ইতিহাস

ইতিহাস কথা বলে – ৩

-মেহেদী আরীফ

ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতার সূর্য সন্তানেরা

ভারতের অস্তমিত স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের অভিপ্রায়ে, স্বাধীনতাকামী মানুষের মুখে একটু হাসি ফোটানোর জন্য নিজেদের জীবনকে যারা সঁপে দিয়েছেন, তাঁরা আজ হারিয়ে যাচ্ছেন সাধারণের মনের খাতা থেকে, পুরাতন পুস্তকের জীর্ণশীর্ণ পৃষ্ঠা থেকে, ঐতিহাসিকদের কলমের অাঁচড় থেকে। ইতিহাস বিজেতাদের পক্ষে লেখা হয়। আজ ইতিহাসের ফাঁপা বেলুন ঐতিহাসিকের কলমের খোঁচায় চোপসে গেছে। ঐতিহাসিকের কলম আজ ভোঁতা হয়ে গেছে, মিথ্যা ইতিহাস লিখে লিখে মরিচা ধরেছে তাদের কলমে। ইতিহাস নিজে নিজে তৈরি করলে সেটা ইতিহাস হয় না, সর্বোচ্চ সেটা একটা সাহিত্য কর্ম কিংবা বিশাল এক গ্রন্থের স্তূপ তৈরী হয়। ইতিহাসের ঘটনাকে পুঁজি করে এলোমেলো করে সাজালে সাহিত্য লেখার পাশাপাশি মানুষকে অপমানও করা হয়। ইতিহাসের মহানায়কেরা যদি ভিলেনে পরিণত হন, তার জন্য দায়ী একজন ভ্রান্ত ঐতিহাসিক, একজন চাটুকার সাহিত্যিক কিংবা একজন লোভী বক্তা।

মানুষের মগযে ভ্রান্তির ইন্দ্রজাল ছড়িয়ে দেওয়ার পিছনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন ঐতিহাসিক আর সাহিত্যিকেরা। তিলকে তাল করার কারণে মানুষের মগযে বিশ্বাসের জায়গাটা ফাঁপা বেলুনের মত হয়ে গেছে। মানুষ তাই ক্ষুধার্ত কাকের মত সত্য ও মিথ্যা হাতড়াতে থাকে। একটা অসাধারণ সৃষ্টিকে কেউ যদি নতুন করে আবার সৃষ্টি করতে চায়, তাহলে তা বোকামির সর্বোচ্চ মাত্রাকে অতিক্রম করে। ভারতের ইতিহাসের অনেক সত্য ঘটনা ও চরিত্রকে আড়াল করে অবুঝ সাহিত্যিকেরা চরিত্রের মহিমা বর্ণনা করে কিংবা চরিত্রকে কলুষিত করে এমনভাবে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেছেন, যে সাধারণ পাঠকশ্রেণী এটাকে অসাধারণ মনে করে উল্টো পথে উল্টো রথে হাঁটা শুরু করেছে। বিকৃত লেখা উপযুক্ত পাঠকের কাছে ধিক্কৃত হলেও সাধারণের কাছে যে স্বীকৃত এ ব্যাপারে কারো বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকার কথা নয়। ইতিহাসের কালো অধ্যায় মানুষের জ্ঞানের সীমা-পরিসীমার বাইরে চলে গেলে মানুষ যা পড়ে তাতেই বিশ্বাস স্থাপন করে। আলোচনা-সমালোচনা কিংবা পর্যালোচনার তোয়াক্কা না করে পাঠকগণ নিজেদের মনগড়া তথ্যে ভরাট করেছেন পৃষ্ঠা, তৈরি করেছেন ইতিহাস, এ যেন কারিগরের হাতে গড়া শিবের মূর্তি। ভারতের ইতিহাস থেকে মুসলিম নেতৃত্বের ও কৃতিত্বের প্রভাব দারুণভাবে এড়িয়ে গেছে মিথ্যুক ঐতিহাসিকদের ধারালো কলম। এখন সময় এসেছে সত্য কথা অকপটে স্বীকার করার। সত্য চিরদিন সত্য, মিথ্যার ফ্রেম থেকে এক সময় সত্য বের হয়ে এসে সকালের সূর্যের মত জেগে ওঠে আপন শক্তিতে। ভারতের স্বাধীনতার সূর্য সন্তানদের ইতিহাস পাঠকদের অনুপ্রেরণার দারুণ এক উৎস হিসাবে কাজ করবে। সত্য ইতিহাস পাঠককে নিজেদের জ্ঞানের অসারতাকে অগ্রাহ্য করে সত্য জ্ঞানের রাজ্যে বিচরণের পরিবেশ তৈরি করবে ইনশাআল্লাহ।

শাহ অলিউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলভী (রহঃ) : ভারতের স্বাধীনতা বিপ্লবের ইতিহাসের প্রথম মশালবাহক

জন্ম ও বংশ পরিচয় :

শাহ্ অলিউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলভী (রহঃ) ১৭০৩ খ্রীস্টাব্দে উত্তর ভারতের মুযাফফরনগর যেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মূল নাম আহমাদ, উপাধি আবুল ফাইয়ায, ঐতিহাসিক নাম আযীমুদ্দীন। তবে বিশ্বে তিনি অলিউল্লাহ নামে সমধিক পরিচিত।

ভারতগুরু শাহ অলিউল্লাহ (রহঃ)-এর ৩১তম ঊর্ধ্বতন পুরুষ ছিলেন খীলফা ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) এবং তাঁর মাতা ছিলেন ইমাম মূসা আল-কাজিমের বংশধর। শাহ অলিউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলবী (রহঃ) ছিলেন মুজাদ্দিদে আলফে ছানী (রহঃ)-এর আদর্শ ও চিন্তা-চেতনার বলিষ্ঠ উত্তরাধিকারী ও মানস সন্তান। 

শিক্ষা জীবন :

ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে, ‘Morning shows the day’ দিনটি কেমন যাবে তা সকালকে দেখে অাঁচ করা যায়। তাই বুঝি ভারতবর্ষের ভগ্ন সমাজে অলিউল্লাহর উপস্থিতিতে একজন মহা মনীষীর আগমনী বার্তা পাওয়া গিয়েছিল। অত্যন্ত  মেধাবী এই ভারতরত্ন  ‘যুযবে লতীফ’ নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন  যে, ‘যখন আমার বয়স পাঁচ বছর, তখন মক্তবে ভর্তি হই এবং আমার পিতার নিকট  ফার্সী ভাষা শিক্ষা করি। সাত বছর বয়সে আমার পিতা আমাকে ছালাত আদায়ের অনুমতি দেন এবং ঐ বছরে আমি কুরআনের হিফয সমাপ্ত করি’। পনের বছর বয়সে তিনি তাফসীর, হাদীছ, ফিক্ব হ, তর্কশাস্ত্র, চিকিৎসাশাস্ত্র, জ্যামিতি ইত্যাদি বিষয়ে বুৎপত্তি অর্জন করেন, যা কোন মানুষের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। এই পনের বছর বয়সেই তিনি পিতার নিকট থেকে আধ্যাতিকতার সবক গ্রহণ করেন। মাত্র সতের বছর বয়সে তিনি পিতার  নিকট  থেকে বায়‘আত গ্রহণ করার অনুমতি পান। ১১৪৩ হিজরীতে তিনি মদিনা গমন করেন এবং শায়খ আবু তাহের কুর্দীর সান্নিধ্যে এসে ছহীহ বুখারীর পাঠ শুরু করেন।

তাঁর কাছ থেকে তিনি হাদীছ পাঠদান ও সনদ প্রদানের অনুমতি লাভ করেন। উস্তাদ কুর্দী ছাহেব প্রায়ই তাকে বলতেন, ‘অলিউল্লাহ আমার নিকট থেকে শব্দের সনদ নিচ্ছে, আর আমি তার নিকট থেকে অর্থের সনদ নিচ্ছি’।

কর্মজীবন :

শাহ্ ছাহেবের বয়স যখন মাত্র সতের তখন তাঁর প্রাণপ্রিয় পিতা মৃত্যুবরণ করেন। পিতার মৃত্যুর পর তিনি মাদরাসা রহীমিয়াতে শিক্ষকতার কাজ শুরু করেন। তিনি একটানা বার বছর এই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেন। সমাজের সামাজিক ও রাজনৈতিক উত্থান-পতন দেখে তিনি খুবই বিচলিত হন। তিনি উপলব্ধি করেন যে, পথভোলা মুসলিম উম্মাহকে চলমান অন্ধত্ব ও কুসংস্কার থেকে বাঁচাতে হলে তিনটি বিষয়ে তাদেরকে প্রজ্ঞাবান হওয়া অতীব প্রয়োজন। বিষয়গুলো হল-

১. যুক্তিদর্শন : তর্কশাস্ত্রের মনগড়া প্রশ্নের অযথা আমদানিতে মুসলিম মননে নানা ধরনের ফেতনা-ফাসাদ এসে দানা বাঁধে। মুসলিম সমাজ গ্রিক দর্শনের আমদানিতে মগজকে পরিপুষ্ট করার প্রতিযোগিতায় নেমেছিল। সুতরাং এই সমাজকে মুক্ত করতে গেলে যুক্তিদর্শনের চর্চা করতে হবে। বিষয়টি কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মত।  

২. আধ্যাত্মিক দর্শন : তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থায় ছূফীবাদের প্রভাব খুব বেশি প্রকট হয়েছিল। কুরআন ও সুন্নাহকে বাদ দিয়ে মানুষ আধ্যাত্মিক সাধনার ভিতরে হাবুডুবু খাচ্ছিল। আধ্যাত্মিক সাধনা সে যুগে শিক্ষার একটা বড় অঙ্গে পরিণত হয়েছিল। এ কারণে শাহ্ ছাহেব ভাবলেন যে, এ ব্যাপারে সাধারণ মানুষের ধারণা থাকতে হবে।   

৩. ইলম বির-রিওয়ায়াহ : নবী করীম (ছাঃ)-এর মাধ্যমে যে জ্ঞান পৃথিবীব্যাপী প্রসার লাভ করেছিল তা হল, কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর জ্ঞান। মানুষ যাতে করে মস্তিষ্ক প্রসূত কোন কথা বা কাজ না করে, জাগতিক ও আধ্যাত্মিক জীবনে যেন নিজের খেয়াল খুশি ও দলীয় গোঁড়ামীর আবরণে বন্দি না হয়, সে জন্য শাহ ছাহেব আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন।

মানুষের ভিতরকার আত্মকেন্দ্রিকতা ও আত্মঅহমিকা তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার একটা সাধারণ চিত্র ছিল। মানুষের মাঝে কুরআন ও সুন্নাহর বার্তা পৌঁছিয়ে দেওয়া ছিল তাঁর লক্ষ্য। কারণ তিনি চেয়েছিলেন কুরআন ও সুন্নাহভিত্তিক একটি শক্তিশালী মুসলিম সমাজ।

গ্রন্থাবলী :

শাহ অলিউল্লাহ ১১৪৬ হিজরীতে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর থেকে ইন্তিকাল পর্যন্ত প্রায় ত্রিশ বছর যাবৎ শুধু রচনার কাজে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন।

ভারতগুরু শাহ অলিউল্লাহ প্রণীত গ্রন্থাবলীর সংখ্যা শতাধিক। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, তাঁর সব বইগুলো সংরক্ষিত হয়নি। তার লিখিত বইয়ের ভিতরে কুরআন মাজীদের তরজমা ‘ফৎহুর রহমান’ উল্লেখযোগ্য। এটা কুরআনের সংক্ষিপ্ত অথচ জ্ঞানগর্ভ তরজমা। তার এ পর্যায়ে গ্রন্থের মধ্যে মুক্বাদ্দমা ফী তারজুমাতিল কুরআন, আল-ফাওযুল কবীর এবং আল-ফাতহুল কাবীর। তাঁর হাদীছের উপর লিখিত গ্রন্থের মধ্যে ইমাম মালিকের বিশ্বখ্যাত মুওয়াত্ত্বার আরবী শরাহ। ফিকহ শাস্ত্রের মধ্যে রয়েছে আল-ইনছাফ ও ইকদুল জীদ ফী আহকামিল ইজতিহাদ ওয়াত তাক্বলীদ। তাছাউফ সংক্রান্ত বইয়ের মধ্যে ফায়াসালাতু ওয়াহাদাতিল ওয়াজুদ ওয়াশ শাহুদ,  আল-ক্বওলুল জামীল, তাফহীমাতুল-ইলাহিয়া, ফয়ুযুল হারামাইন, আল-খায়রুল-কাসীর, সাৎয়াত ও লুময়াত বিখ্যাত। এছাড়া হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ তার জগদ্বিখ্যাত এক গ্রন্থ। মাওলানা মনযির আহসান গিলানীর ভাষায়, ‘আমি এ গ্রন্থটির ন্যায় মানব রচিত এমন কোন গ্রন্থ দেখিনি, যাতে ইসলামকে পরিপূর্ণ জীবন-বিধান হিসাবে সুসংবদ্ধভাবে তুলে ধরা হয়েছে’।

বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ মওলানা নূর মুহাম্মদ আযমী তাঁর  ‘নেজামে তালীন’ নামক পুস্তকে মন্তব্য করে বলেন, ‘আমার মতে আল্লাহর কিতাব ও সুন্নাহর পরে এটাই সর্বোৎকৃষ্ট কিতাব। কেননা এতে এমন সব জ্ঞান সমৃদ্ধ বিষয় রয়েছে, যা অপর কোন গ্রন্থে নেই, যা কোন চক্ষু দেখেনি, কানে শোনেনি, এমনকি কেউ অন্তর দিয়েও উপলব্ধি করেনি। মূলত এটা হচ্ছে কুরআন ও সুন্নাহর ব্যাখ্যা, অথচ পূর্ণ নির্ভরযোগ্য বরং বলা চলে মুহাম্মদী শরী‘আতের নির্যাস’।         

শাহ্ অলিউল্লাহর সংস্কার আন্দোলন ও বিপ্লবী কর্মসূচী :

আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর ভারতবর্ষে ইংরেজদের একচেটিয়া রাজত্ব মুসলমানদের মেরুদন্ডকে ভেঙে দিয়েছিল। মুসলিমদের শোচনীয় পরাজয়ের পিছনে যে বিষয়টি মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল তা হল তাদের ধর্মীয় ও নৈতিক অধঃপতন।

উপমহাদেশের সংকটময় মুহূর্তে হাতে গোনা যে কয়জন সাহসী নওজোয়ান, বীর-মুজাহিদ মুসলমানদের হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার চিন্তায় বিভোর ছিলেন শাহ্ অলিউল্লাহ তাদের মাঝে অন্যতম এক পুরোধা ব্যক্তিত্ব। সাম্রাজ্যবাদীদের কাল থাবা ও নীল নকশা থেকে ঘুমন্ত জাতিকে জাগিয়ে তুলতে তিনি ইসলামী সংস্কার আন্দোলনে মন দেন। সমাজের বুকে প্রচলিত অনৈসলামিক রীতিনীতি, অনাচার ও কুসংস্কারের নিত্য খেলার মূলোৎপাটন করার প্রাণান্তকর চেষ্টা করেন। পীরপূজা, কবরপূজা, কেরামতি প্রভৃতির উচ্ছেদের জন্য তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেন। ছূফীবাদের নেতিবাচক প্রভাব সমাজকে করে তুলেছিল বিকৃত ও কলুষিত। তিনি ছূফীবাদকে ঢেলে সাজাতে চেয়েছিলেন।

বস্ত্তবাদী চিন্তার বন্যায় ভেসে গিয়েছিল মুসলিম উম্মাহর অনুর্বর মস্তিষ্ক। বস্ত্তবাদীদের পুশ করা ইনজেকশনে হতবিহবল হয়ে পড়েছিল মুসলিম মনন। আলো-অাঁধারের ভেল্কিতে কান্ডজ্ঞান হারিয়ে বিপদগামী হয়ে পড়া মুসলিমদেরকে জাগিয়ে তুলতে কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে সমাজনীতি, অর্থনীতি, রাজনীতি প্রভৃতি বিষয়ে তিনি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করেন, যা তাঁর হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগায় প্রমাণ মেলে। সবকিছু যে কুরআন ও সুন্নাহর কষ্টি পাথরে চমৎকারভাবে পরিবেশন করা যায় তা তিনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের মন, মেজাজ, খাদ্যাভ্যাস, চাল-চলন, আচার-আচরণ, রীতি-নীতিতে পরিবর্তন ঘটে। মাঝেমাঝে মানুষ নতুনকে এমনভাবে শুভেচ্ছা জানায়, যে তাঁর অতীত বলতে আর কিছু থাকে না।

তখন তারা মিছে আলেয়ায় দৌঁড়াতে থাকে। দিগ্বিদিক ছুটতে থাকা এই অবুঝ মানুষগুলোকে নিয়ে শাহ্ ছাহেব খুব বেশি ভেবেছিলেন। ধর্মীয় বিধিবিধানকে সহজভাবে মানুষের সামনে উপস্থাপন করার অভিপ্রায় ছিল তার চমৎকার একটা দিক।

তিনি কুরআন ও হাদীছকে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু ইসলামের সনাতন ধারা থেকে বের হয়ে আসেননি। কারণ ইসলাম কারও ইচ্ছায় পরিচালিত হয় না। তিনি বিশ্বাস করতেন, এটা আল্লাহর দেওয়া একটা জীবন বাবস্থা। কারও মনগড়া সিদ্ধান্তে ইসলাম এক পাও আগাতে পারে না, এটাই শরী‘আত।

মক্কা-মদীনায় অবস্থানকালে শাহ ছাহেব ইজতিহাদের উপযোগী গুণাবলী ও যোগ্যতা অর্জন করেন। শিবলী বলেন, ‘ইবনে রুশদ ও ইমাম ইবনে তাইমিয়ার পর মুসলিম জগতের যে চরম অবনতি ঘটেছিল, তাকে পুনরায় উজ্জীবিত করেন শাহ্ অলিউল্লাহ দেহলভী (রহঃ)। 

অলিউল্লাহ ছাহেব মক্কা গমনের আগে সমাজকে যেমন দেখেন, মক্কা থেকে দেশে ফেরার পর সমাজের অসারতা তার চোখে আরও বেশি স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়। মানুষ কুরআন ও সুন্নাহ ভুলে গিয়ে ভন্ড পীরের মুরীদ বনে গিয়েছিল। আবুল মুযাফফর মুহিউদ্দিন আলমগীর আওরঙ্গজেব চেয়েছিলেন উপমহাদেশে মহানবী (ছাঃ)-এর আদর্শকে পুনরুজ্জীবিত করতে। আর তার অযোগ্য ভাই দারাশিকো চেয়েছিলেন প্রপিতামহ আকবরের মতবাদকে প্রতিষ্ঠা করতে। এর পর থেকে মুসলিমদের ভিতরের ঐক্য বিনষ্ট হতে শুরু করে। মানুষেরা নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর দেখানো পথের চেয়ে পীরের দেওয়া ফাঁকা বুলি শোনার দিকে বেশি মন দিতে শুরু করে।  তার সংস্কার আন্দোলনের মূল দাবী ছিল, ‘প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা ভেঙ্গে দিয়ে নতুন করে সমাজ গড়তে হবে এবং বর্তমানে যে শাসন ব্যবস্থা রয়েছে তা পরিবর্তন করে নতুনভাবে শাসন ব্যবস্থা তৈরি করা একান্ত প্রয়োজন।

মুঘল সাম্রাজ্যের অধিপতি যহীরুদ্দীন মুহাম্মাদ বাবরের পুত্র হুমায়ুনের শাসনামলে ইরানী শী‘আদের মোঘল রাজ দরবারে প্রভাব বৃদ্ধি পেলে গ্রিক দর্শনের অনুপ্রবেশ বেশ প্রবল হয়। গ্রিক দর্শনকে জ্ঞানের মাপকাঠি তৈরি করার কারণে কুরআন ও সুন্নাহর গুরুত্ব অনেকটা ঠুনকো হয়ে যায়। এমতাবস্থায় শাহ্ অলিউল্লাহ (রহঃ) সর্বাগ্রে কুরআন ও সুন্নাহর গুরুত্বকে তুলে ধরে মাদ্রাসায়ে রহীমিয়ার সিলেবাসে আমূল পরিবর্তন আনেন, যা মুসলিম উম্মাহর জ্ঞানের পথে বিরাট এক দিগন্ত উন্মোচন করে।

আকবরের শাসনামলে ইসলামের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি সাধিত হয়েছিল। তার প্রচলিত দ্বীন-ই-ইলাহীর প্রভাবে মুসলিমরা শরী‘আতের মূল থেকে ক্রমশঃ ছিটকে পড়ছিল। এ রকম সংকটময় মুহূর্তে শাহ্ ছাহেব ভাবলেন যে, কুরআন ও সুন্নাহর যথাযথ প্রচার ও প্রসার হওয়া উচিত। সমাজের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের নিমিত্তে তিনি কুরআনের ফারসী অনুবাদ করেন, যার নাম ‘ফাৎহুর রহমান’। এ কাজ করতে গিয়ে তাকে অনেক বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। এক শ্রেণীর অর্ধ শিক্ষিত আলেম তার এই প্রচেষ্টাকে কুফরীর সমতুল্য গণ্য করে। এক পর্যায়ে তাকে কাফের বলে ফৎওয়াও দেওয়া হয়। কিন্তু বকের দো‘আতে যে গাঙ শুকিয়ে যায় না এটা তারা স্পষ্ট বুঝে উঠতে পারেনি। শাহ্ ছাহেব কুরআন ও হাদীছের প্রচার ও প্রসারে নিজের জীবনকে বিলিয়ে দেন। তার প্রথম কর্মসূচী ছিল মানুষকে কুরআনের পথে আহবান জানানো। কারণ তৎকালীন সময়ের মানুষেরা শিরক ও বিদ‘আতের সাগরে এমনভাবে হাবুডুবু খাচ্ছিল যে, হাদীছের উপর মানুষের বিশ্বাস ঠুনকো হয়ে পড়েছিল। ভারতীয় উপমহাদেশে নিয়মতান্ত্রিকভাবে তিনিই প্রথম হাদীছের দারস চালু করেন। [ক্রমশঃ]    

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button