মদীনার আনসারদের মধ্যে ইসলামের সূচনা হয়েছিল যেভাবে
জাহিলী যুগে মক্কার সাথে আনসারদের যোগাযোগ ছিল হজ্জ, ’উমরাহ, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি উপলক্ষে তাঁরা মক্কায় আসতেন। নিজেদের গৃহযুদ্ধ এবং ইহুদীদের শত্রুতার কারণে তাঁরা মক্কার সমর্থন ও সাহায্য লাভের আশায় সেখানে আসতেন। এ ছাড়া বিভিন্ন কারণে আউস ও খাযরাজ গোত্রের লোকদের মক্কাবাসীদের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। মক্কা ও মদীনার লোকদের মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্ক ও মৈত্রী চুক্তিও ছিল।
বর্ণিত আছে, মদীনাবাসীদের মধ্যে সর্বপ্রথম সুওয়ায়িদ ইবন সামিত রাসূলুল্লাহর সা. নিকট থেকে ইসলামের দা’ওয়াত লাভ করেন এবং তাঁর মুখ থেকে পবিত্র কুরআন শোনার সৌভাগ্য অর্জন করেন। তিনি ছিলেন মদীনার ’আমর ইবন ’আওফ গোত্রের একজন সম্মানিত ব্যক্তি। সেই জাহিলী যুগেই তিনি আরববাসীর নিকট থেকে ‘কামিল’ উপাধি লাভ করেন। মক্কায় গেলে রাসূলুল্লাহর সা. সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। রাসূলুল্লাহর সা. নিকট ইসলামের দাওয়াত শুনে তিনি বলেনঃ ‘আপনার নিকট যা আছে, আমারও নিকট প্রায় একই জিনিস আছে।’ রাসূল সা. প্রশ্ন করলেনঃ আপনার কী আছে? তিনি বললেনঃ ‘সাহীফা-ই-লুকমান’। রাসূল সা. কিছু শোনার ইচ্ছাপ্রকাশ করলে তিনি কিছু শোনালেন। রাসূল সা. সন্তুষ্টি প্রকাশ করে বললেনঃ আমার কাছে এর চেয়ে ভালো জিনিস আছে। আর তা হচ্ছে ‘কুরআন’। তিনি কুরআন শুনে মুগ্ধ হলেন। ফল এই দাঁড়ালো যে, ইবন হিশামের মতে, ‘তিনি ইসলাম থেকে দূরে থাকলেন না।’ তিনি মদীনায় ফিরে গেলে খাযরাজীদের হাতে নিহত হন। ‘আমর ইবন ’আওফ গোত্রের ধারণা, তিনি মুসলমান অবস্থায় মারা গেছেন। এটা বু’য়াস যুদ্ধের পূর্বের ঘটনা। (দ্রঃ সীরাতু ইবন হিশাম- ১/১৬)
এরপর ’আবদুল আশহাল গোত্রের কয়েক ব্যক্তিকে সংগে করে আবুল মাইসার আনাস ইবন রাফে ’আসেন মক্কায়। উদ্দেশ্য, কুরাইশদের সাথে মৈত্রী চুক্তি করা। এই দলে ছিলেন ইয়াস ইবন মু’য়াজ। মক্কায় তাঁদের উপস্থিতির সংবাদ পেয়ে রাসূল সা. তাঁদের সাথে দেখা করে ইসলামের দা’ওয়াত দেন। ইয়াস ছিলেন তরুণ। রাসূলুল্লাহর সা. মুখে কুরআন শুনে তিনি সঙ্গীদের লক্ষ্য করে বলেন, ‘তোমরা যে কাজের জন্য এসেছো এটা তার চেয়ে ভালো। মদীনায় ফিরে তিনি মারা যান। রাসূলুল্লাহর সা. এই স্বল্প সুহবতে তিনি ইসলামকে এতটুকু বুঝেছিলেন যে, জীবনের শেষ মুহুর্তে শুধু তাকবীর উচ্চারণ করেছিলেন এবং মানুষকে আল্লাহর হাম্দ ও সানা শুনিয়েছিলেন। তাঁর গোত্রের লোকদের ধারণা, তিনি মুসলমান ছিলেন। (মুসনাদ- ৫/৪২৭)
মদীনাবাসীদের মধ্যে প্রথম মুসলমান কে, এ বিষয়ে ঐতিহাসিকদের মতভেদ আছে। এ ব্যাপারে যাঁদের নাম বিভিন্ন ঐতিহাসিক উল্লেখ করেছেন, তাঁরা হলেনঃ রাফে ’ইবন মালেক যারকী, মু’য়াজ ইবন ’আফরা’, আস’য়াদ ইবন যুরারাহ্, জাকওয়ান ইবন ’আদী, জাবির ইবন ’আবদিল্লাহ রা. প্রমুখ। (দ্রঃ তাবাকাত- ১/১৪৬; যারকানী- ১/৩৬১)
প্রকৃতপক্ষে মদীনার আনসারদের মধ্যে ইসলামের প্রচার-প্রসারের সূচনা ’আকাবার প্রথম বাই’য়াত থেকে। ’আকাবা বলা হয় পর্বতাংশকে। এখানে ’আকাবা বলতে বুঝায় ’মিনার জমরায়ে ’আকাবার সাথে মিলিক পর্বতাংশকে। এ স্থানে মদীনা থেকে আগত আনসারগণের তিন দফায় বাই’য়াত নেয়া হয়। প্রথম দফায় নেয়া হয় নবুওয়াতের একাদশ বর্ষে। তখন মোট ছয়, মতান্তরে আটজন লোক ইসলাম গ্রহণ করে রাসূলুল্লাহর সা. হাতে বাই’য়াত নিয়ে মদীনায় ফিরে যান। এটা ’আকাবার প্রথম বাই’য়াত। এতে মদীনার ঘরে ঘরে ইসলাম ও নবী কারীমের সা. চর্চা শুরু হয়। পরবর্তী বছর হজ্জের মওসুমে বারো জন লোক সেখানে একত্রিত হন। এঁদের পাঁচজন ছিলেন আগের এবং সাতজন নতুন। তাঁরা সবাই রাসূলুল্লাহর সা. হাতে বাই’য়াত করেন। এটা ’আকাবার দ্বিতীয় বাই’য়াত। তাঁরা রাসূলুল্লাহর কাছে আবেদন জানান যে, তাঁদের কুরআনের তা’লীম দানের উদ্দেশ্যে সেখানে কাউকে পাঠানো হোক। তিনি হযরত মুস’য়াব ইবন ’উমারকে রা. পাঠালেন। তিনি মদীনার মুসলমানদের কুরআন পড়ান ও ইসলামের তাবলীগ করেন। ফলে মদনিায় ইসলামের দ্রুত ও ব্যাপক প্রসার ঘটে।
অতঃপর নবুওয়াতের ত্রয়োদশ বর্ষে সত্তর, মতান্তরে তিহাত্তর জন পুরুষ ও দুই জন মহিলা হজ্জ মওসুমে আবার ’আকাবায়ে রাসূলুল্লাহর সা. সাথে মিলিত হন এবং বাই’য়াত করেন। এ হলো ’আকাবার তৃতীয় বা সর্বশেষ বাই’য়াত। সাধারণতঃ বাই’য়াতে ’আকাবা বলতে একেই বুঝানো হয়্ এ বাই’য়াতটি ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস ও কাজ, কাফিরদের সাথে জিহাদ এবং মহানবী হিজরাত করে মদীনায় গেলে তাঁর হিফাজত ও সাহায্য সহযোগিতার জন্য নেয়া হয়। বাই’য়াতের পর রাসূল সা. তাঁদের মধ্য থেকে বারো জন নাকীব বা প্রতিনিধি নিয়োগ করেন। তাঁরা সবাই ফিরে গিয়ে রাসূলুল্লাহর সা. মদীনায় হিজরাতের পথ ও পরিবেশ তৈরী করেন।
এই তৃতীয় বা সর্বশেষ আকাবায় যে ৭২/৭৫ জন লোক অংশগ্রহণ করেন তাঁদের মধ্যে ১১ জন আউস গোত্রের এবং দু’জন মহিলাসহ মোট ৬৪ জন খাযরাজ গোত্রের (সীরাতু ইবন হিশাম- ১/২৪৯-২৫৫)
আনসারগণ ইসলামের সাহায্য ও সহযোগিতায় কোনরূপ ত্রুটি করেননি। নিজেদের নজীরবিহীন কুরবানী ও সাহায্য দ্বারা ইসলামের মান-মর্যাদা বৃদ্ধি করেন। তাঁদের বীরত্ব ও ত্যাগের কাহিনীতে ইতিহাস পরিপূর্ণ। বদর যুদ্ধে দু’শো তিরিশ জন আনসার শরীক হয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে ১৭০ জন ছিলেন খাযরাজ গোত্রের এবং বাকী আনসার আউস গোত্রের। এ যুদ্ধে ব্যবহৃত সর্বমোট ৭০টি উটের মধ্যে হযরত সা’দ ইবন ’উবাদা আল-খাযরাজী একাই ২০টি উট দান করেছিলেন। এ বদরের যুদ্ধে শাহাদাত বরণকারী চৌদ্দ জনের আটজনই ছিলেন আনসার। উহুদের যুদ্ধে বহু সংখ্যক আনসার অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং সত্তর জন (৭০) শহীদের মধ্রে ছেষট্টিজনই (৬৬) ছিলেন আনসার। কারো কারো শরীরে ৭০ টি আঘাত লেগেছিল। বি’রে মা’উনার শহীদদের মধ্যেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছিলেন আনসার। (ইসলামী বিশ্বকোষ- ১ম খণ্ড, আনসার)
ইসলামের জন্য আনসারদের ত্যাগ তিতিক্ষার বিবরণ অল্প কথায় দেওয়া সম্ভব নয়। তাঁরা তাঁদের জান-মালসহ সবকিছু ইসলামের জন্য উৎসর্গ করেন। মদীনা আগত মুহাজিরদের জন্য তাঁরা নিজেদের অর্থ সম্পদ ও বাড়ী-ঘর ভাগ করে দেন। তাঁরা যে সততা ও উদারতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, মানব ইতিহাসে তা খুঁজে পাওয়া কষ্টকর। এ কারণে তাদের প্রতি রাসূলের সা. গভীর মুহাব্বত ছিল। তিনি তাদের অবদান, ত্যাগ ও কুরবানী যথার্থ মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখতেন। তিনি কথা ও কাজের দ্বারা তাঁদের এ অবদানের স্বীকৃতি দিয়েছেন। আনসারদের প্রতি ভালোবাসাকে তিনি ঈমানের অংশ বলে ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেছেন, আল্লাহ ও পরকালের ওপর বিশ্বাসী কোন ব্যক্তিই আনসারদের প্রতি বৈরিতা পোষণ করতে পারেনা। আনসারদের প্রতি বিদ্বেষকে তিনি মুনাফিকের স্বভাব-প্রকৃতি বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি আনসার ও তাঁদের সন্তান-সন্তুতির ওপর আল্লাহর রহমত বর্ষণের জন্য দু’আ করেছেন। তাঁদের প্রতি সন্তুষ্টি থেকে তিনি দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন।
পবিত্র কুরআনের একাধিক স্থানে আনসার শব্দটি এসেছে। তার মধ্যে সূরা তাওবার ১০০ ও ১১৭ নং আয়াতের একাংশ মদীনার আনসার মুসলমানদের প্রতি সরাসরি প্রযুক্ত হয়েছে। আল্লাহ বলেনঃ
১. ‘আর যারা সর্বপ্রথম হিজরাতকারী ও আনসারদের মাঝে পুরাতন, এবং যারা তাদের অনুসরণ করেছে, আল্লাহ সে সমস্ত লোকদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। আর তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন জান্নাত, যার তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত নদীসমূহ। সেখানে তারা থাকবে চিরকাল। এটাই হলো মহান কৃতকার্যতা।’ (আত-তাওবা-১০০)
২. ‘আল্লাহ দয়াশীল নবীর প্রতি এবং মুহাজির ও আনসারদের প্রতি, যারা কঠিন মুহূর্তে নবীর সংগে ছিল, যখন তাদের এক দলের অন্তর ফিরে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। অতঃপর তিনি দয়াপরবশ হন তাদের প্রতি, নিঃসন্দেহে তিনি তাদের প্রতি দয়াশীল ও করুণাময়।’ (আত-তাওবা-১১৭)
এছাড়া কুরআনের আরো বহু আয়াতে, কোথাও প্রত্যক্ষ আবার কোথাও পরোক্ষভাবে আনসারদের সাহসের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। যেমন সূরা আল-হাশর-এর ৯ নং আয়াতে বলা হয়েছেঃ ‘যারা মুহাজিরদের আগমণের পূর্বে মদীনায় বসবাস করেছিল এবং বিশ্বাস স্থাপন করেছিল, তারা মুহাজিরদের ভালোবাসে, মুহাজিরদেরকে যা দেওয়া হয়েছে, তজ্জন্যে তারা অন্তরে ঈর্ষা পোষণ করেনা এবং নিজেরা অভাবগ্রস্থ হলেও তাদেরকে অগ্রাধিকার দান করে। যারা কার্পণ্য থেকে মুক্ত, তারাই সফলকাম।’