হিজবুত তাহরীর
আব্দুল্লাহ শাহেদ
*পাঠকদের সামনে হিজবুত তাহরীরের আকীদা ও বিশ্বাস তাদের কিতাব থেকেই তুলে ধরছি।
দলের প্রতিষ্ঠাতা
এই দলের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম আমীর হচ্ছে, তকীউদ্দীন নাবাহানী। তিনি ১৯০৯ সালে বর্তমান ইসরাঈলের হাইফা শহরে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৪৮ সালে বাইরুতে হিজবুত তাহরীর প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭৭ সালে তিনি বাইরুতে ইন্তকাল করেন।
দলটির মূলনীতিঃ
এ দলের মূলনীতি মুতাযেলা ও আশআরী সম্প্রদায়ের সাথে মিলে যায়। তারা শরীয়তের দলীলের উপর মানবীয় বিবেক বুদ্ধিকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে।
এই দলের কার্যকলাপ সম্পর্কে যতদূর জানা যায়ঃ
১) তাদের একমাত্র দাবী হচ্ছে খেলাফত প্রতিষ্ঠা করা। এ দিকেই তারা আহবান করে। ঈমান, নামায, রোজা ও ইসলামের অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে তাদের কোন তৎপরতা লক্ষ্য করা যায় না।
২) তাদের অনেক নেতাই নিজ নিজ দেশ ছেড়ে পাশ্চাত্য দেশে গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে।
৩) তারা খেলাফত পুনরুদ্ধার করতে চায়। কিন্তু শির্ক, বিদআত, সুফীবাদ ও পাপ কাজে লিপ্ত হওয়ার কারণে যে উছমানী খেলাফতের পতন ঘটেছে, তা নিয়ে তাদের কোন মাথা ব্যাথা নেই। তারা নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন ছাড়াই আল্লাহর কাছে ভাগ্যের পরিবর্তন চায়।
৪) তারা সবসময় রাজনীতি নিয়েই ভাষণ ও বক্তৃতা দেয়। ইসলামের অন্যান্য মৌলিক শিক্ষার দিকে কোন গুরুত্ব নেই।
৫) মুসলিম দেশের সেনাপতি অমুসলিম হলেও কোন অসুবিধা নেই। (দেখুনঃ ৫/৬/১৯৭০ তারিখে এ দলের আমীর নাবহানী কর্তৃক প্রকাশিত একটি প্রশ্নোত্তর সম্বলিত লিফলেট)
৬) হারাম পথ অবলম্বন করে লক্ষ্য-উদ্দেশ্যে পৌঁছাতে কোন অসুবিধা নেই।
৭) আমরা যে অর্থে তাকদীরের প্রতি বিশ্বাস করি, তারা তা অস্বীকার করে। (দেখুনঃ আদ্-দাওসীয়া, পৃষ্ঠা নং-১৮ )
৮) আকল তথা মানবীয় বিবেক হচ্ছে দ্বীনের অন্যতম মূলনীতি। তাদের এ নীতিটি মুতাযেলাদের কথার সাথে মিলে যায়।
৯) কর্মক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের একত্রিত হওয়া এবং পরস্পর সহযোগিতা করা জরুরী।
১০) শিয়া ও সুন্নীর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। (দেখুনঃ আল-ওয়াঈ আত্ তাহরীরিয়া, সংখ্য ৭৫, বর্ষ-১৯৯৩)
১১) তাদেরকে ছাড়া তারা সকল মুসলমানকে কাফের মনে করে এবং সকল মুসলিম রাষ্ট্রকে কুফরী রাষ্ট্র বলে মনে করে। এমন কি মক্কা ও মদীনাকেও তারা ইসলামী দেশ মনে করে না।
১২) অপরিচিত মহিলাকে চুম্বন করা ও তার সাথে মুসাফাহা করা জায়েয। (দেখুনঃ তাদের আমীর নাবহান কর্তৃক প্রকাশিত ২৯/৫/১৯৭০ সালে প্রকাশিত -একটি প্রশ্নের উত্তর- নামে একটি লিফলেট)
১৩) মহিলাদের উলঙ্গ ছবির দিকে তাকানো জায়েয।
১৪) কুরআন ও সুন্নার বিরোধতা করলেও খলীফার আনুগত্য করা জরুরী। (আদ্ দাওলাতুল ইসলামীয়া, পৃষ্ঠা নং-১০৮)
১৫) খবরে ওয়াহেদ তথা একক ব্যক্তির সনদে বর্ণিত হাদীছ সহীহ হলেও তা গ্রহণযোগ্য নয়। এখানে তাদের কথা মুতাযেলাদের সাথে মিলে যায়।
১৬) তারা কবরের আযাবকে অস্বীকার করে।
১৭) ইমাম মাহদীর আগমণ সম্পর্কে বর্ণিত সহীহ হাদীছগুলো তারা গ্রহণ করে না।
আজ এখানেই রেখে দিলাম। তাদের সম্পর্কে আরও কোন নতুন তথ্য পেলে আগামীতে লিখবো ইনশা-আল্লাহ্। এটি একটি বাতিল ও গোমরাহ ফির্কা। এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। তবে শেখ দামেশকিয়া কর্তৃক লিখিত ( حزب التحرير مناقشة لأهم مباديء الحزب ) নামক কিতাবটিতে তাদের মতবাদ সমূহ বিস্তারিত পাওয়া যাবে।
সাবধান! সাবধান! মুসলিম যুবক ও শিক্ষিত ভাইগণ তাদের দলে শরীক হওয়া থেকে সাবধান।
হিজবুত তাহরীর যে সমস্ত বিভ্রান্তির মধ্যে রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ইসলামের দু’টি মূলনীতি কুরআন ও সহীহ হাদীছের দলীলের উপর মানুষের বিবেক-বুদ্ধিকে প্রাধান্য দেওয়া। তাদের কিতাব গুলোতেই সুস্পষ্টভাবে উক্ত কথাটি উল্লেখ আছে। হিজবুত তাহরীরের অন্যতম একটি কিতাব نداء حار إلى المسلمين من حزب التحرير এ বলা হয়েছে, ইসলামের প্রকৃত রূপ হচ্ছে, তা চিন্তা ও গবেষণার ফলাফল সমূহ। এ জন্যই অহীর মাধ্যমে যা কিছু এসেছে, তার প্রতিটির মধ্যেই বিবেক ও চিন্তাকে কাজে লাগাতে হবে। ইসলাম এমন চিন্তা ও গবেষণার ফল যার ভিত্তি হচ্ছে মানুষের বিবেক। কিতাবটির লেখক আরও বলেনঃ বিবেক দিয়েই ইসলামকে বুঝতে হবে। সঠিক কথা হচ্ছে ইসলাম বিবেকের অধিনস্ত। আর যদি বলা হয় ইসলামকে মাপার যন্ত্রও হল আকল বা বিবেক, তাও ঠিক হবে। কারণ বিবেকই হচ্ছে ইসলামের মূল। সুতরাং আকল বা বিবেক-বুদ্ধি যেটা বলে সেটাই ইসলামের দলীল। কুরআনের আয়াত বা হাদীছ নয়।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের সকল ইমামের মতে ইসলামের মূল ভিত্তি হচ্ছে আল্লাহর কিতাব ও রাসূল সুন্নাত; মানুষের বিবেক-বুদ্ধি নয়। মানুষের বিবেক ও বুদ্ধি যদি কুরআন ও হাদীছের কোন তথ্য ও রহস্য বুঝতে সক্ষম হয় তাহলে তো ভালই। আর কোন বিষয়ের বা হুকুমের রহস্য বিবেক দ্বারা বুঝতে না পারলেও তা বিশ্বাস করা জরুরী। এমন কি কুরআন ও হাদীছে বর্ণিত কোন মাসআলা মানুষের বিবেকের বিরোধী হলে বিবেক প্রসুত কথা বাদ দিয়ে কুরআন ও হাদীছের কথাই মেনে নিতে হবে। কারণ কুরআন ও হাদীছের বাণী ভুলের উর্ধে। আর মানুষের জ্ঞান ও বুদ্ধি ভুলের উর্ধে নয়।
বিবেককে কুরআন ও হাদীছের দলীলের উপর প্রাধান্য দেওয়ার কারণেই হিজবুত তাহরীর ও মুতাযেলাদের যথেষ্ট মিল খুঁজে পাওয়া যায়। হিজবুত তাহরীরের লোকেরা মুতাযেলাদের ইমামদের প্রশংসা করেছেন। হিজবুত তাহরীরের প্রতিষ্ঠাতা তকীউদ্দীন নাবাহানী মুতাজেলাদের ইমাম ওয়াসেল বিন আতা, আমর বিন উবাইদ, আবু হিলাল আল-আল্লাক এবং নাযযাম প্রসংগে বলনেঃ
لم يحصل منهم أي انحراف في العقائد على اختلاف معتقداتهم، فكلهم مسلمون مدافعون عن الإسلام
আকীদার ক্ষেত্রে তাদের কোন প্রকার বিভ্রান্তি ঘটে নি। যদিও তাদের আকীদায় ভিন্নতা ছিল। তারা সকলেই ছিলেন মুসলিম এবং ইসলামের পক্ষের শক্তি। (দেখুন হিজবুত তাহরীরে কিতাবঃ الشخصية الإسلامية)
মুতাজেলাদের মতই হিজবুত তাহরীরের লোকেরা কবরের আযাব ও নেয়ামতকে অস্বীকার করেন। দাজ্জালের আগমণেও তারা বিশ্বাসী নয়।
এ দলটি মুতাযেলাদের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার কারণেই খবরে ওয়াহেদ তথা একজন রাবীর সূত্রে বর্ণিত হাদীছ দ্বারা আকীদার যে সমস্ত মাসআলা সাব্যস্ত হয়েছে, তা প্রত্যাখ্যান করে থাকেন। তকীউদ্দীন নাবাহানী বলেনঃ
خبر الآحاد ليس بحجة في العقائد
অর্থাত আকীদাহ বা বিশ্বাসের সাথে সম্পৃক্ত মাসআলা গুলোর ক্ষেত্রে একজন রাবীর মাধ্যমে বর্ণিত হাদীছ দলীল নয়। (দেখুন হিজবুত তাহরীরে কিতাবঃ الشخصية الإسلامية)
এটি অত্যন্ত বিভ্রান্তিকর একটি কথা। এর মাধ্যমে মুতাযেলা সম্প্রদায় এবং হিজবুত তাহরীরের লোকেরা দ্বীনের অনেক বিষয় অস্বীকার করেছেন। মুহাদ্দিছগণের মতে আল্লাহর কিতাবের পর সবচেয়ে অধিক বিশুদ্ধ কিতাব বুখারী শরীফের প্রথম হাদীছটিই খবরে ওয়াহেদ তথা একজন রাবীর সূত্রে বর্ণিত। এভাবে যদি একক সূত্রে বর্ণিত হাদীছকে অস্বীকার করা হয় তাহলে দ্বীনের অনেক বিষয়কেই অস্বীকার করা হবে। সুতরাং এই দলের লোকদের থেকে সাবধান থাকতে হবে। তাদের বাহ্যিক বড় বড় কথা শুনে আমরা যেন বিভ্রান্ত না হই।
তাদের বই ডাউনলড এর link টা দিলে খুব উপকার হত
হিজবুত তাহরীরকে আমিও সহীহ মনে করি না। তাদের মধ্যে গলদ অবশ্যই আছে। বিশেষত সারাক্ষণ শুধু ‘খেলাফত’ ‘খেলাফত’ একঘেয়ে জিগির আর পুলিশের সাথে ধস্তাধস্তি আমার কাছে হাস্যকর বলেই মনে হয়। কিন্তু এ প্রবন্ধে যেভাবে পয়েন্ট বাই পয়েন্ট ধরে তাদের দোষ ধরবার চেষ্টা হয়েছে, তা আমার কাছে জাকির নায়েকবিরোধী প্রচারণার সাথেই সাদৃশ্যপূর্ণ মনে হয়েছে। যারা জাকির নায়েকের ছিদ্রান্বেষণে ব্যস্ত, তাদের কথাবার্তার ধরন যেমন হয়ে থাকে, এ লেখাটিও কেন জানি আমার কাছে সেরকমই মনে হয়। (দেখুন: http://i-onlinemedia.net/archives/3319) ব্যক্তিবিদ্বেষ বা গোষ্ঠীবিদ্বেষ যেন পরচর্চায় রূপ না নেয়, সেদিকে আমাদের সকলেরই সংযমী হওয়া উচিত। সংশোধনমূলক সমালোচনা আর অপ্রয়োজনীয় পরচর্চা এক জিনিস নয়।