ছিয়ামের আদব
ছিয়াম একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, যার মাধ্যমে তাক্বওয়া অর্জিত হয়, আল্লাহর রহমত, মাগফিরাত ও নৈকট্য হাছিল হয়, জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণ ও জান্নাত লাভ হয়। তাই সঠিকভাবে ছিয়াম পালন করা যরূরী। ছিয়ামের অনেক আদব রয়েছে, যার প্রতি লক্ষ্য রাখা প্রত্যেক ছায়েমের জন্য আবশ্যক। মূলতঃ প্রকৃত ছায়েম সেই, যার দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পাপাচার থেকে; যবান মিথ্যা, নির্লজ্জ, কদর্যতাপূর্ণ ও অনর্থক কথা থেকে; উদর পানাহার থেকে বিরত থাকে। অর্থাৎ যদি সে কথা বলে তাহ’লে এমন কথা বলে না, যা তার ছিয়ামকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। কোন কাজ করলে এমন কাজ করে না, যা তার ছিয়ামকে বিনষ্ট করে। তার মুখ থেকে উত্তম ও সুন্দর কথা বের হয়। কাজ করলে সৎ কাজ করে। তাই ছায়েম সকলের জন্য কল্যাণকারী হয়ে থাকে। এরূপ ছিয়াম পালনকারীর জন্য পার্থিব জীবনে রয়েছে অশেষ কল্যাণ এবং পরকালে রয়েছে অফুরন্ত পুরস্কার। বস্ত্ততঃ ছায়েমের ছিয়াম যথার্থ ও সঠিক হওয়ার জন্য বহু আদব বা শিষ্টাচার রয়েছে। সেগুলি নিম্নে উল্লেখ করা হ’ল।-
ছিয়ামের আদব সমূহ : ছিয়ামের অনেক আদব রয়েছে, যেগুলি প্রতিপালন না করলে ছিয়াম পূর্ণাঙ্গরূপে আদায় হয় না। এ আদবগুলি দু’ভাগে বিভক্ত। ক. ওয়াজিব আদব ও খ. মুস্তাহাব আদব।
ক. ওয়াজিব আদব : ওয়াজিব আদব সমূহ পালন করা প্রত্যেক ছায়েমের জন্য আবশ্যক। এসব আদবের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কতিপয় আদব নিম্নে উল্লেখ করা হ’ল।-
১. তাক্বওয়া অর্জন করা : তাক্বওয়া তথা আল্লাহভীতি অর্জনের জন্যই রামাযানের ছিয়াম উম্মাতে মুহাম্মাদীর উপরে ফরয করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ- ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের জন্য ছিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেমন ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপরে। যাতে তোমরা মুত্তাক্বী হ’তে পার’ (বাক্বারাহ ২/১৮৩)। আল্লাহর নির্দেশিত বিষয় সমূহ প্রতিপালন ও নিষিদ্ধ বিষয় সমূহ পরিত্যাগের মাধ্যমে তাক্বওয়া অর্জিত হয়।
২. আল্লাহর ইবাদত করা : আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় বান্দাদের উপরে কাওলী (ভাষাগত) ও ফে‘লী (কর্মগত) যেসব ইবাদত ফরয করেছেন, ছায়েমের জন্য সেসব প্রতিপালন করা আবশ্যক। ঈমান আনয়নের পরে এসব ইবাদতের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হ’ল ফরয ছালাত। রাসূল (ছাঃ) বলেন, أَوَّلُ مَا يُحَاسَبُ بِهِ الْعَبْدُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ الصَّلاَةُ فَإِنْ صَلُحَتْ صَلُحَ لَهُ سَائِرُ عَمَلِهِ وَإِنْ فَسَدَتْ فَسَدَ سَائِرُ عَمَلِهِ- ‘ক্বিয়ামতের দিন বান্দার সর্বপ্রথম হিসাব হবে ছালাতের। যার ছালাত ঠিক হবে তার সব আমল সঠিক হবে। আর যার ছালাত বিনষ্ট হবে, তার সব আমল বিনষ্ট হবে’।[1] সুতরাং ছালাতের রুকন, শর্তাবলী ও ওয়াজিব সহ সময়মত মসজিদে জামা‘আতে ছালাত আদায় করা ছায়েমের জন্য অতীব যরূরী। আর ছালাত বিনষ্ট করা তাক্বওয়ার পরিপন্থী এবং এটা শাস্তিকে অবধারিত করে। আল্লাহ বলেন, فَخَلَفَ مِنْ بَعْدِهِمْ خَلْفٌ أَضَاعُوا الصَّلَاةَ وَاتَّبَعُوا الشَّهَوَاتِ فَسَوْفَ يَلْقَوْنَ غَيًّا، إِلَّا مَنْ تَابَ وَآمَنَ وَعَمِلَ صَالِحًا فَأُولَئِكَ يَدْخُلُوْنَ الْجَنَّةَ وَلَا يُظْلَمُوْنَ شَيْئًا ‘তাদের পরে আসল অপদার্থ পরবর্তীরা, তারা ছালাত নষ্ট করল ও লালসাপরবশ হ’ল। সুতরাং তারা অচিরেই কুকর্মের শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে। কিন্তু তারা নয়, যারা তওবা করেছে, ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে। তারা তো জান্নাতে প্রবেশ করবে। তাদের প্রতি কোন প্রকার যুলুম করা হবে না’ (মারিয়াম ১৯/৫৯-৬০)।
মহান আল্লাহ যুদ্ধরত অবস্থায় ও ভীতির সময়ও জামা‘আতে ছালাত আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন (নিসা ৪/১০২)। সুতরাং নিরাপদ ও স্থিতিশীল অবস্থায় জামা‘আতে ছালাত আদায় করা আরো যরূরী। আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত হাদীছে এসেছে, জনৈক অন্ধ ছাহাবী রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমার এমন কোন লোক নেই যে আমাকে মসজিদে নিয়ে আসবে। ফলে রাসূল (ছাঃ) তাকে (বাড়ীতে ছালাত আদায়ের) অবকাশ দিলেন। যখন সে চলে যাচ্ছিল, তখন রাসূল (ছাঃ) তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, هَلْ تَسْمَعُ النِّدَاءَ بِالصَّلاَةِ، فَقَالَ نَعَمْ، قَالَ فَأَجِبْ. ‘তুমি কি ছালাতের আযান শুনতে পাও? সে বলল, হ্যাঁ। তিনি বললেন, তাহ’লে তুমি সাড়া দাও’।[2] অর্থাৎ জামা‘আতে শরীক হও।
জামা‘আতে ছালাত আদায়ের ছওয়াব বহুগুণ হয়ে থাকে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, صَلاَةُ الْجَمَاعَةِ تَفْضُلُ عَلَى صَلاَةِ الْفَذِّ بِسَبْعٍ وَعِشْرِيْنَ دَرَجَةً ‘জামা‘আতে ছালাত আদায় করার ছওয়াব একাকী আদায় করার চেয়ে ২৭ গুণ বেশী’।[3]
জামা‘আত পরিত্যাগ করার পরিণাম হচ্ছে নিজেকে শাস্তির মুখোমুখি করা এবং এটা মুনাফিকীর অন্তর্ভুক্ত। রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِنَّ أَثْقَلَ صَلاَةٍ عَلَى الْمُنَافِقِيْنَ صَلاَةُ الْعِشَاءِ وَصَلاَةُ الْفَجْرِ وَلَوْ يَعْلَمُوْنَ مَا فِيْهِمَا لأَتَوْهُمَا وَلَوْ حَبْوًا وَلَقَدْ هَمَمْتُ أَنْ آمُرَ بِالصَّلاَةِ فَتُقَامَ ثُمَّ آمُرَ رَجُلاً فَيُصَلِّىَ بِالنَّاسِ ثُمَّ أَنْطَلِقَ مَعِىْ بِرِجَالٍ مَعَهُمْ حُزَمٌ مِنْ حَطَبٍ إِلَى قَوْمٍ لاَ يَشْهَدُوْنَ الصَّلاَةَ فَأُحَرِّقَ عَلَيْهِمْ بُيُوْتَهُمْ بِالنَّارِ- ‘এশা ও ফজরের ছালাত আদায় করা মুনাফিকদের জন্য সর্বাপেক্ষা কঠিন। তারা যদি জানতো এ দুই ছালাতের মধ্যে কি (ছওয়াব) আছে, তাহ’লে তারা এ দুই ছালাতের জামা‘আতে হাযির হ’ত হামাগুড়ি দিয়ে হ’লেও। আমার ইচ্ছা হয় ছালাত আদায় করার নির্দেশ দিয়ে কাউকে ইমামতি করতে বলি। আর আমি কিছু লোককে নিয়ে জ্বালানী কাঠের বোঝাসহ বের হয়ে তাদের কাছে যাই, যারা ছালাতে (জামা‘আতে) উপস্থিত হয় না এবং তাদের ঘর-বাড়ীগুলি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেই’।[4]
৩. হারাম বিষয় পরিত্যাগ করা : ছায়েমের জন্য আবশ্যক হ’ল আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ) কথা ও কর্মের মধ্যে যেসব বিষয় হারাম করেছেন তা পরিহার করা। এখানে কতিপয় হারাম বিষয় উল্লেখ করা হ’ল, যা ত্যাগ করা ছায়েমের জন্য অপরিহার্য।
◙ মিথ্যা কথা ও কাজ ত্যাগ করা : মিথ্যার মধ্যে সবচেয়ে বড় হচ্ছে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপরে মিথ্যারোপ করা। অনুরূপভাবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি মিথ্যাকে সম্বন্ধিত করা। যেমন তাঁদের হালালকৃত জিনিসকে হারাম গণ্য করা এবং তাঁদের হারামকৃত জিনিসকে হালাল সাব্যস্ত করা। আল্লাহ বলেন, وَلاَ تَقُوْلُوْا لِمَا تَصِفُ أَلْسِنَتُكُمُ الْكَذِبَ هَذَا حَلاَلٌ وَهَذَا حَرَامٌ لِتَفْتَرُوْا عَلَى اللهِ الْكَذِبَ إِنَّ الَّذِيْنَ يَفْتَرُوْنَ عَلَى اللهِ الْكَذِبَ لَا يُفْلِحُوْنَ، مَتَاعٌ قَلِيْلٌ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيْمٌ- ‘তোমাদের জিহবা মিথ্যা আরোপ করে বলে আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করার জন্য তোমরা বলো না, এটা হালাল এবং ওটা হারাম। নিশ্চয়ই যারা আল্লাহ সম্বন্ধে মিথ্যা উদ্ভাবন করবে তারা সফলকাম হবে না। তাদের সুখ-সম্ভোগ সামান্যই এবং তাদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি’ (নাহল ১৬/১১৬-১৭)।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ كَذَبَ عَلَىَّ مُتَعَمِّدًا فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ ‘যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে আমার উপরে মিথ্যারোপ করল, সে যেন জাহান্নামে নিজের স্থান নির্ধারণ করে নিল’।[5] তিনি আরো বলেন,إِيَّاكُمْ وَالْكَذِبَ فَإِنَّ الْكَذِبَ يَهْدِىْ إِلَى الْفُجُوْرِ وَإِنَّ الْفُجُوْرَ يَهْدِىْ إِلَى النَّارِ وَإِنَّ الرَّجُلَ لَيَكْذِبُ وَيَتَحَرَّى الْكَذِبَ حَتَّى يُكْتَبَ عِنْدَ اللهِ كَذَّابًا ‘তোমরা মিথ্যাচার পরিহার কর। কেননা মিথ্যাচার পাপের দিকে ধাবিত করে এবং পাপ জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়। কোন লোক অনবরত মিথ্যা বলতে থাকে এবং মিথ্যাচারকে স্বভাবে পরিণত করে। অবশেষে আল্লাহর নিকটে তার নাম মিথ্যাবাদী হিসাবে লিখিত হয়’।[6]
◙ গীবত পরিহার করা : গীবত হচ্ছে কোন মুসলিম ভাইয়ের অগোচরে তার এমন কোন বিষয় উল্লেখ করা যা সে অপসন্দ করে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, أَتَدْرُوْنَ مَا الْغِيْبَةُ، قَالُوْا اللهُ وَرَسُوْلُهُ أَعْلَمُ، قَالَ ذِكْرُكَ أَخَاكَ بِمَا يَكْرَهُ، قِيْلَ أَفَرَأَيْتَ إِنْ كَانَ فِىْ أَخِىْ مَا أَقُوْلُ، قَالَ إِنْ كَانَ فِيْهِ مَا تَقُوْلُ فَقَدِ اغْتَبْتَهُ وَإِنْ لَمْ يَكُنْ فِيْهِ فَقَدْ بَهَتَّهُ– ‘তোমরা কি জান গীবত কি? ছাহাবায়ে কেরাম বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই অধিক জ্ঞাত। তিনি বললেন, তোমার কোন ভাইয়ের এমন কোন বিষয় উল্লেখ করা যা সে অপসন্দ করে। বলা হ’ল, (এ ব্যাপারে) আপনার অভিমত কি যে, আমি যা বলি তা যদি আমার ভাইয়ের মাঝে থাকে? তিনি বললেন, তুমি যা বল, তা যদি তোমার ভাইয়ের মধ্যে থাকে, তাহ’লে তুমি তার গীবত করলে। আর যদি তার মধ্যে না থাকে তাহ’লে তুমি তার প্রতি অপবাদ দিলে’।[7]
মহান আল্লাহ গীবত করতে নিষেধ করেছেন এবং একে মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণের সাথে তুলনা করেছেন। তিনি বলেন, وَلاَ يَغْتَبْ بَعْضُكُمْ بَعْضًا أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَنْ يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيْهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوْهُ ‘তোমরা একে অপরের পশ্চাতে নিন্দা (গীবত) করো না। তোমাদের মধ্যে কি কেউ তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পসন্দ করবে? বস্ত্তত তোমরা তো একে ঘৃণ্যই মনে কর’ (হুজুরাত ৪৯/১২)।
নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, মি‘রাজের রাতে আমি এমন এক সম্প্রদায়ের নিকট দিয়ে যাচ্ছিলাম যাদের নখগুলো তামার তৈরী, যা দ্বারা তারা অনবরত তাদের মুখমন্ডল ও বক্ষদেশে অাঁচড় কাঁটছে। তখন তিনি জিজ্ঞেস করলেন, مَنْ هَؤُلاَءِ يَا جِبْرِيْلُ قَالَ هَؤُلاَءِ الَّذِيْنَ يَأْكُلُوْنَ لُحُوْمَ النَّاسِ وَيَقَعُوْنَ فِىْ أَعْرَاضِهِمْ ‘এরা কারা হে জিবরীল! তিনি বললেন, এরা ঐ সমস্ত লোক যারা মানুষের গোশত খেত (গীবত করতো) এবং তাদের মান-সম্মানে আঘাত আঘাত হানতো’।[8]
◙ চোগলখুরী ত্যাগ করা : চোগলখুরী হচ্ছে বিবাদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে একের কথা অপরকে বলা। এটা বড় পাপ। রাসূল (ছাঃ) বলেন, لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ نَمَّامٌ ‘চোগলখোর জান্নাতে প্রবেশ করবে না’।[9] অপর একটি হাদীছে এসেছে, একদা রাসূল (ছাঃ) দু’টি কবরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন তিনি বললেন, إِنَّهُمَا لَيُعَذَّبَانِ وَمَا يُعَذَّبَانِ فِيْ كَبِيْرٍ، أَمَّا أَحَدُهُمَا فَكَانَ لاَ يَسْتَتِرُ مِنَ الْبَوْلِ وَأَمَّا الْآخَرُ فَكَانَ يَمْشِيْ بِالنَّمِيْمَةِ- ‘এ দু’ব্যক্তিকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে। অথচ তাদেরকে বড় কোন পাপের কারণে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে না। তাদের একজন পেশাব থেকে সতর্কতা অবলম্বন করত না। আর অপরজন চোগলখোরী করে বেড়াত’।[10]
আল্লাহ বলেন, وَلَا تُطِعْ كُلَّ حَلَّافٍ مَهِيْنٍ، هَمَّازٍ مَشَّاءٍ بِنَمِيْمٍ ‘আর অনুসরণ করো না তার যে কথায় কথায় শপথ করে, যে লাঞ্ছিত; পশ্চাতে নিন্দাকারী, যে একের কথা অপরের নিকটে লাগিয়ে বেড়ায়’ (ক্বলাম ৬৮/১০-১১)। চোগলখোরী ব্যক্তি ও পরিবারের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি করে এবং মুসলমানদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা ও শত্রুতা পয়দা করে। তাই এটা সর্বোতভাবে পরিত্যাজ্য।
◙ ধোঁকা ও প্রতারণা পরিত্যাগ করা : ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পকর্ম, কৃষিকাজসহ সকল প্রকার আচার-ব্যবহার, পরামর্শ-উপদেশ ও সামাজিক কর্মকান্ডে ধোঁকা-প্রতারণা ও প্রবঞ্চনা পরিত্যাগ করা অপরিহার্য। কেননা এটা বড় গোনাহের কাজ। প্রতারক উম্মতে মুহাম্মাদীর অন্তর্ভুক্ত নয়। রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَنْ غَشَّنَا فَلَيْسَ مِنَّا ‘যে ব্যক্তি আমাদেরকে ধোঁকা দেয়, সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়’।[11] অন্য শব্দে এসেছে, مَنْ غَشَّ فَلَيْسَ مِنِّى ‘যে ধোঁকা দেয় সে আমার (উম্মতের) অন্তর্ভুক্ত নয়’।[12]
◙ বাদ্যযন্ত্র পরিত্যাগ করা : বাদ্য-বাজনার সকল প্রকার ও বাজনার সুরে গাওয়া গান সব পাপাচার ও হারাম। আল্লাহ বলেন, وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَشْتَرِيْ لَهْوَ الْحَدِيْثِ لِيُضِلَّ عَنْ سَبِيْلِ اللهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَيَتَّخِذَهَا هُزُوًا أُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ مُهِيْن ‘মানুষের মধ্যে কেউ কেউ অজ্ঞতাবশত আল্লাহর পথ হ’তে বিচ্যুত করার জন্য অসার বাক্য ক্রয় করে এবং আল্লাহ প্রদর্শিত পথ নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে। তাদের জন্য রয়েছে অবমাননাকর শাস্তি’ (লুকমান ৩১/৬)। ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, ইবনু আববাস, জাবের, সাঈদ ইবনু জুবায়ের, ইকরিমা, ও হাসান বছরী প্রমুখ বলেছেন, এ আয়াতটি গান-বাজনার ব্যাপারে নাযিল হয়েছে।[13]
রাসূল (ছাঃ) বাদ্যযন্ত্র ও গান-বাজনা হ’তে সতর্ক করে বলেন, لَيَكُوْنَنَّ مِنْ أُمَّتِىْ أَقْوَامٌ يَسْتَحِلُّوْنَ الْحِرَ وَالْحَرِيْرَ وَالْخَمْرَ وَالْمَعَازِفَ ‘আমার উম্মতের মধ্যে অবশ্যই একটি দল হবে যারা ব্যভিচার, রেশমী বস্ত্র, মদ ও বাদ্যযন্ত্রকে হালাল মনে করবে’।[14]অর্থাৎ তারা এগুলিকে হালাল মনে করে ব্যবহার করবে।
◙ অনর্থক, অশ্লীল এবং কদর্যপূর্ণ কথা ও কাজ এবং গালিগালাজ পরিহার করা : ছিয়াম অবস্থায় অনর্থক, অশ্লীল, নির্লজ্জ ও ফাহেশা কথা ও কাজ এবং গালিগালাজ পরিত্যাগ করা আবশ্যক। রাসূল (ছাঃ) বলেন, لَيْسَ الصِّيَامُ مِنَ الأَكْلِ وَالشُّرْبِ، إِنَّمَا الصِّيَامُ مِنَ اللَّغْوِ وَالرَّفَثِ، فَإِنْ سَابَّكَ أَحَدٌ، أَوْ جَهِلَ عَلَيْكَ فَلْتَقُلْ : إِنِّي صَائِمٌ، إِنِّي صَائِمٌ- ‘কেবল পানাহার পরিহারের নাম ছিয়াম নয়; বরং অনর্থক ও অশ্লীলতা পরিহারের নাম হচ্ছে ছিয়াম। অতএব যদি তোমাকে কেউ গালি দেয় কিংবা তোমার সাথে কোন জাহেলী কাজ করে, তাহ’লে তুমি বলবে, আমি ছায়েম, আমি ছায়েম’।[15] অন্য হাদীছে এসেছে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, আল্লাহ বলেন, كُلُّ عَمَلِ ابْنِ آدَمَ لَهُ إِلاَّ الصِّيَامَ، فَإِنَّهُ لِىْ، وَأَنَا أَجْزِىْ بِهِ. وَالصِّيَامُ جُنَّةٌ، وَإِذَا كَانَ يَوْمُ صَوْمِ أَحَدِكُمْ، فَلاَ يَرْفُثْ وَلاَ يَصْخَبْ، فَإِنْ سَابَّهُ أَحَدٌ، أَوْ قَاتَلَهُ فَلْيَقُلْ إِنِّى امْرُؤٌ صَائِمٌ- ‘আদম সন্তানের প্রতিটি আমল তার জন্য, কেবল ছিয়াম ব্যতীত। কেননা সেটা আমার জন্য এবং আমিই এর প্রতিদান দেব। ছিয়াম ঢাল স্বরূপ। যখন কারো ছিয়ামের দিন হবে, তখন সে যেন অশ্লীল ও গর্হিত কাজ না করে। যদি তাকে কেউ গালি দেয় অথবা বিবাদ করতে আসে, তাহ’লে সে যেন বলে, আমি ছায়েম’।[16] রাসূল (ছাঃ) আরো বলেন, مَنْ لَمْ يَدَعْ قَوْلَ الزُّوْرِ وَالْعَمَلَ بِهِ فَلَيْسَ لِلَّهِ حَاجَةٌ فِىْ أَنْ يَدَعَ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা ও কাজ পরিহার করল না, তার পানাহার পরিহারে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই’।[17]
তিনি আরো বলেন, رُبَّ صَائِمٍ لَيْسَ لَهُ مِنْ صِيَامِهِ إِلاَّ الْجُوْعُ وَرُبَّ قَائِمٍ لَيْسَ لَهُ مِنْ قِيَامِهِ إِلاَّ السَّهَرُ ‘কত ছায়েম আছে, যাদের ছিয়ামের বিনিময়ে ক্ষুধা ছাড়া আর কিছুই জোটে না। আর কত (নফল) ছালাত আদায়কারী আছে যাদের রাত্রি জাগরণ ছাড়া আর কিছু জোটে না’।[18] অন্যত্র তিনি বলেন, لا تَسَابَّ وَأَنْتَ صَائِمٌ وَإِنْ سَابَّكَ أَحَدٌ فَقُلْ إِنِّيْ صَائِمٌ ‘তুমি ছিয়াম অবস্থায় গালি দিবে না। আর যদি তোমাকে কেউ গালি দেয়, তাহ’লে বলবে, আমি ছায়েম’।[19]
খ. মুস্তাহাব আদব : এসব আদবের প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখা এবং এগুলি পালনের চেষ্টা করা ছায়েমের কর্তব্য। মুস্তাহাব আদবগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কতিপয় নিম্নরূপ:
১. সাহারী খাওয়া : ফজরের পূর্বে কোন কিছু খাওয়াকে সাহারী বলে। এটা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। সাহারী খাওয়ার জন্য রাসূল (ছাঃ) নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন,تَسَحَّرُوْا فَإِنَّ فِى السَّحُوْرِ بَرَكَةً ‘তোমরা সাহারী খাও। কেননা সাহারীতে বরকত রয়েছে’।[20] সাহারী গ্রহণ করাকে উম্মতে মুহাম্মাদী ও আহলে কিতাবদের ছিয়ামের মাঝে পার্থক্যকারী নিদর্শন বলে রাসূল (ছাঃ) উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, فَصْلُ مَا بَيْنَ صِيَامِنَا وَصِيَامِ أَهْلِ الْكِتَابِ أَكْلَةُ السَّحَرِ ‘আমাদের ও আহলে কিতাবদের ছিয়ামের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে সাহারী খাওয়া’।[21]
সাহারী গ্রহণের ফযীলত সম্পর্কে অনেক হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেন, إنَّ اللهَ وَمَلاَئِكَتَهُ يُصَلَّوْنَ عَلَى الْمُتَسَحِّرِيْنَ ‘নিশ্চয়ই সাহারী গ্রহণকারীদের জন্য আল্লাহ রহমত করেন ও ফেরেশতাগণ দো‘আ করেন’।[22] অন্যত্র তিনি বলেন, إِنَّهَا بَرَكَةٌ أَعْطَاكُمُ اللهُ إِيَّاهَا فَلاَ تَدَعُوْهُ ‘নিশ্চয়ই সাহারী বরকতপূর্ণ, আল্লাহ তা‘আলা বিশেষভাবে তা তোমাদেরকে দান করেছেন। অতএব তোমরা তা (সাহারী) পরিত্যাগ করো না’।[23] তিনি আরো বলেন, اَلْبَرَكَةُ فِيْ ثَلاَثَةٍ : فِي الْجَمَاعَةِ وَالثَّرِيْدِ وَالسَّحُوْرِ ‘তিনটি বস্ত্ততে বরকত রয়েছে- জামা‘আতে, ছারীদে (এক প্রকার খাদ্য) এবং সাহারীতে’।[24] অন্য বর্ণনায় এসেছে, إِنَّ اللهَ جَعَلَ الْبَرَكَةَ فِي السَّحُوْرِ وَالْكَيْلِ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ বরকত রেখেছেন সাহারীতে ও পরিমাপে’।[25]
উপরোক্ত হাদীছ সমূহ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সাহারী করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য এক ঢোক পানি কিংবা একটা খেজুর দিয়ে হ’লেও সাহারী করতে রাসূল (ছাঃ) নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, تَسَحَّرُوْا وُلَوْ بِجُرْعَةٍ مِنْ مَاءٍ ‘সাহারী গ্রহণ কর যদিও এক ঢোক পানি দিয়েও হয়’।[26] অন্য বর্ণনায় আছে, نِعْمَ سَحُوْرُ الْمُؤْمِنِ التَّمْرُ ‘মুমিনের উত্তম সাহারী হচ্ছে খেজুর’।[27]
সাহারীর সময় হচ্ছে ফজরের পূর্ব পর্যন্ত। আল্লাহ বলেন, وَكُلُوْا وَاشْرَبُوْا حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَكُمُ الْخَيْطُ الْأَبْيَضُ مِنَ الْخَيْطِ الْأَسْوَدِ مِنَ الْفَجْرِ ‘আর তোমরা খাও এবং পান কর যতক্ষণ না রাত্রির কৃষ্ণ রেখা হ’তে শুভ্র রেখা প্রতিভাত হয়’ (বাক্বারাহ ২/১৮৭)।
সুন্নাত হচ্ছে বিলম্ব করে সাহারী খাওয়া। রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِنَّا مَعْشَرَ الْأَنْبِيَاءِ أُمِرْنَا بِتَعْجِيْلِ فِطْرِنَا وَتَأْخِيْرِ سَحُوْرِنَا وَأَنْ نَضَعَ أَيْمَانَنَا عَلَى شَمَائِلِنَا فِي الصَّلاَةِ ‘আমরা নবীদের দল আদিষ্ট হয়েছি ইফতার দ্রুত করতে এবং সাহারী দেরীতে করতে। আর ছালাতের মধ্যে আমাদের ডান হাত বাম হাতের উপরে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে’।[28] অন্য হাদীছে এসেছে, كَانَ أَصْحَابُ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَسْرَعُ النَّاسِ إِفْطَارًا وَأَبْطَأُهُمْ سُحُوْرًا অর্থাৎ মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর ছাহাবীগণ ইফতার দ্রুত করতেন এবং সাহারী দেরীতে করতেন।[29]
২. দ্রুত ইফতার করা : ছিয়ামের অন্যতম সুন্নাত ও আদব হ’ল তাড়াতাড়ি অর্থাৎ সূর্যাস্তের সাথে সাথে ইফতার করা। রাসূল (ছাঃ) বলেন, لاَ يَزَالُ النَّاسُ بِخَيْرٍ مَا عَجَّلُوا الْفِطْرَ ‘মানুষ ততদিন কল্যাণের মধ্যে থাকবে যতদিন তারা ইফতার দ্রুত করবে’।[30] তিনি আরো বলেন, لاَ تَزَالُ أُمَّتِيْ عَلَى سُنَّتِيْ مَا لَمْ تَنْتَظِرْ بِفِطْرِهَا النُّجُوْمَ ‘আমার উম্মত আমার সুন্নাতের উপরে থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত তারা ইফতারের জন্য তারকা উদয়ের অপেক্ষা না করবে’।[31] অন্যত্র তিনি আরো বলেন, لاَ يَزَالُ الدِّيْنُ ظَاهِرًا مَا عَجَّلَ النَّاسُ الْفِطْرَ لأَنَّ الْيَهُوْدَ وَالنَّصَارَى يُؤَخِّرُوْنَ ‘দ্বীন ততদিন পর্যন্ত বিজয়ী থাকবে যতদিন মানুষ ইফতার তাড়াতাড়ি করবে। কেননা ইহুদী, নাছারারা দেরীতে ইফতার করে’।[32]
৩. তরতাজা খেজুর দ্বারা ইফতার করা : সতেজ বা তরতাজা খেজুর দ্বারা ইফতার করা, না পেলে শুকনা খেজুর দ্বারা ইফতার করা। হাদীছে এসেছে, كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم يُفْطِرُ عَلَى رُطَبَاتٍ قَبْلَ أَنْ يُصَلِّىَ فَإِنْ لَمْ تَكُنْ رُطَبَاتٌ فَعَلَى تَمَرَاتٍ فَإِنْ لَمْ تَكُنْ حَسَا حَسَوَاتٍ مِنْ مَاءٍ- ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তরতাজা খেজুর দ্বারা ইফতার করতেন। না পেলে শুকনা খেজুর দ্বারা ইফতার করতেন। তাও না পেলে তিনি এক অঞ্জলী পানি দ্বারা ইফতার করতেন’।[33]
৪. ইফতারের সময় দো‘আ করা : ইফতারের সময় দো‘আ কবুল হয়। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ثَلاَثُ دَعَوَاتٍ لاَ تُرَدُّ دَعْوَةُ الْوَالِدِ، وَدَعْوَةُ الصَّائِمِ وَدَعْوَةُ الْمُسَافِرِ ‘তিনটি দো‘আ প্রত্যাখ্যাত হয় না। পিতার দো‘আ, ছায়েমের দো‘আ ও মুসাফিরের দো‘আ’।[34]
‘বিসমিল্লাহ’ বলে শুরু ও ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে শেষ করবে।৩ ইফতারকালে রাসূল (ছাঃ) এ দো‘আ করতেন- ذَهَبَ الظَّمَأُ وَابْتَلَّتِ الْعُرُوْقُ وَثَبَتَ الْأَجْرُ إِنْ شَاءَ اللهُ- অর্থ- পিপাসা দূর হ’ল, শিরা-উপশিরা সিক্ত হ’ল এবং আল্লাহ চাহে তো পুরস্কার নিশ্চিত হ’ল’।[35]
৫. দান-ছাদাক্বাহ ও কুরআন তেলাওয়াত করা : রামাযান মাসে অধিক দান-ছাদাক্বাহ করা এবং বেশী বেশী কুরআন তেলাওয়াত করা সুন্নাত। কেননা রাসূল (ছাঃ) রামাযানে প্রবাহিত বাতাসের ন্যায় দান করতেন এবং অধিক কুরআন তেলাওয়াত করতেন। আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন,
كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَجْوَدَ النَّاسِ، وَكَانَ أَجْوَدُ مَا يَكُوْنُ فِىْ رَمَضَانَ حِيْنَ يَلْقَاهُ جِبْرِيْلُ، وَكَانَ يَلْقَاهُ فِىْ كُلِّ لَيْلَةٍ مِنْ رَمَضَانَ فَيُدَارِسُهُ الْقُرْآنَ، فَلَرَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَجْوَدُ بِالْخَيْرِ مِنَ الرِّيْحِ الْمُرْسَلَةِ –
অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মানুষের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ দাতা। রামাযানে তিনি আরো অধিক দানশীল হ‘তেন, জিবরীল (আঃ) যখন তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতেন। আর রামাযানে প্রতি রাতেই জিবরীল (আঃ) তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং তাঁরা একে অপরকে কুরআন তেলাওয়াত করে শুনাতেন। নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) প্রবাহিত বাতাস অপেক্ষা অধিক অধিক দানশীল ছিলেন’।[36]
৬. অধিক ইবাদতের চেষ্টা করা বিশেষত শেষ দশকে : রামাযান আল্লাহর সন্তোষ, নৈকট্য ও মাগফিরাত লাভের মাস। এ মাসে অধিক ইবাদতের মাধ্যমে গোনাহ মাফ করিয়ে নেওয়ার ও আল্লাহর রহমত লাভের চেষ্টা করা ছায়েমের জন্য অবশ্য কর্তব্য। আর এ মাসে প্রতি রাতে একজন আহবানকারী বেশী বেশী সৎকাজ করার জন্য আহবান জানান। রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِذَا كَانَتْ أَوَّلُ لَيْلَةٍ مِنْ رَمَضَانَ صُفِّدَتِ الشَّيَاطِيْنُ وَمَرَدَةُ الْجِنِّ وَغُلِّقَتْ أَبْوَابُ النَّارِ فَلَمْ يُفْتَحْ مِنْهَا بَابٌ وَفُتِحَتْ أَبْوَابُ الْجَنَّةِ فَلَمْ يُغْلَقْ مِنْهَا بَابٌ وَنَادَى مُنَادٍ يَا بَاغِىَ الْخَيْرِ أَقْبِلْ وَيَا بَاغِىَ الشَّرِّ أَقْصِرْ وَلِلَّهِ عُتَقَاءُ مِنَ النَّارِ وَذَلِكَ فِى كُلِّ لَيْلَةٍ ‘যখন রামাযানের প্রথম রাত্রি প্রবেশ করে তখন বিতাড়িত শয়তানকে শৃঙ্খলিত করা হয়, জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়; তার কোন দরজা খোলা থাকে না। জান্নাতের দরজা খুলে দেওয়া হয়; তার কোন দরজা বন্ধ থাকে না। আর একজন আহবানকারী ডেকে বলেন, হে কল্যাণের অভিযাত্রীরা! অগ্রসর হও। হে অকল্যাণের অভিসারীরা! বিরত হও। এরূপ প্রত্যেক রাত্রিতে করা হয়’।[37]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) রামাযানে অধিক ইবাদত করতেন। বিশেষ করে শেষ দশকে তিনি বেশী বেশী ইবাদত করতেন এবং তাঁর পরিবার-পরিজনকে জাগাতেন। আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, قَالَتْ كَانَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم إِذَا دَخَلَ الْعَشْرُ شَدَّ مِئْزَرَهُ، وَأَحْيَا لَيْلَهُ، وَأَيْقَظَ أَهْلَهُ– অর্থাৎ যখন রামাযানের শেষ দশ আসত তখন রাসূল তাঁর পরিধেয় বস্ত্র শক্ত করে বাঁধতেন এবং রাত্রি জাগরণ করতেন ও তাঁর পরিবার-পরিজনকে জাগাতেন।[38] অন্য বর্ণনায় এসেছে আয়েশা (রাঃ) বলেন,كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَجْتَهِدُ فِى الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ مَا لاَ يَجْتَهِدُ فِىْ غَيْرِهِ অর্থাৎ রাসূল (ছাঃ) শেষ দশকে (ইবাদতের) জন্য যে চেষ্টা করতেন, অন্য সময় তা করতেন না।[39]
৭. ছায়েমকে খাদ্য খাওয়াতে আগ্রহী হওয়া : ছিয়াম পালনকারীকে খাবার দিলে বহু পুণ্য লাভ হয়। রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَنْ فَطَّرَ صَائِمًا كَانَ لَهُ مِثْلُ أَجْرِهِمْ مِنْ غَيْرِ أَنْ يَنْقُصَ مِنْ أُجُوْرِهِمْ شَيْئًا ‘যে ব্যক্তি ছায়েমকে ইফতার করালো, তার জন্য ছায়েমের সমপরিমাণ নেকী রয়েছে। তবে ছায়েমের নেকী হরাস করা হবে না’।[40] রাসূল (ছাঃ) আরো বলেন, مَنْ جَهَّزَ غَازِيًا أَوْ جَهَّزَ حَاجًّا أَوْ خَلَّفَهُ فِيْ أَهْلِهِ أَوْ فَطَّرَ صَائِمًا كَانَ لَهُ مِثْلَ أُجُوْرِهِمْ مِنْ غَيْرِ أَنْ يَّنْقُصَ مِنْ أُجُوْرِهِمْ شَيْءٌ ‘যে ব্যক্তি কোন যোদ্ধাকে অথবা হজ্জে গমনকারীকে পাথেয় প্রস্ত্তত করে দিল অথবা তার পরিবারের দেখাশুনা করল (প্রতিনিধিত্ব করল) কিংবা ছায়েমকে ইফতার করালো তার তাদের সমপরিমাণ ছওয়াব রয়েছে। কিন্তু তাদের ছওয়াব কম করা হবে না’।[41]
ইফতার করার পরে খাদ্য দানকারীর জন্য দো‘আ করতে হয়। একটি হাদীছে বর্ণিত হয়েছে যে, একদা রাসূল (ছাঃ) সা‘দ ইবনু উবাদা (রাঃ)-এর বাড়ীতে গিয়ে প্রবেশের অনুমতি চাইলেন। তিনি তিনবার সালাম দিলেন। কিন্তু উত্তর না পেয়ে ফিরে আসতে উদ্যত হ’লেন। সা‘দ (রাঃ) তাঁর পিছনে পিছনে গিয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আপনার জন্য আমার পিতা-মাতা উৎসর্গীত হোক। আপনি যখনই সালাম দিয়েছেন, আমি তা শুনতে পেয়েছি এবং উত্তরও দিয়েছি। তবে আপনাকে শুনিয়ে বলিনি। কারণ আমি চাচ্ছিলাম আপনার বেশী বেশী সালাম এবং অধিক বরকত। অতঃপর তাঁরা বাড়ীতে প্রবেশ করলেন। তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর জন্য পনীর নিয়ে আসলেন। রাসূল (ছাঃ) তা খেলেন। আহার শেষে তিনি দো‘আ করলেন, أَكَلَ طَعَامَكُمُ الأَبْرَارُ، وَصَلَّتْ عَلَيْكُمُ الْمَلاَئِكَةُ، وَأَفْطَرَ عِنْدَكُمُ الصَّائِمُوْنَ ‘পূণ্যবান ব্যক্তিগণ তোমাদের খাদ্য খেয়েছেন, ফেরেশতারা তোমাদের জন্য দো‘আ করেছেন এবং ছিয়াম পালনকারীগণ তোমাদের নিকটে ইফতার করেছেন’।[42]
৮. রাত্রি জাগরণ করে ইবাদত করা : রামাযান একটি ফযীলতপূর্ণ মাস। এ মাসের ইবাদতে অধিক ছওয়াব লাভ হয়। এ মাসে রাত্রি জেগে ইবাদত করলে আল্লাহ পূর্বের গোনাহ ক্ষমা করে দেন। রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَنْ قَامَ رَمَضَانَ إِيْمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ছওয়াবের আশায় রাত্রি জাগরণ করল তার পূর্বের সকল গোনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়’।[43]
৯. রাত্রে অতিভোজ পরিহার করা : রাত্রে ভুরিভোজ না করে পরিমিত আহার করা। কেননা মানুষ পেটপুরে আহার করলে এবং রাতের প্রথমাংশে পরিতৃপ্তি সহকারে খাবার খেলে অবশিষ্ট রাত্রে যথার্থ ইবাদত করতে পারে না। কেননা অতিভোজ দেহে অলসতা ও অবসাদ নিয়ে আসে। তাছাড়া ভুরিভোজ ছিয়ামের মূল উদ্দেশ্যকে রহিত করে। কেননা ছিয়ামের মূল লক্ষ্য হচ্ছে ক্ষুধার জ্বালা অনুভব করা এবং প্রবৃত্তি পরায়ণতাকে পরিহার করা।
১০. মনের স্বাভাবিক চাহিদা পরিহার করা : অন্তরের এমন চাহিদা যাতে ছিয়াম নষ্ট হয় না যেমন শ্রবণ, দর্শন, স্পর্শ প্রভৃতি; কিন্তু এসব কখনো কখনো ছিয়ামকে ত্রুটিযুক্ত করে দেয়। বিধায় তা পরিত্যাজ্য।
১১. আল্লাহর নে‘মতের কথা স্মরণ করা : ছায়েমকে তার প্রতি আল্লাহর নে‘মতের পরিমাণ স্মরণ করা। কারণ আল্লাহ তাকে ছিয়াম পালনের সুযোগ দিয়েছেন এবং তার জন্য তা সহজসাধ্য করে দিয়েছেন, যাতে সে পূর্ণরূপে আদায় করতে পারে; রামাযান মাসকে সে অতিক্রম করতে পারে। অথচ অনেক মানুষ ছিয়াম থেকে বঞ্চিত হয়েছে; হয়তো রামাযানা মাস আসার পূর্বেই মৃত্যুর কারণে অথবা অপারগ ও অক্ষম হওয়ায় কিংবা তার গোমরাহী ও ছিয়াম পালন প্রত্যাখ্যান করার মাধ্যমে। এক্ষেত্রে ছায়েমকে যে আল্লাহ ছিয়াম পালনের এ নে‘মত দিয়েছেন সেজন্য তাঁর প্রতি সকল প্রশংসা ও যাবতীয় গুণগান। কারণ এ ছিয়াম গোনাহ থেকে ক্ষমা লাভের, পাপ মোচন হওয়ার এবং জান্নাতে আল্লাহর নিকটে তার সম্মান ও মর্যাদার স্তরে উন্নত হওয়ার মাধ্যম।
পরিশেষে বলব, উপরোল্লিখিত ছিয়ামের আদব সমূহ পালনের মাধ্যমে ছিয়াম পূর্ণাঙ্গ হয়, এর হক যথাযথভাবে আদায় হয়, উদ্দেশ্য পূরণ হয় এবং অশেষ ছওয়াব অর্জিত হয়। যার মাধ্যমে পরকালে জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণ লাভ করা যাবে। প্রবেশ করা যাবে অফুরন্ত শান্তি-সুখের আবাস জান্নাতে। তাই আল্লাহ আমাদের সবাইকে উক্ত আদব সমূহ পালনের মাধ্যমে সঠিকভাবে ছিয়াম রাখার তাওফীক দান করুন-আমীন!
-ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম