রামাযান ও ছিয়ামসচেতনতা

ইফতার পার্টি!

*রোজার মাসে বন্ধুরা একবার এর জন্যও কি এক সাথে হবো না? সবাই মিলে এক বার ইফতার না করলে কি হয়!

*আত্মীয়দের তো একবার হলেও ইফতারিতে ডাকতে হয়, না হলে কি চলে?এভাবে সব আত্মীয়দের বাসায় এই ছুতোয় এক দিন করে ইফতার পার্টি হবে।

*অফিসের কলিগদের সাথে ইফতারি অন্তত একবার করাটা তো মাস্ট!

*আশে পাশের বাসার ভাবীরা সবাই মিলে একদিন রান্না করে এক যায়গায় একত্রিত হয়েও ইফতার করতে হয়!!

এভাবে সবার কথা রাখতে রাখতে ও সামাজিকতা রক্ষা করতে করতে চলে যায়, কম পক্ষে হলেও রামাদানের দশ বারটি স্বর্ণালী দিন। তার উপর যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে সেহেরির স্পেশাল বুফে অফার, পিজা হাটের আনলিমিটেড প্যান পিজার অফার, এর সাথে হ্যাং আউট, তার হ্যাং আউট… এই করতে করতে রোজার মাসও যে কোন দিক দিয়ে ক্যালেন্ডার থেকে আউট হয়ে যায়, তা বোঝাও যায় না। হঠাত করে দেখা যায় বিটিভিতে “রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ” বাজানো হচ্ছে।

ইফতার পার্টির পক্ষে বহুল প্রচলিত খোঁড়া যুক্তিটি হল, এক জন রোজাদারদেরকে ইফতার করালে, একটি পূর্ণ রোজার সওয়াব পাওয়া যায়। এই কথাটি সত্য হলেও আমরা আইনের ফাঁক ফোকর যেভাবে বের করি, সেভাবে এই সুন্দর কথাটিরও ফাঁক ফোকর বের করে ফেলেছি।

যেকোন ভাল কাজ করার আগে আমাদের ভাবতে হবে, একটি ভাল কাজ করতে গিয়ে কি আমরা আল্লাহ্‌র অপছন্দনীয় একাধিক খারাপ কাজ করে ফেলছি না তো? ভাল ও মন্দের এই দাঁড়িপাল্লায় আমার কাজগুলো রাখা হলে, পাল্লা মন্দের দিকে ভারী হয়ে যাবে না তো?

আমাদের দেশের টিপিকাল ইফতার পার্টিতে যা হয়ঃ

*সারা দিন ধরে ইফতারির আয়োজন করতে করতে গিন্নি ও কাজের মানুষদের দফা রফা হয়।

*অঢেল খাবারের ছড়াছড়ি, খাদ্যের অপচয়, গসিপ করা।

*ঈদে কে কি কিনেছে ও কিনবে সেগুলোর প্রতিযোগীতা করা।

*ইফতার পার্টিতে কার বাসায় কয় পদ বেশি রান্না হল তা নিয়ে তূলনামূলক আলোচনা ও সমালোচনা।

*হাজারো পদের ইফতার আইটেম রান্না করে শো অফ করা ক্ষেত্র প্রস্তুত করা।
*নারী পুরুষের অবাধ মেলা মেশা ও আড্ডাবাজী।

*অনেক রেস্টুরেন্টে ইফতারের আয়োজন থাকলেও, থাকে না নামাজের ব্যবস্থা!

*একগাদা খাবার খেয়ে বাসায় ফেরা ও হাঁসফাঁস করতে করতে তারাবীর নামাজ পড়া, কিংবা বেশি অস্থির লাগলে তারাবী বাদ দেয়া।

*ঘটনা আরো গুরুতর হয় যখন ইফতার পার্টির এক ধাক্কায় এমনই চিতপটাং হয়ে যাওয়া যে আগামী দিনের সেহেরীতে ওঠাটাও মিস হয়ে যাওয়া!!

উপরের কথাগুলো এখন শুনতে অবাস্তব লাগলেও আগের রামাদানসমূহ মনে করে দেখুন, এসবই কিন্তু ঘটে আমাদের অধিকাংশের জীবনে। তাছাড়া এমন অনেক দাওয়াত থাকে যেসবে না যাওয়াটা বা এড়িয়ে যাওয়াটা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
এই মাসে খাদ্যের প্রতি সবার অত্যাধিক আকাঙ্খা দেখলে অমুসলিমরা মনে করবে, রামাদান রোজার মাস নয় বরং food festival এর মাস!!

সারা দিন না খেয়ে আমরা ইফতারিতে গোগ্রাসে যে বিপুল পরিমান খাবার গলধঃকরণ করি তা আমাদের জন্য কতটা ক্ষতিকর হতে পারে্, আমরা চিন্তাও করি না। আমাদের ইফতারির টেবিলের আইটেম এর সঙ্খ্যা ও সবার খাওয়ার পরিমান দেখলে মনে হয় বিগত এক বছর আমরা খেতে পাই নি এবং আজকের পর আগামী এক বছরও আমরা খেতে পারব না।

রোজার দিনে সুন্নত মোতাবেক যদি আমরা অল্প আইটেম দিয়ে/বিলাস বাহুল্যতা ত্যাগ করে মানুষকে দাওয়াত দিতে পারি তবে ভিন্ন কথা। কিন্তু আমাদের সমাজটা এতটাই কলুষিত হয়ে গেছে যে, এ ধরণের চিত্র আজকাল খুব কমই দেখা যায়।

কয়েক বছর আগে আমরা একটি রামাদান দেশের বাইরে কাটিয়েছিলাম। সেখানে একদিন আমি আমাদের বাঙ্গালীদের ইফতারিতে ডেকেছিলাম। ইফতার তৈরিতে আর মেহমানদের সাথে দুনিয়াবি গল্পগুজবে কেটে গিয়েছিল সেই দিনের রোজাটা!

আর ঠিক তার পর দিন বিদেশী কিছু মুসলিমদের দাওয়াত দিয়েছিলাম। আমার এখনো মনে আছে, তারা আমার বাসায় এসে মাত্র কুরআনের একটি ক্যাসেট ছেড়ে দিল, নামাজের সময় সবাই মিলে জামাতে নামাজ পড়ল, ইফতারের পর অনেকক্ষণ ধর্মীয় আলাপ আলোচনা করে বিদায় নিল!! আলহামদুলিল্লাহ্‌ আমি সেদিন জীবনে প্রথম দেখলাম আদর্শ ইফতার পার্টি কাকে বলে!

আমার এই বিদেশী অতিথিদের শেখানো ইফতার মাহফিল এর মত করে যদি আমরা মানুষকে ঘরে এনে খাওয়াতে পারি তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু আড্ডাবাজী আর অত্যাধিক রান্না বান্নায় সময় নষ্ট হওয়ার আর গৃহিণী ও গৃহ ভৃত্যদের উপর কাজের চাপ দিয়ে তাদের ইবাদতের সময় নষ্ট করার সম্ভাবনা থাকলে, আমার মনে হয় সেক্ষেত্রে ইফতার এর দাওয়াত এড়ানোই ভাল।

ইফতার পার্টি সংক্রান্ত বিড়ম্বনা এড়াবার জন্য আমরা নিম্নোক্ত কাজগুলো করতে পারিঃ

*রোজাদারদের ইফতার করিয়ে সওয়াব অর্জনের ইচ্ছা থাকলে এতিম খানায় ইফতারের জন্য টাকা দেয়া যায়। এতে সওয়াব হবে, রিয়া (শো অফ) হবে না, শারীরিক পরিশ্রমের জন্য ইবাদাত নষ্ট হবে না ও গরীব বাচ্চাদের দোয়া পাওয়া যাবে।

*বাসার বুয়াদের অথবা পরিচিত দরিদ্র পরিবারকে রোজার সময় বেশি করে শুকনো খাবার কিনে দিলে, তারা সারা মাস সেখান থেকে ইফতার করতে পারবে। এবং আপনি পুরো রামাদান জুড়ে সিয়ামকারীকে ইফতার খাওয়ানোর সওয়াব পাবেন।

ছোলা, মুড়ি, চিনি, তেল, ডাল, দুধ, সেমাই, চিড়া, গুড় ইত্যাদি এক সাথে করে ব্যাগ বানিয়ে গরিবদের দেয়া যেতে পারে অথবা প্রত্যেককে কয়েক কেজি করে চাল দেয়া যায়।

*রোজার এক দিন আগে বেশি করে রান্না করে, রোজার প্রথম দিন আত্মীয়দের বাড়িতে পাঠানো যায়, এতে পরিশ্রম কম হবে।

*বাসায় যদি ইফতার পার্টি দিতেই হয় তাহলে সেই অনুষ্ঠানকে ইসলামিক হালাকা/আলোচনা অনুষ্ঠানের দিকে ধাবিত করে, দুনিয়াবি আলাপ বর্জন করা যায়।

*ইফতারের প্যাকেট কিনে অথবা ঘরের বানানো ইফতার বাক্সে বাক্সে নিয়ে রাস্তার অজানা/অচেনা মুসাফির/ভিক্ষুক/পথচারীদের দেয়া যায়। এতে আপনার সৎ কাজটি লোক দেখানোর জন্যও হবে না কিন্তু আমলনামার খাতা ইন শা আল্লাহ্ ভারী হয়ে যাবে।

হায়রে আমরা কখন বুঝব যে রোজার দিনের মূল সাফল্য রকমারি খাবারে টেবিল সাজানোও নয় কিংবা ইফতারির টেবিলে ঝাঁপিয়ে পড়াও নয়। বরং আল্লাহ্‌ যাদের এই মাসের প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগানোর সৌভাগ্য দেবেন, তারাই সত্যিকার অর্থে সফল সিয়াম পালনকারী। যার জীবনে রামাদান এল ও সে কাজে লাগাতে পারল না, অর্থহীন বা কম গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলীতে নিজেকে ব্যস্ত রাখল, তার চেয়ে দুর্ভাগা মুসলিম আর কে হতে পারে।

আল্লাহ্ যেন আমাদের সকলকে রামাদানের গুরত্ব বুঝে সেই অনুযায়ী আমল করার তৌফিক দেন ও প্রডাক্টিভ রামাদান উপহার দেন।

(রৌদ্রময়ী)

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button