নও মুসলিম

গুয়ান্তানামো বন্দীশালার কারারক্ষী টেরি হোল্ডব্রুকের ইসলাম গ্রহণ

২০০৩ সালের ক্থা, ১৯ বছরের উচ্ছৃঙ্খল এক ডিজুস যুবক। মদ, যৌনতা আর রক-এন্ড-রোল মিউজিকে ডুবে থাকা অন্ধকার জীবন। হাতে ট্যাটু আঁকা, “উন্মত্ত হয়ে যাও”। “ঈশ্বর বলে ওসব কিছু নেই, দুনিয়ার জীবনই সব”, ভাবতেন টেরি হোল্ডব্রুক।

এমন গা-ভাসানো আর ভোগে-মত্ত জীবনে ডুবে থাকা টেরির মত তরুণেরা পশ্চিমা সমাজে মোটেও দুষ্প্রাপ্য নয়। পারিবারিক বাঁধা-বন্ধনহীন, বন্ধু-আড্ডা-গানে বুঁদ হয়ে থাকা বস্তুবাদী সমাজে এমন যুবক রাস্তার অলিতে গলিতে মেলে। বন্ধু-আড্ডা-গানে হারিয়ে যাওয়া মানুষরা দায়িত্বশীল হতে শেখে না, টেরির বয়স যখন সাত, টেরির বাবা-মা তাকে ছুঁড়ে ফেলে যে-যার-মত পথ বেছে নিয়েছিল। টেরি বড় হলেন দাদার কাছে, দাদাও নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন করতেন না, শেষকালে অবশ্য বদলে গিয়েছিলেন।

টেরি পরিণত বয়সে পৌঁছলেন, ভাবলেন কিছু তো একটা করা দরকার। ৯/১১ এর কিছু পরের ঘটনা, ক্ষ্যাপাটে টেরি মিলিটারিতে গিয়ে বললেন, বেতন দিলেই তিনি মানুষ হত্যা করতে রাজি আছেন। আমেরিকায় তখন নতুন রিক্রুট করা হয়েছে অনেক সৈন্যকে, টেরি চাকরি পেলেন। বিশেষ বোনাস সুবিধা দেখে “মিলিটারি পুলিশ” এর চাকরিটি গ্রহণ করলেন।

ইসলাম নিয়ে তখন টেরির কোন ধারণাই ছিল না। ইসলাম সম্পর্কে তার সকল জ্ঞান ৯/১১ এ সীমাবদ্ধ। তাকে বারবার ৯/১১ এর ভিডিও দেখানো হত, বলা হত, “গুয়ানতানামো বে’তে যারা আছে, তারা এসব করেছে, তারা মানুষ নয়। তারা সামনে পেলেই তোমাকে খেয়ে ফেলবে। এদের সাথে কথা বলবে না, মেলামেশা করবে না”। টেরির দায়িত্ব পড়ল গুয়ানতানামোর কারারক্ষী হিসেবে, কারাগারে গার্ড দিতে গিয়ে এক “জঙ্গি”কে আবিষ্কার করলেন, তার বয়স ১২! টেরি বুঝে উঠতে পারলেন, যে ছেলে এখনো সাগর দেখে নি, যে ছেলে এখন দুনিয়া কীভাবে চলে তা জানে নি, সে “ওয়ার অন টেরর” এর কি বুঝে!

১২ বছর বয়স্ক “হাই সিকিউরিটি থ্রেট” জঙ্গি ছাড়া টেরি আরো দেখলেন কিছু সাধারণ মুসলিমদের, যাদেরকে বিভিন্ন দেশ থেকে ধরে আনা হয়েছে। তাদের কেউ ট্যাক্সি ড্রাইভার, ডাক্তার, প্রফেসর, সত্তরোর্ধ বৃদ্ধ। টেরির দায়িত্ব ছিল কারাবন্দীদের কে ইন্টারোগেশন সেলে নিয়ে যাওয়া এবং সেখান থেকে নিয়ে আসা। গুয়ানতানামো বে’র কারাগারে নিষ্ঠুর আর অমানুষিক নির্যাতনের সাক্ষী তিনি। তিনি বলেন, “বন্দীকে শিকলে বেঁধে তাদের উপর হিংস্র কুকুর লেলিয়ে দেওয়া হত, কুকুরগুলো তাদের মুখের ঠিক সামনে ঘেউ ঘেউ করত এবং কখনো কামড়ে দিত”।

তিনি সেখানকার অমানুষিক অত্যাচারের বিবরণ দেন, “প্রচণ্ড চাপের মুখে রাখা হত কারাবন্দীদের, তাদের লোহার খাঁচায়, প্রচণ্ড ঠাণ্ডার মাঝে ফেলে রাখা হত দিনের পর দিন”। এমন কারাবন্দীও আছে গুয়ানতানামো বে’তে, যাদের রুমের লাইট গত ৬/৭ বছর ধরে বন্ধ করা হয় নি, ক্ষণিকের জন্য তারা অন্ধকারে শান্তিতে ঘুমুতে পারেন নি। উপরন্তু, টর্চারের সময় তাদের মুখের সামনে ৪০ ডিগ্রী তাপমাত্রার আলো জ্বালিয়ে রাখা হত, কানের কাছে গান বাজানো হত ঘন্টার পর ঘন্টা। অথচ তাদের কারোরই অপরাধ প্রমাণিত নয়, কেবল মুসলিম বলে সন্দেহভাজন হিসেবে ধরে আনা হয়েছে।

বন্দীদেরকে যৌননির্যাতন করা হত মহিলা সৈন্যদের দ্বারা নিকৃষ্টতম উপায়ে। তারা জানতো, মুসলিমরা নামাযের আগে পাক-পবিত্র হয়ে নামায আদায় করে। টেরি আবদুল হাদী নামের সিরিয়ার এক কমবয়সী ছেলের কথা বলেন, জিজ্ঞাসাবাদ ও নির্যাতনের পর এক মহিলা সৈন্যকে দিয়ে তাকে sexually harras করে এবং তার মুখে ঋতুকালীন নাপাক রক্ত মাখিয়ে তাকে সেলে পাঠিয়ে দেয়। চারদিন তাকে গোসলের জন্য পানি দেওয়া হয় নি, যেন সে নামায আদায় করতে না পারে।

টেরি বলেন, গুয়ানতানামো বে’তে বন্দীদের নির্যাতন করা হত কোন কারণ ছাড়াই। কথা নেই, বার্তা নেই, চার-পাঁচ জন এসে কোন বন্দীকে ধরে বেধড়ক পেটাতে শুরু করত, কখনও দরজার মধ্যে হাত-পা চাপা দিত। তারা বন্দীদের মাথা ধরে কমোডে চুবিয়ে দিয়ে ফ্লাশ করে দিত। কখনও তার মরিচের গুঁড়া স্প্রে করে দিত বন্দীদের মুখে। গুয়ানাতানামোর iguanas এবং ধেঁড়ে ইদুঁরগুলো বেশি অধিকার আর নিরাপত্তা ভোগ করত মুসলিম বন্দীদের থেকে। এসব প্রাণীকে ছুঁলে বা ক্ষতি করলে ছিল হাজার ডলার জরিমানা, অথ্চ মুসলিম বন্দীদের যা খুশি করা যেত। মুসলমান বলে কথা! তাদের পশু অধিকারও থাকতে নেই!

কাফের হলেও নীতিহীন ছিলেন না টেরি। তিনি কারাবন্দীদের সাথে ফাঁকে ফাঁকে কথা বলতে চেষ্টা করলেন। তার সহকর্মীরা বিষয়টি পছন্দ করত না, তারা তাকে নিয়ে বিরক্ত হয়ে বলত, “আমরা আজকেই তোমার মাথা থেকে তালিবানদের ভূত তাড়াবো”, তবু টেরি হাল ছাড়লেন না । অবাক হয়ে দেখলেন এই মুসলিমগুলোর উপর শত অত্যাচার আর নির্যাতন সত্ত্বেও তাদের মাঝে কি যেন একটা প্রশান্তি আর সন্তুষ্টি আছে। বন্দী হয়েও তারা যেন মুক্ত, আর কারারক্ষী হয়েও টেরি যেন বন্দী, সবসময় বস এর অর্ডার মানতে গিয়ে তার নিজেকে মনে হত দাস। তার যেন থেকেও নেই, আর বন্দীদের কিছু নেই তবু তাদের মুখে হাসি। নাইট শিফটের সময়ে তিনি বন্দীদের সাথে খোলাখুলিভাবে সবকিছু নিয়ে আলোচনা করতে শুরু করলেন, ধর্ম, রাজনীতি, ইতিহাস, কালচার, নৈতিকতা সবকিছু। কারাবন্দীদের ইসলাম চর্চায় তিনি মুগ্ধ হলেন।

তিনি ইসলামের মধ্যে তা আবিষ্কার করলেন যার সন্ধান তিনি এতদিন করে আসছিলেন, শৃঙ্খলা এবং নিয়মতান্ত্রিকতা, যা একজন মানুষের হৃদয়কে তুষ্ট করতে পারে। অবাধ স্বাধীনতা কেবল মানুষের আকাঙ্গ্খাকে অনিয়ন্ত্রিত করে তোলে, কখনই তা হৃদয়কে শান্ত করতে পারে না। তিনি আল্লাহর দাসত্বের মাঝে শান্তি পেতে শুরু করলেন।

আহমেদ এরাচিদি নামের এক মরোক্কানের সাথে টেরির পরিচয় হল কারাগারে। আহমেদ প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর গুয়ানাতানামোয় বন্দী ছিলেন, আল-ক্বায়েদার ট্রেনিং ক্যাম্পে যোগ দেওয়ার অভিযোগে তাকে আটকে রাখা হয়। আহমেদ তার কুরআনের কপিটি টেরিকে পড়তে দিলেন। টেরি কুরআন পড়তে শুরু করলেন, এবং এর মাঝে তিনি যুক্তিবোধের ছোঁয়া পেতে থাকলেন। খ্রিষ্টধর্ম, ইহুদীধর্ম কোন কিছুই তাকে স্পর্শ করে নি, কিন্তু তিনি ইসলামের প্রেমে পড়ে গেলেন। তার ভাষায়, “আমি যতই ইসলামকে জানতে লাগলাম, ইসলাম যেন ততই আমার কাছে আসতে লাগল”।

টেরির অন্য সহকর্মীরা যেখানে পর্নোগ্রাফি, নেশা আর খেলাধূলায় মত্ত, টেরি ইসলাম নিয়ে পড়াশোনায় সময় ব্যয় করতে লাগলেন। আজকের গতানুগতিক মুসলিমদের যেখানে বছরে এক ঘন্টাও ইসলাম নিয়ে পড়াশোনার সময় হয় না, সেখানে টেরি প্রতিদিন ইসলামকে জানতে ও বুঝতে ব্যয় করতে থাকেন। একটা সময় তিনি সিদ্ধান নিলেন, হ্যাঁ, তিনি ইসলাম গ্রহণ করবেন।

এক কারাবন্দীদের কাছে গিয়ে জানালেন এ কথা। সে বলল, “তুমি ভালো করে ভেবে দেখেছ তো? ইসলাম কোন হাসিঠাট্টার বিষয় নয়, এটা সিরিয়াস ব্যাপার, এটা জীবন বদলে একটা ঘটনা হবে তোমার জন্য। তোমাকে মদ খাওয়া ছাড়তে হবে, শরীরে ট্যাটুবাজি বন্ধ করতে হবে, নোংরা কাজকর্ম ছেড়ে দিতে হবে। তোমার চাকরি হারা হবার সম্ভাবনা আছে, তোমার পরিবার তোমাকে ত্যাগ করতে হতে পারে, পারবে?”

টেরি ভেবে দেখলেন, হ্যাঁ তিনি পারবেন, ইসলামের আলো যার মধ্যে প্রবেশ করেছে, সে কেনই বা পারবে না দুনিয়ার চাকচিক্য ছেড়ে আল্লাহর দিকে ফিরতে? অবশেষে ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে টেরি কারাবন্দীদের মাঝে আরবীতে ঘোষণা দিলেন, আল্লাহ ছাড়া আর কোন মা’বূদ নেই, এবং মুহাম্মাদ হচ্চেন আল্লাহর রাসূল। সকলের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল! ইসলাম কত আশ্চর্যজনক ভাবে মানুষকে বদলে দিতে পারে! আল্লাহ কুরআনে বলেন,

“পূর্ব ও পশ্চিমের মালিক আল্লাহ্‌, তিনি যাকে ইচ্ছা করেন তাকে সহজ-সঠিক পথের দিকে পরিচালিত করেন।” (সূরা বাক্বারাঃ১৪২)

টেরি মদপান ছেড়ে দিলেন, গান-বাজনাও ছেড়ে দিলেন। ভেবে দেখুন, অমুসলিম হয়ে জন্ম নেওয়া এক যুবক কত সহজেই আল্লাহর জন্য প্রিয় কিছু ছাড়তে পারছেন, অথচ মুসলিম হয়ে জন্ম নিয়ে আমরা আজকে আল্লাহর দ্বীনের থোড়াই কেয়ার করছি। টেরির ইসলাম গ্রহণের কথা তার সহকর্মীরা জানলে সমস্যা হতে পারে বিধায় তাকে লুকিয়ে নামায পড়তে হত, ঘনঘন তাকে বাথরুমে যেতে হত। অথচ আমাদের নামকা ওয়াস্তে মুসলিমদের জুম্মার সালাহ পড়তেই কত না আলসেমি, কোন ভয় নেই, ঝুঁকি নেই, তবুও!

২০০৪ সালে টেরিকে তার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় “general personality disorder” এর অজুহাতে। গুয়ানতানামো বে’তে যতদিন ছিলেন, তার ইসলাম চর্চা ভালোই চলছিল, কিন্তু সেখান থেকে চলে আসার পর আবার এলোমেলো হয়ে গেল। কিছুকালের জন্য তিনি জাহেলিয়াতের মাঝে সুখ খোঁজার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন। আবার ইসলামে ফিরে আসলেন টেরি। টেরি পেছনে ফিরে দেখেন, কেবল ইসলামের মাঝেই তিনি স্বস্তি খুঁজে পেয়েছেন, অন্য কিছুই তাকে খুশি করতে পারে নি।

টেরি হোল্ডব্রুক গুয়ানতানামোর সেই অল্প কিছু কারারক্ষীদের একজন যারা কিনা আমেরিকার শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার মিথ্যা আশ্বাসকে তুলে ধরছেন সবার সামনে। তিনি বলেছেন, আমেরিকানদের লজ্জা পাওয়া উচিত এই জঘন্য কারাগারের মালিক হওয়ার জন্য। তিনি বর্তমানে তাই কাজ করে যাচ্ছেন “মুসলিম লিগ্যাল ফান্ড অফ আমেরিকা”র সাথে। যেসকল আমেরিকান নাগরিক অন্যায়ভাবে তথাকথির সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে বন্দী হয়ে আছেন তাগুতের কারাগারে, তাদের মুক্তির জন্য তারা ফান্ড তুলছেন এবং আইনগত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

টেরির হোল্ডব্রুক এখন আর টেরি হোল্ডব্রুক নন, তিনি এখন মুসতাফা আবদুল্লাহ। মুসতাফা আবদুল্লাহ হয়ে থাকুক জাহেল মুসলিমদের জন্য একজন চোখে-আঙ্গুল-দেখানো উদাহারণ, আল্লাহ তাকে কবুল করে নিন।

– জিম তানভির

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

Back to top button