বিভিন্ন ধর্ম ও মতবাদ

ISIS-DAESH : একটি বিপর্যয় ও দুর্দশা

এটি মূলত ৪০ পৃষ্ঠার একটি পূর্ণাঙ্গ বই। এখানে শুধু শুরুর দিকের ১০ পৃষ্ঠার অনুবাদ দেয়া হলো।
 

কিছু প্রয়োজনীয় বিষয় স্পষ্টকরণঃ প্রবন্ধটি সংকলিত হয়েছে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক উলামায়ে কেরাম এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ম্যাগাজিন, সাময়িকী ও খবরের কগজে রিপোর্টকৃত তথ্যাদি থেকে যাতে করে সেই সকল অপরিপক্ক, সংবেদনশীল ও আবেগপ্রবণ যুবসম্প্রদায় সতর্ক ও সাবধান হতে পারে, কারণ তারা অনির্ভরযোগ্য ওয়েবসাইট এবং ভ্রান্ত মতবাদ ও ভাবাদর্শসম্পন্ন লোকদের কাছ থেকে তাদের বিভিন্ন তথ্য নিয়ে থাকে। আর তারা ইসলাম ও রাষ্ট্রের আইন লঙ্ঘন করে বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠন যেমন আল-কায়দা এবং দায়েশ এর মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে থাকে।

ফিতনা সম্পর্কে সতর্কীকরণ এবং তা থেকে দূরত্ব বজায় রাখাঃকিয়ামত যখন অতি নিকটে চলে আসবে যমীনের উপর অনেকগুলো ফিতনা প্রকাশ পাবে[1], সেগুলোর তীব্রতা এবং নিষ্ঠুরতা জ্যোতিহীন ঘন অন্ধকারের অনুরূপ হবে[2], আর সেগুলো এত পুনঃ পুনঃ ঘটবে যে পূর্ববর্তী ফিতনাগুলোকে এগুলোর তুলনায় নগন্য মনে হবে।[3]

তাই এমন দুর্দশাপূর্ণ মুহূর্তে বসে থাকা ব্যক্তি দন্ডায়মান ব্যক্তি অপেক্ষা অধিক ন্যায়পরায়ণ হবে এবং দন্ডায়মান ব্যক্তি হেটে চলা ব্যক্তি অপেক্ষা অধিক ন্যায়পরায়ণ হবে, আর হেটে চলা ব্যক্তি ন্যায়পরায়ণতার দিক দিয়ে দৌড়ানো ব্যক্তিকে অতিক্রম করবে।[4] এর অর্থ হল কোন ব্যক্তি যত বেশি ফিতনা-ফাসাদ থেকে দূরে থাকবে তত বেশি সে ফিতনা কর্তৃক গ্রাসকৃত ব্যক্তির তুলনায় উত্তম হিসেবে প্রমাণিত হবে।

অধিকন্তু, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, সৌভাগ্যবান তারাই যারা এসব বিপর্যয় থেকে মুক্ত থাকতে পারবে[5]। তাছাড়া দ্বীন (ইসলাম) হল সকলের জন্য সুসংবাদের নাম, আর বিভিন্ন ফিতনা থেকে মানুষকে সতর্ক করা তাদের প্রতি কল্যাণকামিতা প্রদর্শনেরই অন্তর্ভুক্ত[6]

বাতিল ফিরক্বা এবং বিপথগামী আন্দোলন থেকে সতর্ক করা আহলুস সুন্নাহর মূলনীতি এবং রাসূল(সাঃ) ও তাঁর সাহাবীগণের প্রায়োগিক বিধানের অন্তর্ভুক্তঃ কিছু সহজ-সরল মানুষের বিশ্বাস, আমরা শুধুমাত্র বাহ্যিকভাবে প্রতীয়মান বিষয়গুলো মানতে বাধ্য এবং যারাই কালেমার সাক্ষ্য দেয় তাদের সকলের প্রতি আমাদের সুধারণা পোষণ করতে হবে কেননা প্রত্যেকের মাঝেই সর্বদা কিছু না কিছু ভাল দিক পাওয়া যাবে। কাজেই আমাদের উচিত হবে না কাউকে তাদের সংসর্গ ও সাহচর্য থেকে সতর্ক করা।

শরীয়াহর মূলনীতি অনুযায়ী নিঃসন্দেহে আমরা কেবল বাহ্যিকভাবে প্রতীয়মান বিষয়গুলোই মানতে বাধ্য এনং প্রকৃতপক্ষে আহলে ইলমগণ বিভিন্ন বাতিল ফিরক্বা ও বিপথগামী আন্দোলন থেকে তাদের বাহ্যিক কর্মকান্ডের উপর নির্ভর করেই তাদেরকে সতর্ক করে থাকেন। এর কারণ বিভিন্ন বিপথগামী মতাদর্শ ও ভ্রান্ত পথ সম্পর্কে সতর্কীকরণ আহলুস সুন্নাহর মূলনীতি এবং রাসূল (সাঃ) এবং তাঁর সাহাবীগণের প্রায়োগিক বিধানেরই অন্তর্ভুক্ত যা আমরা পূর্বেই আলোচনা করেছি।

অধিকন্তু, রাসূল (সাঃ) তাঁর সম্প্রদায়কে সেই সকল লোকজন সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন যারা ক্বুর’আন মাজীদের বিভিন্ন আয়াতের অস্পষ্ট অর্থগ্রহণের উপর অটল থাকে[7], বিশেষভাবে তিনি খারেজীদের সম্পর্কে বলেছেন, তোমরা যেখানেই তাদেরকে পাবে হত্যা করবে, কারণ যে ব্যক্তি তাদেরকে হত্যা করতে পারবে তার জন্য বিচারের দিনে পুরস্কার রয়েছে।[8] আর যদি আমি তাদেরকে পেয়ে যাই তবে ‘আদ জাতির মত তাদেরকে হত্যা করবো।[9]

আবু সাঈদ (রাঃ) বলেন, ‘আমার নিকট মুশরিকদের চেয়ে খারেজীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা অধিকতর প্রিয় ও পছন্দনীয়’।[10]

ইমাম ইবনে হাবীরাহ (রহঃ) বলেন, ‘এর পেছনে হিকমত হল খারেজীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানো বায়তুল মাল কে রক্ষা করাকে আবশ্যিক করে, অপরদিকে মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ফায়দা অর্জনকে আবশ্যিক করে। আর বায়তুল মালকে রক্ষা করা ফায়দা অর্জনের চেয়ে বহুগুণে প্রাধান্য পাবে’। [11]

উম্মুল মু’মিনীন, মহান আল্লাহর প্রিয়জনের প্রিয়জন, আবু বকর সিদ্দীক্ব (রাঃ) এর কন্যা আয়িশা (রাঃ) কে মু’আযাহ ‘আদভিয়াহ হায়েযের কারণে ছুটে যাওয়া সালাতের কাযা আদায় সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলেন। তাই উম্মুল মু’মিনীন তাকে খারেজীদের সম্পর্কে সতর্ক করার উদ্যেশ্যে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি হুরুরী (খারেজী)’? সে উত্তর দিল, ‘না, আমি হুরুরী নই। আমি প্রশ্ন করেছি বিষয়টি সম্পর্কে জানার জন্যই’।[12]

আমরা মু’আযাহ ‘আদভিয়াহর উত্তর থেকে জানতে পারলাম, এমনকি সাধারণ লোকদেরকেও সকল প্রকার ভ্রান্ত মতাদর্শ ও বিপথগামী ব্যক্তিবর্গ থেকে সচেতন করতে হবে যেমনটি তিনি তাদের বিষয়ে ছিলেন, যেকারণে তিনি উত্তরে বলেন, ‘না, আমি হুরুরী নই’। অবশ্য তিনি যদি খারাজীদের বিষয়ে সতর্ক নাই থাকতেন তবে তার উত্তর হতো, ‘হুরুরী কে’? যা তার পূর্বে প্রদানকৃত উত্তরের বিপরীত।

আমরা আরও জানতে পারলাম, এমনকি সাধারণ লোকেরাও মাঝেমধ্যে দ্বীনের একেবারে মৌলিক বিষয় যেমন তাহারাত (পবিত্রতা), সালাত (নামায) ইত্যাদির বিস্তারিত জ্ঞান সম্পর্কে অসচেতন থাকতে পারে কিন্তু সর্বদা তাদেরকে ভ্রান্ত মতাদর্শ সম্পর্কে অবগত ও সজাগ থাকা জরুরি।

আমরা তাহলে দেখতে পেলাম, আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এবং তার সাহাবীগণ বিপথগামী লোকদের ব্যাপারে সতর্ক করতেন, আমরা আরও কিছু সাহাবীকে দেখতে পাই যেমন হুযায়ফা (রাঃ) যিনি তাদেরকে মন্দ থেকে বাঁচাতে উদ্বিগ্ন থাকতেন এবং প্রায়ই রাসূল (সাঃ) কে এ বিষয়ে প্রশ্ন করতেন।[13]

ওয়াহহাব ইবনে মানবাহ(রহঃ) তার তরুণ, নিষ্পাপ ও সংবেদনশীল ছাত্রদেরকে উপদেশ দিতেন, ‘তোমরা খারেজীদের ব্যাপারে সতর্ক হও! অন্যথায় তারা তোমাদেরকে তাদের ভ্রান্ত পথে টেনে আনবে যেহেতু তারা এ জাতির অনিষ্টের কারণ’।[14]

ইমাম আজরী বলেন, ‘পূর্বের ও বর্তমানের আহলে ইলমদের মাঝে এ বিষয়ে কোন ইখতিলাফ নেই যে খারেজীরা ইবাদত, সালাত এবং সিয়াম পালনে বেশি পরিমাণে নিয়োজিত থাকা সত্ত্বেও তারা একটি ক্ষতিকর সম্প্রদায় যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্য। এসব আমলগত ইবাদত তাদের জন্য কোন কল্যাণ বয়ে আনবে না। তারা অবশ্যই সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধের মানসিকতা পোষণ করে, কিন্তু এটা তাদের ফায়দা হাসিলের মত কিছু নয় কারণ তারা এমন সম্প্রদায় যারা নিজেদের প্রবৃত্তি অনুযায়ী ক্বুর’আন ব্যাখ্যা করে এবং লোকদেরকে ধোকা দেয়। তাদের ব্যাপারে মহান আল্লাহ আমাদেরকে সতর্ক করেছেন, রাসূল (সাঃ) জানিয়েছেন, সুপথপ্রাপ্ত খলীফাগণ সতর্ক করেছেন, সাহাবা এবং তাদের ছাত্রগণ এ বিষয়ে ধারণা দিয়েছেন কারণ তারা (খারেজীরা) এবং তাদের অনুসারীরা কলুষিত এবং অপবিত্র, তারা শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং মুসলিম ব্যক্তির রক্তপাতকে হালাল মনে করে’।[15]

ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ (রহঃ) বলেন, ‘খারেজীরা মুসলিমদের জন্য ইহুদী-খ্রিস্টানের চেয়েও অধিক অনিষ্টকর বিষয় কারণ তারা প্রতিনিয়ত মুসলিমদের রক্তপাত ঘটানোর ওজর খুঁজে বেড়ায় যারা তাদের মতের সাথে একমত নয়। তারা একজন মুসলিমের জীবন, সম্পদ এবং সন্তান-সন্তুতির জীবন নিয়ে নেওয়াকে হালাল মনে করে এবং তাদেরকে কাফির বলে ঘোষণা দেয়। বরং তাদের অত্যধিক অজ্ঞতা এবং ভ্রান্ত নবউদ্ভাবনের কারণে তারা শুধুমাত্র এই কাজগুলোকেই ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে মনে করে’।[16]

ইমাম ইবনে কাসীর (রহঃ) বলেন, ‘যদি খারেজীরা ক্ষমতা পেয়ে যায়, হোক তা ইরাক্ব কিংবা সিরিয়া, তারা যমীনের বুকে অপকর্ম ও বিশৃংখলা ছড়িয়ে দিবে। না তারা কোন শিশুপুত্র বা শিশুকন্যার প্রতি করুণা প্রদর্শন করবে, না কোন পুরুষ বা নারীকে ক্ষমা করবে। একারণে তাদের প্রতি মানুষের নৈতিক শুভবোধ মানহানিকর পর্যায়ের এত গভীরে চলে গেছে যে তাদের সংশোধনের একমাত্র পথ হল তাদেরকে হত্যা করা’।[17]

ইমাম ইবনে হাজার আস্কালানী (রহঃ) বলেন, ‘খারেজীদের সূচনা হয় ইরাক্বে’।[18]

আশ্চর্যের বিষয় হল ইমাম ইবনে কাসীর (রহঃ) খারেজীদের অনিষ্টতা ও ভ্রষ্টাচরণ সম্পর্কে এই দুনিয়ার সকল জায়গার মাঝে শুধু ইরাক্ব ও সিরিয়ার নাম উল্লেখ করেছেন। এমনকি ইবনে হাজার আস্কালানী (রহঃ) খারেজীরা ইরাক্ব থেকে উদ্ভূত হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। আর সাম্প্রতিককালের খারেজীদের (দায়েশ) প্রথমে ইরাক্বে উদ্ভব ঘটে এবং পরবর্তীতে তারা সিরিয়ার অভিমুখে পরিচালিত হয়।

অধিকন্তু, দায়েশ একটি তাকফিরী দল হওয়ার কারণে তারা বিদ’আতী। নিঃসন্দেহে মুসলিম উম্মাহর মাঝে তাকফীর করা (মুসলিমদেরকে কাফির আখ্যা দেওয়া) হল সর্বপ্রথম বিদ’আত, আর শায়খ আব্দুল ক্বাদীর জিলানী (রহঃ) সহ সকল আহলে ইলমগণ সর্বসম্মতভাবে তাদের সহচর হতে নিষেধ করেছেন এবং তাদেরকে বর্জন করেছেন।

শায়খ বিন বায (রহঃ) বলেন, ‘নিঃসন্দেহে যে ব্যক্তি বিদ’আতীদের প্রশংসা করে সে তাদের মতই, বরং সে হল তাদের আহবায়ক’।[19]

খারেজীদের বিষয়ে একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণঃ ‘খাওয়ারীজ’ হল ‘খারিজ’ এবং ‘খারেজী’ শব্দদ্বয়ের বহুবচন যা ‘খুরূজ’ অর্থাৎ ত্যাগ করা বা বের হয়ে আসা কে আবশ্যিক করে। অতএব হয় তারা ইসলাম ত্যাগ করেছে অথবা তারা খুরূজ অর্থাৎ জনসাধারণ এবং শাসকদের বিরুদ্ধে তীব্র বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। যেহেতু খারেজীরা একটি সুসংগঠিত দল হিসেবে আলী(রাঃ) এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল, তাদেরকে তাই খারেজী দল হিসেবে অভিহিত করা হয়।

যদিও খারেজীরা ‘যুল খুসায়রাহ’ এর বংশধর থেকে এসেছে যারা নবী (সাঃ) এর যুদ্ধলব্ধ সম্পদ বণ্টনকে অনুপযুক্ত হিসেবে পরিগনিত করেছিল। আর খারেজীদের কর্মকান্ড উসমান (রাঃ) এর খিলাফতের শেষের দিকে স্পষ্ট হয়ে উঠে। তারা আসলে আলী (রাঃ) এর শাসনকালে নাহরাওয়ান এর যুদ্ধের পূর্বে একটি সুসংগঠিত স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দল হিসেবে আবির্ভূত হয়।

আহলে ইলমগণ বর্ণনা করেন, খিলাফতের বিষয়গুলোতে ভিন্নমত পোষণ, মধ্যস্ততার বিষয়ে আপত্তি, শাসকদেরকে জালেম এবং সমাজকে পাপপরায়ণ হিসেবে ঘোষণা প্রদান এবং গোষ্ঠীগত শত্রুতাকে উৎসাহিতকরণ ইত্যাদি খারেজীদের শর্তসমূহের প্রধান প্রধান অংশ, আর তাদের মাঝে অন্যতম একটি দল হল ‘ইবাদিয়াহ’।

খারেজীরাই হল সর্বপ্রথম কোন পথভ্রষ্ট দল যাদের আলামত সম্পর্কে নবী (সাঃ) আমাদেরকে ব্যাখ্যা করে গেছেনঃ “তারা এমনভাবে সালাত আদায় করবে যে তোমাদের কাছে তা ঈর্ষণীয় মনে হবে, তারা সিয়াম পালন করবে, ক্বুর’আন তিলাওয়াত করবে কিন্তু ক্বুর’আন তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না (হয় তারা না বুঝেই তা পড়বে অথবা তাদের তিলাওয়াত অগ্রহণযোগ্য), তারা অল্পবয়ষ্ক ও সহজ-সরল হবে, তারা ভাল ভাল কথা বলবে কিন্তু তারা দ্বীন থেকে এমনভাবে বেরিয়ে যাবে যেমনভাবে ধনুক থেকে তীর বের হয়, তারা হল জাহান্নামের কুকুর। তারা সৃষ্টির মাঝে নিকৃষ্টতম। যাদেরকে হত্যা করা হয় তাদের মাঝে তারাই সর্বনিকৃষ্ট, আর তারা যাদেরকে হত্যা করে তারা হত্যাকৃতদের মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ। তাদেরকে যেখানেই পাবে হত্যা করবে, কারণ বিচার দিবসে তাদের হত্যাকারীদের জন্য পুরস্কার রয়েছে। আর যদি আমি কখনও তাদেরকে পাই তবে ’আদ জাতির মত হত্যা করবো”।[20]

দায়েশ নামকরণ পদ্ধতিঃ দায়েশ হল ‘Islamic State’ এর আদ্যোক্ষরা (আদি অক্ষরগুলোর সমন্বয়ে গঠিত শব্দ) বা শব্দসংক্ষেপ। মাঝে মাঝে এটি ইংরেজীতে ISIS (Islamic State of Iraq and Syria) হিসেবে পরিচিত অথবা ISIL (Islamic State of Iraq and Levant), [আরবীতে الدولة الإسلامية في العراق والشام অর্থাৎ ‘আদ-দাউলাহ আল-ইসলামিয়াহ ফিল ইরাক্ব ওয়াশ শাম’]।* যাইহোক, বর্তমানে তারা নিজেদেরকে IS (Islamic State) হিসেবেই অভিহিত করে থাকে যাতে করে এদের অধিকৃত এলাকা শুধুমাত্র ইরাক্ব এবং পূর্ব-ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের মাঝে সীমাবদ্ধ না থাকে, কারণ তাদের কর্মকান্ডের মন্দ প্রভাব মিশর, লিবিয়া এবং নাইজেরিয়ার বেশ কিছু জায়গায় দেখা যায়, আর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সকল ক্ষেত্রেই এই দলটির খবরাখবর। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদেরকে আনুষ্ঠানিকভাবে পরিত্যাগ করে চলে।[21]

দায়েশ এর মিশনঃ এটি একটি বিদ্রোহী ও জংগী সংগঠন। ইরাক্ব ও সিরিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রাধান্য বিস্তার করে তাদের কল্পিত ব্যাখ্যানুযায়ী খিলাফতের ঘোষণা দেওয়া, শরীয়াহ বাস্তবায়ন এবং বাইতুল মাল (ইসলামের রাষ্ট্রীয় কোষাগার) প্রতিষ্ঠাই এর মূল উদ্দেশ্য যার নেতা হল আবু বকর আল-বাগদাদী।

দায়েশ এর সূত্রপাতঃ দায়েশ আবু মুস’আব যারক্বাভীর নেতৃত্বে আল-কায়দা সংগঠন থেকে বিচ্ছিন্নতা ও স্বাধীনতা অর্জন করে। অতঃপর ২০১৪ সালের ২৯ জুন আবু বকর আল বাগদাদী খিলাফত ও নেতৃত্ব ঘোষণা দেয় যে জন্য সে ২০০৪ থেকে সংগ্রাম করে এসেছে।

দায়েশ এর মতাদর্শঃ দায়েশ তাদের বিরোধিতাকারীদেরকে ধর্মত্যগী, কাফির এবং মুনাফিক্ব হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। আর তারা আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার এবং বৃহৎ পরিসরে ব্যাপক মিডিয়া সম্প্রচারের মাধ্যমে তাদের ধর্মীয় কটাক্ষপূর্ণ মতাদর্শ প্রচার করছে।

দায়েশ এর আয়ের উৎসঃ দায়েশের আয়ের উৎসের মধ্যে রয়েছে পেট্টোল ও গ্যাসের রিজার্ভ, ব্যাংক দখল, নাগরিকদের উপর অবৈধ কর আরোপ, চুরি, চাঁদাবাজি, অপহরণ এবং মানবপাচার।

দায়েশ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনঃ দায়েশ এর রক্তপিপাসু, হীনকর যৌনতাপূর্ণ, পৈশাচিক, বিকৃতমস্তিষ্ক, স্বেচ্ছাচারী এবং বর্বর কর্মকান্ডের মাঝে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল পৌত্তলিক এবং ধর্মীয় সংখালঘুদের উপর নিপীড়ন, অত্যাচার ও অবমাননা করা, নাগরিকদের অপব্যবহার করা এবং তাদের থেকে অন্যায়ভাবে সুবিধা গ্রহণ করা, জর্ডানের পাইলট মুয়ায কাসাসবাহ কে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা, ছোট ছেলে-মেয়েদেরকে সেনাবাহিনীতে ভর্তি করা, বালিকা ও মহিলাদের উপর যৌন নির্যাতন চালানো, তাদেরকে কারাগারে আবদ্ধ রেখে পরবর্তীতে অন্যত্র বিক্রয় করা, সাংবাদিকদেরকে আক্রমণ করা, প্রকাশ্যে শিরচ্ছেদ করা, ইবাদতের স্থানসমূহকে ধ্বংস করা এবং সকল মহিলাকে খাৎনা করতে বাধ্য করা ইত্যাদি।

সংগঠনটি গোয়েন্দাগিরির মাধ্যমে নিছক সন্দেহের বশে এবং চরমপন্থা অবলম্বন করে লোকদেরকে হত্যা করে থাকে। কারাবন্দীদেরকে হত্যার পূর্বে তারা নিজেদেরকে দিয়েই ক্ববর খোড়ায় এবং কখনও কখনও আমরা তাদের একজন কর্তৃক অপরজনকে হত্যার চিত্র দেখতে পাই।

দায়েশ একটি বিতর্কিত নামঃ মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শায়খ সালেহ আস-সুহাইমি (হাফিঃ) বলেন, ‘আমি তাদেরকে ইসলামিক স্টেট বলতে পছন্দ করি না কারণ দায়েশ ইসলামের বাস্তবায়ন ও প্রতিষ্ঠা করে না বরং বরং এটি মুসলিমদেরকে হত্যা করে। আর তাদের পথ ও পদ্ধতি প্রাচীন খারেজীদের চেয়েও অধিকতর নিকৃষ্ট। কাজেই আমরা এই সংগঠনের প্রতি আনুগত্য স্বীকারের বিরুদ্ধে সতর্ক করছি যেটি মুসলিম নারীদের হস্তাগত করে এবং পরবর্তীতে তাদেরকে অন্যত্র বিক্রয় করে দেয়’।

মুসাল্লাহ ইবনে যুওয়ায়েদ আল-উতাইবী (হাফিঃ) বলেন, ‘দায়েশ এর পাপিষ্ঠ হওয়ার জন্য এর নাম ভালভাবে ভেবে দেখাই যথেষ্ট, কারণ এমন পাপাচারপূর্ণ কোন নাম তার পাপিষ্ঠ হওয়ারই প্রমাণ বহন করে। সম্ভবত এ কারণেই রাসূল(সাঃ) মন্দ নাম পরিবর্তন করে দিতেন।[22]

মূলঃ ISIS-DAESH: A Catastrophe and a Tribulation

লেখকঃ শায়খ হুসাইন মাদানী

অনুবাদ ও পরিবেশনায়ঃ সত্যান্বেষী রিসার্চ টীম

© Shottanneshi – সত্যান্বেষী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

প্রবন্ধটি পড়া হলে, শেয়ার করতে ভুলবেন না।


[1] সহীহ বুখারী, ‘আবওয়াবুল ইসতিস্কা’, হাদীস – ১০৩৬, আবু হুরায়রা(রাঃ) থেকে বর্ণিত।

[2] সুনান আবু দাউদ, ‘কিতাবুল ফিতান’, ‘বাব আন-নাহই ‘আনিস সাঈ ফিল ফিতনাহ’, হাদীস – ৪২৫৯, আবু মূসা আশ’আরী (রাঃ) থেকে হাসান লিগাইরিহী সনদে বর্ণিত।

[3] সুনান ইবনে মাজাহ, ‘আবওয়াবুল ফিতান’, ‘বাব মা ইয়াকুন মিনাল ফিতান’, হাদীস – ৩৯৫৬, আব্দুল্লাহ বিন উমার (রাঃ) থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত।

[4] সুনান আবু দাউদ, ‘কিতাবুল ফিতান’, ‘বাব আন-নাহই ‘আনিস সাঈ ফিল ফিতনাহ’, হাদীস – ৪২৫৯, আবু মূসা আশ’আরী (রাঃ) থেকে হাসান লিগাইরিহী সনদে বর্ণিত।

[5] সুনান আবু দাউদ, ‘কিতাবুল ফিতান’, ‘বাব আন-নাহই ‘আনিস সাঈ ফিল ফিতনাহ’, হাদীস – ৪২৬৩, মিক্বদাদ বিন আসওয়াদ (রাঃ) থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত।

[6] সহীহ মুসলিম, ‘কিতাবুল ঈমান’, ‘বাব বায়ান ‘আনিদ দ্বীন আন-নাসীহা’, হাদীস – ৯৫, তামীম আদ-দারী (রাঃ) থেকে বর্ণিত।

[7] সহীহ বুখারী, ‘কিতাবু তাফসীরিল ক্বুর’আন’, ‘বাব মিনহ আয়াত…’, হাদীস – ৪৫৪৭, আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত।

[8] সহীহ বুখারী, ‘কিতাবু ফাযায়েলিল ক্বুর’আন’, ‘বাব ইসাম মিন রাঈ…’, হাদীস – ৫০৫৭, আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত।

[9] সহীহ বুখারী, ‘কিতাবুত তাওহীদ’, ‘বাব ক্বুল আল্লাহু তা’আলা তা’রাজ…’হাদীস – ৭৪৩২, আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত।

[10] মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা, ‘কিতাবুল জুমাল’, ‘মা যিকর ফিল খাওয়ারীজ’, হাদীস – ৩৭৮৮৬, আবু সাঈদ খুদরী(রাঃ) থেকে বর্ণিত।

[11] ফাতহুল বারী, ‘কিতাবুত দিয়াত’, ‘বাব মিন তারকি ক্বিতাল…’।

[12] সহীহ মুসলিম, ‘কিতাবুল হাইদ’, ‘বাব উজূব কাযা…’, হাদীস – ৬৯।

[13] সহীহ বুখারী, ‘কিতাবুল মানাক্বিব’, ‘বাব ‘আলামাত আন-নুবুওয়াহ…’, হাদীস – ৩৬০৬।

[14] সিয়ার আ’লাম আন-নুবালা, ‘আত তাবাক্বাতুস সানিয়াহ’, ‘ওয়াহহাব ইবনে মানবাহ’, ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা ৫৫৩।

[15] আশ-শারিয়াহ, ‘বাব দইম আল-খাওয়ারীজ…’, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা ৩২৫।

[16] মিনহাজুস সুন্নাহ আন-নববিয়্যাহ……আল-ফাসল আস-সাদিস, ‘ফাসলুন নবী আরশাদ আল-উম্মাহ…’, ৫ম খন্ড, পৃষ্ঠা ২৪৮।

[17] আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ‘সুম্মা দাখালতা সুন্নাতু সাব’আ ওয়া সালাসীন’, ‘যিকর খুরূজ আল-খাওয়ারীজ…’, ১০ম খন্ড, পৃষ্ঠা ৫৮৪।

[18] ফাতহুল বারী, ‘আল-মুক্বাদ্দিমাহ’, ফাসল হা বা। 

[19] ইবনে বায থেকে, মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব এর ‘শারহ কিতাব ফাযল আল-ইসলাম’।

[20] খারেজীদের সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে আক্বীদা ও হাদীসের গ্রন্থগুলো ছাড়াও ‘ফারক্ব মু’আসিরাহ তানসীব ইলাল ইসলাম…লি ডঃ গালিব আল-আওয়াজী’ এবং ‘আল খাওয়ারীজ তারীখুহুম…লিল মুয়ালিফ নাফসাহ’ বইটি উপকারী। 

* এছাড়া এটি ‘দায়েস’ (যে কোন কিছু পদতলে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে) এবং ‘দাহেস’ (যে বিরোধিতার বীজ বপন করে) শব্দদ্বয়ের অনুরূপ। [অনুবাদকের মন্তব্য]

[21] আরবী ও ইংরেজী উইকিপিডিয়া থেকে।

[22] মওক্বা সাইয়েদ আল যাওয়ায়েদ, দায়েশ ওয়া মা আদরাকা মা’আ দায়েশ।

মন্তব্য করুন

Back to top button