ইতিহাস কথা বলে – ১
-মেহেদী আরীফ
ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ ও সত্যধর্মী ইতিহাসের বিস্তারিত আলোচনাই মূলতঃ ঐতিহাসিকদের কাজ। সত্যকে বিকৃত করে এবং বিকৃতকে সত্য বলে উপস্থাপন করা বিশ্বাসঘাতকতার নামান্তর। কিন্তু একশ্রেণীর পাশ্চাত্যের পদলেহী ও ইংরেজদের দালাল সদৃশ ঐতিহাসিকবৃন্দ সত্য ঘঠনাকে অতি কূটচালে বিকৃত করে ইতিহাস বিকৃত করেছেন ও করছেন। উল্লেখ্য যে, ভারতীয় উপমহাদেশ প্রায় সাড়ে সাতশত বছর মুসলমানদের করায়াত্তে ছিল। তাদের রয়েছে ত্যাগ-তিতিক্ষা, সম্মান-মর্যাদা, যশ-খ্যাতি ও উৎসর্গিত প্রাণের অনেক জ্বলন্ত ইতিহাস। অথচ ঐ সমস্ত পাশ্চাত্যপ্রেমী ঐতিহাসিকরা সেই সত্য ও জ্বলন্ত ইতিহাসকে করেছে বিকৃত, নির্লিপ্ত ও অবহেলিত। এর মাধ্যমে তারা মুসলিম জাতির সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। ক্ষতিগ্রস্থ করেছে মুসলিম জাতির ঐতিহ্য ও সুমহান আদর্শের বিশ্বময়তাকে। তাই ‘ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ কলামের মাধ্যমে জাতির সম্মুখে সত্য ইতিহাস, গ্রহণযোগ্য তথ্যসূত্রের মাধ্যমে উপস্থাপন করার লক্ষ্যেই আজকের এই ‘ইতিহাস কথা বলে’ প্রবন্ধটির অবতারণা
ইতিহাস কথা বলে, কথা বলে ঐতিহাসিকের কলম, কখনও শিশুর মত অস্ফুট স্বরে, আবার কখনও সিংহের মত গর্জন করে। রাজা হারিয়ে যায়, রাজত্ব অপরের হস্তগত হয়, রয়ে যায় নানা কাহিনী। কিছু বিষয় ঘটে আবার কিছু রটে, আবার কিছু বিষয় না ঘটেও রটে। এই ঘটে যাওয়া এবং কলম ফসকে রটে যাওয়া ঘটনাগুলো আশ্রয় পায় ইতিহাসে। আজ যেটা ঘটনা, কাল সেটা ইতিহাস। ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করেনা, মিথ্যার কালো বিড়াল ঠিকই বের হয়ে আসে। মানুষের ভিতরের শক্ত ইস্পাতসদৃশ বিশ্বাসকে টলানো সহজ কথা নয়, সেটা বদ্ধমূল হয়ে আছে মনের গহীন অন্দরে। মনের অন্দর থেকে বিশ্বাসের বন্দরে সত্যের তরী ভিড়ানো খুবই কঠিন ব্যাপার। সত্য ইতিহাস জানার পরও বিরোধিতা করার প্রবণতা যেমন ঐতিহাসিকের ভিতরে আছে, তেমনি আছে সাধারণ অবুঝ মানুষের ভিতরে। সত্য ইতিহাস আজ মিথ্যার চাঁদোয়ায় ঢাকা। আজ প্রচলিত মিথ্যা আর কুসংস্কারের কাঁটাতারের বেড়া থেকে বের হওয়া দুরূহ ব্যাপার। ঐতিহাসিকদের সাথে পাল্লা দিয়েছেন কবি, সাহিত্যিক, পুঁথি লেখকরাও। পুঁথিতে হযরত আলী (রাঃ)-কে নারীলোলুপ হিসাবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে (নাঊযুবিল্লাহ)। সুতরাং দেখা যায় যে, ঐতিহাসিকদের সাথে সাথে কবি, সাহিত্যিক, পুঁথি লেখকরাও কলঙ্কিত করেছেন ইতিহাসের পাতা। সে আলোচনাতে পরে আসব। ইংরেজ জাতি অসভ্য নিরক্ষর বাঙ্গালী জাতিকে সভ্য করার অভিপ্রায়ে ভারতবর্ষে আগমন করে। হিন্দু-মুসলমান হ’ল ব্রিটিশদের দুই বাহু। নিজ ইচ্ছায় মনোবাসনা চরিতার্থ করার জন্য তারা দুই জাতিকে ইচ্ছামত ব্যবহার করেছে। তাদের প্রশংসার ধরনটায় আলাদা। প্রশংসা শেষে সামান্য গোমূত্র প্রয়োগ করতে তারা এতটুকু দ্বিধাবোধ করেনি। ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করা অগ্নিকুন্ডে হাত দেওয়ার নামান্তর। আর এই অগ্নিকুন্ডে ঝাঁপ দেওয়ার দুঃসাহস দেখানো বড়ই দুঃসাধ্য। কিন্তু আল্লাহর উপর ভরসা করে আজ শুরু করব মুঘল ইতিহাস দিয়ে, পুরাতন ইতিহাসের ভস্ম নিয়ে গূঢ় রহস্যের সত্য উৎঘাটনে ব্রতী হব ইনশাআল্লাহ।
মুঘল সাম্রাজ্যের সত্য ইতিহাস : আকবারের উদ্ধত আচরণ
ইতিহাসের এক বিশাল জায়গা দখল করে আছে মুঘল সাম্রাজ্য। মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাস লিখতে গিয়ে ঐতিহাসিকের কলম কোথাও বক্রপথে চলেছে, কখনও পথ হারিয়ে ফেলেছে, কখনও আবার মানুষের বিশ্বাস নিয়ে ঐতিহাসিকেরা ইচ্ছামত খেলা করেছে। বোদ্ধা ঐতিহাসিকদের মতে, সবচেয়ে আলোচিত সম্রাট হলেন ‘মহামতি আকবর’। তিনি ইতিহাসে ‘আকবর দ্যা গ্রেট’ নামে পরিচিত।[1] মুঘল সাম্রাজ্যের মহাপ্রতাপশালী শাসক ছিলেন আকবর, যিনি তের বছর বয়সে ক্ষমতায় এসেছিলেন। প্রভাব, প্রতিপত্তি, অর্থ-যশ ও খ্যাতি মানুষকে যে অমানুষে পরিণত করে এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ ইতিহাসের ‘আকবর দ্যা গ্রেট’। এই গ্রেটকে নিয়ে আলোচনা করা অতীব যরূরী। একজন মুসলিম হিসেবে আরও যরূরী। তিনি ‘কালেমা তাইয়্যেবা’র আদলে নিজেই কালেমা চালু করলেন নিজের আধিপত্য টিকিয়ে রাখার জন্য। ইসলামের কালেমা তাইয়্যেবা হ’ল ‘লা ইলাহা ইলালাহু’। আকবর চালু করলেন, ‘লা ইলাহা ইলালাহু আকবর খলীফাতুলাহ’ (নাঊযুবিল্লাহ)। অন্য কোন ধর্মের অনুসারীরা এমন আঘাত দেওয়ার সাহস পায়নি, যেমনটি মহামতি আকবর পেয়েছিলেন। কুরআন যেখানে সুদ-ঘুষ হারাম করেছে, সেখানে গ্রেট আকবর তা হালালে পরিণত করেছিলেন। তার শাসনামলে নিষিদ্ধ জুয়া খেলাও প্রসিদ্ধ লাভ করেছিল। আকবর পর্দা প্রথার চরম বিরোধিতা করেছিলেন। মসজিদে আযান দেওয়া এবং ছালাত আদায় করা নিষিদ্ধ করেছিলেন তিনি। সালামের পরিবর্তে তিনি ‘আদাব’ দেওয়ার প্রথা চালু করেছিলেন।
আকবর ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের এক প্রতিমূর্তি। ধর্মনিরপেক্ষতা আসলে ধর্মহীনতার নামান্তর। ১৫৮২ সালে ‘দ্বীন-ই-ইলাহী’ গঠিত হয়েছিল বিভিন্ন ধর্মের সার নিয়ে। আকবর নিজেই রাতারাতি ধর্ম প্রবর্তক বনে যান। তার একান্ত অনুগত বীরবল ও অন্য ১৭ জন ছাড়া আর কেউ এই নব্য-সৃষ্ট ধর্মের ছায়াতলে শামিল হয়নি। যারা তাঁর ধর্মের অনুসারী হয়েছিল তারা ছিল চাটুকার, ধান্দাবাজ, লোভী ও দুনিয়াপূজারী স্বার্থবাদী। মহামতি তার সাম্রাজ্য বিস্তার করার জন্য একটি পন্থা বের করেছিলেন, যা বেশ ফলদায়ক হয়েছিল। রাজ্যের নারীরা ছিল তাঁর মনোরঞ্জনের প্রধান নিয়ামক। বিবাহের ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলিম কোনও ভেদাভেদ ছিলনা। জাতীয় অধ্যাপক ডঃ কবীর চৌধুরী তাঁর ‘Dismantling Hindu-Muslim Hostile Images’ নামক প্রবন্ধে লেখেন, ‘Akbar himself married a Hindu princess who stayed a Hindu and practised her religious rites without any hindrance’. তার লাম্পট্যের পরিচয় দিয়ে ভারতের বিখ্যাত একটি গ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘Akbar had over five thousand wives’.[2] এই চরিত্রহীন শাসক ইতিহাসে মহামতি হ’ল আর অন্যরা হ’ল ঐতিহাসিকদের হাতের মোয়া। আকবর সম্পর্কে ঐতিহাসিকরা মিথ্যার বেসাতি ছড়াতে মোটেও কারচুপি করেননি। আকবর ছিলেন খর্বাকৃতির, কালো বর্ণের, দেখতে মোটেও সুশ্রী ছিলেন না। অথচ ইংরেজ প্রভুর দেওয়া সনদ হচ্ছে, ‘He looked every inch a king’. আবার কোন কোন ঐতিহাসিক বলেছেন, ‘তার চক্ষুর চাহনি ছিল সূর্যকরোজ্জ্বল সমুদ্রের মত’। তার প্রতি কৃত্রিম আনুগত্য প্রকাশ করে ১৫৭৭ খ্রিষ্টাব্দে এক হিন্দু কবি চন্ডী মাধবাচারজ রচনা করলেন,
‘হেথা এক দেশ আছে পঞ্চগৌড়।
সেখানে রাজত্ব করেন বাদশাহ আকবর।।
অর্জুনের অবতার তিনি মহামতি
বীরত্বে তুলনাহীন জ্ঞানে বৃহস্পতি।।
ত্রেতা যুগে রাম হেন অতি সযতনে।
এই কলি যুগে ভূপ পালে প্রজাগণে’।।
মহামতি নিজেকে ইমাম মাহদী কিংবা মসীহ রূপে আত্মপ্রকাশ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি পরাস্ত হলেন, আল্লাহ্র সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে হেরে গেলেন। অসংখ্য নারীকে বিধবা করে মহামতি ১৬০৫ খ্রিষ্টাব্দে ৬০ বছর বয়সে দীর্ঘ ৪৭ বছরের রাজত্বের পর পরলোক গমন করেন। আগাছার চাষ করার দরকার হয়না, সার দেওয়ার দরকার হয়না, এমনি এমনি গজিয়ে ওঠে। আকবরের বহু কুকীর্তি মুঘল সাম্রাজ্যের অন্যান্য শাসকদের মাঝে ইচ্ছামত বণ্টন করা হয়েছে। তবে মহামতি একটি ভাল কাজ করতে চেয়েছিলেন তা হ’ল, সতীদাহ প্রথার বিলোপ সাধন। কিন্তু তিনি তা পারেননি। আর এটাই তাকে নিয়ে বলার মত একটা ইতিবাচক কথা।
বাবরের ইতিবাচক দিক ও তাঁর উৎসর্গিত প্রাণের করুণ মৃত্যু :
জহিরউদ্দিন মুহাম্মাদ বাবর ছিলেন মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। কিন্তু চাটুকার ঐতিহাসিকরা শুধু আকবরের সাফাই গেয়েছেন আর অন্যান্য শাসকদেরকে সহজ শিকারে পরিণত করেছেন। অজ্ঞ ঐতিহাসিকরা বিজ্ঞের ছদ্মবেশে চরম মিথ্যাচারের ঝুলি ভারী করেছেন। তাইতো বাবরকে তারা মদ্যপায়ী হিসেবে চিহ্নিত করতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হননি। মুঘল সাম্রাজ্যের এই মহান অধিপতি জানতেন যে, মদ্যপান হ’ল ইসলামী শরী‘আতে একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। হাযার হাযার সৈন্যকে কড়া শাসনের যাঁতাকলে ফেলে শাসন করা সম্ভব নয়। তাইতো তিনি যুদ্ধের প্রারম্ভে এমন এক বুদ্ধি আঁটলেন যা প্রশংসার দাবি রাখে। ১২ হাজার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে তিনি আল্লাহর দরবারে হাত তুলে ফরিয়াদ করলেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমায় ক্ষমা কর, আমি প্রতিজ্ঞা করছি আর জীবনে মদ্যপান করব না। পূর্ব অপরাধ ক্ষমা কর এবং এর পরিবর্তে যুদ্ধের ইযযত রক্ষা কর’। বাবর শিশুর মত কাঁদতে লাগলেন। তার কান্না বিশাল সৈন্য বাহিনীকে এমনভাবে আলোড়িত করল যে, অশ্রুসিক্ত সৈন্যরা মদ্যপান থেকে নিজেদেরকে অব্যাহতি দিল। কি অসাধারণ বিজ্ঞ এক শাসক ছিলেন বাবর!
স্বীয় পুত্র হুমায়ূন যখন কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত হ’ল, তখন রাজ্যের কোন বিদ্যা, কোন চিকিৎসা তার রোগ সারাতে পারলনা। কোন উপায় কারো জানা ছিল না। মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হুমায়ূনের শিয়রে বসে ভারাক্রান্ত মনে পিতার ব্যাকুল হৃদয় দিয়ে বাবর আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করলেন, ‘হে আল্লাহ! নিজের প্রাণের বিনিময়ে আমার পুত্রের প্রাণ ভিক্ষা দাও’। অসুস্থ হুমায়ূন সুস্থ হয়ে গেলেন, বাবর পুত্রকে সুস্থ রূপে পেলেন কিন্তু নিজে হয়ে পড়লেন অসুস্থ। বাবরের আধ্যাত্মিকতার একনিষ্ঠতার সেদিন জয় হয়েছিল। জয় হয়েছিল এক খাঁটি মুসলিম শাসকের। সন্তানের প্রতি বুকভরা ভালবাসার এক পিতার। ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল তার এই মহান ত্যাগ। নীতিতে অটল, শরী‘আতের বিধান মান্য করার ক্ষেত্রে এক ইস্পাত সদৃশ মানুষ, প্রজাবাৎসল বাবর সবকিছু মিলিয়ে তিনি এক দারুণ ব্যক্তিত্ব। কিন্তু তিনি অজ্ঞ নামের বিজ্ঞের ছদ্মবেশে অন্ধ ঐতিহাসিকের কলমের বলি হয়েছেন। ফলশ্রুতিতে তার গুণগুলো সব মাটি চাপা পড়েছে।
বাবর পুত্র হুমায়ূনের পরিচয় ও তার উদারতা :
হুমায়ূন ছিলেন সাধু চরিত্রের এক পরহেযগার মুসলমান। তিনি নাকি আফিমখোর ছিলেন! এমন কথা ছড়াতে ঐতিহাসিকের কলম একটুও নড়েনি। ঐতিহাসিকরা ইতিহাস বিক্রি করেছেন খুব কম দামে, বিকৃত করেছেন অবুঝ পাঠকের সবুজ হৃদয়। উদারতা এবং কৃতজ্ঞতা স্বীকার হুমায়ূনের চরিত্রগত গুণ ছিল। একবার হুমায়ূন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে খরস্রোতা নদীতে ঝাঁপ দেন। সৌভাগ্যক্রমে এক ভিস্তিওয়ালা তার প্রাণ রক্ষা করেন। প্রাণরক্ষার পুরস্কার স্বরূপ ভিস্তিওয়ালাকে তিনি আশ্বাস দেন যে, তিনি দিল্লীর অধিপতি হলে সে যা চাইবে তাই তাকে দিবে। যথারীতি ভিস্তিওয়ালা একদিন বাদশাহর দরবারে এসে হাজির। বাদশাহ চিনতে পেরে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, সে তার থেকে কি দাবি করে। তখন সে বলল, ‘আমি চাই তোমাকে সরিয়ে সিংহাসনে বসতে’। সমস্ত সভাসদের মুখে মাছি যাওয়ার উপক্রম হল। কৃতজ্ঞ হুমায়ূন নিজের মাথার পাগড়ি খুলে ভিস্তিওয়ালার মাথায় পরিয়ে দিলেন আর ঘোষণা করলেন, ‘আজ হতে ইনিই দিল্লীর বাদশাহ, আমি এঁর একজন নগণ্য খাদেম’। গোটা দিল্লীতে ঘটনাটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল। সবাই জানতে চাইলেন যে, কাহিনী আসলে কি! বাদশাহ হুমায়ূন তখন উত্তরে করলেন, ‘পবিত্র কুরআনে আছে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা অবৈধ। আমি তো ডুবে মরেই যেতাম, তাঁর উপকারে তিনি যা চাইবেন তাই দেব বলে অঙ্গীকার করেছিলাম’। একদিন এক রাত্রি যাপন করে ভিস্তিওয়ালা হুমায়ূনের মাথায় মুকুট পরিয়ে তাকে সিংহাসনে বসালেন। হুমায়ূনের মানবতা আর চরিত্রের দৃঢ়তা ছিল ভিস্তিওয়ালার কাছে সবচেয়ে বড় পুরস্কার। এই সত্য কাহিনী সত্য রূপে প্রকাশ করতে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গিয়েছেন ঐতিহাসিকরা। তাদের কলম বিকৃতির পথ খুঁজে পেয়েছে, সত্য প্রকাশ করতে গিয়ে থেমে গেছে কিংবা দুমড়ে-মুচড়ে পড়েছে। পরিশেষে মহান বাদশাহ হুমায়ূন সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে মৃত্যু মুখে পতিত হন।
ঐতিহাসিকদের দৃষ্টিতে জাহাঙ্গীর ও অদৃশ্যে থাকা ইতিহাস :
বাদশাহ জাহাঙ্গীর প্রথম জীবনে ছিলেন চরিত্রে, চেহারায়, পোশাক-পরিচ্ছদে ইসলাম বিরোধী একজন মানুষ। মুজাদ্দিদে আলফেছানী আহমাদ সারহিন্দকে তিনি জেলখানায় বন্দি করেছিলেন। আর মুজাদ্দিদ সাহেব হলেন সেই ব্যক্তি যিনি আকবরের সৃষ্ট নতুন ধর্মের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছিলেন। তিনি জাহাঙ্গীরের ভুল শুধরে দিয়েছিলেন। জাহাঙ্গীরের দরবারে প্রবেশ করার সময় কুর্নিশ না করার কারণে জাহাঙ্গীর তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে চেয়েছিলেন এর কারণ কি? তখন মুজাদ্দিদ দৃঢ় সাহস সঞ্চার করে নির্ভয়ে বলেছিলেন, ‘আমি জাহাঙ্গীরের দরবারের ভৃত্য নই, আমি আল্লাহর দরবারের ভৃত্য। তাই তাঁর আইনই আমার কাছে আইন, বাকি সবকিছু আমার কাছে বেআইন। আর তোমাকে সালাম দেই নাই এ জন্য যে, তুমি অহংকারী, হয়তো উত্তর দেবে না; তখন তোমার সালাম দেওয়ার অর্থ হবে প্রিয় নবীর একটা সুন্নাতকে পদদলিত করানো’। ফলশ্রুতিতে জাহাঙ্গীর ক্রোধান্বিত হয়ে তাঁকে জেলে পাঠিয়েছিলেন। এই জাহাঙ্গীর-ই আবার তাঁর সংস্পর্শে এসে এক সোনার মানুষে পরিণত হন। দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আদায়ের পাশাপাশি তিনি নিয়মিত কুরআন তেলাওয়াত করতেন। জাহাঙ্গীরের ন্যায়পরায়ণতার কথা আমরা খুব কমসংখ্যক মানুষ-ই জানি। কারণ ঐতিহাসিকদের সম্মোহনী কলমী শক্তি মানুষের মনে বিকৃতির এক মহাঘূর্ণন তৈরি করেছে। যে ঘূর্ণনে হাবুডুবু খাচ্ছে সাধারণ মানুষেরা। ঐতিহাসিকরা দিনকে যেমন রাত করতে পারে, তেমনি রাতকেও দিন করতে পারে। মদ্যপ জাহাঙ্গীরকে সবাই চেনে, কিন্তু ন্যায়পরায়ণ প্রজাবাৎসল জাহাঙ্গীরকে কয়জন জানে?
একদিন বিকৃত মস্তিষ্কের এক হিন্দু প্রজা ভুল করে জাহাঙ্গীর পত্নী নূরজাহানের কক্ষে প্রবেশ করেন। নূরজাহান তাকে গুলি করে হত্যা করেন। নূরজাহানের বিচার হল, রায় হ’ল প্রাণদন্ডের। নূরজাহানের একসময়ের হাতের পুতুল সেই বাদশা জাহাঙ্গীরের এহেন বিচার নূরজাহানকে বড়ই ব্যথিত করল। নূরজাহান প্রিয় স্বামীর কাছে জানতে চাইলেন যে, এই শাস্তি থেকে বাঁচার কোন উপায় আছে কিনা, মনের তুলাদন্ডে এর বিচার সম্ভব কিনা। তখন কাঁদতে কাঁদতে জাহাঙ্গীর বললেন, ‘প্রিয়া নূরজাহান, আমি আমার তুলাদন্ডে তোমার সারা জীবনের সবকিছু এক পাল্লায় চাপিয়েছি, আর অন্য পাল্লায় চাপিয়েছি হযরত মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আইনকে; বারেবারেই আমার কাছে ভারী হয়েছে ইসলামের নির্দেশ’। সুতরাং নূরজাহানের প্রাণদন্ড কার্যকর করা অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়ায়। বিকৃত মস্তিষ্ক ব্যক্তিটির বিচারের জন্য তার পক্ষ থেকে যারা এসেছিল তারা বাদশার বিচারে মুগ্ধ হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘হে বাদশাহ! আমরা আর প্রাণদন্ড দেখতে চাই না, নূরজাহানকে আমরা ক্ষমা করলাম। আমরা আজ বুঝলাম ইসলাম সত্যিই শান্তি ও সত্যের নিরপেক্ষ ধর্ম’। এই ইতিহাস প্রচার করবে কে? কে কলম ধরবে? মুসলিম ইতিহাস-ঐতিহ্য ঢাকা পড়ে গেছে, জাহাঙ্গীরের মদ্যপানের কথা স্থান পেয়েছে ইতিহাসে। কিন্তু সত্য ইতিহাসের ডালি সবই অধরা রয়েই গেছে। অতএব হে বিশ্বের অকুতোভয় মুসলিম নওজোয়ানরা! আঘাত কর মিথ্যার বিরুদ্ধে, ত্রাস সৃষ্টি কর মিথ্যুক ঐতিহাসিকদের অন্দরকেল্লায়, অধ্যয়ন কর, প্রতিবাদ কর। সত্যকে উন্মোচিত করার দায়িত্ব তোমাদেরই। কেননা সত্য আজ মিথ্যার বেসাতিতে নিশ্চিহ্ন হতে বসেছে। অতএব সাবধান!
আল্লাহভীরু সম্রাট শাহজাহান : লুকানো ইতিহাস
এবার বাদশাহ শাহজাহানের কথায় আসা যাক। চাল-চলনে, পোশাক-পরিচ্ছদে শাহজাহান একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম ছিলেন। তথাপি এখানেও ঐতিহাসিকরা অনুর্বর ইতিহাসের বীজ বপন করতে বিন্দুমাত্র কসুর করেননি। কিছু কিছু অনুর্বর মস্তিষ্কের অসাধু ঐতিহাসিক সবজান্তা সাধুর বেশ ধারণ করে ইতিহাসের রশি টেনেছেন। তাঁরা মনে করেন যে, বাদশাহ শাহজাহান বিলাসিতা আর প্রাচুর্যের মহাসমুদ্রে হাবুডুবু খেয়েছিলেন এবং তাঁর চারিত্রিক স্খলন হয়েছিল। স্মিথ বলেন, ‘During the remaining thirty five years of his life he disgraced himself by gross licentiousness’. কিন্তু এই কুৎসিত কদাকার বিকৃত মস্তিষ্কের ঐতিহাসিকরা জানতেন না যে, শাহজাহান তাঁর স্ত্রীকে হারিয়ে শোকে বিহবল হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। তাইতো তিনি তাঁর রত্নের মত পুত্র আওরঙ্গজেবকে চিনতে না পেরে অযোগ্য পুত্র দারাশেকোহকে বেশি অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন।
বাদশাহ শাহজাহান একবার এক স্বপ্নে একটি মসজিদ দর্শন করলেন। তিনি তাঁর বর্ণনা অনুযায়ী মসজিদটির ছবি এঁকে আনার কথা বললেন। কিন্তু কারো ছবিই তাঁর মনের মত না হওয়াতে তিনি এক দরবেশের শরণাপন্ন হলেন। দরবেশ তাকে জানালেন, ‘আমা অপেক্ষা ঐ বড় দরবেশ যিনি আপনার রান্না করেন’। বাদশাহ যখন রাঁধুনির কাছে গেলেন তখন তিনি বললেন, ‘আমার চেয়ে বড় বুযুর্গ যিনি আপনার পায়খানা পরিষ্কার করে’। এ কথা শুনে বাদশাহর চোখ তো চড়কগাছ। বাদশাহ তাদের কাছে ক্ষমা চাইলেন তাদেরকে চিনতে না পারার জন্য। অবশেষে মেথর সব কথা শোনার পর বললেন, রাজা যে মসজিদের স্বপ্ন দেখেছেন তা আসলে জান্নাতের এক মসজিদ। মেথর ফকির এক শিল্পীকে ডেকে এনে মসজিদটির ছবি এঁকে বাদশাহকে দেখালেন। বাদশাহ এই ছবি দেখে বেশ অবাক হলেন এবং জানালেন যে, এটা তাঁর স্বপ্নের মসজিদের সাথে মিলে যায়। এই মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর যিনি প্রথমে স্থাপন করবেন তিনি অবশ্যই এমন ব্যক্তি হবেন যার কখনও তাহাজ্জুদের ছালাত কাযা হয়নি। পরে সেই মেথর ফকিরকে আর লোকালয়ে দেখা যায়নি। বাদশাহ তখন ঘোষণা দিলেন যে, এমন ব্যক্তি এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন যার বার বছর তাহাজ্জুদের ছালাত কাযা হয়নি। কোন আলেম আসার সাহস পাননি। অবশেষে বাদশাহ নিজেই প্রথম ইট হাতে নিলেন আর কেঁদে বললেন, ‘হে আল্লাহ! আমি জানতাম না যে তুমি আমাকে এমনিভাবে প্রকাশ করে লজ্জিত করবে। হে আল্লাহ! তোমার শোকর (কৃতজ্ঞতা) যে আমার বার বছর তাহাজ্জুদ বাদ যায়নি’। কোথায় সেইসব অর্বাচিন ও কথিত সাহসী ঐতিহাসিক, যারা এরকম মুত্তাক্বী বাদশার সত্য ইতিহাস বিকৃত করে প্রচার করে? নির্লজ্জ ও বেহায়ার মত সত্য ইতিহাসকে এভাবে জীবন্ত কবর দেয়? শাহজাহানের বিশ্ব সুন্দরী স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও সবকিছু উপেক্ষা করে তিনি বারটি বছর তাহাজ্জুদের ছালাত কাযা করেন নি। এটা দিয়ে প্রমাণিত হয় তিনি উচ্ছৃঙ্খল নাকি সুশৃঙ্খল ছিলেন। কিন্তু বুঝেও না বোঝার ভান করে থাকেন ঐসব অর্বাচিন ঐতিহাসিকরা। যদিও সত্যপন্থী কিছু ঐতিহাসিক সত্য প্রকাশ করতে কুণ্ঠাবোধ করেন নি। যেমন- B. P. Saksena বলেন, ‘In Shahjahan’s reign the Mughal Empire attained to the zenith of prosperity and affluence’. ডঃ ভি. স্মিথও বলেছেন, ‘Shahjahan’s reign marks the climax of the Mughal dynasty and Empire’.
আওরঙ্গজেব ও তার শাসননীতি : ধর্ম বিদ্বেষের কালোমেঘ
বাদশাহ আওরঙ্গজেব আলমগীর নামে সমধিক পরিচিত। অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী এই মহাপুরুষকে ঐতিহাসিকরা সবচেয়ে বেশি দোষারোপ করেছেন, কালিমালেপন করেছেন তার চরিত্রে, ইচ্ছামত তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করেছেন। অথচ তাঁরা লম্পট আকবরকে সবচেয়ে উত্তম শাসক রূপে অভিহিত করেছেন। এমনকি মনগড়া ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে তাকে ন্যায়পরায়ণ ও যোগ্য শাসক বলে বিশ্বের সামনে পরিচয় করেছেন। কিন্তু উন্নত চরিত্রের অধিকারী আওরঙ্গজেবকে অনেক ঐতিহাসিক ‘ঔরঙ্গজীব’ নামে আখ্যা দিয়েছেন। এটা কটাক্ষ ছাড়া আর কিছুই নয়। অথচ তিনি ছিলেন মুঘল সাম্রাজ্যের সর্বশ্রেষ্ঠ বাদশাহ। অধিকাংশ ঐতিহাসিক মনে করেন যে, তিনি ছিলেন প্রবল হিন্দু বিদ্বেষী। কিন্তু তাঁর সেনাপতি হিসেবে তিনি জয়সিংহ এবং যশোবন্ত সিংহকে নিয়োগ করেছিলেন। এটা কি হিন্দু-বিদ্বেষী কোন শাসকের কাজ হতে পারে? আবার ইতিহাস ঘাটতে থাকলে বিষয়টি পরিষ্কারভাবে প্রতীয়মান হয় যে, তাঁর সময়ে হিন্দু-মুসলিম খুব-ই সুখে-শান্তিতে জীবন-যাপন করত। অন্যান্য ধর্মের লোকজনও তাঁর সময়ে খুব সুখে-শান্তিতে বসবাস করত। মারাঠা নেতা শিবাজীকে কাছে পেয়েও তিনি তাঁর গর্দান না নিয়ে তাকে বন্দি করে রাখেন। এই ভীরু, কাপুরুষ, কুটিল, পাপাচার, রাষ্ট্রদ্রোহী শিবাজীকে ঐতিহাসিকরা মহান শিবাজী রূপে আখ্যা দিয়েছেন। তাঁর নামে ১৯০৫ সাল থেকে শিবাজী উৎসব শুরু হয়েছে। ব্যাপার হল, যে বর্গীদের অত্যাচারের কথা শুনে আজো মানুষ ভয়ে থাকে সেই বর্গীদের নেতা ছিল শিবাজী। মূলতঃ শিবাজী ছিলেন এক ভন্ড নেতা। বাদশাহ আওরঙ্গজেবের কাছে তিনি যখন পরাজয় বরণ করেন তখন আওরঙ্গজেব তার সৈন্যবাহিনীকে বন্দী শিবাজীর প্রতি সবরকম সদ্ব্যবহারের নির্দেশ দিলেন। ঘঠনাক্রমে শিবাজীকে শিষ্টাচার শেখানোর নির্দেশ দিলেন বাদশাহ। এক মারাঠী আত্মীয়ের উপর শিবাজীর দেখাশোনার ভার অর্পিত হয়। দুষ্ট গোয়ালের চেয়ে শূন্য গোয়াল আচ্ছা। চোর ধর্মের কাহিনী শোনে না। শিবাজীর ক্ষেত্রেও তাই ঘটল। শিবাজী ধর্মপালনের জন্য আবেদন করলেন। তাঁর আবেদন মঞ্জুর হ’ল। তিনি ব্রাহ্মণের কাছে পূজার অর্ঘ্য স্বরূপ বজরা ভর্তি মিষ্টি পাঠানোর বিষয়টি বাদশাহকে অবগত করেন। বাদশাহ ভাবলেন যে, অন্যের ধর্মে হস্তক্ষেপ করা ধর্ম বিরোধী কাজ। মহান শাসক আওরঙ্গজেব শিবাজীকে সুযোগ দিয়েছিলেন। আর ধূর্ত শিবাজী সেই সুযোগ নিয়ে নিজেই আমের ঝুড়িতে বসে পালিয়ে যান। কিন্তু একশ্রেণির অসাধু ঐতিহাসিকরা আওরঙ্গজেবের উপর ধর্ম বিদ্বেষের কালিমা লেপন করেছেন। অথচ সস্তা চরিত্রের শিবাজী ঐতিহাসিকের কলমের খোঁচায় দামী মানুষে পরিণত হলেন। বহু মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আওরঙ্গজেব। কই, এই কথা তো গোমড়ামুখো কথিত বোদ্ধা ঐতিহাসিকরা বর্ণনা করেনা! তাঁরা শুধু বলেন থাকেন যে, আওরঙ্গজেব হিন্দু-বিদ্বেষী ছিলেন। বাংলাদেশের প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী হায়দার আকবর খান রনো ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৩ তারিখের ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ পত্রিকায় ‘মৌলবাদের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ’ নামক কলামে লিখেছেন, ‘সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া (যেমন আওরঙ্গজেব) মুসলিম শাসনকালে ধর্মীয় নিপীড়নের কথা জানা যায় না’। এখানে দেখা যায় যে, আওরঙ্গজেবকে নিয়ে রনো সাহেবও মিথ্যাচার করেছেন। সত্য ইতিহাস থেকে বুদ্ধিজীবীরা যেখানে অনেক পিছিয়ে সেখানে স্বল্প জ্ঞানের লোকেদের অবস্থা বড়ই করুণ। আওরঙ্গজেবের শাসননীতি, অর্থনীতি, সাম্যবাদ এতটাই প্রভাব বিস্তার করেছিল যে, তা পরবর্তীতে সাম্যবাদী নীতির প্রবক্তা কার্ল মার্কসকেও খুব বেশী আন্দোলিত করেছিল।
নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা প্রসঙ্গ ও পলাশী যুদ্ধের রক্তস্নাত ইতিহাস :
পলাশীর যুদ্ধের প্রসঙ্গ আসলেই আমরা মীরজাফরের কথা বলি। কিন্তু নাম জানা-অজানা আরও কত যে মীরজাফর আছে তা একটু গবেষণার বিষয়, একটু সুস্থ মস্তিষ্কে ভাবার বিষয়। বিহারের গভর্ণর যয়নুদ্দীনের পুত্র ছিলেন সিরাজ। নবাব আলীবর্দী খাঁর সুযোগ্য দৌহিত্র দেশপ্রেমিক সিরাজ যখন সিংহাসনে বসলেন তখন থেকেই তাকে উৎখাত করার জন্য উঠে পড়ে লাগলেন ইংরেজের পা চাঁটা গোলাম বাংলার নবাবেরা। হিন্দু রাজারা ইংরেজদেরকে বিভিন্নভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, যেকোনভাবেই হোক নবাবকে সরিয়ে দিতে হবে। পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া বাঁধানোর জন্য ইংরেজরা কলকাতার ঘাঁটি ফোট উইলিয়ম দূর্গ নির্মাণ করতে আরম্ভ করে। নবাবের কথা ইংরেজ বাবুরা তোয়াক্কা না করাতে নবাব বিদেশী ইংরেজকে আক্রমণ করেন এবং ভীষণভাবে পরাজিত করেন। এ যুদ্ধের সাথে জড়িত ‘Black Hole’ বা অন্ধকূপের কাহিনী। সে কথায় পরে আসছি।
ইংরেজ বাহিনী কোণঠাসা হয়ে যাওয়ার পর বাংলার স্বার্থান্বেষী বড় বড় ব্যবসায়ীরা (জগৎশেঠ, উমিচাঁদ, রাজবল্লভ) সিরাজের বিরুদ্ধে যোগ দেন। একেই বলে ঘরের শত্রু বিভীষণ। কুলাঙ্গার জগৎশেঠের বাড়িতে গোপন সভা করা হয়। সেই সভায় স্ত্রী লোকের ছদ্মবেশে ইংরেজ দূত মি. ওয়াটসকে পাল্কিতে করে আনা হয়। সিরাজকে পরাজয়ের জন্য যত টাকা লাগবে তা দেওয়ার আশ্বাস দেন মি. ওয়াট্স। রাজা রাজবল্লভ সিরাজের খালা ঘসেটি বেগমকে প্ররোচিত করেন ইংরেজকে সমর্থন করার জন্য। তাকে হাত করা গেলেও মীরজাফরকে হাত করা কষ্টকর হয়। তিনি প্রথমে বলেন, ‘আমি নবাব আলীবর্দীর শ্যালক, অতএব সিরাজ-উদ-দ্দৌলা আমার আত্মীয়, কি করে তা সম্ভব?’ তখন উমিচাঁদ তাঁকে বোঝালেন, ‘আমরাতো আর সিরাজকে মেরে ফেলছি না অথবা আমরা নিজেরাও নবাব হচ্ছি না, শুধু নবাবকে সিংহাসনচ্যুত করে আপনাকে বসাতে চাইছি। কারণ আপনাকে শুধুমাত্র আমি নই; বরং ইংরেজরা এবং মুসলমানদের অনেকেই আর অমুসলমানদের প্রায় প্রত্যেকেই গভীর শ্রদ্ধার চোখে দেখে’। উমিচাঁদের উষ্কানি যথেষ্ট কাজ দিল। মীর জাফর ইংরেজদের সাথে হাত মেলালেন। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন ক্লাইভ মাত্র তিন হাজার দুই শত সেন্য নিয়ে যুদ্ধে নামেন। সেখানে সিরাজের সৈন্য পঞ্চাশ হাযার। যুদ্ধে সিরাজের জয় নিশ্চিত। কিন্তু মীর জাফর, রায় দুর্লভদের মত সেনাপতিরা যুদ্ধ না করে দাঁড়িয়ে রইলেন। মীর মদন সিংহের মত যুদ্ধ করে নিহত হন। সিরাজ দিশেহারা হয়ে পড়লেন। মীর মদনের বীরত্বে মোহনলাল ও সিনফ্রে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ মীরজাফর যুদ্ধ বন্ধ করার নির্দেশ দিলে যুদ্ধ অন্যদিকে মোড় নিল। এ সময় ক্লাইভ বাহিনী পাল্টা আক্রমণ করে বসল। নবাব বাহিনীর উপর বর্ষার মত গুলিবর্ষণ করতে লাগল। নবাব রাজমহলের দিকে যাওয়ার পথে ধরা পড়লেন। তাঁকে বন্দী করে নির্মমভাবে হত্যা করা হ’ল। বাংলার বিশ্বাসঘাতক সন্তানেরা বোঝেনি যে, এ পরাজয় শুধু বাংলার নয়, বরং সমগ্র ভারতের। আর ঐ জয় ইংরেজ ও ইংল্যান্ডের। ‘পলাশীর যুদ্ধ একটা যুদ্ধ নয়, যেন যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা’ এমনটিই মন্তব্য করেছেন শ্রী ঘোষ তাঁর ইতিহাস গ্রন্থের ৫১৬ পৃষ্ঠায়।
এবার মিথ্যুক ইংরেজ অনুচর ‘অন্ধকূপ হত্যা’র কাহিনীর মূল নায়ক হলওয়েলের কথায় আসি, যিনি সিরাজের বিরুদ্ধে মিথ্যার বেসাতি ছড়িয়েছিলেন। অনেক কাহিনী যে শুধু গাজাখুরে কাহিনী, তাঁর বাস্তব প্রমাণ হ’ল হলওয়েলের সৃষ্ট ‘অন্ধকূপ হত্যা’র কাহিনী। সিরাজবিদ্বেষী ইংরেজদের কল্পিত অন্ধকূপে প্রায় দুইশত জন লোকের বন্দীর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ভাবার বিষয় হ’ল সেই ঘরটির আয়তন ছিল মাত্র 18×14। এখানে জায়গা কম হওয়ার কারণে ১৪৬ জনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ধুরন্ধর প্রকৃতির ঐতিহাসিকরা পরে দেখলেন না যে, এত লোকের কথা বললে কেউ বিশ্বাস করবেনা। তাই পরে ৬০ জনের কথা বলা হ’ল। এটাই হ’ল ইতিহাস। যেদিকে স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে সেদিকে ভেসে যাচ্ছে ঐতিহাসিকের মূল্যবোধ। সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে, বোধকরি, নষ্টদের হাতে গেছে অনেক আগ থেকেই, যার নমুনা আমরা ঐতিহাসিকদের থেকে পায়।
ঐতিহাসিকের বিষোদগার থেকে মুক্তি পাননি সিরাজ। শ্রী সুধীর কুমার চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘সিরাজ অতিরিক্ত নিষ্ঠুর প্রকৃতির লোক ছিলেন। তিনি প্রায় নদীতে বন্যার সময় নৌকা হতে আরোহী উল্টিয়ে দিয়ে বা ডুবিয়ে দিয়ে এক সঙ্গে এক দুই শত যুবক, যুবতী, স্ত্রী, বৃদ্ধ, শিশু, সাঁতার না জেনে জলে নিমজ্জিত হওয়ার নিষ্ঠুর দৃশ্যটি উপভোগ করে আনন্দ লাভ করতেন’। আর কত ছেলেভুলানো, মায়ে খেদানো ইতিহাস আমরা পড়ব! ইতিহাস বিকৃতির পথে আমরাই হতে পারি এক একজন আলোকবর্তিকা ও দিশারী। তাহ’লে অন্তত উদভ্রান্ত জাতি সত্য ইতিহাস খুঁজে পেতে পারবে। আল্লাহ আমাদের সেই অসাধ্য সাধনের তৌফিক দিন।
গ্রন্থপঞ্জি :
১। চেপে রাখা ইতিহাস, গোলাম আহমদ মোর্তজা
২। ইতিহাসের ইতিহাস, ঐ।
৩। বাংলার মুসলিম সম্প্রদায়, সুফিয়া আহমেদ।
৪। ওয়াহাবী আন্দোলন, আব্দুল মওদুদ।
৫। বাঙালি মুসলমানের মন, আহমদ ছফা।
৬। মোছলেম বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস, মওলানা আকরম খাঁ।
৭। The Indian Musalmans, W.W. Hunter.
৮। উনিশ শতকে বাঙালি মুসলমানের চিন্তা ও চেতনার ধারা, ওয়াকিল আহমদ।
৯। নিবন্ধমালা, উচ্চতর মানববিদ্যা গবেষণা কেন্দ্র, (পঞ্চদশ খন্ড), ২০০৯।
১০। মৌলবাদের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ, হায়দার আকবর খান রনো, বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৩।
১১। রাজনীতিকোষ, হারুনুর রশীদ।
১২। বাংলাপিডিয়া।
[লেখক : এম.এ, ইংরেজী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়]
[1]. ইতিহাসে বেশ কয়েকজন গ্রেট আছেন : আকবর দ্যা গ্রেট, পিটার দ্যা গ্রেট, আলফ্রেড দ্যা গ্রেট, আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট ইত্যাদি।
[2]. Vindication of Aowrangazeb, P. 143।