সাময়িক প্রসঙ্গ

ঈদ-উল-আযহা ২০২৩

২০২৩ সালের ঈদ-উল-আযহা কত তারিখে এবং পবিত্র এই ইসলামিক উৎসব সম্পর্কে আপনার যা জানা দরকার

ঈদ-উল-আযহা ২০২৩ কত তারিখে

২০২৩ সালের ঈদ-উল-আযহা অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাব্য তারিখ: বৃহস্পতিবার, ২৯ জুন, ২০২৩-এর সন্ধ্যা হতে শুক্রবার, ৩০ জুন, ২০৩০-এর সন্ধ্যা প‍র্যন্ত। তবে, চাঁদ দেখার উপর ভিত্তি করে দিন-তারিখের সামান্য তারতম্য হতে পারে।

কুরবানী

আল্লাহর নৈকট্য, আত্মত্যাগ, আত্মোৎসর্গ, ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্য, সাম্য, মৈত্রী, সম্প্রীতির সুমহান মহিমায় ভাস্বর কুরবানী। কুরবানী আমাদের আদি পিতা আদম (আঃ) ও তদীয় পুত্র হাবিল-কাবীল এবং মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহীম (আঃ) ও তদীয় পুত্র ইসমাঈল (আঃ)-এর সুমহান আত্মত্যাগ এবং আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা-ভরসা ও জীবনের সর্বস্ব সমর্পণের মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য লাভের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সমন্বয়।

ঈদ-উল-আযহার ইতিহাস

আদি পিতা আদম (আঃ)-এর দুই পুত্র কাবীল ও হাবীলের দেওয়া কুরবানী থেকেই কুরবানীর ইতিহাসের গোড়াপত্তন হয়েছে। তারপর থেকে বিগত সকল উম্মতের উপর এটা জারী ছিল। আমাদের উপর যে কুরবানীর নিয়ম নির্ধারিত হয়েছে, তা মূলতঃ ইবরাহীম (আঃ) কর্তৃক শিশু পুত্র ইসমাঈল (আঃ)-কে আল্লাহর রাহে কুরবানী দেওয়ার অনুসরণে ‘সুন্নাতে ইবরাহীমী’ হিসাবে চালু হয়েছে। মক্কা নগরীর জনমানবহীন ‘মিনা’ প্রান্তরে আল্লাহর দুই আত্মনিবেদিত বান্দা ইবরাহীম ও ইসমাঈল আল্লাহর কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মাধ্যমে তুলনাহীন ত্যাগের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, বর্ষপরম্পরায় তারই স্মৃতিচারণ হচ্ছে ‘ঈদুল আযহা’ বা কুরবানীর ঈদ। আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণের প্রকৃষ্ট নমুনা এই কুরবানীতে প্রতীয়মান।

ঈদ-উল-আযহার গুরুত্ব

ঈদুল আযহার গুরুত্ব অপরিসীম। কুরআন-হাদীছে এ ব্যাপারে যথেষ্ট তাকীদ দেওয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর কুরবানীর পশু সমূহকে আমরা তোমাদের জন্য আল্লাহর নিদর্শন সমূহের অন্তর্ভুক্ত করেছি। এর মধ্যে তোমাদের জন্য কল্যাণ রয়েছে’ (হজ্জ ৩৬)। আল্লাহ আরও বলেন, ‘আর আমরা তাঁর (ইসমাঈলের) পরিবর্তে যবহ করার জন্য দিলাম একটি মহান কুরবানী। আমরা এটিকে পরবর্তীদের মধ্যে রেখে দিলাম’ (ছাফফাত ১০৭-১০৮)। আল্লাহ বলেন,  ‘তুমি তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে ছালাত আদায় কর এবং কুরবানী কর’ (কাওছার ২)। কাফির-মুশরিকরা তাদের দেব-দেবী ও বিভিন্ন কবর ও বেদীতে পূজা দেয় এবং মূর্তির উদ্দেশ্যে কুরবানী করে থাকে। তার প্রতিবাদ স্বরূপ মুসলমানকে আল্লাহর জন্য ছালাত আদায়ের ও তাঁর উদ্দেশ্যে কুরবানী করার হুকুম দেওয়া হয়েছে।

আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) বলেছেন, ‘সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কুরবানী করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটবর্তী না হয়’। এটি ইসলামের একটি ‘মহান নিদর্শন’ যা ‘সুন্নাতে ইবরাহীম’ হিসাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজে মদীনায় প্রতি বছর আদায় করেছেন এবং ছাহাবীগণও নিয়মিতভাবে কুরবানী করেছেন। অতঃপর অবিরত ধারায় মুসলিম উম্মাহ্র সামর্থ্যবানদের মধ্যে এটি চালু আছে। এটি কিতাব ও সুন্নাহ এবং ইজমায়ে উম্মত দ্বারা সুপ্রমাণিত।

ঈদ-উল-আযহার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি

মুসলিম জাতি যেহেতু শেষ নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর উম্মাত, সেহেতু তাঁর সুন্নাত বা ঐতিহ্য সংস্কৃতি ছাড়া অন্য কোন নবীর ঐতিহ্য-সংস্কৃতি লালন-পালন করে না, একমাত্র ইবরাহীম (আঃ)-এর ঐতিহ্য-সংস্কৃতি ব্যতীত। কেননা তিনি মুসলিম জাতির জনক। তাই ইবরাহীম (আঃ) স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে প্রাণপ্রিয় পুত্রকে কুরবানী করার অবিস্মরণীয় আত্মত্যাগ ও আত্মোৎসর্গের প্রয়াসকে আমরা চির অম্লান করে রাখার লক্ষ্যে প্রতি বছর ১০ই যিলহজ্জ তারিখে কুরবানী করে থাকি। কেননা এ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে জাগরুক রাখতে আল্লাহ তা‘আলা নিম্নোক্ত আয়াতে নির্দেশ দিয়েছেন- فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ ‘আপনি আপনার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে ছালাত আদায় করুন এবং কুরবানী করুন’ (কাওছার ২)

আমাদের সাহিত্য অঙ্গনে এমন আত্মত্যাগ বিজড়িত ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায় বেশ কয়েক শতাব্দী পূর্ব থেকেই। কুরবানীর মহান আদর্শে আমাদের সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে। ইবরাহীম (আঃ) ও ইসমাঈল (আঃ)-এর সুমহান আত্মত্যাগ অনন্য আদর্শরূপে মহিমা অর্জন করছে। কবি আলাওল, ইসমাঈল হোসেন সিরাজী, গোলাম মোস্তফা, শাহাদত হোসেন, ফররুখ আহমেদ, কাযী নযরুল ইসলাম প্রমুখ সাহিত্যরথীকে ত্যাগ-তিতিক্ষা তথা মহামানবতার আদর্শ উচ্চারণে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করেছে। কিন্তু এ ভূ-খন্ডের সাহিত্য ক্ষেত্রে কুরবানীর মহোত্তম প্রভাব যার রচনায় সত্যিকার অর্থে প্রত্যক্ষভাবে একান্ত নিষ্ঠায় উচ্চারিত হয়েছে, তিনি আমাদের জাতীয় কবি কাযী নযরুল ইসলাম। কুরবানীর কাহিনী তার মনে এক অভাবনীয় চেতনা ও আদর্শবাদিতার সৃজন ঘটিয়েছে। এই চেতনা ও বোধ-বোধির অন্তরাল থেকেই তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘কুরবানীর’ সৃষ্টি। কুরবানী আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে যে অনন্ত, নির্বিবোধ শক্তির উদ্বোধন, তারই জয়গীতি। সত্যের পথে, ন্যায়ের পথে আত্মবিসর্জনের যে পরম শান্তি, তা লাভের জন্য প্রেরণাদান করেছেন, উদ্বুদ্ধ করেছেন কবি। এ শান্তি মানুষকে এক অনির্বচনীয় আনন্দলোকে উত্তরণ ঘটায়। এ স্বপ্ন পরিসরে কবি কাযী নযরুল ইসলামের কবিতার গুটিকয়েক চরণ উদ্বৃতির মাধ্যমে কুরবানী সম্পর্কে তাঁর ধ্যান-ধারণা, পরিচয়-পরিচিতি ও মুসলিম ঐতিহ্য-সংস্কৃতির স্বরূপ অবলোকন করা যায়। কবির ভাষায়-

ওরে হত্যা নয় আজ সত্যাগ্রহ শক্তির উদ্বোধন
ওরে শক্তি-হস্তে মুক্তি, শক্তি রক্তে সুপ্ত শোন।
এই ইবরাহীম আজ কুরবানী কর শ্রেষ্ঠ পুত্র ধন!
খুন এ যে, এতে গোর্দা ঢের রে, ত্যাগে বুদ্ধ মন।
এতে মা রাখে পুত্র পণ!
তাই জননী হাজেরা বেটারে পরালো বলির পূত বসন।
ওরে মুক্তি স্বাধীনতা দেবে এই সে খুন-মোচন!
আজ আল্লাহর নামে জান কুরবানে ঈদের পূত বোধন।
ওরে হত্যা নয় আজ সত্যাগ্রহ শক্তির উদ্বোধন

ঈদ-উল-আযহা উদযাপন

মুসলিম বিশ্বের প্রতিটি দেশ ও জনপদে কুরবানীর ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বিশেষ গুরুত্ব ও মর্যাদার সাথে উদযাপন করা হয়। কুরবানীর দিনগুলোতে সরকারী ছুটি ঘোষিত হয়, দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক ও ত্রৈমাসিক প্রায় প্রতিটি সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিনে কুরবানী ঈদের বিশেষ ক্রোড়পত্র ছাপানো হয়। কোন কোন সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিন কর্তৃপক্ষ বহু পৃষ্ঠাব্যাপী কুরবানীর ঈদ সংখ্যা ছাপেন। ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়ায় বিশেষ অনুষ্ঠান মালা পরিবেশিত হয়। ব্যবসা-বাণিজ্য, লেখা-পড়া ও চাকুরীর জন্য বাড়ী থেকে দূর-দূরান্তে চলে যাওয়া মানুষগুলো পরিবার-পরিজনের সাথে কুরবানীতে অংশগ্রহণের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হ’লেও বাড়ীতে চলে আসেন। শহরে-বন্দরে, গ্রামে-গঞ্জে সর্বত্রই সাজ-সাজ রব পরিলক্ষিত হয়। ধনী-দরিদ্র, ইতর-ভদ্র, রাজা-প্রজা সকল ভেদাভেদ ভুলে সকলেই খোলা আকাশের নীচে এক কাতারে দাঁড়িয়ে ঈদের ছালাত আদায় করে। ছালাতের পর সকলে একসাথে কুরবানী করে কুরবানীর গোশত গরীব-দুঃখী, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে বিতরণের যে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি তা সত্যিই অবিস্মরণীয়।

ঈদ-উল-আযহার শিক্ষা

মুসলিম মিল্লাতের পিতা ইবরাহীম (আঃ) তাঁর প্রাণপ্রিয় পুত্র ইসমাঈল (আঃ)-কে আল্লাহর রাহে কুরবানী দেয়ার সুমহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যেভাবে ঈমানী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মানবজাতিকে ত্যাগের শিক্ষা দিয়ে গেছেন, সে আদর্শ ও প্রেরণায় আমরা আমাদের জীবনকে ঈমানী আলোয় উজ্জীবিত করব, এটাই কুরবানীর মৌলিক শিক্ষা। ত্যাগ ছাড়া কখনোই কল্যাণকর কিছুই অর্জন করা যায় না। মহান ত্যাগের মধ্যেই রয়েছে অফুরন্ত প্রশান্তি। কুরবানী আমাদেরকে আরও শিক্ষা দেয় যে, দুনিয়াবী সকল মিথ্যা, অনাচার, অবিচার, অত্যাচার, যুলুম, হানাহানি, স্বার্থপরতা, দাম্ভিকতা, অহমিকা, লোভ-লালসা ত্যাগ করে পৃথিবীতে শান্তি ও সাম্যের পতাকা সমুন্নত রাখতে।

পশু কুরবানী মূলত নিজের নফস তথা কুপ্রবৃত্তিকে কুরবানী করার প্রতীক। কুরবানী আমাদেরকে সকল প্রকার লোভ-লালসা, পার্থিব স্বার্থপরতা ও ইন্দ্রিয় কামনা-বাসনার জৈবিক আবিলতা হ’তে মুক্ত ও পবিত্র হয়ে মহান স্রষ্টার প্রতি নিবেদিত বান্দা হওয়ার প্রেরণা যোগায় এবং সত্য ও হকের পক্ষে আত্মোৎসর্গ করতে অনুপ্রাণিত করে। কুরবানীর স্বার্থকতা এখানেই। তাই পশুর গলায় ছুরি চালানোর সঙ্গে সঙ্গে যাবতীয় পাপ-পঙ্কিলতা, কুফর, শিরক, হিংসা-বিদ্বেষ, ক্রোধ, রিয়া, পরচর্চা-পরনিন্দা, পরশ্রীকাতরতা, আত্মগর্ব, আত্মঅহংকার, কৃপণতা, ধনলিপ্সা, দুনিয়ার মায়া-মুহাববত কলুষতার মত যেসব জঘণ্য পশুসুলভ আচরণ সযত্নে লালিত হচ্ছে তারও কেন্দ্রমূলে ছুরি চালাতে হবে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রতিটি পদক্ষেপে প্রতিটি মুহূর্তে প্রভুর আনুগত্য, আজ্ঞাপালন ও তাক্বওয়ার দ্বিধাহীন শপথ গ্রহণ করতে হবে।

আরও দেখুন

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button