কল্যাণের অভিযাত্রী
রামাযানের প্রথম রাত্রিতেই আল্লাহ বান্দাদের উদ্দেশ্যে ডেকে বলেন, হে কল্যাণের অভিযাত্রী এগিয়ে চল! হে অকল্যাণের অভিসারী থেমে যাও’ (তিরমিযী, ইবনু মাজাহ)। প্রতি রাত্রির শেষ প্রহরে নিম্ন আকাশে নেমে আল্লাহ স্বীয় বান্দাদের প্রতি অনুরূপভাবে সারা বছর দরদভরা আহবান জানিয়ে থাকেন (বুখারী, মুসলিম)। সে আহবান শুনতে পায় তারাই, যাদের তা শোনার মত কান আছে। বুঝার মত হৃদয় আছে। স্বার্থবাদী এ পৃথিবীতে বস্ত্তবাদী মানুষ সর্বদা ভোগের নোংরা ডোবায় হাবুডুবু খাচ্ছে। তার কানে কিভাবে তার সৃষ্টিকর্তার এ স্নেহভরা আহবান ধ্বনিত হবে? সে ভেবেছে দুনিয়াই তার সবকিছু। কিন্তু সে জানেনা যে, তার আসল জীবন পড়ে আছে পরপারে। ঐ জীবনটাই তার চিরস্থায়ী জীবন। সেখানে মানুষ আগুনে পুড়ে জীবন্ত দগ্ধীভূত হোক, এটা প্রেমময় আল্লাহ কখনোই চান না। তাই তিনি অহী পাঠিয়ে নবী-রাসূলগণের মাধ্যমে মানুষকে আগেই সাবধান করেছেন যাতে তারা আল্লাহর বিধানের অনুসারী হয় এবং পরকালে শান্তিতে থাকে। কিন্তু শয়তান সর্বদা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে ফিরিয়ে রাখে।
প্রত্যেক মানুষের মধ্যে সত্য গ্রহণের যোগ্যতা ও প্রেরণা আল্লাহ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। যাকে কুরআনে ও হাদীছে ‘ফিৎরাত’ বলা হয়েছে। সে প্রকৃতিগত ভাবেই আল্লাহর অনুগত। এটাই তার স্বভাবধর্ম। কিন্তু শয়তানী ধোঁকার জাল তাকে বাধাগ্রস্ত করে। প্রধানতঃ চারভাবে শয়তান তাকে সত্যগ্রহণে বাধা দেয়। প্রথমে তার পিতামাতা ও পরিবারের মাধ্যমে। তারা নাস্তিক, অমুসলিম বা বিদ‘আতী হ’লে সন্তান সেভাবে গড়ে ওঠে। এমনকি বাপ-দাদার দোহাই দিয়েই সে আমৃত্যু সত্যকে এড়িয়ে চলে। দুই- তার সমাজের মাধ্যমে। যে সমাজে সে বেড়ে ওঠে, সে সমাজের মন্দ রীতিনীতি সে মেনে চলে। তিন- রাষ্ট্রের মাধ্যমে। রাষ্ট্রের আইন-কানূন আল্লাহবিরোধী হলেও সে তা বাধ্য হয়ে মেনে চলে। চার- তার নিজস্ব হঠকারিতা ও উদাসীনতা। এ রোগ যার মধ্যে প্রবল, শয়তান তাকে খুব সহজে কাবু করতে পারে। এই চার প্রকার বাধা মুকাবিলা করে সত্যিকারের ভাগ্যবানরাই কেবল সত্য গ্রহণে সক্ষম হয়। প্রথম তিনটি কারণ কেউ পেরোতে পারলেও শেষোক্ত বাধা অতিক্রম করা অধিকাংশের পক্ষেই সম্ভব হয় না। বংশের গৌরব, ইলমের গর্ব, পদমর্যাদার অহংকার, প্রাচুর্যের স্ফীতি তাকে অন্ধ করে রাখে। সেই সাথে সত্যের ব্যাপারে উদাসীনতা ও শৈথিল্য তাকে মিথ্যায় নিক্ষেপ করে অথবা মিথ্যার সহযোগী বানায়। ফলে সত্যের আলো বারবার জ্বললেও সে তা দেখতে পায় না। হুতোম পেঁচা যেমন দিনের আলো দেখতে পায় না। অতএব যারা আল্লাহর পথের দাঈ, যারা আলোর পথের দিশারী, যারা সমাজ সংস্কারের অগ্রপথিক, তাদেরকে অবশ্যই উক্ত শয়তানী ধোঁকাসমূহ থেকে সাবধান থাকতে হবে। এগুলো মুকাবিলা করেই তাকে সত্য গ্রহণ করতে হবে এবং সর্বদা আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করতে হবে।
এ দুনিয়াতে যারা হক চিনে, হক অনুযায়ী আমল করে, হক-এর দিকে মানুষকে দাওয়াত দেয় এবং ঝুঁকি এলে হাসিমুখে ছবর করে ও মুকাবিলা করে, জান্নাত কেবল তাদেরই জন্য। কিন্তু যারা ঝুঁকির ভয়ে পিছিয়ে যায় বা অজুহাত দিয়ে সরে পড়ে, তারা জান্নাতের কিনারে এসে ছিটকে পড়ে। আল্লাহ বলেন, লোকদের মধ্যে অনেকে আল্লাহর ইবাদত করে দ্বিধার সাথে। এতে কল্যাণপ্রাপ্ত হ’লে সে প্রশান্তি লাভ করে। কিন্তু পরীক্ষায় পতিত হ’লে পূর্বাবস্থায় ফিরে যায়। ফলে সে দুনিয়া ও আখেরাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর এটাই হ’ল সুস্পষ্ট ক্ষতি’ (হাজ্জ ২২/১১)। তিনি বলেন, যারা আল্লাহর পথে পরীক্ষায় পতিত হয়, তাদের একমাত্র প্রতিদান হ’ল জান্নাতের বিশেষ কক্ষ। সেখানে তাদেরকে অভ্যর্থনা দেওয়া হবে অভিবাদন ও সালাম সহকারে’। ‘সেখানে তারা অনন্তকাল থাকবে। আশ্রয়স্থল ও আবাসস্থল হিসাবে কতই না উৎকৃষ্ট সেটি’ (ফুরক্বান ২৫/৭৫-৭৬)।
একদল মানুষ আছেন, যারা নিজেদের মনগড়া ফৎওয়া, মাযহাব ও রেওয়াজ ঠিক রাখার জন্য মুহাদ্দেছীন ও সালাফে ছালেহীনের বুঝের বাইরে গিয়ে অহেতুক যুক্তিতর্কের আশ্রয় নেন। এরা যুক্তি দিয়ে কুরআন-হাদীছের প্রকাশ্য অর্থকে এড়িয়ে চলেন এবং যেকোন মূল্যে নিজের বুঝটা ঠিক রাখেন। এদের দিকে ইঙ্গিত করেই ওমর ফারূক (রাঃ) বলে গেছেন, ইসলামকে ধ্বংস করে তিনজন লোক। (১) পথভ্রষ্ট আলেম (২) আল্লাহর কিতাবে বিতর্ককারী মুনাফিক এবং (৩) পথভ্রষ্ট (সমাজ ও রাষ্ট্র) নেতারা (দারেমী হা/২১৪)। তিনি সাবধান করে বলেন, সত্বর কিছু লোক আসবে, যারা তোমাদের সাথে কুরআনের অস্পষ্ট বিষয়গুলি নিয়ে ঝগড়া করবে। তোমরা তাদেরকে হাদীছ দিয়ে পাকড়াও কর। কেননা হাদীছবিদগণ আল্লাহর কিতাব সম্পর্কে সবার চাইতে বিজ্ঞ’ (ঐ, হা/১১৯)। ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, সত্বর একদল লোকের আবির্ভাব ঘটবে, যারা দ্বীনের সবকিছু তাদের রায় অনুযায়ী ক্বিয়াস করবে’ (ঐ, হা/১৮৮)। শা‘বী বলেন, আল্লাহর কসম! যদি তোমরা কিয়াসকে ধারণ কর, তাহ’লে অবশ্যই তোমরা হালালকে হারাম করবে এবং হারামকে হালাল করবে’ (ঐ, হা/১৯২)। যেমন এ যুগে সূদ-ঘুষ, যেনা-ব্যাভিচার সহ প্রায় সকল প্রকার হারামকে হালাল করা হচ্ছে পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে ও কপট যুক্তি দিয়ে। আল্লাহ সূদকে হারাম করেছেন। কিন্তু কাফেররা সূদকে ব্যবসার মত বলেছিল (বাক্বারাহ ২/২৭৫)। শয়তানের স্পর্শে মোহাবিষ্ট ব্যক্তির মত আমরাও তাই বলছি। তাহ’লে কাফেরদের সাথে আমাদের পার্থক্য কোথায়? সূদ-ঘুষের টাকা খেয়ে ইবাদত করছি। আর ভাবছি জান্নাত পাব। সেটা কি সম্ভব?
প্রবৃত্তিপূজারীদের প্রতি ইঙ্গিত করে হযরত আলী (রাঃ) বলেন, যদি কোন ব্যক্তি সারা বছর ছিয়াম রাখে ও ইবাদতে রাত্রি জাগরণ করে। অতঃপর কা‘বাগৃহে হাজারে আসওয়াদ ও মাক্বামে ইবরাহীমের মাঝখানে নিহত হয়। তাহ’লেও কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে প্রবৃত্তিপূজারীদের সঙ্গে উত্থিত করবেন’ (দারেমী হা/৩১০)। বিগতযুগে ছাহাবী ও তাবেঈগণ এইসব লোকদের এড়িয়ে চলতেন। একদা আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ)-এর নিকটে একজন লোক এসে বলল, অমুক ব্যক্তি আপনাকে সালাম দিয়েছে। তিনি বললেন, আমি শুনেছি লোকটি বিদ‘আতী। যদি সে বিদ‘আতী হয়ে থাকে, তবে তাকে তুমি আমার সালাম দিয়ো না’ (ঐ, হা/৩৯৩)। ইবনু সীরীন ও হাসান বাছরী বলেন, তোমরা কখনোই বিদ‘আতী ও ঝগড়াটে লোকদের সাথে বসবে না, তাদের সাথে তর্কে জড়াবে না ও তাদের কোন কথা শুনবে না (ঐ, হা/৪০১)। ইবনু সীরীন পরিষ্কারভাবে বলেন, নিশ্চয়ই কুরআন-হাদীছের ইলম হল দ্বীন। অতএব তোমরা দেখ কার কাছ থেকে দ্বীন গ্রহণ করছ’ (ঐ, হা/৪২৪)। ওমর (রাঃ) বলেন, তোমরা রায়পন্থীদের থেকে দূরে থাক। ওরা সুন্নাতের শত্রু। হাদীছ আয়ত্ত করতে ব্যর্থ হওয়ায় ওরা মনগড়া কথা বলে। ফলে নিজেরা পথভ্রষ্ট হয় ও অন্যকে পথভ্রষ্ট করে’ (দারাকুৎনী হা/৪২৩৬)। অতএব কোন প্রশ্নে কেবল ছহীহ হাদীছ দিয়ে জবাব দিতে হবে। না জানা থাকলে বলবে ‘আল্লাহ সর্বাধিক অবগত’। ‘কোনরূপ ভান করা যাবে না এবং কোনরূপ বিনিময় কামনা করা যাবে না’ (মুত্তা, মিশ হা/২৭২; ছোয়াদ ৮৬)। সকালে যে সত্য জানা ছিল না, বিকালে তা জানলে সঙ্গে সঙ্গে তা গ্রহণ করতে হবে। এজন্য সর্বদা যোগ্য ও তাক্বওয়াশীল হাদীছপন্থী আলেমের শরনাপন্ন হতে হবে। অবশ্যই কোন রায়পন্থী আলেমের কাছে নয়।
অতএব হে কল্যাণের অভিযাত্রী! এগিয়ে চল। বিনয়ী ও সহনশীল হও। সব ছেড়ে ফিরক্বা নাজিয়াহর অন্তর্ভুক্ত হও এবং জামা‘আতী যিন্দেগী অবলম্বন কর। কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকবর্তিকা হাতে নিয়ে সমাজের পুঞ্জীভূত জাহেলিয়াত দূর কর। সময়ের অপচয় করো না। প্রতি মুহূর্তে আয়ু ফুরিয়ে যাচ্ছে। তাই যে কাজে নেকী আছে তা কর, যাতে নেই তা ছাড়। যে বসে থাকবে, বিতর্ক করবে, সে পিছনে পড়ে থাকবে। তুমি নবীদের তরীকায় সমাজ সংস্কারে ব্রতী হও। আল্লাহর ক্ষমা ও জান্নাতের দিকে প্রতিযোগিতা করে দৌড়ে চল। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন!