ড. জোনাথন এ.সি. ব্রাউন -এর ইসলাম গ্রহণ
গির্জা ছেড়ে মসজিদে
[সচেতন পাঠক একটু চিন্তা করলেই আমাদের সাথে একমত হবেন যে, আমাদের চারপাশে এমন অনেক অতি সচেতন পিতা-মাতা আছেন যারা ২০-২২ বছর বয়সকে ছিয়াম পালন, ছালাত আদায়, হিজাব মেনে চলা তথা ইসলাম চর্চার জন্য উপযুক্ত মনে করেন না এবং তাদের নাবালক দুধের সন্তানদের (!) এসব ফরয ইবাদত পালন করা থেকে বিরত রাখেন। অথচ তারা জানেন না যে, বিশ্বের নানা প্রান্তে এমন কতক মানুষ আছেন যারা এই ‘কচি বয়সেই’ তাদের আপন কর্মগুণে বিশ্বজোড়া স্বীকৃতি লাভ করেছেন। অত্র নিবন্ধে এমনই একজন মানুষ সম্পর্কে আলোচনা করা হবে, যিনি মাত্র ২০ বছর বয়সে খ্রিষ্টান ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করার সৌভাগ্য অর্জন করেন। ১৯৯৭ সালে ইসলাম গ্রহণ করার পর আমেরিকার বিখ্যাত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ এই শিক্ষক ড. জোনাথন এ. সি. ব্রাউন বর্তমানে ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় প্রভূত অবদান রেখে চলেছেন।]
জীবন ও কর্ম : ড. জোনাথন এ.সি. ব্রাউন একজন আমেরিকান ইসলামী শিক্ষাবিদ, যিনি বর্তমানে জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইসলাম শিক্ষা এবং মুসলিম-খ্রিষ্টান সম্পর্ক’ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন। পিতা জোনাথন সি. ব্রাউন এবং মাতা নৃতত্ত্ববিদ এ্যালেন ক্লিফটন প্যাটারসন দম্পতির পরিবারে নবাগত সদস্য হিসাবে জোনাথন এ.সি. ব্রাউন ১৯৭৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। জীবনের একুশতম বসন্তে পদাপর্ণ করার অব্যবহিত পরেই তিনি ১৯৯৭ সালে ইসলাম গ্রহণ করেন। যদিও বাল্যকালে তিনি খ্রিষ্টীয় এ্যাংলিকান চার্চের অনুসারী হিসাবে লালিত-পালিত হন। ওয়াশিংটন ডিসির জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জোনাথন ব্রাউন ২০০০ সালে ইতিহাস বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি কায়রোর আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপ্রসিদ্ধ ‘সেন্টার ফর এ্যারাবিক স্টাডি এবরোড’-এর অধীনে ১ বছর যাবৎ আরবী ভাষা শিক্ষা করেন। পরবর্তীতে ২০০৬ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ইসলামিক থট’-এর উপর ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন।
ড. ব্রাউন ২০০৬ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত সিয়াটলে অবস্থিত ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘প্রাচ্য ভাষা ও সভ্যতা’ বিভাগে শিক্ষকতা করেন। ২০১০ সাল থেকে অদ্যবধি তিনি জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইসলাম শিক্ষা এবং মুসলিম-খ্রিষ্টান সম্পর্ক’ বিভাগে অধ্যাপনায় নিয়োজিত আছেন। অধিকন্তু তিনি আমেরিকার ‘কাউন্সিল অব ফরেন রিলেশন্স’-এরও একজন খন্ডকালীন সদস্য।
ইসলামী সাহিত্যে অবদান : ড. ব্রাউন হাদীছ, ইসলামী আইন, সুফীবাদ, আরবী অভিধান, প্রাক ইসলামী কাব্য ইত্যাদি বিষয়ে বেশ কিছু মূল্যবান বই ও প্রবন্ধ লিখেছেন। বর্তমানে তিনি ‘ইসলামী সভ্যতার ঐতিহাসিক সমালোচনা ও জালিয়াতির ইতিহাস’ এবং ‘ইসলামী চিন্তাধারায় পরবর্তী সুন্নীবাদ এবং সালাফীবাদের মধ্যে আধুনিক যুগের দ্বন্দ্ব’ বিষয়ে গবেষণা করছেন। গবেষণার প্রয়োজনে তিনি মিশর, সিরিয়া, তুরষ্ক, মরক্কো, সঊদী আরব, ইয়েমেন, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, ভারত সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন।
রচিত গ্রন্থসমূহ :
১. ‘মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর সংক্ষিপ্ত পরিচয়’ (অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০১১ ইং)।
২. ‘হাদীছ : মধ্যযুগ এবং আধুনিক যুগে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর রেখে যাওয়া আদর্শের বাস্তবতা’ (২০০৯ইং)।
৩. ‘বুখারী ও মুসলিম শরীফের সংকলন : সুন্নী হাদীছ সংকলন পদ্ধতি ও তার ব্যাবহারিক নীতিমালা’ (২০০৭ইং)।
এসব গ্র্ন্থ ছাড়াও আরও কিছু বই এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যতিক্রমধর্মী বিষয়ের উপর বিশ্বের কয়েকটি জনপ্রিয় ও বহুল পঠিত জার্নালে ড. ব্রাউনের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। যা আন্তর্জাতিক জ্ঞানী মহলে প্রশংসা কুড়িয়েছে ও স্বীকৃতি লাভ করেছে।
ইসলাম গ্রহণের কাহিনী
প্রশ্ন : আমরা কি আপনার ইসলাম গ্রহণের কাহিনী দিয়ে সাক্ষাৎকার শুরু করতে পারি?
ড. ব্রাউন : একজন এ্যাংলিকান তথা আমেরিকায় অবস্থিত ইংলিশ চার্চ ভুক্ত খ্রিষ্টান হিসাবে আমি বড় হয়েছি। কিন্তু আমাদের পরিবার খুব একটা ধার্মিক ছিল না। তাই ঠিক খ্রিষ্টান হিসাবে আমি বেড়ে উঠিনি। যদিও আমি সবসময় সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করতাম। জর্জটাউন কলেজের ১ম বর্ষে পড়ার সময় আমি ইসলামের উপর একটি সাবজেক্ট নেই। ক্লাসটি নিতেন একজন মুসলিম শিক্ষিকা। তাঁর আলোচনা আমার কাছে অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর লাগত। আমি অনুধাবন করলাম যে, সারা জীবন ধরে আমি যা বিশ্বাস করে এসেছি সে বিষয়গুলিই তিনি আলোচনা করেন। যেমন ঈশ্বরের প্রকৃতি, বিচারবুদ্ধির ধারণা, যুক্তি এবং ধর্মের সামঞ্জস্যতামূলক অবস্থানের ধারণা, ধর্মের উচিৎ মানবজীবনকে সমৃদ্ধ করা, জীবনকে কঠিন করে তোলা বা ভোগান্তির মধ্যে ঠেলে দেয়া নয় ইত্যাদি ধারণা। যখন সেমিস্টার সমাপ্ত হল তখন বাস্তবিকই আমি নিজেকে একজন মুসলিমের মত অনুভব করতে লাগলাম। সেই গ্রীষ্মে অর্থাৎ ১৯৯৭ সালের গ্রীষ্মের ছুটিতে ইসলামের উপর লিখিত প্রচুর বই পড়লাম এবং সারা ইউরোপ ও মরক্কো সফর করলাম। অতঃপর সফর থেকে ফিরে কলেজে ঢোকার পরপরই ২য় বর্ষের শুরুতেই আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেকে মুসলিম ঘোষণা করলাম।
প্রশ্ন : এর পূর্বে কোন মুসলিমের সাথে কি আপনার যোগাযোগ ছিল?
ড. ব্রাউন : না, আমার মনে পড়ে না। ইসলাম শিক্ষা ক্লাসে উপস্থিত হওয়ার পূর্বে কোন মুসলিমের সাথে আমার পরিচয় ছিল না।
প্রশ্ন : মুহাম্মাদ (ছাঃ) সম্পর্কে আপনার লেখা বইটার কথা আমরা সবাই জানি। সম্প্রতি জানলাম যে, আপনি নাকি নতুন আর একটা বই লিখছেন?
ড. ব্রাউন : হ্যাঁ। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসের একটি ধারাবাহিক প্রকাশনা কার্যক্রম আছে ‘সংক্ষিপ্ত পরিচয়’ এই শিরোনামে। একই শিরোনামে তারা অনেক বিষয়ের উপর বই প্রকাশ করেছে। যেমন : ‘ইউরোপীয় ইউনিয়নের সংক্ষিপ্ত পরিচয়’। এই ধারাবাহিক প্রকাশনার অংশ হিসাবে তারা আমার বইটা প্রকাশ করবে। বইটি আমি মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর উপরই লিখেছি। বইটি তারা এককভাবেও প্রকাশ করবে এবং এই সিরিজের একটি অংশ হিসাবেও প্রকাশ করবে। তবে একটু দেরী হচ্ছে কারণ প্রকাশের পূর্বে তারা আমার পান্ডুলিপি পাকিস্তানে পাঠিয়েছে এই মর্মে নিশ্চিত হওয়ার জন্য যে, বইতে মুসলিমদের জন্য অপমানজনক কিছু আছে কি না তা যাচাই করার জন্য। আমি তাদের বলতে চেয়েছিলাম, ‘দেখুন আমি নিজে একজন মুসলিম। বইটির মধ্যে যা কিছু আছে সবকিছুই মুসলমানদের রচিত। এতে মুসলিমদের জন্য অপমানজনক কিছু নেই’। বইটি লেখার পূর্বে বেশ কয়েকজন পশ্চিমা ঐতিহাসিকের শরণাপন্ন হয়েছিলাম শুধু এটা জানতে যে, তারা নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে কিভাবে মূল্যায়ন করেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর জীবনের খুঁটিনাটি সকল বিষয় আমি পেয়েছি সীরাহ এবং হাদীছ গ্রন্থসমূহে।
প্রশ্ন : আপনাকে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর কোন বৈশিষ্ট্যটি সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করেছে?
ড. ব্রাউন : সম্ভবত সকল পরিস্থিতিতেই তিনি ছিলেন সর্বোত্তম ব্যক্তি। আমার কাছে মনে হয়েছে এটা খুবই অনুপ্রেরণাদায়ক। আমেরিকাতে ধর্মের মহাপুরুষদের আমরা শুধু একই রকম বৈশিষ্ট্যের অধিকারীরূপে পেয়ে থাকি। উদাহরণস্বরূপ যীশু সবসময় দয়ালু এবং ক্ষমাশীল। কিন্তু আপনি তো সব সময় ক্ষমাশীল হতে পারেন না বা পারা উচিৎও না। কখনও হয়ত আপনাকে কোমল ও মধুর আচরণ করতে হবে, কখনও দ্বিধাহীন ও কঠোর হতে হবে, কখনও বা ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতে হবে আবার হয়ত অন্য সময় আপনাকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। এটা নয় যে, জীবনের সর্বক্ষেত্রে আপনার আচরণ একাধারে শুধু একটি নীতিই অনুসরণ করে যাবে; বরং আপনাকে পরিস্থিতি বোঝার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে এবং সে মোতাবেক সর্বোত্তম উপায়ে কাজ করতে হবে। মুহাম্মাদ (ছাঃ) এই কাজটিই খুব দক্ষতার সাথে করতে জানতেন এবং আমার মতে এটিই তার চরিত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক।
প্রশ্ন : আজ মুসলিমরা কি তাঁর শিক্ষাকে দৈনন্দিন জীবনে যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে পারছে?
ড. ব্রাউন : আমি মনে করি মুসলিমদের এই ব্যাপারটি অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে যে, মহানবী (ছাঃ) কতটা আদর্শবাদী এবং সক্রিয় ছিলেন। তিনি নিজে আদর্শ জীবন-যাপন করতেন এবং সাথে সাথে এটাও জানতেন কিভাবে নিজের আদর্শ প্রচার করতে হয় এবং কিভাবে কথার মাধ্যমে মানুষের অন্তর জয় করতে হয়। তিনি আরও জানতেন কিভাবে কথা বললে মানুষকে নিজের অনুগামীতে পরিণত করা যায়। তিনি সবসময় খুব কঠোরতা বা খুব কড়া ও নির্মম নীতিপরায়ণতা দেখাতেন না। তিনি জানতেন আল্লাহর বাণী কিভাবে উপস্থাপন করলে তা প্রত্যেক মানুষের জন্য অনুধাবনযোগ্য হতে পারে। তাই তিনি আল্লাহর একই বাণীকে বিষয়বস্ত্তর পরিবর্তন না ঘটিয়ে ব্যক্তিবিশেষে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করতেন অর্থাৎ বিষয়বস্ত্ত একই, তবে উপস্থাপনভঙ্গি আলাদা। এটা খুব কার্যকর পদ্ধতি। আমার মনে হয় মুসলিমরা যখনই নিজেকে ধার্মিক বলে ভাবতে শুরু করে তখন তারা কোন কোন বিষয় ‘হারাম’ তা ঘোষণা করতে মনোযোগী হয়। তবে সত্যিই যদি মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর অনুসরণ করতে হয়, তবে সবসময় আগে চিন্তা করা উচিৎ কোন কোন জিনিস ‘হালাল’ বা যথার্থ। দ্বীনকে অনুসরণের জন্য এটা সত্যিই খুব কার্যকর পদ্ধতি। একজন পরিপূর্ণ এবং ভারসাম্যপূর্ণ মানুষ হতে গেলে এ নীতির বিকল্প নেই।
প্রশ্ন : ইউরোপ ও আমেরিকায় আজ মুহাম্মাদ (ছাঃ) কিছু ব্যক্তির আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যবস্ত্ত। এটা কেন?
ড. ব্রাউন : প্রথমতঃ অজ্ঞতা। সাধারণ মানুষ ইসলাম অথবা নবী (ছাঃ) সম্পর্কে আসলে কিছুই জানে না। তারা কেবল শুনে থাকে যে, মুসলিমরা সন্ত্রাসী এবং ইসলাম একটি সন্ত্রাসবাদী ধর্ম। সুতরাং তাদের ধারণা মহানবী (ছাঃ)-কে অবশ্যই সন্ত্রাসের উৎস এবং এর প্রতীক হতে হবে। এটাই হল সবচেয়ে বড় কারণ। যা অনেকটাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কেন মুসলিম বিশ্বের সাথে পশ্চিমা দেশগুলোর এত সংঘাত? এর কারণ হল পশ্চিমা দেশগুলো অন্যায়ভাবে মুসলিম দেশগুলো আক্রমণ করছে এবং দখল করে রাখছে। যার জের ধরে তৈরী হচ্ছে রাজনৈতিক সমস্যা। আর একে কেন্দ্র করে পশ্চিমারা মুসলমানদের সন্ত্রাসীরূপে চিত্রিত করছে। কেননা মুসলিমরা তাদের যুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। পশ্চিমা বিশ্ব এবং মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে এই সংঘাত নতুন নয়; এর এক লম্বা ইতিহাস রয়েছে। তবে বর্তমান সময়ে মহানবী (ছাঃ)-কে যে বিদ্বেষ এবং ঘৃণা সহকারে চিত্রিত করা হচ্ছে, তার একমাত্র ব্যাখ্যা হতে পারে এটা একটা রাজনৈতিক সংঘাতের ফলশ্রুতি। আর সেই কারণে যদি রাস্তার কোন সাধারণ লোককে যদি ‘ইসলাম’ সম্পর্কে কিছু বলতে বলেন তবে দেখবেন তার মনে আসা শব্দগুলো হল সন্ত্রাসবাদ, নবী মুহাম্মাদ, চরমপন্থা, তলোয়ার, সহিংসতা ইত্যাদি। এই মিথ্যা কল্পনার পুনরাবৃত্তি চলে আসছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে।
প্রশ্ন : মুসলিমদের এ ব্যাপারে কি করা উচিত বলে আপনি মনে করেন?
ড. ব্রাউন : মুসলিমদের উচিৎ হবে তাদেরকে সঠিক জ্ঞান দানের জন্য যথাসাধ্য পদক্ষেপ নেয়া। কেননা সাধারণ মানুষ ইসলাম সম্পর্কে কিছুই জানে না। বেশিরভাগ মানুষকে যদি রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনী শোনানো হয় যে, মক্কায় কোন সংঘাত ছাড়াই কিভাবে তিনি ১৩ বছর কাটিয়ে দিলেন, যদিও মক্কার মুশরিকরা তার প্রতি অত্যাচার করেছিল, তারা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাবে। আমি মনে করি, প্রতিদিনই কাগজে লিখে হোক আর ইন্টারনেটে লিখে হোক মুহাম্মাদ (ছাঃ) সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রত্যেক মুসলিমের ঈমানী দায়িত্ব।
প্রশ্ন : ইউরোপে দিনের পর দিন ইসলামের ব্যাপারে প্রতিকূলতা এবং মিডিয়ার অপপ্রচার বৃদ্ধি পাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে কি অবস্থা?
ড. ব্রাউন : যুক্তরাষ্ট্রে ধর্ম পালনের স্বাধীনতা খুব কঠোরভাবে সংরক্ষণ করা হয়। এখানে সাংবিধানিকভাবেই ধর্মচর্চার অধিকার সুরক্ষিত। এখানে ক্লাস বা কাজ ছেড়ে দিয়ে খুব সহজেই ছালাত আদায় করতে যাওয়া যায়। এই অধিকার সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত। হিজাব পরার কারণে কোন প্রতিষ্ঠান যদি কোন মহিলার সমালোচনা করে তবে তিনি আদালতে অভিযোগ দায়ের করতে পারেন অনায়াসেই। অবশ্য সন্ত্রাসবাদ নামক জুজুর ভয়ে অনেক সময় সরকার কোন কারণ ছাড়াই মুসলিমদের হয়রানি করে থাকে। এই ধারণা থেকে যে একজন প্রাক্টিসিং মুসলিম হল জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। তাদের ধারণা এ সকল মুসলিমরা আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতির সাথে একমত নয়। অথচ মজার ব্যাপার হল, স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার থেকে অধিকাংশ মার্কিন নাগরিকই সরকারের পররাষ্ট্র নীতির সাথে একমত নন। কিন্তু একই অধিকার একজন মুসলিম চর্চা করলে তিনি হয়ে যান ‘সম্ভাব্য চরমপন্থী’ ‘মৈŠলবাদী’ (!)। ৯/১১-এর পর সেখানে একটা আইন পাশ করা হয় যা ‘প্যাট্রিয়ট অ্যাক্ট’ নামে পরিচিত। এই আইনের বলে সরকারের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জাতীয় নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে ঢালাওভাবে যে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করতে পারে। বিনা অনুমতিতে ফোনকল রেকর্ড, যে কাউকে বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেপ্তার করার অধিকার দেয়া হয়েছে এ আইনে। আর কিউবার কুখ্যাত ‘গুয়ানতানামো বে’ কারাগারে মুসলিম নির্যাতনের বর্বরতা তো আজ বিশ্ব মানবতাকে কাঁপিয়ে দিয়েছে।
প্রশ্ন : সম্প্রতি জানা গেছে যে, মুসলিম শিক্ষার্থীদের সকল তথ্য নাকি সি.আই.এ-র কাছে সংরক্ষিত থাকে?
ড. ব্রাউন : এই ধরনের ঘটনা প্রচুর ঘটছে যা আমেরিকার সর্বত্র সমালোচিত হচ্ছে। সরকার সংবিধান পরিপন্থী কাজ করছে এই অভিযোগে অনেক অমুসলিম আমেরিকানও এই নীতির বিরোধিতা করছে। সরকার কখনোই আপনার ফোনে আঁড়ি পাততে পারে না, যতক্ষণ আদালত অনুমতি না দেয়। ছাত্রদের উপর এত নজরদারিও করতে পারে না। এমনকি যদি কেউ লাইব্রেরীতে গিয়ে কোন বই ইস্যু করে তবে সরকার সেটাও খতিয়ে দেখবে যে, সে কি ধরনের বই পড়ছে। যুক্তরাষ্ট্র তার মুসলিম নাগরিকদের অন্য দেশেও পাঠাচ্ছে নির্যাতন করার জন্য। এটা একটা বিরাট বিতর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুসলিমরা যেমন এই আইনের বিরোধী, তেমনি অধিকাংশ মার্কিন নাগরিকই এই অন্যায়ের ঘোর বিরোধী।
প্রশ্ন : মুসলিম শিক্ষাবিদ হিসাবে আপনি কি কখনো এমন বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন?
ড. ব্রাউন : না, এমন অভিজ্ঞতা এখনও হয়নি। তবে আমি যথার্থ উদাহরণ নই। কারণ আমার নাম জোনাথন ব্রাউন। আমার নামে বোঝা যায় না যে আমি কোন মুসলিম দেশের মানুষ। ব্যক্তিগতভাবে আমার নাম বা চেহারার কারণে কোন ঝামেলার সম্মুখীন হইনি এখনও। একজন মুসলিম শিক্ষাবিদ হিসাবেও কোন সমস্যা পোহাতে হয় নি। প্রকৃতপক্ষে আমেরিকার সাধারণ জনগণ মুসলিমদের অভিব্যক্তি জানতে অত্যন্ত আগ্রহী।
প্রশ্ন : মুসলিম দেশ তুরস্ককে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করেন?
ড. ব্রাউন : দেশটি আমার পছন্দের তালিকায় শীর্ষে আছে। আমি জানি এখানে মুসলিমরা খুব কঠিন অবস্থায় রয়েছে। তবুও আমি এদেশকে ভালবাসি। কারণ রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে যখনই খুশী মসজিদে ছালাত আদায় করা যায়। আর এখানকার খাবার অত্যন্ত সুস্বাদু। মাঝে মাঝে আক্ষেপ হয়, আহ! তুর্কী ভাষাটা যদি রপ্ত করতে পারতাম! আমি আসলে আরো অনেক কিছু জানতে চাই। তবে ইসলাম চর্চার জন্য তুরষ্কের পরিবেশ খুব জটিল। তুর্কীদের প্রতি আমার অনেক শ্রদ্ধা রয়েছে কিন্তু এটা সত্যিই খুব জটিলতাপূর্ণ একটা দেশ।
প্রশ্ন : মুসলিম বিশ্বে ঐক্যের এত অভাব কেন?
ড. ব্রাউন : সত্যিই, মুসলিমদের মধ্যে ঐক্যের আজ বড়ই অভাব। এর অন্যতম কারণ হল মানুষ কেবলই ব্যক্তিস্বার্থ দ্বারা চালিত হয়। ফলে আমরা ঐক্যবদ্ধ শক্তিতে পরিণত হতে পারছি না। মুসলমানদের অনেকেই মনে করে যদি কারো সাথে কোন একটি বিষয়ে দ্বিমত হয় তবে তার সাথে আর কাজ করা যাবে না। কিন্তু এটা খুব তুচ্ছ ব্যাপার। কেননা আপনি কখনোই সবার সাথে শতভাগ একমত হতে পারবেন না। তাই ভিন্নমতের চেয়ে সর্বদা পারস্পরিক সহযোগিতামূলক সম্পর্ক স্থাপনের সুযোগ খুঁজতে হবে। এটাই কল্যাণকর।
প্রশ্ন : আপনি কি মনে করেন, এমন এক বা দুইটি রাজনৈতিক শক্তি থাকা দরকার যারা মুসলিমদের নেতৃত্ব দিবে? যেমন ধরুন মুসলিম রাষ্ট্রগুলো কি ওআইসির অধীনে ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারে?
ড. ব্রাউন : এটা একটা যুক্তিপূর্ণ ব্যাপার। বিভিন্ন রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ইস্যুগুলোতে যদি মুসলিম রাষ্ট্রগুলো পরস্পর সমঝোতায় আসতে পারে তবে অচিরেই তারা সংঘবদ্ধভাবে অন্যান্য দেশগুলোর সাথে দর কষাকষি করার সক্ষমতা অর্জন করতে পারবে। ধরুন ফ্রান্সের মত কোন দেশ যদি মুসলিম নারীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে হিজাব পরা নিষিদ্ধ করে, তবে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে একযোগে এর বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিতে হবে এবং প্রয়োজনে সে দেশকে বর্জন করতে হবে। কেননা কেউ যদি তার ধর্মীয় পোশাক পরিধান করতে চায় তবে এটা তার একান্ত মৌলিক অধিকার। আমি নিশ্চিত যে, আমার মত কোন মার্কিন নাগরিকই স্বাধীনভাবে ধর্মচর্চায় বাধা প্রদানে একমত হবেন না। এটা একটা দিক। আরেকটা দিক হল মুসলিম রাষ্ট্রগুলো পররাষ্ট্রনীতির দিক থেকে রাজনৈতিক প্রভাব রাখার মত শক্তি বৃদ্ধি করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ যখনই কোন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি কোন মুসলিম দেশ আক্রমণ করতে চাইবে তখন কোন মুসলিম দেশই তা সমর্থন করবে না এবং আক্রমণকারীদেরকে নিজস্ব আকাশসীমা এবং স্থলভাগ ব্যবহার করার অনুমতি দিবে না।
যাইহোক মুসলমানদের এই ঐক্যজোট স্বয়ং আমেরিকার জন্যও মঙ্গল বয়ে আনত। কেননা বেশিরভাগ আমেরিকান এখন বুঝতে পেরেছে যে, ইরাক আক্রমণ ছিল ইতিহাসের একটি অন্যতম ভুল সিদ্ধান্ত। তাদের মতে, যদি মুসলিম রাষ্ট্রগুলো সহযোগিতা ও সমর্থন না করে একজোট হয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে এ আগ্রাসন চালাতে বাধা প্রদান করত তবে হয়ত লাখ লাখ ডলার আর নিরীহ মানুষের জীবনের অপচয় রোধ করা সম্ভব হত।
প্রশ্ন : পরিশেষে মুসলিমদের উদ্দেশ্যে আপনি কি কোন উপদেশ দিবেন?
ড. ব্রাউন : কেউ যদি তোমাকে নসীহত প্রদান করে এবং অসৎ কাজে বাধা দেয় তবে সেটা হবে তোমার জন্য পার্থিব জীবনের সেরা উপহার। আল্লাহু আকবার!
তথ্যসূত্র : ওয়েবসাইট
-কে.এম. রেজওয়ানুল ইসলাম