ইতিহাস

বার্মায় আলেম নির্যাতন

আরাকানে সবচেয়ে বেশী নির্যাতনের শিকার হন আলেম সমাজ। বর্মী সেনা ও কর্তৃপক্ষের এক নম্বর টার্গেট হ’লেন এ আলেম সমাজ। তারা আরাকানকে মুসলিম শূন্য করার নীল-নকশা বাস্তবায়নের পথে এক নম্বর বাধা মনে করে আলেম সমাজকে। তাই আলেম সমাজের ওপর চালানো হয় পৈশাচিক নির্যাতন। বহুল আলোচিত একটি ঘটনার মাধ্যমে এ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে।

ঘটনাটি ১৯৯৫ সালের এবং এর শিকার হন আরাকানের একজন শীর্ষস্থানীয় আলেম ব্যক্তি মাওলানা জিয়াউল হাকীম। তিনি নির্যাতিত হয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন এবং সাংবাদিকদের নিকট তার নির্যাতনের কাহিনী বৰ্ণনা করেন। ১৯৯৬ সালের জানুয়ারী মাসে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক পত্র-পত্রিকায় সে ঘটনা প্ৰকাশিত হয়েছিল। এ প্ৰতিবেদনের লেখক উক্ত মাওলানা জিয়াউল হাকীমের একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিলেন। সাক্ষাৎকারে তার করুণ কাহিনী যেভাবে বর্ণনা করেন তা এখানে হুবহু তুলে ধরা হলো।

গত ২০ ডিসেম্বর ১৯৯৫ তারিখে কুমিরখালী এলাকায় আমরা বেশ কিছু লোক সেনা ক্যাম্প থেকে একটি হুকুমনামা পাই। তাতে লেখা ছিল, প্রত্যেক গ্রাম থেকে ১০ জন যুবতী যারা অবিবাহিত তাদের পিতা যেন মেয়েদের নিয়ে অবিলম্বের কুমিরখালী ক্যাম্পে হাযির হয়। হুকুমনামার সাথে প্রত্যেক গ্রামের ১০ জন মেয়ের একটি লিস্টও প্রেরণ করা হয়- যা ছিল প্ৰথম শ্রেণীর আলেম ব্যক্তিদের মেয়েদের তালিকা। শেষে লেখা ছিল, এসব মেয়েদের নিয়ে কারিগরি প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। ছ’মাস মেয়াদী এ প্রশিক্ষণ কোর্সের সময় মেয়েদের ক্যাম্পের বাইরে আসতে দেয়া হবে না বা তাদের আত্মীয়-স্বজনের সাথে দেখা করতে দেয়া হবে না। অবশেষে হুমকি দেয়া হয়, যদি কোন পিতা তার মেয়েকে নিয়ে উপস্থিত হ’তে না চায়। তবে তাকে কঠোর শাস্তি দেয়া হবে।

এ ছিল আরাকানের আলেমগণকে মানসিকভাবে নির্যাতন ও তাদের ধর্মীয় চেতনার ওপর আঘাত হানার ভয়ঙ্কর এক পূর্বপরিকল্পিত নীল-নকশা। এর পূর্বে প্রায়ই গ্রাম থেকে সেনারা মেয়েদের জোর করে ধরে নিয়ে যেত এবং কারিগরি প্রশিক্ষণের নাম করে তাদের লাইগেশন (চিরস্থায়ী বন্ধ্যাত্ব) করিয়ে ক্যাম্পে আটকে রেখে যৌন নির্যাতন চালাত। তাই মেয়েদের সেনা ক্যাম্পে নিয়ে কারিগরি শিক্ষা দেয়ার নামে কি ঘটে তা সকলেই জানত। এ ঘটনায় এলাকায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। আবার সবাই তটস্থ হয়ে পড়ে এ ভেবে যে, সরকারী বাহিনী যা বলে তা করে ছাড়ে।

২৬ ডিসেম্বর সোমবার ফজরের ছালাতের সময় সেনারা গ্রামে আগমন করে এবং মসজিদে ছালাতরত মুছল্লীদের মাঝে মেয়েদের লিস্ট বিতরণ করে তাদের নিজ নিজ মেয়েদের নিয়ে ক্যাম্পে হাযির হাতে বলে। আমরা ক’জন গ্রামবাসী মেয়েদের না নিয়েই ক্যাম্পে হাযির হই। অফিসার আমাদের একা হাযির হাতে দেখে রাগান্বিত হয় এবং ধমক দিয়ে মেয়েদের না আনার কথা জিজ্ঞেস করে। আমরা উত্তর দেই, শরীয়তে আমাদের মেয়েদের একা একা কোন স্থানে থাকা নিষেধ আছে। পরে আমাদের ঝিমুরখালী ক্যাম্পে প্রেরণ করা হয়। সেখানের অফিসাররাও মেয়েদের সাথে না দেখে রাগান্বিত হয় এবং এর কারণ জিজ্ঞেস করে। আমরা তাকেও একই উত্তর দেই। তখন সে আবার জিজ্ঞেস করে, কোথায় তোমাদের এই আইন লেখা আছে। উত্তর দেই, কুরআন শরীফের ১৮ পারায়।

এর উত্তরে অফিসার ক্ৰোধে ফেটে পড়ে এবং অধীনস্থ সেনাদের নিয়ে আমাদের জামা (জুব্বা) খুলে নেয়। এরপর সেনা ক্যাম্পের পার্শ্ববর্তী নোংরা ও আবর্জনাময় স্থান পরিষ্কার করতে আমাদের বাধ্য করে। আমার সাথে মাওলানা সিরাজুল ইসলাম নামের ১১৫ বছরের একজন অতি বৃদ্ধ আলেম ব্যক্তিও ছিলেন। তিনি বসে বসে তাসবীহ পড়ছিলেন। সেনারা তার তাসবীহ কেড়ে নিয়ে তাকেও আবর্জনা পরিষ্কার করতে বাধ্য করে। যোহরের ছালাতের সময় হলে আমরা অফিসারের কাছে ছালাত আদায় করার সময় চাই। কিন্তু তারা আমাদের সময় দিতে অস্বীকার করে। বেলা দু’টোর দিকে উর্ধ্বতন অফিসার আমাদের ডেকে পাঠায়। সেখানে আলেমদের একলাইনে এবং সাধারণ গ্রামবাসীদের আরেক লাইনে বসানো হয়। এ অফিসারও আমাদের মেয়েদের সাথে না নিয়ে আসার কারণ জিজ্ঞেস করে। আমরা শরীয়তের আইনের কথা বললে সেও ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে এবং বলে, ‘তোমাদের শুধু শরীয়ত নয়, সরকারী আইনও মানতে হবে’।

যদি সরকারী আইন শরীয়তের বিরুদ্ধে না হয় তবে আমরা মানব, আর যদি বিরুদ্ধে হয় তবে আমরা মানব কিভাবে? আমি অফিসারকে এ কথা বললে সে আমাকে প্রশ্ন করে, অন্যান্য মুসলিম দেশের মেয়েরাতো পর্দা মেনে চলে না, তারা একা একা রাস্তায় বের হয়। তারা পারে, তবে তোমাদের মেয়েরা তা পারবে না কেন? আমি বললাম, অফিসার তোমাদের ধর্মে তো চুরি করা, মানুষ খুন করা, যেনা করা মহাপাপ, অথচ তোমাদের সমাজের অনেকেই তা মানছে না। তাই বলে কি তোমাদের মেয়েরা ধর্ম অস্বীকার করে? ধর্মবিরোধী কাজকে পসন্দ করে? এর কোন উত্তর না দিয়ে অফিসার থ মেরে যায়। কিন্তু দাম্ভিক কি শোনে যুক্তির কথা। সে আমাকে গাছের সাথে বেঁধে বেত্ৰাঘাত করার জন্য সেনাদের নির্দেশ দেয়। সেনারা আমাকে গাছের সাথে বেঁধে বেত্ৰাঘাত করে আর বলে, তোমার আল্লাহ তোমায় মারছে।

আমি মুখ বুজে আঘাত সহ্য করতে থাকি আর যিকির করতে থাকি। একসময় আমি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লে আমাকে একটি রুমের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয়। সংজ্ঞা ফিরে এলে সেখানে এক বীভৎস দৃশ্য দেখতে পাই; যা আমি জীবনে কল্পনাও করিনি। আমার সমস্ত শরীর শিউরে ওঠে। আমি দেখতে পাই আমার সামনে সুন্নাতী দাড়ির স্তুপ। আরাকানের শীর্ষস্থানীয় আলেমদের দাড়ি কেটে স্তুপ করে রেখেছে নরপশুরা। এসব আলেমদের মধ্যে তাবলীগ জামাআতের আমীর মাওলানা নবী হোসেন, বার্মার মুফতীয়ে আযম মাওলানা সুলতান আহমাদ ও মাওলানা জাফর আলী অন্যতম। আমাকে দেখে তারা লজায় মাথা নিচু করে রাখেন। তাদের একটাই অপরাধ সেনাদের মর্জি মাফিক তাঁরা তাঁদের মেয়েদের নিয়ে ক্যাম্পে হাযির হ’তে অস্বীকার করেছিলেন।

পরে আমার পালা এলো। হায়ানার দল জোর করে আমার সযত্নে লালিত রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাত দাড়ি কেটে ফেলল। সুন্নাতের এ অপমান দেখে আমার মাথায় আগুন ধরে যায়। কিন্তু হায়! আমি যে অসহায়। পরে উপস্থিত ১০টি গ্রামের নির্দিষ্ট করা ১০০ মেয়ের পিতাকে আমাদের অবস্থা দেখিয়ে সাবধান করা হয়। তাদের হুমকি দেয়া হয়, কেউ যদি সরকারী আইন মানতে অস্বীকার করে তবে তার অবস্থা এর চেয়েও ভয়ঙ্কর হবে। আমাদের পরদিন সকাল ১০টার মধ্যে মেয়েদের নিয়ে হাযির হাতে নির্দেশ দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। আমি বাংলাদেশে চলে আসি।

এই ঘটনা আরাকানে হাযারো নির্যাতনের মধ্যে ক্ষুদ্রতর একটি মাত্র। প্রতিদিন আলেম সমাজকে টার্গেট করে এ ধরনের অসংখ্য লোমহর্ষক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেই চলেছে।

[উৎস: দৈনিক ইনকিলাব ২ জুলাই ১৯৯৮; সৌজন্যে: waytojannah.com]

– মুহাম্মাদ ফারুক হোসেন

বি.দ্র: প্রায় আঠার বছর আগের এই প্রতিবেদন থেকেই বুঝা যায়, এরকম পাশবিক নির্যাতন শুরু হয়েছে অনেক আগে থেকেই। জানি না, এখনকার নির্যাতনের হার আরো কতগুণ লম্বা হয়েছে। এই মুসলিমদের জন্য আমাদের কি কিছুই করার নেই ? আমরা একটি বিভিন্ন জাতিগত পরিচয়ের চেয়ে একটি উম্মাহ হতে পারি না ? যা একটি গাছের মতো যে কোন পাতা ছিড়লেই তার আঘাত সারা অংগে লেগে যাবে…

মন্তব্য করুন

Back to top button