১০৪. সূরা হুমাযাহ -এর তাফসীর
সূরা হুমাযাহ
(নিন্দাকারী)
সূরা ক্বিয়ামাহ-এর পরে মক্কায় অবতীর্ণ।
সূরা ১০৪, আয়াত ৯, শব্দ ৩৩, বর্ণ ১৩৩।
بِسْمِ اللہِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ
পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে (শুরু করছি)।
(১) দুর্ভোগ প্রত্যেক সম্মুখে ও পিছনে নিন্দাকারীর জন্য। |
وَيْلٌ لِكُلِّ هُمَزَةٍ لُمَزَةٍ
|
(২) যারা সম্পদ জমা করে ও তা গণনা করে |
الَّذِي جَمَعَ مَالًا وَعَدَّدَهُ
|
(৩) সে ধারণা করে যে, তার মাল তাকে চিরস্থায়ী করে রাখবে |
يَحْسَبُ أَنَّ مَالَهُ أَخْلَدَهُ
|
(৪) কখনোই না। সে অবশ্যই নিক্ষিপ্ত হবে হুত্বামাহর মধ্যে |
كَلَّا لَيُنْبَذَنَّ فِي الْحُطَمَةِ
|
(৫) তুমি কি জানো ‘হুত্বামাহ’ কি? |
وَمَا أَدْرَاكَ مَا الْحُطَمَةُ
|
(৬) এটি আল্লাহর প্রজ্বলিত অগ্নি |
نَارُ اللَّهِ الْمُوقَدَةُ
|
(৭) যা কলিজা পর্যন্ত পৌঁছে যাবে |
الَّتِي تَطَّلِعُ عَلَى الْأَفْئِدَةِ
|
(৮) এটা তাদের উপরে বেষ্টিত থাকবে |
إِنَّهَا عَلَيْهِمْ مُؤْصَدَةٌ
|
(৯) দীর্ঘ স্তম্ভ সমূহে। |
فِي عَمَدٍ مُمَدَّدَةٍ
|
বিষয়বস্ত্ত :
আলোচ্য সূরায় দু’টি বিষয় আলোচিত হয়েছে। এক- পরনিন্দাকারী ও অর্থলিপ্সু ধনিক শ্রেণীর দুর্ভোগ ও ধ্বংসের কথা (১-৩ আয়াত)।
দুই- ঐসব লোকদের পরকালীন শাস্তির বর্ণনা (৪-৯ আয়াত)।
তাফসীর :
(১) وَيْلٌ لِّكُلِّ هُمَزَةٍ لُّمَزَةٍ ‘দুর্ভোগ প্রত্যেক সম্মুখে ও পিছনে নিন্দাকারীর জন্য’। আল্লাহ وَيْلٌ দিয়ে সূরা শুরু করেছেন। যা كلمة وعيد ‘দুঃসংবাদবাহী শব্দ’। অর্থাৎ দুর্ভোগ প্রত্যেক পরনিন্দাকারী ব্যক্তির জন্য। আবুল ‘আলিয়াহ, হাসান বাছরী, রবী‘ বিন আনাস, মুজাহিদ, আত্বা প্রমুখ বিদ্বান বলেন, الهمزة الذى يَغْتاب ويَطْعن فى وجه الرجل، واللمزة الذى يغتابه من خلفه إذا غاب- ‘হুমাযাহ’ হ’ল ঐ ব্যক্তি যে মানুষের মুখের উপরে নিন্দা করে ও অপদস্থ করে। আর ‘লুমাযাহ’ হ’ল ঐ ব্যক্তি যে পিছনে নিন্দা করে তার অনুপস্থিতিতে’। তবে মুক্বাতিল এর বিপরীত বলেছেন। অর্থাৎ হুমাযাহ পিছনে এবং লুমাযাহ সম্মুখে নিন্দাকারী’। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, المشّاؤون بالنميمة والمفسدون بين الأحبة والباغون للبراء العيب- ‘এরা ঐসব লোক যারা একের কথা অন্যকে লাগিয়ে চোগলখুরী করে। বন্ধুদের মধ্যে ভাঙন ধরায় ও নির্দোষ ব্যক্তিদের দোষ খুঁজে বেড়ায়’। ইবনু কায়সান বলেন, الهمزة الذى يؤذى جلساءه بسوء اللفظ واللمز الذى يكسر عينه على جليسه ويشير بعينه ورأسه وحاجبيه- ‘হুমাযাহ’ হ’ল, যে ব্যক্তি বৈঠকের সাথীদের মন্দ ভাষা বলে কষ্ট দেয় এবং ‘লুমাযাহ’ হ’ল, যে ব্যক্তি চোখ, মাথা বা ভ্রুর সাহায্যে বৈঠকের কোন সাথীর বিরুদ্ধে মন্দ ইঙ্গিত করে’। যেমন আল্লাহ বলেন, إِنَّ الَّذِيْنَ أَجْرَمُوا كَانُوا مِنَ الَّذِيْنَ آمَنُوا يَضْحَكُوْنَ وَإِذَا مَرُّوا بِهِمْ يَتَغَامَزُونَ ‘যারা পাপী তারা মুমিনদের দেখে হাসে’। ‘আর যখন তারা তাদের নিকট দিয়ে যায়, তখন চোখ টিপে কটাক্ষ করে’ (মুত্বাফফেফীন ৮৩/২৯-৩০)।
هُمَزَةٍ -এর আভিধানিক অর্থ الكسر ‘ভাঙ্গা’। আরবী বর্ণমালার ‘হামযাহ’ অক্ষরটি ভগ্ন হওয়ার কারণে ওটাকে ‘হামযাহ’ বলা হয়। لُّمَزَةٍ অর্থ الطعن والضرب ‘আঘাত করা বা প্রহার করা’। الهمز واللمز দু’টি সমার্থক শব্দ। যার অর্থ الدفع والضرب প্রতিরোধ করা ও প্রহার করা। সেখান থেকে হুমাযাহ ও লুমাযাহ কথাটি পরনিন্দাকারী ব্যক্তির জন্য প্রসিদ্ধ হয়ে গেছে (কুরতুবী, তানতাভী)। কেননা এর ফলে মানুষের অন্তরে আঘাত করা হয় ও তাতে সম্পর্ক বিনষ্ট হয়।
তবে ব্যবহারিকভাবে দু’টি শব্দের মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে। সেটি হ’ল الهمز بالفعل واللمز باللسان। অর্থাৎ همز হ’ল কাজের মাধ্যমে নিন্দা করা, আর لمز হ’ল কথার মাধ্যমে নিন্দা করা। প্রথমটির উদাহরণ হিসাবে মক্কার ধনকুবের অলীদ বিন মুগীরাহর চোগলখুরী চরিত্র তুলে ধরে আল্লাহ বলেন, هَمَّازٍ مَّشَّاءٍ بِنَمِيْمٍ ‘সে পিছনে নিন্দা করে এবং একের কথা অপরের নিকট লাগিয়ে বেড়ায়’ (ক্বলম ৬৮/১১)। দ্বিতীয়টির উদাহরণ হিসাবে মুনাফিক ও দুনিয়াপূজারীদের চরিত্র বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ বলেন, وَمِنْهُمْ مَّنْ يَّلْمِزُكَ فِي الصَّدَقَاتِ فَإِنْ أُعْطُواْ مِنْهَا رَضُواْ وَإِن لَّمْ يُعْطَوْا مِنْهَا إِذَا هُمْ يَسْخَطُوْنَ- ‘তাদের মধ্যে এমন লোকও রয়েছে, যারা ছাদাক্বা বণ্টনে তোমাকে পিছনে দোষারোপ করে। তারা কিছু পেলে খুশী হয়, আর না পেলে ক্ষুব্ধ হয়’ (তওবা ৯/৫৮)।
আয়াতটি রাসূল (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে নিন্দাকারী মক্কার নেতা আখনাস বিন শারীক্ব, অলীদ বিন মুগীরাহ, উবাই ইবনে খালাফ প্রমুখের উদ্দেশ্যে নাযিল হ’লেও (কুরতুবী) এর বক্তব্য সর্বযুগের সকল পরনিন্দাকারীর জন্য প্রযোজ্য।
(২) اَلَّذِيْ جَمَعَ مَالاً وَّعَدَّدَهُ ‘যারা মাল জমা করে ও তা গণনা করে’।
অর্থ كنز المال ولم ينفقه فى وجوه البر لله ‘মাল জমা করে এবং তা আল্লাহর জন্য কোন সৎকর্মে ব্যয় করে না’। মুহাম্মাদ ইবনু কা‘ব বলেন, ألهاه ماله بالنهار هذا إلى هذا، فإذا كان بالليل نام كأنه جيفة- ‘দিনের বেলায় মাল তাকে গাফেল রাখে এই মাল ঐ মাল করে। আর রাতের বেলায় সে ঘুমে মরা লাশের মত পড়ে থাকে’ (ইবনু কাছীর)। অর্থাৎ সে কেবল টাকার পিছনে ছুটেই জীবন শেষ করে। রূহের খোরাক দেয় না। আল্লাহর হক আদায় করে না। ইবাদতের জন্য তার সময় জোটে না। যেমন অন্যত্র আল্লাহ বলেন, وَجَمَعَ فَأَوْعَى ‘সে সম্পদ জমা করে ও তা আগলে রাখে’ (মা‘আরেজ ৭০/১৮)। অত্র আয়াতে পুঁজিবাদীদের প্রচন্ডভাবে ধিক্কার দেওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য যে, যাকাত আদায় ও প্রয়োজনীয় দানশীলতা বজায় রেখে ভবিষ্যতের জন্য মাল সঞ্চয় করা দোষণীয় নয়। বরং দোষণীয় হ’ল মাল উপার্জন ও সঞ্চয় করাকেই মুখ্য বিষয় হিসাবে গণ্য করা ও সেই চিন্তায় জীবনপাত করা।
(৩) يَحْسَبُ أَنَّ مَالَهُ أَخْلَدَهُ ‘সে ধারণা করে যে, মাল তাকে চিরস্থায়ী করে রাখবে’।
এখানে أَخْلَدَهُ অর্থ দু’টো হ’তে পারে اخلد ذكره او طال عمره ‘তার স্মৃতি চিরস্থায়ী হবে অথবা তার হায়াত দীর্ঘ হবে’।
টাকা থাকলে স্বাস্থ্য-সুখ সবই ঠিক থাকবে এবং সে দুনিয়াতে চিরস্থায়ী হবে, এমন এক উদ্ভট ধারণা ধনলিপ্সু কৃপণ লোকেরা মনের মধ্যে লালন করে থাকে। অথচ সে যদি কৃপণ হয়, তাহ’লে তার দুর্নামটাই চিরস্থায়ী হয়। যেমন কৃপণ সেরা ক্বারূণের দুর্নাম। পক্ষান্তরে যদি যে দানশীল হয়, তাহ’লে তার সুনাম মানুষের মুখে মুখে থাকে। যেমন হাতেম তাঈ, আবুবকর, ওমর, ওছমান (রাঃ), হাজী মুহসিন প্রমুখ। পরপর বর্ণিত দু’টি আয়াতে আল্লাহ বস্ত্তবাদী ও দুনিয়াপূজারীদের অবাস্তব উচ্চাকাংখার বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন এবং তাদের ধিক্কার দিয়ে বলেছেন, তারা কি ভেবেছে যে, তাদের ধন-সম্পদ তাদেরকে ক্ষণস্থায়ী এ দুনিয়ায় চিরস্থায়ী করে রাখবে? ইকরিমা বলেন, أى يزيد فى عمره؟ ‘সে কি ভেবেছে যে, তার ধন-সম্পদ তার আয়ু বৃদ্ধি করে দেবে’? এখানে أَخْلَدَهُ অতীতকালের ক্রিয়াপদ হ’লেও এর অর্থ হবে ভবিষ্যৎকালের। যেমন বলা হয়ে থাকে, هلك والله فلان ودخل النار اى يدخل ‘আল্লাহর কসম! সে ধ্বংস হয়েছে এবং জাহান্নামে গেছে। অর্থ সে জাহান্নামে যাবে’ (কুরতুবী)। অতএব আয়াতের অর্থ হবে, সে কি ভেবেছে যে, তার মাল তাকে ভবিষ্যতে চিরস্থায়ী করে রাখবে বা তাকে দীর্ঘজীবী করবে?
হযরত আনাস ইবনে মালেক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, يَتْبَعُ الْمَيِّتَ ثَلاَثَةٌ، فَيَرْجِعُ اثْنَانِ وَيَبْقَى مَعَهُ وَاحِدٌ، يَتْبَعُهُ أَهْلُهُ وَمَالُهُ وَعَمَلُهُ، فَيَرْجِعُ أَهْلُهُ وَمَالُهُ، وَيَبْقَى عَمَلُهُ– ‘মৃত ব্যক্তির সাথে তিনজন যায়। তার মধ্যে দু’জন ফিরে আসে ও একজন তার সাথে থেকে যায়। সঙ্গে যায় তার পরিবার, তার মাল ও আমল। অতঃপর তার পরিবার ও মাল ফিরে আসে এবং আমল তার সাথে থেকে যায়’।[1]
আমল যদি পাপের হয়, তাহ’লে ঐ আমলের কারণে তাকে জাহান্নামে যেতে হবে। অর্থগৃধণু কৃপণ ব্যক্তি, যে তার অর্থ-সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করেনি, কেবলই সঞ্চয় করেছে, তার সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
وَالَّذِيْنَ يَكْنِزُوْنَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلاَ يُنْفِقُوْنَهَا فِيْ سَبِيْلِ اللهِ فَبَشِّرْهُمْ بِعَذَابٍ أَلِيْمٍ، يَوْمَ يُحْمَى عَلَيْهَا فِيْ نَارِ جَهَنَّمَ فَتُكْوَى بِهَا جِبَاهُهُمْ وَجُنُوْبُهُمْ وَظُهُوْرُهُمْ هَذَا مَا كَنَزْتُمْ لِأَنْفُسِكُمْ فَذُوْقُوْا مَا كُنْتُمْ تَكْنِزُوْنَ–
‘আর যারা স্বর্ণ-রৌপ্য জমা করে, অথচ তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদেরকে কঠিন আযাবের সুসংবাদ দাও’। ‘সেদিন জাহান্নামের আগুনে মালগুলি উত্তপ্ত করা হবে। অতঃপর তা দ্বারা তাদের ললাট, পার্শ্বদেশ ও পৃষ্ঠদেশ দগ্ধ করা হবে (এবং বলা হবে,) এগুলো সেই মাল, যা তোমরা নিজেদের জন্য সঞ্চয় করেছিলে। অতএব এখন তোমাদের সঞ্চয়ের স্বাদ গ্রহণ করো’ (তওবা ৯/৩৪-৩৫)।
অত্র আয়াতে পুঁজিবাদ ও পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা ব্যক্ত করা হয়েছে। কেননা এ অর্থনীতি মানুষকে অর্থনৈতিক পশুতে পরিণত করে। টাকার মানদন্ডে উঁচু-নীচু ও ন্যায়-অন্যায় বিচার করা হয়। পুঁজিবাদী ব্যক্তি ও সরকার পুঁজির স্বার্থে যেকোন অন্যায় করতে প্রস্ত্তত থাকে। আধুনিক বিশ্বে বড় বড় যতগুলি যুদ্ধ হয়েছে, সব কেবলই পুঁজিবাজার বৃদ্ধির স্বার্থে। আজকের পৃথিবীতে যে প্রকট খাদ্যাভাব চলছে, তার জন্য সিংহভাগ দায়ী পুঁজিবাদী অর্থনীতি এবং মানুষের পুঁজিবাদী মানসিকতা ও বিশ্বব্যাপী চক্রবৃদ্ধিহারে সূদী কারবারের ব্যাপকতা। যা কেবল অন্ধ দুনিয়াপূজারই তিক্ত ফল মাত্র।
(৪) كَلاَّ لَيُنْبَذَنَّ فِي الْحُطَمَةِ ‘কখনোই না। সে অবশ্যই নিক্ষিপ্ত হবে ‘হুত্বামাহ্’র মধ্যে’। অর্থ حَقَّا لَيُطْرَحَنَّ ‘অবশ্যই সে নিক্ষিপ্ত হবে’।
نَبَذَ يَنْبِذُ نَبْذًا ‘নিক্ষেপ করা’। এই শব্দ প্রয়োগের মাধ্যমে পুঁজিবাদী ব্যক্তির প্রতি আল্লাহর প্রচন্ড ঘৃণা ও তাচ্ছিল্য প্রকাশ পেয়েছে। كَلاَّ হ’ল كلمة ردع প্রত্যাখ্যানকারী অব্যয়। অর্থাৎ ধনলিপ্সু কাফেররা যা ধারণা করে, সেটা কখনোই হবার নয়। ওমর বিন আব্দুল্লাহ (গুফরাহর গোলাম) বলেন, আল্লাহ পাক যেখানেই كَلاَّ বলেন, সেখানে তার অর্থ হবে যেন তিনি বলছেন, كَذَبْتَ ‘তুমি মিথ্যা বলেছ’ (কুরতুবী)। অতএব كَلاَّ অর্থ حَقَّا لَيُنْبَذَنَّ ‘অবশ্যই সে নিক্ষিপ্ত হবে’। অথবা উহ্য শপথের জওয়াব, وَاللهِ لَيُنْبَذَنَّ আল্লাহর কসম! সে নিক্ষিপ্ত হবে’।
এখানে ‘কখনোই না’ বলে একথা বুঝানো হয়েছে যে, ধন-সম্পদ কাউকে চিরজীবী বা দীর্ঘজীবী করে না। বরং মাল ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু তার নেক আমল বেঁচে থাকে। এই নেক আমল বা সৎকর্ম তাকে যেমন দুনিয়াতে সুনাম-সুখ্যাতির সাথে বাঁচিয়ে রাখে, আখেরাতেও তেমনি তার সাথী হয় এবং তার জান্নাতের অসীলা হয়।
الْحُطَمَةِ একটি জাহান্নামের নাম। الحطمة هى التى تحطم الشئ اى تفتته ‘যা বস্ত্তকে পিষ্ট করে’ অর্থাৎ পিষ্টকারী। حَطَمَ يَحْطِمُ حَطْمًا অর্থ كَسَرَ يَكْسِرُ كَسْرًا ‘ভেঙ্গে ফেলা’। সকল জাহান্নামই পিষ্টকারী। কিন্তু হুত্বামাহ জাহান্নামের বিশেষ কোন বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে, যেজন্য এভাবে বিশেষ নামকরণ করা হয়েছে। ইবনু কাছীর (রহঃ) জাহান্নামের আটটি নাম উল্লেখ করেছেন। যথা : নার, জাহীম, সাক্বার, জাহান্নাম, হাভিয়াহ, হাফেরাহ, লাযা, হুত্বামাহ (নাযে‘আত ১০ আয়াতের তাফসীর)।
(৫) وَمَا أَدْرَاكَ مَا الْحُطَمَةُ ‘তুমি কি জানো ‘হুত্বামাহ’ কি?
প্রশ্নবোধক বাক্যের মাধ্যমে হুত্বামাহ জাহান্নামের ভয়ংকর রূপ বুঝানো হয়েছে। এই বিশেষ ও কঠিনতম আযাবের জাহান্নামেই মাল সঞ্চয়কারী ও গণনাকারী ধনলিপ্সু পুঁজিবাদী লোকদের শাস্তি দেয়া হবে।
(৬) نَارُ اللهِ الْمُوْقَدَةُ ‘এটি আল্লাহর প্রজ্বলিত অগ্নি’।
এটি পূর্ববর্তী আয়াতের জওয়াব। এখানে نَارُ اللهِ বলে জাহান্নামকে আল্লাহর দিকে সম্বন্ধ করার উদ্দেশ্য হ’ল এই যে, শাস্তি পাওয়ার হকদার ব্যক্তিই মাত্র শাস্তি পাবে। যা হবে ন্যায়বিচারমূলক শাস্তি (عقوبة عدل)। এটি আদৌ অবিচারমূলক শাস্তি (عقوبة جور) নয়। যেমনটি দুনিয়ায় হয়ে থাকে। শক্তিশালী যালেমরা দুনিয়ায় পার পেয়ে যায়। আর দুর্বল মযলূম সর্বদা নির্যাতিত হয়। তাই ন্যায়বিচারের দাবী এটাই যে, ক্বিয়ামতের দিন এরা কঠিন শাস্তিপ্রাপ্ত হউক। আর আল্লাহ সেটাই দিবেন।
وَقَدَ يَقِدُ وَقْدًا وُقُوْدًا অর্থ ‘প্রজ্বলিত হওয়া’। সেখান থেকে مُوْقَدَة ‘প্রজ্বলিত’।
সকল জাহান্নামই আল্লাহর সৃষ্ট এবং সকল জাহান্নামই প্রজ্বলিত অগ্নি। অথচ হুত্বামাহর বেলায় ‘আল্লাহর’ এবং ‘প্রজ্বলিত’ বলার কারণ হ’ল এর বিশেষ ও ভয়ংকর বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা। কুরতুবী বলেন, এ জাহান্নামের আগুন হাযার হাযার বছর ধরে জ্বালানো হয়েছে এবং যা কখনো নিভেনি। এর দ্বারা জাহান্নাম ও জান্নাত যে সৃষ্ট, সেটা বুঝা যায়।
(৭) اَلَّتِيْ تَطَّلِعُ عَلَى الْأَفْئِدَةِ ‘যা কলিজা পর্যন্ত পৌঁছে যাবে’।
الْأَفْئِدَةِ একবচনে فؤاد অর্থ হৃদয় বা কলিজা। اطلع على الشئ اى أشرف عليه او وصل اليه ‘ঝুঁকে পড়া’, পৌঁছে যাওয়া’।
تَطَّلِعُ عَلَى الْأَفْئِدَةِ অর্থ تَهِجُ ألمها على القلوب ‘আগুনের উত্তাপ কলিজা জ্বালিয়ে দিবে’। অর্থাৎ আগুন তার সারা দেহ খেয়ে ফেলবে। এমনকি তার কলিজা পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। কিন্তু সে মরবে না। কেননা আল্লাহ অন্যত্র বলেছেন, لاَ يَمُوْتُ فِيْهَا وَلاَ يَحْيَى ‘সেখানে তারা মরবেও না এবং বাঁচবেও না’ (ত্বোয়াহা ২০/৭৪; আ‘লা ৮৭/১৩)। এখানে নির্দিষ্টভাবে ‘কলিজা’ বলার কারণ হ’ল এই যে, এটিই হ’ল দেহের সবচেয়ে নরম স্থান এবং আগুন যখন কলিজায় পৌঁছে যায়, তখন মানুষ মারা যায়। অর্থাৎ ঐ ব্যক্তি শাস্তির কঠোরতায় মৃত্যুর দুয়ারে উপনীত হবে। কিন্তু মরবে না, যাতে সে শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করতে পারে। আবার বাঁচবেও না যাতে সে স্বস্তি লাভ করে।
(৮) إِنَّهَا عَلَيْهِمْ مُّؤْصَدَةٌ ‘এটা তাদের উপরে বেষ্টিত থাকবে’।
وَصَدَ يَصِدُ وَصْدًا অর্থ ‘দৃঢ় হওয়া’। أَوصد عليه اى ضيَّق عليه ‘সংকীর্ণ হওয়া’। أَوْصَدَ الْبَابَ অর্থ أَغْلَقَهُ ‘দরজা বন্ধ করা’। সেখান থেকে مُّؤْصَدَةٌ অর্থ مطبقة مغلقة الأبواب لا مخلص لهم منها ‘চারদিক থেকে দরজা বন্ধ থাকবে, সেখান থেকে বের হবার কোন পথ পাবে না’। যেমন আল্লাহ অন্যত্র বলেন, كُلَّمَا أَرَادُوا أَنْ يَخْرُجُوا مِنْهَا أُعِيدُوا فِيهَا وَقِيلَ لَهُمْ ذُوقُوا عَذَابَ النَّارِ الَّذِي كُنْتُمْ بِهِ تُكَذِّبُونَ ‘যখনই তারা জাহান্নাম থেকে বের হ’তে চাইবে, তখনই তাদেরকে সেখানে ফিরিয়ে দেওয়া হবে আর বলা হবে, আগুনের শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করো, যাকে তোমরা মিথ্যা বলতে’ (সাজদাহ ৩২/২০)। চলন্ত গাড়ীতে বা কোন গৃহে আগুন ধরে গেলে বদ্ধ দরজার মধ্যে জীবন্ত মানুষ যেভাবে পুড়ে কয়লা হয়ে যায়, এখানে সেটি কল্পনা করা যায়।
(৯) فِيْ عَمَدٍ مُّمَدَّدَةٍ ‘দীর্ঘ স্তম্ভ সমূহে’।
অর্থাৎ তাদেরকে লম্বা লম্বা খুঁটিতে বেঁধে আগুনে পুড়িয়ে শাস্তি দেওয়া হবে। এখানে في অর্থ با অর্থাৎ مؤصدة بعمد ممددة লম্বা লম্বা খুঁটির সাথে দৃঢ়ভাবে বাঁধা হবে (কুরতুবী)। عَمَدٌ وعُمُدٌ একবচনে عَمُوْدٌ وَعِمَادٌ অর্থ খুঁটি (কুরতুবী)। যেমন আল্লাহ বলেন, خَلَقَ السَّمَاوَاتِ بِغَيْرِ عَمَدٍ تَرَوْنَهَا ‘তিনি আকাশমন্ডলী সৃষ্টি করেছেন স্তম্ভসমূহ ব্যতিরেকে, যেটা তোমরা দেখছ’ (লোকমান ৩১/১০; রা‘দ ১৩/২)। রাসূল (ছাঃ) বলেন, رَأْسُ الأَمْرِ الإِسْلاَمُ وَعَمُوْدُهُ الصَّلاَةُ وَذِرْوَةُ سَنَامِهِ الْجِهَادُ ‘মূলবস্ত্ত হ’ল ইসলাম। আর তার খুঁটি হ’ল ছালাত এবং শিখর হ’ল জিহাদ’।[2]
ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, তাদেরকে জাহান্নামে প্রবেশ করানো হবে। তারপর খুঁটির সাথে বাঁধা হবে এবং গলায় বেড়ীবদ্ধ করা হবে। অতঃপর জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হবে’ (ইবনু কাছীর)। এভাবে চূড়ান্ত শাস্তি প্রদান করা হবে। পুঁজিবাদী কৃপণরা সাবধান হবে কি?
সারকথা :
পরনিন্দাকারী ও অর্থলিপ্সু ব্যক্তির জন্য দুনিয়া ও আখেরাতে কেবল ধ্বংসই রয়েছে। পরচর্চাকারীরা মানুষের অন্তরকে ক্ষত-বিক্ষত করে এবং পুঁজিবাদীরা মানুষের প্রাপ্য খাদ্য ছিনিয়ে নিয়ে তাকে ক্ষুৎ-পিপাসায় কাতর ও হত্যা করে। তাই উভয়ের জন্য পরকালে হুত্বামাহর কঠিন শাস্তি নির্ধারিত হয়েছে।