৯২. সূরা লায়েল -এর তাফসীর
সূরা লায়েল
(রাত্রি)
সূরা আ‘লা-এর পরে মক্কায় অবতীর্ণ।
সূরা ৯২, আয়াত ২১, শব্দ ৭১, বর্ণ ৩১২।
بِسْمِ اللہِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ
পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে (শুরু করছি)।
(১) শপথ রাত্রির, যখন সে আচ্ছন্ন করে |
وَاللَّيْلِ إِذَا يَغْشَى
|
(২) শপথ দিবসের, যখন তা প্রকাশিত হয় |
وَالنَّهَارِ إِذَا تَجَلَّى
|
(৩) শপথ, যা তিনি সৃষ্টি করেছেন নর ও মাদী |
وَمَا خَلَقَ الذَّكَرَ وَالْأُنْثَى
|
(৪) নিশ্চয়ই তোমাদের প্রচেষ্টা বিভিন্নমুখী। |
إِنَّ سَعْيَكُمْ لَشَتَّى
|
(৫) অতঃপর যে ব্যক্তি দান করে ও আল্লাহভীরু হয়, |
فَأَمَّا مَنْ أَعْطَى وَاتَّقَى
|
(৬) এবং উত্তম বিষয়কে সত্য বলে বিশ্বাস করে, |
وَصَدَّقَ بِالْحُسْنَى
|
(৭) অচিরেই আমরা তাকে সরল পথের জন্য সহজ করে দেব। |
فَسَنُيَسِّرُهُ لِلْيُسْرَى
|
(৮) পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি কৃপণতা করে ও বেপরওয়া হয়, |
وَأَمَّا مَنْ بَخِلَ وَاسْتَغْنَى
|
(৯) এবং উত্তম বিষয়কে মিথ্যা মনে করে, |
وَكَذَّبَ بِالْحُسْنَى
|
(১০) অচিরেই আমরা তাকে কঠিন পথের জন্য সহজ করে দেব। |
فَسَنُيَسِّرُهُ لِلْعُسْرَى
|
(১১) তার ধন-সম্পদ তার কোন কাজে আসবে না, যখন সে ধ্বংস হবে। |
وَمَا يُغْنِي عَنْهُ مَالُهُ إِذَا تَرَدَّى
|
(১২) নিশ্চয়ই আমাদের দায়িত্ব হ’ল পথ প্রদর্শন করা। |
إِنَّ عَلَيْنَا لَلْهُدَى
|
(১৩) নিশ্চয়ই আমাদের মালিকানায় রয়েছে পরকাল ও ইহকাল। |
وَإِنَّ لَنَا لَلْآخِرَةَ وَالْأُولَى
|
(১৪) অতএব আমি তোমাদেরকে প্রজ্বলিত অগ্নি থেকে ভয় প্রদর্শন করছি। |
فَأَنْذَرْتُكُمْ نَارًا تَلَظَّى
|
(১৫) যাতে প্রবেশ করবে না হতভাগা ব্যতীত। |
لَا يَصْلَاهَا إِلَّا الْأَشْقَى
|
(১৬) যে মিথ্যারোপ করে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়। |
الَّذِي كَذَّبَ وَتَوَلَّى
|
(১৭) সত্বর এ থেকে দূরে রাখা হবে আল্লাহভীরু ব্যক্তিকে, |
وَسَيُجَنَّبُهَا الْأَتْقَى
|
(১৮) যে তার ধন-সম্পদ দান করে আত্মশুদ্ধির জন্য |
الَّذِي يُؤْتِي مَالَهُ يَتَزَكَّى
|
(১৯) এবং কারু জন্য তার নিকটে কোনরূপ অনুগ্রহ থাকে না যা প্রতিদান যোগ্য। |
وَمَا لِأَحَدٍ عِنْدَهُ مِنْ نِعْمَةٍ تُجْزَى
|
(২০) কেবলমাত্র তার মহান পালনকর্তার চেহারা অন্বেষণ ব্যতীত। |
إِلَّا ابْتِغَاءَ وَجْهِ رَبِّهِ الْأَعْلَى
|
(২১) আর অবশ্যই সে অচিরেই সন্তোষ লাভ করবে। |
وَلَسَوْفَ يَرْضَى
|
বিষয়বস্ত্ত :
তিনটি বিষয়ের শপথ করে আল্লাহ বলছেন যে, কর্মপ্রচেষ্টার দিক দিয়ে পৃথিবীতে মানুষ দু’ধরনের হয়ে থাকে। এক ধরনের লোক তারাই, যাদের সত্তাকে সরলপথে চলার জন্য সহজ করে দেওয়া হয়েছে। এরাই সফলকাম এবং তাদের তিনটি গুণাবলী উল্লেখ করা হয়েছে (১-৭ আয়াত)। আরেক ধরনের লোক আছে, যাদের সত্তাকে বক্রপথে চলার জন্য সহজ করে দেওয়া হয়েছে। এরা ব্যর্থকাম এবং এদের তিনটি দোষ চিহ্নিত করা হয়েছে। অতঃপর তাদের পরিণতি ব্যাখ্যা করা হয়েছে (৮-১৬)। সবশেষে আল্লাহর সন্তোষভাজন ব্যক্তিদের চরিত্র ও তাদের প্রতিদান বিবৃত করা হয়েছে (১৭-২১ আয়াত)।
গুরুত্ব :
ইতিপূর্বে সূরা ফজরের আলোচনায় বলা হয়েছে যে, একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মু‘আয বিন জাবালকে বলেন, তুমি কি ছালাতে সূরা আ‘লা, ফজর, শাম্স, লায়েল, যোহা পড়তে পারো না’? [1]
শানে নুযূল :
ইবনু মাসঊদ, ইবনু আববাস, ইবনু যুবায়ের (রাঃ) প্রমুখ ছাহাবীগণের বর্ণনামতে সূরাটি হযরত আবুবকর ছিদ্দীক (রাঃ) সম্পর্কে নাযিল হয় (কুরতুবী)। ইবনু কাছীর বলেন, কোন কোন বিদ্বান এ বিষয়ে মুফাসসিরগণের ইজমা বর্ণনা করেছেন (ইবনু কাছীর)।
তাফসীর :
(১-২) وَاللَّيْلِ إِذَا يَغْشَى، وَالنَّهَارِ إِذَا تَجَلَّى ‘শপথ রাত্রির, যখন সে আচ্ছন্ন করে’। ‘শপথ দিবসের, যখন তা প্রকাশিত হয়’।
يَغْشَى অর্থ يُغَطِّى ‘আচ্ছন্ন করে’। কাকে আচ্ছন্ন করে সেটা স্পষ্ট বিধায় উল্লেখ করা হয়নি। অর্থাৎ সূর্য বা দিবসকে রাত্রি তার অন্ধকার দ্বারা আচ্ছন্ন করে (কুরতুবী)। تَجَلَّى অর্থ ظهر بزوال ظلمة الليل ‘রাত্রির অন্ধকার দূর করে প্রকাশিত হওয়া’। প্রথমটি فعل مضارع হওয়ার কারণ এই যে, অন্ধকার এসে আলোটিকে ঢেকে দেয়। দ্বিতীয়টি فعل ماضى হওয়ার কারণ এই যে, দিবস হ’ল স্বয়ং প্রকাশমান এবং যেটি হ’ল মূল (ক্বাসেমী)।
এখানে রাত্রি ও দিবসের শপথ করার মাধ্যমে এ দু’টির গুরুত্ব বুঝানো হয়েছে। এখানে উভয়ের দু’টি প্রধান বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে। যে দু’টি বৈশিষ্ট্য সকলের নিকটে স্পষ্ট। অর্থাৎ রাত্রির বৈশিষ্ট্য হ’ল ‘আচ্ছন্ন করা’। আর দিনের বৈশিষ্ট্য হ’ল ‘অন্ধকার ঠেলে দিন প্রকাশিত হওয়া’। কিন্তু কেবল এটুকু বুঝানোর জন্য শপথ করা হয়নি। বরং এতে জ্ঞানীদের জন্য রয়েছে গভীর তাৎপর্য এবং রয়েছে সৌরবিজ্ঞানের মূল্যবান উৎস। কেবল এখানেই নয়, বরং কুরআনে বর্ণিত সকল শপথই বিজ্ঞানের উৎস কেন্দ্র। যেমন এখানে রাত্রির শপথ করা হয়েছে ‘আচ্ছন্নকারী’ হিসাবে। এর তাৎপর্য কি?
প্রথমতঃ রাত্রি ও দিনের প্রতিটিই কিছু বস্ত্তকে আচ্ছন্ন করে ও কিছু বস্ত্তকে প্রকাশ করে। যেমন রাত্রি আকাশের চাঁদ ও নক্ষত্ররাজিকে প্রকাশ করে দেয়। কিন্তু ভূপৃষ্ঠের সবকিছুকে আচ্ছন্ন করে। পক্ষান্তরে দিন আকাশের নক্ষত্ররাজিকে আচ্ছন্ন করে। কিন্তু ভূপৃষ্ঠের সবকিছুকে প্রকাশ করে দেয়। এর মধ্যে পৃথিবীর আহ্নিক গতির বৈজ্ঞানিক তথ্যের সন্ধান রয়েছে। যা ২৪ ঘণ্টায় একবার নিজের অক্ষের উপরে ঘুরে থাকে। লাটিমের মত ঘূর্ণনের সময় পৃথিবীর যে অংশ সূর্যের দিকে পড়ে, সেই অংশে দিন হয় এবং অপরাংশে রাত হয়। সেকারণ আচ্ছন্নকারী হ’ল রাত্রি, দিন নয়। কেননা দিন অর্থাৎ সূর্য সদা প্রকাশিত। বস্ত্ততঃ এটি কুরআনের বিস্ময়কর তথ্যসমূহের অন্যতম।
দ্বিতীয়তঃ রাতের বেলায় যা কিছু প্রকাশিত হয় ও আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়, তা হ’ল আল্লাহর বিশাল সৃষ্টিসমূহের সারৎসার মাত্র। কিন্তু দিনের বেলায় যা আমাদের সামনে প্রকাশিত হয়, তা হ’ল ঐসব সৃষ্টির তুলনায় সরিষাদানা সমতুল্য। আর তা হ’ল পৃথিবী নামক এই ছোট্ট গ্রহটি। যার সবকিছু আমরা বড় ও স্পষ্ট দেখি হাতের কাছে থাকার কারণে। পক্ষান্তরে আকাশের বড় বড় নক্ষত্ররাজিকে আমরা ছোট দেখি, দূরে এবং নাগালের বাইরে থাকার কারণে।
দিবস ও রাত্রির এই আসা-যাওয়ার মধ্যে মানুষের দুনিয়াবী জীবন ও পরকালীন জীবনের দৃষ্টান্ত লুকিয়ে রয়েছে। মানুষ যতক্ষণ বেঁচে থাকে, ততক্ষণ সে কূয়ার ব্যাঙের মত কেবল তার আশপাশের ছোট্ট দুনিয়াটুকু দেখে। কিন্তু মৃত্যুর পরে বিশাল এক জগতের দৃশ্য তার সামনে ভেসে ওঠে, যার কোন সীমা-পরিসীমা নেই। যার সৌন্দর্যের কোন তুলনা নেই। ঠিক যেমন সূর্যাস্তের পর রাতের পর্দা উন্মোচিত হ’লে আমাদের সামনে ভেসে ওঠে লক্ষ-কোটি নক্ষত্রশোভিত সীমাহীন আকাশের এক অনিন্দ্যসুন্দর ক্যানভাস। একথাটাই আল্লাহ বলেছেন এভাবে- لَقَدْ كُنْتَ فِيْ غَفْلَةٍ مِّنْ هَذَا فَكَشَفْنَا عَنْكَ غِطَاءَكَ فَبَصَرُكَ الْيَوْمَ حَدِيْدٌ ‘তুমি তো এই দিন সম্পর্কে উদাসীন ছিলে। এখন আমরা তোমার থেকে পর্দা সরিয়ে দিয়েছি। ফলে আজ তোমার দৃষ্টি সুতীক্ষ্ণ’ (ক্বাফ ৫০/২২)।
ঘুমের স্বপ্নজগত থেকে জেগে উঠে মানুষ যেমন সবকিছু নতুন দেখে, দুনিয়ার এ স্বপ্নজগত শেষে মৃত্যুর পরে সে দেখবে নতুন এক বিস্ময়কর জগত। সে তখন পরকালের অনন্ত জীবনের বাসিন্দা হবে। ইহকালের সাথে তার কোনই সম্পর্ক থাকবে না। যেমন সূর্য ডুবে গেলে দিনের সাথে রাতের কোন সম্পর্ক থাকে না। আল্লাহ বলেন, وَمِنْ وَّرَائِهِم بَرْزَخٌ إِلَى يَوْمِ يُّبْعَثُوْنَ ‘তাদের সামনে পর্দা থাকবে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত’ (মুমিনূন ২৩/১০০)। কবরের ঐ জগতকে এজন্যই বলা হয় ‘বরযখী জগত’। অর্থাৎ পর্দার জগত। ওখানে গিয়ে দুনিয়ার কারুর কোন উপকার বা ক্ষতি কেউ করতে পারে না। যারা ছবি-মূর্তি, প্রতিকৃতি বা কবরপূজা করে এবং মৃত ব্যক্তির নিকটে বা তার অসীলায় কিছু কামনা করে, তারা অলীক কল্পনার পিছনে ছুটে মাত্র। তারা কুরআনের বিরোধিতা করে এবং প্রকাশ্য শিরকে লিপ্ত হয়। আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন- আমীন!
রাত্রির আচ্ছন্ন করা এবং দিবসের আলোকিত হওয়ার শপথ করে আল্লাহ এই দু’য়ের কল্যাণকারিতার বিষয়ে চিন্তা-গবেষণার প্রতি যেমন বান্দার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তেমনি দুনিয়ায় নেক আমলের মাধ্যমে আখেরাতে মুক্তি হাছিলের প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন।
(৩) وَمَا خَلَقَ الذَّكَرَ وَالْأُنْثَى ‘শপথ, যা তিনি সৃষ্টি করেছেন নর ও মাদী’।
কুরতুবী, ইবনু কাছীর ও ক্বাসেমীসহ প্রায় সকল মুফাসসিরوَمَا خَلَقَ অর্থ وَمَنْ خَلَقَ (যিনি সৃষ্টি করেছেন) বলে ‘আল্লাহ’ অর্থ নিয়েছেন। অর্থাৎ আল্লাহ এখানে নিজেই নিজের সত্তার কসম করছেন। অথচ ইতিপূর্বে আল্লাহ রাত্রি ও দিবস দু’টি সৃষ্টির কসম করেছেন এবং প্রায় সকল সূরাতেই আল্লাহর এ নীতি বজায় রয়েছে। সেকারণ আমরা এখানেوَمَا خَلَقَ -এর প্রকাশ্য অর্থ (ما مصدرية) গ্রহণ করেছি। দূরতম অর্থ (ما موصولة) গ্রহণের কোন প্রয়োজন বোধ করিনি।
অর্থাৎ নর ও মাদীরূপে যে প্রাণীজগত এবং নেগেটিভ ও পজেটিভ তথা ইলেকট্রন ও প্রোটন নামক দু’টি বিপরীতধর্মী মৌলিক অণু দিয়ে যে বস্ত্তজগত আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন, সেই সবকিছুর শপথ। ইবনু মাসঊদ (রাঃ)-এর ক্বিরাআতে এসেছে, وَالذَّكَرَ وَالْأُنْثَى অর্থাৎ ‘শপথ নর ও মাদীর’।[2] এর দ্বারা জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি বুঝানো হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন, وَخَلَقْنَاكُمْ أَزْوَاجاً ‘আমরা তোমাদের সৃষ্টি করেছি জোড়ায় জোড়ায়’ (নাবা ৭৮/৮)। অন্যত্র তিনি বলেন, وَمِنْ كُلِّ شَيْءٍ خَلَقْنَا زَوْجَيْنِ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُوْنَ- ‘আমরা প্রত্যেক বস্ত্ত জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছি, যাতে তোমরা উপদেশ হাছিল করতে পারো’ (যারিয়াত ৫১/৪৯)।
অন্য সব বাদ দিলেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের আদমশুমারি সন্ধান করলে দেখা যাবে যে, সব দেশেই পুরুষ ও নারীর সংখ্যা সর্বদা কাছাকাছি রয়েছে। যদি এটা না হয়ে এর বিপরীত হ’ত। অর্থাৎ উদাহরণ স্বরূপ কোন দেশে মোট লোকসংখ্যার তিনগুণ পুরুষ ও একগুণ নারী হ’ত অথবা তিনগুণ নারী ও একগুণ পুরুষ হ’ত, তাহ’লে সেই দেশের সামাজিক শৃংখলা ভেঙ্গে পড়ত। বস্ত্ততঃ পুত্র বা কন্যাসন্তান জন্মের ব্যাপারে পিতা-মাতার কিছুই করার নেই। আর সারা দেশের বা সারা পৃথিবীর লোকসংখ্যা হিসাব করে জন্ম নিয়ন্ত্রণের কোন ক্ষমতাও মানুষের হাতে নেই। অতি উৎসাহী কিছু বস্ত্তবাদী মানুষ অহেতুক চেষ্টা করে বরং নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কেননা মানুষ সহ সকল প্রাণী ও বস্ত্ত জগতের সংখ্যা ও রূযী নিয়ন্ত্রণের মূল চাবিকাঠি আল্লাহর হাতে। তিনি বলেন, اَللهُ يَعْلَمُ مَا تَحْمِلُ كُلُّ أُنْثَى وَمَا تَغِيْضُ الْأَرْحَامُ وَمَا تَزْدَادُ وَكُلُّ شَيْءٍ عِنْدَهُ بِمِقْدَارٍ- ‘আল্লাহ জানেন প্রত্যেক নারী যা গর্ভে ধারণ করে এবং যা গর্ভাশয়ে সংকুচিত ও বর্ধিত হয়। বস্ত্ততঃ তাঁর নিকটে প্রত্যেক বস্ত্তরই একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ রয়েছে’ (রা‘দ ১৩/৮)। সকল প্রাণী ও বস্ত্তজগতে নর ও মাদীর সমতা বিধান নিঃসন্দেহে একটি বিস্ময়কর ব্যাপার। যার মধ্যে একজন দূরদর্শী পরিকল্পক ও প্রজ্ঞাময় সৃষ্টিকর্তার নিশ্চিত প্রমাণ নিহিত রয়েছে। আল্লাহ বলেন, اَللهُ الَّذِيْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا فِيْ سِتَّةِ أَيَّامٍ… يُدَبِّرُ الْأَمْرَ مِنَ السَّمَاءِ إِلَى الْأَرْضِ- ‘আল্লাহ তিনি যিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল এবং এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সবকিছুকে ছয়দিনে সৃষ্টি করেছেন… । যিনি আকাশ হ’তে পৃথিবী পর্যন্ত সমস্ত কর্ম পরিচালনা করেন’… (সাজদাহ ৩২/৪-৫)।
(৪) إِنَّ سَعْيَكُمْ لَشَتَّى ‘নিশ্চয়ই তোমাদের প্রচেষ্টা বিভিন্নমুখী’।
অত্র আয়াতটি পূর্বের তিনটি আয়াতে বর্ণিত শপথসমূহের জওয়াব হিসাবে এসেছে (কুরতুবী)। শপথের বিষয়বস্ত্ত রাত্রি ও দিবস, নর ও নারী যেমন পরস্পরে বিপরীতধর্মী, শপথের জবাবটাও এসেছে পরস্পরে বিপরীতমুখী। অর্থাৎ মানুষের কর্ম প্রচেষ্টা হ’ল দু’ধরনের। ভাল ও মন্দ, যা পরবর্তী আয়াতগুলিতে স্পষ্ট হয়েছে। আর সেখানে ভাল ও মন্দ প্রতিটি দলের তিনটি করে বৈশিষ্ট্য বর্ণিত হয়েছে। যেমন,
(৫-৬) فَأَمَّا مَنْ أَعْطَى وَاتَّقَى، وَصَدَّقَ بِالْحُسْنَى ‘অতঃপর যে ব্যক্তি দান করে ও আল্লাহভীরু হয় এবং উত্তম বিষয়কে সত্য বলে বিশ্বাস করে’।
অত্র দু’টি আয়াতে সৎকর্মশীল ব্যক্তিদের তিনটি গুণ বর্ণনা করা হয়েছে। এক- যারা আল্লাহর পথে ব্যয় করে। দুই- আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ থেকে বেঁচে থাকে এবং তিন- ‘উত্তম বিষয়’ অর্থাৎ তাওহীদের কালেমা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ-কে মনেপ্রাণে সত্য বলে বিশ্বাস করে।
ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, আয়াত দু’টি আবুবকর (রাঃ) সম্পর্কে নাযিল হয়। আর এটাই সকল মুফাসসির বলেন (কুরতুবী)। ইবনু জারীর ‘আমের বিন আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রাঃ) হ’তে বর্ণনা করেন যে, আবুবকর (রাঃ) মক্কায় থাকাকালে ইসলাম কবুলকারী বৃদ্ধা ও নারীদের তাদের মনিবদের নিকট থেকে খরিদ করে মুক্ত করে দিতেন। এতে আপত্তি করে তাঁর পিতা আবু ক্বোহাফা বলেন, বেটা! আমি দেখছি তুমি কেবল দুর্বলদের মুক্ত করছ। যদি তুমি শক্তিশালী ও সাহসী পুরুষ লোকদের মুক্ত করতে, তাহ’লে তারা তোমাকে সাহায্য করত ও তোমার পক্ষে প্রতিরোধ গড়ে তুলতো। জবাবে আবুবকর (রাঃ) বলেন, أى أبت إنما أريد ما عند الله ‘হে পিতা! আমি তো কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি চাই’। রাবী ‘আমের বলেন, আমার পরিবারের লোকেরা আমাকে বলেছেন যে, আলোচ্য আয়াতটি উক্ত প্রসঙ্গেই নাযিল হয়েছিল’।[3]
উল্লেখ্য, হযরত ‘আমের হলেন, হযরত আসমা বিনতে আবুবকর (রাঃ)-এর পৌত্র এবং আবুবকর (রাঃ)-এর নাতি আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের (রাঃ)-এর পুত্র।
وَصَدَّقَ بِالْحُسْنَىঅর্থ صدَّق بالكلمة الحسنى ‘উত্তম কালেমাকে সত্য বলে বিশ্বাস করে’। ইবনু আববাস, যাহহাক প্রমুখ বলেন, কালেমা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ-কে সত্য বলে বিশ্বাস করে (কুরতুবী)। ক্বাতাদাহ বলেন, بالمجازاة على ذلك অর্থাৎ আল্লাহর পথে ব্যয় ও আল্লাহভীরুতার উত্তম প্রতিদানে বিশ্বাস পোষণ করে (ইবনু কাছীর)। সবগুলি কাছাকাছি মর্ম বহন করে। কেননা তাওহীদে বিশ্বাসী না হলে কেউ পরকালীন ছওয়াবে বিশ্বাসী হবে না এবং নিঃস্বার্থভাবে সৎকর্ম করবে না।
(৭) فَسَنُيَسِّرُهُ لِلْيُسْرَى ‘অচিরেই আমরা তাকে সরল পথের জন্য সহজ করে দেব’।
অর্থাৎ আমরা ছিরাতে মুস্তাক্বীম-এর পথ প্রদর্শন করব এবং সেপথে চলা তার জন্য সহজ করে দেব। যায়েদ বিন আসলাম বলেন, ‘সরল পথের জন্য’ অর্থ ‘জান্নাতের জন্য’ (ইবনু কাছীর)। কেননা জান্নাতের পথই সরল পথ বা ছিরাতে মুস্তাক্বীম। আর এ পথের শেষ ঠিকানাই হ’ল জান্নাত।
আয়াতে سَ অর্থ ‘সত্বর’ যা এসেছে تحقيق বা নিশ্চয়তা বুঝানো জন্য। অর্থাৎ তার দ্বীন ও দুনিয়ার সকল কাজ আল্লাহ সহজ করে দিবেন। যেমন তিনি বলেন, وَمَنْ يَتَّقِ اللهَ يَجْعَلْ لَهُ مِنْ أَمْرِهِ يُسْرًا ‘যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার কাজ-কর্ম সহজ করে দেন’ (তালাক ৬৫/৪)।
আলোচ্য আয়াতে যে তিনটি গুণের বিনিময়ে জান্নাতের পথ সহজ করে দেবার ওয়াদা করা হয়েছে, মূলতঃ ঐ গুণাবলী তারাই হাছিল করেন, যাদেরকে আল্লাহ জান্নাতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। ফলে সৎকর্ম করা তাদের মজ্জাগত স্বভাবে পরিণত হবে। এদের পক্ষে জাহান্নামের কাজ করাটাই কষ্টকর এমনকি অসম্ভব হবে।
(৮-১০) وَأَمَّا مَنْ بَخِلَ وَاسْتَغْنَى، وَكَذَّبَ بِالْحُسْنَى، فَسَنُيَسِّرُهُ لِلْعُسْرَى ‘পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি কৃপণতা করে ও বেপরওয়া হয়’। ‘এবং উত্তম বিষয়কে মিথ্যা মনে করে’। ‘অচিরেই আমরা তাকে কঠিন পথের জন্য সহজ করে দেব’।
পূর্বের আয়াতে জান্নাতী বান্দাদের তিনটি বৈশিষ্ট্যের বর্ণনা শেষে এবার জাহান্নামীদের তিনটি বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হচ্ছে যে, এক- তারা আল্লাহর পথে ব্যয় করার বিষয়ে কৃপণতা করবে। দুই- আল্লাহর অবাধ্যতায় বেপরওয়া হবে এবং তিন- তাওহীদের কালেমায় মিথ্যারোপ করবে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ)-এর বাণীর অবাধ্যতা করবে। তাদের জন্য কঠিন পথ অর্থাৎ জাহান্নামের পথ সহজ করে দেয়া হবে। অসৎকর্ম করা তখন তাদের মজ্জাগত হয়ে যাবে। এদের পক্ষে জান্নাতের কাজ করাটা কষ্টকর এমনকি অসম্ভব হবে।
উল্লেখ্য যে, শয়তান সর্বদা মুমিনদের এই বলে ধোঁকা দিয়ে থাকে যে, মন্দ লোকেরাই দুনিয়াতে সুখে আছে। অতএব দ্বীনদার হয়ে কি লাভ? এর জবাব এই যে, বাহ্যিকভাবে এদের সুখী দেখা গেলেও অন্তরজগতে এরা চরম অসুখী। দুনিয়াতে এটাই এদের জন্য আযাব। যেমন আল্লাহ বলেন, فَمَنْ يُرِدِ اللهُ أَنْ يَهْدِيَهُ يَشْرَحْ صَدْرَهُ لِلْإِسْلاَمِ وَمَنْ يُرِدْ أَنْ يُضِلَّهُ يَجْعَلْ صَدْرَهُ ضَيِّقًا حَرَجًا كَأَنَّمَا يَصَّعَّدُ فِي السَّمَاءِ كَذَلِكَ يَجْعَلُ اللهُ الرِّجْسَ عَلَى الَّذِينَ لاَ يُؤْمِنُونَ ‘আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করার ইচ্ছা করেন, আর অন্তরকে সংকুচিত করে দেন, যেন সে আকাশে আরোহন করছে। এমনিভাবে যারা ঈমান আনে না, তাদের উপর আল্লাহ পংকিলতাকে বিজয়ী করে দেন’ (আন‘আম ৬/১২৫)। তিনি বলেন, وَالَّذِينَ كَذَّبُوا بِآيَاتِنَا سَنَسْتَدْرِجُهُمْ مِنْ حَيْثُ لاَ يَعْلَمُونَ- وَأُمْلِي لَهُمْ إِنَّ كَيْدِي مَتِينٌ- ‘যারা আমার আয়াত সমূহে মিথ্যারোপ করে, আমরা তাদেরকে ধীরে ধীরে এমনভাবে পাকড়াও করব যে, তারা জানতেও পারবে না’। ‘আর আমি তাদের অবকাশ দেব। নিশ্চয়ই আমার কৌশল খুবই মযবুত’ (আ‘রাফ ৭/১৮২-৮৩; ক্বলম ৬৮/৪৪-৪৫)।
হযরত আলী (রাঃ) বলেন, আমরা একদিন বাক্বী‘ গারক্বাদে একটি জানাযায় ছিলাম। এমন সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সেখানে এলেন এবং বসলেন। আমরাও তাঁকে ঘিরে বসলাম। ঐ সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর হাতের ছড়ি দিয়ে মাটি খুঁচছিলেন এবং বললেন, এমন কোন মানুষ নেই যার ঠিকানা জান্নাতে অথবা জাহান্নামে নির্ধারিত হয়নি। অথবা সে হতভাগ্য না সৌভাগ্যবান সেকথা লিখিত হয়নি। তখন একজন বলল, হে আল্লাহর রাসূল! তাহ’লে আমরা কি অদৃষ্টের উপরে ভরসা করব এবং কাজ-কর্ম ছেড়ে দেব? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, اِعْمَلُوْا فَكُلٌّ مُيَسَّرٌ لِمَا خُلِقَ لَهُ ‘তোমরা কাজ করে যাও। তোমরা প্রত্যেকে ঐ কাজ সহজে করবে, যার জন্য তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে’।[4] অতঃপর তিনি বলেন,
أَمَّا أَهْلُ السَّعَادَةِ فَيُيَسَّرُوْنَ لِعَمَلِ أَهْلِ السَّعَادَةِ وَأَمَّا أَهْلُ الشَّقَاوَةِ فَيُيَسَّرُوْنَ لِعَمَلِ أَهْلِ الشَّقَاءِ ثُمَّ قَرَأَ {فَأَمَّا مَنْ أَعْطَى وَاتَّقَى وَصَدَّقَ بِالْحُسْنَى فَسَنُيَسِّرُهُ لِلْيُسْرَى}
‘যারা সৌভাগ্যশালী হবে, তাদের জন্য সৌভাগ্যবানদের কাজ সহজ করে দেয়া হবে। আর যারা হতভাগ্য হবে, তাদের জন্য হতভাগাদের কাজ সহজ করে দেয়া হবে। অতঃপর তিনি আলোচ্য আয়াতগুলি পাঠ করলেন’।[5]
আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) বলেন, একদিন রাসূল (ছাঃ) দু’টি খাতা হাতে করে এনে বললেন, এ দু’টি আল্লাহর কিতাব। এর মধ্যে ডান হাতের কিতাবটিতে জান্নাতীদের নাম ও বাম হাতেরটিতে জাহান্নামীদের নামের তালিকা আছে। এ তালিকায় কোন কাটছাট করা হবে না বা কমবেশী করা হবে না। তখন ছাহাবীগণ বললেন, আল্লাহ যখন সবকিছু শেষ করে ফেলেছেন, তখন আর কাজ করা কেন? তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, سَدِّدُوْا وَقَارِبُوْا ‘তোমরা সৎকর্ম করে যাও এবং মধ্যপন্থা অবলম্বন কর’। কেননা জান্নাতবাসী জান্নাতী কাজের উপরেই মৃত্যুবরণ করবে, ইতিপূর্বে সে যে কাজই করুক না কেন। আর জাহান্নামী ব্যক্তি জাহান্নামের কাজের উপরেই মৃত্যুবরণ করবে। ইতিপূর্বে সে যে কাজই করুক না কেন। এ সময় রাসূল (ছাঃ) হাত দিয়ে ইশারা করলেন ও খাতা দু’টি ফেলে দিয়ে বললেন, তোমাদের পালনকর্তা তার বান্দাদের ব্যাপারে কাজ শেষ করে ফেলেছেন। অতঃপর তিনি নিম্নের আয়াতটি পাঠ করলেন, فَرِيْقٌ فِي الْجَنَّةِ وَفَرِيْقٌ فِي السَّعِيْرِ ‘একদল জান্নাতের জন্য ও একদল জাহান্নামের জন্য’।[6]
আবুদ্দারদা (রাঃ) হ’তে মরফূ বর্ণনা এসেছে كُلُّ امْرِئٍ مُهَيَّأٌ لِمَا خُلِقَ لَهُ ‘প্রত্যেক মানুষকে প্রস্ত্তত করা হয়েছে, যেজন্য তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে’।[7]
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন, প্রতিদিন সকালে দু’জন ফেরেশতা অবতরণ করেন। যাদের একজন বলেন, اَللَّهُمَّ أَعْطِ مُنْفِقًا خَلَفًا ‘হে আল্লাহ! তুমি দাতাকে প্রতিদান দাও। অপরজন বলেন, اَللَّهُمَّ أَعْطِ مُمْسِكًا تَلَفًا ‘হে আল্লাহ! তুমি কৃপণকে ধ্বংস কর’।[8] একই মর্মে আবুদ্দারদা (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে, দু’জন ফেরেশতা চিৎকার দিয়ে বলেন, যা জিন ও ইনসান ব্যতীত অন্য সকলে শুনতে পায়। অতঃপর উক্ত বিষয়ে নাযিল হয় আলোচ্য ৫-১০ আয়াতগুলি ( (فَأَمَّا مَنْ أَعْطَى الخ।[9]
(১১) وَمَا يُغْنِيْ عَنْهُ مَالُهُ إِذَا تَرَدَّى ‘তার ধন-সম্পদ তার কোন কাজে আসবে না, যখন সে ধ্বংস হবে’। رَدِىَ يَرْدَى وتَرَدَّى অর্থ هلك ومات وسقط فى جهنم ধ্বংস হওয়া, মৃত্যুবরণ করা, জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হওয়া।
বখীলের ধন-সম্পদ যেমন তার জীবদ্দশায় কোন কাজে লাগে না, তার মৃত্যুর পরেও কোন কাজে লাগে না। কেননা মৃত্যুর পূর্বে সে মাল কমে যাওয়ার ভয়ে কোনরূপ ছাদাক্বায়ে জারিয়া করে যায় না। সে নিজের জন্য কিছু খরচ করে না, পরের জন্য তো প্রশ্নই ওঠে না। ফলে মৃত্যুর পরে সে কিছুই পায় না। তার আমলনামা শূন্য থাকে। আল্লাহ বলেন, سَيُطَوَّقُوْنَ مَا بَخِلُوْا بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ‘তারা যে বিষয়ে কৃপণতা করেছিল, ক্বিয়ামতের দিন সেগুলিই তাদের গলায় বেড়ী হবে…’ (আলে ইমরান ৩/১৮০)।
ক্বিয়ামতের দিন সে আফসোস করে বলবে, مَا أَغْنَى عَنِّي مَالِيَهْ- هَلَكَ عَنِّي سُلْطَانِيَهْ- ‘আমার মাল আমার কোন কাজে আসল না’। ‘আমার রাজনৈতিক ক্ষমতা ধ্বংস হয়েছে’ (হা-ক্কাহ ৬৯/২৮-২৯)। আবু যর গেফারী (রাঃ) বলেন, একদিন রাসূল (ছাঃ) কা‘বা গৃহের ছায়ায় বসেছিলেন। এমন সময় আমাকে দেখে তিনি বললেন, هُمُ الأَخْسَرُوْنَ وَرَبِّ الْكَعْبَةِ ‘কা‘বার মালিকের কসম! অধিক ধনশালীরা ক্ষতিগ্রস্ত। তিনি বলেন, এরা ক্বিয়ামতের দিন নিঃস্ব হবে। কেবল তারা ব্যতীত, যারা নেকীর কাজে ছাদাক্বা করেছে’।[10] তিনি বলেন, তুমি ছাদাক্বা কর যখন তুমি সুস্থ, লোভী, দারিদ্র্যভীরু ও ধনী হওয়ার আকাংখী থাক। মৃত্যু ওষ্ঠাগত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করো না।[11] তিনি আরও বলেন, لاَ يَجْتَمِعُ الشُّحُّ وَالإِيْمَانُ فِى قَلْبِ عَبْدٍ أَبَدًا ‘কৃপণতা ও ঈমান কোন বান্দার অন্তরে কখনো একত্রিত হ’তে পারে না’।[12] আল্লাহ বলেন, أَنْفِقْ يَا ابْنَ آدَمَ أُنْفِقْ عَلَيْكَ ‘হে আদম সন্তান! তুমি দান কর। আমি তোমাকে দান করব’।[13] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,أَنْفِقِى وَلاَ تُحْصِى فَيُحْصِىَ اللهُ عَلَيْكِ، وَلاَ تُوعِى فَيُوعِىَ اللهُ عَلَيْكِ ارْضَخِيْ مَا اسْتَطَعْتِ ‘তুমি দান কর। গণনা করো না। তাহ’লে আল্লাহ তোমাকে দান করার সময় গণনা করবেন। ধরে রেখ না। তাহ’লে আল্লাহ তোমার ব্যাপারে (রহমতকে) ধরে রাখবেন। অতএব অল্প হলেও তুমি সাধ্যমত দান কর’।[14] তিনি বলেন, তোমরা ছাদাক্বা কর। কেননা এমন একটি যামানা তোমাদের নিকট আসছে, যখন মানুষ ছাদাক্বা নিয়ে ঘুরবে। কিন্তু তা নেওয়ার মত লোক পাবে না। তারা বলবে, গতকাল পেলে নিতাম, আজ আমার প্রয়োজন নেই’।[15]
(১২) إِنَّ عَلَيْنَا لَلْهُدَى ‘নিশ্চয়ই আমাদের দায়িত্ব হ’ল পথ প্রদর্শন করা’।
অর্থাৎ আমাদের দায়িত্ব হ’ল ভ্রান্ত পথ হ’তে সঠিক পথ বাৎলে দেয়া। হারাম-হালাল ব্যাখ্যা দেয়া। ভবিষ্যৎ ভাল-মন্দ পথ সুস্পষ্ট করে দেয়া। যেমন আল্লাহ বলেন, شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِيْ أُنْزِلَ فِيْهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِّنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ ‘রামাযান মাস যাতে কুরআন নাযিল হয়েছে। মানবজাতির পথপ্রদর্শক হিসাবে এবং হেদায়াতের ব্যাখ্যা হিসাবে এবং হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্যকারী হিসাবে…’ (বাক্বারাহ ২/১৮৫)। অন্যত্র তিনি বলেন, إِنَّا هَدَيْنَاهُ السَّبِيْلَ إِمَّا شَاكِراً وَّإِمَّا كَفُوْرًا- ‘আমরা তাকে পথ প্রদর্শন করেছি। এক্ষণে সে কৃতজ্ঞ বা অকৃতজ্ঞ হ’তে পারে’ (দাহর ৭৬/৩)।
বস্ত্ততঃ পথ প্রদর্শনের জন্যই আল্লাহ যেমন রাসূল পাঠিয়েছেন, তেমনি তাঁর সাথে কুরআন ও হাদীছ প্রেরণ করেছেন (নাজম ৫৩/৩-৪; ক্বিয়ামাহ ৭৫/১৬-১৯)। বিদায় হজ্জের ভাষণে রাসূল (ছাঃ) এ দু’টি বস্ত্তকে কঠিনভাবে আঁকড়ে থাকার জন্য উম্মতে মুহাম্মাদীকে অছিয়ত করে গেছেন।[16] কুরআন ও সুন্নাহ তাই রাসূল (ছাঃ)-এর রেখে যাওয়া দুই জীবন্ত মু‘জেযা হিসাবে ক্বিয়ামত পর্যন্ত মানবজাতিকে অন্ধকারে চলার পথে ধ্রুবতারার ন্যায় সঠিক পথ প্রদর্শন করে যাবে।
অত্র আয়াতে একথা স্পষ্ট হয় যে, আল্লাহর দেখানো পথই প্রকৃত সুপথ এবং মানুষের জ্ঞান কখনোই চূড়ান্ত সত্যের সন্ধান দিতে পারে না বা সত্যিকারের সুপথ প্রদর্শন করতে পারে না। এজন্য আল্লাহ নিজেই মানুষের হেদায়াতের দায়িত্ব নিয়েছেন। ‘হেদায়াত’ দু’প্রকারের। ১. তাওফীক লাভের হেদায়াত (هدى التوفيق)। যা কেবলমাত্র আল্লাহর হাতে। ২. পথ দেখানোর হেদায়াত (هدى إرشاد)। যা আল্লাহ এবং নবী-রাসূল ও আলেমগণের পক্ষ হ’তে হয়ে থাকে। প্রথমটির দলীল, যেমন আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে বলেন, إِنَّكَ لاَ تَهْدِي مَنْ أَحْبَبْتَ وَلَكِنَّ اللهَ يَهْدِي مَن يَّشَاءُ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِيْنَ ‘নিশ্চয়ই তুমি হেদায়াত করতে পারো না যাকে তুমি পসন্দ কর। বরং আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন হেদায়াত দিয়ে থাকেন’ (ক্বাছাছ ২৮/৫৬)। দ্বিতীয়টির দলীল, যেমন আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে বলেন, وَإِنَّكَ لَتَهْدِي إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيْمٍ ‘নিশ্চয়ই তুমি সরল পথ প্রদর্শন করে থাকো’ (শূরা ৪২/৫২)। আর আল্লাহ প্রদত্ত এই হেদায়াত মানুষের বিশ্বাস ও কর্মজগতের সর্বত্র রয়েছে। ইবাদাত ও মু‘আমালাত সবকিছুতেই কুরআন ও সুন্নাহর মাধ্যমে তিনি মানবজাতির জন্য হেদায়াত প্রেরণ করেছেন। একবার জনৈক মুশরিক সালমান ফারেসী (রাঃ)-কে বলে যে, قَدْ عَلَّمَكُمْ نَبِيُّكُمْ صلى الله عليه وسلم كُلَّ شَىْءٍ حَتَّى الْخِرَاءَةَ ‘তোমাদের নবী তোমাদেরকে এমনকি পায়খানার আদবও শিখিয়ে থাকেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ, তিনি আমাদের এটাও শিখিয়ে থাকেন’।[17] কেননা ইসলামই কেবলমাত্র পূর্ণাঙ্গ দ্বীন (আলে ইমরান ৩/১৯)। এতে কোন কিছুরই অপূর্ণতা নেই। আল্লাহ বলেন, وَنَزَّلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ تِبْيَانًا لِكُلِّ شَيْءٍ وَهُدًى وَرَحْمَةً وَبُشْرَى لِلْمُسْلِمِينَ ‘আমরা তোমার প্রতি কিতাব নাযিল করেছি আত্মসমর্পণকারীদের জন্য সকল বিষয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যা, পথনির্দেশ, রহমত ও সুসংবাদস্বরূপ’ (নাহল ১৬/৮৯)।
(১৩) وَإِنَّ لَنَا لَلْآخِرَةَ وَالْأُولَى ‘নিশ্চয়ই আমাদের মালিকানায় রয়েছে পরকাল ও ইহকাল’।
এখানে ‘আখেরাত’কে আগে আনা হয়েছে তার গুরুত্ব ও নিশ্চয়তা বুঝানোর জন্য। তাছাড়া দুনিয়াতে কর্তৃত্ব অনেকের থাকতে পারে। কিন্তু আখেরাতে কর্তৃত্ব এককভাবে আল্লাহর। যেমন তিনি বলেন, لِمَنِ الْمُلْكُ الْيَوْمَ ِللهِ الْوَاحِدِ الْقَهَّارِ ‘(আল্লাহ সেদিন জিজ্ঞেস করবেন) আজ কর্তৃত্ব কার? কেবলমাত্র আল্লাহর; যিনি একক ও পরাক্রমশালী’ (মুমিন/গাফের ৪০/১৬)।
অর্থাৎ আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি ও পরিচালনা এবং দুনিয়া ও আখেরাতের সার্বিক মালিকানা কেবলমাত্র আল্লাহর হাতে। এই মালিকানায় কেউ সামান্যতম শরীক নয়। আল্লাহ বলেন, فَسُبْحَانَ الَّذِيْ بِيَدِهِ مَلَكُوْتُ كُلِّ شَيْءٍ وَإِلَيْهِ تُرْجَعُوْنَ ‘অতএব পবিত্র তিনি, যার হাতে রয়েছে সবকিছুর রাজত্ব এবং তাঁর দিকেই তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে’ (ইয়াসীন ৩৬/৮৩)। বস্ত্ততঃ সুপথে চলা ও পথভ্রষ্ট হওয়ার মধ্যে আল্লাহর কোন লাভ-ক্ষতি নেই। বরং এতে কেবল বান্দারই কল্যাণ ও অকল্যাণ নিহিত রয়েছে।
(১৪) فَأَنْذَرْتُكُمْ نَارًا تَلَظَّى ‘অতএব আমি তোমাদেরকে প্রজ্বলিত অগ্নি থেকে ভয় প্রদর্শন করছি’।
لََظَى تَلْظِيَةً تَلَظَّى অর্থ تَشْتَعِلُ ‘প্রজ্বলিত হওয়া’। ‘জাহান্নামের আগুন দুনিয়ার আগুনের চাইতে ৭০ গুণ বেশী দাহিকা শক্তি সম্পন্ন’।[18] যার সর্বনিম্ন শাস্তি হ’ল, পাপীকে আগুনের জুতা ও ফিতা পরানো হবে, তাতেই তার মাথার ঘিলু টগবগ করে ফুটবে’।[19] জাহান্নামের শাস্তির ব্যাপারে কুরআন ও হাদীছে বহু বর্ণনা এসেছে।
এখানে আল্লাহ নিজেই জাহান্নামের ভয় প্রদর্শন করছেন। এর মধ্যে তিনটি বিষয় প্রতিভাত হয়। (১) জাহান্নাম যে অবধারিত সত্য সেটা দৃঢ়ভাবে বলা হয়েছে (২) এর দ্বারা জাহান্নামের শাস্তির ভয়াবহতা বুঝানো হয়েছে (৩) রাসূল (ছাঃ)-এর ভয় প্রদর্শন মূলতঃ আল্লাহরই ভয় প্রদর্শন, সেকথা বলে দেওয়া হয়েছে।
তিনি নিজে কখনো সশরীরে মানুষের কাছে এসে ভয় দেখান না। অন্যত্র ‘আমরা’ বহুবচনের পদ ব্যবহার করলেও আল্লাহ এখানে ‘আমি’ একবচন পদ ব্যবহার করেছেন দৃঢ়ভাবে একথা বলে দেওয়ার জন্য যে, রাসূল মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর মুখ দিয়ে কুরআনের যে সকল বাণী মানবজাতির উদ্দেশ্যে বর্ণিত হয়, তা সবই সরাসরি আল্লাহর বাণী। এমনকি যে সকল হাদীছ তিনি বর্ণনা করেন, মর্মগত দিক দিয়ে সেগুলিও আল্লাহর বাণী। কেননা শারঈ বিষয়ে তিনি নিজে থেকে কোন কথা বলেন না, যতক্ষণ না তাকে ‘অহি’ করা হয়। যেমন আল্লাহ বলেন,وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى، إِنْ هُوَ إِلاَّ وَحْيٌ يُّوْحَى- ‘তিনি নিজ থেকে কোন কথা বলেন না’। ‘যা বলেন তা ‘অহি’ ব্যতীত কিছুই নয়, যা তাঁর নিকটে করা হয়’ (নাজম ৫৩/৩-৪)।
আল্লাহ তাঁর রাসূলকে প্রেরণ করেছেন মানবজাতিকে জান্নাতের সুসংবাদ দানকারী ও জাহান্নামের ভয় প্রদর্শনকারী হিসাবে।[20] সেমতে মক্কায় নবুঅতী জীবনের শুরুতে যখন আল্লাহর হুকুম হ’ল, وَأَنْذِرْ عَشِيْرَتَكَ الْأَقْرَبِيْنَ ‘তুমি তোমার নিকটাত্মীয়দের ভয় প্রদর্শন কর’ (শো‘আরা ২৬/২১৪), তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সর্বপ্রথম স্বীয় আত্মীয়-পরিজনকে জাহান্নামের ভয় প্রদর্শন করেন। ছাফা পাহাড়ের পাদদেশে সবাইকে ডেকে তিনি বলেন,
يَا مَعْشَرَ قُرَيْشٍ أَنْقِذُوْا أَنْفُسَكُمْ مِنَ النَّارِ يَا بَنِىْ كَعْبِ بْنِ لُؤَىٍّ أَنْقِذُوْا أَنْفُسَكُمْ مِنَ النَّارِ يَا بَنِىْ عَبْدِ مَنَافٍ أَنْقِذُوْا أَنْفُسَكُمْ مِنَ النَّارِ يَا بَنِىْ هَاشِمٍ أَنْقِذُوْا أَنْفُسَكُمْ مِنَ النَّارِ يَا بَنِىْ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ أَنْقِذُوْا أَنْفُسَكُمْ مِنَ النَّارِ يَا عَبَّاسُ بْنَ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ لاَ أُغْنِى عَنْكَ مِنَ اللهِ شَيْئًا يَا فَاطِمَةُ بِنْتَ مُحَمَّدٍ أَنْقِذِىْ نَفْسَكِ مِنَ النَّارِ فَإِنِّىْ لاَ أَمْلِكُ لَكُمْ مِنَ اللهِ شَيْئاً غَيْرَ أَنَّ لَكُمْ رَحِماً سَأَبُلُّهَا بِبَلاَلِهَا –
‘হে কুরায়েশগণ! তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও! হে বনু কা‘ব বিন লুআই! তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও! হে বনু আবদে মানাফ! তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও! হে বনু হাশেম! তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও! হে বনু আব্দিল মুত্ত্বালিব! তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও! হে আববাস বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব! আমি তোমাকে আল্লাহর কবল থেকে কোনই কাজে আসব না। হে মুহাম্মাদের কন্যা ফাতেমা! তুমি নিজেকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও! কেননা আমি তোমাদের কাউকে আল্লাহর পাকড়াও হ’তে রক্ষা করতে পারব না’। তবে তোমাদের সঙ্গে আত্মীয়তার যে সম্পর্ক রয়েছে, তা আমি (দুনিয়াতে) সদ্ব্যবহার দ্বারা সিক্ত করব’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, يَا فَاطِمَةُ بِنْتَ مُحَمَّدٍ سَلِيْنِىْ مَا شِئْتِ مِنْ مَالِىْ وَلاَ أُغْنِى عَنْكِ مِنَ اللهِ شَيْئًا ‘হে মুহাম্মাদের কন্যা ফাতেমা! তুমি আমার মাল-সম্পদ থেকে যা খুশী নাও। কিন্তু আল্লাহর পাকড়াও থেকে আমি তোমাকে রক্ষা করতে পারব না’।[21] অন্য বর্ণনায় এসেছে, إلا أنْ تَقُوْلُوْا لآ إله إلا الله ‘তবে যদি তোমরা বল, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই’ (বায়হাক্বী, দালায়েলুন নবুঅত ১/৬৪)।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর এই ভয় প্রদর্শন মাদানী জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। সর্বদা তিনি মানুষকে জাহান্নাম থেকে বাঁচার আহবান জানাতেন। নু‘মান বিন বাশীর (রাঃ) বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-কে (জুম‘আর) খুৎবায় বলতে শুনেছি أَنْذَرْتُكُمْ النَّارَ أَنْذَرْتُكُمْ النَّارَ أَنْذَرْتُكُمْ النَّارَ ‘আমি তোমাদের জাহান্নামের ভয় দেখাচ্ছি, আমি তোমাদের জাহান্নামের ভয় দেখাচ্ছি, আমি তোমাদের জাহান্নামের ভয় দেখাচ্ছি’। রাবী বলেন, তিনি কথাগুলি এত জোরে জোরে বলেন যে, لَوْ أَنَّ رَجُلاً كَانَ بِالسُّوْقِ لَسَمِعَهُ مِنْ مَقَامِيْ هَذَا ‘যদি কোন লোক বাজারে থাকে, তাহ’লে আমার এই স্থান থেকে সে শুনতে পেত’। তিনি বলেন, এই সময় তাঁর কাঁধের চাদর নীচে পায়ের কাছে পড়ে যায়। রাবী বলেন, ঐ খুৎবায় রাসূল (ছাঃ) একথাও বলেন,
إِنَّ أَهْوَنَ أَهْلِ النَّارِ عَذَابًا مَنْ لَهُ نَعْلاَنِ وَشِرَاكَانِ مِنْ نَارٍ يَغْلِي مِنْهُمَا دِمَاغُهُ كَمَا يَغْلِى الْمِرْجَلُ مَا يَرَى أَنَّ أَحَدًا أَشَدُّ مِنْهُ عَذَابًا وَإِنَّهُ لَأَهْوَنُهُمْ عَذَابًا-
‘জাহান্নামীদের মধ্যে সবচেয়ে কম শাস্তিপ্রাপ্ত হবে তারাই, যাদের দু’পায়ের জুতা ও ফিতা আগুনের হবে। যার কঠিন তাপে তার মস্তিষ্কের ঘিলু টগবগ করে ফুটবে, যেমনভাবে উত্তপ্ত ডেগের ফুটন্ত পানি টগবগ করে ফুটে থাকে। সে ভাববে যে তার চাইতে কঠিন শাস্তি কারু হচ্ছে না। অথচ এটাই হ’ল সবচেয়ে হালকা শাস্তি’।[22]
(১৫-১৬) لاَ يَصْلاَهَا إِلاَّ الْأَشْقَى، الَّذِيْ كَذَّبَ وَتَوَلَّى ‘যাতে প্রবেশ করবে না হতভাগা ব্যতীত’। ‘যে মিথ্যারোপ করে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়’।
পূর্বের আয়াতে الْأَتْقَى -এর বিপরীতে এখানে الْأَشْقَى এসেছে। অর্থাৎ সর্বাধিক হতভাগা। যাদের জন্য জাহান্নাম নির্ধারিত হয়ে আছে। তাদের বৈশিষ্ট্য হ’ল كَذَّبَ بالخبر وَتَوَلَّى عن الأمر ‘সে প্রথমে অহি-র বিধানে মিথ্যারোপ করে, অতঃপর বিধান মান্য করা থেকে পিঠ ফিরিয়ে নেয়’।
আবু জাহল, উমাইয়া বিন খালাফ ও তাদের ন্যায় দুষ্টু লোকদের উদ্দেশ্যে আয়াতটি নাযিল হয় (কুরতুবী)। কেননা এরা ছিল মক্কার সবচেয়ে দুরাচার নেতৃবৃন্দ। যারা রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি মিথ্যারোপ করেছিল এবং তাঁকে সত্য জেনেও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। তবে আয়াতটির মর্ম সকল যুগের হতভাগাদের জন্য প্রযোজ্য। আল্লাহ বলেন,فَأَمَّا الَّذِيْنَ شَقُوا فَفِي النَّارِ ‘অতঃপর যারা দুর্ভাগা হবে, তারা জাহান্নামে যাবে’ (হূদ ১১/১০৬)। وَأَمَّا الَّذِينَ سُعِدُوا فَفِي الْجَنَّةِ ‘পক্ষান্তরে যারা ভাগ্যবান হবে, তারা জান্নাতে যাবে’ (হূদ ১১/১০৮)।
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, كُلُّ أُمَّتِى يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ ، إِلاَّ مَنْ أَبَى. قَالُوا يَا رَسُولَ اللهِ وَمَنْ يَأْبَى؟ قَالَ : مَنْ أَطَاعَنِى دَخَلَ الْجَنَّةَ، وَمَنْ عَصَانِى فَقَدْ أَبَى- ‘আমার সকল উম্মত জান্নাতে প্রবেশ করবে কেবল তারা ব্যতীত যারা অস্বীকার করে। ছাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! কারা অস্বীকার করে? রাসূল (ছাঃ) বললেন, যারা আমার আনুগত্য করে, তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যারা আমার অবাধ্যতা করে, তারাই অস্বীকার করে’।[23]
আবু ইসহাক আয-যাজ্জাজ বলেন, মুর্জিয়াগণ এই আয়াতকে দলীলরূপে গ্রহণ করে বলে থাকে যে, لا يدخل النار إلا كافر ‘জাহান্নামে কেবল কাফেররাই প্রবেশ করবে’। মুমিনরা নয়। কেননা তাদের নিকট হৃদয়ে বিশ্বাস অথবা মুখে স্বীকৃতিই মুমিন হওয়ার জন্য যথেষ্ট। আমল শর্ত নয়। কারণ আমল ঈমানের অংশ নয়’। অথচ এই আয়াত থেকে তাদের দলীল নেবার কোন সুযোগ নেই। কেননা জাহান্নামীদের বিভিন্ন স্তর রয়েছে। তার মধ্যে একটি হ’ল মুনাফিকদের জন্য। যারা জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে থাকবে (নিসা ৪/১৪৫)। আল্লাহপাক জাহান্নামীদের নানাবিধ শাস্তির কথা বলেছেন। আল্লাহ যার জন্য যেরূপ শাস্তি নির্ধারণ করবেন, তাকে সেভাবেই শাস্তি দিবেন। আল্লাহ বলেছেন, শিরকের গোনাহ তিনি মাফ করবেন না। এছাড়া বাকী সকল গোনাহ তিনি যাকে ইচ্ছা মাফ করবেন (নিসা ৪/৪৮,১১৬)। এক্ষণে ঐসব পাপী যারা শিরক করেনি, তাদের কারু যদি পাপের শাস্তি তিনি না দিবেন, তাহ’লে ‘তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করবেন’ বলার তো কোন অর্থ হয় না’ (কুরতুবী)। অতএব প্রকৃত কথা এই যে, কবীরা গোনাহগার মুমিন যদি তওবা না করে মারা যায়, তাহ’লে পাপের শাস্তিস্বরূপ সে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর শাফা‘আতে এবং আল্লাহর বিশেষ রহমতে তারা পরবর্তীতে ক্রমে ক্রমে মুক্তি পেয়ে জান্নাতে যাবে তাদের খালেছ ঈমানের বদৌলতে, যদি সেটা থাকে।
ক্বাতাদাহ বলেন, كَذَّبَ وَتَوَلَّى অর্থ كذب بكتاب الله وتولى عن طاعة الله ‘সে আল্লাহর কিতাবে মিথ্যারোপ করে ও আল্লাহর আনুগত্য হ’তে মুখ ফিরিয়ে নেয়’। ফার্রা বলেন, لم يكن كذب بردّ ظاهر، ولكن قصر عما أمر به من الطاعة ‘প্রকাশ্যে রদ করার মাধ্যমে সে মিথ্যারোপ করে না। বরং আল্লাহর আদিষ্ট বিষয়সমূহ মান্য করতে কছূর করার ফলে তা মিথ্যারোপ হিসাবে সাব্যস্ত হয়ে যায়’ (কুরতুবী)। বর্তমান যুগে অধিকাংশ মুসলিম সরকার ও সমাজনেতাগণ এটাই করে থাকেন।
(১৭) وَسَيُجَنَّبُهَا الْأَتْقَى ‘সত্বর এ থেকে দূরে রাখা হবে আল্লাহভীরু ব্যক্তিকে’।
الْأَتْقَى আধিক্য জ্ঞাপক বিশেষ্য (اسم تفضيل) হয়েছে تقوى থেকে। যার অর্থ সর্বাধিক আল্লাহভীরু। এর দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে, জাহান্নাম থেকে দূরে রাখা হবে শুদ্ধ চরিত্র সর্বাধিক আল্লাহভীরু ব্যক্তিকে। এতে বুঝা যায় যে, কেবল ঈমান আনলেই সে জাহান্নাম থেকে দূরে থাকবে না। বরং তাকে যথার্থভাবে মুত্তাক্বী হ’তে হবে। সেকারণ ঈমানদারগণকে ডাক দিয়ে আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا اتَّقُوا اللهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلاَ تَمُوْتُنَّ إِلاَّ وَأَنْتُمْ مُّسْلِمُوْنَ- ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর যথার্থ ভয়। আর অবশ্যই তোমরা মরো না সত্যিকারের মুসলিম না হয়ে’ (আলে ইমরান ৩/১০২)।
বিশ্বাস, আল্লাহভীতি ও কর্মে বাস্তবায়ন- তিনটি বিষয়কে এখানে একত্রিত করে বলা হয়েছে। যাতে বুঝা যায় যে, শুধু বিশ্বাস দিয়ে আমল হয় না, বরং আমলের জন্য চাই আল্লাহভীতি। বিশ্বাস আছে কিন্তু আল্লাহভীতি নেই, সে ব্যক্তির আমলে খুলূছিয়াত নেই। অতএব তাকে জাহান্নাম থেকে দূরে রাখা হবে না।
(১৮) الَّذِيْ يُؤْتِيْ مَالَهُ يَتَزَكَّى ‘যে তার ধন-সম্পদ দান করে আত্মশুদ্ধির জন্য’।
زَكَّى تَزْكِيَةً ‘পবিত্র করা’ সেখান থেকে يَتَزَكَّى ‘সে পবিত্রতা অর্জন করে’। অর্থাৎ যে ব্যক্তি তার মাল-সম্পদ খরচ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে তাঁরই দেখানো পথে আত্মশুদ্ধি ও মালশুদ্ধির জন্য। এর মধ্যে কোনরূপ শ্রুতি বা লোক দেখানো উদ্দেশ্য থাকে না। আল্লাহ বলেন, خُذْ مِنْ أَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَتُزَكِّيهِمْ بِهَا وَصَلِّ عَلَيْهِمْ إِنَّ صَلاَتَكَ سَكَنٌ لَهُمْ وَاللهُ سَمِيْعٌ عَلِيْمٌ ‘(হে রাসূল!) তুমি তাদের ধন-সম্পদ হ’তে যাকাত গ্রহণ কর, যা দ্বারা তুমি তাদের পবিত্র করবে ও পরিশুদ্ধ করবে এবং তুমি তাদের জন্য দো‘আ কর। নিশ্চয়ই তোমার দো‘আ তাদের জন্য প্রশান্তির কারণ। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’ (তওবা ৯/১০৩)। এর মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে যে, ঐ ব্যক্তি অপচয় করে না বা কার্পণ্য করে না। বরং মালশুদ্ধির জন্য আল্লাহর পথে ব্যয় করে। যেমন আল্লাহ বলেন, وَالَّذِيْنَ إِذَا أَنْفَقُوا لَمْ يُسْرِفُوا وَلَمْ يَقْتُرُوا وَكَانَ بَيْنَ ذَلِكَ قَوَامًا ‘আর যখন তারা ব্যয় করে তখন তারা অপব্যয় করে না এবং কার্পণ্য করে না। বরং তারা এতদুভয়ের মধ্যম পন্থায় থাকে’ (ফুরক্বান ২৫/৬৭)।
(১৯) وَمَا لِأَحَدٍ عِنْدَهُ مِنْ نِّعْمَةٍ تُجْزَى ‘এবং কারু জন্য তার নিকটে কোনরূপ অনুগ্রহ থাকে না যা প্রতিদান যোগ্য’।
جَزَى يَجْزِى جَزَاءً ‘বদলা দেওয়া, যথেষ্ট হওয়া’। অর্থাৎ কারু কোনরূপ অনুগ্রহ বা দানের প্রতিদান হিসাবে তিনি দান করেন না বা কারু প্রতি কোন অনুগ্রহের দায়বদ্ধতা তার মধ্যে থাকে না।
ইবনু মাসঊদ, ইবনু আববাস, ইবনু যুবায়ের ও অধিকাংশ মুফাসসিরের মতে আয়াতগুলি আবুবকর (রাঃ) সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। তারা বলেন যে, উমাইয়া ইবনে খালাফের ক্রীতদাস ছিলেন বেলাল বিন রাবাহ। ইসলাম কবুলের অপরাধে তাঁর উপরে অমানুষিক নির্যাতন চালানো হ’ত। প্রচন্ড রোদে স্ফুলিঙ্গ সদৃশ মরু বালুকার উপরে হাত-পা বেঁধে তাকে নগ্নদেহে চিৎ করে ফেলে বুকের উপরে ভারি পাথর চাপিয়ে দেয়া হ’ত। আর বলা হ’ত لاَ تَزَالُ هَكَذَا حَتَّى تَمُوْتَ أَوْ تَكْفُرَ بِمُحَمَّدٍ ‘তোকে এভাবেই থাকতে হবে, যতক্ষণ না তুই মরবি অথবা মুহাম্মাদকে অস্বীকার করবি’। কিন্তু ঐ অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যেও বেলালের মুখ থেকে কেবলি বের হ’ত ‘আহাদ’ ‘আহাদ’। একদিন রাসূল (ছাঃ) পাশ দিয়ে যাবার সময় এই দৃশ্য দেখলেন এবং বললেন, أَحَدٌ يُنْجِيْكَ ‘নিশ্চয়ই ‘আহাদ’ অর্থাৎ আল্লাহ তোমাকে মুক্তি দেবেন’। তিনি আবুবকরকে যেয়ে বললেন, يَا أَبَا بَكْرٍ إِنَّ بِلاَلاً يُعَذَّبُ فِي اللهِ ‘হে আবুবকর! নিশ্চয়ই বেলাল আল্লাহর পথে শাস্তি ভোগ করছে’। আবুবকর ইঙ্গিত বুঝলেন। অতঃপর তিনি উমাইয়া বিন খালাফের কাছ থেকে তার দাবী অনুযায়ী নিজের ‘কাফের’ গোলাম ‘নিসতাস’ (نسطاس) -এর বিনিময়ে এবং একটি মূল্যবান চাদর ও ১০টি স্বর্ণমুদ্রার (উক্বিয়া) বিনিময়ে বেলালকে খরিদ করে মুক্ত করে দেন। তখন কাফেররা বলতে থাকে যে, আবুবকরের উপরে বেলালের অনুগ্রহ ছিল, যার প্রতিদান হিসাবে তিনি তাকে মুক্ত করেছেন। তখন অত্র আয়াতদ্বয় নাযিল হয়।[24] ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) বলতেন, أَبُو بَكْرٍ سَيِّدُنَا، وَأَعْتَقَ سَيِّدَنَا. يَعْنِى بِلاَلاً ‘আমাদের নেতা আবুবকর মুক্ত করেছেন আমাদের নেতাকে’। এর দ্বারা তিনি বেলালকে বুঝাতেন’।[25] বেলালসহ বহু দাস-দাসীকে মুক্ত করার প্রশংসা করে আম্মার বিন ইয়াসির (রাঃ) যে কবিতা রচনা করেন, তার প্রথম লাইন ছিল নিম্নরূপ :
جَزَى اللهُ خَيْرًا عَنْ بِلاَل وَصَحْبِهِ + عَتِيْقًا وَأَخْزَىْ فَاكِهًا وَأَبَا جَهْلٍ
‘বেলাল ও তার সাথীদের পক্ষ হ’তে আল্লাহ উত্তম জাযা দান করুন আবুবকরকে এবং তিনি লজ্জিত করুন উমাইয়া বিন খালাফ ও আবু জাহলকে’ (তানতাভী)। তবে এটা নিঃসন্দেহ যে, নাযিলের কারণ যেটাই হৌক না কেন, এর বক্তব্য সকল নিঃস্বার্থ দানশীল মুমিনের জন্য।
একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য যে, ওমর ফারূক (রাঃ) এখানে খলীফাতুল মুসলেমীন হযরত আবুবকর (রাঃ) এবং কৃষ্ণাঙ্গ দাস বেলাল (রাঃ) উভয়কে ‘সাইয়িদুনা’ (আমাদের নেতা) বলেছেন। এতেই বুঝা যায়, ইসলাম মানুষের অন্তরে কেমন প্রভাব বিস্তার করেছিল যে, নিমেষে মনিব ও ক্রীতদাসকে এক আল্লাহর দাসত্বের অধীনে সমান মর্যাদায় আসীন করে দিয়েছিল। ফালিল্লাহিল হাম্দ।
(২০) إِلاَّ ابْتِغَاءَ وَجْهِ رَبِّهِ الْأَعْلَى ‘কেবলমাত্র তার মহান পালনকর্তার চেহারা অন্বেষণ ব্যতীত’।
জান্নাতে মুমিনগণ আল্লাহকে চাক্ষুষ দেখবেন, এখানে সেকথার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। এমর্মে কুরআনে বহু আয়াত ও বহু ছহীহ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে।[26]
ইবনু কাছীর বলেন, أَيْ طَمَعًا فِي أَنْ يَحْصُلَ لَهُ رُؤْيَتُهُ فِي الدَّارِ الْآخِرَةِ فِي رَوْضَاتِ الْجَنَّاتِ ‘অর্থাৎ ঐ ব্যক্তি দান করে কেবলমাত্র এই আকাংখায় যেন আখেরাতে জান্নাতের বাগিচায় তার জন্য আল্লাহর দর্শন লাভের সৌভাগ্য হয়’। পক্ষান্তরে কুরতুবী ব্যাখ্যা করেছেন, أى ابْتِغَاءَ مَرْضَاتِهِ وَمَا يُقَرَّبُ مِنْهُ ‘আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনায় এবং তাঁর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে’।
জালালায়েন ব্যাখ্যা করেছেন, طَلَبَ ثَوَابِ اللهِ ‘আল্লাহর ছওয়াব লাভের জন্য’।[27]
বলা আবশ্যক যে, ইবনু কাছীর-এর তাফসীরে আহলে সুন্নাতের আক্বীদা এবং কুরতুবী ও জালালায়েন-এর তাফসীরে ভ্রান্ত ফের্কা মু‘তাযেলী আক্বীদার প্রতিফলন ঘটেছে। যারা আল্লাহর নিরেট একত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে তাঁকে নাম ও গুণহীন সত্তা মনে করেন। তাদের মতে আল্লাহর নাম ও নামীয় সত্তা পৃথক। আল্লাহর সাথে তাঁর গুণাবলীকে ক্বাদীম বা সনাতন মনে করলে সেটা ‘শিরক’ হবে। এইসব বক্তব্যের পিছনে তাদের কাছে কোন দলীল নেই, যুক্তিও নেই। কেননা ফুল থেকে তার সুগন্ধিকে যেমন পৃথক করা যায় না, আল্লাহর সত্তা থেকে তাঁর গুণাবলীকে তেমনি পৃথক করা যায় না। আর এটা শিরক হবার প্রশ্নই ওঠে না। তারা ‘আল্লাহর চেহারা’-কে আল্লাহর সন্তুষ্টি হিসাবে ব্যাখ্যা করে থাকেন। ক্বিয়ামতের দিন জান্নাতী মুমিনগণ আল্লাহকে স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করবেন। যেমন মেঘমুক্ত রাতে পূর্ণিমার চাঁদকে স্পষ্ট দেখা যায়- মর্মের ছহীহ হাদীছসমূহকে তারা বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে দূরতম ব্যাখ্যা করেন। একইভাবে কুরআনে বর্ণিত আল্লাহর হাত, পা, চেহারা ইত্যাদিসহ অন্যান্য গুণবাচক আয়াতসমূহের বিভিন্ন কাল্পনিক ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন। তাদের এই যুক্তিবাদের বেড়াজালে আটকে গেছেন বিগত ও বর্তমান যুগের অসংখ্য মুফাসসিরে কুরআন। অথচ এ বিষয়ে বিশুদ্ধ আক্বীদা হ’ল আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত আহলেহাদীছের আক্বীদা। আর তা হ’ল এই যে, পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছসমূহে আল্লাহর গুণবাচক বিষয়সমূহ যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, সেভাবেই প্রকাশ্য অর্থে বিশ্বাস করা। অর্থাৎ আল্লাহর চেহারা ও তাঁর আকৃতি তেমন, যেমন তাঁর মহান সত্তার উপযুক্ত এবং যা তিনি নিজের জন্য নির্ধারণ করেছেন (ما يليق بشأنه وما يختص لنفسه)। এটি গায়েবী বিষয়। এখানে কল্পনার কোন সুযোগ নেই। ইবনু কাছীরের তাফসীরের মধ্যে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আক্বীদার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। বলা বাহুল্য, বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রায় সকল তাফসীরে আল্লাহর গুণবাচক আয়াতসমূহের ব্যাখ্যায় মু‘তাযেলীদের অনুসরণ করা হয়েছে।[28]
(২১) وَلَسَوْفَ يَرْضَى ‘আর অবশ্যই সে অচিরেই সন্তোষ লাভ করবে’।
অর্থাৎ যে ব্যক্তি পূর্বে বর্ণিত গুণাবলী অর্জন করবে, সে ব্যক্তি সত্বর আল্লাহর সন্তোষ লাভে ধন্য হবে। আর তা হ’ল- (ক) সর্বাধিক আল্লাহভীরু হওয়া এবং (খ) স্রেফ আত্মশুদ্ধি ও মালশুদ্ধির জন্য আল্লাহর ওয়াস্তে ব্যয় করা’। এখানে سوف এসেছে تحقيق বা নিশ্চয়তাবোধক অর্থে। অর্থাৎ অবশ্যই সে অচিরে আল্লাহর সন্তোষভাজন হবে অশেষ ছওয়াব লাভের মাধ্যমে। যেমন তিনি বলেন, مَثَلُ الَّذِينَ يُنْفِقُونَ أَمْوَالَهُمْ فِي سَبِيلِ اللهِ كَمَثَلِ حَبَّةٍ أَنْبَتَتْ سَبْعَ سَنَابِلَ فِي كُلِّ سُنْبُلَةٍ مِائَةُ حَبَّةٍ وَاللهُ يُضَاعِفُ لِمَنْ يَشَاءُ وَاللهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ- ‘যারা আল্লাহর পথে স্বীয় ধন-সম্পদ ব্যয় করে, তাদের উপমা যেমন একটি শস্যবীজ, যা থেকে উৎপন্ন হ’ল সাতটা শিষ, প্রত্যেক শিষে উৎপন্ন হ’ল একশ’ শস্যদানা। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাকে আরো বর্ধিত করে দেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ প্রশস্ত দাতা ও সর্বজ্ঞ’ (বাক্বারাহ ২/২৬১)। বস্ত্ততঃ আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করার চূড়ান্ত প্রতিদান হ’ল আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।
ইবনু কাছীর বলেন, একাধিক মুফাসসিরের মতে অত্র আয়াতগুলি হযরত আবুবকর (রাঃ)-এর শানে নাযিল হয়েছে। অনেকে এ বিষয়ে ‘ইজমা’ দাবী করেছেন। তবে এটা নিশ্চিত যে, তিনি এর মধ্যে শামিল আছেন। যদিও আয়াতের মর্ম ব্যাপক এবং সর্বযুগীয়। নিঃসেন্দেহে আবুবকর (রাঃ)-এর মহান চরিত্রে উপরোক্ত গুণাবলীর একত্র সমাবেশ ঘটেছিল। আল্লাহভীরুতা ও নিঃস্বার্থ দানশীলতায় তিনি ছিলেন উম্মতের সেরা ব্যক্তিত্ব। ছাক্বীফ গোত্রের নেতা ওরওয়া ইবনে মাসঊদের মত আরবের কাফের নেতারা হুদায়বিয়ার সন্ধিকালে প্রকাশ্যে সেকথা স্বীকার করেছিলেন (ইবনু কাছীর)। এটা যদি হয় শত্রুপক্ষের নেতাদের স্বীকারোক্তি, তাহ’লে অন্যদের স্বীকৃতি কেমন ছিল তা বুঝতে কষ্ট হয় না।
শেষের আয়াতটিতে যেন হযরত আবুবকর (রাঃ)-এর জন্য জান্নাতের অগ্রিম সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে। যেমন আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, مَنْ أَنْفَقَ زَوْجَيْنِ مِنْ شَىْءٍ مِنَ الْأَشْيَاءِ فِىْ سَبِيْلِ اللهِ دُعِىَ مِنْ أَبْوَابِ الْجَنَّةِ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় কোন বস্ত্তর একটি জোড়া দান করবে, উক্ত ব্যক্তি জান্নাতের সকল দরজা থেকে আহূত হবে (যেমন মুছল্লী, মুজাহিদ, দাতা ও ছায়েমদের দরজা)। আবুবকর বললেন, সকল দরজা দিয়ে আহবানের প্রয়োজন নেই (একটি দরজাই যথেষ্ট)। তবে আসলে কি কেউ সকল দরজা দিয়ে আহূত হবে? রাসূল (ছাঃ) বললেন, نَعَمْ، وَأَرْجُوْ أَنْ تَكُوْنَ مِنْهُمْ ‘হ্যাঁ, আমি আশা করি তুমি তাদের অন্তর্ভুক্ত হবে’।[29] আল্লাহ আমাদেরকে ঐ সকল পবিত্রাত্মাগণের সাথে জান্নাতের অধিবাসী করুন -আমীন!
সারকথা :
আল্লাহ জান্নাত ও জাহান্নামের জন্য দু’ধরনের মানুষ সৃষ্টি করেছেন। ফলে প্রত্যেকে সেই কাজ সহজে করে, যে কাজের জন্য তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে।
[22]. মুসলিম হা/২১৩, বুখারী হা/৬৫৬১, হাকেম ১/২৮৭ ‘জুম‘আ’ অধ্যায়; মিশকাত হা/৫৬৬৭ ‘জাহান্নাম ও তার অধিবাসীদের বর্ণনা’ অনুচ্ছেদ।
[27]. ‘জালালায়েন’ অর্থ দুই জালাল। অর্থাৎ জালালুদ্দীন সৈয়ূতী (৮৪৯-৯১১ হি:), যিনি সূরা বাক্বারাহর শুরু থেকে সূরা বনু ইস্রাঈলের শেষ পর্যন্ত তাফসীর করেছেন। দ্বিতীয়জন হ’লেন জালালুদ্দীন মাহাল্লী (৭৯১-৮৬৪ হি:), যিনি সূরা কাহফের শুরু থেকে সূরা নাস পর্যন্ত তাফসীর করেছেন। উভয়ে মিসরীয় শাফেঈ ছিলেন। দু’জনের তাফসীরের ধারা একই এবং আল্লাহর গুণাবলীর ক্ষেত্রে উভয়ের আক্বীদা মু‘তাযেলীদের অনুরূপ। যদিও ইমাম শাফেঈ (রহঃ) জান্নাতে আল্লাহ দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন।
[28]. (ক) মাওলানা মওদূদী তাফহীমুল কুরআনে অত্র আয়াতের অনুবাদ করেছেন, اپنے بر تركي رضاجوئ كيلئے (নিজের রবের সন্তুষ্টি লাভের জন্য)। (খ) ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা এবং (গ) মাওলানা মহিউদ্দীন খান মা‘আরেফুল কুরআনে একই মর্মের অনুবাদ করেছেন, যা ভুল। (ঘ) ড. মুজীবুর রহমান তাফসীর ইবনু কাছীরে অনুবাদ করেছেন, মহান প্রতিপালকের মুখমন্ডল (সন্তোষ) লাভের আশায়’। এখানে তিনি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগেছেন।