১০২. সূরা তাকাছুর -এর তাফসীর
সূরা তাকাছুর
(অধিক পাওয়ার আকাংখা)
সূরা কাওছারের পরে মক্কায় অবতীর্ণ।
সূরা ১০২, আয়াত ৮, শব্দ ২৮, বর্ণ ১২২।
بِسْمِ اللہِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ
পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে (শুরু করছি)
(১) অধিক পাওয়ার আকাংখা তোমাদের (পরকাল থেকে) গাফেল রাখে, |
أَلْهَاكُمُ التَّكَاثُرُ
|
(২) যতক্ষণ না তোমরা কবরস্থানে উপনীত হও। |
حَتَّى زُرْتُمُ الْمَقَابِرَ
|
(৩) কখনই না। শীঘ্র তোমরা জানতে পারবে। |
كَلَّا سَوْفَ تَعْلَمُونَ
|
(৪) অতঃপর কখনই না। শীঘ্র তোমরা জানতে পারবে |
ثُمَّ كَلَّا سَوْفَ تَعْلَمُونَ
|
(৫) কখনই না। যদি তোমরা নিশ্চিত জ্ঞান রাখতে (তাহ’লে কখনো তোমরা পরকাল থেকে গাফেল হ’তে না)। |
كَلَّا لَوْ تَعْلَمُونَ عِلْمَ الْيَقِينِ
|
(৬) তোমরা অবশ্যই জাহান্নাম প্রত্যক্ষ করবে। |
لَتَرَوُنَّ الْجَحِيمَ
|
(৭) অতঃপর তোমরা অবশ্যই তা দিব্য-প্রত্যয়ে দেখবে। |
ثُمَّ لَتَرَوُنَّهَا عَيْنَ الْيَقِينِ
|
(৮) অতঃপর তোমরা অবশ্যই সেদিন তোমাদেরকে দেওয়া নে‘মতরাজি সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। |
ثُمَّ لَتُسْأَلُنَّ يَوْمَئِذٍ عَنِ النَّعِيمِ
|
বিষয়বস্ত্ত :
প্রাচুর্যের লোভ মানুষকে আখেরাত ভুলিয়ে রাখে। কিন্তু না, তাকে দুনিয়া ছাড়তেই হবে এবং আখেরাতে পাড়ি দিতেই হবে (১-৫ আয়াত)। অতঃপর সেখানে তারা দুনিয়াবী নে‘মতরাজি সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে এবং হাতে-নাতে ফলাফল পাবে (৬-৮ আয়াত)।
তাফসীর :
(১) أَلْهَاكُمُ التَّكَاثُرُ ‘অধিক পাওয়ার আকাংখা তোমাদের (পরকাল থেকে) গাফেল রাখে’।
أَلْهَاكُمُ অর্থ أنساكم ‘তোমাদের ভুলিয়ে রাখে’। এখানে كُمْ (তোমাদের) বলে অবিশ্বাসী, কপট বিশ্বাসী, অংশীবাদী এবং পাপাচারী লোকদের বুঝানো হয়েছে; ঈমানদার ও সৎকর্মশীলদের নয়। মন্দ লোকের সংখ্যা বেশী হওয়ার কারণেই এখানে সাধারণভাবে كُمْ বা ‘তোমাদের’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে। বস্ত্ততঃ পৃথিবীতে সর্বযুগেই মন্দ লোকের সংখ্যা বেশী ছিল এবং আছে। সেকারণ আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে সাবধান করে বলেন, وَإِنْ تُطِعْ أَكْثَرَ مَنْ فِي الْأَرْضِ يُضِلُّوكَ عَنْ سَبِيْلِ اللهِ إِنْ يَتَّبِعُوْنَ إِلاَّ الظَّنَّ وَإِنْ هُمْ إِلاَّ يَخْرُصُوْنَ ‘যদি তুমি জনপদের অধিকাংশ লোকের কথা মান্য কর, তাহ’লে ওরা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে। ওরা কেবল ধারণার অনুসরণ করে এবং অনুমানভিত্তিক কথা বলে’ (আন‘আম ৬/১১৬)। হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ বলবেন, হে আদম! … তোমার সন্তানদের একটি দলকে জাহান্নামের দিকে বের করে নাও। আদম বলবেন, ঐদলটি কতজনের? আল্লাহ বলবেন, এক হাযারের মধ্যে ৯৯৯ জন’।[1] ভাল ও মন্দ লোকের সংখ্যায় কি বিশাল ব্যবধান! সম্ভবতঃ একারণেই আল্লাহ বলেছেন, قَلِيْلٌ مِّنْ عِبَادِيَ الشَّكُوْرُ ‘আমার কৃতজ্ঞ বান্দার সংখ্যা কম’ (সাবা ৩৪/১৩)। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, আমার উম্মত ৭৩ ফের্কায় বিভক্ত হবে। তার মধ্যে একটি মাত্র ফের্কা জান্নাতে যাবে। ছাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, তারা কারা? রাসূল (ছাঃ) বললেন, مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِى ‘যে তরীকার উপর আমি ও আমার ছাহাবীগণ আছি, তার অনুসারীরা’।[2]
التَّكَاثُرُ অর্থ ‘পরস্পরে প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা’। মূল ধাতু (المادة) হ’ল الكثرة ‘আধিক্য’। এটা নেকীর প্রতিযোগিতা হ’লে তা অন্যায় নয়। যেমন জান্নাত লাভে উৎসাহিত করে আল্লাহ বলেন, وَفِي ذَلِكَ فَلْيَتَنَافَسِ الْمُتَنَافِسُونَ ‘অতএব প্রতিযোগীরা এ বিষয়ে প্রতিযোগিতা করুক’ (মুত্বাফফেফীন ৮৩/২৬)। আধিক্যের প্রতিযোগিতা অন্যায় উদ্দেশ্যে হ’লে সেটা পাপের কারণ হবে। কবি বলেন,
وَلَسْتَ بِالْأَكْثَرِ مِنْهُمْ حَصًى + وإنَّمَا الْعِزَّةُ لِلكَاثِرِ
‘সম্পদ গণনায় তুমি অন্যের চাইতে অধিক নও। বরং প্রকৃত সম্মান নিহিত রয়েছে ইলমে দ্বীন ও অধিক ইবাদতের অধিকারীর জন্য’।
বস্ত্ততঃ অধিক ধনলিপ্সা ও প্রভাব-প্রতিপত্তির আকাংখা মানুষকে আল্লাহর আনুগত্য এবং আখেরাতের চিন্তা হ’তে গাফেল রাখে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার এই আকাংখার শেষ হয় না। আর এটি মানুষের একটি স্বভাবগত প্রবণতা। কাফের-মুনাফিকরা এতে ডুবে থাকে। কিন্তু মুমিন নর-নারী এ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখে এবং সর্বদা আখেরাতের জন্য প্রস্ত্তত থাকে।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ), মুক্বাতিল ও কালবী বলেন, কুরায়েশ বংশের বনু আবদে মানাফ ও বনু সাহ্ম দুই গোত্র পরস্পরের উপরে বিভিন্ন বিষয়ে প্রাধান্য দাবী করে বড়াই করত। সে উপলক্ষে সূরাটি নাযিল হয় (কুরতুবী)। কিন্তু বক্তব্য সকল যুগের সকল লোভী ও অহংকারী মানুষের জন্য প্রযোজ্য। কেননা দুনিয়াবী শান-শওকত মায়া-মরীচিকার মত। এগুলোর কোন কিছুই বান্দা সাথে নিয়ে যেতে পারবে না। কেবলমাত্র তার নেক আমল ব্যতীত।
(১) আনাস ইবনে মালেক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, لَوْ أَنَّ لاِبْنِ آدَمَ وَادِيًا مِنْ ذَهَبٍ أَحَبَّ أَنْ يَكُوْنَ لَهُ وَادِيَانِ، وَلَنْ يَمْلأَ فَاهُ إِلاَّ التُّرَابُ، وَيَتُوْبُ اللهُ عَلَى مَنْ تَابَ– ‘যদি আদম সন্তানকে এক ময়দান ভর্তি স্বর্ণ দেওয়া হয়, তাহ’লে সে দুই ময়দান ভর্তি স্বর্ণের আকাংখা করবে। তার মুখ ভরবে না মাটি ব্যতীত (অর্থাৎ কবরে না যাওয়া পর্যন্ত)। আর আল্লাহ তওবাকারীর তওবা কবুল করে থাকেন’।[3]
রাবী আনাস (রাঃ) বলেন, উবাই বিন কা‘ব (রাঃ) বলতেন যে, আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উপরোক্ত হাদীছকে কুরআনের অংশ মনে করতাম, যতক্ষণ না সূরা তাকাছুর নাযিল হয়’।[4]
(২) আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, দু’জন পিপাসু ব্যক্তি রয়েছে, যারা কখনো তৃপ্ত হয় না। একজন হ’ল জ্ঞান পিপাসু, যার পিপাসা কখনো নিবৃত্ত হয় না। অন্যজন হ’ল দুনিয়া পিয়াসী, যার লোভ কখনো শেষ হয় না’।[5]
(৩) আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, মালের ধনী বড় ধনী নয়। বরং হৃদয়ের ধনী হ’ল বড় ধনী’।[6]
(৪) আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন যে, জিব্রীল আমার হৃদয়ে এ কথাটি নিক্ষেপ করেছেন যে, কেউ মৃত্যুবরণ করে না যতক্ষণ না সে তার রিযিক পূর্ণ করে। অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং বৈধভাবে রিযিক সন্ধান কর। কাংখিত রিযিক আসতে দেরী হওয়ায় তা যেন তোমাদেরকে আল্লাহর অবাধ্যতার মাধ্যমে উপার্জনে প্ররোচিত না করে। কেননা আল্লাহর কাছে যে রিযিক রয়েছে, তা তাঁর আনুগত্য ব্যতীত লাভ করা যায় না (অর্থাৎ বৈধ রিযিকেই আল্লাহ বরকত দেন, অবৈধ রিযিকে নয়)।[7]
(৫) আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, তুমি আল্লাহভীরু হও, তাহ’লে তুমি হবে শ্রেষ্ঠ ইবাদতকারী। তুমি অল্পে তুষ্ট হও, তাহ’লে তুমি হবে শ্রেষ্ঠ কৃতজ্ঞ ব্যক্তি। তুমি অন্যের জন্য সেটাই ভালবাসো, যেটা তুমি নিজের জন্য ভালবাসো, তাহ’লে তুমি হবে প্রকৃত মুমিন।[8]
(২) حَتَّى زُرْتُمُ الْمَقَابِرَ ‘যতক্ষণ না তোমরা কবরস্থানে উপনীত হও’।
حَتَّى زُرْتُمُ الْمَقَابِرَ অর্থحَتَّى يَأْتِيَكُمُ الْمَوتُ فَوَصَلْتُمْ إلَى الْمَقابِرِ وَصِرْتُمْ مِنْ أَهْلِهَا ‘যতক্ষণ না তোমাদের মৃত্যু এসে যায়। অতঃপর তোমরা কবরস্থানে পৌঁছে যাও ও তার বাসিন্দা হয়ে যাও’। مَقَابِر একবচনে مَقْبرةً অর্থ কবরস্থান। القُبُوْر একবচনে القَبْر ‘কবর’। জানা আবশ্যক যে, দুনিয়াবী জীবনের সমাপ্তি হিসাবে এখানে কবরের কথা বলা হয়েছে। নইলে কবর মানুষের জন্য চূড়ান্ত ঠিকানা নয়। বরং এটি জীবনের সফরসূচীর তৃতীয় পর্যায় বা দারুল বারযাখ। অর্থাৎ পর্দার অন্তরালের যাত্রী বিশ্রামাগার বা Waiting room মাত্র। আল্লাহ বলেন,وَمِنْ وَرَائِهِمْ بَرْزَخٌ إِلَى يَوْمِ يُبْعَثُوْنَ ‘আর তাদের সম্মুখে পর্দা থাকবে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত’ (মুমিনূন ২৩/১০০)। অর্থাৎ এটি দুনিয়া ও আখেরাতের মধ্যবর্তী অবস্থান এবং কবর হ’ল আখেরাতের প্রথম মনযিল। এর পরবর্তী চূড়ান্ত ও চিরস্থায়ী ঠিকানা বা দারুল ক্বারার হ’ল জান্নাত অথবা জাহান্নাম।
জীবনের সফরসূচী :
মানব জীবনের সফরসূচী শুরু হয় প্রথমে আল্লাহর নিকট থেকে মায়ের গর্ভে। এটা হ’ল প্রথম মনযিল। এখানে সাধারণতঃ ৯ মাস ১০ দিন থাকার পর ভূমিষ্ট হয়ে সে দুনিয়াতে আসে। এটা হ’ল দ্বিতীয় মনযিল বা ‘দারুদ্দুনিয়া’। এখানে সে কমবেশী ৭০ বছর অবস্থান করে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, আমার উম্মতের আয়ু ষাট হ’তে সত্তুর বছরের মধ্যে হবে। খুব কম সংখ্যকই তা অতিক্রম করবে’।[9] যা চারটি স্তরে বিভক্ত : (ক) শৈশবের দুর্বলতা (১-১৬ বছর)। (খ) যৌবনের শক্তিমত্তা (১৬-৪০ বছর)। (গ) প্রৌঢ়ত্বের পূর্ণতা (৪০-৬০ বছর) এবং (ঘ) বার্ধক্যের দুর্বলতা (৬০-৭০ বছর)। অতঃপর নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে মৃত্যু ও কবরে গমন। এটা হ’ল তৃতীয় মনযিল বা ‘দারুল বারযাখ’। এখান থেকে তার আখেরাতের সফর শুরু হয়। যা শেষ হবে ক্বিয়ামতের দিন। কবর তার জন্য জান্নাতের টুকরা হবে বা জাহান্নামের গর্ত হবে। অতঃপর ক্বিয়ামতের দিন পুনরুত্থান শেষে সেখানে মানুষের তিনটি সারি হবে। অগ্রগামী দল, ডাইনের সারি ও বামের সারি। প্রথম দু’টি দল জান্নাতী হবে ও বামের সারি জাহান্নামী হবে। এটি হ’ল চতুর্থ মনযিল বা ‘দারুল ক্বারার’। যা হ’ল চূড়ান্ত ঠিকানা।
ক্বিয়ামতের দিন হিসাব শেষে সকল মানুষকে জাহান্নামের উপর রক্ষিত পুলছিরাত পার হ’তে হবে (মারিয়াম ১৯/৭১)। জান্নাতীগণ চোখের পলকে পার হয়ে যাবেন ও সেখানে চিরকাল থাকবেন। কিন্তু জাহান্নামীরা তাতে পতিত হবে। সেখানে কাফির-মুশরিকরা চিরকাল থাকবে। কিন্তু মুমিন পাপীরা তাদের খালেছ ঈমানের কারণে ও রাসূল (ছাঃ)-এর সুফারিশক্রমে এবং সবশেষে আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহে জান্নাতে প্রবেশ করবে’।[10]
উল্লেখ্য যে, অনেকে আলোচ্য আয়াত দ্বারা কবরকে শেষ ঠিকানা বলেন এবং ক্বিয়ামত ও জান্নাত-জাহান্নামকে অস্বীকার করেন। এটি ভুল ও অন্যায় ব্যাখ্যা মাত্র। কেননা এখানে زُرْتُمُ ‘তোমরা যিয়ারত কর’ বলা হয়েছে। আর যিয়ারতকারী অবশ্যই তার মূল ঠিকানায় ফিরে আসে। আর মানুষের মূল ঠিকানা হ’ল যেখান থেকে মায়ের গর্ভে তার রূহ এসেছিল। অর্থাৎ আল্লাহর কাছে সে ফিরে যাবে। যেমন তিনি বলেন, إِلَى اللهِ مَرْجِعُكُمْ جَمِيْعًا فَيُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ فِيْهِ تَخْتَلِفُوْنَ ‘আল্লাহর নিকটেই তোমাদের সকলের প্রত্যাবর্তনস্থল। অতঃপর তিনি তোমাদের জানিয়ে দিবেন যেসব বিষয়ে তোমরা মতবিরোধ করতে’ (মায়েদাহ ৫/৪৮, ১০৫; হূদ ১১/৪)।
হযরত ওছমান গণী (রাঃ) যখন কোন কবরের পাশে দাঁড়াতেন, তখন কান্নায় তাঁর দাড়ি ভিজে যেত। তাঁকে বলা হল, জান্নাত ও জাহান্নামের বর্ণনা আসলে আপনি কাঁদেন না। অথচ এখানে আপনি কাঁদছেন? জবাবে তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,
إِنَّ الْقَبْرَ أَوَّلُ مَنَازِلِ الآخِرَةِ فَإِنْ نَجَا مِنْهُ فَمَا بَعْدَهُ أَيْسَرُ مِنْهُ وَإِنْ لَمْ يَنْجُ مِنْهُ فَمَا بَعْدَهُ أَشَدُّ مِنْهُ، وَقَالَ : مَا رَأَيْتُ مَنْظَرًا قَطُّ إِلاَّ وَالْقَبْرُ أَفْظَعُ مِنْهُ-ُ
‘নিশ্চয়ই কবর হ’ল আখেরাতের মনযিল সমূহের প্রথম মনযিল। যে ব্যক্তি এখানে মুক্তি পাবে, তার জন্য পরবর্তী মনযিলগুলি সহজ হয়ে যাবে। আর যদি সে এখানে মুক্তি না পায়, তাহলে পরবর্তীগুলি কঠিন হবে। তিনি বলেন, কবরের চাইতে ভয়ংকর কোন দৃশ্য আমি দেখিনি’।[11]
ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমার দেহের একাংশ ধরে বললেন, كُنْ فِى الدُّنْيَا كَأَنَّكَ غَرِيبٌ أَوْ عَابِرُ سَبِيلٍ- ‘পৃথিবীতে তুমি আগন্তুক অথবা পথযাত্রীর মত বসবাস কর’।[12]وَعُدَّ نَفْسَكَ فِى أَهْلِ الْقُبُورِ ‘এবং নিজকে সর্বদা কবরবাসীদের মধ্যে গণ্য কর’।[13]
(৩) كَلاَّ سَوْفَ تَعْلَمُوْنَ ‘কখনই না। শীঘ্র তোমরা জানতে পারবে’।
(৪) ثُمَّ كَلاَّ سَوْفَ تَعْلَمُوْنَ ‘অতঃপর কখনই না। শীঘ্র তোমরা জানতে পারবে’। যখন তোমরা আখেরাতে ফিরে আসবে, তখন এই প্রাচুর্য তোমাদের কোন কাজে লাগবে না।
كَلاَّ পরপর দু’বার আনা হয়েছে শ্রোতাকে ধমক দেওয়ার জন্য ও সতর্ক করার জন্য। এটি كلمة ردع বা প্রত্যাখ্যানকারী শব্দ। এর মাধ্যমে বান্দার লোভের আধিক্যকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। এর দ্বারা বলতে চাওয়া হয়েছে যে, প্রাচুর্যের লোভ করো না। পরিণামে তোমরা লজ্জিত হবে। যা তোমরা সত্বর জানতে পারবে। হাসান বাছরী বলেন, هذا وعيد بعد وعيد ‘এটি ধমকের পরে ধমক’ (ইবনু কাছীর)। দু’বার আনার অর্থ এটাও হ’তে পারে যে, প্রথমটি দ্বারা কবর এবং দ্বিতীয়টি দ্বারা আখেরাত বুঝানো হয়েছে। অথবা প্রথমটিতে বলা হয়েছে, তোমরা সত্বর জানতে পারবে যখন মৃত্যু এসে যাবে ও তোমাদের রূহ তোমাদের দেহ থেকে টেনে বের করা হবে। দ্বিতীয়টিতে বলা হয়েছে, পুনরায় তোমরা জানতে পারবে যখন তোমরা কবরে প্রবেশ করবে এবং মুনকার-নাকীর তোমাদের প্রশ্ন করবে’। অথবা প্রথমটি দ্বারা ক্বিয়ামত এবং শেষেরটি দ্বারা হাশর অর্থাৎ বিচার দিবস বুঝানো হয়েছে (কুরতুবী)।
(৫) كَلاَّ لَوْ تَعْلَمُوْنَ عِلْمَ الْيَقِيْنِ ‘কখনই না। যদি তোমরা নিশ্চিত জ্ঞান রাখতে (তাহ’লে কখনো তোমরা পরকাল থেকে গাফেল হ’তে না)’। তৃতীয়বার كَلاَّ এনে বান্দাকে কঠোর হুঁশিয়ারী দিয়ে বলা হয়েছে, যদি তোমরা ক্বিয়ামত সম্পর্কে নিশ্চিত জ্ঞান রাখতে! কেননা ক্বিয়ামত ও আখেরাতের উপরে বিশ্বাস দৃঢ় থাকলে তোমরা কখনোই অধিক অর্থ-বিত্ত ও প্রাচুর্যের পিছনে ছুটতে না। এখানে لَوْ (যদি) এর জবাব উহ্য রয়েছে। অর্থাৎ যদি তোমরা ক্বিয়ামত সম্পর্কে আজকে নিশ্চিত জানতে যা পরে জানবে, তাহ’লে অবশ্যই তোমরা আল্লাহ ও আখেরাত থেকে গাফেল হ’তে না। ইবনু আবী হাতেম বলেন, তিনটি স্থানেই كَلاَّ অর্থ أَلاَ অর্থাৎ ‘সাবধান’। ফার্রা বলেন, বরং كَلاَّ অর্থ হবে حقًّا ‘অবশ্যই’। অর্থাৎ অবশ্যই তোমরা ক্বিয়ামত সম্পর্কে সত্বর জানতে পারবে (কুরতুবী)।
অত্র আয়াতের শেষে পাঠক অবশ্যই থামবেন এবং ওয়াক্ফ করবেন। পরবর্তী আয়াতের সঙ্গে মিলানো যাবে না। কেননা তাতে অর্থ হবে, ‘যদি তোমরা নিশ্চিত জ্ঞান রাখতে, তাহ’লে অবশ্যই জাহান্নাম প্রত্যক্ষ করতে’। যা মূল অর্থকে বিনষ্ট করে দেয়। কেননা জাহান্নাম দেখার বিষয়টি হ’ল মৃত্যু ও পুনরুত্থানের পরের বিষয়।
দুনিয়ার সাথে আখেরাতের তুলনা :
(১) জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একদিন চলার পথে একটি মৃত বকরীর বাচ্চা দেখিয়ে বলেন, এক দিরহামের বিনিময়েও কি তোমরা এটিকে খরিদ করবে? আমরা বললাম, না। তখন তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! এটি তোমাদের কাছে যত নিকৃষ্ট, আল্লাহর নিকটে দুনিয়া তার চাইতেও অধিক নিকৃষ্ট’।[14] পক্ষান্তরে জান্নাত সম্পর্কে আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, আল্লাহ বলেন, أَعْدَدْتُ لِعِبَادِى الصَّالِحِيْنَ مَا لاَ عَيْنَ رَأَتْ، وَلاَ أُذُنَ سَمِعَتْ، وَلاَ خَطَرَ عَلَى قَلْبِ بَشَرٍ، فَاقْرَءُوا إِنْ شِئْتُمْ (فَلاَ تَعْلَمُ نَفْسٌ مَا أُخْفِىَ لَهُمْ مِنْ قُرَّةِ أَعْيُنٍ) ‘আমি আমার সৎকর্মশীল বান্দাদের জন্য এমনসব চক্ষু শীতলকারী বস্ত্ত প্রস্ত্তত করে রেখেছি, যা কোন চোখ কখনো দেখেনি, কান কখনো শোনেনি, হৃদয় কখনো কল্পনা করেনি। অতঃপর তিনি সূরা সাজদাহ ১৭ আয়াতটি পাঠ করেন যার অর্থ ‘কেউ জানেনা তার জন্য চক্ষুশীতলকারী কি বস্ত্ত লুক্কায়িত রয়েছে তাদের পুরস্কার স্বরূপ’।[15] তিনি বলেন, مَوْضِعُ سَوْطٍ فِى الْجَنَّةِ خَيْرٌ مِنَ الدُّنْيَا وَمَا فِيْهَا ‘জান্নাতের একটি চাবুক রাখার স্থান দুনিয়া ও তার মধ্যকার সবকিছুর চাইতে উত্তম’।[16]
(২) মুত্বাররিফ স্বীয় পিতা আব্দুল্লাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন যে,
أَتَيْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَهُوَ يَقْرَأُ (أَلْهَاكُمُ التَّكَاثُرُ) قَالَ : يَقُوْلُ ابْنُ آدَمَ مَالِىْ مَالِىْ، قَالَ وَهَلْ لَكَ يَا ابْنَ آدَمَ مِنْ مَالِكَ إِلاَّ مَا أَكَلْتَ فَأَفْنَيْتَ أَوْ لَبِسْتَ فَأَبْلَيْتَ أَوْ تَصَدَّقْتَ فَأَمْضَيْتَ ؟
‘আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে এলাম। সে সময় তিনি সূরা তাকাছুর পাঠ করছিলেন। অতঃপর তিনি বলেন, বনু আদম বলে আমার মাল, আমার মাল। অথচ হে আদম সন্তান! তোমার মাল কি কেবল অতটুকু নয়, যতটুকু তুমি ভক্ষণ করলে ও শেষ করলে। অথবা পরিধান করলে ও জীর্ণ করলে, অথবা ছাদাক্বা করলে ও তা সঞ্চয় করলে’?[17]
(৩) আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, يَقُوْلُ الْعَبْدُ مَالِىْ مَالِىْ، إِنَّمَا لَهُ مِنْ مَالِهِ ثَلاَثٌ : مَا أَكَلَ فَأَفْنَى أَوْ لَبِسَ فَأَبْلَى أَوْ أَعْطَى فَاقْتَنَى، وَمَا سِوَى ذَلِكَ فَهُوَ ذَاهِبٌ وَتَارِكُهُ لِلنَّاسِ– ‘বান্দা বলে আমার মাল, আমার মাল! অথচ তার মাল হ’ল মাত্র তিনটি : (১) যা সে খায় ও শেষ করে। (২) যা সে পরিধান করে ও জীর্ণ করে এবং (৩) যা সে ছাদাক্বা করে ও সঞ্চয় করে। এগুলি ব্যতীত বাকী সবই চলে যাবে এবং অন্যদের জন্য সে ছেড়ে যাবে’।[18]
(৪) আনাস ইবনে মালেক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, يَتْبَعُ الْمَيِّتَ ثَلاَثَةٌ ، فَيَرْجِعُ اثْنَانِ وَيَبْقَى مَعَهُ وَاحِدٌ ، يَتْبَعُهُ أَهْلُهُ وَمَالُهُ وَعَمَلُهُ ، فَيَرْجِعُ أَهْلُهُ وَمَالُهُ ، وَيَبْقَى عَمَلُهُ- ‘মাইয়েতের সাথে তিনজন যায়। তার মধ্যে দু’জন ফিরে আসে ও একজন তার সাথে থেকে যায়। মাইয়েতের সঙ্গে যায় তার পরিবার, তার মাল ও তার আমল। অতঃপর তার পরিবার ও মাল ফিরে আসে এবং আমল তার সাথে থেকে যায়’।[19]
(৫) হযরত আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত অন্য একটি হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, يَهْرَمُ ابْنُ آدَمَ وَتَشِبُّ مِنْهُ اثْنَتَانِ الْحِرْصُ عَلَى الْمَالِ وَالْحِرْصُ عَلَى الْعُمُرِ- ‘আদম সন্তান বার্ধক্যে জীর্ণ হয়ে যায়। কিন্তু দু’টি বস্ত্ত বৃদ্ধি পায়। সম্পদের লোভ ও অধিক বয়স পাওয়ার আকাংখা’।[20]
(৬) হাফেয ইবনু আসাকির ইমাম আহনাফ ইবনে ক্বায়েস (নাম : যাহহাক)-এর জীবনী আলোচনায় বলেন, একদা তিনি একজন ব্যক্তির হাতে একটি দিরহাম দেখে বলেন, এটি কার? সে বলল, আমার। আহনাফ বললেন, ওটা তোমার হবে তখনই, যখন তুমি ওটা কোন নেকীর কাজে বা আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ের উদ্দেশ্যে ব্যয় করবে। অতঃপর আহনাফ জনৈক কবির নিম্নোক্ত কবিতাটি পাঠ করেন-
أنتَ للمال إذا أمسكتَه + فإذا أنفقتَه فالمالُ لَكَ
‘যখন তুমি আটকে রাখলে, তখন তুমি মালের
আর যখন তুমি খরচ করলে, তখন মাল হ’ল তোমার’ (ইবনু কাছীর)।
(৬) لَتَرَوُنَّ الْجَحِيْمَ ‘তোমরা অবশ্যই জাহান্নাম প্রত্যক্ষ করবে’।
এটি পূর্ববর্তী আয়াতের لَوْ (যদি)-এর জবাব নয়। বরং এটি সম্পূর্ণ পৃথক ও শপথসূচক বাক্য। শুরুতে وَاللهِ (আল্লাহর কসম) উহ্য রয়েছে। لَتَرَوُنَّ الْجَحِيْمَ হ’ল উক্ত শপথের জওয়াব। এর সাথে পূর্বের আয়াতের কোন সম্পর্ক নেই।
(৭) ثُمَّ لَتَرَوُنَّهَا عَيْنَ الْيَقِيْنِ ‘অতঃপর তোমরা অবশ্যই তা দিব্য-প্রত্যয়ে দেখবে’।
এটি পূর্ববর্তী আয়াতের তাকীদ হয়েছে এবং لَتَرَوُنَّه – لام ةاكيد بانون ةاكيد ثقيلة আনা হয়েছে। যার অর্থ, ‘অবশ্য অবশ্যই তোমরা দেখবে’। যেদিন জাহান্নামকে ৭০ হাযার লাগামে বেঁধে টেনে আনা হবে। প্রত্যেক লাগামে ৭০ হাযার ফেরেশতা থাকবে’।[21] আর প্রত্যেক ফেরেশতা হবে ‘নির্মম ও কঠোর’ (তাহরীম ৬৬/৬)। কত বিশাল ও ভয়ংকর সেই জাহান্নাম! আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন -আমীন!
এটিতে প্রচ্ছন্নভাবে আরেকবার ধমক দেওয়া হয়েছে। যার মধ্যে শপথ লুকিয়ে রয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, তোমরা অবশ্যই জা হান্নামকে চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করবে। তখন তোমাদের মধ্যে দিব্য-প্রত্যয় জন্মাবে।
এখানে ‘তোমরা’ বলে কাফেরদের বুঝানো হ’তে পারে। কেননা তাদের জন্যে জাহান্নাম অবধারিত। অথবা সাধারণভাবে সকল বনু আদমকে বুঝানো হ’তে পারে। যেমন আল্লাহ বলেন, وَإِنْ مِّنكُمْ إِلاَّ وَارِدُهَا كَانَ عَلَى رَبِّكَ حَتْماً مَّقْضِيًّا ‘তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই, যে তথায় (জাহান্নামে) পৌঁছবে না। এটা তোমার প্রতিপালকের অনিবার্য ফায়ছালা’ (মারিয়াম ১৯/৭১)। এখানে পৌঁছানোর অর্থ প্রবেশ করা নয়, বরং অতিক্রম করা। একে ‘পুলছিরাত’ বলা হয়। ছহীহ হাদীছে এসেছে যে, মুমিনগণ পুলছিরাত পার হয়ে জান্নাতে চলে যাবে বিদ্যুতের বেগে, জাহান্নামের কোন উত্তাপ তারা অনুভব করবে না। কিন্তু কাফের-ফাসেকগণ আটকে যাবে ও জাহান্নামে পতিত হবে…।[22] যেমন পরের আয়াতেই আল্লাহ বলেন, ثُمَّ نُنَجِّي الَّذِيْنَ اتَّقَوْا وَّنَذَرُ الظَّالِمِيْنَ فِيْهَا جِثِيًّا ‘অতঃপর আমরা আল্লাহভীরুদের উদ্ধার করব এবং যালেমদেরকে জাহান্নামের মধ্যে নতজানু অবস্থায় ছেড়ে দেব’ (মারিয়াম ১৯/৭২)। অতএব মুমিন-কাফির সবাই জাহান্নামকে প্রত্যক্ষ করবে। মুমিনগণ সহজে পার হয়ে যাবে। কিন্তু কাফের-ফাসেকগণ জাহান্নামে পতিত হবে। আল্লাহ আমাদেরকে সেদিনের কঠিন পাকড়াও থেকে রক্ষা করুন- আমীন!
এখানে عَيْنَ الْيَقِيْنِ বা ‘দিব্য-প্রত্যয়ে’ বলার কারণ এই যে, মানুষ চোখে দেখাটাকে অধিক গুরুত্ব দেয় কানে শোনার চাইতে। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, لَيْسَ الْخَبَرُ كَالْمُعَايَنَةِ ‘শোনা খবর কখনো চোখে দেখার সমান নয়’।[23] الْعَيْنُ অর্থ النَّفْسُ। ফলে দেখাটাকেই ইয়াক্বীন গণ্য করা হয়েছে’ (ক্বাসেমী)।
দুনিয়াতে ঈমানদারগণ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কথায় বিশ্বাসী হয়ে মনের চোখ দিয়ে সেটা দেখতে পারে এবং আখেরাতে মানুষ সেটা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করবে। কিন্তু তখনকার দিব্য-প্রত্যয়ে কোন কাজ হবে না (সাজদাহ ৩২/২৯)। দুনিয়াতে বিশ্বাস করলে ও সেই অনুযায়ী সাবধান হয়ে নেক আমল করলে আখেরাতে কাজে লাগবে (মুল্ক ৬৭/২; যিলযাল ৯৯/৭-৮)। ফলে সেদিন জাহান্নাম প্রত্যক্ষ করলেও আল্লাহর হুকুমে সেখানে সে পতিত হবে না। বরং সহজে পার হয়ে জান্নাতে চলে যাবে। দুঃখ হয় মানুষের জন্য যে, সে নিজে না দেখেও অন্যের কথা শুনে নিজের মৃত মাতা-পিতা ও দাদা-দাদীর উপরে ঈমান এনে থাকে। অথচ সে নবী-রাসূলের কথা শুনে আল্লাহ ও আখেরাতের উপর ঈমান আনতে পারে না। আল্লাহ আমাদের অন্তরকে নরম করে দিন এবং তাকে ঈমানের আলোকে আলোকিত করুন- আমীন!
(৮) ثُمَّ لَتُسْأَلُنَّ يَوْمَئِذٍ عَنِ النَّعِيْمِ ‘অতঃপর তোমরা অবশ্যই সেদিন তোমাদেরকে দেওয়া নে‘মতরাজি সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে’। এখানেও পূর্বের আয়াতের ন্যায় ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা বাচক ক্রিয়া لام ةاكيد بانون ةاكيد ثقيلة আনা হয়েছে। যার অর্থ, অবশ্য অবশ্যই তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে’।
আবু নছর আল-কুশায়রী বলেন, প্রত্যেকেই জিজ্ঞাসিত হবে। তবে কাফেরদের প্রশ্ন করা হবে ধমক ও ধিক্কার হিসাবে ( (تَقْرِيْعًا وَتَوْبِيْخًا। কেননা তারা এগুলোর কৃতজ্ঞতা স্বীকার করত না। আর মুমিনকে প্রশ্ন করা হবে তাকে স্মরণ করানোর উদ্দেশ্যে ও তার মর্যাদা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে (تذكيرًا وَتشريفًا)। কেননা সে সর্বদা এসব নে‘মতের শুকরিয়া আদায় করত’ (কুরতুবী)। ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ যখন তাকে উক্ত কথা স্মরণ করিয়ে দিবেন, তখন সে খুশী হবে ও গর্বিত বোধ করবে। সকলের নিকট তখন তার মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। পক্ষান্তরে কাফের-মুনাফিকরা লজ্জিত ও ধিকৃত হবে।
মানবদেহের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, তার চক্ষু-কর্ণ-নাসিকা, তার হস্ত-পদ-পেট ও মস্তিষ্ক, তার প্রতিটি নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস সবই আল্লাহর দেওয়া অফুরন্ত নে‘মতের অংশ। মানুষের জীবন-জীবিকার স্বার্থে সৃষ্ট আসমান-যমীন, সূর্য-চন্দ্র-নক্ষত্ররাজি, বায়ু-পানি-মাটি, খাদ্য-শস্য, ফল-ফলাদি, পাহাড়-জঙ্গল, নদী-নালা, গবাদিপশু ও পক্ষীকুল সবই আল্লাহর নে‘মতরাজির অংশ। মানুষের জ্ঞান-সম্পদ, তার চিন্তাশক্তি ও বাকশক্তি হ’ল সর্বাধিক মূল্যবান নে‘মত। সর্বোপরি মানুষকে সঠিক পথ প্রদর্শনের জন্য আল্লাহর পক্ষ হ’তে প্রেরিত কিতাব ও নবী-রাসূলগণ মানব জাতির জন্য আল্লাহর সবচেয়ে বড় অনুগ্রহ। আল্লাহ বলেন, وَإِنَّ تَعُدُّواْ نِعْمَتَ اللهِ لاَ تُحْصُوْهَا ‘যদি তোমরা আল্লাহর নে‘মতরাজি গণনা কর, তবে তা গণনা করে শেষ করতে পারবে না’ (ইবরাহীম ১৪/৩৪; নাহল ১৬/১৮)।
দৃশ্যমান ও অদৃশ্য হাযারো নে‘মতের মধ্যে আল্লাহ মানুষের লালন-পালন করে থাকেন। অকৃতজ্ঞ সন্তান যেমন পিতা-মাতার শুকরিয়া আদায় করে না, অকৃতজ্ঞ মানুষ তেমনি তার পালনকর্তা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে না। আল্লাহ বলেন, أَلَمْ تَرَوْا أَنَّ اللهَ سَخَّرَ لَكُمْ مَّا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَأَسْبَغَ عَلَيْكُمْ نِعَمَهُ ظَاهِرَةً وَّبَاطِنَةً- ‘তোমরা কি দেখ না, নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে যা কিছু আছে, সবকিছুকে আল্লাহ তোমাদের সেবায় অনুগত করে দিয়েছেন? এবং তোমাদের উপরে তাঁর প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য নে‘মতসমূহ পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন?…’ (লোকমান ৩১/২০)। তিনি বলেন, وَلَوْ أَنَّ مَا فِي الْأَرْضِ مِنْ شَجَرَةٍ أَقْلاَمٌ وَالْبَحْرُ يَمُدُّهُ مِنْ بَعْدِهِ سَبْعَةُ أَبْحُرٍ مَّا نَفِدَتْ كَلِمَاتُ اللهِ إِنَّ اللهَ عَزِيْزٌ حَكِيْمٌ- ‘পৃথিবীতে যত বৃক্ষ আছে, সবই যদি কলম হয় এবং একটি সমুদ্রের সাথে সাতটি সমুদ্র যুক্ত হয়ে কালি হয়, তবুও তাঁর নে‘মতসমূহ (كلمات) লিখে শেষ করা যাবে না। নিশ্চয় আল্লাহ মহা পরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়’ (লোকমান ৩১/২৭)।
প্রধান নে‘মত সমূহ :
নিম্নে আমরা মানুষের প্রধান প্রধান নে‘মত সমূহ, যা পবিত্র কুরআনে ও ছহীহ হাদীছ সমূহে উল্লেখিত হয়েছে, তার মধ্য থেকে কয়েকটির কথা উল্লেখ করব।-
(১) চক্ষু, কর্ণ ও হৃদয় : আল্লাহ বলেন, وَلاَ تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُوْلَـئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْؤُوْلاً- ‘যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তার পিছনে পড়ো না। নিশ্চয় কর্ণ, চক্ষু ও অন্তঃকরণ প্রত্যেকটিই জিজ্ঞাসিত হবে’ (বনু ইসরাঈল ১৭/৩৬)। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) النَّعِيْمِ -এর ব্যাখ্যায় বলেন,هو صحة الأبدان والأسماع والأبصار এটা হ’ল দেহ, কর্ণ ও চক্ষুর সুস্থতা। কেননা এগুলি কোন কোন কাজে ব্যবহার করা হয়েছে, সে বিষয়ে আল্লাহ বান্দাকে পৃথক পৃথকভাবে প্রশ্ন করবেন। যদিও আল্লাহ এ বিষয়ে সম্যক অবহিত’ (ইবনু কাছীর)। অতএব এইসব অমূল্য নে‘মতের অপব্যবহার যাতে না হয়, সে বিষয়ে সদা সতর্ক থাকতে হবে।
(২) স্বাস্থ্য ও সচ্ছলতা : আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, نِعْمَتَانِ مَغْبُوْنٌ فِيْهِمَا كَثِيْرٌ مِّنَ النَّاسِ، الصِّحَّةُ وَالْفَرَاغُ ‘দু’টি নে‘মত রয়েছে, যে দু’টিতে বহু মানুষ ধোঁকায় পতিত হয়েছে- স্বাস্থ্য এবং সচ্ছলতা’।[24] অর্থাৎ যখন সে সুস্থ ও সচ্ছল থাকে, তখন এ দু’টি নে‘মতকে সে আল্লাহর আনুগত্যের কাজে ব্যয় করে না। বরং অলসতা করে এবং এখন নয়, পরে করব বলে শয়তানী ধোঁকায় পতিত হয়। ফলে যখন সে অসুস্থ হয় বা অসচ্ছল হয় কিংবা ব্যস্ত হয়ে পড়ে, তখন আর ঐ নেকীর কাজটি করার সুযোগ থাকে না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জনৈক ব্যক্তিকে উপদেশ দিয়ে বলেন,
اِغْتَنِمْ خَمْسًا قَبْلَ خَمْسٍشَبَابَكَ قَبْلَ هَرَمِكَ، وَصِحَّتَكَ قَبْلَ سَقَمِكَ، وَغِنَاكَ قَبْلَ فَقْرِكَ، وَفَرَاغَكَ قَبْلَ شُغْلِكَ، وَحَيَاتَكَ قَبْلَ مَوْتِكَ-
‘তুমি পাঁচটি বস্ত্তর পূর্বে পাঁচটি বস্ত্তকে গণীমত (সম্পদ) মনে কর : (১) বার্ধক্য আসার পূর্বে যৌবনকে (২) পীড়িত হওয়ার পূর্বে সুস্থতাকে (৩) দরিদ্রতার পূর্বে সচ্ছলতাকে (৪) ব্যস্ততার পূর্বে অবসর সময়কে এবং (৫) মৃত্যুর পূর্বে তোমার জীবনকে’।[25]
ইবনুল জাওযী বলেন, مَنِ اسْتَعْمَلَ فَرَاغَهُ وَصِحَّتَهُ فِي طَاعَةِ اللهِ فَهُوَ الْمَغْبُوطُ وَمَنِ اسْتَعْمَلَهُمَا فِي مَعْصِيَةِ اللهِ فَهُوَ الْمَغْبُونُ- ‘যে ব্যক্তি তার সচ্ছলতা ও সুস্থতাকে আল্লাহর আনুগত্যের কাজে লাগায়, সে ব্যক্তি হ’ল ‘মাগবূত্ব’ বা ঈর্ষণীয়। আর যে ব্যক্তি ঐ দু’টি বস্ত্তকে আল্লাহর অবাধ্যতার কাজে লাগায়, সে হ’ল ‘মাগবূন’ বা ধোঁকায় পতিত’।[26] অত্র হাদীছে সুস্বাস্থ্য ও আর্থিক সচ্ছলতাকে আল্লাহর বিশেষ নে‘মত হিসাবে গণ্য করা হয়েছে।
(৩) সম্পদ, সন্তান ও নেতৃত্ব : আবু হুরায়ারা (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,يُؤْتَى بِالْعَبْدِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَيَقُوْلُ اللهُ لَهُ أَلَمْ أَجْعَلْ لَكَ سَمْعًا وَبَصَرًا وَمَالاً وَوَلَدًا… وَتَرَكْتُكَ تَرْأَسُ وَتَرْبَعُ..- ‘ক্বিয়ামতের দিন বান্দাকে হাযির করা হবে। অতঃপর আল্লাহ তাকে বলবেন, আমি কি তোমাকে কান, চোখ, সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দেইনি?… আমি কি তোমাকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য ও গণীমতের মাল নেওয়ার জন্য ছেড়ে দেইনি?’[27] অত্র হাদীছে কান ও চোখ ছাড়াও ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি ও নেতৃত্বকে অন্যতম প্রধান নে‘মত হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। যে বিষয়ে তাকে ক্বিয়ামতের দিন প্রশ্ন করা হবে।
(৪) আত্মীয়-পরিজন, ব্যবসা ও বাড়ী-ঘর : পবিত্র কুরআনে আরও কয়েকটি বস্ত্তকে মানুষের প্রিয়বস্ত্ত হিসাবে অভিহিত করা হয়েছে, যেগুলি নিঃসন্দেহে আল্লাহর দেওয়া অত্যন্ত মূল্যবান নে‘মত। যেমন আল্লাহ বলেন,
قُلْ إِنْ كَانَ آبَاؤُكُمْ وَأَبْنَآؤُكُمْ وَإِخْوَانُكُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ وَعَشِيْرَتُكُمْ وَأَمْوَالٌ اقْتَرَفْتُمُوْهَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَمَسَاكِنُ تَرْضَوْنَهَا أَحَبَّ إِلَيْكُمْ مِنَ اللهِ وَرَسُولِهِ وَجِهَادٍ فِي سَبِيْلِهِ فَتَرَبَّصُوا حَتَّى يَأْتِيَ اللهُ بِأَمْرِهِ وَاللهُ لاَ يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ-
‘বল তোমাদের নিকটে যদি তোমাদের পিতা-মাতা, ছেলে-মেয়ে, ভাই-বোন, স্ত্রী-পরিবার ও গোত্র-পরিজন, তোমাদের মাল-সম্পদ যা তোমরা অর্জন করে থাক, তোমাদের ব্যবসা-বানিজ্য যা তোমরা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশংকা করে থাক এবং বাড়ী-ঘর যা তোমরা পসন্দ করে থাক, যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের চাইতে এবং তাঁর পথে জিহাদের চাইতে তোমাদের নিকটে অধিক প্রিয় হয়, তাহ’লে তোমরা প্রতীক্ষায় থাক, যে পর্যন্ত না আল্লাহ স্বীয় নির্দেশসহ আগমন করেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ ফাসেক সম্প্রদায়কে পথ প্রদর্শন করেন না’ (তওবা ৯/২৪)। উপরোক্ত আয়াতে বর্ণিত প্রতিটি নে‘মতের বিষয়ে বান্দাকে জিজ্ঞাসিত হ’তে হবে।
(৫) সদাসঙ্গী পুত্রগণ : এই সঙ্গে আরেকটি নে‘মতের কথা বলা হয়েছে। وَبَنِينَ شُهُودًا ‘সদাসঙ্গী পুত্রগণ’ (মুদ্দাছছির ৭৪/১৩)। অনেকের একাধিক পুত্র সন্তান আছে। কিন্তু কেউ পিতামাতার কাছে থাকেনা। এটা যথার্থ নে‘মত নয়। যে সন্তান সর্বদা পিতামাতার সুখ-দুঃখের সাথী থাকে, সেই-ই হ’ল প্রকৃত নে‘মত।
(৬) পুণ্যশীলা স্ত্রী : আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, إِنَّ الدُّنْيَا كُلَّهَا مَتَاعٌ وَخَيْرُ مَتَاعِ الدُّنْيَا الْمَرْأَةُ الصَّالِحَةُ- ‘নিশ্চয় সমগ্র দুনিয়াটাই সম্পদ। আর দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ সম্পদ হ’ল পুণ্যবতী স্ত্রী’।[28] এই শ্রেষ্ঠ নে‘মত কিভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, সে বিষয়ে স্বামীকে জিজ্ঞেস করা হবে। তেমনি স্ত্রীকেও তার সংসারের গুরু দায়িত্ব পালন সম্পর্কে ক্বিয়ামতের দিন জিজ্ঞাসিত হ’তে হবে’।[29]
(৭) ক্ষুধায় অন্ন : হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন,
خَرَجَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ذَاتَ يَوْمٍ أَوْ لَيْلَةٍ فَإِذَا هُوَ بِأَبِى بَكْرٍ وَعُمَرَ فَقَالَ ্র مَا أَخْرَجَكُمَا مِنْ بُيُوتِكُمَا هَذِهِ السَّاعَةَ গ্ধ. قَالاَ الْجُوعُ يَا رَسُولَ اللهِ. قَالَ ্র وَأَنَا وَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ لأَخْرَجَنِى الَّذِى أَخْرَجَكُمَا، قُومُوا গ্ধ. فَقَامُوا مَعَهُ فَأَتَى رَجُلاً مِنَ الأَنْصَارِ فَإِذَا هُوَ لَيْسَ فِى بَيْتِهِ فَلَمَّا رَأَتْهُ الْمَرْأَةُ قَالَتْ مَرْحَبًا وَأَهْلاً. فَقَالَ لَهَا رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ্র أَيْنَ فُلاَنٌ গ্ধ. قَالَتْ ذَهَبَ يَسْتَعْذِبُ لَنَا مِنَ الْمَاءِ. إِذْ جَاءَ الأَنْصَارِىُّ فَنَظَرَ إِلَى رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَصَاحِبَيْهِ ثُمَّ قَالَ الْحَمْدُ لِلَّهِ مَا أَحَدٌ الْيَوْمَ أَكْرَمَ أَضْيَافًا مِنِّى قَالَ فَانْطَلَقَ فَجَاءَهُمْ بِعِذْقٍ فِيهِ بُسْرٌ وَتَمْرٌ وَرُطَبٌ فَقَالَ كُلُوا مِنْ هَذِهِ. وَأَخَذَ الْمُدْيَةَ فَقَالَ لَهُ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ্র إِيَّاكَ وَالْحَلُوبَ গ্ধ. فَذَبَحَ لَهُمْ فَأَكَلُوا مِنَ الشَّاةِ وَمِنْ ذَلِكَ الْعِذْقِ وَشَرِبُوا فَلَمَّا أَنْ شَبِعُوا وَرَوُوا قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لأَبِى بَكْرٍ وَعُمَرَ وَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ لَتُسْأَلُنَّ عَنْ هَذَا النَّعِيمِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَخْرَجَكُمْ مِنْ بُيُوتِكُمُ الْجُوعُ ثُمَّ لَمْ تَرْجِعُوا حَتَّى أَصَابَكُمْ هَذَا النَّعِيمُ ، رواه مسلم-
‘একদা দিনে বা রাত্রিতে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ঘর থেকে বের হ’লেন। রাস্তায় তিনি আবুবকর ও ওমরকে পেলেন। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন, কোন্ বস্ত্ত এই সময় তোমাদেরকে ঘর থেকে বের করে এনেছে? তারা উভয়ে বললেন, ক্ষুধা, হে আল্লাহর রাসূল! জবাবে রাসূল (ছাঃ) বললেন, যার হাতে আমার জীবন তার কসম করে বলছি, আমাকেও বের করেছে ঐ বস্ত্ত, যা তোমাদেরকে বের করে এনেছে’। অতঃপর বললেন, ওঠো! তারা উঠলেন ও তাঁর সাথে জনৈক আনছারীর বাড়ীতে গেলেন। কিন্তু তখন বাড়ীতে কেউ ছিল না। এমতাবস্থায় বাড়ীওয়ালার স্ত্রী তাঁদের স্বাগত জানালো। রাসূল (ছাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, অমুক কোথায়? স্ত্রী বলল, উনি আমাদের জন্য সুপেয় পানি আনতে গিয়েছেন। এমন সময় আনছার ব্যক্তি এসে গেলেন। তিনি রাসূল (ছাঃ) ও তাঁর দুই সাথীকে দেখে আনন্দে বলে উঠলেন, الْحَمْدُ ِللهِ، مَا أَحَدٌ الْيَوْمَ أَكْرَمَ أَضْيَافًا مِنِّى ‘আল্লাহর জন্য যাবতীয় প্রশংসা! আজকের দিনে সর্বাধিক সম্মানিত মেহমান কারু নেই আমার ব্যতীত’। অতঃপর তিনি গাছে উঠে টাটকা খেজুরের কাঁদি কেটে আনলেন এবং আধা-পাকা, শুকনা ও পাকা খেজুর পরিবেশন করতে লাগলেন। অতঃপর ছুরি নিয়ে ছাগল যবেহ করতে গেলেন। তখন রাসূল (ছাঃ) তাকে বললেন, খবরদার দুগ্ধবতী বকরী যবেহ করো না। অতঃপর ছাগল যবেহ করা হ’ল এবং তিনজনে মিলে রান্না করা গোশত খেলেন। খেজুর খেলেন ও পানি পান করলেন।
খানাপিনা শেষে পরিতৃপ্ত হয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আবুবকর ও ওমর (রাঃ)-কে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘যার হাতে আমার জীবন তার কসম করে বলছি, আজকের এই নে‘মত সম্পর্কে তোমরা ক্বিয়ামতের দিন অবশ্যই জিজ্ঞাসিত হবে। ক্ষুধা তোমাদেরকে ঘর থেকে বের করে এনেছিল। অতঃপর তোমরা ফিরে যাওনি এই নে‘মত না পাওয়া পর্যন্ত’।[30]
মুসনাদে আবু ইয়া‘লা (হা/৭৮) আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে এবং ছহীহ ইবনু হিববান (হা/৫২১৬) ইবনু আববাস (রাঃ) থেকে ওমর (রাঃ) বর্ণিত রেওয়ায়াতে দুপুর বেলায় যোহর ছালাত শেষে দু’জনের মসজিদে ঠেস দিয়ে বসে থাকার কথা এসেছে। তিরমিযী (হা/২৩৬৯-৭০) ও আবু ইয়া‘লা (হা/২৫০)-তে উক্ত আনছার ছাহাবীর নাম এসেছে, আবুল হায়ছাম মালেক ইবনুত তাইয়েহান (ابو الهيثم مالك ابن التيِّهان)। সেখানে একথাও এসেছে যে, রাসূল (ছাঃ) গিয়ে প্রথমে তিনবার সালাম করেন। কিন্তু সাড়া না পেয়ে ফিরে আসতে উদ্যত হ’লেন। এমন সময় তার স্ত্রী ছুটে এসে বললেন, يَا رَسُوْلَ اللهِ سَمِعْتُ تَسْلِيْمَكَ وَلَكِنْ أَرَدْتُ أَنْ يَّزِيْدَنَا مِنْ سَلاَمِكَ ‘হে রাসূল! আমি আপনার সালাম শুনেছিলাম। কিন্তু আমাদের উপর আপনার সালাম আরও বেশী পাবার আকাংখায় জবাব না দিয়ে দরজার আড়ালে লুকিয়ে ছিলাম’। রাসূল (ছাঃ) খুশী হয়ে বললেন, خيرًا ‘বেশ’। আবুল হায়ছাম কোথায়? তাকে দেখছি না যে? উম্মুল হায়ছাম বললেন, উনি আমাদের জন্য পানি আনতে গিয়েছেন’।[31]
উল্লেখ্য যে, এই মহা সৌভাগ্যবান মেযবান আবুল হায়ছাম আনছারীর (রাঃ)-এর প্রশংসা করে বিখ্যাত সৈনিক কবি ও পরবর্তীতে ৮ম হিজরীর জুমাদাল ঊলা মাসে রোমকদের বিরুদ্ধে সংঘটিত ঐতিহাসিক মুতা যুদ্ধের অন্যতম শহীদ সেনাপতি আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা (রাঃ) তাঁর ছয় লাইনের বিখ্যাত কবিতা রচনা করেন (কুরতুবী)। যার দু’টি লাইন নিম্নরূপ :
فَلَمْ أَرَ كَالْإِسْلاَمِ عِزًّا لِأُمَّةٍ + وَلاَ مِثْلَ أَضْيَافِ الْإِرَاشِيِّ مَعْشَرًا
نَبِيٌّ وَصِدِّيقٌ وَفَارُوقُ أُمَّةٍ + وَخَيْرُ بَنِي حَوَّاءَ فَرْعًا وَعُنْصُرًا
‘উম্মতের জন্য ইসলামের চাইতে সম্মান আমি কিছুতে দেখিনি। আর ইরাশীর মেহমানদের ন্যায় মর্যাদাবান কাউকে আমি মানবজাতির মধ্যে দেখিনি’। ‘নবী, ছিদ্দীক ও উম্মতের ফারূক। শাখা ও মূলে হাওয়ার সন্তানদের মধ্যে সেরা’ (কুরতুবী)। ইরাশ একটি স্থানের নাম। বাড়ীওয়ালা মেযবান সেদিকে সম্পর্কিত।
উপরোক্ত ঘটনায় প্রমাণিত হয় যে, ক্ষুৎ-পিপাসায় অন্নদান আল্লাহর এক অমূল্য নে‘মত। এজন্য আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) পাখি থেকে উপদেশ হাছিল করতে বলেছেন। যেমন ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) বলেন,
سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ: لَوْ أَنَّكُمْ تَوَكَّلْتُمْ عَلَى اللهِ حَقَّ تَوَكُّلِهِ لَرَزَقَكُمْ كَمَا يَرْزُقُ الطَّيْرَ تَغْدُو خِمَاصًا وَتَرُوْحُ بِطَانًا-
‘আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি যে, যদি তোমরা আল্লাহর উপর যথার্থভাবে ভরসা করতে পার, তাহ’লে অবশ্যই তিনি তোমাদেরকে রিযিক দান করবেন, যেভাবে তিনি পাখিকে রিযিক দিয়ে থাকেন। তারা সকালে ক্ষুধার্ত অবস্থায় বাসা থেকে বের হয় ও সন্ধ্যায় পেট ভরে ফিরে আসে’।[32]
(৮) জীবন একটি নে‘মত : আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বলেন,
لاَ تَزُوْلُ قَدَمَا ابْنِ آدَمَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مِنْ عِنْدِ رَبِّهِ حَتَّى يُسْأَلَ عَنْ خَمْسٍ : عَنْ عُمْرِهِ فِيْمَا أَفْنَاهُ وَعَنْ شَبَابِهِ فِيْمَا أَبْلاَهُ وَمَالِهِ مِنْ أَيْنَ اكْتَسَبَهُ وَفِيْمَ أَنْفَقَهُ وَمَاذَا عَمِلَ فِيْمَا عَلِمَ-
‘ক্বিয়ামতের দিন আদম সন্তান তার প্রভুর নিকট থেকে পাঁচটি প্রশ্নের জবাব না দিয়ে পা বাড়াতে পারবে না। ১- তার জীবন সম্পর্কে, কিসে তা শেষ করেছিল। ২- তার যৌবন সম্পর্কে, কিসে তা জীর্ণ করেছিল। ৩- তার মাল সম্পর্কে, কোন পথে তা অর্জন করেছিল এবং ৪- কোন পথে তা ব্যয় করেছিল। ৫- তার ইল্ম সম্পর্কে, তদনুযায়ী সে আমল করেছিল কি-না’।[33]
অত্র হাদীছটি মানুষের পুরা জীবনকেই নে‘মত গণ্য করে। বিশেষ করে দ্বীনী ইল্মের নে‘মত। কেননা বাকী চারটা সবার থাকলেও ইল্ম সবার থাকে না। অধিকন্তু ইল্ম অনুযায়ী আমলকারী আলেমের সংখ্যা খুবই কম।
(৯) সকল নবী ও শেষনবী : আল্লাহ বলেন, وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولاً أَنِ اعْبُدُوا اللهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوْتَ ‘আমরা প্রত্যেক জাতির নিকট রাসূল পাঠিয়েছি এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং ত্বাগূত থেকে বিরত হও’ (নাহল ১৬/৩৬)। বস্ত্ততঃ এটাই ছিল মানবজাতির প্রতি আল্লাহর সবচেয়ে বড় অনুগ্রহ। এজন্য প্রেরিত ১ লক্ষ ২৪ হাযার নবী-রাসূলের মধ্যে প্রথম মানুষ আদম (আঃ) ছিলেন প্রথম নবী।[34] অতঃপর শেষনবী[35] মুহাম্মাদ (ছাঃ) ছিলেন জগদ্বাসীর প্রতি রহমত স্বরূপ। যেমন আল্লাহ বলেন, وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلاَّ رَحْمَةً لِّلْعَالَمِيْنَ ‘আমরা তো তোমাকে জগদ্বাসীর জন্য কেবল রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছি’ (আম্বিয়া ২১/১০৭)। মুহাম্মাদ ইবনু কা‘ব আলোচ্য আয়াতের তাফসীরে বলেন, هو ما أنعم الله علينا بمحمد صلى الله عليه و سلم ‘ঐ নে‘মত হ’লেন স্বয়ং মুহাম্মাদ (ছাঃ)। যাঁকে আল্লাহ আমাদের উপরে নে‘মত স্বরূপ প্রেরণ করেছেন’ (কুরতুবী)। যেমন আল্লাহ বলেন,
لَقَدْ مَنَّ اللهُ عَلَى الْمُؤمِنِيْنَ إِذْ بَعَثَ فِيْهِمْ رَسُوْلاً مِّنْ أَنْفُسِهِمْ
‘আল্লাহ ঈমানদারগণের উপর অনুগ্রহ করেছেন, যখন তিনি তাদের মাঝে তাদের নিজেদের মধ্য থেকেই একজন রাসূল পাঠিয়েছেন…’ (আলে ইমরান ৩/১৬৪)।
সকল উম্মতের প্রতি নবী প্রেরণের এই মহা নে‘মত সম্পর্কে কাফের ও ফাসেকদের জাহান্নামে নিক্ষেপের সময় সেখানকার দাররক্ষীরা জিজ্ঞেস করবে,
أَلَمْ يَأْتِكُمْ رُسُلٌ مِّنكُمْ يَتْلُوْنَ عَلَيْكُمْ آيَاتِ رَبِّكُمْ وَيُنْذِرُوْنَكُمْ لِقَاءَ يَوْمِكُمْ هَذَا ؟ قَالُوا بَلَى وَلَكِنْ حَقَّتْ كَلِمَةُ الْعَذَابِ عَلَى الْكَافِرِينَ-
‘তোমাদের কাছে কি তোমাদের মধ্য থেকে রাসূলগণ আসেননি? তারা কি তোমাদের নিকট তোমাদের প্রতিপালকের আয়াতসমূহ পাঠ করেননি? এবং তোমাদেরকে আজকের দিনে সাক্ষাতের ব্যাপারে তাঁরা কি সতর্ক করেননি? তারা বলল, হ্যাঁ’। কিন্তু অবিশ্বাসীদের প্রতি শাস্তির আদেশ বাস্তবায়িত হয়েছে’ (যুমার ৩৯/৭১)।
(১০) ইসলামের বিধান হালকা হওয়া : হাসান বাছরী ও মুফাযযাল বলেন, উক্ত নে‘মত হ’ল, আমাদের উপর শরী‘আতের বিধানসমূহকে হালকা করা এবং কুরআনকে সহজ করা (কুরতুবী)। যেমন আল্লাহ বলেন, وَمَا جَعَلَ عَلَيْكُمْ فِي الدِّيْنِ مِنْ حَرَجٍ ‘আর তিনি তোমাদের উপরে দ্বীনের ব্যাপারে কোন সংকীর্ণতা রাখেননি’ (হজ্জ ২২/৭৮)। যেমন ইহুদীদের জন্য বিধান ছিল শিরকের তওবা কবুল হওয়ার জন্য মৃত্যুদন্ড গ্রহণ করা (বাক্বারাহ ২/৫৪)। অথচ ইসলামে কথা ও কর্মের মাধ্যমে অন্তর থেকে তওবা করাই যথেষ্ট। এছাড়াও যেমন সফরে ছালাত জমা ও ক্বছর করা, পরিবহনে ক্বিবলা বাধ্যতামূলক না হওয়া, অপারগ অবস্থায় বসে, কাৎ হয়ে বা ইশারায় ছালাত আদায় করা, মোযার উপর মাসাহ করা, সফরে ছিয়াম ক্বাযা করা, ঋতু অবস্থায় মেয়েদের ছালাত মাফ হওয়া ও ছিয়াম ক্বাযা করা ইত্যাদি। অন্যত্র আল্লাহ কুরআন সম্পর্কে বলেন, وَلَقَدْ يَسَّرْنَا الْقُرْآنَ لِلذِّكْرِ فَهَلْ مِنْ مُّدَّكِرٍ؟ ‘আমরা কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি উপদেশ লাভের জন্য। অতএব উপদেশ গ্রহণকারী কেউ আছে কি’? (ক্বামার ৫৪/১৭, ২২, ৩২, ৪০)। উল্লেখ্য যে, কুরআন সহজ হওয়ার অর্থ হ’ল, এর তেলাওয়াত সহজ এবং এর শিক্ষা-দীক্ষাসমূহ স্পষ্ট ও বাস্তবায়নযোগ্য। যেমন ছালাত পড়, ছিয়াম রাখো, অন্যায়-অশ্লীলতা হ’তে দূরে থাক ইত্যাদি। কিন্তু কুরআন থেকে আহকাম বের করা ও আয়াতের উদ্দেশ্য অনুধাবন করাটা সহজ নয়। এজন্য যোগ্য ও তাক্বওয়াশীল আলেম হওয়া যরূরী।
(১১) কুরআন ও সুন্নাহ : কুরআন ও সুন্নাহ উম্মতের নিকটে রেখে যাওয়া শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর দুই জীবন্ত মু‘জেযা, দুই পবিত্র আমানত এবং মানবজাতির জন্য আল্লাহর সবচাইতে বড় নে‘মত। বিদায় হজ্জের সময় আইয়ামে তাশরীক্বের মধ্যবর্তী দিনের এক ভাষণে রাসূল (ছাঃ) বলেন, تَرَكْتُ فِيكُمْ أَمْرَيْنِ لَنْ تَضِلُّوا مَا مَسَّكْتُمْ بِهِمَا كِتَابَ اللهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّهِ- ‘তোমাদের মাঝে আমি দু’টি বস্ত্ত ছেড়ে গেলাম। তোমরা কখনোই পথভ্রষ্ট হবে না যতদিন এ দু’টি বস্ত্তকে তোমরা কঠিনভাবে আঁকড়ে থাকবে। আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নবীর সুন্নাহ’।[36]
এখন রাসূল নেই, খলীফাগণ নেই। উম্মতের সম্মুখে রয়েছে কেবল কুরআন ও হাদীছের দুই অমূল্য নে‘মত। অতএব সে অনুযায়ী মুসলিম উম্মাহ তাদের সার্বিক জীবন পরিচালনা করেছে কি-না, সে বিষয়ে আল্লাহর নিকটে অবশ্যই জওয়াবদিহি করতে হবে।
শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) ছিলেন বিশ্বনবী।[37] কুরআন ও সুন্নাহ হ’ল আল্লাহ প্রেরিত বিশ্ববিধান। যা সমগ্র মানবজাতির জন্য আল্লাহ প্রেরিত সর্বশেষ এলাহী বিধান। অতএব মুসলিম-অমুসলিম সকলকেই উক্ত ইলাহী নে‘মত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, وَالَّذِى نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ لاَ يَسْمَعُ بِى أَحَدٌ مِنْ هَذِهِ الأُمَّةِ يَهُودِىٌّ وَلاَ نَصْرَانِىٌّ ثُمَّ يَمُوتُ وَلَمْ يُؤْمِنْ بِالَّذِى أُرْسِلْتُ بِهِ إِلاَّ كَانَ مِنْ أَصْحَابِ النَّارِ যার হাতে মুহাম্মাদের জীবন, তার কসম করে বলছি, ইহুদী হৌক, নাছারা হৌক এই উম্মতের যে কেউ আমার আগমনবার্তা শুনেছে, অতঃপর মৃত্যুবরণ করেছে, অথচ আমি যা নিয়ে প্রেরিত হয়েছে, তার উপরে বিশ্বাস স্থাপন করেনি, সে অবশ্যই জাহান্নামী হবে’।[38]
বস্ত্ততঃপক্ষে উপরে বর্ণিত সকল বিষয়ই আল্লাহর গুরুত্বপূর্ণ নে‘মত। এগুলি সম্পর্কে বান্দাকে জিজ্ঞাসা করা হবে। তারা দুনিয়ায় থাকতে এগুলির শুকরিয়া আদায় করেছিল, না কুফরী করেছিল। এই প্রশ্ন প্রত্যেক মানুষকেই করা হবে। আল্লাহ আমাদেরকে আখেরাতে জবাবদানের তাওফীক দান করুন -আমীন!
সারকথা :
অধিক পাওয়ার আকাংখা পরিহার করতে হবে এবং অল্পে তুষ্ট থাকতে হবে। সাথে সাথে আখেরাতে আল্লাহর নে‘মত সমূহের জওয়াবদিহি করার জন্য সদা প্রস্ত্তত থাকতে হবে।
[25]. হাকেম হা/৭৮৪৬, বায়হাক্বী-শো‘আব, তিরমিযী; ছহীহুল জামে‘ হা/১০৭৭; ছহীহাহ হা/১১৫৭; মিশকাত হা/৫১৭৪।
[30]. মুসলিম হা/২০৩৮ ‘পানীয় সমূহ’ অধ্যায়, ২০ অনুচ্ছেদ; তিরমিযী হা/২৩৬৯; মিশকাত হা/৪২৪৬ ‘খাদ্য সমূহ’ অধ্যায়, ‘মেহমানদারী’ অনুচ্ছেদ। উপরোক্ত হাদীছের রাবী হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) ৭ম হিজরীতে খায়বর যুদ্ধের সময় ইসলাম কবুল করেছিলেন। এতে অনেকে ধারণা করেন ঘটনাটি অনেক পূর্বের, যা তিনি শুনে বর্ণনা করেছেন। কেননা খায়বর যুদ্ধে বিজয়ের পর গণীমত হিসাবে রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরাম অনেক সম্পদের অধিকারী হয়েছিলেন এবং তিনি নিজে ‘ফিদাক’ খেজুর বাগানের মালিক হন। এর জবাবে ইমাম নববী (রহঃ) বলেন, هذا زعم باطل এটি একটি বাতিল ধারণা মাত্র। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমৃত্যু সচ্ছলতা ও দরিদ্রতার মধ্যে পরিক্রান্ত হয়েছেন। কখনো তিনি সম্পদশালী হয়েছেন, আবার কখনো নিঃস্ব হয়েছেন’। যেমন আয়েশা, আবু হুরায়রা (রাঃ) প্রমুখ ছাহাবী বর্ণিত হাদীছ সমূহে এসেছে যে, মৃত্যুকালে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দীনার, দিরহাম, বকরী, উট, গোলাম, বাঁদী কিছুই রেখে যাননি। এরপরও যদি কিছু থেকে থাকে, সবই ছাদাক্বা হয়ে গিয়েছিল (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৫৯৬৪-৬৭, ফাযায়েল ও শামায়েল অধ্যায়, ১০ অনুচ্ছেদ)। উল্লেখ্য যে, হাদীছটি আবু হুরায়রা (রাঃ) ছাড়াও হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস, আবু সালামাহ বিন আব্দুর রহমান প্রমুখ ছাহাবী থেকেও বর্ণিত হয়েছে।