যেসব আমল সম্পাদনকালে আকাশের দরজাগুলো খোলা হয় (২)
পূর্বের অংশ: আকাশের দরজাগুলো কখন ও কেন খোলা হয়? (১)
যেসব আমল সম্পাদনকালে আকাশের দরজাগুলো খোলা হয় :
কিছু কিছুু আমল রয়েছে, যা সম্পাদনের সময় আল্লাহ আকাশের দরজাগুলো খুলে দেন। সৎকর্মশীল বান্দার আমলের নেকী গ্রহণের জন্যই মূলতঃ আসমানী দরজাগুলো উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এ জাতীয় কিছু আমলের বর্ণনা দেওয়া নিম্নে হ’ল।-
(১) যোহরের পূর্বে চার রাক‘আত সুন্নাত ছালাত আদায় করা :
পাঁচ ওয়াক্ত ফরয ছালাতের পূর্বে ও পরে ১০/১২ রাক‘আত সুন্নাত ছালাত আদায় করা অত্যন্ত ফযীলতপূর্ণ। তন্মধ্যে যোহরের ফরয ছালাতের পূর্বের চার রাক‘আত এমন অন্যতম, যা আদায়ের প্রাক্কালে আকাশের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়। আব্দুল্লাহ ইবনে আস-সায়েব (রাঃ) বলেন,
أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يُصَلِّي أَرْبَعًا بَعْدَ أَنْ تَزُوْلَ الشَّمْسُ قَبْلَ الظُّهْرِ، وَقَالَ: إِنَّهَا سَاعَةٌ تُفْتَحُ فِيْهَا أَبْوَابُ السَّمَاءِ، وَأُحِبُّ أَنْ يَصْعَدَ لِيْ فِيْهَا عَمَلٌ صَالِحٌ.
‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সূর্য ঢলে পড়ার পর যোহরের (ফরযের) পূর্বে চার রাক‘আত ছালাত আদায় করতেন। তিনি বলেন, এটা এমন একটা সময় যখন আসমানের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়, আর আমি ভালোবাসি যে, এই সময়ে আমার নেক আমল উত্থিত হোক’।[1]
অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বলেন,إنه إذا زالت الشمسُ فتِحَتْ أبوابُ السماءِ، فلا يُغلقُ منها بابٌ حتى يُصلى الظهرُ، فأنا أَحبُّ أن يُرفعَ لي في تلك الساعة خير. ‘নিশ্চয়ই যখন সূর্য (পশ্চিমাকাশে) ঢলে পড়ে, আকাশের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়। অতঃপর যোহর ছালাত সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত কোন দরজাই বন্ধ করা হয় না। আর আমি পসন্দ করি যে, এই সময় আমার আমল উঠিয়ে নেওয়া হোক’।
রাসূল (ছাঃ) এই চার রাক‘আত ছালাতকে এতই গুরুত্ব দিতেন যে, কখনো যোহরের পূর্বে তা আদায় করতে না পারলে যোহরের পরে পড়ে নিতেন। আর যারা যোহরের পূর্বের চার রাক‘আতের পাশাপাশি পরেও চার রাক‘আত সুন্নাত আদায় করে, আল্লাহ তাদের জন্য জাহান্নামকে হারাম করে দেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مَنْ حَافَظَ عَلَى أَرْبَعِ رَكَعَاتٍ قَبْلَ الظُّهْرِ وَأَرْبَعٍ بَعْدَهَا حَرَّمَهُ اللهُ عَلَى النَّارِ، ‘যে ব্যক্তি যোহরের পূর্বে চার রাক‘আত এবং পরে চার রাক‘আত সুন্নাত ছালাতের ব্যাপারে যত্নশীল হয়, আল্লাহ তার উপর জাহান্নামের আগুন হারাম করে দেন’।[2]
২. এক ফরয ছালাত শেষে অপর ছালাতের জন্য অপেক্ষা করা :
এক ফরয ছালাত আদায়ের পর অপর ফরয ছালাতের জন্য অপেক্ষায় থাকলে আল্লাহ ঐ বান্দাদেরকে নিয়ে ফেরেশতাদের সামনে গর্ব করেন এবং তাদের জন্য আসমানের বিশেষ একাটি দরজা খুলে দেন। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) বলেন, একদা আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে মাগরিবের ছালাত আদায় করলাম। তারপর যার চলে যাওয়ার সে চলে গেল, আর যার থাকার সে (মসজিদে) থেকে গেল। একটু পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এত দ্রুতবেগে ফিরে এলেন যে, তাঁর দীর্ঘ নিঃশ্বাস বের হ’তে লাগল। তিনি তাঁর দু’হাঁটুর উপর ভর করে বসে বললেন, أَبْشِرُوْا، هَذَا رَبُّكُمْ قَدْ فَتَحَ بَابًا مِنْ أَبْوَابِ السَّمَاءِ، يُبَاهِيْ بِكُمُ الْمَلَائِكَةَ، يَقُوْلُ: انْظُرُوْا إِلَى عِبَادِيْ قَدْ قَضَوْا فَرِيْضَةً، وَهُمْ يَنْتَظِرُوْنَ أُخْرَىْ. ‘তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ করো। তোমাদের প্রতিপালক আকাশের একাটি দরজা খুলে দিয়েছেন এবং ফেরেশতাদের সামনে তোমাদেরকে নিয়ে গর্ব করে বলছেন, ‘তোমরা আমার বান্দাদের দিকে তাকিয়ে দেখ, তারা এক ফরয আদায়ের পর পরবর্তী ফরয আদায়ের জন্য অপেক্ষা করছে’।[3]
অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘আমি কি তোমাদেরকে এমন কিছু আমলের সন্ধান দিব না, যা তোমাদের পাপরাশি মিটিয়ে দিবে এবং মর্যাদা উচ্চকিত করবে? তাহ’ল- কষ্টের সময় সুন্দররূপে ওযূ করা, অধিক পদক্ষেপে মসজিদে গমন করা এবং এক ছালাতের পর অপর ছালাতের জন্য অপেক্ষা করা। এটাই হ’ল তোমাদের পাহারা দেওয়া, এটাই হ’ল তোমাদের পাহারা দেওয়া, এটাই হ’ল তোমাদের পাহারা দেওয়া।[4] অর্থাৎ ছালাতের জন্য অপেক্ষমাণ ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় পাহারারত মুজাহিদের মত মর্যাদাবান।
ইবনে বাত্তাল বলেন, ‘অনেক বড় পাপী বান্দা যদি কামনা করে যে, কোন কষ্ট ছাড়াই তার পাপগুলো মিটিয়ে দেওয়া হোক, সে যেন ছালাতের পর তার মুছাল্লাতে (তাসবীহ-তাহলীলের মাধ্যমে) অবস্থান করাকে গনীমত মনে করে। কেননা এতে তার দো‘আ কবুল করা হয় এবং ফেরেশতারা তার জন্য দো‘আ করে ও তার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করে।
৩. আল্লাহর কিতাব পঠন-পাঠনের মজলিসে :
কোন বান্দা যদি তার রবের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে তাঁর কিতাব পঠন-পাঠনে সময় অতিক্রান্ত করে এবং তাঁর গৃহে সমবেত হয়ে দ্বীন শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে রত থাকে, তাহ’লে ফেরেশতারা আকাশের দরজা খুলে যমীনে অবতরণ করে ঐ বান্দাদেরকে ঘিরে রাখেন এবং আকাশের উন্মোচিত দরজা দিয়ে তাদের উপর রহমত ও প্রশান্তি বর্ষিত হতে থাকে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
مَا اجْتَمَعَ قَوْمٌ فِيْ بَيْتٍ مِنْ بُيُوْتِ اللهِ، يَتْلُوْنَ كِتَابَ اللهِ، وَيَتَدَارَسُونَهُ بَيْنَهُمْ، إِلَّا نَزَلَتْ عَلَيْهِمِ السَّكِينَةُ، وَغَشِيَتْهُمُ الرَّحْمَةُ وَحَفَّتْهُمُ الْمَلَائِكَةُ، وَذَكَرَهُمُ اللهُ فِيْمَنْ عِنْدَهُ.
‘যখন কোন সম্প্রদায় আল্লাহর কোন ঘরে সমবেত হয়ে আল্লাহর কিতাব তেলাওয়াত করে এবং পরস্পরে তা নিয়ে আলোচনা করে, তখন তাদের উপর প্রশান্তি বর্ষিত হয়, (আল্লাহর) রহমত তাদেরকে ঢেকে রাখে, ফেরেশতাগণ তাদেরকে ঘিরে রাখে এবং আল্লাহ তাঁর নিকটবর্তী ফেরেশতাদের কাছে তাদের প্রশংসা করেন’।[5]
একদা উসাইদ বিন হুযায়ের (রাঃ) রাতে তার বাড়ীতে বসে সূরা বাক্বারাহ তেলাওয়াত করছিলেন। হঠাৎ তার পাশে বেঁধে রাখা ঘোড়াটি লাফাতে শুরু করে। তিনি যখন কুরআন তেলাওয়াত বন্ধ করলেন, তখন ঘোড়াটি শান্ত হ’ল। পুনরায় যখন তেলাওয়াত শুরু করলেন, ঘোড়াটিও লাফাতে শুরু করে দিল। আর ঘোড়াটির পাশে তার শিশু পুত্র ইয়াহইয়া শুয়েছিল। তিনি ভয় পেয়ে গেলেন, না জানি ছেলের গায়ে আঘাত লেগে যায়। তখন তিনি পুত্রকে টেনে আনলেন এবং আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছু দেখতে পেলেন। অতঃপর পরের দিন সকালে তিনি আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে উপস্থিত হয়ে রাতের ঘটনাটি জানালেন। নবী করীম (ছাঃ) বললেন, হে ইবনু হুযায়ের! তুমি পড়তেই থাকতে! হে ইবনু হুযায়ের! তুমি পড়তেই থাকতে! তখন সে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! ছেলেকে ঘোড়ার পায়ের আঘাত লাগার ভয়ে আমি তেলাওয়াত বন্ধ করেছিলাম। আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে ছায়ার মত এক জ্যোতির্ময় জিনিস দেখতে পেয়েছিলাম এবং তা দেখতে দেখতে উপরের দিকে উঠে শূন্যে মিলিয়ে গেল। তখন রাসূল (ছাঃ) তখন বললেন,وَتَدْرِيْ مَا ذَاكَ؟ تِلْكَ الـمَلاَئِكَةُ دَنَتْ لِصَوْتِكَ، وَلَوْ قَرَأْتَ لَأَصْبَحَتْ يَنْظُرُ النَّاسُ إِلَيْهَا، لاَ تَتَوَارَى مِنْهُمْ، ‘তুমি কি জান, সেটা কি ছিল? তাঁরা ছিল ফেরেশতা। তোমার তেলাওয়াত শুনে তোমার কাছে এসেছিল। যদি তুমি তেলাওয়াত করতেই থাকতে, তাহ’লে তাঁরা সকাল পর্যন্ত এভাবেই থাকত এবং লোকেরা তাদেরকে দেখতে পেত। একজন ফেরেশতাও তাদের দৃষ্টির অন্তরাল হ’তেন না’।[6]
অতএব এতে প্রমাণিত হয় যে, কুরআনের মজলিসকে বরকতমন্ডিত করার জন্য ফেরেশতারা কল্যাণের বার্তা নিয়ে যমীনে নেমে আসেন এবং ঐ মজলিসে উপবেশনকারী বান্দাদের উপর আল্লাহ সন্তুষ্ট হন।
৪. প্রতিশোধ বর্জন করে সহনশীল হওয়া :
যারা প্রতিশোধ না নিয়ে ধৈর্য ধারণ করতে পারে, তারা সফলকাম। তাদের জন্য আকাশের দরজা খুলে দেওয়া হয় এবং আকাশ থেকে ফেরেশতা নাযিল হয়ে তাদের পক্ষে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সাঈদ ইবনুল মুসাইয়িব (রাঃ) বলেন, ‘একদা রাসূল (ছাঃ) তাঁর ছাহাবীদের নিয়ে বসে ছিলেন। এমন সময় এক ব্যক্তি এসে আবুবকর (রাঃ)-কে গালি দিয়ে কষ্ট দিল, কিন্তু আবুবকর (রাঃ) কোন জবাব না দিয়ে চুপ থাকলেন। তারপর লোকটা পুনরায় আবুবকর (রাঃ)-কে কষ্ট দিল। কিন্তু তিনি কোন জবাব না দিয়ে চুপ থাকলেন। তৃতীয়বার লোকটা আবারও আবুবকর (রাঃ)-কে গালি দিয়ে কষ্ট দিল, কিন্তু তিনি এবার লোকটির প্রতিশোধ নিলেন (অর্থাৎ লোকটাকে পাল্টা জবাব দিলেন)। যখন আবুবকর (রাঃ) তার প্রতিশোধ নিলেন, তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) উঠে দাঁড়ালেন। আবুবকর (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আপনি কি আমার উপর রাগ করেছেন? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, (যখন তুমি চুপ ছিলে) আসমান থেকে একজন ফেরেশতা অবতরণ করে তোমার পক্ষ হয়ে জবাব দিচ্ছিলেন। কিন্তু যখন তুমি তার প্রতিশোধ নিলে, তখন এখানে শয়তান উপস্থিত হ’ল। আর যেখানে শয়তান উপস্থিত হয়, সেখানে আমি বসে থাকতে পারি না’।[7] তারপর আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বললেন,يَا أَبَا بَكْرٍ ثَلَاثٌ كُلُّهُنَّ حَقٌّ: مَا مِنْ عَبْدٍ ظُلِمَ بِـمَظْلَمَةٍ فَيُغْضِيْ عَنْهَا لِلَّهِ عَزَّ وَجَلَّ، إِلَّا أَعَزَّ اللهُ بِـهَا نَصْرَهُ، وَمَا فَتَحَ رَجُلٌ بَابَ عَطِيَّةٍ، يُرِيدُ بِـهَا صِلَةً، إِلَّا زَادَهُ اللهُ بِهَا كَثْرَةً، وَمَا فَتَحَ رَجُلٌ بَابَ مَسْأَلَةٍ، يُرِيدُ بِهَا كَثْرَةً، إِلَّا زَادَهُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ بِـهَا قِلَّةً- ‘হে আবুবকর! তিনটি বিষয় আছে, যেগুলোর প্রত্যেকটি সত্য। (১) যদি কোন ব্যক্তির উপর যুলুম করা হয়, আর সে যুলুমের প্রতিবাদ না করে চুপ থাকে, তাহ’লে মহান আল্লাহ অবশ্যই তাকে সাহায্য করবেন। (২) যদি কোন ব্যক্তি তার দানের দরজা খুলে দেওয়ার মাধ্যমে আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার ইচ্ছা পোষণ করে, তাহ’লে আল্লাহ অবশ্যই তা বৃদ্ধি করে দিবেন। (৩) কোন ব্যক্তি ভিক্ষার দরজা খুলে দিলে এবং এর মাধ্যমে তার সম্পদ বৃদ্ধি করতে চাইলে আল্লাহ তার সম্পদ কমিয়ে দিবেন’।[8]
অন্যত্র ওক্ববা ইবনে ‘আমের (রাঃ) বলেন, একদা আমি রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে সাক্ষাত করে তাঁর হাত ধরে বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমাকে কতিপয় উৎকৃষ্ট আমলের কথা বলুন! তখন তিনি বললেন,يَا عُقْبَةُ، صِلْ مَنْ قَطَعَكَ، وَأَعْطِ مَنْ حَرَمَكَ، وَأَعْرِضْ عَمَّنْ ظَلَمَكَ وفي رواية: واعْفُ عَمَّنْ ظلَمكَ، ‘হে ওক্ববা! যে তোমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে, তার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখ। যে তোমাকে বঞ্চিত করে তাকে দান করো। যে তোমার প্রতি যুলুম করে তাকে এড়িয়ে চল। অপর বর্ণনায় আছে, যুলুমকারীকে ক্ষমা করে দাও’।[9]
ইউসুফ (আঃ) শত নির্যাতন ও যুলুমের স্বীকার হয়ে এবং প্রতিশোধ গ্রহণের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তার ভাইদেরকে ক্ষমা করে দিয়ে বলেছিলেন,لَا تَثْرِيبَ عَلَيْكُمُ الْيَوْمَ يَغْفِرُ اللهُ لَكُمْ وَهُوَ أَرْحَمُ الرَّاحِمِيْنَ ‘আজ তোমাদের বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নেই। আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করুন। তিনি মেহেরবানদের চেয়ে অধিক মেহেরবান’ (ইউসুফ ১২/৯৬)।
নবী করীম (ছাঃ) মক্কা বিজয়ের দিন এমন লোকদেরকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন, যারা ছিল তার প্রাণঘাতি শত্রু। ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তিনি তাদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি। কারণ ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যারা প্রতিশোধ গ্রহণ করা থেকে নিজেকে নিবৃত রাখেন, আকাশের দরজা খুলে ফেরশতা নেমে এসে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদেরকে সাহায্য করেন এবং তাদের উপর রহমত বর্ষিত হয়। তবে ক্ষেত্র বিশেষে মাযলূম হয়ে প্রতিশোধ গ্রহণ করতে হয়। যেমন আল্লাহ আখেরাত পিয়াসী বান্দাদের গুণ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, وَالَّذِيْنَ إِذَا أَصَابَهُمُ الْبَغْيُ هُمْ يَنْتَصِرُوْنَ، ‘আর তারা অত্যাচারিত হ’লে প্রতিশোধ গ্রহণ করে’ (শূরা ৪২/৩৯)।
৬. যিকিরের মজলিস অংশগ্রহণ করা :
যখন কোন বৈঠকে আল্লাহর যিকির করা হয়, তখন আকাশের দরজা খুলে দেওয়া হয়। আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে নিযুক্ত একদল ফেরেশতা আছেন, যারা যিকিরের মজলিস অনুসন্ধান কারার জন্য সর্বদা যমীনে পরিভ্রমণ করে বেড়ান। আর যখন কোন মজলিস খুঁজে পান, তখন আকাশ-যমীন পরিব্যাপ্ত হয়ে সেই মজলিসকে ঘিরে রাখেন।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর একদল ফেরেশতা আছেন, যাঁরা আল্লাহর যিকিরে রত লোকেদের খোঁজে পথে পথে ঘুরে বেড়ান। যখন তাঁরা কোথাও আল্লাহর যিকিরে রত লোকেদের দেখতে পান, তখন ফেরেশতারা পরস্পরকে ডেকে বলেন, তোমরা আপন আপন কাজ করার জন্য এগিয়ে এসো। তখন তাঁরা তাঁদের ডানাগুলো দিয়ে সেই লোকদের ঢেকে ফেলেন নিকটবর্তী আকাশ পর্যন্ত। তখন তাঁদের প্রতিপালক তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন যদিও ফেরেশতাদের চেয়ে তিনিই অধিক জানেন, مَا يَقُوْلُ عِبَادِيْ؟ ‘আমার বান্দারা কি বলছে’? তখন তাঁরা বলেন, তারা আপনার পবিত্রতা বর্ণনা করছে, আপনার শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা দিচ্ছে, আপনার গুণগান করছে এবং আপনার মহত্ত্ব প্রকাশ করছে। তখন তিনি জিজ্ঞেস করবেন,هَلْ رَأَوْنِي؟ ‘তারা কি আমাকে দেখেছে’? তখন তাঁরা বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক, আপনার শপথ! তারা আপনাকে দেখেনি। তিনি বলবেন, وَكَيْفَ لَوْ رَأَوْنِي؟ ‘আচ্ছা যদি তারা আমাকে দেখত তাহ’লে কি করত? তাঁরা বলবেন, যদি তারা আপনাকে দেখত, তবে তারা আরও অধিক পরিমাণে আপনার ইবাদত করত, আরো অধিক আপনার মাহাত্ম্য ঘোষণা করত, আরো অধিক পরিমাণে আপনার পবিত্রতা বর্ণনা করত। বর্ণনাকারী বলেন, আল্লাহ বলবেন,فَمَا يَسْأَلُونِيْ؟ ‘তারা আমার কাছে কি চায়’? তাঁরা বলবেন, তারা আপনার কাছে জান্নাত চায়। তিনি জিজ্ঞেস করবেন, তারা কি জান্নাত দেখেছে? ফেরেশতারা বলবেন, না। আপনার সত্তার কসম! হে রব! তারা তা দেখেনি। তিনি জিজ্ঞেস করবেন, যদি তারা দেখত তবে তারা কি করত? তাঁরা বলবেন, যদি তারা তা দেখত তাহ’লে জান্নাতের জন্য আরো অধিক লোভ করত, আরো বেশী চাইত এবং এর জন্য আরো বেশী বেশী আকৃষ্ট হ’ত। আল্লাহ তা‘আলা জিজ্ঞেস করবেন, তারা কি থেকে আল্লাহর আশ্রয় চায়? ফেরেশতাগণ বলবেন, জাহান্নাম থেকে। তিনি জিজ্ঞেস করবেন, তারা কি জাহান্নাম দেখেছে? তাঁরা জবাব দিবেন, আল্লাহর কসম! হে প্রতিপালক! তারা জাহান্নাম দেখেনি। তিনি জিজ্ঞেস করবেন, যদি তারা তা দেখত তখন তাদের কি হ’ত? তাঁরা বলবেন, যদি তারা তা দেখত, তাহ’লে তারা তাত্থেকে দ্রুত পালিয়ে যেত এবং একে অত্যধিক ভয় করত। তখন আল্লাহ বলবেন,فَأُشْهِدُكُمْ أَنِّيْ قَدْ غَفَرْتُ لَهُمْ ‘আমি তোমাদের সাক্ষী রাখছি, আমি তাদের ক্ষমা করে দিলাম’। তখন ফেরেশতাদের একজন বলবে, তাদের মধ্যে অমুক ব্যক্তি আছে, যে তাদের অন্তর্ভুক্ত নয় বরং সে কোন প্রয়োজনে এসেছে। আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, তারা এমন উপবেশনকারী যাদের মজলিসে উপবেশনকারী বিমুখ হয় না’।[10]
তবে বিভিন্ন মাযারে নাচের তালে তালে ও গানের সুরে সুরে যিকির করার যে পদ্ধতি চালু আছে, তা অবশ্যই পরিত্যজ্য এবং ‘লা-ইলাহা’ অথবা শুধু ‘ইল্লাল্লাহ’ এরূপ অংশবিশেষ বলে যিকির করা শরী‘আত সম্মত নয়। অপরদিকে নবীর নামে যিকির করা শিরক। কারণ যিকির হ’তে হবে আল্লাহর নামে, কোন সৃষ্টির নামে নয়। তাছাড়া আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) চিৎকার করে যিকির করতে নিষেধ করেছেন। আবূ মূসা আশ‘আরী (রাঃ) বলেন, যখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদেরকে নিয়ে খায়বারের দিকে যাত্রা করেছিলেন, তখন লোকেরা কোন উপত্যকায় উপনীত হ’লে উচ্চৈঃস্বরে ‘আল্লাহু আকবার’ ও ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু’ বলে তাকবীর দিচ্ছিল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তখন তাদেরকে বললেন,ارْبَعُوْا عَلَى أَنْفُسِكُمْ، إِنَّكُمْ لاَ تَدْعُوْنَ أَصَمَّ وَلاَ غَائِبًا، إِنَّكُمْ تَدْعُوْنَ سَمِيْعًا قَرِيْبًا وَهُوَ مَعَكُمْ، ‘তোমরা নিজেদের প্রতি দয়া কর। কারণ তোমরা বধির ও অনুপস্থিত কোন সত্তাকে ডাকছ না; বরং তোমরা সেই সত্তাকে ডাকছ, যিনি সর্বশ্রোতা এবং তোমাদের অতি নিকটে অবস্থানকারী’।[11]
এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন,وَاذْكُرْ رَبَّكَ فِي نَفْسِكَ تَضَرُّعًا وَخِيفَةً وَدُونَ الْجَهْرِ مِنَ الْقَوْلِ بِالْغُدُوِّ وَالْآصَالِ وَلَا تَكُنْ مِنَ الْغَافِلِيْنَ، ‘তোমার প্রতিপালককে স্মরণ কর মনে মনে কাকুতি-মিনতি ও ভীতি সহকারে অনুচ্চৈঃস্বরে সকালে ও সন্ধ্যায়। আর তুমি উদাসীনদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না’ (আ‘রাফ ৭/২০৫)।
৭. রোগীকে দেখতে যাওয়া :
নবী করীম (ছাঃ) রোগীর সেবা এবং অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়ার ব্যাপারে তাঁর উম্মতকে অনুপ্রাণিত করেছেন। তিনি বলেন, عُودُوا الْمَرِيْضَ، وَاتَّبِعُوا الْجَنَازَةَ تُذَكِّرُكُمُ الْآخِرَةَ، ‘তোমরা রোগীর সেবা কর এবং জানাযার ছালাতে অংশগ্রহণ কর, যা তোমাদেরকে আখেরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দিবে’।[12]
একবার আলী (রাঃ)-এর পুত্র হাসান (রাঃ) খুব অসুস্থ হ’লেন। আবূ মূসা আশ‘আরী (রাঃ) তাকে দেখার জন্য আলী (রাঃ)-এর বাড়িতে গেলেন। আলী (রাঃ) তাকে বললেন, আপনি রোগীকে দেখতে এসেছেন নাকি অন্য কোন উদ্দেশ্যে এসেছেন? আবূ মূসা আশ‘আরী (রাঃ) বললেন, আমি আপনার অসুস্থ ছেলে হাসানকে দেখতে এসেছি। তখন আলী (রাঃ) বললেন,مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَعُوْدُ مَرِيْضًا إِلا خَرَجَ مَعَهُ سَبْعُونَ أَلْفَ مَلَكٍ، كُلُّهُمْ يَسْتَغْفِرُ لَهُ، إِنْ كَانَ مُصْبِحًا حَتَّى يُمْسِيَ، وَكَانَ لَهُ خَرِيفٌ فِي الْجَنَّةِ، وَإِنْ كَانَ مُمْسِيًا خَرَجَ مَعَهُ سَبْعُونَ أَلْفَ مَلَكٍ، كُلُّهُمْ يَسْتَغْفِرُ لَهُ حَتَّى يُصْبِحَ، وَكَانَ لَهُ خَرِيفٌ فِي الْجَنَّةِ، ‘কোন মুসলিম ব্যক্তি সকাল বেলা কোন রোগীকে দেখতে গেলে সত্তর হাযার ফেরেশতা তার সাথে রওনা দেয়। প্রত্যেক ফেরেশতাই সন্ধ্যা পর্যন্ত তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে। আর তার জন্য জান্নাতে একটি বাগান তৈরী করা হয়। আর সে যদি সন্ধ্যা বেলা কোন রোগীকে দেখতে বের হয়, তাহ’লে সত্তর হাযার ফেরেশতা তার সাথে রওনা দেয়। প্রত্যেক ফেরেশতাই সকাল পর্যন্ত তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে এবং তার জন্য জান্নাতে একটি বাগান
বরাদ্দ করে রাখা হয়’।[13]
এমনকি কোন মুসলিম যদি এমন দিন মৃত্যুবরণ করে, যেদিন সে কোন রোগীর সেবা করেছে, তাহ’লে আল্লাহ তার জন্য যিম্মাদার হয়ে যান। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,خمْسٌ مَنْ فَعل واحدةً مِنْهُنَّ كَانَ ضَامِناً على الله عزَّ وجلَّ: مَنْ عادَ مَرِيْضاً، أو خَرجَ معَ جَنازَةٍ، أوْ خَرجَ غَازِياً، أوْ دَخَل عَلَى إِمامٍ يُرِيْدُ تَعْزيرَه وتوْقيرَه، أو قعَد في بَيْتِه فسَلِمَ الناسُ مِنْهُ وسَلِمَ مِنَ الناسِ، ‘পাঁচটি কাজ রয়েছে, যে ব্যক্তি সেগুলোর কোন একটি সম্পাদন করবে, মহান আল্লাহ তার জন্য যিম্মাদার হয়ে যাবেন। (১) যে ব্যক্তি রোগীর সেবা করবে। (২) জানাযার ছালাতে অংশগ্রহণ করবে। (৩) জিহাদ থেকে গাযী হয়ে ফিরে আসবে। (৪) ইমাম বা আমীরের নিকটে গমন করবে, এ উদ্দেশ্যে যে, তাকে সাহায্য করবে এবং তাকে সম্মান করবে। (৫) বাড়িতেই অবস্থান করবে, ফলে মানুষ তার থেকে নিরাপত্তা লাভ করে এবং সেও মানুষের অনিষ্ট থেকে নিরাপদ থাকবে’।[14]
অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ عَادَ مَرِيضًا أَوْ زَارَ أَخًا لَهُ فِي اللهِ نَادَاهُ مُنَادٍ أَنْ طِبْتَ وَطَابَ مَمْشَاكَ وَتَبَوَّأْتَ مِنَ الجَنَّةِ مَنْزِلًا، ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য কোন রোগীকে দেখতে যায় অথবা নিজের ভাইয়ের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করতে যায়, একজন ঘোষক (ফেরেশতা) তাকে ডেকে বলতে থাকেন, তোমার জীবন কল্যাণময় হয়েছে এবং পথচলাও কল্যাণময় হয়েছে। তুমি তো জান্নাতের মধ্যে একটি বাসস্থান বানিয়ে নিলে’।[15]
সে রোগীর কাছে যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ জান্নাতের ফল আহরণ করতে থাকে। আর তাদের পঠিত দো‘আর শেষে ফেরেশতা মন্ডলী ‘আমীন’ বলতে থাকেন। এজন্য আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) রোগীকে দেখতে যেতেন, তার শিয়রে বসে দো‘আ করতেন এবং তাঁর উম্মতকে এ ব্যাপারে উৎসাহিত করেছেন।
পরবর্তী অংশ: আকাশের দরজাগুলো কখন ও কেন খোলা হয়? (৩)
– আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
[1]. তিরমিযী হা/৪৭৮; তাবারানী, আল-মু‘জামুল আওসাত হা/৪৪১২।
[2]. আবূদাঊদ হা/১২৬৯; তিরমিযী হা/৪২৮; নাসাঈ হা/১৮১৬।
[3]. ইবনু মাজাহ হা/৮০১; আল-মু‘জামুল কাবীর হা/১৪৫২৩।
[4]. মুসলিম হা/২৫১; তিরমিযী হা/৫১।
[5]. মুসলিম হা/২৬৯৯; আবূ দাঊদ হা/১৪৫৫।
[6]. বুখারী হা/৫০১৮।
[7]. আবূদাঊদ হা/৪৮৯৬; শু‘আবুল ঈমান হা/৬২৪২; ছহীহাহ হা/২৩৭৬।
[8]. মুসনাদে আহমাদ হা/৯৬২২; মিশকাত হা/৫১০২; ছহীহাহ হা/২২৩১।
[9]. মুসনাদে আহমাদ হা/১৭৪৮৮; ছহীহাহ হা/৯৮১।
[10]. বুখারী হা/৬৪০৮।
[11]. বুখারী হা/৪২০৫।
[12]. মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ হা/১০৮৪১।
[13]. মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ হা/১০৮৪১।
[14]. আহমাদ হা/২২১৪৬; ছহীহাহ হা/৩৩৮৪।
[15]. মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ হা/১০৮৪১।