অন্তরের আমল – ১
অন্তরের আমলঃ
অন্তরের আমল বলতে উদ্দেশ্য এমন সব বিষয় যার উৎপত্তি শুধু অন্তরেই হয় এবং অন্তরের সাথেই তা ওতোপ্রতোভাবে জড়িত থাকে। তম্মধ্যে সবচেয়ে বড় আমল হচ্ছে আল্লাহর প্রতি ঈমান,যার উৎপত্তি অন্তরেই হয়ে থাকে। অন্তরের আরো আমল হচ্ছে, মান্য ও স্বীকৃতির মাধ্যমে সত্যায়ন করা। এ ছাড়া পালনকর্তা সম্পর্কে বান্দার অন্তরে যা স্থান লাভ করে যেমনঃ ঈমান, ভালবাসা, ভয়-ভীতি, আশা-আকাঙ্খা, তাওবা, ভরসা, ধৈর্য্য, দৃঢ়তা, বিনয় ইত্যাদি।
আল্লাহ্ তা’আলা অন্তর সৃষ্টি করে তাকে বাদশা বানিয়েছেন এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে করেছেন তার সৈনিক। বাদশা সৎ হলে সৈনিকরাও সৎ হবে। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, وإنَّ فِيْ الْجَسَدِ مُضْغَةٌ إذَا صَلُحَتْ صَلُحَ الْجَسَدُ كُلُّهُ، و إذَا فَسَدَتْ فَسَدَ الْجَسَدُ كُلُّهُ: ألاَ وَ هِيَ الْقَلْبُ “ নিশ্চয় মানুষের শরীরে একটি মাংসপিন্ড রয়েছে, উহা সংশোধন হলে সমস্ত শরীর সংশোধন হবে, উহা বিনষ্ট হলে সারা শরীর বিনষ্ট হবে। আর উহা হলো কলব বা অন্তকরণ।” (বুখারী ও মুসলিম) অন্তরই হচ্ছে ঈমান ও তাক্বওয়া অথবা কুফরী, মুনাফেকী ও শির্কের স্থান। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, التَّقْوَى هَاهُنَا وَيُشِيرُ إِلَى صَدْرِهِ ثَلَاثَ مَرَّاتٍ “তাক্বওয়ার স্থান এখানে, একথা বলে তিনি নিজ সিনার দিকে তিনবার ইঙ্গিত করলেন।” (মুসলিম)
ঈমানঃ
বিশ্বাস, কথা ও কাজের নাম ঈমান। অন্তরের বিশ্বাস, মুখে উচ্চারণ এবং অন্তর ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আমলের মাধ্যমে ঈমান পূর্ণতা লাভ করবে। অন্তর বিশ্বাস করবে ও সত্যায়ন করবে, ফলে মুখ তার সাক্ষ্য দিবে। অতঃপর অন্তরের মধ্যে আমল শুরু হবে- ভালবাসা, ভয়-ভীতি ও আশা-আকাঙ্খা অন্তরে স্থান লাভ করবে। এরপর অন্তরের এই আমল প্রকাশ করার জন্য যিকির, কুরআন পাঠ প্রভৃতির মাধ্যমে মুখ নড়ে উঠবে। আর রুকূ’-সিজদা ও আল্লাহর নৈকট্যদানকারী নেক কর্মের মাধ্যমে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে আন্দোলন তৈরী হবে। বস্তুতঃ শরীর হচ্ছে অন্তরের অনুসরণকারী। অতএব অন্তরে কোন জিনিস স্থীরতা লাভ করলেই, যে কোনভাবে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা তার প্রকাশ ঘটবেই।
-
আন্তরের আমলের বিপরীত আমল কি?
অন্তরের প্রতিটি নেক আমলের বিপরীতে অন্তরের রোগও রয়েছে। যেমন একনিষ্ঠতার বিপরীত হচ্ছে রিয়া, দৃঢ়-বিশ্বাসের বিপরীত হচ্ছে সন্দেহ, ভালবাসার বিপরীত হচ্ছে ঘৃণা.. ইত্যাদি। আমরা যদি অন্তরকে সংশোধন করতে উদাসীন থাকি, তবে অন্তরের মধ্যে পাপরাশি পঞ্জিভূত হয়ে তাকে ধ্বংস করে দিবে। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, “বান্দা যখন একটি পাপকর্ম করে, তখন অন্তরে একটি কাল দাগ পড়ে যায়। সে যদি ফিরে আসে, তাওবা করে এবং ক্ষমা প্রার্থনা করে তখন তা পরিস্কার উজ্জল হয়ে যায়। কিন্তু তাওবা না করে পূনরায় যদি পাপকর্মে লিপ্ত হয় দাগটিও বৃদ্ধি পায়, এভাবে যতবার পাপে লিপ্ত হবে দাগও বৃদ্ধি পেতে থাকবে। এভাবে অন্তর কাল দাগে প্রভাবিত হয়ে সেখানে মরিচা পড়ে যায়। এই মরিচার কথাই আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করেছেন। كَلَّا بَلْ رَانَ عَلَى قُلُوبِهِمْ مَا كَانُوا يَكْسِبُونَ “কখনো নয়, তাদের কর্মের কারণে তাদের অন্তরে (পাপের) মরিচা পড়ে গেছে।” (সূরা মুতাফ্ফিফীনঃ ১৪) (তিরমিযী) রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেন, “চাটাইয়ের কাঠিগুলো যেমন একটি একটি করে সাজানো হয়, তেমনি অন্তরের মধ্যে একটি একটি করে ফেৎনা পতিত হয়। যে অন্তর উহা গ্রহণ করবে তার মধ্যে একটি কাল দাগ পড়ে যাবে। আর যে অন্তর তাকে প্রত্যাখ্যান করবে তার মধ্যে একটি শুভ্র দাগ পড়বে। এভাবে অন্তরগুলো দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। একটি সাদা পাথরের মত শুভ্র। তাকে কোন ফিৎনাই ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারে না- যতদিন নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল প্রতিষ্ঠিত থাকবে। আর একটি অন্তর ছাইয়ের মত কাল যেমন কোন পানির পাত্রকে উপুড় করে রাখা হয় (সে পাত্র যেমন পানি ধরে রাখে না, তেমনি উক্ত অন্তর) কোন ভাল কাজ চেনে না কোন অন্যায়কে অন্যায় মনে করে না। শুধু সে নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে থাকে।” (সহীহ্ মুসলিম)
-
অন্তরের আমল সম্পর্কে জ্ঞান লাভঃ
- অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আমল সম্পর্কে জ্ঞানার্জনের চেয়ে অন্তরের আমল ও ইবাদত সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা বান্দার সবচেয়ে বড় ফরয ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কেননা অন্তরের আমল হচ্ছে মূল বা শেকড় স্বরূপ আর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আমল হচ্ছে তার সৌন্দর্য, পূর্ণতা ও শাখা-প্রশাখা এবং ফল স্বরূপ। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, إِنَّ اللَّهَ لَا يَنْظُرُ إِلَى صُوَرِكُمْ وَأَمْوَالِكُمْ وَلَكِنْ يَنْظُرُ إِلَى قُلُوبِكُمْ وَأَعْمَالِكُمْ “নিশ্চয় আল্লাহ্ তোমাদের শারিরীক অবয়ব ও সম্পদের দিকে তাকাবেন না, বস্তুতঃ তিনি তাকাবেন তোমাদের অন্তকরণ ও কর্মের দিকে।” (মুসলিম) অতএব অন্তকরণ হচ্ছে জ্ঞান, চিন্তা ও গবেষণার স্থান। এ জন্যে আল্লাহর নিকট মানুষের মর্যাদা অন্তরের ঈমান, দৃঢ়তা, একনিষ্ঠতা প্রভৃতির ভিত্তিতে হয়ে থাকে। হাসান বাসরী (রহঃ) বলেন, “আল্লাহর কসম আবু বকর (রাঃ) অধিক সালাত-সিয়ামের মাধ্যমে তাদের (সাহাবীদের) মধ্যে শ্রেষ্ঠ মর্যাদাবান হননি; কিন্তু তাঁর অন্তরে ঈমানের স্থীতির মাধ্যমেই তিনি তাঁদের মধ্যে অগ্রণী হয়েছেন।”
অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের তুলনায় অন্তরের আমল কয়েক কারণে অধিক মর্যাদা সম্পন্নঃ
(১) অন্তরের ইবাদতের ত্র“টি কখনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বা শারীরীক ইবাদতকে নষ্ট করে দেয়। যেমন ইবাদতে রিয়া।(২) অন্তরের আমলই মূল। কেননা অন্তরের ইচ্ছা ব্যতীত কোন কথা বা কাজ হয়ে গেলে তাতে কোন দোষ নেই। (৩) অন্তরের আমলই জান্নাতে উচ্চ মর্যাদা লাভের মাধ্যম। যেমনঃ যুহ্দ বা দুনিয়া বিমূখতা।
(৪) অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আমলের তুলনায় অন্তরের আমলই অধিক কঠিন ও কষ্টকর। মুহাম্মাদ বিন মুনকাদির (রহঃ) বলেন, “আমার নফসকে চল্লিশ বছর পর্যন্ত কষ্ট করিয়েছি; অতঃপর তা আমার জন্যে সংশোধন হয়েছে।” (হিল্ইয়াতুল আউলিয়া ১/৪৫৮)
(৫) অন্তরের আমলের প্রভাব সর্বাধিক সুন্দর। যেমন আল্লাহর উদ্দেশ্যে ভালবাসা।
(৬) অন্তরের আমলের প্রতিদানও বেশী। আবু দারদা (রাঃ) বলেন, “এক ঘন্টা চিন্তা করা সারারাত নফল ইবাদত করার চেয়ে উত্তম।”
(৭) অন্তরই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে পরিচালনাকারী।
(৮) অন্তরই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আমলের ছওয়াবকে বৃদ্ধি করে অথবা হ্রাস করে অথবা তাকে নষ্ট করে দেয়। যেমন বিনয়ের সাথে নামায আদায় করা।
(৯) শারীরীক ইবাদতে অক্ষম হলে তার বিনিময় অন্তরের মাধ্যমে লাভ করা যায়। যেমন সম্পদ না থাকার পরও অন্তরে দানের নিয়ত থাকলে তার ছওয়াব পাওয়া যায়।
(১০) অন্তরের ইবাদতে সীমাহীন প্রতিদান দেয়া হয়। যেমনঃ সবর বা ধৈর্য্য।
(১১) শরীরীক আমল বন্ধ হয়ে গেলে বা আমল করতে অপারগ হলেও অন্তরের আমলের ছওয়াব জারী থাকে। (১২) শারীরীক আমল শুরুর পূর্বে যেমন অন্তরের উপস্থিতি দরকার অনুরূপ আমল চলা অবস্থাতেও দরকার।
শারীরীক আমল শুরুর পূর্বে অন্তরে কয়েক ধরণের অবস্থা সৃষ্টি হয়ঃ
(১) অন্তরে হঠাৎ কোন বিষয় উদয় হওয়া
(২) অন্তরে তা স্থান লাভ করা
(৩) তা নিয়ে অন্তরে চিন্তা সৃষ্টি হওয়া, করবে কি করবে না এরূপ দোটানায় ভুগবে।
(৪) সংকল্প করা অর্থাৎ তাতে লিপ্ত হওয়ার ইচ্ছাকে প্রাধ্যান্য দেয়া।
(৫) দৃঢ় সংকল্প করা। অর্থাৎ কাজটির ব্যাপারে অপরিহার্য ও পাকাপোক্ত সিদ্ধান্ত নেয়া। প্রথম তিনটি অবস্থায় ভাল কাজের ক্ষেত্রেও কোন ছওয়াব পাওয়া যাবে না এবং অন্যায় কাজের ক্ষেত্রেও কোন গুনাহ্ হবে না। চতুর্থ অবস্থায় সংকল্প করলে ভাল কাজের ক্ষেত্রে একটি নেকী আমল নামায় লিখা হবে, কিন্তু মন্দ কাজের ক্ষেত্রে কোন গুনাহ লিখা হবে না। কিন্তু সংল্পকে যদি পঞ্চম অবস্থায় উন্নীত করে অপরিহার্য ও দৃঢ়তায় পরিণত করা হয়, তবে ভাল কাজের ক্ষেত্রে যেমন ছওয়াব লিখা হবে, অনুরূপ মন্দ কাজের ক্ষেত্রেও গুনাহ লিখা হবে- যদিও সে তা কর্মে বাস্তবায়ন না করে। কেননা কোন কাজ বাস্তবায়ন করার সুযোগ ও ক্ষমতা থাকাবস্থায় তাতে দৃঢ় ইচ্ছা পোষণ করা কাজটি বাস্তবায়ন করারই নামান্তর। মহাপবিত্র আল্লাহ্ বলেন, إِنَّ الَّذِينَ يُحِبُّونَ أَنْ تَشِيعَ الْفَاحِشَةُ فِي الَّذِينَ آَمَنُوا لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ فِي الدُّنْيَا وَالْآَخِرَةِ “নিশ্চয় যারা ঈমানদারদের মাঝে অশ্লীলতা ছড়াতে ভালবাসে তাদের জন্যে আছে দুনিয়া ও আখেরাতে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।” রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,إِذَا الْتَقَى الْمُسْلِمَانِ بِسَيْفَيْهِمَا فَالْقَاتِلُ وَالْمَقْتُولُ فِي النَّارِ فَقُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ هَذَا الْقَاتِلُ فَمَا بَالُ الْمَقْتُولِ قَالَ إِنَّهُ كَانَ حَرِيصًا عَلَى قَتْلِ صَاحِبِهِ “দু’জন মুসলমান লড়াই করার জন্যে যদি তরবারী নিয়ে পরস্পর মুখোমুখি হয়, তবে হত্যাকারী ও নিহত উভয়ে জাহান্নামে যাবে। আবু বাকরা (রাঃ) বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! এ লোক তো হত্যাকারী (হিসেবে জাহান্নামে যাবে), কিন্তু নিহত ব্যক্তির অপরাধ কি? (কেন সে জাহান্নামে যাবে?) তিনি বললেন, কেননা সেও তো প্রতিপক্ষকে হত্যা করতে আগ্রহী ছিল।” (বুখারী ও মুসলিম)
অন্যায় কাজে দৃঢ় সংকল্প করার পর যদি তা পরিত্যাগ করে, তবে তা চার ভাগে বিভক্তঃ
(১) আল্লাহর ভয়ে পরিত্যাগ করবে। এ ক্ষেত্রে সে ছওয়াবের অধিকারী হবে।
(২) মানুষের ভয়ে পরিত্যাগ করবে। এতে সে গুনাহগার হবে। কেননা পাপাচার ছেড়ে দেয়াটাই ইবাদত;অতএব আল্লাহর ভয়েই তা ছেড়ে দেয়া আবশ্যক।
(৩) অপারগতার কারণে পরিত্যাগ করবে; কিন্তু এ জন্যে অন্য কোন উপায় খুঁজবে না। এতেও সে দৃঢ় নিয়ত করার কারণে গুনাহগার হবে।
(৪) সবধরণের উপায়-উপকরণের আশ্রয় নিয়েও যখন তার উদ্দেশ্য হাসিল হবে না, তখন অনুন্যপায় অবস্থায় ব্যর্থ হয়ে তা পরিত্যাগ করবে। এ অবস্থায় উক্ত কর্ম বাস্তবায়নকারীর ন্যায় সে গুনাহগার হবে। কেননা দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করার সাথে সাথে যখন সে সম্ভাব্য সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, তখন সে উক্ত কাজে লিপ্ত ব্যক্তির বরাবর অবস্থায় পৌঁছে গেছে। যেমনটি পূর্বের হাদীছে উল্লেখ করা হয়েছে। যখনই কোন অন্যায় কাজ করার সংকল্প করবে (লিপ্ত হওয়ার ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিবে) তখনই সে শাস্তির সম্মুখিন হবে। চাই অন্যায়ে তাৎক্ষণিক লিপ্ত হোক বা দেরী করে লিপ্ত হোক। যেমন কোন ব্যক্তি হারাম কাজে একবার লিপ্ত হওয়ার পর সংকল্প করল যে, যখনই সুযোগ পাবে তখনই তাতে লিপ্ত হবে, তবে সে নিয়তের কারণে উক্ত কাজে সর্বক্ষণ লিপ্ত বলে গণ্য হবে এবং শাস্তি দেয়া হবে- যদিও সে উক্ত অন্যায়ে আর লিপ্ত না হয়।
অনুবাদঃ মুহা. আবদুল্লাহ আল কাফী