সুন্নাহ/হাদীছ

হাদীছ কি এবং কেনো? – ১

বিস্মিল্লাহির রাহমানির রাহীম

সকল প্রশংসা নিখিল বিশ্বের প্রতিপালক মহান রাব্বুল আলামীনের জন্য। সহস্র দুরূদ ও সালাম বর্ষিত হউক মানব জাতির শিক্ষক, মহানবী ও সর্ব শেষ নবী মুহাম্মদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এবং তাঁর পরিবার-পরিজন ও ছাহাবীগণের উপর।

আম্মা বা’দ! মহান রাব্বুল আলামীন যুগে যুগে মানব জাতির হেদায়েতের জন্য দুটি ব্যবস্থা গ্রহন করেছেন। প্রথমঃ ‘কিতাবুল্লাহ’, দ্বিতীয়ঃ ‘রিজালুল্লাহ’। ‘কিতাবুল্লাহ’ অর্থাৎ আসমান থেকে অবতীর্ণ আল্লাহ তাআ’লার মহাগ্রন্থ সমূহ। আর ‘রিজালুল্লাহ’ অর্থাৎ মানব জাতির পিতা হযরত আদম [আঃ] থেকে শুরু করে সর্বশেষ নবী, আল্লাহর প্রিয় খালীল হযরত মুহাম্মদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত প্রত্যেক যুগে প্রত্যেক সম্প্রদায়ের কাছে মানুষের হেদায়েতের জন্য প্রেরীত নবী ও রাসূলগণ। আল্লাহ তাআ’লা শুধু গ্রন্থ নাযিল করাই যেমন যথেষ্ট মনে করেননি, তেমনি শুধু রাসূল প্রেরণ করেও ক্ষান্ত হননি। বরং সর্বদা উভয় ধারা অব্যাহত রেখেছেন। এতদুভয় ধারা সমভাবে প্রবর্তন করে আল্লাহ তাআ’লা একটি বিরাট শিক্ষার দ্বার উম্মুক্ত করে দিয়েছেন। তা এই যে, মানুষের নির্ভুল শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য শুধু গ্রন্থ কিংবা শুধু শিক্ষাই যথেষ্ট নয়, বরং একদিকে আল্লাহর হেদায়েত ও আল্লাহর সংবিধানেরও প্রয়োজন, যাকে কুরআন বলা হয় এবং অপর দিকে একজন শিক্ষাগুরুরও প্রয়োজন, যিনি স্বীয় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে আল্লাহর হেদায়েতে অভ্যস্ত করে তুলবেন। কারণ, মানুষই মানুষের প্রকৃত শিক্ষাগুরু হ’তে পারে। গ্রন্থ কখনো গুরু বা অভিভাবক হ’তে পারে না, তবে শিক্ষা-দীক্ষায় সহায়ক অবশ্যই হ’তে পারে।

দুটি বস্তুর মাধ্যমে ইসলামের সুচনা ঃ

ইসলামের সুচনা একটি গ্রন্থ ও একজন রাসূলের মাধ্যমে হয়েছে। এদ’ুয়ের সম্মিলিত শক্তিই জগতে একটি সুষ্ঠু ও উচ্চস্তরের আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠিত করেছে। এমনিভাবে ভবিষ্যত বংশধরদের জন্যেও একদিকে পবিত্র শরীয়ত এবং অন্যদিকে কৃতী পুরুষগণ রয়েছেন। কেউ কেউ কুরআনের প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করে শুধু ওলামা ও মাশায়েখকেই সবকিছু মনে করে বসে। তারা শরীয়তের অনুসারী কি-না তারও খোঁজ নেয়না। এ রোগটি আসলে ইহুদী ও খ্রীষ্টানদের থেকেই সংক্রামিত হয়েছে। আল্লাহ তাঅ’ালা বলেনঃ

(التوبة:৩১) . اتَّخَذُواْ أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِّن دُونِ اللّهِ

‘তারা আল্লাহকে ছেড়ে তাদের ওলামা ও মাশায়েখকে উপাস্য বানিয়ে নিয়েছে’।

এটা নিঃসন্দেহে শিরক ও কুফরের রাস্তা। লক্ষ লক্ষ মানুষ এ রাস্তায় বের হয়েছে এবং হচ্ছে। পক্ষান্তরে এমন কিছু লোক রয়েছে, যারা কুরআন ও হাদীছের শিক্ষা অর্জনের জন্য কোন উস্তাদ ও অভিভাবকের প্রয়োজনই মনে করে না। তারা বলে ‘আল্লাহর কিতাব কুরআনই আমাদের জন্য যথেষ্ট।’ এটাও আরেক পথভ্রষ্টতা। এর ফল হচ্ছে ধর্মচ্যুত হয়ে মানবীয় প্রবৃত্তির শিকারে পরিণত হওয়া। কেননা বিশেষজ্ঞদের সাহায্য ব্যতিরেকে শাস্ত্র অর্জন মানুষের স্বভাববিরুদ্ব কাজ। এরূপ ব্যক্তি অবশ্যই ভূল বুঝাবুঝির শিকার হতে পারে। এভুল বুঝাবুঝি কোন কোন সময় তাকে ধর্মচ্যুতও করে দিতে পারে’।

রাসূলগণের মহান দায়িত্ব ঃ

রাসূলগণের মহান দায়িত্ব ছিল, আল্লাহ তাআ’লার কিতাবের মর্মবানী ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ মানুষকে বলে দেয়া এবং আল্লাহর কিতাব মতে কিভাবে আমল করা যায় তার একটি বাস্তব নমূনা ও আদর্শ জনগণের সামনে পেশ করা। রিসালাত ও নুবুওয়াতের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। মানব ইতিহাসের সূচনা লগ্ন থেকেই এর প্রারম্ভ। সর্বপ্রথম নবী ছিলেন আদম (আঃ)। আর সর্বশেষ নবী হলেন মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। রাসূল হিসেবে তাঁর দায়িত্ব ছিল অনেক, কুরআন মজীদে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ভাষায় তা বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তাঅ’ালা এরশাদ করেনঃ

لَقَدْ مَنَّ اللّهُ عَلَى الْمُؤمِنِينَ إِذْ بَعَثَ فِيهِمْ رَسُولاً مِّنْ أَنفُسِهِمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِن كَانُواْ مِن قَبْلُ لَفِي ضَلالٍ مُّبِينٍ . (آل عمران: ১৬৪.)

‘আল্লাহ ঈমানদারদের উপর অনুগ্রহ করেছেন যে, তাদের মাঝে তাদের নিজেদের মধ্য থেকে নবী পাঠিয়েছেন। তিনি তাদের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করেন, তাদেরকে পরিশোধন করেন এবং তাদেরকে কিতাব ও, হেকমত শিক্ষা দেন। বস্তুতঃ তারা ছিল পূর্ব থেকে পথভ্রষ্ট’। এই একই কথাগুলি সূরা বাক্কারাহর ১২৯, ১৫১ এবং সূরা জূমুঅ’াহর ২ আয়াতেও বর্ণিত হয়েছে। এই আয়াতগুলিতে রিসালাতের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি দায়িত্বের কথা বলা হয়েছে। প্রথমঃ কুরআন তেলাওয়াত করে শুনানো। দ্বিতীয়ঃ কিতাব ও হেকমত তথা কুরআন ও সুন্নাহর শিক্ষাদান। তৃতীয়ঃ পবিত্রকরণ অর্থাৎ বাহ্যিক ও আত্মিক নাপাকী থেকে পবিত্র করা। উক্ত আয়াতগুলিতে ‘হেকমত’ অর্থ হল ‘সুন্নাহ’।

এখান থেকে আমরা বুঝতে পারলাম যে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেখানে ছিলেন কুরআন তেলাওয়াতকারী ও আত্মশুদ্ধি কারক, সেখানে কুরআন-সুন্নাহর একজন আদর্শ শিক্ষকও ছিলেন তিনি।

এছাড়া তাঁকে আদর্শ নমূনা ও অনুসরণীয় আদর্শ হিসাবেও প্রেরণ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআ’লা এরশাদ করেনঃ

لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ . (الأحزاب: ২১)

‘নিশ্চয়ই রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মধ্যে রয়েছে তোমাদের জন্য অনুপম আদর্শ’।

অন্যত্র এরশাদ হয়েছেঃ

قُلْ إِن كُنتُمْ تُحِبُّونَ اللّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللّهُ غَفُورٌ رَّحِيمٌ .

‘বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তাহ’লে আমাকে অনুসরণ কর, যাতে আল্লাহও তোমাদেরকে ভালবাসেন এবং তোমাদের পাপসমূহ মার্জনা করে দেন। আল্লাহ হ’লেন ক্ষমাকারী দয়ালু’।

এমনিভাবে তাঁকে প্রেরণ করা হয়েছে ন্যায়নিষ্ঠ বিচারক হিসাবে। এরশাদ হয়েছেঃ

إِنَّا أَنزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ لِتَحْكُمَ بَيْنَ النَّاسِ بِمَا أَرَاكَ اللّهُ وَلاَ تَكُن لِّلْخَآئِنِينَ خَصِيمًا.

‘নিশ্চয় আমি আপনার প্রতি সত্য কিতাব অবতীর্ণ করেছি, যাতে আপনি মানুষের মধ্যে ফায়সালা করেন, যা আল্লাহ আপনাকে হৃদয়ঙ্গম করান’।

অন্যত্র এরশাদ হয়েছেঃ

فَلاَ وَرَبِّكَ لاَ يُؤْمِنُونَ حَتَّىَ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لاَ يَجِدُواْ فِي أَنفُسِهِمْ حَرَجًا مِّمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُواْ تَسْلِيمًا. (النساء: ৬৫)

‘অতএব আপনার পালনকর্তার কসম, সে লোক ঈমানদার হবেনা, যতক্ষণ তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে আপনাকে ন্যায়বিচারক বলে মনে না করে। অতঃপর আপনার মীমাংসার ব্যাপারে নিজের মনে কোন রকম সংকীর্ণতা পাবেনা এবং তা হৃষ্টচিত্তে কবুল করে নেবে’।

এমনিভাবে আল্লাহ তাআ’লা তাঁকে পাঠিয়েছেন হালাল-হারাম নির্ণয়কারী হিসাবে। এরশাদ হয়েছেঃ

يَأْمُرُهُم بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَاهُمْ عَنِ الْمُنكَرِ وَيُحِلُّ لَهُمُ الطَّيِّبَاتِ وَيُحَرِّمُ عَلَيْهِمُ الْخَبَآئِثَ.

‘তিনি তাদেরকে নির্দেশ দেন সৎকর্মের, বারণ করেন অসৎকর্ম থেকে, তাদের জন্য যাবতীয় পবিত্রবস্তু হালাল ঘোষণা করেন ও নিষিদ্ধ করেন হারাম বস্তুসমূহ’।

এমনিভাবে তাঁকে তাবলীগে রিসালাতের দায়িত্ব দিয়েও প্রেরণ করা হয়েছে। এরশাদ হয়েছেঃ

يأَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنزِلَ إِلَيْكَ مِن رَّبِّكَ وَإِن لَّمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ. (المائدة ،৬৭.)

‘হে রাসূল, পৌঁছে দিন আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে। যদি আপনি এরূপ না করেন, তবে আপনি তাঁর পয়গাম পৌঁছালেন না’।

এমনিভাবে আল্লাহর মুরাদ বর্ণনাকারী হিসাবেও প্রেরণ করা হয়েছে তাকে। এরশাদ হয়েছেঃ

وَأَنزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ وَلَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ . (النحل، ৪৪.)

‘এই কুরআন আপনার প্রতি নাযিল করেছি, যাতে মানুষের প্রতি অবতীর্ণ বিষয়গুলিকে আপনি স্পষ্ট করে বর্ণনা করে দেন’।

এছাড়া এরূপ আরো অনেক গুণ-মর্যাদা এবং দায়িত্ব ও কার্যভার সহ তিনি প্রেরিত হয়েছেন। বস্তুতঃ রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সমূহ দায়িত্ব আদায় করতঃ এবং তাঁর আল্লাহ প্রদত্ত সমূহ গুণের ব্যবহার করতঃ নবী-রাসূল, দাঈ ও মুবাল্লিগ, মুঅ’াল্লিম ও মুরুববী, ন্যায়নিষ্ঠ শাসক ও বিচারক, আমির বিলমা’রুফ ও নাহি আনিল্ মুনকার, আত্মশুদ্ধিকারক ও আধ্যাতিœক গুরু, কুরআনের ব্যাখ্যাকার ও আল্লাহর মুরাদ বর্ণনাকারী এবং পরস্পরের বিবাদ মীমাংসাকারী ও হালাল-হারাম নির্ণয়কারী হিসাবে যা বলেছেন, যা করেছেন এবং যা অনুমোদন ও সমর্থন করেছেন সেই সব কথা, কাজ, সমর্থন ও অনুমোদনকেই বলা হয় ‘হাদীছ’। তাঁর কাউলী, ফে’লী ও তাকরীরি তিন প্রকারের হাদীছই মুলতঃ শরীয়তের দ্বিতীয় মহান দলীল এবং কুরআনের পরপর তার স্থান।

হাদীছের সংজ্ঞা ও পরিচয়ঃ

হাদীছ আরবী শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ ‘নতুন’, ‘কথা’ ও ‘খবর’। এটি ‘ক্বাদীম’ (পুরাতন)-এর বিপরীত অর্থবোধক শব্দ। আল্লাহ তাঅ’ালা কুরআন মজীদের অনেক স্থানে কুরআনকে ‘হাদীছ’ বলেছেন। রাসুল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহর কিতাবই হ’ল, উত্তম হাদীছ।

মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় ‘হাদীছ’ বলতে বুঝায়, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যাবতীয় কথা, কাজ, অনুমোদন, সমর্থন এবং তাঁর অবস্থার বিবরণকে। আল্লামা জা’ফর আহমদ উসমানী (রহঃ) বলেনঃ ‘যা কিছু রাসুল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামে বর্ণিত আছে, তার সমুদয়কে হাদীছ বলা হয়’।

ডক্টর মাহমুদ তাহ্হান বলেনঃ ‘রাসূলের নামে কথিত কথা, কাজ অনুমোদন ও গুণ-বৈশিষ্ট্যকে হাদীছ বলা হয়’।

আল্লামা তীবি, হাফেজ ইবনু হাজর আসক্বালানী, নবাব সিদ্দীক হাসান খান ও ইমাম সাখাবী প্রমুখ বলেনঃ ‘হাদীছের অর্থ ব্যাপক। রাসূলুল্লাহর কথা, কাজ ও অনুমোদনকে যেমন হাদীছ বলা হয়, তেমনি ছাহাবী, তাবী ও তবে তাবেঈদের কথা কাজ ও অনুমোদনকেও হাদীছ বলা হয়’।

উল্লেখ্য যে, উপরোক্ত বিবরণে নবী কারীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, ছাহাবায়েকেরাম, তাবেঈ ও তবে তাবেঈদের কথা, কাজ ও সমর্থন যদিও মোটামুটি ভাবে হাদীছ নামে অভিহিত, তথাপি শরীয়তী মর্যাদার দৃষ্টিতে এসবের মধ্যে অবশ্যই পার্থক্য আছে। তাই হাদীছ শাস্ত্রে প্রত্যেকটির জন্য স্বতন্ত্র পরিভাষা নির্ধারণ করা হয়েছে। যথাঃ নবী কারীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা, কাজ ও সমর্থনকে বলা হয় ‘হাদীছ’। ছাহাবীদের কথা, কাজ ও সমর্থনকে বলা হয় ‘আছার’ এবং তাবেঈ ও তবে তাবেঈগণের কথা, কাজ ও সমর্থনকে বলা হয় ‘ফাতাওয়া’।

এছাড়া তিন প্রকারের হাদীছের আরো তিনটি পারিভাষিক নাম রয়েছে। যথাঃ নবী কারীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কথা, কাজ ও সমর্থন সংক্রান্ত বিবরণকে বলা হয় ‘মারফু’। ছাহাবীদের কথা, কাজ ও সমর্থনের বিবরণকে বলা হয় ‘মাওকুফ’ এবং তাবেঈগণের কথা, কাজ ও সমর্থনের বিবরণকে বলা হয় ‘মাকতু’।

হাদীছের অপর নাম ‘সুন্নাহ’। ‘সুন্নাহ’ শব্দের অর্থ, চলার পথ, পদ্ধতি ও কর্মনীতি। ইমাম রাগিব ইস্পাহানী বলেনঃ ‘সুন্নাতুন্নবী বলতে সে পথ ও রীতি পদ্ধতিকে বুঝায়, যা নবী কারীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাছাই করে নিতেন এবং অবলম্বন করতেন’। মুহাদ্দিসগণ ‘হাদীছ’ ও ‘সূন্নাহ’ কে একই অর্থে ব্যবহার করেছেন।

শায়খ ডক্টর মোস্তফা সাবায়ী বলেনঃ ‘আরবী অভিধানে ‘সুন্নাহ’ অর্থ কর্মপন্থা, কর্মপদ্ধতি-তা ভাল বা মন্দ যা হোক। মুসলিম শরীফের হাদীছ দ্বারাও তা বুঝা যায়। পক্ষান্তরে পরিভাষায় ‘সুন্নাহ’-এর একাধিক ব্যাখ্যা রয়েছে। যেমনঃ

(১) হাদীছ শাস্ত্রবিদগণের পরিভাষায় রাসূল কারীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কথা, কর্ম ও সম্মতি এবং তাঁর শারিরীক বৈশিষ্ট্য, স্বভাব ও চাল চরিত্রকে ‘সুন্নাহ’ বলা হয়। তা নুবুওয়াত লাভের আগের হোক বা পরের।

(২) উসূল শাস্ত্রবিদগণের মতে ‘সুন্নাহ’ বলা হয়, প্রত্যেক কথা, কর্ম ও সম্মতিকে, যা রাসূল কারীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে সম্পৃক্ত এবং যার থেকে শরীয়তের কোন না কোন হুকুম প্রমাণিত হয়।

(৩) ফিকাহ শাস্ত্রবিদগণের মতে ‘সুন্নাহ’ হল, ফরজ-ওয়াজিব ব্যতীত শরীয়তের অন্যান্য হুকুম আহকাম।

(৪) মুহাদ্দিসগণের মতে এবং অনেক সময় ফিকাহ্ শাস্ত্রবিদগণের মতেও ‘সুন্নাহ বলা হয়, সেই সব কমর্কে যা শরীয়তের কোন দলীল কিংবা উসূলে শরীয়তের কোন আসল তথা মৌল নীতি দ্বারা দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত বলে প্রমাণিত।’

এছাড়া আরো দু’টি শব্দ কখনো হাদীছ অর্থে ব্যবহৃত হয়, তা হ’ল ‘খবর’ ও ‘আছার’। কিন্তু বেশী প্রসিদ্ধ শব্দ হ’ল ‘হাদীছ’ ও ‘সুন্নাহ’।

মিশকাত শরীফের ব্যাখ্যাকার প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা আবুল হাছান (রহঃ) বলেনঃ ‘জানা আবশ্যক যে, রাসূল কারীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কর্ম মোটামুটি দু’প্রকার। প্রথম, যেগুলিতে অনুসরণ জায়েয। দ্বিতীয়, যেগুলিতে অনুসরণ জায়েয নয়। অনুসরণীয় কাজগুলি হ’ল, মুস্তাহাব, সুন্নাত, ওয়াজিব ও ফরয। অনুসরণ জায়েয নয়- এমন কাজ হর, যথাঃ এক সাথে নয় বিবি রাখা, দিন রাত লাগাতার সিয়াম পালন করা ইত্যাদি। মোট কথা, অনুসরণীয় এবং অনুসরণীয় নয়, এউভয় প্রকারের কর্মকান্ডের উপর হাদীছ শব্দটি প্রযোজ্য হয়। কিন্তু সুন্নাত শব্দটি তেমন নয়। বরং সুন্নাত বলা হয়, তাঁর কেবল অনুসরণীয় কর্মকান্ডকে। একারণে বলা যায় প্রত্যেক সুন্নাত তো হাদীছ, কিন্তু প্রত্যেক হাদীছ সুন্নাত নয়। যেমন লজিকের ভাষায় বলা হয়, প্রত্যেক মানুষ তো প্রাণী, কিন্তু প্রত্যেক প্রাণী মানুষ নয়।’

হাদীছের প্রকারভেদ ঃ

হাদীছ প্রথমতঃ তিন প্রকার। কাউলী, ফে’লী ও তাকরীরি। রাসূল কারীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কথা জাতিয় হাদীছগুলিকে কাউলী বলে। তাঁর কাজ সম্পর্কীয় হাদীছগুলিকে ফে’লী বলে। আর তাঁর সমর্থন ও অনুমোদন সম্পর্কীয় হাদীগুলিকে তাকরীরি বলে। এছাড়া হাদীছ বর্ণনাকারীদের নিজস্ব গুণ-বৈশিষ্ট্যের প্রেক্ষিতে হাদীছকে বিভিন্ন শ্রেনীতে বিভক্ত করা হয়। যথাঃ সহীহ, হাসান, সহীহ লিযাতিহী, সহীহ লিগাইরিহী, হাসান লিযাতিহী, হাসান লিগাইরিহী, যঈফ, মুনকার, মাওযু ইত্যাদি। আবার হাদীছ বর্ণনাকারীদের সংখ্যা হিসাবে হাদীছের কয়েকটি শ্রেণী হয়। যথাঃ মুতাওয়াতির, মাশহুর, আযীয ও গরীব ইত্যাদি। অনুরূপ হাদীছের সনদ পরম্পরা হিসাবে হাদীছ কয়েক প্রকার হয়ে থাকে। যথাঃ মারফু, মাওকুফ ও মাকতু ইত্যাদি। এছাড়া হাদীছের আর একটি প্রকার আছে তাকে বলা হয় হাদীছে কুদসী। ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) বলেনঃ ‘ওলামাদের সর্ব সম্মতিক্রমে ‘সূন্নাহ’ তিন প্রকারঃ ১-যাতে, কুরআন যা বলেছে হুবহু তাই বর্ণিত হয়েছে। ২-যাতে, কুরআনে যা আছে তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ রয়েছে। ৩-যাতে, কুরআন যে বিষয়ে নীরব সে বিষয়ে নতুন কথা বলা হয়েছে। ‘সূন্নাহ’ যে প্রকারেরই হোক না কেন, আল্লাহ তাঅ’ালা সুস্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন যে, তাতে আমাদেরকে তাঁর আনুগত্য করতে হবে। তাঁর ‘সূন্নাহ’ জানার পরে তার বরখেলাফ করার অধিকার আল্লাহ তাআ’লা কাউকে দেন নি’।

ইসলামী শরীয়তে হাদীছে রাসূলের মর্যাদা

হাদীছ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত পরিচয় লাভের পর এবার আসুন, দ্বীনে ইসলামে হাদীছে রাসূলের মার্যাদা সম্পর্কে একটু অবগত হই। এব্যাপারে সর্বপ্রথম আমাদের দেখতে হবে কুরআন কি বলে?

কুরআনের দৃষ্টিতে হাদীছঃ

কুরআন অধ্যয়ন করলে আমরা বুঝতে পারি যে, অন্ততঃ শতাধিক আয়াত একথা প্রমাণ করে যে, হাদীছে রাসূলও কুরআন মজীদের ন্যায় শরীয়তের মহান উৎস। কুরআনের পর পর তার স্থান। হাদীছও কুরআনের মত অহী। কুরআন বুঝার জন্য হাদীছের নিতান্ত প্রয়োজন। হাদীছকে অস্বীকার করলে কুরআনের অস্বীকার হবে এবং সে ব্যক্তি ধর্মচ্যুত ও ইসলাম বহির্ভূত হবে। হাদীছ বাদ দিয়ে কুরআন মানার কোন অবকাশ নেই। এবার উদাহরণ স্বরুপ কয়েকটি আয়াত আপনাদের সামনে তুলে ধরছিঃ-

১ – আল্লাহ তাঅ’ালা এরশাদ করেনঃ

وَالنَّجْمِ إِذَا هَوَى. مَا ضَلَّ صَاحِبُكُمْ وَمَا غَوَى. وَمَا يَنطِقُ عَنِ الْهَوَى . إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَى. (النجم:১، ২،৩،৪.)

‘নক্ষত্রের শপথ, যখন তা অস্তমিত হয়। তোমাদের সঙ্গী পথভ্রষ্ট হননি এবং বিপথগামীও হননি। তিনি এবং প্রবৃত্তির তাড়নায় কথা বলেন না। তা তো প্রত্যাদেশিত ‘অহি’।

এই আয়াতে বলা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের পক্ষ থেকে কথা তৈরী করে আল্লাহ তাআ’লার দিকে সম্বন্ধযুক্ত করেন না। এর কোন সম্ভাবনাই নেই। বরং তিনি যা কিছু বলেন, তা সবই আল্লাহর কাছ থেকে প্রত্যাদেশ হয়। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে বিভিন্ন উপায়ে যে অহী নাযিল হত, তা সাধারণতঃ দুই প্রকারঃ প্রথম ‘অহিয়ে মাত্লু’ অর্থাৎ যার অর্থ ও ভাষা উভয়ই আল্লাহর কাছ থেকে নাযিল হয়। এর নাম আল-কুরআন। দ্বিতীয় ‘অহিয়ে গায়রে মাত্লু’ অর্থাৎ যার কেবল অর্থ আল্লাহর তরফ থেকে নাযিল হয়। সেই অর্থ রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের ভাষায় ব্যক্ত করেন, এর নাম ‘হাদীছ ও সুন্নাহ’।

এরপর হাদীছে আল্লাহর পক্ষ থেকে যে বিষয়বস্তু বিধৃত হয়, কখনো তা কোন ব্যাপারে সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ফায়সালা তথা বিধান হয়ে থাকে এবং কখনো কেবল সামগ্রিক নীতি বর্ণনা করা হয়। এই নীতির মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইজতিহাদ করে বিধানাবলী বের করেন। এই ইজতিহাদে ভুল হওয়ার ও সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু রাসুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তথা পয়গাম্বর কুলের বৈশিষ্ট্য এইযে তাঁদের ইজতিহাদে ভুল খুব কমই হয়ে থাকে, আর কখনো ভুল হয়ে গেলে আল্লাহপাক তাঁদেরকে ভুলের উপর স্থির ও প্রতিষ্ঠিত রাখেন না। বরং সাথে সাথে অহীর মাধ্যমে শুধরিয়ে দেন। কিন্ত অন্যান্য মুজাতাহিদ আলেম ইজতিহাদে ভুল করলে, তারা তার উপর ক্বায়েম থাকতে পারেন। এজন্যই যখনই কোন মুজতাহিদ ইমামের ইজতিহাদের বিপরীত কোন সহীহ হাদীছ পাওয়া যায়, তখন হাদীছ বাদ দিয়ে ইজতিহাদ মতে আমল করার কোন অবকাশ থাকেনা। এ কারণেই সকল মুজতাহিদ ইমাম সুস্পষ্ট ভাষায় একথা স্বীকার করেছেন যে, সহীহ হাদীছই আমাদের মাযহাব। আর যখনই আমাদের কথার বিপরীত কোন হাদীছ পাবে, তখন আমাদের কথা বাদ দিয়ে হাদীছ অনুসারে আমল করবে। তবে ইমামগণের এই ভুল আল্লাহর কাছে কেবল ক্ষমার যোগ্যই নয়, বরং ধর্মীয় বিধান হৃদয়ঙ্গঁম করার ক্ষেত্রে তাঁরা যে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন, তজ্জন্য কিঞ্চিৎ ছাওয়াবেরও অধিকারী হবেন।

২ – আল্লাহ তাঅ’ালা এরশাদ করেনঃ

وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانتَهُوا وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ. (الحشر:৭.)

‘রাসূল তোমাদেরকে যা দেন তা গ্রহন কর এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাক এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা’।

এই আয়াতটি ফাই-এর মাল বন্টন সম্পর্কে অবতীর্ণ হলেও আয়াতের ভাষা ধন-সম্পদের সাথেই বিশেষভাবে সম্পর্কযুক্ত নয়, বরং শরীয়তের বিধি-বিধানও এতে দাখিল আছে। তাই ব্যাপক ভঙ্গিতে আয়াতের অর্থ হবে এই যে, যে কোন নির্দেশ অথবা ধন-সম্পদ অথবা অন্য কোন বস্তু তিনি কাউকে দেন, তা তার গ্রহন করা উচিত এবং তদনুযায়ী কাজ করতে সম্মত হওয়া উচিত। পক্ষান্তরে তিনি যে বিষয় নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাকা দরকার। অনেক ছাহাবায়ে কেরাম আয়াতের এই ব্যাপক অর্থ অবলম্বন করে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রত্যেক নির্দেশকে কুরআনের নির্দেশের স্বরূপ অবশ্য পালনীয় সাব্যস্ত করেছেন।

আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেনঃ ‘আল্লাহ তাঅ’ালা লা’নত করেছেন ঐসব নারীর উপর, যারা অন্যের শরীরে নাম বা চিত্র অংকন করে এবং যারা নিজ শরীর অন্যের দ্বারা অংকন করায়, যারা ললাট বা কপালের উপরস্থ চুল উপড়িয়ে কপাল প্রশস্ত করে এবং সৌন্দর্য্যরে জন্য রেত ইত্যাদির সাহায্যে দাঁত সরু ও দু’দাতের মাঝে ফাঁক সৃষ্টি করে। এসব নারী আল্লাহর সৃষ্টির আকৃতি বিকৃত করে ফেলে। বনী আসাদ গোত্রের উম্মে ইয়াকুব নামীয় এক মহিলা এই বর্ণনা শুনে ইবনু মাসঊদ (রাঃ) এর নিকট আসল এবং বলল, আমি জানতে পেরেছি যে, আপনি এ ব্যাপারে লা’নত করেছেন। তিনি বললেনঃ আল্লাহর রাসূল যার উপর লা’নত করেছেন, আল্লাহর কিতাবে যার প্রতি লা’নত করা হয়েছে, তার উপর আমি লা’নত করবনা কেন? তখন মহিলাটি বলল, আমি তো কুরআন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়েছি, তাতে তো আপনি যা বলেছেন তা পেলাম না। আব্দুল্লাহ (রাঃ) বললেনঃ যদি তুমি পড়তে তবে অবশ্যই পেতে। তুমি কি পড়নিঃ ‘রাসূল তোমাদেরকে যা নির্দেশ দেন তা গ্রহন কর আর যা থেকে বারণ করেন তা থেকে বিরত থাক। এবং আল্লাহকে ভয় করে চলো’। মহিলাটি বললঃ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বললেনঃ রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা থেকে নিষেধ করেছেন’।

ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) একবার মক্কা শরীফে ঘোষণা করলেনঃ আমি তোমাদের প্রত্যেক প্রশ্নের জবাব কুরআন থেকে দিতে পারি। জিজ্ঞেস কর, যা জিজ্ঞেস করতে চাও। এক ব্যক্তি বললঃ এক ব্যক্তি এহরাম অবস্থায় প্রজাপতি মেরে ফেলল, এর বিধান কি? ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) উক্ত আয়াতটি তেলাওয়াত করে হাদীছ থেকে এর বিধান বর্ণনা করে দিলেন।

৩ – আল্লাহ তাঅ’ালা এরশাদ করেনঃ

يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ أَطِيعُواْ اللّهَ وَأَطِيعُواْ الرَّسُولَ وَأُوْلِي الأَمْرِ مِنكُمْ فَإِن تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللّهِ وَالرَّسُولِ إِن كُنتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلاً. (النساء: ৫৯)

‘হে ম’ুমিনগণ! আল্লাহর নির্দেশ মান্য কর, রসূলের নির্দেশ মান্য কর এবং তোমাদের মধ্যে যারা বিচারক তাদের নির্দেশ মান্য কর। তারপর যদি তোমরা কোন বিষয়ে বিবাদে প্রবৃত্ত হয়ে পড়, তা হলে তা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি প্রত্যার্পন কর। যদি তোমরা আল্লাহ ও ক্বেয়ামত দিবসের উপর বিশ্বাসী হয়ে থাকো। আর এটাই কল্যাণকর এবং পরিণতির দিক দিয়ে উত্তম’।

উক্ত আয়াতে ‘উলুল আম্র’ এর অর্থ কেউ বলেছেন শাসকবর্গ আর কেউ বলেছেন উলামা ও ফিকাহবিদগণ। উভয় অর্থ আয়াতে হতে পারে। উদ্দেশ্য হ’ল, আসল ‘এতাঅ’াত’ তো আল্লাহরই। কারণ সৃষ্টি যেহেতু তাঁর, ‘হুকুম’ও তাঁরই হবে। কিন্তু রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেহেতু আল্লাহর বিশ্বস্ত প্রতিনিধী এবং নির্ভেজালভাবে আল্লাহর উদ্দেশ্য ও মুরাদ বর্ণনাকারী, সেহেতু আল্লাহ তাঅ’ালা নিজের সাথে রাসূলের হুকুমকেও স্বতন্ত্র মর্যাদা দান করেছেন। এর দ্বারা বুঝা গেল যে, কুরআনের মত হাদীছে রাসূলও দ্বীনে ইসলামের একটি উৎস। আল্লামা ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেনঃ আল্লাহর এতাঅ’াতের অর্থ হ’ল কিতাবুল্লাহ (কুরআন)-কে মান্য করা। আর রাসূলুল্লাহর এতাঅ’াতের অর্থ হল হাদীছে রাসূলের অনুসরণ। আর উলূল আমর তথা শাসকবর্গ ও ওলামা-ফুকাহার এতাঅ’াতের অর্থ হল, তারা যদি আল্লাহ ও রাসূলের এতাঅ’াতের মাধ্যমে কোন আদেশ নিষেধ করে তাও মানতে হবে, আর যদি আল্লাহ ও রাসূলের বিপরীত কোন আদেশ-নিষেধ করে, তা কখনো মান্য করতে হবে না। এর দ্বারা বুঝা গেল যে, উলুল আমরের এত্বাঅ’াতের স্বতন্ত্র কোন মর্যাদা নেই। বরং তা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের হুকুমের অধীন। এই কারণেই ‘আতীউল্লাহ’ এর পর ‘আতীউর রাসূল’ তো বলা হয়েছে কিন্তু ‘আতিউ উলিল আমর’ বলা হয়নি। তদ্রুপ সাধারণ লোকজন ও উলুল আমরের মধ্যে বিরোধকালে উলুল আমরের হুকুমকে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত হিসাবে গ্রহন করা হয়নি, বরং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের হুকুমের প্রতি অর্থাৎ কুরআন ও সুন্নাহর দিকে ফিরে যাওয়ার আদেশ দেয়া হয়েছে। এই আয়াত দ্বারা আরো বুঝা গেল যে, উম্মতের যে কোন মতবিরোধপূর্ণ বিষয়ে একমাত্র কুরআন ও সুন্নাহ থেকেই ফায়সালা গ্রহন করতে হবে। অন্যথায় প্রকৃত ঈমানদার হওয়া যাবেনা।

৪ – আল্লাহ তাঅ’ালা এরশাদ করেনঃ

كَمَا أَرْسَلْنَا فِيكُمْ رَسُولاً مِّنكُمْ يَتْلُو عَلَيْكُمْ آيَاتِنَا وَيُزَكِّيكُمْ وَيُعَلِّمُكُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَيُعَلِّمُكُم مَّا لَمْ تَكُونُواْ تَعْلَمُونَ . (البقرة: ১৫১.)

‘যেমন, আমি পাঠিয়েছি তোমাদেরই মধ্য থেকে তোমাদের জন্য একজন রাসূল, যিনি তোমাদের নিকট আমার বাণী সমূহ পাঠ করবেন এবং তোমাদের পবিত্র করবেন, আর তোমাদের শিক্ষা দেবেন কিতাব ও হেকমত এবং শিক্ষা দেবেন এমন বিষয় যা কখনো তোমরা জানতে না’।

এই আয়াতে আল্লাহ তাআ’লা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর চারটি দায়িত্বের কথা বলেছে। প্রথম, তেলাওয়াতে কুরআন, দ্বিতীয়, তাযকিয়া, তৃতীয়, তালীমে কিতাব, চতুর্থ, তা’লীমে হেকমত। এখানে ‘হেকমত’ অর্থ হল, সূন্নাত বা হাদীছ।

ইমাম শাফেয়ী, হাফেজ ইবনু কাছীর, আল্লামা বয়যাবী, ইমাম ত্ববরী, রবী’, যমখশরী, ইমাম রাযী, কাতাদা ও আরো অনেকে হেকমতের অর্থ বলেছেন ‘সূন্নাহ’।

এই আয়াত দ্বারা স্পষ্ট বুঝা যায় যে, হাদীছে রাসূলও শরীয়তের দলীল এবং ইসলামে তার গুরুত্ব অপরিসীম।

৫- আল্লাহ তাঅ’ালা এরশাদ করেনঃ

وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَن يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ وَمَن يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا مُّبِينًا. (الأحزاب: ৩৬.)

‘আল্লাহ ও তাঁর রাসুল কোন কাজের আদেশ করলে কোন ঈমানদার পুরুষ ও নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন কোন ক্ষমতা নেই, যে আল্লাহ ও তার রাসুলের আদেশ অমান্য করে সে প্রকাশ্য পথভ্রষ্টতায় পতিত হয়’।

এই আয়াতে বলা হ’ল যে, যদি রাসুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কারো প্রতি বাধ্যতামুলকভাবে কোন কাজের নির্দেশ দান করেন, তাহ’লে তার পক্ষে সে কাজ করা ওয়াজিব হয়। শরীয়তানুযায়ী তা না করার অধিকার থাকে না। যে লোক এ কাজ পালন করবেনা, আয়াতের শেষে তাকে স্পষ্ট গোমরাহ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

হাফেজ ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেনঃ আয়াতটি সকল ব্যাপারে স্বতন্ত্র। অর্থাৎ যদি কোন ব্যাপারে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন আদেশ দেন, তখন তার বিরোধিতা করার কারো কোন অধিকার থাকবেনা এবং সে ব্যাপারে কারো কোন রায় ও অভিমতও গ্রহন করা হবে না। সুতরাং বুঝা গেল যে, এই আয়াতটিও ‘হাদীছ’ শরীয়তের দলীল হওয়ার আর একটি প্রমাণ।

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button