ইয়াতীম প্রতিপালন
-ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
ভূমিকা :
একটি সমাজে নানাধরনের মানুষের বসবাস। কেউ অর্থ-বিত্তের মালিক, কেউ অসহায়-নিঃস্ব, কেউ মালিক, কেউ শ্রমিক, কেউ অনাথ-ইয়াতীম প্রভৃতি। এসবই মহান আল্লাহ তা‘আলার ব্যবস্থাপনা। কেননা সকলেই যদি মালিক হন, তাহ’লে মালিকের প্রয়োজনে শ্রমিক পাওয়া যাবে কোথায়? আবার সকলে শ্রমিক হ’লে কাজ পাওয়া যাবে কোথায়? মূলতঃ একটি সমাজ সুন্দর ও সুশৃংখলভাবে পরিচালনার জন্য মহান আল্লাহ তা‘আলাই উঁচু-নীচু ভেদাভেদ সৃষ্টি করেছেন (যুখরুফ ৪৩/৩২)। তাই বলে বিত্তবানরা বিত্তহীনদের শোষণ করবে এমনটি নয়। বরং এক্ষেত্রে কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করা হয়েছে। কারো প্রতি যুলুম-নির্যাতন, অন্যায় দখল, কাউকে বঞ্চিত করা এহেন জঘন্যতম অন্যায়ের জন্য মর্মন্তুদ শাস্তি নির্ধারিত আছে।[1]
সমাজের সবচাইতে অসহায় হচ্ছে ইয়াতীম সন্তান। কেননা শৈশবেই সে তার পিতাকে অথবা পিতা-মাতা উভয়কে হারায়। তখন তার সুস্থ-সুন্দর ভাবে বেড়ে ওঠা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। শিক্ষা-দীক্ষারও তেমন কোন সুযোগ থাকে না। এমনকি তার পিতা-মাতার রেখে যাওয়া সহায়-সম্পত্তিও অন্যরা ভোগদখলের জন্য হায়েনার ন্যায় থাবা বিস্তার করে। অনেক ক্ষেত্রে কিছু অংশ ফেরত দেওয়া হ’লেও বেশিরভাগই আত্মসাৎ করা হয়। অথচ ইসলামে ইয়াতীমদের তত্ত্বাবধান ও লালন-পালনে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে এবং ইয়াতীমের সম্পদ আত্মসাতকারীর জন্য মর্মান্তিক শাস্তি ঘোষিত হয়েছে। আলোচ্য নিবন্ধে ইয়াতীম প্রতিপালন প্রসঙ্গে আলোকপাত করা হ’ল।-
ইয়াতীম অর্থ :
‘ইয়াতীম’ (يَتِيْمٌ) শব্দটি আরবী। এর অর্থ একক, একাকী, নিঃসঙ্গ ইত্যাদি। পরিভাষায় ইয়াতীম বলা হয় وَالْيَتِيمُ مَنْ مَاتَ أَبُوهُ وَهُوَ صَغِيرٌ يَسْتَوِي فِيهِ الْمُذَكَّرُ وَالْمُؤَنَّثُ ‘শৈশবে যার পিতা মৃত্যুবরণ করেছে। চাই সে ছেলে হোক বা মেয়ে হোক’ (আউনুল মা‘বূদ)। শায়খ উছায়মীন (রহঃ) বলেন, وَ هُوَ مَنْ مَاتَ اَبُوْهُ قَبْلَ بُلُوْغِهِ مِنْ ذَكَرٍ اَوْ اُنْثَى ‘বালেগ হওয়ার পূর্বে যার পিতা মৃত্যুবরণ করেছে, ছেলে হোক বা মেয়ে হোক’।[2] উল্লেখ্য যে, মাতা মৃত্যুবরণ করলে সন্তান ইয়াতীম হিসাবে গন্য হবে না।[3] তবে কারো পিতা ও মাতা উভয়ে মারা গেলে সেই হয় সমাজের সবচেয়ে বড় অসহায়। পিতৃস্নেহ ও মমতাময়ী মায়ের আদর-সোহাগ তার ভাগ্যে জুটে না। অতি প্রিয় ‘মা’ ডাকটি যেন তার হৃদয় জুড়ে বিষাদের করুণ সুর বাজায়। অবহেলিত ও অধিকার বঞ্চিত হয়ে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠে সে।
ইয়াতীমের বয়সসীমা :
ইয়াতীমের বয়সসীমা হচ্ছে বালেগ বা প্রাপ্ত বয়ষ্ক হওয়া পর্যন্ত। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, لاَ يُتْمَ بَعْدَ احْتِلاَمٍ ‘যৌবনপ্রাপ্ত হ’লে আর ইয়াতীম থাকে না’।[4] অর্থাৎ বালেগ হওয়া পর্যন্ত সে ইয়াতীম হিসাবে গণ্য হবে। যখন সে বালেগ হয়ে যাবে বা সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের যোগ্যতা অর্জন করবে তখন তার সম্পদ তাকে ফিরিয়ে দিতে হবে।
ইয়াতীম প্রতিপালনের গুরুত্ব :
ইয়াতীমদের ব্যাপারে ইসলামের নির্দেশ অত্যন্ত কঠোর। পবিত্র কুরআনের যেখানেই সদয়, সহানুভূতি ও ভাল আচরণের কথা এসেছে সেখানেই ইয়াতীমদের কথা এসেছে। মহান আল্লাহ তাঁর ইবাদত ও শিরক থেকে বাঁচার পাশাপাশি পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম ও নিঃস্বদের প্রতি সদয় হওয়ার নির্দেশ প্রদান করেছেন। তিনি বলেন,
وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلَا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا وَبِذِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينِ وَالْجَارِ ذِي الْقُرْبَى وَالْجَارِ الْجُنُبِ وَالصَّاحِبِ بِالْجَنْبِ وَابْنِ السَّبِيلِ وَمَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ مَنْ كَانَ مُخْتَالًا فَخُورًا.
‘তোমরা আল্লাহ্র ইবাদত কর ও তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক কর না এবং পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম, অভাবগ্রস্ত, নিকট-প্রতিবেশী, দূর-প্রতিবেশী, সংগী-সাথী, মুসাফির ও তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসীদের প্রতি সদাচরণ কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ দাম্ভিক, অহংকারীকে পসন্দ করেন না’ (নিসা ৪/৩৬)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,
لَيْسَ الْبِرَّ أَنْ تُوَلُّوا وُجُوهَكُمْ قِبَلَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ وَلَكِنَّ الْبِرَّ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالْكِتَابِ وَالنَّبِيِّينَ وَآتَى الْمَالَ عَلَى حُبِّهِ ذَوِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَالسَّائِلِينَ وَفِي الرِّقَابِ وَأَقَامَ الصَّلَاةَ وَآتَى الزَّكَاةَ وَالْمُوفُونَ بِعَهْدِهِمْ إِذَا عَاهَدُوا وَالصَّابِرِينَ فِي الْبَأْسَاءِ وَالضَّرَّاءِ وَحِينَ الْبَأْسِ أُولَئِكَ الَّذِينَ صَدَقُوا وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُتَّقُونَ.
‘পূর্ব ও পশ্চিম দিকে মুখ ফিরানোতে তোমাদের কোন পুণ্য নেই; বরং পুণ্য আছে তার জন্য, যে আল্লাহ, পরকাল, ফিরিশতাগণ, কিতাব সমূহ এবং নবীগণের প্রতি ঈমান আনয়ন করে; আল্লাহ্র মুহাববাতে আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম, অভাবগ্রস্ত, মুসাফির ও সাহায্যপ্রার্থীদেরকে এবং দাসমুক্তির জন্য অর্থ দান করে; ছালাত কায়েম করে ও যাকাত প্রদান করে এবং অঙ্গীকার করলে পূর্ণ করে, দুঃখ-ক্লেশে ও সংগ্রাম-সংকটে ধৈর্য ধারণ করে। বস্ত্ততঃ তারাই সত্যপরায়ণ ও তারাই আল্লাহ ভীরু’ (বাক্বারাহ ২/১৭৭)।
সম্পদ ব্যয়ের ক্ষেত্রেও ইয়াতীমদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন, يَسْأَلُونَكَ مَاذَا يُنْفِقُونَ قُلْ مَا أَنْفَقْتُمْ مِنْ خَيْرٍ فَلِلْوَالِدَيْنِ وَالْأَقْرَبِينَ وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينِ وَابْنِ السَّبِيلِ. ‘তারা তোমাকে জিজ্ঞেস করে যে, তারা কিরূপে ব্যয় করবে? তুমি বল, তোমরা ধন-সম্পদ হ’তে যা ব্যয় করবে তা পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম, মিসকীন ও পথিকদের জন্য কর’ (বাক্বারাহ ২/২১৫)।
ইয়াতীমের অসম্মান করাকে আল্লাহ মানুষের মন্দ স্বভাব হিসাবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, كَلَّا بَلْ لَا تُكْرِمُونَ الْيَتِيمَ. وَلَا تَحَاضُّونَ عَلَى طَعَامِ الْمِسْكِينِ. ‘কখনোই নয়। বস্ত্ততঃ তোমরা ইয়াতীমকে সম্মান কর না এবং অভাবগ্রস্তকে খাদ্যদানে পরস্পরকে উৎসাহিত কর না’ (ফাজর ৮৯/১৭-১৮)। এখানে ‘সম্মান করা’ কথাটি বলার মাধ্যমে ইয়াতীমের যথাযথ হক আদায় করা ও তার প্রাপ্য অধিকার বুঝিয়ে দেওয়ার প্রতি ইয়াতীমের অভিভাবক ও সমাজের প্রতি নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।[5]
স্মর্তব্য যে, সমাজের সর্বাধিক অসহায় হচ্ছে ইয়াতীমরা। এরা পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত, অবহেলিত বনু আদম। যথাযথ আদর-যত্ন ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এরা শিক্ষাবঞ্চিত ও শিষ্টাচার বহির্ভূত মানব শিশু হিসাবে বেড়ে ওঠে। সমাজের আর দশটা সন্তানের মত নিশ্চিন্তভাবে সে বেড়ে ওঠতে পারে না। অথচ ইসলাম দেড় হাযার বছর পূর্বেই এর সুন্দর সমাধান দিয়েছে। সমাজের অপরাপর সদস্যদের প্রতি নির্দেশ জারি করেছে ইয়াতীমদের প্রতি সদয়, সহযোগী ও সহানুভূতিশীল হ’তে। এদের সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ করতে এবং সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা দানের মাধ্যমে এদেরকে সুস্থ-সুন্দর আদর্শ সন্তান হিসাবে গড়ে তুলতে। এমনকি বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত বিশ্বনবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পিতৃ-মাতৃহীন ইয়াতীম শিশু করে ক্বিয়ামত পর্যন্ত অনাগত সকল ইয়াতীম সন্তানকে সান্ত্বনা প্রদান করা হয়েছে যে, ইয়াতীমদের নেতা হচ্ছেন বিশ্বনবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। জান্নাতে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানব ও শ্রেষ্ঠ ইয়াতীম রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর সাথী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করবে তারাই, যারা ইয়াতীমদের তত্ত্বাবধান করবে। মহান আল্লাহ তা‘আলা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করে সর্বযুগের সকল ইয়াতীমের প্রতি সদয় হওয়ার চূড়ান্ত নির্দেশ প্রদান করেছেন। আল্লাহ বলেন, أَلَمْ يَجِدْكَ يَتِيمًا فَآوَى وَوَجَدَكَ ضَالًّا فَهَدَى وَوَجَدَكَ عَائِلًا فَأَغْنَى فَأَمَّا الْيَتِيمَ فَلاَ تَقْهَرْ- ‘তিনি কি আপনাকে ইয়াতীম রূপে পাননি? অতঃপর আশ্রয় দিয়েছেন। তিনি আপনাকে পেয়েছেন পথহারা, অতঃপর পথ প্রদর্শন করেছেন। আপনাকে নিঃস্ব পেয়েছেন, অতঃপর অভাবমুক্ত করেছেন। সুতরাং আপনি ইয়াতীমের প্রতি কঠোর হবেন না’ (যুহা ৯৩/৬-৯)।
ইয়াতীমদের সঠিকভাবে গড়ে না তুলা হ’লে এরা ঈমান-আমলহীন এক অন্ধকার জগতে হাবুডুবু খাবে। তখন এরা সমাজের জন্য এক বিষফোঁড়া হিসাবে দেখা দিবে। অতএব ইয়াতীমদের লালন-পালন, দেখাশুনা করা, তাদের দ্বীনি জ্ঞানে পারদর্শী করা এবং তাদের সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ করা সবিশেষ গুরুত্ববহ।
ইয়াতীম প্রতিপালনের ফযীলত :
ইয়াতীম প্রতিপালন করা জান্নাতী লোকদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তা‘আলা জান্নাতী লোকদের প্রশংসা করতে গিয়ে বলেন,وَيُطْعِمُونَ الطَّعَامَ عَلَى حُبِّهِ مِسْكِينًا وَيَتِيمًا وَأَسِيرًا – إِنَّمَا نُطْعِمُكُمْ لِوَجْهِ اللهِ لَا نُرِيدُ مِنْكُمْ جَزَاءً وَلَا شُكُورًا – ‘আহার্যের প্রতি আসক্তি সত্ত্বেও তারা অভাবগ্রস্ত, ইয়াতীম ও বন্দীকে আহার্য দান করে এবং (বলে) আমরা তোমাদেরকে আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অর্জনে খাদ্য দান করি। এর বিনিময়ে তোমাদের থেকে কোন প্রতিদান ও কৃতজ্ঞতা চাইনা’ (দাহর ৭৬/৮-৯)। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে ইয়াতীম প্রতিপালনের বিশেষ ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোকপাত করা হল:
১. জান্নাত লাভ ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির উপায় :
ইয়াতীমদের লালন-পালন করলে জান্নাত লাভ হয়। আমর বিন মালেক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, مَنْ ضَمَّ يَتِيمًا بَيْنَ أَبَوَيْنِ مُسْلِمَيْنِ إِلَى طَعَامِهِ وَشَرَابِهِ حَتَّى يَسْتَغْنِيَ عَنْهُ وَجَبَتْ لَهُ الْجَنَّةُ الْبَتَّةَ. ‘যে ব্যক্তি মাতা পিতা মারা যাওয়া কোন মুসলিম ইয়াতীমকে স্বাবলম্বী হওয়া পর্যন্ত নিজ পানাহারে শামিল করে, ঐ ব্যক্তির জন্য জান্নাত অবধারিত হয়ে যায়’।[6] একই ভাবে অসহায় মায়ের ক্ষুধার্ত অবুঝ সন্তানকে নিজের মুখের গ্রাস তুলে দেওয়ার মধ্যেও জান্নাত হাছিল হয়।
عَنْ عَائِشَةَ رضي الله عنها أَنَّهَا قَالَتْ:جَاءَتْنِي مِسْكِينَةٌ تَحْمِلُ ابْنَتَيْنِ لَهَا فَأَطْعَمْتُهَا ثَلَاثَ تَمَرَاتٍ فَأَعْطَتْ كُلَّ وَاحِدَةٍ مِنْهُمَا تَمْرَةً وَرَفَعَتْ إِلَى فِيهَا تَمْرَةً لِتَأْكُلَهَا فَاسْتَطْعَمَتْهَا ابْنَتَاهَا فَشَقَّتْ التَّمْرَةَ الَّتِي كَانَتْ تُرِيدُ أَنْ تَأْكُلَهَا بَيْنَهُمَا فَأَعْجَبَنِي شَأْنُهَا فَذَكَرْتُ الَّذِي صَنَعَتْ لِرَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ إِنَّ اللهَ قَدْ أَوْجَبَ لَهَا بِهَا الْجَنَّةَ أَوْ أَعْتَقَهَا بِهَا مِنْ النَّارِ.
আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক অসহায় মহিলা তার দুই মেয়েকে নিয়ে আমার কাছে আসল। আমি তাকে তিনটি খেজুর খেতে দিলাম। সে দুই মেয়েকে একটি করে খেজুর দিল। আর নিজে খাওয়ার জন্য একটি খেজুর তার মুখে উঠাল। অতঃপর দুই মেয়ে ঐ খেজুরটি খেতে চাইল। সে খেজুরটি তাদের মধ্যে ভাগ করে দিল যেটি সে নিজে খেতে চেয়েছিল। তার এ অবস্থাটি আমাকে বিস্মিত করল। আমি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে সে যা করেছে তা তুলে ধরলাম। তিনি বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা এ কারণে তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব করে দিয়েছেন অথবা তাকে একারণেই জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়েছেন’।[7]
২. জান্নাতে রাসূল (ছাঃ)-এর সাথী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন: জান্নাতে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর সাথী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করা সর্বাধিক মর্যাদা ও সম্মানের বিষয়। মহান আল্লাহ তা‘আলা এই বিশেষ মর্যাদা তাঁর ঐ সকল বান্দাদের জন্য নির্ধারণ করে রেখেছেন, যারা ইয়াতীমদের যথাযথভাবে তত্ত্বাবধান করেন। সাহল বিন সা‘দ (রা) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, أَنَا وَكَافِلُ الْيَتِيمِ فِى الْجَنَّةِ هَكَذَا وَأَشَارَ بِالسَّبَّابَةِ وَالْوُسْطَى وَفَرَّجَ بَيْنَهُمَا شَيْئًا. ‘আমি ও ইয়াতীম প্রতিপালনকারী জান্নাতে এভাবে থাকব। তিনি তর্জনী ও মধ্যমা অঙ্গুলি দিয়ে ইঙ্গিত করলেন এবং এ দু’টির মধ্যে ফাকা করলেন’।[8] অন্য বর্ণনায় আছে وَفَرَّقَ بَيْنَهُمَا قَلِيْلاًَ ‘উভয় আঙ্গুলের মধ্যে সামান্য ফাকা করলেন’।[9]
অপর এক হাদীছে বর্ণিত হয়েছে-
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رضي الله عنه قَالَ :قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَافِلُ الْيَتِيمِ لَهُ أَوْ لِغَيْرِهِ أَنَا وَهُوَ كَهَاتَيْنِ فِي الْجَنَّةِ وَأَشَارَ مَالِكٌ بِالسَّبَّابَةِ وَالْوُسْطَى.
আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আমি ও ইয়াতীম প্রতিপালনকারীর অবস্থান জান্নাতে এই দুই আঙ্গুলের ন্যায় পাশাপাশি হবে। চাই সে ইয়াতীম তার নিজের হোক অথবা অন্যের। (বর্ণনাকারী) মালেক বিন আনাস (রাঃ) তর্জনী ও মধ্যমা অঙ্গুলি দ্বারা ইশারা করলেন’।[10]
عَن سَهْلٍ رضي الله عنه أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: أَنَا وَكَافِلُ الْيَتِيمِ كَهَاتَيْنِ فِي الْجَنَّةِ وَقَرَنَ بَيْنَ أُصْبُعَيْهِ الْوُسْطَى وَالَّتِي تَلِي الْإِبْهَامَ.
সাহল (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আমি ও ইয়াতীম প্রতিপালনকারী জান্নাতে এই দুই আঙ্গুলের ন্যায় পাশাপাশি অবস্থান করব। তিনি তাঁর মধ্যমা ও বৃদ্ধাঙ্গুলিকে কাছাকাছি করে দেখালেন’।[11]
আলোচ্য হাদীছ সমূহে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর দুই আঙ্গুল পাশাপাশি করে বুঝাতে চেয়েছেন যে, হাতের দু’টি আঙ্গুল যেমন খুব কাছাকাছি, ইয়াতীমের প্রতিপালনকারীও জান্নাতে অনুরূপ আমার কাছাকাছি অবস্থান করবে। অর্থাৎ জান্নাতে তার ঘর হবে আমার ঘরের নিকটবর্তী। নিঃসন্দেহে উম্মতের জন্য এর চাইতে অধিক আনন্দের ও অধিক সৌভাগ্যের আর কিছুই হ’তে পারে না। আল্লাহ আমাদেরকে এই সৌভাগ্য অর্জনের তাওফীক দান করুন-আমীন!
৩. রিযিক প্রশস্ত হয় এবং রহমত ও বরকত নাযিল হয় : ইয়াতীমরাই সমাজের সবচেয়ে দুর্বল ও অসহায় ব্যক্তি। আর দুর্বলদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসলে আল্লাহ তা‘আলা বান্দাকে সাহায্য করেন এবং রিযিক প্রদান করেন। আবূ দারদা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন,
اَبْغُونِي الضُّعَفَاءَ فَإِنَّمَا تُرْزَقُونَ وَتُنْصَرُونَ بِضُعَفَائِكُمْ.
‘আমার জন্য তোমরা দুর্বলদের খুঁজে আন। কেননা দুর্বল-অসহায়দের কারণেই তোমরা সাহায্য ও রিযিক প্রাপ্ত হও’।[12]
৪. ইয়াতীম প্রতিপালনে হৃদয় কোমল হয় : কোমল হৃদয় মুমিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কঠোর হৃদয়ের অধিকারীকে আল্লাহ পসন্দ করেন না। আল্লাহ রাববুল আলামীন তাঁর রাসূলকে সতর্ক করে বলেন, فَبِمَا رَحْمَةٍ مِنَ اللَّهِ لِنْتَ لَهُمْ وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانْفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ ‘আল্লাহ্র অনুগ্রহে তুমি তাদের প্রতি কোমল চিত্ত হয়েছ। যদি তুমি কর্কশভাষী ও কঠোর হৃদয়ের হ’তে, তবে নিশ্চয়ই তারা তোমার সংসর্গ হ’তে দূরে সরে যেত’ (আলে ইমরান ৩/১৫৯)। হৃদয় কোমল করার অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে ইয়াতীমের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, أَنَّ رَجُلًا شَكَا إِلَى رَسُولِ اللهُ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَسْوَةَ قَلْبِهِ فَقَالَ لَهُ إِنْ أَرَدْتَ تَلْيِينَ قَلْبِكَ فَأَطْعِمِ الْمِسْكِينَ وَامْسَحْ رَأْسَ الْيَتِيْمِ. ‘এক ব্যক্তি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে তার অন্তর কঠিন মর্মে অভিযোগ করলে তিনি তাকে বললেন, যদি তুমি তোমার হৃদয় নরম করতে চাও তাহ’লে দরিদ্রকে খানা খাওয়াও এবং ইয়াতীমের মাথা মুছে দাও’।[13]
৫. আত্মীয় ইয়াতীম প্রতিপালনে দ্বিগুণ নেকী: মানুষ নিকটাত্মীয়ের ব্যাপারে উদাসীন থাকে। অনেক সময় দানের ক্ষেত্রে তাদের বঞ্চিত করা হয়। অথচ ইসলাম তাদেরকেই অগ্রাধিকার দিয়েছে। কেননা এক্ষেত্রে তাদের দু’টি হক রয়েছে। একটি ইয়াতীম-মিসকীন হওয়ার কারণে, আরেকটি আত্মীয় হওয়ার কারণে। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, إن الصَّدَقَة عَلَى الْمِسْكِينِ صَدَقَةٌ، وَهِيَ عَلَى ذِي الرَّحِمِ ثِنْتَانِ، صَدَقَةٌ وَصِلَةٌ. ‘মিসকীনকে দান করায় একটি নেকী এবং আত্মীয়কে দান করায় দু’টি নেকী হাছিল হয়, একটি দানের নেকী এবং অপরটি আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করার নেকী’।[14]
ইয়াতীমের সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ :
ইয়াতীমের সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এটি এমন এক আমানত যে বিষয়ে ত্রুটি হ’লে পরিণাম হবে ভয়াবহ। আর এ কাজ নিশ্চয়ই দুর্বলদের দ্বারা সম্ভব নয়। খেয়ানতের আশংকা থাকলে এই দায়িত্ব থেকে দূরে থাকাই বরং কল্যাণকর। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবূ যর (রাঃ)-কে এ বিষয়ে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেন, يَا أَبَا ذَرٍّ إِنِّى أَرَاكَ ضَعِيفًا وَإِنِّى أُحِبُّ لَكَ مَا أُحِبُّ لِنَفْسِى لاَ تَأَمَّرَنَّ عَلَى اثْنَيْنِ وَلاَ تَوَلَّيَنَّ مَالَ يَتِيمٍ- ‘হে আবূ যর! আমি তোমাকে দুর্বল দেখতে পাচ্ছি। আমি তোমার জন্য তাই পসন্দ করি যা আমি নিজের জন্য পসন্দ করি। তুমি কখনো দু’জনের উপর আমীর হবে না এবং ইয়াতীমের সম্পদের দায়িত্বশীল হবে না’।[15] উল্লেখ্য যে, আলোচ্য হাদীছ দ্বারা দায়িত্ব গ্রহণ না করা উদ্দেশ্য নয়, বরং অধিক সর্তকতা অবলম্বন উদ্দেশ্য। অর্থাৎ যিনি দায়িত্বশীল হবেন তিনি যেন আমানতের ব্যাপারে অতি সাবধানতা অবলম্বন করেন। অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে-
وَعَن أبي هُرَيْرَة رَضِيَ اللَّهُ عَنْه عَن النَّبِي صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم قَالَ اللَّهُمَّ إِنِّي أُحَرِّجُ حَقَّ الضَّعِيْفَيْنِ : الْيَتِيْمِ وَالْمَرْأَةِ.
আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘হে আল্লাহ! আমি লোকদেরকে দুই শ্রেণীর দুর্বল মানুষের অধিকার সম্বন্ধে ভীতি প্রদর্শন করছি। (এরা হচ্ছে) ইয়াতীম ও নারী’।[16]
ইয়াতীমদের সম্পদ সঠিক ভাবে সংরক্ষণ করতঃ সময়মত তাদের নিকটে সমর্পন করতে হবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَآتُوا الْيَتَامَى أَمْوَالَهُمْ وَلَا تَتَبَدَّلُوا الْخَبِيثَ بِالطَّيِّبِ وَلَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَهُمْ إِلَى أَمْوَالِكُمْ إِنَّهُ كَانَ حُوبًا كَبِيرًا. ‘আর ইয়াতীমদেরকে তাদের ধন-সম্পদ সমর্পন কর। পবিত্রতার সাথে অপবিত্রতার বিনিময় কর না ও তোমাদের সম্পদের সাথে তাদের সম্পদ মিশ্রিত করে গ্রাস কর না। নিশ্চয়ই এটা গুরুতর অপরাধ’ (নিসা ৪/২)। আল্লাহ আরও বলেন,
وَابْتَلُوا الْيَتَامَى حَتَّى إِذَا بَلَغُوا النِّكَاحَ فَإِنْ آنَسْتُمْ مِنْهُمْ رُشْدًا فَادْفَعُوا إِلَيْهِمْ أَمْوَالَهُمْ وَلَا تَأْكُلُوهَا إِسْرَافًا وَبِدَارًا أَنْ يَكْبَرُوا وَمَنْ كَانَ غَنِيًّا فَلْيَسْتَعْفِفْ وَمَنْ كَانَ فَقِيرًا فَلْيَأْكُلْ بِالْمَعْرُوفِ فَإِذَا دَفَعْتُمْ إِلَيْهِمْ أَمْوَالَهُمْ فَأَشْهِدُوا عَلَيْهِمْ وَكَفَى بِاللَّهِ حَسِيبًا.
‘আর ইয়াতীমগণ বিবাহযোগ্য না হওয়া পর্যন্ত তাদেরকে পরীক্ষা করে নাও; অতঃপর যদি তাদের মধ্যে ভাল-মন্দ বিচারের জ্ঞান লক্ষ্য কর, তবে তাদের সম্পদ তাদেরকে সমর্পন কর এবং তারা বয়োঃপ্রাপ্ত হবে বলে তা অপব্যয় ও তাড়াহুড়া করে আত্মসাৎ কর না। যে অভাবমুক্ত সে নিবৃত্ত থাকবে এবং যে ব্যক্তি অভাবগ্রস্ত হবে সে সঙ্গত পরিমাণ ভোগ করবে। যখন তাদের সম্পত্তি তাদেরকে সমর্পণ করতে চাও তখন তাদের জন্য সাক্ষী রেখ এবং আল্লাহই হিসাব গ্রহণে যথেষ্ট’ (নিসা ৪/৬)।
আলোচ্য আয়াতে ইয়াতীমদের প্রাপ্ত বয়স্ক ও জ্ঞান-বুদ্ধি না হওয়া পর্যন্ত তাদের সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। প্রাপ্ত বয়ষ্ক হয়ে গেলে যথাযথভাবে তাদের সম্পদ তাদেরকে বুঝিয়ে দিতে হবে। তবে রক্ষণাবেক্ষণকারী দরিদ্র হ’লে সঙ্গত পরিমাণ গ্রহণ করতে পারবে।
[চলবে]
[1]. মুসলিম, মিশকাত হা/৫১২৭।
[2]. ছালেহ আল-উছায়মীন, তাফসীরু কুরআনিল কারীম (রিয়ায : দারু ইবনুল জাওযী, ২য় সংস্করণ ১৪৩১ হিঃ), সূরা বাক্বারাহ ২/২৭৬ পৃঃ।
[3]. তাফসীরু কুরআনিল কারীম ২/২৭৬ পৃঃ।
[4]. আবূদাউদ, হা/২৮৭৩ সনদ ছহীহ।
[5]. তাফসীরুল কুরআন রাজশাহী : হাফাবা প্রকাশনী, ২য় সংস্করণ মে ২০১৩), ৩০ তম পারা, পৃ : ২৮৩।
[6]. আহমাদ হা/১৯০২৫; ছহীহ তারগীব হা/২৫৪৩।
[7]. মুসলিম হা/২৬৩০।
[8]. বুখারী, হা/৫৩০৪; মিশকাত হা/৪৯৫২।
[9]. সিলসিলা ছহীহা হা/৮০০।
[10]. মুসলিম হা/২৯৮৩ ‘যুহুদ’ অধ্যায়।
[11]. আবূদাঊদ হা/১১০।
[12]. আবূদাঊদ হা/২৫৯৪।
[13]. আহমাদ, ছহীহুল জামে‘ হা/১৪১০; সিলসিলা ছহীহা হা/৮৫৪।
[14]. আহমাদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/১৯৩৯ সনদ ছহীহ।
[15]. মুসলিম হা/১৮২৬; মিশকাত হা/৩৬৮২।
[16]. ইবনু মাজাহ হা/৩৬৭৮; সিলসিলা ছহীহা হা/১০১৫ সনদ হাসান।