বিরোধীদের প্রতি ইমাম ইবনু তায়মিয়া (রহঃ)-এর ক্ষমাসুন্দর আচরণ
মিসরে অবস্থানকালে শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তায়মিয়া (রহঃ) ভ্রান্ত ছূফীদের দ্বারা সবচেয়ে বেশী নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। সেখানে তিনি শিক্ষকতা, মানুষের আক্বীদা-আমল মযবূতকরণ এবং মানুষের মাঝে ছড়িয়ে থাকা উদ্ভট উপাখ্যান ও অলৌকিক কাহিনী অপনোদন সহ বহুমুখী দাওয়াতী কাজে লিপ্ত ছিলেন। কিন্তু সেখানকার ভ্রান্ত ছূফী-সাধকরা তাঁর এই সংস্কার কার্যক্রমকে মোটেও সহ্য করতে পারছিল না। এক পর্যায়ে তারা ছূফীপন্থী ও সাধারণ মানুষদের জড়ো করে মিসরের গভর্ণরের নিকটে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ পেশ করল এবং তাঁকে কারাগারে নিক্ষেপ করতে বাধ্য করল।
কিন্তু ইবনু তায়মিয়া (রহঃ) কারাগারেও ছিলেন স্বীয় লক্ষ্যে অবিচল। বন্দী অবস্থাতেই তাঁর দরস চলতে থাকল অবিরত। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ দ্বীনী বিষয়ে জ্ঞানার্জন এবং বিভিন্ন ফৎওয়া জানতে কারাগারে তাঁর সাথে সাক্ষাতের জন্য ভীড় জমাতে লাগল। ফলে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁকে ইস্কান্দারিয়ার কারাগারে পাঠিয়ে দিয়ে মানুষের সাক্ষাৎ নিষিদ্ধ করল। এরূপ বিপদাপদের ক্ষেত্রে ইবনু তায়মিয়া (রহঃ) সর্বদা ধৈর্যশীল থাকতেন এবং এর বিনিময় শুধুমাত্র আল্লাহর নিকটেই কামনা করতেন। তিনি মন্দ আচরণের বিপরীতে উত্তম আচরণ করতেন। অত্যাচারের বিনিময় ক্ষমা দ্বারা প্রদান করতেন। শত বিপদ সত্ত্বেও সর্বদা নির্ভীকচিত্তে হক প্রকাশ করতেন এবং প্রশ্নকারীকে সর্বোচ্চ আমানত ও ন্যায়পরায়ণতার সাথে উত্তর দিতেন।
তিনি শত্রুদের প্রতি সর্বদাই ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতেন। যেমন তিনি বলেন, ‘আমি সর্বদা আমার বিরোধীদের ব্যাপারে উদারচিত্ত। যদি কেউ আমার বিরুদ্ধে কুফরী ও ফাসেকীর মিথ্যা অপবাদ দেয় বা জাহেলী গোঁড়ামির মাধ্যমে আল্লাহর নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করে, তবে সেক্ষেত্রে আমি সীমালংঘন করব না। বরং আমি ন্যায়পরায়ণতার সাথে এ ব্যাপারে আমার বক্তব্য এবং করণীয় নির্ধারণ করব। আমি আমার কথা ও কাজকে কুরআনের অনুগামী করব। যা আল্লাহ অবতীর্ণ করেছেন এবং মানুষের জন্য মতভেদপূর্ণ বিষয়ে হেদায়াত হিসাবে নির্ধারণ করেছেন (ইবনু তায়মিয়া, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ৩/২৪৫)।
পরবর্তীতে জেল থেকে বের হওয়ার পর তিনি আল-ইস্তিগাছাহ (الاسةغاثة) নামে একটি পুস্তিকা রচনা করেন, যেখানে তিনি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নিকটে সাহায্য প্রার্থনার ক্ষেত্রে শরী‘আতের বিধান সম্পর্কে আলোকপাত করেন। এর মাধ্যমে তিনি সমকালীন ছূফী শায়খ আলী বিকরীর লিখিত একটি বইয়ের প্রতিবাদ করেছিলেন। কিন্তু ফল হ’ল উল্টো। শায়খ বিকরী ইবনে তায়মিয়ার দলীল ভিত্তিক লেখনীর উত্তর দিতে না পেরে তাঁর বিরুদ্ধে কুফরী এবং মুসলিম মিল্লাত থেকে খারিজ হয়ে যাওয়ার ফৎওয়া জারী করলেন। বিভিন্ন কর্মকান্ডের মাধ্যমে তাকে কষ্ট দিতে লাগলেন। এমনকি বাদশাহর নিকটে তার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ পেশ করলেন এবং প্রশাসনিক দায়িত্বশীলসহ সাধারণ জনগণকে তাঁর বিরুদ্ধে উস্কে দিয়ে তাঁকে হত্যা করার জন্য প্ররোচনা দিতে লাগলেন।
তার এ প্রচারণার ফলে অনেকেই তাকে শাস্তি দেওয়ার পক্ষে মত দিল। কেউ কেউ তাকে হত্যা করতে চাইল। এভাবে বেশ কিছুদিন অপপ্রচার চলার পর একদিন শায়খ বিকরীসহ একদল ছূফী ইবনু তায়মিয়াকে একাকী পেয়ে আক্রমণ করে বসল এবং তাকে কঠিনভাবে প্রহার করল। এভাবে একাধিকবার তারা তার উপর অত্যাচার করল। তার পোষাক ছিন্ন-ভিন্ন করে দিল। কিন্তু সকল অত্যাচারের বিরুদ্ধে অসীম ধৈর্যের প্রতীক ইবনু তায়মিয়া (রহঃ) আল্লাহর নিকট কেবল একটি ফরিয়াদই জানিয়েছিলেন, হাসবুনাল্লাহু ওয়া নি‘মাল ওয়াকীল….।
এভাবে মাত্রাতিরিক্ত অত্যাচার সত্ত্বেও তাঁর এই অবিচলতায় মুগ্ধ হয়ে সাধারণ মানুষ একসময় প্রকৃত সত্য উপলব্ধি করতে সক্ষম হ’ল। ফলে তারা বিকরী ও তার ছূফী সাথীদের বিরুদ্ধে চরমভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। সমাজে ফেতনা-ফাসাদ ছড়ানোর কারণে প্রশাসনও তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী করল। ফলে সে পালিয়ে গেল এবং আত্মগোপন করল। এদিকে সাধারণ জনগণ এবং রাষ্ট্রীয় ব্যক্তিবর্গ ইবনু তায়মিয়ার কাছে গিয়ে তার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার দাবী জানালো। তারা বলল, আপনি যদি পুরো মিসরকে ধ্বংস করার নির্দেশ দেন তবে আমরা আপনার জন্য তাই করব। ইবনু তায়মিয়াহ বললেন, এটা তোমরা করতে পার না। তারা বলল, এইসব ছূফীরা মানুষের মাঝে বিশৃংখলা সৃষ্টি করছে এবং সমাজে ফেতনা ছড়িয়ে দিচ্ছে। সুতরাং আমরা তাদেরকে হত্যা করব এবং ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেব। ইমাম বললেন, এটা তোমাদের জন্য জায়েয হবে না। তারা বলল, তবে তারা আপনার উপর যে নির্যাতন চালিয়েছে তা কি জায়েয ছিল? এতকিছুর পর কোনভাবেই ধৈর্যধারণ সম্ভব নয়। আমরা অবশ্যই আগামীকাল আমাদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করব। একথা শুনে ইবনু তায়মিয়াহ তাদেরকে ধমক দিলেন এবং বললেন, أَنَا مَا انْتَصِرُ لِنَفْسِيْ ‘আমি নিজের ব্যাপারে কখনোই কারো উপর প্রতিশোধ নেব না’। অতঃপর তাদের উপর আক্রমণের অনুমতির জন্য তারা পীড়াপীড়ি শুরু করলে তিনি স্বীয় সিদ্ধান্ত তাদের জানিয়ে দিয়ে বললেন, إما أن يكون الحق لي أو لكم أو لله فإن كان الحق لي فهم في حل منه وإن كان لكم فإن لم تسمعوا مني ولا تستفتوني فافعلوا ما شئتم وإن كان الحق لله فالله يأخذ حقه إن شاء كما يشاء ‘যদি আমি শাস্তিদানের অধিকারী হয়ে থাকি, তাহ’লে আমার পক্ষ থেকে তারা মুক্ত। আর যদি এর হকদার তোমরা হয়ে থাক এবং এ ব্যাপারে আমার কথা না শোন, তাহ’লে আমার কাছ থেকে সিদ্ধান্ত না নিয়ে তোমরা যা খুশী কর। আর যদি স্বয়ং আল্লাহ এর হকদার হয়ে থাকেন, তবে তিনি যা খুশী এবং যখন খুশী তার প্রতিশোধ নিবেন’।
নাছোড়বান্দা জনগণ আবারো বলল, তবে কি তারা আপনার উপর যা করেছে তা তাদের জন্য হালাল হয়েছে? তিনি বললেন, তারা যা করেছে, হয়ত এর জন্য তারা নেকীই লাভ করেছে।
তারা বলল, যদি আপনি এটাই বলেন তবে তো তারাই হকের উপর আর আপনি বাতিলের উপর রয়েছেন। তাহ’লে তাদের কথা মেনে নিয়ে একমত হয়ে যান। ইবনু তায়মিয়াহ বললেন, বিষয়টি এমন নয়। বরং হয়ত তারা ভুল ইজতিহাদ করে আমার উপর অত্যাচার করেছে। আর ইজতিহাদে ভুল করে ফেললে তার জন্য একটি নেকী রয়েছে। এবার জনগণ তাদের ভুল বুঝতে পারল এবং বলল, তিনি যা বলেছেন সেটাই সত্য।
কিন্তু জনগণ তার সিদ্ধান্ত মেনে নিলেও প্রশাসন এই ছূফীদের পিছু ছাড়ল না। তারা আরো জোরে-শোরে বিকরীকে খুঁজতে লাগল। ফলে সে একস্থান থেকে অন্য স্থানে পালাতে পালাতে একসময় পালানোর জায়গাও আর থাকল না। অবশেষে সে ইবনু তায়মিয়ার গৃহে পালিয়ে থাকার জন্য আশ্রয় চাইল। উদারচিত্ত ইবনু তায়মিয়া তাকে নিজ গৃহে আশ্রয় দিলেন এবং বাদশাহর নিকটে তাকে ক্ষমার জন্য সুফারিশ করলেন। অতঃপর তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হ’ল।
[আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ (দারুল ফিকর : ১৯৮৬) ১৪/৭০, ১১৪; মুহাম্মাদ বিন আহমাদ আল-মাকদেসী, আল-ঊকূদুদ দুর্রিইয়াহ মিন মানাকেবে ইবনু তায়মিয়া ৩০১-৩০৫ পৃঃ]
শিক্ষণীয় বিষয় :
১. শত নির্যাতনের মুখেও হক থেকে বিচ্যুত হওয়া যাবে না।
২. ইসলাম প্রতিশোধ গ্রহণকে অনুমোদন দেয় না। বরং প্রতিরোধের অনুমোদন দেয়। তবে যুলুম প্রতিরোধের জন্য কখনোই অবৈধ পথ তালাশ করা যাবে না।
৩. ক্ষমার মাঝেই প্রকৃত বিজয় নিহিত।
৪. ক্ষমাশীল আচরণ দুনিয়া ও আখেরাতে মর্যাদার কারণ। রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَا زَادَ اللهُ عَبْدًا بِعَفْوٍ إِلاَّ عِزًّا وَمَا تَوَاضَعَ أَحَدٌ لِلَّهِ إِلاَّ رَفَعَهُ اللهُ ‘বান্দা ক্ষমা করলে আল্লাহ তা‘আলা তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন। আর বান্দা আল্লাহর জন্য বিনয় অবলম্বন করলে আললাহ তার মর্যাদাকে সমুনণত করেন (মুসলিম হা/২৫৮৮, মিশকাত হা/১৮৮৯)।
৫. কেবল মুখে এবং লেখনীর মাধ্যমে হকের দাওয়াত দিলে চলবে না। বরং ইসলামী আদর্শ যথাযথভাবে অনুসরণের মাধ্যমে নিজেকে আদর্শ মানুষ হিসাবে গড়ে তুলতে হবে ও সমাজকে গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে।
* আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
এম.ফিল গবেষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।