যাকাত ও ছাদাক্বা

কষ্টের টাকায় দেয়া আমাদের যাকাত কি আদায় হচ্ছে?

রমজান মাসে বিভিন্ন কাপড়ের দোকান আর মার্কেটের সামনে প্রায়ই একটা ব্যানার ঝুলতে দেখা যায় তা হলো-“এখানে যাকাতের শাড়ি ও লুঙ্গি পাওয়া যায়”। এই দোকানগুলোতে ঢুকলে নিম্নমানের ছাপা শাড়ী কিংবা মানহীন লুঙ্গীর স্তুপ দেখা যায় যা যাকাতের কাপড় বলে বিক্রি করা হয়। আমাদের দেশের মানুষ এ সকল শাড়ি কিংবা লুঙ্গি লটে কিনে নিয়ে ঈদের সময় বাড়ী গিয়ে কাজের লোক এবং আশপাশের দরিদ্র লোকদের হাতে একটি করে তুলে দেয়, আর এভাবেই যাকাত আদায় হয়ে গেছে বলে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ে। কোন কোন ‘বিজনেস ম্যাগনেট’ বিরাট ট্রাক বোঝাই যাকাতের কাপড় নিয়ে বিতরণ করতে আসে আর অসহায় দরিদ্র মানুষ হুড়োহুড়িতে পায়ের নীচে চাপা পড়ে মারা যায়। যাকাত নামের ইসলামের এই অতি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ আজ আমাদের কাছে সস্তা শাড়ী আর লুঙ্গির মতোই ছেলেখেলার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। অথচ আমরা জানিনা, সামান্য ভুল বা গাফিলতির জন্য যাকাত ঠিকমতো আদায় না হলে অপরিসীম গুনাহের বোঝা নিয়ে আল্লাহর কাছে আমাদের হাজির হতে হবে, আল্লাহ যদি ক্ষমা না করেন যার পরিণতি আগুন পর্যন্ত গড়াতে পারে।

যাকাত এমন এক স্পর্শকাতর বিষয় যা শুধু বিশ্বাস করলেই হয়না বরং তা সূক্ষ্মতম হিসাবে হিসাব করে আদায় করতে হয়। রাসুলুল্লাহ সাঃ এর ইন্তেকালের পর সারা আরব উপদ্বীপে ইসলাম ত্যাগের হিড়িক পড়েছিল। কোন কোন গোত্র সরাসরি ইসলাম ত্যাগের ঘোষণা দিয়েছিল আর কেউবা আল্লাহ ও রাসুলের উপর বিশ্বাস রেখে রাসুল সাঃ এর পর অন্য একজনকে নবী মেনে নিয়েছিল। এর মধ্যে সবচেয়ে নমনীয় যে দলটি ছিলো তারা বলেছিল, আমরা আল্লাহ, তাঁর রাসুল মুহাম্মাদ সাঃ, সালাত, সিয়াম, হাজ্জ্ব এগুলোর সবই বিশ্বাস করি এবং পালন করব কেবল আমরা মুসলিম কেন্দ্রীয় খলিফাকে যাকাত দেবোনা। কিন্তু আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু এই দলটিকে অমুসলিম ঘোষণা করে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। সুবহানাল্লাহ, আল্লাহ আবু বকরের মাধ্যমে সামান্য কিছু মুসলিমের দলকে যাকাত অস্বীকারকারী ওই বিশাল দলটির উপর বিজয় দিয়ে সে ফিতনা নির্মুল করেছিলেন।

অর্থাৎ, যাকাত হলো ইসলামের সে স্তম্ভ যা অস্বীকার করলে যে কেউ অমুসলিম হয়ে যাবে আর তা সময়মতো না আদায় করলে কবীরা গুনাহর অধিকারী হবে। মানবজাতির ইতিহাস আল্লাহর নির্ধারিত যাকাত নির্ভর অর্থনীতি থেকে শক্ত আর সাম্যের কোন অর্থব্যবস্থা আর দেখেনি। যাকাত দেবার খাতকে নির্ধারিত করে আল্লাহ যেমন সাধারণ ট্যাক্সের মতো এই অর্থের অপব্যবহার চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছেন, তেমনি একে ফরজ করে দিয়ে এবং একে অসচ্ছ্বলের অধিকার ঘোষণা করে সমাজে ধনী আর দরিদ্রের ব্যবধান বাড়বার পথকে রুদ্ধ করে দিয়েছেন। আল্লাহু আকবার।

আমরা সংক্ষেপে যাকাত ও এর বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করবো।

কাদের উপর যাকাত ফরজঃ

আল্লাহ মুসলিম সামর্থবান সকল নর-নারীর উপরই কয়েকটি শর্ত সাপেক্ষে যাকাত ফরজ করেছেন। শর্তগুলো মোটামুটি এরকম-নির্দিষ্ট পরিমাণ সোনা বা রূপা বা এর সমমূল্যের টাকা বা ইনভেস্টমেন্ট যদি এক হিজরী বছর বা চান্দ্র বছর কারো অধিকারে থেকে থাকে তাহলে তাকে যাকাত দিতে হবে। নির্দিষ্ট এই পরিমানকে বলে ‘নিসাব’। আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত নিসাব হচ্ছে- সাড়ে সাত তোলা বা ৮৫ গ্রাম খাঁটি সোনা অথবা সাড়ে বায়ান্ন তোলা বা ৫৯৫ গ্রাম খাঁটি রূপা বা এর সমপরিমান অর্থ।

সোনা বা রূপা হচ্ছে আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত প্রমাণ ধাতু যার মূল্য চিরকাল মানুষের কাছে অটুট থাকবে। মানব ইতিহাসের শুরু থেকে সোনা এবং রূপার তুলনামূলক মূল্য উঠানামা করেছে। কখনও সোনার দাম রূপার দামের তুলনায় বেশী হয়েছে আবার কখনও রূপার দাম এই দুইয়ের মধ্যে বেড়ে গেছে। যখন সোনা ও রূপার মুদ্রা বা দীনার ও দিরহাম ভিত্তিক অর্থব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে উনবিংশ শতাব্দীতে আমেরিকা ও তার অনুচরেরা কাগজের মুদ্রা ভিত্তিক অর্থব্যবস্থা চালু করেছে, তখন থেকেই বিশ্ব ইতিহাসে সোনা ও রূপার দামে অস্বাভাবিক ভারসাম্যহীনতা তৈরী হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাঃ এর সময় যেখানে সাড়ে সাত তোলা সোনা আর সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার দাম সমান ছিলো সেখানে আজ সাড়ে সাত তোলা সোনার দাম চার লাখ তেইশ হাজার টাকা হয়ে গেছে, অথচ সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার দাম মাত্র আটাত্তর হাজার টাকার মতো (মে, ২০১২ হিসাব অনুযায়ী)। কিন্তু বিশ্ব অর্থনীতিতে মানব দুর্বৃত্তায়নের এ গতিপথ আল্লাহর জ্ঞানের বাইরে নয়। প্রকৃত সত্য আল্লাহই জানেন তবে এ জন্যই হয়তো আল্লাহ যাকাতের নিসাবে শুধু সোনা বা শুধু রূপার পরিমানকে নির্দিষ্ট করে দেননি, দুটোই রেখেছেন।

আজকের এ সময়ে নিসাবের মূল্য তাই রূপা দিয়েই হিসাব করতে হবে। অর্থাৎ, যাকাত দেবার জন্য কারো কাছে এক চান্দ্র বছরে চার লাখ বেয়াল্লিশ হাজার নয়, মাত্র সাতাত্তর হাজার টাকা থাকলেই তাকে যাকাত দিতে হবে।

কাদেরকে যাকাত দেয়া যাবেঃ

যাকাতের খাতকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন এবং এর অন্যথা করলে যাকাত যেমন আদায় হবেনা, তেমনি কবীরা গুনাহের মতো অপরাধ হবে। আল্লাহ কুরাআনে যাকাতের যোগ্য লোকদের ঘোষণা দিয়েছেন সুরা তাওবার ৬০ নং আয়াতে। তিনি বলেছেন-

“সদাকা (যাকাত) হচ্ছে গরীব-মিসকীনদের জন্য, এর (ব্যবস্থাপনায় কর্মরত) কর্মচারীদের জন্য, যাদের অন্তঃকরণ (দ্বীনের প্রতি) অনুরাগী করার প্রয়োজন তাদের জন্য, কোন ব্যক্তিকে গোলামীর বন্ধন থেকে আজাদ করার জন্য, ঋণগ্রস্থ ব্যক্তিদের (ঋণমুক্তির) জন্য, আল্লাহর পথের জন্য ও মুসাফীরদের জন্য। এটা আল্লাহ তাআলার নির্ধারিত ফরজ। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাআলা (সব কিছু) জানেন এবং তিনি হলেন বিজ্ঞ, কুশলী”।

এখানে আল্লাহ ৮টি খাতের কথা উল্লেখ করেছেন। এ খাতগুলো সম্পর্কে আমরা কিছুটা বিস্তারিত জানার চেষ্টা করব।

১। গরীব (আল্লাহ বলেছেন ‘ফুকারা’) – এরা হচ্ছে সে সকল লোক যাদের কাছে কিছুই নেই বা নিঃস্ব।

২। মিসকিন (আল্লাহ বলেছেন ‘মাসাকিন’) – যার কিছু সম্পদ আছে কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। এক্ষেত্রে তার সম্পদ হতে হবে যাকাতের নুন্যতম নিসাবের চেয়ে কম এবং তার উপার্জন বা আয় এমন হতে হবে যা তার জন্য যথেষ্ট নয়।

৩। যাকাত আদায়কারী – রাসুলুল্লাহ সাঃ এর সময় থেকে শুরু করে ইসলামী খিলাফাতের সাম্প্রতিক অতীতের সময় পর্যন্ত যাকাত আদায়ের জন্য খলিফা এবং প্রাদেশিক গভর্ণরের নিয়োগ করা যাকাত আদায়কারী ছিলো। তারা একদিকে যেমন যাকাত আদায় করে কেন্দ্রে পাঠাতো তেমনি ঈর্ষণীয় আমানতদারীর সাথে মানুষকে যাকাত আদায় করার জন্য সাহায্য করত। এই দলের সদস্যের জন্য যাকাতের টাকা থেকে বেতন-ভাতা বা উপহার দেবার দেবার অনুমতি আল্লাহ দিয়েছেন, এমনকি তারা যদি যথেষ্ট ধনী হয় তবুও।

৪। যাদের অন্তঃকরণ দ্বীনের প্রতি অনুরাগী করা প্রয়োজন – এই খাতটিতে কয়েকটি অপশন রয়েছে। প্রথমতঃ নও মুসলিম, যারা নতুন ইসলাম গ্রহণ করেছে কিন্তু কিছুটা দোদুল্যমান অবস্থায় আছে-তাদের যাকাত দেয়া যাবে। দ্বিতীয়তঃ যে ইসলামের শত্রু, কিন্তু তাকে অর্থ সাহায্য দিলে সে কম ক্ষতি করার সম্ভাবনা আছে তাকে দেয়া যাবে। তৃতীয়তঃ যারা এখনো ইসলামে আসেনি কিন্তু ইসলামের প্রতি সহানুভুতিশীল এবং অর্থ সাহায্য তাকে ইসলামের দিকে ঝুঁকাতে পারে তাকে দেয়া যাবে।

৫। গোলামীর বন্ধন থেকে আযাদ করার জন্য – এরও কয়েকটি অপশন আছে। যেমন, কোন ক্রীতদাস যদি তার মনিবের সাথে এরকম লিখিত চুক্তিতে আসে যে এতো পরিমান টাকা দিলে তাকে মুক্ত করে দেয়া হবে তাকে যাকাত দেয়া যাবে। আবার কোন দাস যদি কোন চুক্তিতে নাও আসে, তাকেও যাকাতের টাকা দিয়ে মনিব থেকে মুক্ত করা যাবে। যেসব মুসলিম যুদ্ধে শত্রু শিবিরের হাতে বন্দী হয়, তাদের মুক্ত করার জন্য মুক্তিপণ হিসাবে যাকাত দেয়ে যাবে।

৬। আল্লাহর পথে বা ফী সাবিলিল্লাহ – এই খাতটি হলো শুধুমাত্র আল্লাহর পথে জিহাদের জন্য। আমাদের দেশে ফী সাবিলিল্লাহ, আল্লাহর পথে বা আল্লাহর ওয়াস্তে কথাগুলোর বিচিত্র সব অর্থ আছে। কেউ যদি তার কোন কিছু হারিয়ে ফেলে তা খুঁজে না পায় তাহলে বলে-‘গেলো ভাই ফী সাবিলিল্লাহ’, আবার কেউ লক্ষ টাকা থেকে দু-তিন টাকা ফকিরকে ভিক্ষে দিয়ে বলে ‘দিলাম ফী সাবিলিল্লাহ’, কেউবা আল্লাহর পথের নামে প্রকৃত ইসলামের শিক্ষার বাইরের কোন বিষয় আবিষ্কার করে নিয়েছে। অথচ পবিত্র কুরআনে আল্লাহ ফী সাবিলিল্লাহ বলতে জিহাদকেই বুঝিয়েছেন। কোন কোন ইসলামী স্কলার হাজ্জ্বকেও ফী সাবিলিল্লাহর একটি খাত বলেছেন, তবে বলেছেন জিহাদই হলো ফী সাবিলিল্লাহর প্রধান খাত।

৭। ঋণগ্রস্থ ব্যক্তির ঋণমুক্তির জন্য – এক্ষেত্রে ঋণগ্রস্থ ব্যক্তির সম্পদ এমন হতে হবে যে তা যাকাতের নিসাব থেকে কম।

৮। মুসাফীর – সেই মুসাফীর যে তার সম্পদ থেকে বিচ্ছিন্ন আছে। হতে পারে সে নিজ অঞ্চলে অনেক ধনী, কিন্তু সফর অবস্থায় কোন বিপদে পড়লে তাকে যাকাত দেয়া যাবে। যেমন, কোন ব্যক্তি যার বাড়ী হলো চট্টগ্রাম এবং সেখানে তিনি ধনী ব্যবসায়ী যদি ঢাকায় কোন কাজে এসে ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে সব খুইয়ে বসেন, তাহলে তাকে যাকাত দেয়া যাবে এবং এই টাকা তাকে আর ফেরত দিতে হবেনা। তেমনিভাবে কোন অচেনা মুসাফির যদি হাসপাতালের বিছানায় অজ্ঞান অবস্থায় থাকেন, তাকে যাকাত দিয়ে সাহায্য করা যাবে।

আলহামদুলিল্লাহ, আশা করি যাকাতের খাতের এ আলোচনা থেকে আমরা অনেক প্রশ্নের উত্তর পাবো। মনে রাখতে হবে যে কাউকে গরীব হিসাবে যাকাত দিতে গেলে তাকে আল্লাহ ঘোষিত ‘ফুকারা’ বা ‘মিসকিন’ এর মধ্যে পড়তে হবে। এক্ষেত্রে তার যদি নিসাব পরিমাণ কোন সম্পদ থাকে তাহলেই যাকাত পাবার সুবিধা থেকে সে বঞ্চিত হবে। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি আমাদের গ্রামে এমন অনেক লোক যাকাত নেবার জন্য মানুষের কাছে আসে যার নিজেরই যাকাত ফরজ হয়ে আছে। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন এবং অপাত্রে যাকাত দেয়া থেকে আমাদের আশ্রয় দিন।

এবার আমরা যাকাত বিষয়ক আরো কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করব যাকে বলা যায় FAQ বা Frequently Asked Questions.

যাকাত কখন দিতে হবে, তা কি রামাদান মাসেই দিতে হবে?

যাকাতের জন্য শর্ত হলো নিসাব পরিমান সম্পদ এক হিজরী সাল (গ্রেগরিয়ান সাল নয়) নিজ অধিকারে থাকতে হবে। এই গনণা যে কোন মাসে শুরু করা যায়-মুহাররম, সফর, রাবিউল আউয়াল……কিংবা রামাদান যে কোন মাস। সুতরাং যে কোন মাসে যাকাত আদায় করা যাবে, শুধু রমজানে নয়। তবে রমজান মাস আল্লাহর পক্ষ থেকে রাহমাতের মাস বলে সাধারণতঃ এ মাসেই মানুষ তা আদায় করে নিতে চায় এবং এটা দোষের কিছু নয়। তবে কোন সম্পদের হিসা যদি রমজানের আগে থেকেই শুরু হয়ে থাকে এবং রমজানের আগেই এক হিজরী বছর হয়ে যায়, তাহলে তা অবশ্যই সে হিসাবেই দিতে হবে।

যাকাতের পরিমানঃ

যাকাত হলো সম্পদের শতকরা আড়াই ভাগ বা চল্লিশ ভাগের একভাগ। তবে পশুসম্পদের জন্য আলাদা যাকাত আছে যা আমাদের আলোচনায় আনা হলোনা।



অন্য কারো যাকাত কি আদায় করে দেয়া যাবে?


হ্যাঁ, যাবে। হোক সে কোন আত্মীয় বা অন্য কেউ।

মূলধন এবং লাভঃ

যদি কারো বছরের শুরুতে মূলধন একটি থাকে আর বছরের শেষদিকে তা বেড়ে যায় তাহলে পুরো হিসাবের উপর যাকাত হবে। যেমন, কারো বছরের শুরুতে মূলধন ১ লাখ টাকা থাকলে এবং বছরের শেষদিকে ৫০ হাজার টাকা লাভ হলে তাকে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকার উপরই যাকাত দিতে হবে। এক্ষেত্রে যাকাত হবে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকার ২,৫%।

স্ত্রীর সোনা বা রূপার অলংকারের যাকাতঃ

স্ত্রীর অলংকারের যাকাত তার নিজেকেই দিতে হবে স্বামীকে নয়। যদি স্বামী চায় তাহলে সে তা স্ত্রীর পক্ষ থেকে আদায় করতে পারবে। যদি স্বামী না দিতে চায় এবং স্ত্রীর নিজস্ব আয় না থাকে, তাহলে কিছু স্বর্ণ বা রূপা বিক্রী করে হলেও স্ত্রীকে যাকাত আদায় করতে হবে।

সম্পত্তি, বাড়ী, গাড়ীর যাকাতঃ

• যে বাড়ীতে থাকে তার যাকাত দিতে হবেনা, যদি একাধিক বাড়ী থাকে তবুও না।

• জমি ব্যবসার জন্য কেনা জমি ছাড়া অন্য কোন জমির জন্য যাকাত দিতে হবেনা।

• যদি কোন জমিতে হ্যবসা প্রতিষ্ঠান, দোকান ইত্যাদি থাকে তারও যাকাত দিতে হবেনা।

• ব্যবসার জন্য ব্যবহৃত সম্পদ যেমন-ফার্নিচার, ট্রাক, বুলডোজার ইত্যাদির যাকাত দিতে হবেনা।

মাসিক ভিত্তিতে যাকাতঃ

যাকাত হলো আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত ফরজ এবং তা হলো অন্যের হক। ফরজ হবার পর এ টাকা দিতে দেরী করার অবকাশ নেই। যাকাতের টাকা পুরো হিসাব করে তা থেকে প্রতি মাসে মাসে একান্ত প্রয়োজন ছাড়া দেয়া যাবেনা।

অগ্রিম যাকাতঃ

যাকাত বছর ঘুরে আসার আগেই আদায় করা যাবে। এক্ষেত্রে কম বা বেশী হলে পরবর্তিতে তা ব্যালেন্স করা যাবে।

বাবা যদি সন্তানের নামে টাকা জমা রাখেঃ

সন্তানকে যদি ওই টাকার উপর পুরো অধিকার দেয়া হয় তাহলে সন্তানকে যাকাত দিতে হবে, অন্যথায় বাবাকেই তার যাকাত দিতে হবে।

বাড়ীভাড়ার উপর যাকাতঃ

কোন লোকের যতটি বাড়ীই থাকুক তা যদি বিক্রি করে ব্যবসার উদ্দেশ্য না থাকে তাহলে তার যাকাত দিতে হবেনা। তবে সে বাড়ীর ভাড়ার টাকা যদি বছর শেষে নিসাব অতিক্রম করে তাহলে তার যাকাত দিতে হবে।

স্ত্রীর যাকাত স্বামী পেতে পারে কি?

হ্যাঁ, স্বামী যদি যাকাত নেবার মতো হয় তাহলে স্ত্রী স্বামীকে যাকাত দিতে পারবে।

বছরের শুরুতে নির্দিষ্ট টাকা ছিলো, বছর শেষে তা বেড়েছেঃ

এর ৩টি ক্ষেত্র আছে।

• প্রথম ক্ষেত্রটি আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন শুরুতে মুলধন ১০০০০০ টাকা থেকে বেড়ে ৫০০০০০ টাকা হলে ৫০০০০০ টাকার উপর আড়াই শতাংশ যাকাত দিতে হবে।

• যদি মূলধন না বেড়ে অন্য উৎস থেকে আসে যেমন- গিফট, অন্য কিছু বিক্রয়লব্ধ অর্থ ইত্যাদির ক্ষেত্রে যখন সে টাকা মূলধনের সাথে মিলেছে সেই সময় থেকে হিজরী বছর হিসাব করে এর জন্য আলাদা যাকাত দিতে হবে।

• যদি ধীরে ধীরে টাকা বাড়ে যেমন মাঝে মাঝে বেতনের টাকা জমিয়ে রাখা এবং এভাবে বেড়ে ওঠা টাকা যদি নিসাব অতিক্রম করে তাহলে দুভাবে যাকাত দেয়া যায়। প্রথমতঃ পুরো টাকার উপর এক বছর হিসাব করে, দ্বিতীয়তঃ প্রতি মাসের হিসাব আলাদা করে এবং আলাদা আলাদা করে বছর হিসাব করে।

বাড়ী বা গাড়ী বিক্রি করলেঃ

বাড়ী বা গাড়ী বিক্রি করে ব্যবসা করার উদ্দেশ্য থাকলে তার যাকাত দিতে হবে। কিন্তু যদি এ উদ্দেশ্য থাকে যে এর আর প্রয়োজন নেই তাহলে তার যাকাত দিতে হবেনা।

শেয়ারের যাকাতঃ

প্রথমতঃ বর্তমানের শেয়ার বাজার ইসলামী বিধান সম্মত নয়। সুতরাং মুসলিমদের উচিৎ কোন ব্যবসাতে ইনভেস্ট করলে আলাহকে ভয় করেই তা করা।

দ্বিতীয়তঃ শেয়ারের ইনভেস্টের পুরো টাকার যাকাত দিতে হবে যদি তা নিসাব এবং বছর অতিক্রম করে। এক্ষেত্রে যে দামে শেয়ার কেনা হয়েছে সে দামের উপরেই যাকাত দিতে হবে তার প্রাইমারী মূল্য যাই হোক না কেন। যদি সে শেয়ারে লাভ হয় তাহলে লাভের অংশ সহ হিসাব করে যাকাত দিতে হবে, যদি লস হয়ে থাকে তাহলে লস হিসাব করে তা মূল ইনভেস্টমেন্ট থেকে বাদ দিয়ে তার যাকাত দিতে হবে। লস হবার পর যদি টাকা নিসাবের নীচে নেমে যায় তাহলে তার যাকাত দিতে হবেনা।

বেতনের উপর যাকাতঃ

নেই, যতক্ষন পর্যন্ত তা সঞ্চয় করে করে নিসাব অতিক্রম না করে।

আগের বছরগুলোতে না দেয়া যাকাতঃ

যাকাত হলো আল্লাহর নির্ধারিত ফরজ এবং তা আদায় না করলে ভয়াবহ শাস্তির কথা আল্লাহ বলেছেন। কেউ যদি অজ্ঞানতায় বা গাফিলতির জন্য আগের বছরগুলোতে যাকাত না দিয়ে থাকে তাহলে আল্লাহর কাছে তওবা করে সকল বছর হিসাব করে যাকাত দিয়ে দিতে হবে। এর কোন অন্যথা নেই, কেননা এটা অন্যের হক বা অধিকার।

ঋণগ্রস্থ ব্যক্তির যাকাতঃ

আমাদের দেশে একটি ভুল ধারণা প্রচলিত আছে যে ঋণগ্রস্থ ব্যক্তির যাকাত দেবার প্রয়োজন নেই। ইসলামী বিধানে এ কথার কোন ভিত্তি নেই। অধিকাংশ স্কলার এ মত দিয়েছেন।



যাকাত কাদেরকে দেয়া যাবেনাঃ


অনেক সময় আমরা এমন ব্যক্তিকে যাকাত দিয়ে দেই যে অভাবী হলেও সামর্থবান। যাকাত কাদের দেয়া যাবেনা এ ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন,

“যাকাতে তাদের কোন অংশ নেই যে ব্যক্তি স্বাধীন এবং যে বেক্তি শক্ত সামর্থ এবং নিজের জীবনধারণের জন্য উপার্যনক্ষম”। (আবু দাউদঃ১৩৯১, নাসায়ীঃ২৫৫১ এবং আলবানীর মতে সহীহ)।

“যাকাত তাকে দেয়া যাবেনা যে ধনী অথবা তাকে দেয়া যাবেনা যে সুস্থ ও সবল”। (আবু দাউদঃ১৩২৯, তিরমিজিঃ৫৮৯, নাসায়ীঃ২৫৫০, ইবন মাজাহঃ১৮২৯; নাসায়ীর তাহকিকে আলবানী একে সহীহ বলেছেন)।

যাকাত না দেবার অপরাধ ও শাস্তিঃ

যাকাত বিশ্বাস না করা বা দিতে অস্বীকার করা স্পষ্ট কুফর এবং তা করলে কেউ মুসলিম থাকে না। আর কেউ যদি যাকাত বিশ্বাস করে ইচ্ছাকৃতভাবে তা আদায় না করে তাহলে তা হলো ভয়াবহতম গুনাহর মধ্যে একটি।

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ এ ব্যাপারে বলেছেন-

“আল্লাহ তাআলা নিজের অনুগ্রহ দিয়ে তাদের যে প্রাচুর্য দিয়েছেন, যারা তা আল্লাহর পথে ব্যয় করতে কার্পণ্য করে-তারা যেন কখনও এটা মনে না করে যে তাদের জন্য কল্যাণকর কিছু হবে; না, এ কৃপণতা তাদের জন্য খুবই অকল্যাণকর। কার্পণ্য করে তারা যা জমা করেছে, অচিরেই কিয়ামাতের দিন তা দিয়ে তাদের গলায় বেড়ী পরিয়ে দেয়া হবে। আকাশসমূহ আর জমিনসমূহের উত্তরাধীকার তো আল্লাহরই জন্য, আর তোমাদের প্রতিটি কার্যকলাপ সম্বন্ধে আল্লাহ বিশেষভাবে অবগত আছেন”। সুরা আল ইমরানঃ ১৮০

আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন। যাকাত এবং ইসলামের অন্য সকল বিধান পুরোপুরি মেনে চলার ভাগ্য আমাদের দান করুন। তাদের ভেতর শামিল হওয়া থেকে আমাদের আশ্রয় দিন যাদের তিনি নিশ্চিত শাস্তির ঘোষণা দিয়েছেন। আমীন।

যাকাতের আলোচনার অধিকাংশ অংশ বিখ্যাত স্কলারদের ফাতওয়া থেকে নেয়া হয়েছে। এদের মধ্যে আছেন শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়াহ, আব্দুল্লাহ বিন বায, সালিহ আল উসাইমিন, সালিহ আল মুনাজ্জিদ প্রমুখ। এর উৎস হলো ওয়েবসাইট www.islamqa.com

– আবু উসাইদ

১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

Back to top button