ইলম-উদ-দীনঃ ভারতবর্ষের ইতিহাসের এক অজানা অধ্যায়
১৯২৯ সাল। বৃটিশ শাসন চলছে। সে সময় ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, বার্মার কিয়দাংশ এই একই সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত। বৃটিশরা নানা কারণে সাম্রাজ্যের মানুষকে দমিয়ে রাখত। তবে ইসলামের সাথে দীর্ঘ শত্রুতার কারণে তারা জানত ইসলাম দমন করতে না পারলে তাদের সমস্যা হবে সবচেয়ে বেশী। এ কারণে মুসলিম সমাজ সবচেয়ে বেশী অত্যাচারিত ছিল। নিজেদের ইসলাম বৈরীতার পাশাপাশি অন্য ধর্মীয় যারা ইসলামের বিরুদ্ধে কিছু বলতো বা করতো, তাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে গোপন বা প্রকাশ্য সহায়তা দিত এরা। কাদিয়ানী মতবাদের পত্তন ও এর লালন পালন থেকে নিয়ে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে বিকৃত ইসলামী শিক্ষা বিস্তারের জন্য আলীয়া মাদ্রাসা স্থাপন, শির্ক ও বিদআত উৎসাহ দান, আহমাদ রেজা খান বেরলভির হাত দিয়ে মাজার পূজার মতো বিধ্বংসী শিরকি বেরলভি মতবাদ ইসলামে ঢুকিয়ে দেয়া এবং এভাবে বিকৃত ইসলামের প্রসারে তাদের চেষ্টার অন্ত ছিল না। পাগড়ির মতো ইসলামের পৌরুষদীপ্ত গৌরবময় পোষাককে খানসামা, আর্দালীদের মাথায় বাধ্যতামূলকভাবে পরিয়ে দিয়ে তারা ইসলামিক কালচারকে সুকৌশলে হেয় করার পথও অবলম্বন করে। ইসলামের খিলাফাহ তখন পতন ঘটেছে বৃটিশ-ইউরোপীয় খৃষ্টীয় শক্তি ও তাদের দোসর কামাল আতাতুর্কের হাতে। মুসলিম বিশ্ব শুরু করেছে পথহারা নাবিকের মতো পথচলা। উপমহাদেশের জর্জরিত মুসলিম জনপদ সৈয়দ আহমেদ বেরলভি, শাহ ওয়ালিউল্লাহ শহীদ প্রমুখ আপোষহীন আলিমের রক্তে রঞ্জিত হচ্ছিল।
ইসলামের এমন কোনঠাসা অবস্থায় মহাশয় রাজপাল নামের লাহোরের একজন প্রকাশক রাসুলুল্লাহ সাঃকে কটাক্ষ করে লেখা একটি বই প্রকাশ করল যার নাম ‘রঙ্গিলা রাসুল’। উপমহাদেশে এমন প্রকাশনার সাহস এর আগে কেউ করেনি। প্রিয় রাসুলের উপর এমন আঘাতে আহত হলো প্রতিটি মুসলিমের হৃদয়। ফুঁসে উঠল ভারতবর্ষ। সকলে দাবী করল এই বই বাজেয়াপ্ত করে রাজপালের উপযুক্ত শাস্তি। কিন্তু বৃটিশ শাসকদল অস্বীকার করল তা নিষিদ্ধ করতে। ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা’ সবারই আছে-এমন কথা বলে উল্লাসে গোপন হাসি হাসতে লাগলো সকল কুফফার শক্তি।
ইলম-উদ-দীন নামের ছেলেটির বয়স তখন ২০ বছর। বাবা কাঠমিস্ত্রীর কাজ করেন লাহোরে, ইলমুদ্দিনও কাজ করে তার বাবার সাথে। নিরীহ ও শান্ত স্বভাবের ছিল সে। একদিন নিজের বন্ধুর সাথে লাহোরের এক মসজিদের সামনে মানুষের বিশাল সমাবেশ দেখে এগিয়ে গেল তারা। মানুষ সমবেত হয়ে স্লোগান দিচ্ছিল মহাশয় রাজপালের বিরুদ্ধে। ওখানে গিয়ে সে ঘটনা প্রথম শুনল ইলমুদ্দীন। আঘাতে ক্ষত হলো তার হৃদয়। প্রতিজ্ঞা করল এর প্রতিশোধ সে নিবেই। পরদিন সকালেই ইলমুদ্দীন কৌশলে রাজপালের প্রকাশনা সংস্থায় গিয়ে তাকে হত্যা করল। হত্যা করার পর ইমমুদ্দীন সেখানেই আল্লাহ্র কাছে সিজদায় গিয়ে কাঁদল কিছুক্ষণ। এরপর উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল, “আমি আমার রাসুলের জন্য প্রতিশোধ নিলাম, আমি আমার রাসুলের জন্য প্রতিশোধ নিলাম”।
ইলমুদ্দীনকে সেখান থেকেই গ্রেফতার করা হলো। তাকে নিয়ে যাওয়া হলো পাঞ্জাবের মিয়ানওয়ালি কারাগারে। আদালতে ইলমুদ্দীন হত্যার দায় স্বীকার করল কিন্তু এটিকে কোন অন্যায় বলতে অস্বীকার করল। তার পক্ষে দাঁড়ালো নামকরা অনেক উকিল। প্রসিকিউটরদের আবেদন অগ্রাহ্য করে আদালত তাকে ফাঁসীর আদেশ দেয়। ১৯২৯ সালের ৩১শে অক্টোবর মিয়ানওয়ালি কারাগারে তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। মৃত্যুর পর জানাজা ছাড়াই তার মরদেহ দ্রুত সমাহিত করা হয় কারাগারের ভেতর। আল্লামা ইকবাল ও আরো অনেকের তৎপরতার ফলে কারাগারের ভেতর থেকে লাশ উত্তোলন করা হয় তার। জানাজা ও দাফনের জন্য আনা হয় লাহোরে। ভারতবর্ষ ও লাহোরের ইতিহাসে বৃহত্তম সে জানাজায় লক্ষ লক্ষ মানুষ অংশ নেয়। মানুষের চাপের কারণে পর পর তিনটি জানাজা হয় তার। গাজী ও শহীদ দুটি উপাধিই তাকে দেয় আবেগাপ্লুত জনতা। তার নাম পরিচিত হয় গাজী ইলমুদ্দীন শহীদ হিসাবে।
– আবু উসাইদ