ছালাতের নিয়ম

ছালাতুল ইস্তিস্ক্বা

ইস্তিস্ক্বা অর্থ : পান করার জন্য পানি প্রার্থনা করা। শারঈ পরিভাষায় ব্যাপক খরা ও অনাবৃষ্টির সময় বিশেষ পদ্ধতিতে ছালাতের মাধ্যমে আল্লাহর নিকটে পানি প্রার্থনা করাকে ‘ছালাতুল ইস্তিস্ক্বা’ বলা হয়। ৬ষ্ঠ হিজরীর রামাযান মাসে সর্বপ্রথম মদীনায় ইস্তিসক্বার ছালাতের প্রবর্তন হয়।[1]

বিবরণ : মলিন ও পরিচ্ছন্ন পোষাক পরে চাদর গায়ে দিয়ে বিনয়-নম্র চিত্তে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে ময়দান অভিমুখে রওয়ানা হবে। সাথে ইমামের জন্য মিম্বর নিতে পারবে। অতঃপর নিম্নের যে কোন একটি পদ্ধতি অবলম্বনে ইস্তিসক্বার ছালাত আদায় করবে।

পদ্ধতি-১ : ঈদের ছালাতের ন্যায় আযান ও ইক্বামত ছাড়াই প্রথমে জামা‘আত সহ দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করবে।[2] ইমাম সরবে ক্বিরাআত করবেন। প্রথম রাক‘আতে সূরা আ‘লা ও দ্বিতীয় রাক‘আতে সূরা গাশিয়াহ কিংবা অন্য যে কোন সূরা পড়বেন। অতঃপর ছালাত শেষে ইমাম মিম্বরে বসে বা দাঁড়িয়ে অথবা মিম্বর ছাড়াই মাটিতে দাঁড়িয়ে প্রথমে আল্লা-হু আকবর, আলহামদু লিল্লা-হি রবিবল ‘আলামীন ওয়াছ ছালাতু ওয়াসসালামু ‘আলা রাসূলিহিল কারীম’ বলে আল্লাহর প্রশংসা ও রাসূল (ছাঃ)-এর উপর দরূদ পাঠ শেষে মুছল্লীদের প্রতি ইস্তিস্ক্বার গুরুত্ব সম্পর্কে ঈমান বর্ধক উপদেশসহ সংক্ষিপ্ত খুৎবা দিবেন। [3] অতঃপর ইমাম ও মুক্তাদী সকলে ক্বিবলামুখী দাঁড়িয়ে স্ব স্ব চাদর উল্টাবে। অর্থাৎ চাদরের নীচের অংশ উপরের দিকে উল্টে নিবেন এবং চাদরের ডান পাশ বাম কাঁধে ও বাম পাশ ডান কাঁধে রাখবে। অতঃপর দু’হাত উপুড় অবস্থায় সোজাভাবে চেহারা বরাবর উঁচু রাখবে, যেন বগল খুলে যায়। [4]

অতঃপর নিম্নের দো‘আ সমূহ পাঠ করবেন-

(1) اَلْحَمْدُ ِللهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ، الرَّحْمنِ الرَّحِيْمِ، مَالِكِ يَوْمِ الدِّيْنِ، لآ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ يَفْعَلُ مَا يُرِيْدُ- اَللَّهُمَّ أَنْتَ اللهُ لآ إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ، أَنْتَ الْغَنِيُّ وَنَحْنُ الْفُقَرَاءُ، أَنْزِلْ عَلَيْنَا الْغَيْثَ وَاجْعَلْ مَا أَنْزَلْتَ عَلَيْنَا قُوَّةً وَّ بَلاَغًا إِلَى حِيْنٍ-

(১) উচ্চারণ : আলহামদুলিল্লা-হি রবিবল ‘আ-লামীন, আররহমা-নির রহীম, মা-লিকি ইয়াওমিদ্দীন। লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ইয়াফ‘আলু মা ইউরীদু। আল্লা-হুম্মা আনতাল্লা-হু লা ইলা-হা ইল্লা আনতা। আনতাল গানিইয়ু ওয়া নাহ্নুল ফুক্বারা-উ। আনঝিল ‘আলায়নাল গায়ছা ওয়াজ‘আল মা আনঝালতা ‘আলায়না কুউওয়াতাঁও ওয়া বালা-গান ইলা হীন।

অনুবাদ: সকল প্রশংসা বিশ্বপালক আল্লাহর জন্য। যিনি করুণাময় ও কৃপানিধান। যিনি বিচার দিবসের মালিক। আল্লাহ ব্যতীত কোন মা‘বূদ নেই। তিনি যা ইচ্ছা তাই-ই করেন। হে প্রভু! আপনি আল্লাহ। আপনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। আপনি মুখাপেক্ষীহীন ও আমরা সবাই মুখাপেক্ষী। আমাদের উপরে আপনি বৃষ্টি বর্ষণ করুন! যে বৃষ্টি বর্ষণ করবেন, তা যেন আমাদের জন্য শক্তির কারণ হয় এবং দীর্ঘ মেয়াদী কল্যাণ লাভে সহায়ক হয়’।[5]

(2) اَللَّهُمَّ اسْقِ عِبَادَكَ وَبَهَائِمَكَ وَانْشُرْ رَحْمَتَكَ وَاحْيِ بَلَدَكَ الْمَيِّتَ-

(২) উচ্চারণ : আল্লা-হুম্মাস্ক্বে ‘ইবা-দাকা ওয়া বাহা-এমাকা ওয়ানশুর রহমাতাকা ওয়াহ্ইয়ে বালাদাকাল মাইয়েতা।

অর্থ: হে আল্লাহ! আপনি পান করান আপনার বান্দাদেরকে ও জীবজন্তু সমূহকে এবং আপনার রহমত ছড়িয়ে দিন ও আপনার মৃত জনপদকে পুনর্জীবিত করুন’। [6]

(3) اَللَّهُمَّ اسْقِنَا غَيْثًا مُّغِيْثًا مَّرِيْئًا مَّرِيْعًا، نَافِعًا غَيْرَ ضَارٍّ عَاجِلاً غَيْرَ آجِلٍ-

(৩) উচ্চারণ : আল্লা-হুম্মাসক্বেনা গায়ছাম মুগীছাম মারীআম মারী‘আ, না-ফে‘আন গায়রা যা-র্রিন ‘আ-জেলান গায়রা আ-জেলিন।

অর্থ : হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে এমন বৃষ্টি দান করুন, যা চাহিদা পূরণকারী, পিপাসা নিবারণকারী ও শস্য উৎপাদনকারী। যা ক্ষতিকর নয় বরং উপকারী এবং যা দেরীতে নয় বরং দ্রুত আগমনকারী’।[7]

এই সময় বৃষ্টি দেখলে বলবে, اَللَّهُمَّ صَيِّبًا نَافِعًا আল্লা-হুম্মা ছাইয়েবান না-ফে‘আন (হে আল্লাহ! উপকারী বৃষ্টি বর্ষণ করুন)।[8] বৃষ্টিতে চাদর ভিজিয়ে আল্লাহর বিশেষ রহমত মনে করে আগ্রহের সাথে তা বরণ করে নিতে হবে। [9]

পদ্ধতি-২ : প্রথমে সংক্ষিপ্ত খুৎবা দিবেন। অতঃপর দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করবেন।[10] অতঃপর দাঁড়িয়ে পূর্বে বর্ণিত নিয়ম অনুযায়ী দো‘আ করতে থাকবেন।

তাৎপর্য : চাদর উল্টানোর মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে যেন খরা উল্টে গিয়ে বৃষ্টিপাত হয়।[11] এছাড়াও রয়েছে রাজাধিরাজ আল্লাহর সামনে বান্দার পরিবর্তিত অসহায় অবস্থার ইঙ্গিত। দাঁড়িয়ে দু’হাত উপুড় ও সোজাভাবে ধরে রাখার মধ্যে রয়েছে পালনকর্তা আল্লাহর প্রতি চূড়ান্ত আত্মসমর্পণ ও একান্তভাবে আত্মনিবেদনের ইঙ্গিত। ময়দানে বেরিয়ে একত্রিত হয়ে বৃষ্টি প্রার্থনার মধ্যে রয়েছে একই বিষয়ে হাযারো বান্দার ঐকান্তিক প্রার্থনার গুরুত্ববহ ইঙ্গিত।

ছালাত ব্যতীত অন্যভাবে বৃষ্টি প্রার্থনা :

(ক) জুম‘আর খুৎবা দানের সময় খত্বীব দু’হাত উঠিয়ে আল্লাহর নিকটে বৃষ্টি প্রার্থনা করবেন। একই সাথে মুছল্লীগণ হাত উঠিয়ে দো‘আ করবেন (অথবা ‘আমীন’ ‘আমীন’ বলবেন)। এ সময়ের সংক্ষিপ্ত দো‘আ হ’ল اَللَّهُمَّ اَغِثْنَا আল্লা-হুম্মা আগিছনা (হে আল্লাহ! আমাদের উপর বৃষ্টি বর্ষণ করুন) কমপক্ষে ৩ বার।[12] অথবা اَللَّهُمَّ اسْقِنَا আল্লা-হুম্মাস্ক্বেনা (হে আল্লাহ! আমাদেরকে পানি পান করান) কমপক্ষে ৩ বার। [13]

(খ) জুম‘আ ও ইস্তিসক্বার ছালাত ছাড়াই স্রেফ দো‘আর মাধ্যমে বৃষ্টি প্রার্থনা করা। এ সময় দু’হাত তুলে বর্ণিত ৩নং দো‘আটি ও অন্যান্য দো‘আ সমূহ পাঠ করবে। [14]

অন্যান্য জ্ঞাতব্য :

(ক) জীবিত কোন মুত্তাক্বী পরহেযগার ব্যক্তির মাধ্যমে আল্লাহর নিকটে বৃষ্টি প্রার্থনা করা যাবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পরে তাঁর চাচা আববাস (রাঃ)-এর মাধ্যমে ওমর (রাঃ) বৃষ্টি প্রার্থনা করতেন।[15] কিন্তু কোন মৃত ব্যক্তির দোহাই বা অসীলা দিয়ে বৃষ্টি প্রার্থনা করা যাবেনা। কারণ এটি হ’ল সবচেয়ে বড় শিরক। (খ) ইস্তিস্ক্বার খুৎবা সাধারণ খুৎবার মত নয়। এটির সবটুকুই কেবল আকুতিভরা দো‘আ আর তাকবীর মাত্র। [16] (গ) অতিবৃষ্টি হ’লে বলবে, اَللَّهُمَّ صَيِّبًا نَافِعًا আল্লা-হুম্মা ছাইয়েবান না-ফে‘আন (হে আল্লাহ! উপকারী বৃষ্টি বর্ষণ করুন)। [17] আর তাতে ব্যাপক ক্ষতির আশংকা দেখা দিলে তা ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য আল্লাহর নিকট দো‘আ করে বলবে, اَللَّهُمَّ حَوَالَيْنَا وَلاَ عَلَيْنَاআল্লা-হুম্মা হাওয়া-লায়না অলা ‘আলায়না (হে আল্লাহ! আমাদের থেকে ফিরিয়ে নাও। আমাদের উপর দিয়ো না)। [18]


[1] . মির‘আত ৫/১৭০।

[2] . আবুদাঊদ হা/১১৬১, ৬৫; মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১৪৯৭; মির‘আত ৫/১৭৯।

[3] . আবুদাঊদ হা/১১৬৫, ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে; বুখারী হা/১০২২ ‘দাঁড়িয়ে ইস্তিস্কার দো‘আ পাঠ’ অনুচ্ছেদ-১৫; মির‘আত ৫/১৮৯।

[4] . আবুদাঊদ হা/১১৬৪, ৬৮; ঐ, মিশকাত হা/১৫০৪; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৬১; মির‘আত ৫/১৭৬।

[5] . আবুদাঊদ, মিশকাত হা/১৫০৮, ‘ছালাত’ অধ্যায়-৪, ‘ইস্তিস্কা’ অনুচ্ছেদ-৫২।।

[6] . মুওয়াত্ত্বা, আবুদাঊদ, মিশকাত হা/১৫০৬ ‘ছালাত’ অধ্যায়-৪, ‘ইস্তিস্ক্বা’ অনুচ্ছেদ-৫২।

[7] . আবুদাঊদ, মিশকাত হা/১৫০৭।

[8] . বুখারী হা/১০৩২, মিশকাত হা/১৫০০।

[9] . মুসলিম, মিশকাত হা/১৫০১।

[10] . আবুদাঊদ হা/১১৬৫, ৭৩; মিশকাত হা/১৫০৮; মির‘আত ৫/১৭৮।

[11] . হাকেম, বায়হাক্বী, মির‘আত ৫/১৭৬।

[12] . বুখারী হা/১০১৪, ১০২৯ ‘ইস্তিসক্বা’ অধ্যায়-১৫, অনুচ্ছেদ-৭, ২১।

[13] . বুখারী হা/১০১৩, অনুচ্ছেদ-৬।

[14] . ইবনু মাজাহ হা/১২৬৯।

[15] . বুখারী হা/১০১০, মিশকাত হা/১৫০৯।

[16] . আবুদাঊদ হা/১১৬৫।

[17] . বুখারী হা/১০৩২, মিশকাত হা/১৫০০।

[18] . বুখারী হা/৯৩৩, ১০২১; আবুদাঊদ হা/১১৭৪; মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৫৯০২, অধ্যায়-২৯, অনুচ্ছেদ-৭ ।

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

আরও দেখুন
Close
Back to top button