুষের সামনে হোক বা নারীদের সামনে- সর্বাবস্থায় কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। যেমন টেনিস, ব্যাডমিন্টন, ফুটবল প্রভৃতি খেলা। তেমনি কিছু শরীরচর্চা রয়েছে যার উদ্দেশ্য উন্মুক্ত সৌন্দর্যপ্রদর্শন, যেমন সুন্দরী প্রতিযোগিতা- সঙ্গত কারণেই এটিও শরীয়তে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। শরীয়ত পর্দা বিধানের মাধ্যমে সবসময় নারীকে যথাযথ সম্মান দিতে চায় এবং যে কোনো মূল্যে তাকে পণ্য বানানোর অশুভ উদ্যোগ প্রতিহত করে। আল্লাহ তা‘আলা আল-কুরআনে ইরশাদ করেন,
‘আর তোমরা নিজ গৃহে অবস্থান করবে এবং প্রাক-জাহেলী যুগের মত সৌন্দর্য প্রদর্শন করো না। আর তোমরা সালাত কায়েম কর, যাকাত প্রদান কর এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর। হে নবী পরিবার (মুসলিম নারী), আল্লাহ তো কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতাকে দূরীভূত করতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে। তোমরা মূর্খতা যুগের অনুরূপ নিজেদেরকে প্রদর্শন করবে না।’ {সূরা আল-আহযাব, আয়াত : ৩৩}
৪. জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ না হওয়া :
খেলাটি এমন হতে হবে যাতে জীবননাশের নিশ্চিত বা প্রবল সম্ভাবনা না থাকে। কেননা নিজের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলা বা ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়ার অনুমতি ইসলামে নেই। মহান আল্লাহ বলেন,
‘আর তোমরা নিজেরা নিজেকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিও না।’ {সূরা আল-বাকারা, আয়াত : ১৯৫}
আরেক আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘আর তোমরা নিজেদের কাউকে হত্যা করো না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়ালু।’ {সূরা আন-নিসা, আয়াত : ২৯}
আমর ইবন ইয়াহইয়া মাযেনী থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
‘ইসলামে কারও ক্ষতি করা নেই, ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াও নেই।’ [মুয়াত্তা মালেক : ২৭৫৬; দারা কুতনী : ৪৫৯৫]
অতএব খেলা যদি হয় জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ চাই এ ঝুঁকি খেলোয়াড়ের নিজের সৃষ্ট হোক বা অন্য কর্তৃক, তা নিষিদ্ধ। কারণ, খেলাধুলার উদ্দেশ্যই হলো জীবনের সুস্থতা তথা এর উপকার করা, একে কষ্ট দেয়া বা এর ক্ষতি করা নয়। যেমন ফর্মুলা ওয়ান রেস (গাড়ির গতি প্রতিযোগিতা) প্রভৃতি ক্রিড়া প্রতিযোগিতায় প্রায়ই প্রতিযোগীদের করুণ মৃত্যুর শিকার হতে দেখা যায়।
একটি বড় উদাহরণ দেয়া যাক, ২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর ৪৫ বছর বয়সী মাইকেল শুমাখার ফ্রেঞ্চ আল্পসে স্কি দুর্ঘটনার শিকার হন। দীর্ষ ১৮ দিন তিনি কোমায় রয়েছেন। দুর্ঘটনার সময় তিনি স্কি হেলমেট পড়েছিলেন কিন্তু তাঁর মাথা একটি শিলার সঙ্গে আঘাতপ্রাপ্ত হয় এবং তাঁর হেলমেট ভেঙ্গে দুই খণ্ড হয়ে যায়। জার্মানির কিংবদন্তী এ ফর্মুলা ওয়ান চ্যাম্পিয়নকে বাকি জীবনটা কোমায় কাটাতে হতে পারে। টিম ম্যানেজমেন্ট ও পরিবারের নীরবতা থেকে এমন অনুমান করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে ডেইলি মেইল। [সূত্র : ডেইলি মেইল অন লাইন/স্কাই স্পোর্টস]
৫. হারাম উপার্জনমুক্ত হওয়া :
খেলা বৈধ হবার আরেক মৌলিক শর্ত হলো, সেটি যে কোনো ধরনের জুয়া ও বাজিমুক্ত হওয়া। খেলাধুলার মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক বাজির অর্থ বৈধ উপার্জন নয়। আজকাল আন্তর্জাতিক খেলাধুলায় বাজি এবং বাজিকে কেন্দ্র করে নানা অনভিপ্রেত ঘটনার উদ্ভব প্রায়ই ঘটতে যায়। ক্রিকেটে জুয়ার ঘটনায় পাকিস্তানের তারকা ক্রিকেটার মোহাম্মাদ আমের, সালমান বাট ও আসিফ নিষিদ্ধ হন। ভারত, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের ক্রিকেটারদের জুয়া, স্পট ফিক্সিংয়ে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা তো মিডিয়ার বদৌলতে সবারই জানা হয়ে গেছে। ইসলাম এসব অবৈধ উপার্জন ও দুর্নীতি প্রতিরোধে সর্বদাই বদ্ধপরিকর। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
‘হে মুমিনগণ, নিশ্চয় মদ, জুয়া, প্রতিমা-বেদী ও ভাগ্যনির্ধারক তীরসমূহ তো নাপাক শয়তানের কর্ম। সুতরাং তোমরা তা পরিহার কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও। শয়তান শুধু মদ ও জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সঞ্চার করতে চায়। আর (চায়) আল্লাহর স্মরণ ও সালাত থেকে তোমাদের বাধা দিতে। অতএব, তোমরা কি বিরত হবে না?’ {সূরা আল-মায়িদা, আয়াত : ৯০-৯১}
আল্লাহ যা উপার্জন ও ভক্ষণ হালাল করেছেন তাই আমাদের আহার্য। এর অন্যথা হলে সেটা শয়তানের অনুকরণ ও অবৈধ। আল্লাহ জাল্লা শানুহু বলেন,
‘হে মানুষ, জমিনে যা রয়েছে, তা থেকে হালাল পবিত্র বস্তু আহার কর এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয় সে তোমাদের জন্য সুস্পষ্ট শত্রু।’ {সূরা আল-বাকারা, আয়াত : ১৬৮}
তেমনি হাদীসে স্পষ্ট বলা হয়েছে প্রতিযোগিতা কেবল তিনটি খেলায়ই অনুমোদিত। আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
‘প্রতিযোগিতা বৈধ কেবল তীরন্দাজিতে, উট ও ঘোড় দৌড়ে। [তিরমিযী : ১৭০০; নাসাঈ : ৩৬০০]
৬. প্রতিযোগিতার জয়-পরাজয়ে শত্রুতা-মিত্রতা সৃষ্টি না হওয়া :
খেলাধুলাকে শত্রুতা-মিত্রতার মাপকাঠি বানালে সে খেলাটি তার স্বাভাবিক বৈধতা হারায়। ভালো খেলার কারণে অতিভক্তি বা খারাপ খেলার কারণে অতি ভক্তি বা অতি অভক্তি কোনোটাই ইসলামে কাম্য নয়। ফুটবলে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার সমর্থক কিংবা ক্রিকেটে ভারত-পাকিস্তানের সমর্থকদের মধ্যে নিজেদের সমর্থিত দল নিয়ে মারামারি, হানাহানি ও শত্রুতা তৈরির ঘটনা পত্র-পত্রিকা প্রায়ই চোখে পড়ে। গত বছর মিসরে ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে মারামারির ঘটনায় প্রায় দশজন মানুষকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। যা আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার করা হয়। দেখুন মানুষকে শয়তানের এসব দুরভিসন্ধিমূলক ঘটনার হাত থেকে বাঁচাতে তাই আল্লাহ তা‘আলার পরিষ্কার ঘোষণা :
‘নিশ্চয় শয়তান শুধু মদ ও জুয়া (সব ধরনের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতাই জুয়াবহুল) দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সঞ্চার করতে চায়। আর (চায়) আল্লাহর স্মরণ ও সালাত থেকে তোমাদের বাধা দিতে। অতএব, তোমরা কি বিরত হবে না?’ {সূরা আল-মায়িদা, আয়াত : ৯১}
তাছাড়া ইসলামে শত্রুতা-মিত্রতার মাপকাঠি কেবল আল্লাহর ভালোবাসা। আল্লাহর জন্যই ভালোবাসা এবং আল্লাহর জন্যই ভালোবাসা ত্যাগ ঈমানের অংশ এবং ইসলামে একান্ত কাম্য বিষয়। আল্লাহ বলেন,
‘আর মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীরা একে অপরের বন্ধু, তারা ভালো কাজের আদেশ দেয় আর অন্যায় কাজ থেকে নিষেধ করে, আর তারা সালাত কায়েম করে, জাকাত প্রদান করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে। এদেরকে আল্লাহ শীঘ্রই দয়া করবেন, নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’ {সূরা তাওবা, আয়াত : ৭১}
তাফসীরবিদ ইমাম কুরতুবী রহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘একে অপরের বন্ধু অর্থ ভালোবাসা, সম্প্রীতি ও আন্তরিকতায় তারা অভিন্ন।’ [তাফসীরে কুরতুবী : ৮/২০৩]
মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মতের বৈশিষ্ট হলো তারা আল্লাহর জন্য পরস্পরকে ভালোবাসাবে। পার্থিব কোনো কারণে একে অপরের সঙ্গে শত্রুতা বা দুশমনি পোষণ করবে না। আল্লাহর শত্রুরাই কেবল তাদের শত্রু। আল্লাহ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন,
‘মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল এবং তার সাথে যারা আছে তারা কাফিরদের প্রতি অত্যন্ত কঠোর; পরস্পরের প্রতি সদয় (ভালোবাসা পরায়ন)।’ {সূরা আল-ফাতহ, আয়াত : ২৯}
হাদীসে আল্লাহর জন্য মিত্রতা-বৈরিতাকে ঈমানের পূর্ণতার নিদর্শন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। যেমন আবূ উমামা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
‘যে কেউ আল্লাহর জন্যই ভালোবাসে এবং আল্লাহর জন্যই ঘৃণা করে এবং (কাউকে কিছু) দিয়ে থাকে আল্লাহর জন্যই এবং (কাউকে কিছু) দেয়া থেকে বিরত থাকেও আল্লাহরই জন্য; তাহলে তার ঈমান পরিপূর্ণ হলো।’ [আবূ দাউদ : ৪৬৮১]
এতো গেল সরাসরি খেলার দিক। খেলা দেখার দিকটিও এখানে প্রাসঙ্গিক। অধুনাকালে খেলাধুলার নানা শাখা-প্রশাখার বিস্তৃতি ঘটেছে। খেলার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আনুষঙ্গিক বহু বিষয়। খেলার বৈধতা-অবৈধতার ক্ষেত্রে এসব বিষয়ও বিবেচ্য। যেমন এখন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সব খেলার প্রাণ দর্শক-শ্রোতা। দর্শকরাই খেলাধুলার মাধ্যমে আয়ের প্রধান উৎস। দর্শক না এলে বিশ্বফুটবলের নিয়ন্ত্রক ফিফা কিংবা বিশ্ব ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসির গুরুচণ্ডালি মাঠে মারা যাবে। এ দর্শকদের কারণেই খেলাধুলা নিয়ে মিডিয়া ও পুঁজিপতিদের যত আগ্রহ। গ্লোবাল ভিলেজের যুগে খেলাধুলায়ও গ্লোবালাইজেশনের ছোঁয়া লেগেছে। শুধু তাই নয়, খেলা এখন সংস্কৃতি ও মানুষের চিন্তা-চেতনা পরিবর্তনে বড় ভূমিকা রাখছে।
স্যাটেলাইন চ্যানেলগুলো জনপ্রিয় খেলা সম্প্রচার করে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ আয় করছে। যে আয়ের ভাগ গিয়ে পড়ছে ওই খেলার আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রক সংস্থা, সংশ্লিষ্ট দেশের বোর্ড এবং প্রতিটি খেলোয়াড় পর্যায়ে। আর টিভি চ্যানেলগুলোর প্রধান উৎস অবশ্যই বিজ্ঞাপন। বল্গাহীন পুঁজিবাদী ও নৈতাকতাহীন অর্থলোভীরা তাদের সব ধরনের বিজ্ঞাপন হজম করাচ্ছে সব জাতি ও দেশকে। অথচ এসব বিজ্ঞাপনের অধিকাংশই বহু দেশ ও জাতি বিশেষত মুসলিম রাষ্ট্র ও উম্মাহর চেতনা ও সংস্কৃতির সঙ্গে মানানসই নয়। কেউ টিভিতে খেলা দেখবেন অথচ অশ্লীল বিজ্ঞাপন তার চোখে পড়বে না, এটা এখন আর সম্ভব নয়। তাই এসব দেখা ও এর মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ কোনোটাই যে অবৈধতামুক্ত নয়, তা বলাবাহুল্য।
খেলা দেখায় বিজ্ঞাপন মতো আরেক সমস্যা প্রমিলা দর্শক। স্টেডিয়ামে নারীদের উপস্থিতি এখন অপরিহার্য। যাদের অধিকাংশের বেশভূষাই শুধু ইসলামের দৃষ্টিতে নয়, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর স্থানীয় সংস্কৃতির দৃষ্টিকোণেও সমর্থনযোগ্য নয়। মিডিয়া ও পুঁজিবাদীরা নিজেদের স্বার্থে বরাবরই এদের পালে হাওয়া দিয়ে আসছে। অমুসলিম দেশগুলোয় স্টেডিয়ামে মেয়েদের খোলামেলা উপস্থিতি দেখে অতি দ্রুত মুসলিম মেয়েরা তাদের অনুসরণ করছে। আপনি খেলা দেখতে চাইলে বিজ্ঞাপনের মতো এদেরও না দেখে উপায় নেই। এবার আপনিই সিদ্ধান্ত নিন কিভাবে খেলা দেখবেন।
সমস্যা আরও আছে। মুসলিম সংখ্যাগুরু এশিয়া মহাদেশে বিশেষত ভারতীয় উপমহাদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ইংরেজ হাতে জন্ম নেয়া ভদ্র লোকের খেলা হিসেবে খ্যাত ক্রিকেট। ক্রিকেট খেলার সংক্ষিপ্ততম ভার্সন টি-টুয়েন্টির অপরিহার্য বানানো হয়েছে চরম দৃষ্টিকটু অরুচিকর চিয়ার্সলেডিদের নাচ। মাঠের দুই পাশে সবার চোখে পড়ার মতো জায়গায় উঁচু মঞ্চে অশ্লীল পোশাকধারী এই মেয়েগুলো দাঁড়িয়ে থাকে। এদের গায়ে কাপড় বলতে বুকে ও কোমরের নিচে এক চিলতে পাতলা বস্ত্রখণ্ড। চার-ছক্কার উদ্দেশ্যে বল গড়িয়ে মাঠের বাইরে যেতে লাগলে এরা বেখাপ্পা হাসি দিয়ে বিশ্রীভাবে নেচে দর্শকদের নজর কাড়ার চেষ্টা করে। অশ্লীলতার এমন জোয়ার পৃথিবী কখনো দেখেছে কিনা আল্লাহ জানেন।
এ ছাড়া যে কোনো জাতীয় বা আন্তর্জাতিক ক্রিড়া প্রতিযোগিতা উদ্বোধনীর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এখন সাংস্কৃতিক প্রদর্শনী। থিম সং, জাতীয় সংস্কৃতি চিত্রায়ণসহ নানা নামে অশ্লীলতার কত নান্দনিক উপস্থাপনা। যার সিংহভাগজুড়েই থাকে অশ্লীল নাচ-গান। কদিন আগে লাতিন আমেরিকার ব্রাজিলে উদ্বোধন হলো ২০১৪ বিশ্বকাপ। পরেরদিন জাতীয় দৈনিকগুলোয় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের নাচ-গানের যে গুটিকয় ছবি ছাপা হয়েছে তা দেখে আঁতকে উঠেছি। এই স্বল্পবসনা ললনাদের পারফরম্যান্স মানুষ সরাসরি টিভিতে কিভাবে দেখেছে ভেবে বিস্মিত হতে হয়। এর আগের বিশ্বকাপ হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকায়। সেখানেও উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ছিল অশ্লীলতার ছড়াছড়ি। অলিম্পিক আসরেও এসব অপরিহার্য। ফলে খেলাধুলার উত্তম ব্যাপারটি এখন নানা কারণে তার উত্তমত্ব হারিয়ে ফেলেছে। অশ্লীলতার এতসব আয়োজন সত্ত্বেও এসব খেলায় অংশগ্রহণ বা দর্শক হিসেবে উপভোগ যে বৈধতা হারিয়েছে বহু আগেই তা বুঝতে মুফতি সাহেবের কাছে যাবার প্রয়োজন আছে?
অতএব দেশ ও জাতির স্বার্থে খেলাকে খেলার জায়গায় রেখে আমাদের শরীরচর্চার প্রশংসনীয় কাজ করে যেতে হবে। খেলাকে অবিবেচক স্বার্থান্ধ অর্থলোভী এবং চরিত্র বিনাশীদের অশুভ হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। সর্বোপরি সুস্থ বিনোদন ও ক্রিড়াচর্চার মাধ্যমে তরুণ ও যুবসমাজের সুষ্ঠু বিকাশ নিশ্চিত করতে হবে। আজকের তরুণরা সুস্থ বিনোদন ও বৈধ খেলা ছেড়ে ছুটছে অবৈধ ও চরিত্রবিধ্বংসী আয়োজনের দিকে। যৌনতা ও অশ্লীলতার জোয়ার তাদের ভেসে নিয়ে যাচ্ছে। জেনা-ব্যভিচারের প্লাবনে ভেসে দেশ ও উম্মাহর এ সম্পদ ও শক্তি। দেশ ও জাতির অন্ধকার ভবিষ্যত কল্পনা করে তাই চিন্তাশীল, দূরদর্শী ব্যক্তিমাত্রেই আজ উদ্বিগ্ন উৎকণ্ঠিত।
এ জগত ও জীবনের নিরাপত্তা ও অস্তিত্বের স্বার্থে আজ আমাদের এতসব অবৈধ আয়োজনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। খেলাধুলা ও শরীরচর্চার বৈধ ও বিকল্প উপায় মানুষের সামনে তুলে ধরে তাদেরকে ফেরাতে হতে আত্মধ্বংসী এসব তৎপরতা থেকে। আল্লাহ আমাদের সঠিক বুঝ দিন। দয়াময় আমাদের সহায় হোন। আমীন।
– আলী হাসান তৈয়ব