মিডিয়া আগ্রাসনের কবলে ইসলাম ও মুসলিম
মিডিয়া (Media) একটি ইংরেজী শব্দ। কোন কিছু প্রচারে যে মাধ্যম ব্যবহৃত হয় সেটাই মিডিয়া। মিডিয়ার প্রধানত দু’টি স্তর রয়েছে- (১) প্রিনট মিডিয়া অর্থাৎ পত্র-পত্রিকা বা সংবাদপত্র। (২) ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া অর্থাৎ স্যাটেলাইট, মোবাইল, কম্পিউটার, টিভি, রেডিও ইত্যাদি। কারো পক্ষে বা বিপক্ষে কিছু বলার ক্ষেত্রে মিডিয়ার নিজস্ব কোন শক্তি নেই। মিডিয়ার ধারক-বাহক ও চালক যে কাজে তাকে চালাবে সে কাজেই মিডিয়া চলবে ও ব্যবহৃত হবে। এটা প্রত্যেক নির্জীব জিনিসের ক্ষেত্রে চিরাচরিত নিয়ম।
যোগাযোগ মাধ্যম প্রকৃতপক্ষে এমন কিছু কর্মের সমষ্টি, যার মাধ্যমে মানুষ পরস্পর আবেগ-অনুভূতি, মতামত-প্রতিক্রিয়া, চিন্তাধারা-ভাবধারা ও জ্ঞানের আদান-প্রদান করে। এই আদান-প্রদান ও মত বিনিময় এমন সব উপকরণের মাধ্যমে হয়ে থাকে, যেগুলোকে পৃথক পৃথক দু’টিভাগে বিভক্ত করা যায় :
(১) এমন সীমিত উপকরণ, যা সীমিত ব্যক্তিকে পরস্পর মিলিয়ে দেয়। সেসব উপকরণের মধ্যে টেলিফোন, ফ্যাক্স, মোবাইল ইত্যাদির সাথে সাথে সমাবেশ, সম্মেলন, কনফারেন্স, সেমিনার-সিম্পোজিয়ামও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কারণ এগুলো পরস্পরকে মিলিয়ে দেওয়ার মাধ্যম।
(২) এমন উপকরণ, যা অগণিত ব্যক্তি পর্যন্ত কথা পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যম। এর মধ্যে পত্র-পত্রিকা, টিভি-ভিসিআর, সিনেমা-ফিল্ম, টিভি-র বিজ্ঞাপন, ইন্টারনেট ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।১
আজ বিশ্ব মুসলিম উভয় প্রকার মিডিয়ার অপব্যবহারের বিভ্রান্তির ধূম্রজালে আবদ্ধ ও সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের শিকার। ইসলাম বিদ্বেষীরা বিশ্ব মুসলিমের আমল-আক্বীদা সমূলে ধ্বংস করার জন্য মিডিয়াকে প্রধান মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করেছে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে সুইজারল্যান্ডের বাজিল নগরীতে অস্ট্রেলিয়ার দুর্ধর্ষ ইহুদী সাংবাদিক ড. থিওডর হার্জেলের নেতৃত্বে বিশ্ব ইহুদী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে তারা গোটা বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করার সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র ও সুপরিকল্পিত নীলনকশা প্রণয়ন করে। তারা সকলে একমত হয় যে, বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করতে হ’লে প্রথমত দুনিয়ার সকল স্বর্ণভান্ডার আয়ত্ত করতে হবে এবং সূদী অর্থ ব্যবস্থার জাল বিস্তার করে পৃথিবীর সকল পুঁজি তাদের হস্তগত করতে হবে। এরপর তারা স্থির সিদ্ধান্ত নেয় যে, আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যম যেন তাদের একচ্ছত্র আধিপত্যে চলে আসে এবং মিডিয়ার সাহায্যে দুনিয়াবাসীর মগজধোলাই প্রক্রিয়া শুরু করে তারা তাদের কাংখিত লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে পারে। সংবাদমাধ্যম তথা সকল প্রচার মাধ্যমের অসাধারণ গুরুত্ব, প্রভাব ও ভূমিকার কথা উলেলখ করে ড. থিওডর বলে, ‘আমরা ইহুদীরা পুরো বিশ্বকে শোষণের পূর্বশর্ত হিসাবে পৃথিবীর সকল পুঁজি হস্তগত করাকে প্রধান কর্তব্য বলে মনে করি। তবে প্রচার মিডিয়া আমাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে দ্বিতীয় প্রধান ভূমিকা পালন করবে। আমাদের শত্রুদের পক্ষ হ’তে এমন কোন শক্তিশালী সংবাদ প্রচার হ’তে দেব না, যার মাধ্যমে তাদের মতামত জনগণের কাছে পৌঁছতে পারে।’
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক প্রচার মিডিয়াগুলোর মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদ ও ইসলামী মৌলবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বময় এক ঝড় তোলা হয়েছে। এরা ইতিমধ্যেই দুনিয়ার মুসলমানদেরকে দু’টি ভাগে ভাগ করে ফেলেছে।
একটি Moderate Islamic group and Muslim activist নামে অভিহিত। বিশেবর অন্যতম প্রধান সংবাদ সংস্থা হ’ল রয়টার। পৃথিবীর এমন কোন সংবাদপত্র, রেডিও সেনটার, টিভি সেনটার ও স্যাটেলাইট নেই যারা রয়টার থেকে সংবাদ সংগ্রহ করে না। বর্তমান বিশেবর প্রধান দু’টি প্রচার মাধ্যম ‘বিবিসি’ এবং ‘ভয়েস অব আমেরিকা’ও প্রায় নববই ভাগ সংবাদ রয়টার থেকে সংগ্রহ করে থাকে। বিশ্বখ্যাত এ সংবাদ সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়াস রয়টার ১৮১৬ সালে জার্মানির এক ইহুদী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার এই রয়টার কার্যক্রম অতি সহজেই বিশ্বময় স্থান লাভ করেছিল। এখন তো রয়টার ছাড়া পৃথিবী যেন অচল। রয়টার হচেছ আকাশ সংবাদসংস্থার মহারাজাধিরাজ।
ইসলাম বিদ্বেষী তৎপরতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাঈল, ভারত ও মার্কিন ইহুদী লবি অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। ইহুদীরা স্বীয় প্রটোকল প্রস্ত্তত করার পূর্বেই ১৮৪৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি সংবাদ এজেন্সি প্রতিষ্ঠিত করেছিল। এই এজেন্সিকে আমেরিকার পাঁচটি বড় বড় দৈনিক মিলে ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’ নামে প্রতিষ্ঠা করে। অর্ধ শতাব্দী অতিক্রান্ত হওয়ার পর ১৯০০ খ্রীষ্টাব্দে এই সংস্থা আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে কাজ শুরু করে এবং আমেরিকায় প্রকাশিত সকল পত্র-পত্রিকাসহ গোটা বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের মিডিয়া ও প্রচার মাধ্যমকে সংবাদ সরবরাহ করতে থাকে। ১৯৮৪ সনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী উক্ত এজেন্সীর সাথে আমেরিকার তেরশ’ দৈনিক, তিন হাযার সাত শত আটাশিটি রেডিও এবং ৮৮টি টিভি স্টেশন জড়িত আছে। আমেরিকার বাইরে এগার হাযার নয় শত সাতাশ (১১৯২৭)টি দৈনিক ও রেডিও, টিভি স্টেশন জড়িত আছে। স্যাটেলাইট ও অন্যান্য মাধ্যমে দৈনন্দিন এক কোটি সতের লাখ শব্দ সম্বলিত লেখা মিডিয়াকে সরবরাহ করা হয়। এছাড়া ১৯০৭ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘ইউনাইটেড প্রেস’, ১৯০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘ইন্টারন্যাশনাল নিউজ সার্ভিস’ যা ১৯৫৮ সালে একীভূত হয়ে ‘নিউইয়র্ক টাইমস’-এর মালিকানায় চলে আসে। এটি পরিচালিত হয় ইহুদী মালিকের অধীনে।২
ইহুদী প্রচার মাধ্যমগুলো বিশ্বময় ইসলামী পুনর্জাগরণ আনেদালন সম্পর্কে অব্যাহতভাবে বিভ্রান্তি সৃষ্টির প্রয়াস চালিয়ে যাচেছ। এ উদ্দেশ্যে তারা আন্তর্জাতিক সূত্রগুলোকে ব্যবহার করছে। বিশেষ করে মার্কিন-ইহুদী প্রভাবিত প্রচার মাধ্যমগুলো মুসলমানদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস ও মৌলবাদের অপবাদ রটিয়ে যাচেছ, যাতে করে বিশ্বে ইসলামী আনেদালন স্তব্ধ করে দেয়া যায়। যেমন-
(১) পশ্চিমা গণমাধ্যম চরমপন্থা, মৌলবাদ, ধর্মীয় অনুশাসন পালনকে শব্দের ব্যবহারগত চাণক্যে সমার্থবোধক করে ফেলেছে। নিউইয়র্ক ভিত্তিক Daily Times ৪ঠা অক্টোবর ২০০২ এক সংবাদে লিখেছে, “Muslims Soliders were shown performing prayers with gun.” এ সংবাদের সাথে একটি ছবি ছাপা হয় এবং ছবির পরিচিতিতে লেখা হয়, “Guns and Prayer go together in the fundamentalist battle”.৩ আফগানিস্তানের মুসলমানরা যুদ্ধক্ষেত্রে ছালাতের সময় ছালাত আদায় করছে এ সত্য কথাটি পশ্চিমা মিডিয়া কৌশলে এড়িয়ে গেছে। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে যুদ্ধরত পক্ষগুলোর হাতে অস্ত্র থাকবে এটাই স্বাভাবিক। সংবাদ প্রকাশের দৃষ্টিভঙ্গির কারণে একটি যুদ্ধের চিত্র সংবাদকে সারাবিশ্বে ইসলামী মৌলবাদীদের (Islamic Fundamentalism) সন্ত্রাসী কর্মকান্ড বলে প্রচার করা হ’ল। এমনিভাবে পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমে ইসলাম ও মুসলমানরা প্রতিনিয়ত বিমাতাসুলভ আচরণের স্বীকার হচ্ছেন।
(২) পশ্চিমা সংবাদ ও গণমাধ্যমের আরেকটি ভ্রান্তি হ’ল মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক অবকাঠামো, অস্থিরতা ও ঘটনা প্রবাহকে ইসলামের সাথে একাকার করে ফেলা। ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের উদাহরণ এখানে উল্লেখ করা যায়। নববই-এর দশকে গালফ যুদ্ধ এবং এর পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ কেবল সাদ্দামের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। তাঁর অমানবিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে নির্বিচারে হাযারো নর-নারী সর্বস্বান্ত হওয়ার যে অভিযোগ রয়েছে, তা কোন সুস্থ ও বিবেকবান মুসলমান সমর্থন করেনি। অথচ পশ্চিমা সংবাদ ও গণমাধ্যম সাদ্দামের এ কর্মকান্ডকে ইসলামের সাথে জড়িয়ে উল্লেখ করেছে ‘ইসলাম কি করে এতো হত্যাকে উৎসাহিত করেছে?’ সাদ্দামের পরিচালিত গণহত্যাকে তারা ইসলামের সাথে তুলনা করেছে। ২০০৩ সালের মার্চ মাসে আন্তর্জাতিক আইন-কানুনকে তোয়াক্কা না করে বুশ-ব্লেয়ার যখন ইরাক আক্রমণ করে তখন পশ্চিমা সংবাদ ও গণমাধ্যম এ আগ্রাসনকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে খৃষ্টান আক্রমণ না বলে সন্ত্রাসী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নৈতিক (?) ও বৈধ (?) আক্রমণ বলে চালানোর চেষ্টা করেছে। আর এ ঘটনাগুলো প্রকাশ্যই পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যম সারা বিশ্বে প্রচার করেছে। হিটলার খৃষ্ট ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। এজন্য আমরা মনে করি না তাঁর সকল কর্মকান্ড খৃষ্টধর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট। ঠিক এমনিভাবে আমরা মনে করি সাদ্দাম ও ইসলামকে পশ্চিমা সংবাদ ও গণমাধ্যম যেমন এক করে ফেলে তেমনি ইসলাম, আরব ও মধ্যপ্রাচ্যকেও বিশ্ববাসীর সামনে এক করে তুলে ধরছে। তাদের পরিবেশিত মিথ্যা ও স্থূল তথ্যের কারণে বিশ্ববাসী ইসলাম এবং মুসলিম বিশ্ব সম্পর্কে ভ্রান্তির বেড়াজালে হাবুডুবু খাচ্ছে। অথচ মধ্যপ্রাচ্যের সকল মুসলিম দেশে সমগ্র মুসলমানের মাত্র ১৮% বাস করে।৪ সুতরাং তাদের সকল কর্মকান্ডকে ইসলামের সাথে জড়িয়ে ফেলার কোন কারণ থাকার কথা নয়।
বাংলাদেশের মিডিয়া জগৎ ও চলচ্চিত্র হ’ল অশলীলতার একমাত্র হাতিয়ার। আমাদের দেশে পশ্চিমাদের মতো কিছু উচ্চ শিক্ষিত লোক আছে যারা ভাই-বোন, পিতা-মাতা, স্ত্রী-পুত্র সহকারে একত্রে স্যাটেলাইট দেখে। কোন চলচ্চিত্রে একটি মেয়ে বস্ত্রহীন হয়ে নাচে অথবা কোন মেয়েকে ধর্ষণ করার দৃশ্য রয়েছে, এ রকম ছবি দেখাকে তারা ‘ফ্রি মাইন্ড’ মনে করে। অথচ যে দেশের মানুষ ক্ষুধার জ্বালায় সন্তান বিক্রি করে, হালের বলদের অভাবে মানুষ কাঁধে জোয়াল টানে, সে দেশে চার্লস ডায়নার বিয়ের ছবি এবং পার্শ্ববর্তী দেশের নায়ক-নায়িকার বিয়ের খবর এক সপ্তাহ ধরে ছাপা হয়। আরেকশ্রেণীর বিলাসপ্রিয় মানুষ ডিসএনিটনার সাহায্যে বিছানায় শুয়ে শুয়ে আলো-ঝলমল পৃথিবীর সভ্যতা বিবর্জিত রঙ্গমঞ্চ প্রত্যক্ষ করে চলছে বিবেকহীনভাবে।
পশ্চিমের মানুষেরা নিজের বোধ-বুদ্ধিকে জলাঞ্জলি দিয়ে প্রচারযন্ত্রের নাচের পুতুলে পরিণত হয়েছে। প্রচারযন্ত্রের প্রচারণার নিরিখেই তারা জীবনের সবকিছু মাপতে চায়। তারা বুঝতে চায় কে কতখানি উন্নত বা অনুন্নত। প্রচারযন্ত্রই সাম্রাজ্যিক স্বার্থে তাদের মাথায় ঢুকিয়ে রেখেছে, অপশ্চিমা বিশেবর মানুষেরা নিজেদের ভালমনদ বুঝতে পারে না। সুতরাং এদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে পশ্চিমের উন্নত মানুষদের সহায়তা যরূরী।
স্বাভাবিকভাবেই পশ্চিমের প্রযুক্তিশাসিত শক্তিশালী মিডিয়া পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদের একান্ত অনুগত খেদমতগার হিসাবে ইসলামকেই এই মুহূর্তে তার বড় শত্রু হিসাবে নিশানা করেছে। কমিউনিজমের পতনের পর ইসলামকে এই নিশানা করার কারণ হচ্ছে- এটি একটি সুগঠিত আদর্শ। এটি কর্পোরেট পুঁজিকে সমর্থন করে না। সমর্থন করে না বাজার অর্থনীতি, বিশ্বায়নের নামে নতুন কালের অর্থনৈতিক শোষণের দাপাদাপি। পশ্চিমের অবাধ কনজুমারিজম, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও স্বার্থপরতা ইসলামের কাম্য নয়। ইসলাম চায় না একজনের শোষণে আর একজনের অগ্রগতি; ইসলাম চায় আদল, ইহসান ও ইনছাফভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা, যেখানে শোষণ ও বঞ্চনা থাকবে না। সাম্রাজ্যবাদীদের পথের কাঁটা এই মতাদর্শকে Preemative war-এর বিজয়নিশান উড়িয়ে মার্কিন বিদ্বেষ খতম করার চেষ্টা করবে, এতে আর অবাক হওয়ার কী আছে। এক্ষেত্রে পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলো তথ্যপ্রযুক্তিকে তাদের স্বার্থে Catalytic converter-এর মতো ব্যবহার করে। এজন্য পুঁজিবাদী মিডিয়া ইসলামকে বর্বর, সন্ত্রাসী ও জঙ্গী ধর্ম হিসাবে অনবরত প্রচার করে। মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগে তাকে অবিরত নিনিদত হ’তে হয়। উদ্দেশ্য, কোন কিছুকে নিনিদত না বানাতে পারলে তাকে ধরাশায়ী করা যাবে কেমন করে! কেবল শক্তিশালী মিডিয়ার সাহায্যে সাম্রাজ্যবাদীরা ইসলামের সঙ্গে শত্রুতাকে আজ বৈধ করে নিচেছ।
আজকে বৃটেন, আমেরিকাসহ তাদের অন্যান্য দোসররা ইসলামী সন্ত্রাসবাদ ও মুসলিম চরমপন্থী নামে অপপ্রচার চালাচেছ এবং বিশ্বকে তা বিশবাসও করাতে চাচেছ। প্রচারণার এই ধরনটা চিরকাল একই রকম। হয় আমাদের সঙ্গে থাক, না হ’লে ভাগাড়ে গিয়ে মরো। পেনটাগন, হোয়াইট হাউস এবং স্টেট ডিপার্টমেনেটর পসনদসই হ’লে টিকবে, নইলে ধ্বংস হয়ে যাবে। স্বাধীনতা সংগ্রামী, মতাদর্শিক যোদ্ধা এতে কিছু আসে যায় না। আমেরিকার জিঘাংসার বিরুদ্ধে, ক্যাপিটালিজমের বিরুদ্ধে, বিশবায়ন-বাজার অর্থনীতির বিরুদ্ধে যে-ই দাঁড়াবে, মোকাবিলা করার কথা বলবে, সে-ই রাতারাতি সভ্যতার শত্রু, জঙ্গী, বর্বর, সন্ত্রাসী বনে যাবে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, মুসলিম রাষ্ট্র ও জনগণ আজও পাশ্চাত্যের পুঁজিপতিদের নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ার উপর ভয়ানকভাবে নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতা আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে মুসলিম জনগণের অবস্থানকে প্রতিনিয়ত দুর্বল করে দিচেছ। পুঁজিপতি মিডিয়াগুলোর অবিরত প্রচারণা মুসলিম জনগণের মাঝে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। তাদের মধ্যে নৈরাজ্য উৎপাদন করে। এসবের ফলে স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক ধারণাগুলোর বিলুপ্তি ঘটে। এগুলো ধীরে ধীরে ভিনদেশী ধারণা দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়।
এই অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ হচেছ মিডিয়াকে ব্যবহার করা। মিডিয়ার প্রচারণাকে মিডিয়া দিয়েই প্রতিহত করতে হবে। এই কৌশল আজ মুসলমানদের আয়ত্ত করতে হবে। পাশ্চাত্যের সুপ্রসিদ্ধ ধর্মবিষয়ক পন্ডিত ‘Muhammad : The biography of a Prophet’-এর ননিদত রচয়িতা কারেন আর্মস্টং-এর একটি উদ্ধৃতি দিতে চাই, যা মিডিয়া জগতে এ কালের মুসলমানদের দায়িত্ব ও করণীয় সম্পর্কে একটা ধারণা দিবে। তিনি বলেন, ‘একুশ শতকে মুসলমানরা এ রকম একটা স্ট্র্যাটেজি ছাড়া পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ার যুদ্ধকে মোকাবিলা করতে পারবে না। মুসলমানদের মিডিয়াকে ব্যবহার করা উচিত ইহুদীদের মতো। মুসলমানদের লবিং করতে জানতে হবে এবং তাদের একটি মুসলিম লবির সৃষ্টি করতে হবে। এটাকে আপনি সমন্বিত প্রচেষ্টা গ্রহণ বলতে পারেন। এটা এমন একটা প্রচেষ্টা, এমন সংগ্রাম; যেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি আপনি মিডিয়াকে পরিবর্তন করতে চান, তাহ’লে মানুষকে আপনার বুঝাতে হবে ইসলাম রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে একটি শক্তি। কিভাবে মিডিয়াকে ব্যবহার করতে হবে এবং মিডিয়াতে নিজেদের কিভাবে উপস্থাপন করতে হবে তা মুসলমানদের জানতে হবে। মুসলিম উম্মাহকে এই নবতর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার বিকল্প কোন পথ নেই।
ইসলাম ও মুসলিম বিশ্ব আজ সামরিক আগ্রাসনের পাশাপাশি মিডিয়া আগ্রাসনেরও শিকার। ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে মিডিয়া আগ্রাসনে মধ্যপ্রাচ্যে যেমন ইসরাঈল, সমগ্র বিশবজুড়ে যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ এশিয়ায় তেমনি ভারত। ভারতীয় প্রচারের কৌশল দ্বিমুখী। ভারত থেকে সরাসরি সম্প্রচারের পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশে তাদের আশ্রয়ে পালিত হচেছ মিডিয়া জগতের অনেকেই। প্রতিবেশী দেশের রাজনীতি ও ভূগোলকে প্রভাবিত করার লক্ষ্যে ভারতীয় পুঁজির বিস্তর বিনিয়োগ হয়েছে মূলত সাতচলিলশ থেকেই। তবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পরিচালিত ১৯৬৫-এর সামরিক আগ্রাসন ভন্ডুল হওয়ার পর তাদের প্রচারধর্মী নিরস্ত্র আগ্রাসনের মাত্রা বহুগুণে বেড়ে যায়।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতীয় আধিপত্য সহনীয়, গ্রহণযোগ্য, এমনকি প্রশংসনীয় করতে অসংখ্য পত্রিকা প্রকাশিত হচেছ। এদেশটিকে কব্জায় রাখতে গিয়ে এককালে নিজেদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা ব্যয় করেছিল বৃটিশরা, লক্ষ্য ছিল বাজার দখল। ভারত একই উদ্দেশ্য সাধন করছে নিজেদের রক্তক্ষয় না করেই। এ কাজটি করছে কিছু অর্থ ব্যয় করেই। বৃটিশের সামনে সমস্যা ছিল, এত অধিক হারে তারা এত আত্মবিক্রিত দালাল পায়নি। ফলে হাজী শরীয়তুল্লাহ, তিতুমীর, দুদুমিয়াদের বিরুদ্ধে তাদের নিজেদেরকেও রক্ত ঢেলে লড়তে হয়েছে। অথচ ভারতের সৌভাগ্য হ’ল, তাদের হয়ে আজ এ দেশের অনেকে লড়ছে। এর কারণ তাদের প্রবল প্রচার আগ্রাসন। তাদের প্রচারের ফসল এদেশে যে ফলেছে প্রচুর এটি তারই জ্বলন্ত উদাহরণ। বাংলাদেশী হয়েও এরা ভারতীয়দের চেয়েও বেশী ভারতীয়। তসলিমা নাসরীন হ’ল এ ক্ষেতেরই ফসল। সে যা লিখেছে তা খুব কম সংখ্যক ভারতীয়ই লেখার সাহস করেছে। এজন্য সে বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত হ’লেও ভারতে পুরস্কৃত হয়েছে। তসলিমা নাসরীনের মত সাহস না থাকলেও মন-মানসিকতায় তার মত অভিন্ন লেখকের সংখ্যা বাংলাদেশে কম নয়, বরং অসংখ্য। এক ও অভিন্ন লক্ষ্যে কাজ করে যাচেছ তারা। সে অভিন্ন লক্ষ্যটি হ’ল, সাতচলিলশের ভারত বিভাগ বাংলাদেশের জন্য অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর ছিল- এটি আদাজল খেয়ে প্রমাণ করা। আর এটি প্রমাণ করতে পারলে বাংলাদেশের পৃথক অস্তিত্বকে অপ্রয়োজনীয় প্রমাণ করাও তাদের জন্য সহজতর হবে। বাংলাদেশের শেকড় কাটার কাজ এবং সে সাথে ভারতের দেহে মলান হওয়ার পক্ষে প্রেক্ষাপট সৃষ্টি হচেছ বস্তুত এভাবেই। অখন্ড ভারতে একীভূত হওয়ার দাবী তারা এ মুহূর্তে না উঠালেও যথাসময়ে যে উঠাবে সেটি সুনিশ্চিত। নইলে ভারতঘেষা এসব বুদ্ধিজীবীদের এত কসরৎ কেন?
ভারতবর্ষে আর্য আগ্রাসন, ফিলিস্তীনে ইহুদী আগ্রাসন এবং আমেরিকায় ইউরোপীয় আগ্রাসনের মধ্যে গুণগত সাদৃশ্য প্রকট। এরা বিজিত দেশের মূল অধিবাসীদের অধীনস্ত বা নির্মূলের মধ্য দিয়ে নিজেদের আবাদ গড়েছে। অথচ প্রচারের বলে এরাই বিশেব ভাল মানুষ সেজেছে। অপরদিকে মুসলমানদের চিত্রিত করেছে সন্ত্রাসী, বর্বর ও অন্যান্য নানা বিশেলষণে। রক্তের গন্ধ আবিষ্কার করছে মুসলমানদের ইতিহাস থেকে। অথচ দু’-দু’টি বিশ্বযুদ্ধ বাধিয়ে কয়েক কোটি মানুষ হত্যা করেছে তারাই। আরো কয়েক কোটিকে করেছে পঙ্গু। হিরোশিমা ও নাগাসাকির মত দু’টো শহরকে পরিণত করেছে সাক্ষাৎ ধ্বংসস্তূপে। অথচ মুসলমানেরা যেখানেই গিয়েছে মসজিদ, মাদরাসা ও বিদ্যালয় গড়ে সভ্যতার উন্নতিকে ত্বরান্বিত করেছে। মুসলমানদের ভান্ডার থেকে এমনকি ইউরোপীয়রাও ফসল কম তোলেনি। ইউরোপের শিল্প বিপলব এসেছিল বস্তুত স্পেনের মুসলমানদের থেকে বিদ্যা লাভের পরেই।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ১১ই সেপ্টেম্বর এসেছে মাত্র একবার। অথচ ইসরাঈল প্রতিষ্ঠার পর থেকে সেটি ফিলিস্তীনীদের জীবনে এসেছে বহুবার। নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারের যত মানুষ মারা পড়েছে তার চেয়ে অনেক বেশী মানুষ মারা গেছে সাবরা ও শাতীলার ফিলিস্তীনী উদ্বাস্ত্ত শিবিরে। গত ৬০ বছরের বেশী সময় ধরে সন্ত্রাসের শিকার ফিলিস্তীনীদের আজ বলা হচেছ সন্ত্রাসী এবং সেটি প্রচারজগতে আধিপত্য থাকার কারণে।
ভৌগলিক সীমানা দিয়ে সীমাবদ্ধ না হওয়ায় মিডিয়ার প্রতাপ এখন বিশ্বব্যাপী। তাদের দ্বারাই বহুলাংশে নিয়ন্ত্রিত হচেছ বিশ্ব রাজনীতিও। বিশেষ করে আজকের মেরুদন্ডহীন মুসলিম বিশেবর। নিউইয়র্কস্থ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রফেসর এডওয়ার্ড সাঈদ Covering Islam নামে একখানি বই লিখেছেন। এডওয়ার্ড সাঈদ একজন ফিলিস্তীনী আরব, যুক্তরাষ্ট্রের বুদ্ধিজীবী মহলে তার পরিচিতিও প্রচুর। ক্যাম্পডেভিড চুক্তির পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আরবদের সম্পর্কে বড় আকারের ফাটল ধরে। সে ফাটলেরই মেরামতে প্রফেসর সাঈদকে বিশেষ দায়িত্ব দিয়েছিলেন প্রেসিডেনট কার্টার। সেহেতু বলা যায়, মার্কিনীদের অনেক নাড়ির খবরই তার জানা। তার বইতে তিনি প্রমাণ করেছেন মার্কিন প্রচার মাধ্যম কতটা জঘন্যরূপে পক্ষপাতদুষ্ট এবং মুসলিম স্বার্থবিরোধী। তার মতে যুক্তরাষ্ট্রে ইদানিং ঝাঁকে ঝাঁকে আবির্ভূত হচেছ অসংখ্য মুসলিমবিদ্বেষী বুদ্ধিজীবী, এদের কাজই হ’ল মুসলিম বিশেব মার্কিন সামরিক আগ্রাসনের প্রেক্ষাপট তৈরী করা। অথবা কোন আগ্রাসন পরিচালিত হ’লে সেটিকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে বৈধ প্রমাণিত করা। অনেকেরই আফসোস, পাশ্চাত্য বিশব কেন এখনও মধ্যপ্রাচ্যকে গ্রাস করছে না। তাদের বক্তব্যের সারমর্ম হ’ল, পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীর পুর্তগীজ আগ্রাসনই বর্তমান পশ্চিমা শাসকবর্গের জন্য মডেল হওয়া উচিত। তাদের মতে ঔপনিবেশিক শাসনই বিশেব শেষবারের মত শান্তি (?) এনেছিল।৯ যদিও সে শান্তি ছিল হত্যা ও লুণ্ঠনের মাধ্যমে নিরীহ ও নিঃসম্বল মানুষের সামরিক ও অর্থনৈতিক পঙ্গুত্বের। এশিয়া-আফ্রিকার মযলূম মানুষের স্বাধীনতাকে এরা বর্বরতা বৈ ভিন্নরূপে দেখে না।
পাশ্চাত্যের শাসকবর্গ কোন ধর্মকেই নিজেদের জন্য আজ আর হুমকি হিসাবে ভাবে না। তবে ইসলামই এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। যেকোন দেশেই ইসলামের উত্থান তাদের কাছে এক নিদারুণ ত্রাস। যারাই এ উত্থানের পক্ষে তারাই তাদের কাছে সন্ত্রাসী। ইসলামের অনুসারীদের পরিকল্পিতভাবে চিত্রিত করা হচেছ মানবতার দুশমনরূপে। এ প্রচারণায় মূল ভূমিকা পালন করছে পাশ্চাত্যের মিডিয়া। অথচ মুসলিম বিশেব যারা সত্যিকার যালেম, যাদের দেশে প্রতিবাদী আওয়াজ তোলার ন্যূনতম শাস্তি হ’ল প্রাণদন্ড, তাদের সাথে ওদের সখ্যতা অতি নিবিড়। বিস্তর অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য দিয়ে এসব দেশের স্বৈরাচারী শাসকদেরকে টিকিয়ে রাখাই হ’ল এদের বিদেশনীতি। এ কাজকে এরা বলে ‘স্থিতিশীলতা’। এমন স্থিতিশীলতার স্বার্থে যে কোন সামরিক বর্বরতা পরিচালনায় বা সমর্থনদানে এদের আপত্তি নেই। আলজেরিয়াতে এমনই এক বর্বরতা চলছে সেদেশের স্বৈরাচারী শাসকের হাতে। অথচ পশ্চিমা মিডিয়া এ বর্বরতা দেখেও দেখে না, শুনেও শুনে না। নিশ্চুপ এরা কাশ্মীর ও ফিলিস্তীনে পরিচালিত নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধেও। তারা বর্বরতা খুঁজে ইরানে বা সূদানে। কারণ সেখানে ইসলামপন্থীরা ক্ষমতাসীন। নিশ্চুপ এসব দেশের একাডেমী বা বিশ্ববিদ্যালয়সমূহও। পাশ্চাত্যের নীতি ও নৈতিকতায় কতটা মড়ক লেগেছে সেটি এ থেকেই অনুমেয়। বিবেকের যে অসুস্থতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হিরোশিমা ও নাগাসাকির কয়েক লক্ষ নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও বেসামরিক মানুষকে জীবন্ত দগ্ধ করে বিজয়ের আননদ খুঁজেছিল, সে অসুস্থতা থেকে আজও যে তাদের আরোগ্য মেলেনি এসব তাদেরই আলামত। ইরাকে ও আফগানিস্তানে হাযার হাযার টন বোমাবর্ষণ, ইরাকের শিশু হাসপাতালে বোমাবর্ষণ, মিসাইল ছুঁড়ে ইরানের বেসামরিক বিমানের যাত্রী হত্যা- এসব নিষ্ঠুরতা সে নৈতিক অসুস্থতারই প্রমাণ। মিডিয়ার অপরাধ তারা সে নিষ্ঠুরতাকে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরছে না। তারা সুনামীতে ধ্বংস হওয়ার আগে ইনেদানেশিয়ার আচেহ দ্বীপের তুলনামূলক ছবি দেখায়। কিন্তু এ ছবি দেখায় না মার্কিনীদের বোমাবর্ষণের পূর্বে ইরাকের ফালুজা কেমন ছিল।
প্রচার মাধ্যমে ইহুদীদের আধিপত্য অতি প্রবল। রয়টারের মত বিশেবর অন্যতম বৃহৎ সংবাদ প্রতিষ্ঠানের মালিকানা তাদেরই। টাইম, নিউজ উইকের মত বহুল প্রচলিত পত্রিকাগুলোর প্রভাবশালী সাংবাদিক ও কলামিস্ট তারাই। এছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ব বিদ্যালয়সমূহে ইহুদী শিক্ষকগণই অধিকতর প্রভাবশালী। যে কোন গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুতে প্রচার মাধ্যম এসব শিক্ষকদের মতামতকেই অধিকতর গুরুত্ব দেয়। অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রশাসনও নির্দেশনা নেয় তাদের থেকেই। প্রচারে ইহুদীদের প্রভাবের কারণেই ফিলিস্তীনী বসতি নির্মূলের পরও আগ্রাসী ইহুদীরা প্রচার পায় শান্তিবাদী রূপে। অথচ ইসরাঈলের জন্মই হয়েছে সন্ত্রাসের মধ্য দিয়ে। টিকেও আছে বিরামহীন সন্ত্রাস চালিয়ে। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই যুদ্ধ আর সন্ত্রাস চালিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের শান্তিকে তারাই বিনষ্ট করেছে। শুধু মধ্যপ্রাচ্যে নয়, মার্কিনীদের পর তারাই এখন বিশেবর বৃহৎ আগ্রাসী শক্তি। আর এদের সাফাই গাচেছ পাশ্চাত্যের মিডিয়া। মিডিয়ার হাতে যিম্মী পশ্চিমা বিশেবর রাজনীতিকেরাও, ঈসরাঈলী স্বার্থের বিরোধিতা দূরে থাক তাদের স্বার্থে সামান্য নীরবতাও তাদের জন্য বিপদ ডেকে আনে। মিডিয়ার আগ্রাসনের মাধ্যমে ফিলিস্তীনীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত তাদের বীভৎস ধ্বংসযজ্ঞকে তারা একটি ন্যায্য যুদ্ধ রূপে বিশ্বময় প্রচার করছে। পাশ্চাত্য বিশ্বে সেটি গ্রহণযোগ্যতাও পাচেছ। মিডিয়া যে কিভাবে মানুষের মনের ভুবনে আধিপত্য বিস্তার করতে পারে এ হ’ল তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। এককালে বহু অর্থ ও বিপুল রক্তক্ষয়ে প্রকান্ড এক সামরিক যুদ্ধ লড়েও এমনটি সম্ভব ছিল না। আগ্রাসী শক্তি রূপে এটিই হ’ল মিডিয়ার ক্ষমতা। সমগ্র মুসলিম বিশ্ব আজ সে শক্তির কাছেই প্রচন্ডভাবে পরাজিত।
একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র অনুযায়ী জানা যায়, ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যাপকহারে অপপ্রচারে অনেক মিডিয়া লিপ্ত আছে। তন্মধ্যে ২০০টি রেডিও ষ্টেশন, ১৭০০টি টিভি চ্যানেল এবং দৈনিক, সাপ্তাহিক ও অন্যান্য প্রায় ২২ হাযার ম্যাগাজিন প্রতিনিয়ত ইসলামের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে যাচেছ।
মূলতঃ দ্বীনের সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর বিষয়ে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন আলেম-ওলামা মিডিয়াতে অংশগ্রহণ না করায় নাস্তিক্যবাদীরা মোক্ষম সুযোগ পেয়ে ইসলামের নাম-নিশানা চিরতরে উড়িয়ে দিতে মিডিয়ার অপব্যবহারে মাতাল হয়ে লেগেছে। ইসলামে চিরনিষিদ্ধ অপকর্মগুলোকে মিডিয়াতে ব্যাপকহারে অতি জোরালোভাবে সম্প্রচার করা হয়। মিডিয়ায় প্রচারিত বিষয়গুলো প্রত্যক্ষ করলে অনায়াসেই অনুমেয় হয় যে, এটার প্রচারক কে বা কারা? বর্তমানে মিডিয়াতে অতি গুরুত্বের সাথে ইহুদী, খৃষ্টানদের চাল-চলন, বেশ-ভূষণ, কাজ-কর্ম সম্প্রচার করা হয়। মিডিয়ায় প্রচারিত বিষয়গুলো প্রত্যক্ষ করে আমাদের মুসলিম দেশের মানুষেরা নাস্তিক ও লম্পটদের সংস্কৃতি ও উলঙ্গপনাকে পসনদসই মনে করছে। ইসলামী সংস্কৃতির চেয়ে তথাকথিত উলঙ্গপনার সংস্কৃতিকে মুসলমানদের মুষ্টিমেয় ছেলে-মেয়েরাই অগ্রাধিকার দিচেছ। ইসলামী তাহযীব-তামাদ্দুনকে এড়িয়ে চলছে।
এ মিডিয়ার যুগে যদি সঠিকভাবে ইসলাম প্রচার করা হয়, মিডিয়ার প্রতিটি সেক্টরে যদি ইসলামের বিধি-বিধান থাকে তাহ’লে ইসলামের যে কত বড় একটা খেদমত হবে তা বলাই বাহুল্য।
সম্প্রতি মুম্বাই-এর ডা. যাকির নায়েক ইসলামী মিডিয়া অঙ্গনে বড় আকারে আলোচিত ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন। তিনি মিডিয়া ব্যবহার করে ইসলাম প্রচারে একনিষ্ঠভাবে কাজ করছেন। তার পরিচালিত ‘পীস টিভি’ বর্তমানে সারাবিশ্বে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। তিনি বিধর্মীদের সাথে বিভিন্ন সেমিনার ও আলোচনায় অংশ নিচেছন। তার প্রতি সেমিনারে হাযার হাযার জনতা অংশগ্রহণ করছেন। তিনি এত জনপ্রিয়তা লাভ করেছেন শুধুমাত্র মিডিয়া চ্যানেল ও ইনটারনেটে অংশগ্রহণের কারণে। তাছাড়া তার লেকচার বিশুদ্ধ ইংরেজী ভাষায় এবং তার কথাগুলোও বৈজ্ঞানিক যুক্তিপূর্ণ। তাই যুগের পরিবর্তনে, সময়ের দাবীতে, ইসলামের খাতিরে ইনটারনেট ও টিভি চ্যানেলসহ বিভিন্ন মিডিয়ায় হক্বপন্থী আলেমদের শক্ত অবস্থান একান্ত আবশ্যক।
আজ বিশ্বজুড়ে মানুষ শান্তির বার্তা খোঁজাখুঁজি করছে। যারা বুঝেছে শান্তির ছায়া একমাত্র ইসলামেই, তারা এখন ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞানদানকারী ব্যক্তিকে তালাশ করছে। ইসলাম জানতে তারা হা করে তাকিয়ে আছে। কিন্তু মিডিয়াতে হক্বপন্থী জ্ঞানী লোকের স্বল্পতা চরম পর্যায়ে। তাই অতি শীঘ্রই এই শূণ্যতা পূরণে এগিয়ে আসতে হবে। কোন জায়গায়, কীভাবে মিডিয়াকে অপব্যবহার করা হচেছ তা পর্যবেক্ষণ করে মিডিয়ার মাধ্যমেই বাতিল শক্তির মুখোশ উন্মোচন করতে হবে। সাম্রাজ্যবাদীদের মোকাবেলায় মিডিয়াকে অস্ত্র হিসাবে গ্রহণ করতে হবে। প্রিনট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া আয়ত্তে এনে তাতে ইসলাম প্রচারের সুগম ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
বর্তমান যুগ বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও ইন্টারনেটের যুগ। তাই বিশ্বের যেকোন প্রান্তে ঘটে যাওয়া ঘটনার খবর মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে সারা দুনিয়ায়। আর এ খবর যার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে তা হ’ল এই আধুনিক নিউজ মিডিয়া। ভয়েস অব আমেরিকা, বিবিসি সহ বিশ্বের প্রধান নিউজ মিডিয়াগুলো সম্পূর্ণ ইসলাম বিদ্বেষীদের করায়ত্তে। এ কারণে প্রতিদিন ইসলাম ও ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রচার, কুৎসা রটনা ও বিভিন্ন অপপ্রচারের মাধ্যমে সহজ-সরল মানুষদেরকে ইসলাম ও ইসলামপন্থীদের সম্পর্কে ভুল ধারণা দেওয়া হচ্ছে। যার ফলে সন্দেহপ্রবণ মানুষকে ইসলামপন্থীদের পক্ষে আনা সম্ভব হচ্ছে না। তাই জ্ঞান অর্জনসহ বিভিন্ন পন্থায় নিউজ মিডিয়ার যুগে একটি বস্ত্তনিষ্ঠ ও প্রতিবাদী নিউজ মিডিয়া সৃষ্টি করলে একবিংশ শতাব্দী ইসলামের বিজয়ের শতাব্দীতে পরিণত হবে ইনশাআল্লাহ।
এ সঙ্কটময় অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য নিম্নলিখিত কয়েকটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া যেতে পারে-
(১) মুসলিম বিশ্বের জনবলকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরিত করতে হবে। মুসলিম বিশ্ব বিশেষ করে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার কাঠামো একবিংশ শতাব্দীর উপযোগী হিসাবে গড়ে তুলতে হবে।
(২) সমগ্র মুসলিম বিশ্বে গণমাধ্যম ও তথ্য প্রবাহের অবস্থা খুবই করুণ। এ অবস্থা উত্তরণের জন্য গণমাধ্যম বিষয়ক শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিতে হবে।
(৩) তথ্য ও প্রযুক্তিতে মুসলিম বিশ্ব অনেকটাই পিছিয়ে। এর অন্যতম কারণ হ’ল তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ না থাকা। ইসলামী বিশ্ব এক্ষেত্রে কোন পর্যায়ে অবস্থান করছে, এক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তথ্য প্রযুক্তি বিশ্ব এ পরিবারের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে।
(৪) OIC (Organization of Islamic Conference) কর্তৃক ১৯৭৯ সালে সঊদী আরবের রাজধানী জেদ্দায় IINA (International Ialamic News Agency) প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ। এটাকে সত্যিকার অর্থে রয়টার বা সিএনএন বা আল-জাযীরা-এর ন্যায় সংবাদ সংস্থা হিসাবে গড়ার কার্যকরী পদক্ষেপ ওআইসিকেই নিতে হবে।
(৫) মুসলিম বিশ্বের সাংবাদিক ও গণমাধ্যম কর্মীদের পারস্পরিক সম্পর্ক দৃঢ়তর ও সুনিবিড় করার লক্ষ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ বৃদ্ধি করার কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে হবে।
পরিশেষে বিশ্ব প্রতিপালকের নিকটে প্রার্থনা, বিধর্মীদের নিউজ মিডিয়ার বিরুদ্ধে তিনি আমাদেরকে শক্তিশালী নিউজ মিডিয়া গড়ে তুলে বিশ্বের মানুষের মন থেকে ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ দূর করার তাওফীক্ব দান করুন -আমীন!
– নূরজাহান বিনতে আব্দুল মজীদ