ইসলামের পরিচয়

কুরআন ও হাদীছের আলোকে “ভুল”

রফীক আহমেদ

            মানুষ মাত্রেরই ভুল হয়। বাক্যটির অর্থ খুব কঠিন  নয়, তাই বুঝতে কোন অসুবিধা হয় না। কিন্তু বিশেষভাবে লক্ষ্য করলে বুঝা যায় বাক্যটির  অর্থ মোটেও সহজ নয়, বরং খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যবহ। ভুল অর্থে আমরা সাধারণত  ভ্রম, ভ্রান্তি, বিস্মৃতি, মনে না থাকা প্রভৃতি বুঝে থাকি। আসলে ভুল কী? ভুলের  সংখ্যা কত? এর উৎস কি এবং এর সৃষ্টিই বা কেন ইত্যাদি বিষয়গুলি পর্যালোচনা করলে  দীর্ঘ পরিসরের প্রয়োজন।

            আল্লাহ বলেন,اللهُ يَخْلُقُ مَا يَشَاءُ  ‘আল্লাহ যা ইচ্ছা সৃষ্টি  করেন’ (আলে ইমরান ৩/৪৭)। ভুল মানব জাতির জন্য বিপদজ্জনক বস্ত্ত। যা দেখা যায়  না, শোনা যায় না, তবে অনুভব বা অনুমান করা যায়। মানব জীবনে ভুলের সংখ্যা এত বেশী  যে তা নিরূপণ করা অসম্ভব। তবে ভুলের সংখ্যাকে শ্রেণীবিন্যাস করলে মোটামুটি  কয়েকভাগে বিভক্ত হবে। তন্মধ্যে দু’টি উল্লেখযোগ্য (১) অনিচ্ছাকৃত ভুল (২) ইচ্ছাকৃত  ভুল। এ দু’টি ভুলই মানব জীবনে জ্ঞান লাভের জন্য আলোচনা করা একান্ত যরূরী। এ  উদ্দেশ্যেই আলোচ্য প্রবন্ধের অবতারণা।

            ভুলের উৎসের সন্ধানে মনোযোগ স্থাপন করলে আমরা  দেখতে পাব অনিচ্ছাকৃত ভুলই ভুলের প্রকৃত উৎস। অনিচ্ছাকৃত ভুল হ’তেই ভুলের সূত্রপাত  হয়েছে। কিন্তু ঐ অনিচ্ছাকৃত ভুলটিও ছিল অসতর্কতা ও অবহেলার সমন্বয়ে সৃষ্ট একটি  অপরাধ। আদম (আঃ) ও মা হাওয়া আল্লাহর নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল খেয়ে ভুলের সূত্রপাত  করেন। তাঁরা জানতেন না যে, ভুল করলে কি হয় এবং জানতেন না এর পরিণতিও। কিন্তু ভুল  করে ফল খাওয়ার পর সবই জানলেন ও বুঝলেন। ইতিপূর্বে আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে একটি  নির্দিষ্ট গাছের ফল খেতে নিষেধ করে বলে দিয়েছিলেন যে, শয়তান তোমাদের চিরশত্রু, সে  তোমাদেরকে ঐ গাছের ফল খেতে উৎসাহিত করবে, কিন্তু তোমরা তা খেও না। শয়তানের মিথ্যা  ও সুন্দর কথায় আদম (আঃ) ও মা হাওয়া আল্লাহর কথা ভুলে গিয়ে ঐ গাছের ফল খেয়ে অপরাধী  হয়ে ছিলেন। মহান আল্লাহ বলেন, وَلَقَدْ عَهِدْنَا إِلَى آدَمَ مِن قَبْلُ فَنَسِيَ وَلَمْ نَجِدْ لَهُ  عَزْماً ‘আমরা ইতিপূর্বে আদমকে  নির্দেশ দিয়েছিলাম। অতঃপর সে ভুলে গিয়েছিল এবং আমরা তার মধ্যে দৃঢ়তা পাইনি’ (ত্বোয়া-হা ২০/১১৫)

            আল্লাহ অন্তর্যামী ও মহাজ্ঞানী। কেউ ইচ্ছাকৃত ভুল  করুক বা অনিচ্ছাকৃত ভুল করুক আল্লাহ তা জানেন। তিনি ইচ্ছাকৃত ভুলকারীর প্রতি বেশী  অসন্তুষ্ট হন। পক্ষান্তরে অনিচ্ছাকৃত ভুলকারীর উপর কম অসন্তুষ্ট হন। তাই আদম (আঃ)  ও মা হাওয়া যখন অনিচ্ছাকৃত ভুল করে আল্লাহর নিকট কান্নাকাটি করে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন, তখন আল্লাহ তাদেরকে  ক্ষমা করে দিলেন এবং আগামী দিনের চলার পথ নির্দেশনা দিলেন। মহান আল্লাহ বলেন,ثُمَّ اجْتَبَاهُ رَبُّهُ فَتَابَ عَلَيْهِ  وَهَدَى، قَالَ اهْبِطَا مِنْهَا جَمِيْعاً بَعْضُكُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّ فَإِمَّا يَأْتِيَنَّكُم  مِّنِّيْ هُدًى فَمَنِ اتَّبَعَ هُدَايَ  فَلاَ يَضِلُّ وَلاَ يَشْقَى، وَمَنْ  أَعْرَضَ عَنْ ذِكْرِيْ فَإِنَّ لَهُ مَعِيْشَةً ضَنْكاً  وَنَحْشُرُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَعْمَى- ‘এরপর তার পালনকর্তা তাকে মনোনীত করলেন, তার তওবা কবুল করলেন এবং তাকে সুপথে আনয়ন  করলেন। তিনি বললেন, তোমরা (শয়তান সহ) উভয়েই এখান থেকে এক সঙ্গে নেমে যাও। তোমরা  একে অপরের শত্রু। এরপর যদি আমার পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে হেদায়াত আসে, তখন যে আমার  পথ অনুসরণ করবে, সে পথভ্রষ্ট হবে না এবং কষ্টে পতিত হবে না। আর যে আমার স্মরণ থেকে  মুখ ফিরিয়ে নিবে তার জীবিকা সংকীর্ণ হবে এবং আমরা তাকে কিয়ামতের দিন অন্ধ অবস্থায়  উত্থিত করব’ (ত্বোয়া-হা ২০/১২২-১২৪)

            সুতরাং অনিচ্ছাকৃত ভুল সৃষ্টির প্রারম্ভেই আল্লাহ  ক্ষমার বিধান জারী করে দিলেন। কিন্তু এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, ভুলটি অবশ্যই  অনিচ্ছাকৃত হ’তে হবে। এখানে ছল-চাতুরী, মিথ্যা কলা-কৌশল বা কোন কৃত্রিমতার স্থান  নেই। মানুষ বড় সুযোগ সন্ধানী, সে ইচ্ছাকৃত ভুল করেও অনিচ্ছাকৃত ভুলের কথা বলতে  পারে। কিন্তু তাদের জানা উচিত আল্লাহ অন্তর্যামী, পরন্তু যে কোন বস্ত্তর উপর  আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতা আছে। মহান আল্লাহ বলেন,وَلِلّهِ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ  وَالأَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا  يَخْلُقُ مَا يَشَاءُ وَاللهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ ‘আকাশ ও পৃথিবী ও তাদের মাঝে যা কিছু আছে তার  সার্বভৌমত্ব আল্লাহরই। তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন, আর আল্লাহ তো সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান’ (মায়েদাহ ৫/১৭)। অপর এক আয়াতে আল্লাহ বলেন, وَلِلَّهِ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ يَغْفِرُ لِمَن يَشَاءُ وَيُعَذِّبُ مَن يَشَاءُ وَكَانَ اللَّهُ غَفُوْراً رَّحِيْماً ‘আকাশ ও পৃথিবীর  সার্বভৌমত্ব আল্লাহরই, তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন আর যাকে ইচ্ছা শাস্তি দেন।  তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’ (ফাতাহ ৪৮/১৪)

            হঠাৎ ভুল হয়ে যাওয়াকে আমরা সামান্য কিছু মনে করি,  কিন্তু সর্বক্ষেত্রে তা নয়। অনেক সময় সামান্য ভুলই অসামান্য ক্ষতির কারণ হয়ে যায়।  এখান থেকে মানব জাতির শিক্ষা নেওয়ার অনেক কিছু আছে।

            মহান আল্লাহ আদম (আঃ)-কে ক্ষমা করে দিলেন এবং  পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন, قَالَ اهْبِطُواْ بَعْضُكُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّ وَلَكُمْ فِي الأَرْضِ مُسْتَقَرٌّ وَمَتَاعٌ إِلَى حِيْنٍ،  قَالَ فِيْهَا تَحْيَوْنَ وَفِيْهَا  تَمُوْتُوْنَ  وَمِنْهَا تُخْرَجُوْنَ- ‘তিনি বললেন, তোমরা নেমে যাও, তোমরা একে অন্যের শত্রু এবং কিছু কালের জন্য  পৃথিবীতে তোমাদের আবাস ও জীবিকা রইল। তিনি বললেন, সেখানেই তোমরা জীবন-যাপন করবে।  সেখানেই তোমাদের মৃত্যু হবে আর সেখান থেকেই তোমাদেরকে বের করে আনা হবে’ (আ‘রাফ ৭/২৪-২৫)

            আদম (আঃ)-এর প্রতি এই আদেশ শুধু তাঁর একার জন্য  নয়; বরং সমগ্র মানব জাতির জন্য অবতীর্ণ হয়েছে। তাছাড়া যারা ইচ্ছাকৃত ভুল করে  মিথ্যার আশ্রয় নিবে তাদের জন্যও সতর্কবাণী রয়েছে। উক্ত বিষয়টি এভাবে প্রকাশ পেয়েছে  যে, তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন, আর যাকে ইচ্ছা শাস্তি দেন। আমরা এটাও বিশ্বাস করি  যে, আল্লাহ কখনও নিরপরাধকে শাস্তি দিবেন না, তিনি অপরাধীকেই শাস্তি দিবেন। এখানে  যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করার ক্ষেত্রে নির্দোষ এবং যাকে ইচ্ছা শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে  দোষী ব্যক্তিই সাব্যস্ত হবে বলে আমরা দৃঢ় আশা পোষণ করি।

            ভুল হ’তেই অনেক শিক্ষণীয়  ইতিহাস সৃষ্টি হয়। এখানে তাবুক যুদ্ধের একটি বাস্তব ঘটনা সংক্ষেপে তুলে ধরছি।  পবিত্র কুরআনে তাবুক যুদ্ধের সময়টিকে অত্যন্ত সংকটময় বলে অভিহিত করা হয়েছে। কারণ ঐ  সময় মুসলমানদের বড় অভাব-অনটন চলছিল, যানবাহন ছিল কম। তখন গ্রীষ্মকাল হওয়ায় পানিরও  স্বল্পতা ছিল। এমতাবস্থায় যুদ্ধ যাত্রাকালে কতিপয় মুনাফিক কিছু মিথ্যা অজুহাত  দেখিয়ে যুদ্ধে না যাওয়ার জন্য ষড়যন্ত্র করতে লাগল। তারা আল্লাহ ও আল্লাহর নবীর  অনুগত কিছু লোককে যুদ্ধে যাওয়া হ’তে বিরত থাকার কুপরামর্শ দিল এবং শেষ পর্যন্ত  তারা বিরত থাকল।

            যুদ্ধ শেষে নবী করীম (ছাঃ) যখন মদীনায় ফিরলেন,  তখন মুনাফিকরা নানা অজুহাত দেখিয়ে ও মিথ্যা শপথ করে রাসূলকে সন্তুষ্ট করতে চাইল।  আর মহানবী (ছাঃ) তাদের গোপন অবস্থাকে আল্লাহর উপর সোপর্দ করে তাদের মিথ্যা শপথেই  আশ্বস্ত হ’লেন। ফলে তারা দিব্যি নিরপরাধের মত সময় অতিবাহিত করতে লাগল। তাদের মধ্যে  তিন বিশিষ্ট ছাহাবী অশান্তির মধ্যে দিন কাটাতে লাগলেন। মুনাফিকরা ঐ তিন জনকে  পরামর্শ দিতে লাগল যে, আপনারাও মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে  সন্তুষ্ট করুন। কিন্তু তাদের বিবেক সায় দিল না। কারণ তাদের প্রথম অপরাধ ছিল জিহাদ  থেকে বিরত থাকা, দ্বিতীয় ভুল বা অপরাধ আল্লাহর নবীর সামনে মিথ্যা বলা, যা কিছুতেই  সম্ভব নয়। তাই তারা পরিষ্কার ভাষায় নিজেদের ভুল স্বীকার করে নিল। মূলতঃ  আল্লাহভীতির কারণেই তারা নিজেদের অপরাধ অপকটে স্বীকার করেছিলেন।

            ঐ তিন জন ছাহাবী হ’লেন কা‘ব  ইবনে মালেক, মুরারা ইবনে রুবাই এবং হেলাল ইবনে উমাইয়া (রাঃ)। তাঁরা তিনজনই ছিলেন  নবী করীম (ছাঃ)-এর ছাহাবী এবং আনছারদের শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি। তাঁরা নিজেদের অপরাধ  স্বীকার করায় অপরাধের সাজা স্বরূপ তাঁদের সমাজচ্যুতির আদেশ দেওয়া হয়। তাঁরা  দীর্ঘদিন মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে দুর্বিসহ অবস্থার মধ্যে দিয়ে আল্লাহর আশ্রয়  প্রার্থনা করেন। ফলে দীর্ঘ পঞ্চাশ দিন এহেন দুর্ভোগ সহ্য করার পর আল্লাহ দয়াপরবশ  হয়ে তাঁদেরকে ক্ষমা করে দেন। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ অবশ্যই অনুগ্রহ করলেন নবীর উপর,  আর মুহাজির ও আনছারদের উপর যারা সংকটের সময় তাঁর (মুহাম্মাদের) সাথে গিয়েছিল,  এমনকি যখন এক দলের মন বক্র হওয়ার উপক্রম হয়েছিল তখনও। পরে আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করলেন।  তিনি তো ওদের ব্যাপারে ছিলেন দয়াপরবশ, পরম দয়ালু। আর তিনি অপর তিনজনকেও ক্ষমা  করলেন, যাদের পিছনে ফেলে আসা হয়েছিল। পৃথিবী প্রশস্ত হওয়া সত্ত্বেও তাদের জন্য তা  ছোট হয়ে আসছিল ও তাদের জীবন তাদের জন্য দুঃসহ হয়ে উঠেছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল যে,  আল্লাহ ছাড়া কোন আশ্রয় নেই। পরে আল্লাহ তাদেরকে অনুগ্রহ করলেন, যাতে তারা অনুতপ্ত  হয়। আল্লাহ তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’ (তওবা ৯/১১৭-১১৮)

            উপরোক্ত ঘটনার সঙ্গে জড়িত কপট মুনাফিকরা কখনই  ক্ষমা পাবে না। কারণ তারা মিথ্যা ও ষড়যন্ত্র দ্বারা মুসলমানদের ধ্বংস সাধনে তৎপর  ছিল। কিন্তু ক্ষমাপ্রাপ্ত তিনজন ছাহাবী তাদের অনিচ্ছাকৃত ভুল ও অপরাধের জন্য  নিবিড়ভাবে আল্লাহর দরবারে আত্মসমর্পণ করেছিল। এই ঐতিহাসিক ঘটনা মুসলিম উম্মাহর  জন্য শিক্ষণীয় এক বিরল দৃষ্টান্ত। এখান থেকে অবশ্যই বহু ঈমানদার শিক্ষা লাভ করে  ভ্রান্ত পথ হ’তে ফিরে আসতে পারে।

            ভুল মানুষের দৈনন্দিন  জীবনের সঙ্গী। যারা বিবেকবান মানুষ তারা নিজেদের কথাবার্তা, কাজ-কর্ম ইত্যাদি নিয়ে  চিন্তা করে, তারা ধৈর্যের সাথে সতর্কভাবে চলে। ফলে তাদের ভুল কম হয়। পক্ষান্তরে  যারা বিবেকহীনভাবে চিন্তা-ভাবনা ছাড়া কথা বলে, কাজ-কর্ম করে তাদের ভুলের পর ভুল  হ’তেই থাকে। দৈনন্দিন জীবনের এসব ভুলের অধিকাংশই অনিচ্ছাকৃতভাবে হয়ে থাকে। আর  এগুলি সাধারণত ছালাত ও অন্যান্য ইবাদতের মাধ্যমে মুছে যায়। অর্থাৎ আল্লাহ ক্ষমা  করে দেন।

            জীবনের ভুলগুলো বহুভাবে  হ’তে পারে। কারণ শয়তান বহু ভাল মানুষকেও ভুল পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য নিয়োজিত থাকে।  সে অনেক মিথ্যা কথা, মিথ্যা আশা,   লোভ-লালসা, প্রতারণা প্রভৃতির দ্বারা মানুষকে ভুল ও অন্যায় পথে চালিত করে।  যারা শয়তান থেকে দূরে থাকতে চায়, শয়তান তাদের পিছনেই বেশী লেগে থাকে এবং তাদের  জন্যেই বেশী সময় ব্যয় করে। এই ভুলই মানুষকে ধীরে ধীরে বড় অপরাধে জড়িয়ে ফেলে।  তাছাড়া শয়তানের কারসাজি তো আছেই। সে দিবারাত্রি মানুষকে বিভ্রান্ত করতে তৎপর। এতে  শয়তানের বিজয় হচ্ছে, তার দল বৃদ্ধি পাচ্ছে, জাহান্নামীর দল ভারী হচ্ছে।

            শয়তানের খপপর থেকে  পরিত্রাণের জন্য মানুষকে আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসূল (ছাঃ) প্রদর্শিত পথে চলতে হবে এবং  তার উপরে অটল থাকতে হবে। সেই সাথে সৎ আমল করতে হবে। কেননা আল্লাহ মানুষকে পৃথিবীতে  পাঠিয়েছেন পরীক্ষা করার জন্য। কাজেই এগুলি নিয়ে তাকে গভীরভাবে ভাবতে হবে। আল্লাহ  যে কোন মুহূর্তে যে কোন অবস্থার পরিবর্তন করতে পারেন। সুন্দরকে অসুন্দর, অসুন্দরকে  সুন্দর, ধনীকে দরিদ্র, দরিদ্রকে ধনী করা তাঁর পক্ষে খুবই সহজ। এরূপ ঘটনা পৃথিবীতে  অহরহ ঘটছে। আল্লাহ সর্বশক্তিমান; এতে কেউ সন্দেহ করলে সে জাহান্নামী হবে। এক  আল্লাহর উপর শতভাগ বিশ্বাস থেকে এক চুল পরিমাণ সরে আসলে সে ভুল করবে। এরূপ  বিশ্বাস করলে, সে (আখেরাতে) সমূলে ধ্বংস হবে।

            আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়। তিনি সর্বশক্তিমান। অতীত  বর্তমান ও ভবিষ্যত সবই তাঁর। তিনি পৃথিবীতে যা কিছু সৃষ্টি করেছেন তা মানুষের  উপকারের জন্যই করেছেন। কাজেই আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ থেকেই আল্লাহর প্রশংসা করতে  হবে। কারণ আল্লাহ বলেন, اَلْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ ‘যাবতীয় প্রশংসা বিশ্বজগতের  প্রতিপ্রালক আল্লাহরই প্রাপ্য’ (মুমিন ৪০/৬৫; ছাফফাত  ৩৭/১৮২)। যদি কেউ  আল্লাহর ঘোষিত এ মহামূল্যবান বাণীকে উপেক্ষা করে, তবে সে অনেক বড় ভুল করবে এবং  শাস্তির সম্মুখীন হবে।

            মানুষের ইতিহাস পর্যালোচনা  করলে দেখা যায় পৃথিবীতে ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, ধর্ম-অধর্ম, হিংসা-বিদ্বেষ,  মারামারি, হানা-হানি, খুনা-খুনি প্রভৃতি কাজগুলি বিরতিহীনভাবে চলে আসছে। এসব  ঘটনাবলীর অধিকাংশই ভুল হ’তেই সূচনা হয়েছে।

            ভুলের কোন সুনির্দিষ্ট পরিমাপ নেই। এটা ক্ষুদ্রতম  হ’তে বৃহত্তম আকারের হ’তে পারে। নবী-রাসূলগণেরও ভুল হয়েছে। যা আল্লাহ সংশোধন করে  দিয়েছেন। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, নবী-রাসূলগণ মানুষ ছিলেন। এখানে কয়েকজনের  কতিপয় ভুল উদাহরণস্বরূপ পেশ করা হ’ল। যাতে আমার এসব ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে  পারি।

            আল্লাহর নবী নূহ (আঃ)-এর ভুল : নূহ (আঃ) স্বীয় ছেলের প্রতি স্নেহবশত তাকে নৌকায়  আরোহণ করতে বললেন। অথচ তাতে ঈমানদার ব্যতীত অন্যের আরোহণের সুযোগ ছিল না। আল্লাহ  নূহের এ ভুল সংশোধন করে দিলেন। এ ঘটনা পবিত্র কুরআনে এসেছে এভাবে, ‘অতঃপর নৌকাখানি  তাদের বহন করে নিয়ে চলল পর্বতপ্রমাণ তরঙ্গমালার মাঝ দিয়ে। এ সময় নূহ তার পুত্রকে  (ইয়ামকে) ডাক দিল- যখন সে দূরে ছিল, হে বৎস! আমাদের সাথে আরোহণ কর, কাফেরদের সাথে  থেকো না। সে বলল, অচিরেই আমি কোন পাহাড়ে আশ্রয় নেব। যা আমাকে প্লাবনের পানি হ’তে  রক্ষা করবে। নূহ বলল, ‘আজকের দিনে আল্লাহর হুকুম থেকে কারো রক্ষা নেই, একমাত্র  তিনি যাকে দয়া করবেন সে ব্যতীত। এমন সময় পিতা-পুত্র উভয়ের মাঝে বড় একটা ঢেউ এসে  আড়াল করল এবং সে ডুবে গেল। অতঃপর নির্দেশ দেওয়া হ’ল, হে পৃথিবী! তোমার পানি গিলে  ফেল (অর্থাৎ হে প্লাবনের পানি! নেমে যাও)। হে আকাশ! ক্ষান্ত হও (অর্থাৎ তোমার  বিরামহীন বৃষ্টি বন্ধ কর)। অতঃপর পানি হরাস পেল ও গযব শেষ হ’ল। ওদিকে জূদী পাহাড়ে  গিয়ে নৌকা ভিড়ল এবং ঘোষণা করা হ’ল, যালেমরা নিপাত যাও। এ সময় নূহ তার প্রভুকে ডেকে  বলল, হে আমার পালনকর্তা! আমার পুত্র তো আমার পরিবারের অন্তর্ভুক্ত, আর তোমার ওয়াদাও  নিঃসন্দেহে সত্য, আর তুমিই সর্বাপেক্ষা বিজ্ঞ ফায়ছালাকারী। আল্লাহ বললেন, হে নূহ!  নিশ্চয়ই সে তোমার  পরিবারভুক্ত নয়। নিশ্চয়ই  সে দুরাচার। তুমি আমার নিকটে এমন বিষয়ে আবেদন কর না, যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই।  আমি তোমাকে সতর্ক করে দিচ্ছি যেন জাহিলদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না। নূহ বলল, হে আমার  পালনকর্তা! আমার অজানা বিষয়ে আবেদন করা হ’তে আমি তোমার নিকটে পানাহ চাচ্ছি। তুমি  যদি আমাকে ক্ষমা না কর ও অনুগ্রহ না কর, তাহ’লে আমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত  হয়ে যাব’ (হূদ ১১/৪২-৪৭)

            মূসা  (আঃ)-এর ভুল : ছহীহ  বুখারী ও মুসলিমে হযরত ওবাই বিন কা‘ব (রাঃ) কর্তৃক রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হ’তে বর্ণিত  হাদীছ হ’তে এবং সূরা কাহফ ৬০ হ’তে ৮২ পর্যন্ত ২৩টি আয়াতে বর্ণিত বিবরণ থেকে যা  জানা যায়, তার সারসংক্ষেপ নিম্নরূপ-

            রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,  একদিন হযরত মূসা (আঃ) বনু ইস্রাঈলের এক সভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন। এমন সময় জনৈক ব্যক্তি  প্রশ্ন করল, লোকদের মধ্যে আপনার চেয়ে অধিক জ্ঞানী কেউ আছে কি? ঐ সময়ে যেহেতু মূসা  ছিলেন শ্রেষ্ঠ নবী এবং তাঁর জানা মতে আর কেউ তাঁর চাইতে অধিক জ্ঞানী ছিলেন না, তাই  তিনি সরলভাবে ‘না’ সূচক জবাব দেন। জবাবটি আল্লাহর পসন্দ হয়নি। কেননা এতে কিছুটা  অহংকার প্রকাশ পেয়েছিল। ফলে আল্লাহ তাঁকে পরীক্ষায় ফেললেন। তাঁর উচিৎ ছিল একথা বলা  যে, ‘আল্লাহই সর্বাধিক অবগত’। আল্লাহ তাঁকে বললেন, ‘হে মূসা! দুই সমুদ্রের  সংযোগস্থলে অবস্থানকারী আমার এক বান্দা আছে, যে তোমার চেয়ে অধিক জ্ঞানী’। একথা  শুনে মূসা (আঃ) প্রার্থনা করে বললেন, হে আল্লাহ! আমাকে ঠিকানা বলে দিন, যাতে আমি  সেখানে গিয়ে জ্ঞান লাভ করতে পারি’। আল্লাহ বললেন, থলের মধ্যে একটি মাছ নিয়ে নাও  এবং দুই সমুদ্রের সঙ্গমস্থলের দিকে সফরে বেরিয়ে পড়। যেখানে পৌঁছার পর মাছটি জীবিত  হয়ে বেরিয়ে যাবে, সেখানেই আমার সেই বান্দার সাক্ষাৎ পাবে’। মূসা (আঃ) স্বীয় ভাগিনা  ও শিষ্য (এবং পরবর্তীকালে নবী) ইউশা‘ বিন নূনকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। পথিমধ্যে এক  স্থানে সাগরতীরে পাথরের উপর মাথা রেখে দু’জন ঘুমিয়ে পড়েন। হঠাৎ সাগরের ঢেউয়ের ছিটা  মাছের গায়ে লাগে এবং মাছটি থলের মধ্যে জীবিত হয়ে নড়েচড়ে ওঠে ও থলে থেকে বেরিয়ে  সাগরে গিয়ে পড়ে। ইউশা‘ ঘুম থেকে উঠে এই বিস্ময়কর দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেন। কিন্তু  মূসা (আঃ) ঘুম থেকে উঠলে তাঁকে এই ঘটনা বলতে ভুলে গেলেন। অতঃপর তারা আবার পথ চলতে  শুরু করলেন এবং একদিন একরাত চলার পর ক্লান্ত হয়ে এক স্থানে বিশ্রামের জন্য বসলেন।  অতঃপর মূসা (আঃ) নাশতা দিতে বললেন। তখন তার মাছের কথা মনে পড়ল এবং ওযর পেশ করে  আনুপূর্বিক সব ঘটনা মূসা (আঃ)-কে বললেন এবং বললেন যে, ‘শয়তানই আমাকে একথা ভুলিয়ে  দিয়েছিল’ (কাহফ  ১৮/৬৩)। তখন মূসা (আঃ) বললেন, ঐ স্থানটিই তো ছিল আমাদের  গন্তব্যস্থল। মূসা (আঃ) সেখানে গেলেন এবং খিযিরের সাথে পথ চলে তার অগাধ জ্ঞানের  কিছুটা উপলব্ধি করলেন। খিযিরের সাথে সাক্ষাৎ ঘটানোর মাধ্যমে আল্লাহ মূসা (আঃ)-এর  ভুল সংশোধন করে দিলেন।

            ইউনুস (আঃ)-এর ভুল : ইউনুস (আঃ) বর্তমান ইরাকের মূছেল নগরীর নিকটবর্তী ‘নীনাওয়া’ জনপদের  অধিবাসীদের প্রতি প্রেরিত হন। তিনি তাদেরকে তাওহীদের দাওয়াত দেন এবং ঈমান ও  সৎকর্মের প্রতি আহবান জানান। কিন্তু তারা তাঁর প্রতি অবাধ্যতা প্রদর্শন করে।  বারবার দাওয়াত দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হ’লে আল্লাহর হুকুমে তিনি এলাকা ত্যাগ করে চলে  যান। ইতিমধ্যে তার কওমের উপরে আযাব নাযিল হওয়ার পূর্বাভাস দেখা দিল। জনপদ ত্যাগ  করার সময় তিনি বলে গিয়েছিলেন যে, তিনদিন পর সেখানে গযব নাযিল হ’তে পারে। তারা  ভাবল, নবী কখনো মিথ্যা বলেন না। ফলে ইউনুসের কওম ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে দ্রুত কুফর ও  শিরক হ’তে তওবা করে এবং জনপদের সকল আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা এবং গবাদিপশু সব নিয়ে জঙ্গলে  পালিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে তারা বাচ্চাদের ও গবাদিপশুগুলিকে পৃথক করে দেয় এবং নিজেরা  আল্লাহর দরবারে কায়মনোচিত্তে কানণাকাটি শুরু করে দেয়। তারা সর্বান্তকরণে তওবা করে  এবং আসন্ন গযব হ’তে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করে। ফলে আল্লাহ তাদের তওবা কবুল  করেন এবং তাদের উপর থেকে আযাব উঠিয়ে নেন। এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন, فَلَوْلاَ  كَانَتْ قَرْيَةٌ آمَنَتْ  فَنَفَعَهَا إِيمَانُهَا  إِلاَّ قَوْمَ يُوْنُسَ لَمَّا  آمَنُوْا كَشَفْنَا عَنْهُمْ عَذَابَ  الْخِزْيِ فِي  الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَمَتَّعْنَاهُمْ  إِلَى حِيْنٍ- ‘অতএব কোন জনপদ কেন এমন হ’ল না যে, তারা এমন সময় ঈমান নিয়ে আসত, যখন ঈমান  আনলে তাদের উপকারে আসত? কেবল ইউনুসের কওম ব্যতীত। যখন তারা ঈমান আনল, তখন আমরা তাদের  উপর থেকে পার্থিব জীবনের অপমানজনক আযাব তুলে নিলাম এবং তাদেরকে নির্ধারিত সময়  পর্যন্ত জীবনোপকরণ ভোগ করার অবকাশ দিলাম’ (ইউনুস ১০/৯৮)। অত্র আয়াতে ইউনুসের  কওমের প্রশংসা করা হয়েছে।

            ওদিকে ইউনুস (আঃ)  ভেবেছিলেন যে, তাঁর কওম আল্লাহর গযবে ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু পরে যখন তিনি জানতে  পারলেন যে, আদৌ গযব নাযিল হয়নি, তখন তিনি চিন্তায় পড়লেন যে, এখন তার কওম তাকে  মিথ্যাবাদী ভাববে এবং মিথ্যাবাদীর শাস্তি হিসাবে প্রথা অনুযায়ী তাকে হত্যা করবে।  তখন তিনি জনপদে ফিরে না গিয়ে অন্যত্র হিজরতের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন। এ সময়  আল্লাহর হুকুমের অপেক্ষা করাটাই যুক্তিযুক্ত ছিল। কিন্তু তিনি তা করেননি।

            আল্লাহর হুকুমের  অপেক্ষা না করে নিজস্ব ইজতিহাদের ভিত্তিতে ইউনুস (আঃ) নিজ কওমকে ছেড়ে এই হিজরতে  বেরিয়েছিলেন বলেই অত্র আয়াতে তাকে মনিবের নিকট থেকে পলায়নকারী বলা হয়েছে। যদিও  বাহ্যত এটা কোন অপরাধ ছিল না। কিন্তু পয়গম্বর ও নৈকট্যশীলগণের মর্তবা অনেক  ঊর্ধ্বে। তাই আল্লাহ তাদের ছোট-খাট ত্রুটির জন্যও পাকড়াও করেন। ফলে তিনি আল্লাহর  পরীক্ষায় পতিত হন। হিজরতকালে নদী পার হওয়ার সময় মাঝ নদীতে হঠাৎ নৌকা ডুবে যাবার উপক্রম হ’লে  মাঝি বলল, একজনকে নদীতে ফেলে দিতে হবে। নইলে সবাইকে ডুবে মরতে হবে। এজন্য লটারী  হ’লে পরপর তিনবার তাঁর নাম আসে। ফলে তিনি নদীতে নিক্ষিপ্ত হন। সাথে সাথে আল্লাহর  হুকুমে বিরাটকায় এক মাছ এসে তাঁকে গিলে ফেলে। কিন্তু মাছের পেটে তিনি হযম হয়ে  যাননি। বরং এটা ছিল তাঁর জন্য নিরাপদ কয়েদখানা (ইবনে কাছীর, আম্বিয়া ২১/৮৭-৮৮)। মাওয়ার্দী বলেন, মাছের পেটে অবস্থান করাটা  তাঁকে   শাস্তি  দানের উদ্দেশ্যে ছিল না।  বরং আদব শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে ছিল। যেমন পিতা  তার শিশু সন্তানকে শাসন করে শিক্ষা দিয়ে থাকেন’ (কুরতুবী, আম্বিয়া ২১/৮৭)

            ইউনুসের ক্রুদ্ধ হয়ে নিজ  জনপদ ছেড়ে চলে আসা, মাছের পেটে বন্দী হওয়া এবং ঐ অবস্থায় আল্লাহর নিকটে ক্ষমা  প্রার্থনা করা সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,

           

وَذَا النُّوْنِ  إِذْ ذَهَبَ  مُغَاضِباً فَظَنَّ أَن  لَّنْ نَقْدِرَ عَلَيْهِ  فَنَادَى فِي الظُّلُمَاتِ أَن لاَّ إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ سُبْحَانَكَ  إِنِّيْ كُنْتُ مِنَ الظَّالِمِيْنَ، فَاسْتَجَبْنَا لَهُ  وَنَجَّيْنَاهُ مِنَ الْغَمِّ  وَكَذَلِكَ  نُنْجِي الْمُؤْمِنِيْنَ-

            ‘আর মাছওয়ালা (ইউনুস)-এর কথা স্মরণ কর, যখন সে  (আল্লাহর অবাধ্যতার কারণে লোকদের উপর) ক্রুদ্ধ হয়ে চলে গিয়েছিল এবং মনে করে ছিল  যে, আমরা তার জন্য শাস্তি নির্ধারণ করব না। অতঃপর সে (মাছের পেটে) অন্ধকারের মধ্যে  আহবান করল (হে আল্লাহ!) তুমি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তুমি পবিত্র। আমি  সীমালংঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত। অতঃপর আমরা তার আহবানে সাড়া দিলাম এবং তাকে  দুশ্চিন্তা হ’তে মুক্ত করলাম। আর এভাবেই আমরা বিশ্বাসীদের মুক্তি দিয়ে থাকি’ (আম্বিয়া ২১/৮৭-৮৮)

            মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর ভুল  : রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনেও বিভিন্ন সময়ে ভুল সংঘটিত হয়েছে।  যেমন-

            (১) হিজরতের পরে তাবীর  সংক্রান্ত ঘটনা : রাফে‘ ইবনু খাদীজ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন,  নবী করীম (ছাঃ) যখন মদীনায় আসলেন, তখন মদীনার লোকেরা খেজুর গাছে তাবীর (পরাগায়ন)  করছিল। রাসূল (ছাঃ) তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা এরূপ কেন করছ? তারা উত্তরে বলল,  আমরা বরাবরই এরূপ করে আসছি। তিনি বললেন, তোমরা এরূপ  না করলেই হয়তো উত্তম হ’ত। সুতরাং তারা এ কাজ ত্যাগ করল। কিন্তু তাতে ফলন কম হ’ল।  (রাবী বলেন,) লোকেরা এ কথা রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে বলল। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, আমি  (তোমাদের ন্যায়) একজন মানুষ। আমি তোমাদের দ্বীন সম্পর্কে তোমাদেরকে কোন বিষয়ে  নির্দেশ দিলে তা তোমরা গ্রহণ করবে। আর আমি যখন (তোমাদের দুনিয়া সম্পর্কে) আমার  নিজের মত অনুসারে তোমাদেরকে কোন বিষয়ে নির্দেশ দেই, তখন (মনে করবে যে) আমিও একজন  মানুষ (আমারও ভুল হ’তে পারে)।[1]

            (২) ছালাত আদায়ের  ক্ষেত্রে : আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল  (ছাঃ) একদা আমাদের বিকালের এক ছালাতে ইমামতি করলেন।… আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন,  তিনি আমাদের নিয়ে দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করে সালাম ফিরালেন। অতঃপর মসজিদে রাখা এক  টুকরা কাঠের উপর ভর দিয়ে দাঁড়ালেন। তাঁকে রাগান্বিত মনে হচ্ছিল। তিনি স্বীয় ডান  হাত বাম হাতের উপরে রেখে এক হাতের আঙ্গুল অপর হাতের আঙ্গুলের মধ্যে প্রবেশ করালেন।  আর তাঁর ডান গাল বাম হাতের পিঠের উপর রাখলেন। যাদের তাড়া ছিল তারা মসজিদের দরজা দিয়ে  বাইরে চলে গেলেন। ছাহাবীগণ বললেন, ছালাত কি সংক্ষিপ্ত হয়ে গেছে? উপস্থিত লোকজনের  মধ্যে আবু বকর (রাঃ) ও ওমর (রাঃ)ও ছিলেন। কিন্তু তাঁরা নবী করীম (ছাঃ)-এর সঙ্গে  কথা বলতে ভয় পেলেন। আর লোকজনের মধ্যে লম্বা হাত বিশিষ্ট এক ব্যক্তি ছিলেন, যাকে  ‘যুল-ইয়াদায়ন’ বল হ’ত। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আপনি কি ভুলে গেছেন,  নাকি ছালাত সংক্ষেপ করা হয়েছে? তিনি বললেন, আমি ভুলিনি এবং ছালাত সংক্ষেপও করা  হয়নি। অতঃপর (তিনি অন্যদের) জিজ্ঞেস করলেন, যুল-ইয়াদায়নের কথা কি ঠিক? তারা বললেন,  হ্যাঁ। অতঃপর তিনি এগিয়ে এলেন এবং ছালাতের বাদপড়া অংশটুকু আদায় করলেন। অতঃপর সালাম  ফিরালেন ও তাকবীর বললেন এবং স্বাভাবিকভাবে সিজদার মত বা একটু দীর্ঘ সিজদাহ করলেন।  অতঃপর তাকবীর বলে তাঁর মাথা উঠালেন। পরে পুনরায় তাকবীর বললেন এবং স্বাভাবিকভাবে  সিজদার মত বা একটু দীর্ঘ সিজদাহ করলেন। অতঃপর তাকবীর বলে মাথা উঠালেন। … অতঃপর  তিনি সালাম ফিরালেন।[2]

            (৩) বদরযুদ্ধের পরে  বন্দীদের ব্যাপারে : রাসূল (ছাঃ) বদর যুদ্ধের বন্দীদের ফিদইয়া নিয়ে  ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে আল্লাহ এ আয়াত নাযিল করে তার ভুল সংশোধন করে দেন।  আল্লাহ বলেন,

           

مَا كَانَ لِنَبِيٍّ  أَنْ يَكُوْنَ لَهُ أَسْرَى حَتَّى يُثْخِنَ  فِي الأَرْضِ تُرِيْدُوْنَ  عَرَضَ الدُّنْيَا وَاللهُ يُرِيْدُ  الآخِرَةَ وَاللهُ عَزِيْزٌ حَكِيْمٌ-

            ‘দেশে ব্যাপকভাবে শত্রুকে পরাভূত না করা পর্যন্ত  বন্দী রাখা কোন নবীর জন্য সংগত নয়। তোমরা কামনা কর পার্থিব সম্পদ এবং আল্লাহ চান  পরলোকের কল্যাণ। আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়’ (আনফাল ৮/৬৭)

            আল্লাহ মানুষের ভুল-ত্রুটি ও অপরাধ ক্ষমা করে  দেন। মৃত্যুর পূর্বে তওবা করলে বড় অপরাধও আল্লাহ মাফ করে দেন। কিন্তু আল্লাহর  সাথে নাফরমানী করলে, সীমালংঘন করলে এবং মৃত্যু আসার পূর্বে তওবা না করলে তাকে  আল্লাহ ক্ষমা করেন না। যেমন ফেরাঊনের ঘটনা জগৎবাসীর জন্য শিক্ষণীয় উপমা হয়ে আছে।

            ফেরাঊন ছিল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অত্যাচারী। আল্লাহ  বলেন, مِنْ فِرْعَوْنَ إِنَّهُ كَانَ عَالِياً مِّنَ الْمُسْرِفِيْنَ ‘ফেরাঊন সে ছিল সীমালংঘনকারীদের মধ্যে  শীর্ষস্থানীয়’ (দুখান ৪৪/৩১)। সে জীবনের শেষ মুহূর্তে নিজের ভুল সম্পূর্ণরূপে বুঝতে  সক্ষম হয়েছিল। আল্লাহ বলেন, ‘আমি বনী ইসরাঈলকে সাগর পার করালাম আর ফেরাঊন ও তার সেনাবাহিনী শত্রুতা করে ও সীমালংঘন করে তাদের পিছে  ধাওয়া করল। অবশেষে পানিতে যখন সে ডুবে যাচ্ছে তখন সে বলল, আমি বিশ্বাস করলাম যে,  বনী ইসরাঈল যাঁর উপর বিশ্বাস করে আমি তাদের একজন। আল্লাহ বললেন, এখন! এর আগে তুমি  তো অমান্য করেছ আর তুমি ছিলে এক ফাসাদ সৃষ্টিকারী। আজ আমরা তোমার দেহকে সংরক্ষণ  করব, যাতে তুমি পরবর্তীদের নিদর্শন হয়ে থাক। অবশ্য মানুষের মধ্যে অনেকেই আমার  নিদর্শন সম্বন্ধে খেয়াল করে না’ (ইউনুস ১০/৯০-৯২)

            আমরা জানি, আল্লাহ তাঁর ইবাদত করার জন্য মানুষ  সৃষ্টি করেছেন। এই ইবাদতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হচ্ছে ছালাত। এই ছালাত আদায়ের সময় হঠাৎ  ভুল হয়ে যায়। অতঃপর আল্লাহর দেওয়া বিধান মত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অনুসরণে  সহো-সিজদার মাধ্যমে তা সংশোধন করা হয়। কিন্তু কেউ যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল ছালাত পড়ে  নিশ্চিন্ত থেকে যায়। তবে তার সব আমল এবং তার ভবিষৎ জীবন ধ্বংস হয়ে যাবে। মহান  আল্লাহ বলেন,وَلَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنَاحٌ فِيمَا أَخْطَأْتُم بِهِ  وَلَكِن مَّا تَعَمَّدَتْ قُلُوبُكُمْ  ‘ভুল করে (কোন কাজ) করলে পাপ হবে না, ইচ্ছায়  করলে পাপ হবে’ (আহযাব ৩৩/৫)

            আল্লাহ মানুষের প্রতি যে কোন বিধান, আদেশ, উপদেশ  অবতীর্ণ করেছেন, তা ভুলে যাওয়ার বিষয় নয়। যেমন জন্ম-মৃত্যু, কবর, পুনরুত্থান,  কিয়ামত, জান্নাত-জাহান্নাম ইত্যাদি। এগুলির প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে বহু আয়াত নাযিল  হয়েছে। এগুলোর প্রতি বিশ্বাস না থাকলে এবং এগুলি বিশ্বাস করেও আমল না করলে পরকালে  শাস্তি পেতে হবে। আল্লাহ বলেন,فَذُوْقُوْا بِمَا نَسِيْتُمْ  لِقَاء يَوْمِكُمْ هَذَا إِنَّا نَسِيْنَاكُمْ وَذُوْقُوْا  عَذَابَ الْخُلْدِ بِمَا كُنتُمْ تَعْمَلُوْنَ ‘অতএব এ দিবসকে ভুলে  যাওয়ার কারণে তোমরা স্বাদ আস্বাদন কর। আমরাও তোমাদের ভুলে গেলাম। তোমরা তোমাদের  কৃতকর্মের কারণে স্থায়ী আযাব ভোগ কর’ (সাজদাহ ৩২/১৪)

            সুতরাং ভুল আমাদের নিত্য সঙ্গী। শ্রেষ্ঠ ইবাদত  ছালাতেই যদি ভুল হয়, তবে জীবিকা নির্বাহের জন্য সাধারণ কাজ-কর্মে, কথাবার্তায়,  চলাফেরা ইত্যাদিতে কত ভুল হয় তা আল্লাহপাকই ভাল জানেন। ভুলটি জ্ঞাতসারে না  অজ্ঞাতসারে, ইচ্ছায় না অনিচ্ছায়, এটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। অনিচ্ছাকৃত হ’লে  এখানেও ক্ষমার পথ আছে, অন্যায়-অবিচার, ব্যভিচার, প্রতারণা ইত্যাদি করে ভুলের দোহাই  দিয়ে পার পাওয়া যাবে না। আল্লাহ অন্তর্যামী, তিনি সবই জানেন। মহান আল্লাহ বলেন, يَعْلَمُ خَائِنَةَ الْأَعْيُنِ وَمَا تُخْفِي الصُّدُوْرُ ‘চোখের চুরি এবং অন্তরের গোপন বিষয় তিনি জানেন’ (মুমিন ৪০/১৯)। আল্লাহ আমাদেরকে ভুল হ’তে সাবধান থাকার তওফীক  দান করুন- আমীন!

           



               


               

                  [1]. মুসলিম  হা/২৩৬২; মিশকাত হা/১৪৭।

               

             

                  [2]. বুখারী হা/৪৮২।

             

           

১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

Back to top button