১০৭. সূরা মা‘ঊন -এর তাফসীর
সূরা মা‘ঊন
(নিত্যব্যবহার্য বস্ত্ত)
সূরা তাকাছুর-এর পরে মক্কায় অবতীর্ণ।
সূরা ১০৭, আয়াত ৭, শব্দ ২৫, বর্ণ ১১২।
بِسْمِ اللہِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ
পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে (শুরু করছি)
(১) তুমি কি দেখেছ তাকে, যে বিচার দিবসে মিথ্যারোপ করে? |
أَرَأَيْتَ الَّذِي يُكَذِّبُ بِالدِّينِ
|
(২) সে হ’ল ঐ ব্যক্তি, যে ইয়াতীমকে গলাধাক্কা দেয় |
فَذَلِكَ الَّذِي يَدُعُّ الْيَتِيمَ
|
(৩) এবং অভাবগ্রস্তকে খাদ্য দানে উৎসাহিত করে না |
وَلَا يَحُضُّ عَلَى طَعَامِ الْمِسْكِينِ
|
(৪) অতঃপর দুর্ভোগ ঐসব মুছল্লীর জন্য |
فَوَيْلٌ لِلْمُصَلِّينَ
|
(৫) যারা তাদের ছালাত থেকে উদাসীন |
الَّذِينَ هُمْ عَنْ صَلَاتِهِمْ سَاهُونَ
|
(৬) যারা লোক দেখানোর জন্য তা করে |
الَّذِينَ هُمْ يُرَاءُونَ
|
(৭) এবং নিত্য ব্যবহার্য বস্ত্ত দানে বিরত থাকে। |
وَيَمْنَعُونَ الْمَاعُونَ
|
বিষয়বস্ত্ত :
সূরাটিতে দু’টি বিষয়বস্ত্ত আলোচিত হয়েছে। এক- বিচার দিবসে অবিশ্বাসী ব্যক্তির দু’টি বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য (১-৩ আয়াত)। দুই- পরকালে ক্ষতিগ্রস্ত মুছল্লীর তিনটি বৈশিষ্ট্য (৪-৭ আয়াত)।
তাফসীর :
(১) أَرَأَيْتَ الَّذِيْ يُكَذِّبُ بِالدِّيْنِ ‘তুমি কি দেখেছ তাকে, যে বিচার দিবসে মিথ্যারোপ করে’? এখানে রাসূল (ছাঃ)-কে বলা হ’লেও উদ্দেশ্য হ’ল সকল যুগের অবিশ্বাসী মানুষ।
أَرَأَيْتَ তুমি কি দেখছ? অর্থ أَلَمْ تَعْلَمْ তুমি কি জানো? এখানে الرؤية বা ‘দেখা’ অর্থ العلم ‘জানা’। কেননা শ্রোতার পক্ষে ঐব্যক্তিকে দেখা সম্ভব নয়। প্রশ্নবোধক বাক্য প্রয়োগের উদ্দেশ্য হ’ল বক্তব্যের প্রতি শ্রোতাকে দ্রুত আকৃষ্ট করা ও তাকে উৎসাহিত করা। كَذَبَ يَكْذِبُ كَذِبًا وَكِذْبًا অর্থ ‘মিথ্যা বলা’। كَذَّبَ يُكَذِّبُ تَكْذِيْبًا অর্থ ‘মিথ্যারোপ করা’। ‘সত্যকে মিথ্যা বানানো’। কাফেররা ক্বিয়ামতের সত্য বিষয়কে মিথ্যা বানাতে চায়। এখানে الدِّيْنِ অর্থ বিচার দিবস, হিসাব ও প্রতিফল দিবস (ইবনু কাছীর)।
কুরায়েশ নেতাদের উক্ত দাবী যে মিথ্যা, তার প্রমাণস্বরূপ অতঃপর আল্লাহ তাদের দু’টি প্রধান বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করছেন।-
(২) فَذَلِكَ الَّذِيْ يَدُعُّ الْيَتِيْمَ ‘সে হ’ল ঐ ব্যক্তি, যে ইয়াতীমকে গলাধাক্কা দেয়’। যেমন আল্লাহ অন্যত্র বলেছেন, كَلاَّ بَلْ لاَّ تُكْرِمُوْنَ الْيَتِيْمَ ‘কখনোই না। বরং তোমরা ইয়াতীমকে সম্মান করো না’ (ফজর ৮৯/১৭)।
ক্বিয়ামতে অবিশ্বাসীদের বাহ্যিক দু’টি প্রধান বৈশিষ্ট্য হ’ল ইয়াতীমের প্রতি কঠোর হওয়া এবং তাদের প্রতি দয়াশীল হ’তে অন্যকে নিরুৎসাহিত করা। অত্র আয়াতে প্রথম বৈশিষ্ট্যের কথা বর্ণিত হয়েছে।
ইবনু জুরায়েজ বলেন, আবু সুফিয়ান প্রতি সপ্তাহে অনেকগুলি উট যবহ করত। একদিন একটা ইয়াতীম শিশু তার কাছে কিছু গোশত চায়। কৃপণ আবু সুফিয়ান তাকে গোশত না দিয়ে লাঠি দিয়ে মারে (فقرعه بعصاه)। এর প্রতিবাদে এটি নাযিল হয় (কুরতুবী)। তানতাভী আবু জাহল সম্পর্কেও অনুরূপ একটি বর্ণনা উল্লেখ করেছেন যে, আবূ জাহল একটি ইয়াতীমের অভিভাবক (وصى) ছিল। একদিন ইয়াতীমটি নগ্ন অবস্থায় তার কাছে এসে তার সকল মাল দাবী করে। তাতে আবূ জাহল তাকে ধাক্কিয়ে তাড়িয়ে দেয় (তানতাভী ২৫/২৭৪)।
فَذَلِكَ -এর فاء উহ্য শর্তের জওয়াব হিসাবে এসেছে। অর্থাৎ যদি তুমি বিচার দিবসে অবিশ্বাসীকে না দেখে থাক, তবে তার বাহ্যিক নিদর্শন দেখ। ذَلِكَ হ’ল مبتدأ এবং পরবর্তী বাক্য (موصول) হ’ল خبر।
دَعَّ يَدُعُّ دَعًّا অর্থ ‘ধাক্কানো’। যেমন অন্যত্র আল্লাহ বলেন, يَوْمَ يُدَعُّوْنَ إِلىَ نَارِ جَهَنَّمَ دَعاًّ ‘যেদিন তাদেরকে জাহান্নামের অগ্নির দিকে ধাক্কিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে’ (তূর ৫২/১৩)। এখানে ‘গলাধাক্কা’ কথাটি আনা হয়েছে ইয়াতীমের প্রতি নিকৃষ্টতম আচরণের নমুনা হিসাবে। এতে অন্যান্য যুলুমের নিষেধাজ্ঞার প্রতিও ইঙ্গিত রয়েছে। যেমন ইয়াতীমের হক নষ্ট করা, তার প্রতি সদ্ব্যবহার না করা ইত্যাদি। মালেক বিন হারেছ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ ضَمَّ يَتِيْماً بَيْنَ أَبَوَيْنِ مُسْلِمَيْنِ إِلَى طَعَامِهِ وَشَرَابِهِ حَتَّى يَسْتَغْنِىَ عَنْهُ وَجَبَتْ لَهُ الْجَنَّةُ أَلْبَتَّةَ- ‘যে ব্যক্তি একজন মুসলিম ইয়াতীমকে নিজের সাথে মিলিয়ে নিল এবং সে অভাবমুক্ত হ’ল, তার জন্য জান্নাত অবশ্যই ওয়াজিব হয়ে গেল।[1]
সাহল বিন সা‘দ (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) বলেন, أَنَا وَكَافِلُ الْيَتِيمِ لَهُ وَلِغَيْرِهِ فِى الْجَنَّةِ هَكَذَا. وَأَشَارَ بِالسَّبَّابَةِ وَالْوُسْطَى ‘আমি ও ইয়াতীমের অভিভাবক, তার নিজের বা অপরের, জান্নাতে পাশাপাশি এভাবে অবস্থান করব। এ বলে তিনি শাহাদাত ও মধ্যমা অঙ্গুলী দিয়ে ইশারা করেন’।[2]
(৩) وَلاَ يَحُضُّ عَلَى طَعَامِ الْمِسْكِيْنِ ‘এবং অভাবগ্রস্তকে খাদ্য দানে উৎসাহিত করে না’। অত্র আয়াতে ক্বিয়ামতে অবিশ্বাসীদের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যের কথা বর্ণিত হয়েছে।
حَضَّ يَحُضُّ حَضًّا ‘উৎসাহিত করা’। অর্থাৎ لا يَحُثُّ غيرَه على إطعام المحتاجين ‘তারা অন্যকে অভাবীদের খাদ্য দানে উৎসাহিত করে না’। এটা হ’ল ক্বিয়ামতে অবিশ্বাসীদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যেমন জাহান্নামে নিক্ষিপ্তদের বিষয়ে আল্লাহ বলবেন, وَلاَ يَحُضُّ عَلَى طَعَامِ الْمِسْكِيْنِ ‘তারা অভাবগ্রস্তকে খাদ্য দানে উৎসাহ প্রদান করতো না’ (হা-ক্কাহ ৬৯/৩৪)। এটা যারা কৃপণতাবশে করে, তাদের উদ্দেশ্যেই বলা হয়েছে। কেননা অপারগ অবস্থায় যারা করে, তাদের উদ্দেশ্যে আল্লাহ বলেন, فَقُل لَّهُمْ قَوْلاً مَّيْسُوْراً- ‘তাদের সাথে নম্রভাবে কথা বলো’ (ইসরা ১৭/২৮)। তবে নিজে খাদ্য দিতে না পারলেও অন্যকে খাদ্য দানে উৎসাহিত করা সর্বাবস্থায় সম্ভব। কিন্তু কৃপণরা সেটাও করে না। তাই তাদের ধিক্কার দিয়ে আল্লাহ বলেছেন, وَلاَ تَحَاضُّوْنَ عَلَى طَعَامِ الْمِسْكِيْنِ ‘তারা মিসকীনকে খাদ্য দানের ব্যাপারে (অন্যকে) উৎসাহিত করেনা’ (ফজর ৮৯/১৮)। অন্যত্র কাফেরদের বদস্বভাব বর্ণনা করে আল্লাহ বলেন, وَإِذَا قِيْلَ لَهُمْ أَنْفِقُوْا مِمَّا رَزَقَكُمُ اللهُ قَالَ الَّذِيْنَ كَفَرُوا لِلَّذِيْنَ آمَنُوا أَنُطْعِمُ مَن لَّوْ يَشَاءُ اللهُ أَطْعَمَهُ ‘আর যখন তাদেরকে বলা হয়, আল্লাহ তোমাদেরকে যে রূযী দান করেছেন, তা থেকে ব্যয় কর। তখন কাফেররা মুমিনদের বলে, ইচ্ছা করলে আল্লাহ যাকে খাওয়াতে পারেন, আমরা তাকে কেন খাওয়াতে যাব’? (ইয়াসীন ৩৬/৪৭)। এর দ্বারা তাদের পাথরের ন্যায় শক্ত ও নিষ্ঠুর হৃদয়ের কথা বর্ণনা করা হয়েছে।
বস্ত্ততঃ যুগে যুগে বস্ত্তবাদী মুশরিক, ফাসেক ও মুনাফিকদের চরিত্র একই। ফাসেক-মুনাফিকরা মুখে আল্লাহ ও আখেরাতের কথা বললেও অন্তরে বিশ্বাস করে না এবং আখেরাতে জবাবদিহিতাকে ভয় পায় না। অথচ ধনীর মালে গরীবের হক রয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন, وَالَّذِيْنَ فِي أَمْوَالِهِمْ حَقٌّ مَعْلُوْمٌ، لِلسَّائِلِ وَالْمَحْرُوْمِ ‘আর তাদের মাল-সম্পদে নির্ধারিত হক রয়েছে’। ‘প্রার্থী ও বঞ্চিতদের জন্য’ (মা‘আরিজ ৭০/২৪-২৫)। আর এটা তাদের করুণা নয়। কেননা ধনীরা তাদের মালের প্রকৃত মালিক নয়। বরং সমস্ত মালিকানা কেবলমাত্র আল্লাহর। তিনি ধনীর মাল দিয়ে তার মাধ্যমে গরীবকে সাহায্য করেন। আর এতেই রয়েছে ধনীদের জন্য পরীক্ষা। দানশীলরা জান্নাত পায়। কৃপণরা জাহান্নামী হয়।
(৪) فَوَيْلٌ لِّلْمُصَلِّيْنَ ‘অতঃপর দুর্ভোগ ঐসব মুছল্লীর জন্য’।
وَيْلٌ ধমকি সূচক শব্দ (كلمة وعيد)। যার অর্থ ধ্বংস, দুর্ভোগ। কুরআনের বহু স্থানে শব্দটি এসেছে অবিশ্বাসীদের ধমক দেওয়ার ও দুঃসংবাদ শুনানোর জন্য।
এখানে ‘দুর্ভোগ’ অর্থ জাহান্নামের আযাব (কুরতুবী)। فا অব্যয় আনা হয়েছে পূর্বের বাক্য থেকে পৃথক বিষয়বস্ত্ত বুঝানোর জন্য। কেননা পূর্বের বক্তব্যগুলি ছিল বিচার দিবসে অবিশ্বাসীদের জন্য। এবারের বক্তব্যগুলি আসছে অলস বা লোক দেখানো মুছল্লীদের জন্য।
(৫) اَلَّذِيْنَ هُمْ عَنْ صَلاَتِهِمْ سَاهُوْنَ ‘যারা তাদের ছালাত থেকে উদাসীন’।
سَاهُوْنَ অর্থ غافلون ‘উদাসীন’, ‘অসতর্ক’। যারা لاهون عن الصلوة ويتغافلون عنها ‘ছালাত থেকে উদাসীন ও খেল-তামাশায় ব্যস্ত’। যারা ইচ্ছাকৃতভাবে আউয়াল ওয়াক্ত ছেড়ে যঈফ ওয়াক্তে ছালাত আদায় করে। যারা জানা সত্ত্বেও ছহীহ হাদীছ মোতাবেক ছালাত আদায় করে না। রুকূ-সিজদা, উঠা-বসা যথাযথভাবে করে না। ক্বিরাআত ও দো‘আ-দরূদ ঠিকমত পাঠ করে না। কোন কিছুর অর্থ বুঝে না বা বুঝবার চেষ্টাও করে না। আযান শোনার পরেও যারা অলসতাবশে ছালাতে দেরী করে বা জামা‘আতে হাযির হওয়া থেকে বিরত থাকে। ছালাতে দাঁড়াবার সময় বা ছালাতে দাঁড়িয়েও অমনোযোগী থাকে ইত্যাদি।
হযরত সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ) বলেন, এর অর্থ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, الَّذِيْنَ يُؤَخِّرُوْنَ الصَّلاَةَ عَنْ وَقْتِهَا، تَهَاوُنًا بِهَا– ‘যারা অবহেলা বশে সঠিক সময় থেকে দেরীতে ছালাত আদায় করে’।[3]
চার প্রকার মানুষ :
সমাজে সর্বদা চার ধরনের মানুষ দেখতে পাওয়া যায়। ইসলামে দৃঢ় বিশ্বাসী, শিথিল বিশ্বাসী, কপট বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী। এদের মধ্যে শেষের তিন ধরনের মানুষ তওবা না করলে নিশ্চিতভাবে জাহান্নামী। অত্র আয়াতে ২য় ও ৩য় ধরনের ব্যক্তিদের কথা বলা হয়েছে। এই ধরনের মুছল্লীরাই ইসলামের বড় শত্রু। শুধু ছালাত নয়, যাকাত, ছিয়াম, জুম‘আ, ঈদায়েন, হজ্জ-ওমরাহ প্রভৃতি ইবাদত অনুষ্ঠানসমূহ পালনের মাধ্যমে এরা জনগণের কাছে নিজেদের ধার্মিকতা যাহির করে। অন্যদিকে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ইসলামী বিধান অগ্রাহ্য করে নিজেদের মনগড়া আইন জারি করে এবং জনগণকে তাদের দাসত্বে পিষ্ট করে। ফলে এদের কারণেই দেশে আল্লাহর গযব নেমে আসে ও জাতি ধ্বংস হয়। সেদিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ ছালাত বিনষ্ট করাকেই বিগত উম্মতগুলির ধ্বংসের প্রধান কারণ হিসাবে উল্লেখ করে বলেন, فَخَلَفَ مِنْ بَعْدِهِمْ خَلْفٌ أَضَاعُوا الصَّلاَةَ وَاتَّبَعُوا الشَّهَوَاتِ فَسَوْفَ يَلْقَوْنَ غَيًّا- (ইবরাহীম ও ইসরাঈলের নেককার বংশধরগণের) পরে এল অপদার্থ উত্তরসূরীরা। তারা ছালাত বিনষ্ট করল ও কুপ্রবৃত্তির অনুসারী হ’ল। সুতরাং অচিরেই তারা ধ্বংসে (জাহান্নামের গর্তে) পতিত হবে’ (মারিয়াম ১৯/৫৯)।
এতে বুঝা যায় যে, ছালাত মানুষকে আখেরাতমুখী করে রাখে এবং ছালাতে অবহেলা করলে মানুষ পুরোপুরি দুনিয়ামুখী হয়ে পড়ে। তখন বস্ত্তপূজাই তার একমাত্র কাম্য হয়। যা তাকে অচিরেই মনুষ্যত্বের সর্বোচ্চ শিখর থেকে পশুত্বের সর্বনিম্ন স্তরে নামিয়ে দেয়। ফলে সে নিজে ধ্বংস হয় এবং অন্যকেও ধ্বংস করে। আর যদি সে ধর্মনেতা বা সমাজনেতা হয়, তাহ’লে হাদীছের ভাষায় فَضَلُّوْا وَأَضَلُّوْا ‘তারা নিজেরা পথভ্রষ্ট হয় এবং অন্যকে পথভ্রষ্ট করে’।[4] নেতাদের পথভ্রষ্টতায় যে সমাজ ধ্বংস হয়, সেদিকে ইঙ্গিত করেই আল্লাহ বলেন, وَإِذَا أَرَدْنَا أَنْ نُهْلِكَ قَرْيَةً أَمَرْنَا مُتْرَفِيهَا فَفَسَقُوا فِيهَا فَحَقَّ عَلَيْهَا الْقَوْلُ فَدَمَّرْنَاهَا تَدْمِيْرًا ‘যখন আমরা কোন জনপদকে ধ্বংস করতে চাই, তখন সেখানকার দুষ্টু নেতাদের নির্দেশ দেই। অতঃপর তারা সেখানে পাপাচার করে। ফলে তাদের উপর আমার আদেশ অবধারিত হয়ে যায়। অতঃপর আমরা উক্ত জনপদকে সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত করি’ (ইসরা ১৭/১৬)। এখানে ‘নির্দেশ দানের’ অর্থ অনুমতি দেওয়া এবং বাধা না দেওয়া। একই মর্মে অন্যত্র আল্লাহ বলেন, وَكَذَلِكَ جَعَلْنَا فِيْ كُلِّ قَرْيَةٍ أَكَابِرَ مُجْرِمِيْهَا لِيَمْكُرُوا فِيْهَا وَمَا يَمْكُرُوْنَ إِلاَّ بِأَنْفُسِهِمْ وَمَا يَشْعُرُوْنَ ‘এভাবে আমরা প্রত্যেক জনপদের শীর্ষ পাপীদের অনুমতি দেই, যাতে তারা সেখানে প্রতারণা করে। বস্ত্ততঃ তারা নিজেরা নিজেদেরকে প্রতারিত করে। কিন্তু তারা বুঝতে পারে না’ (আন‘আম ৬/১২৩)। নেতারা ও কর্মকর্তারা সাধারণতঃ অন্যদেরকে ছালাতে বিরত রাখে অথবা বাধা সৃষ্টি করে। এদের উদ্দেশ্যে আল্লাহ বলেন, وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنْ مَنَعَ مَسَاجِدَ اللهِ أَنْ يُذْكَرَ فِيْهَا اسْمُهُ وَسَعَى فِي خَرَابِهَا ‘তার চাইতে বড় যালেম আর কে আছে, যে আল্লাহর মসজিদসমূহে তাঁর নাম স্মরণ করা থেকে বাধা দেয় ও তা ধ্বংসের পাঁয়তারা চালায়? (বাক্বারাহ ২/১১৪)।
ছালাত হ’ল ইসলামের প্রধান খুঁটি। এই খুঁটি ভাঙতে পারলেই ইসলামকে ধ্বংস করা সহজ হয়। সেকারণ সেদিন যেমন আবু জাহল ও তার সাথীরা রাসূল (ছাঃ) ও মুসলমানদের ছালাত আদায়ে বাধা দিত, এ যুগের বস্ত্তবাদী আবু জাহলরাও তেমনি প্রকাশ্যে বা পরোক্ষে সর্বদা ছালাত আদায়ে বাধা দিয়ে থাকে। অথচ প্রকৃত ঈমানদারগণ সর্বদা যথাসময়ে ও আউয়াল ওয়াক্তে ছালাত আদায়ে সচেষ্ট থাকেন এবং এর মাধ্যমে তারা স্রেফ আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি কামনা করেন।
মুনাফিক ও অলস মুছল্লীরা তার বিপরীত করে। যেমন আল্লাহ বলেন, إِنَّ الْمُنَافِقِيْنَ يُخَادِعُوْنَ اللهَ وَهُوَ خَادِعُهُمْ وَإِذَا قَامُوْا إِلَى الصَّلاَةِ قَامُوْا كُسَالَى يُرَآؤُونَ النَّاسَ وَلاَ يَذْكُرُوْنَ اللهَ إِلاَّ قَلِيْلاً- ‘নিশ্চয় মুনাফিকরা আল্লাহকে ধোঁকা দেয়, আর তিনিও তাদের ধোঁকায় ফেলেন। যখন ওরা ছালাতে দাঁড়ায়, তখন অলসভাবে দাঁড়ায় লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে। আর তারা আল্লাহকে অল্পই স্মরণ করে’ (নিসা ৪/১৪২)। ইমাম সুয়ূতী বলেন, মুনাফিকদের ধোঁকা হ’ল লোক দেখানো ছালাত আদায় করা। এভাবে তারা যেন আল্লাহকে ধোঁকা দেয় যে, তারা ছালাত আদায় করে থাকে। অথচ আল্লাহ তাদের অন্তরের খবর রাখেন। আর আল্লাহ তাদের ধোঁকায় ফেলেন অর্থ ওদের লোক দেখানো ছালাত জানা সত্ত্বেও তিনি তাদের দুনিয়াতে জান-মালের নিরাপত্তা দান করেন। অথচ আখেরাতে তাদের জন্য জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে স্থান নির্ধারণ করেন (নিসা ৪/১৪৫)।
ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, যদি এখানে فى صلاتهم (ছালাতের মধ্যে) হ’ত, তাহ’লে মুমিনদের বিষয়ে হ’ত। আত্বা ইবনু দীনার বলেন, ‘আল্লাহর জন্য সকল প্রশংসা যে, তিনি এখানে عَنْ صَلاَتِهِمْ سَاهُوْنَ বলেছেন, فى صلوتهم বলেননি’ (কুরতুবী, ইবনু কাছীর)। কেননা তাহ’লে কোন মুসলমানই বাদ যেত না। এমনকি রাসূল (ছাঃ)-এরও ছালাতের মধ্যে অনেকবার ভুল হয়েছে। যার জন্য হাদীছে ‘সহো সিজদা’র বিধান রাখা হয়েছে। কেননা عَنْ صَلاَتِهِمْ অর্থ ‘ছালাত থেকে উদাসীন’। আর فِىْ صَلاَتِهِمْ অর্থ ‘ছালাতের মধ্যে ভুলকারী’। যেটা স্বাভাবিক।
ইবনু কাছীর বলেন, عَنْ صَلَوتِهِمْ سَاهُوْنَ ‘তারা তাদের ছালাত থেকে উদাসীন’ অর্থ হ’ল, তারা নিয়মিতভাবে বা অধিকাংশ সময়ে আউয়াল ওয়াক্তের বদলে আখেরী ওয়াক্তে ছালাত আদায় করে (ইবনু কাছীর)।[5] তারা ছালাতের আরকান ও শর্তাবলী সঠিকভাবে আদায় করে না বা ছালাতের মধ্যে একাগ্রতা এবং ক্বিরাআত ও দো‘আ-দরূদের অর্থ ও মর্ম বুঝা হ’তে উদাসীন থাকে। যদি কারু মধ্যে উক্ত দোষগুলির সবটা পূর্ণভাবে থাকে, তাহ’লে তার ‘কর্মগত মুনাফেকী’ (كَمُلَ لَهُ النِّفَاقُ الْعَمَلِيُّ) পূর্ণতা পাবে (ইবনু কাছীর)। যেমন বুখারী ও মুসলিম বর্ণিত হাদীছে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেন, تِلْكَ صَلاَةُ الْمُنَافِقِ يَجْلِسُ يَرْقُبُ الشَّمْسَ حَتَّى إِذَا كَانَتْ بَيْنَ قَرْنَىِ الشَّيْطَانِ قَامَ فَنَقَرَهَا أَرْبَعًا لاَ يَذْكُرُ اللهَ فِيْهَا إِلاَّ قَلِيْلاً– ‘এটা মুনাফিকের ছালাত, যে বসে সূর্য ডোবার অপেক্ষা করে। তারপর যখন সূর্য শয়তানের দুই শিংয়ের মাঝখানে আসে, (অর্থাৎ ডোবার উপক্রম হয়), তখন দাঁড়িয়ে চারটি ঠোকর মারে (অর্থাৎ আছরের চার রাক‘আত ছালাত দ্রুত পড়ে নেয়)। সেখানে সে আল্লাহকে অতি অল্পই স্মরণ করে’।[6] বস্ত্ততঃ আখেরাতে অবিশ্বাসীদের বাহ্যিক নিদর্শনের মধ্যে এটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন।
(৬) اَلَّذِيْنَ هُمْ يُرَآؤُوْنَ ‘যারা লোক দেখানোর জন্য তা করে’।
رَاءَاهُ مُرَاءَاةً وَ رِيَاءً ‘আসলের বিপরীত দেখানো’। সেখান থেকে يُرَآؤُوْنَ ‘তারা লোকদের দেখায়’। অর্থাৎ তারা ছালাত আদায় করে মানুষকে খুশী করার উদ্দেশ্যে, আল্লাহকে খুশী করার উদ্দেশ্যে নয়। সালামাহ বিন কুহায়েল (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, مَنْ سَمَّعَ سَمَّعَ اللهُ بِهِ وَمَنْ رَاءَى رَاءَى اللهُ بِهِ ‘যে ব্যক্তি লোককে শুনানোর জন্য কাজ করে, আল্লাহ তাকে দিয়েই তা শুনিয়ে দেন। আর যে ব্যক্তি লোক দেখানোর জন্য কাজ করে, আল্লাহ তার মাধ্যমে তা দেখিয়ে দেন’।[7] অর্থাৎ আল্লাহ তাকে লজ্জিত করেন এবং স্পষ্ট করে দেন যে সে আদৌ মোখলেছ নয়। বস্ত্ততঃ পূর্ণ আল্লাহভীতি এবং খুশূ-খুযূ ও একাগ্রতা ব্যতীত ছালাত কবুল হয় না। রাসূলূল্লাহ (ছাঃ) বলেন, أَنْ تَعْبُدَ اللهَ كَأَنَّكَ تَرَاهُ ، فَإِنْ لَمْ تَكُنْ تَرَاهُ فَإِنَّهُ يَرَاكَ ‘তুমি এমনভাবে আল্লাহর ইবাদত কর, যেন তুমি তাঁকে দেখছ। আর তা না পারলে এমন বিশ্বাস নিয়ে ইবাদত কর যে, তিনি তোমাকে দেখছেন’।[8] পক্ষান্তরে রিয়াকে হাদীছে ‘গোপন শিরক’ (الشرك الخفى) এবং ‘ছোট শিরক’ (الشرك الأصغر) বলা হয়েছে।[9] অতএব এই শিরক থাকলে কেবল ছালাত নয়, কোন নেক আমলই আল্লাহর নিকটে কবুল হবে না। আল্লাহ বলেন, فَمَنْ كَانَ يَرْجُوْ لِقَاءَ رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلاً صَالِحاً وَلاَ يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَداً- ‘অতএব তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি তার প্রভুর দীদার কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম করে এবং তার প্রভুর ইবাদতে কাউকে শরীক না করে’ (কাহফ ১৮/১১০)। এখানে ইবাদতে শিরক বলতে রিয়া বা গোপন শিরক বুঝানো হয়েছে, যা যেকোন কবীরা গোনাহের চাইতে বড়। খালেছ অন্তরে তওবা করা ব্যতীত যা মাফ হয় না। অতএব ধ্বংস ঐ সব মুছল্লীর জন্য যারা লোক দেখানো ছালাত আদায় করে। শুধু ছালাত নয়, যেকোন সৎকর্ম যদি তা লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে বা লোকদের শুনানোর উদ্দেশ্যে হয়, তবে তা আল্লাহর নিকটে কবুল হবে না।
আলোচ্য আয়াতে ইচ্ছাকৃতভাবে লোক দেখানোর বিষয়ে বলা হয়েছে। কিন্তু এমন কিছু বিষয় রয়েছে, যাতে লোক দেখানোর ইচ্ছা থাকেনা। অথচ লোকে দেখলে বা প্রশংসা করলে মন খুশী হয়- এটি প্রকৃতিগত বিষয়, যা রিয়া ও সুম‘আর মধ্যে পড়বে না। যেমন আবু যার গিফারী (রাঃ) বলেন, একদিন রাসূল (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হ’ল, أَرَأَيْتَ الرَّجُلَ يَعْمَلُ الْعَمَلَ مِنَ الْخَيْرِ وَيَحْمَدُهُ النَّاسُ عَلَيْهِ ‘ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে আপনার রায় কি, যে ব্যক্তি কোন নেক আমল করে, আর লোকেরা তার প্রশংসা করে বা সেজন্য তারা তাকে ভালবাসে’? জবাবে রাসূল (ছাঃ) বললেন, تِلْكَ عَاجِلُ بُشْرَى الْمُؤْمِنِ ‘এটি হ’ল মুমিনের নগদ সুসংবাদ’ (আখেরাতের সুসংবাদ আল্লাহর নিকট পাওনা রইল)।[10]
(৭) وَيَمْنَعُوْنَ الْمَاعُوْنَ ‘এবং নিত্য ব্যবহার্য বস্ত্ত দানে বিরত থাকে’।
ক্ষতিগ্রস্ত মুছল্লীর তৃতীয় প্রধান বৈশিষ্ট্য হ’ল এই যে, সে হবে অত্যন্ত নীচু স্বভাবের। সে এত কৃপণ ও নীচুমনা হবে যে, তার প্রতিবেশীকে নিত্যব্যবহার্য হাড়ি-পাতিল, দা-কোদাল, তৈল-লবণ, পানি বা আগুন পর্যন্ত দিতে চায় না। অনেকে বলেছেন مَاعُون অর্থ যাকাত। সেটাও কমের মধ্যে। কেননা তা হ’ল সঞ্চিত ধনের ৪০ ভাগের একভাগ। সে এটাও দিতে লোককে নিষেধ করে। অর্থাৎ মুনাফিক ব্যক্তি আল্লাহর ইবাদত করে লোক দেখানো। মানুষের সাথে আচরণও করে লোক দেখানো। উভয় ক্ষেত্রেই সে ব্যর্থ।
কুত্বরুব (قطرب) বলেন, أصل الماعون من القلة، والمعن: الشيئ القليل মাঊন-এর আসল অর্থ ‘কম’। المعن অর্থ কম বস্ত্ত। আরবরা বলে থাকে مَالُهُ سَعْنةٌ وَلاَ مَعْنةٌ ‘তার মাল অনেক বেশী, কম নয়’। সেখান থেকে আল্লাহ যাকাত, ছাদাক্বা বা অনুরূপ ছোট-খাট সকল নেকীর বস্ত্তকে ‘মা‘ঊন’ বলে অভিহিত করেছেন। কেননা তা বেশীর তুলনায় অনেক কম (কুরতুবী)। অথচ গাফেল মুছল্লীরা এইসব ছোট-খাট নেকীর কাজও করেনা। বরং পরিবার ও প্রতিবেশীকে তা করতে বাধা দেয়। অথচ আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, كُلُّ مَعْرُوْفٍ صَدَقَةٌ ‘প্রত্যেক সৎকর্মই ছাদাক্বা’[11]চাই তা ছোট হৌক বা বড় হৌক।
আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, হে মুসলিম রমণীগণ! তোমাদের মধ্যে কোন প্রতিবেশিনী যেন আপন প্রতিবেশিনীকে বকরীর ক্ষুরের মাঝের গোশত দান করাকেও তুচ্ছ জ্ঞান না করে (অর্থাৎ যত তুচ্ছ হৌক যেন দান করে)।[12] আলী ইবনু হাতেম (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) বলেন, فَلْيَتَّقِيَنَّ أَحَدُكُمُ النَّارَ وَلَوْ بِشِقِّ تَمْرَةٍ، فَإِنْ لَمْ يَجِدْ فَبِكَلِمَةٍ طَيِّبَةٍ ‘তোমরা জাহান্নাম থেকে বাঁচো একটি খেজুরের টুকরা দিয়ে হ’লেও। যদি তা না পাও, তাহ’লে সুন্দর কথা দিয়ে’।[13] রাসূল (ছাঃ) আয়েশা (রাঃ)-এর বোন আসমা (রাঃ)-কে বলেন, আল্লাহর পথে খরচ কর। গণনা করো না। তাহ’লে আল্লাহ তোমার উপর গণনা করবেন’ (অর্থাৎ রহমতে হিসাব করবেন)।[14] তিনি বলেন, ছাদাক্বা পাপকে নিভিয়ে দেয়, যেমন পানি আগুনকে নিভিয়ে দেয়।[15] আল্লাহ বলেন, ‘হে আদম সন্তান! আল্লাহর পথে খরচ কর। আমি তোমার উপর খরচ করব (অর্থাৎ অনুগ্রহ করব)।[16]
উল্লেখ্য যে, ‘নিত্য ব্যবহার্য বস্ত্ত দানে বিরত থাকা’-র বিষয়টি দু’ধরনের। এক প্রকার, যাতে মানুষ গোনাহগার হয়। অন্য প্রকার, যাতে গোনাহগার হয় না। কিন্তু নেকী থেকে বঞ্চিত হয়। যেমন তৃষ্ণার্ত ব্যক্তি পানি চাইল। যা না পেলে সে মারা যাবে। যদি তাকে না দেওয়া হয় এবং সে মারা যায়, তাহ’লে অনেক বিদ্বানের মতে ঐ ব্যক্তি খুনের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হবে এবং ‘দিয়াত’ (রক্তমূল্য) পাওয়ার হকদার হবে। অন্য ব্যক্তি সাধারণভাবে কোন বস্ত্ত চাইল। কিন্তু দিল না। তাতে গোনাহগার না হ’লেও সে নেকী থেকে বঞ্চিত হবে। একইভাবে মরণোন্মুখ বা এক্সিডেন্টের কোন রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া ও তাকে চিকিৎসা সেবা দেওয়া অত্যন্ত নেকীর কাজ। গাফলতি করলে দায়ী হ’তে হবে।
ছালাত সম্পর্কে উদাসীন মুছল্লীদের তিনটি প্রধান দোষের কথা আলোচ্য আয়াতসমূহে বর্ণিত হয়েছে। যথা : ছালাতে অবহেলা, লোক দেখানো ছালাত ও কৃপণতা। এ তিনটি বিষয় মুনাফিকদের আলামত হিসাবে অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে এভাবে, وَإِذَا قَامُوْا إِلَى الصَّلاةِ قَامُوْا كُسَالَى يُرَآءُوْنَ النَّاسَ وَلاَ يَذْكُرُوْنَ اللهَ إِلاَّ قَلِيْلاً- ‘যখন তারা ছালাতে দাঁড়ায় তখন অলসভাবে দাঁড়ায়, তারা লোকদেরকে দেখায় এবং তারা আল্লাহকে অল্পই স্মরণ করে’ (নিসা ৪/১৪২)। وَلاَ يُنْفِقُوْنَ إِلاَّ وَهُمْ كَارِهُوْنَ ‘এবং তারা ব্যয় করে অনিচ্ছুকভাবে’ (তওবা ৯/৫৪)।
অতএব মানুষের ভেবে দেখা উচিৎ, তার মধ্যে উপরোক্ত দোষগুলি আছে কি-না। যদি থাকে, তবে তওবা করে ফিরে আসবে। আর যদি তওবা না করে, তাহ’লে তার জন্য দুর্ভোগ ও ধ্বংসের দুঃসংবাদ রইল। কেননা إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللهُ مِنَ الْمُتَّقِيْنَ আল্লাহ মুত্তাক্বীদের আমলই মাত্র কবুল করে থাকেন’ (মায়েদাহ ৫/২৭)।
৪ হ’তে ৭ আয়াত পর্যন্ত মুনাফিকদের মন্দ স্বভাব বর্ণিত হয়েছে। অথচ মক্কায় যারা ইসলাম কবুল করেছিলেন, তাদের মধ্যে যতদূর জানা যায় কেউ মুনাফিক ছিলেন না। সেকারণ ইবনু আববাস (রাঃ)-এর একটি মতে এবং ক্বাতাদাহর মতে এ চারটি আয়াত মদীনায় অবতীর্ণ। তবে অন্যেরা মাক্কী বলেন সম্ভবতঃ একারণে যে, এর মাধ্যমে ভবিষ্যৎ মুসলমানদের জন্য আগাম সতর্কবাণী করা হয়েছে।
সারকথা :
পরকালীন জওয়াবদিহিতায় অবিশ্বাস কিংবা দুর্বল বিশ্বাস মানুষকে বড়-ছোট নানা ধরনের অন্যায় কাজে প্ররোচিত করে। প্রকৃত মুমিনকে এই দুর্বলতা থেকে অবশ্যই ফিরে আসতে হবে এবং আল্লাহ ও পরকালে দৃঢ় বিশ্বাসী হ’তে হবে।
[3]. কুরতুবী হা/৬৪৮৩; বাযযার, ত্বাবারী, বায়হাক্বী। তবে বায়হাক্বী সা‘দ থেকে ‘মওকূফ’ সূত্রে বর্ণনা করার পর সেটাকেই ‘সঠিক’ বলেছেন (২/২১৪-১৫)। হায়ছামী একে ‘হাসান’ বলেছেন (১/৩২৫)। টীকাকার বলেন, মওকূফ ছহীহ وهو الراجح ‘এবং এটাই অগ্রাধিকারযোগ্য’। মরফূ বর্ণনা সঠিক নয়।
[5]. যেমন স্রেফ মাযহাবের দোহাই দিয়ে বা রেওয়াজের দোহাই দিয়ে এদেশের বিরাট সংখ্যক মুসলমান ফজর, যোহর ও আছরের ছালাত অনেক দেরীতে পড়েন, অন্যদিকে এশার ছালাত আগে-ভাগে পড়েন, যা ছহীহ হাদীছ সমূহের ঘোর বিরোধী এবং যা স্রেফ অলসতা ও ছালাত থেকে উদাসীনতা বৈ কিছুই নয়।
[12]. বুখারী হা/২৫৬৬, মুসলিম হা/১০৩০, মিশকাত হা/১৮৯২ ‘যাকাত’ অধ্যায়-৬, ‘দানের মাহাত্ম্য’ অনুচ্ছেদ-৬।