কুরআনের কথা

মানুষেরা শোনো, তুমি প্রতিপালকের কাছে পৌঁছা পর্যন্ত খাটতেই থাকবে — আল-ইনশিক্বাক

যখন আকাশকে ছিঁড়ে বিদীর্ণ করে ফেলা হবে এবং সেটা তার প্রতিপালকের আদেশ পালন করবে —যা তার করারই কথা। যখন ভূমিকে প্রসারিত করে সমতল করা হবে, তার ভেতরে যা আছে, তা বের করে দিয়ে খালি হয়ে যাবে এবং তার রবের আদেশ পালন করবে —যা তার করারই কথা। মানুষেরা শোনো, তুমি প্রতিপালকের কাছে পৌঁছা পর্যন্ত খাটতেই থাকবে, তারপর তাঁর সাথে তোমার দেখা হবে। — আল-ইনশিক্বাক ১-৬

যখন আকাশকে ছিঁড়ে বিদীর্ণ করে ফেলা হবে

মহাবিশ্বে এক অদ্ভুত কিছু একটা রয়েছে, যা কোনো যন্ত্রে ধরা যায় না, পরিমাপ করা যায় না, পদার্থ বিজ্ঞানের কোনো সূত্রও মানে না। বিজ্ঞানীরা এর সম্পর্কে কিছুই ধারনা করতে পারছেন না। এই প্রচণ্ড ক্ষমতাধর শক্তি ক্রমাগত মহাবিশ্বকে সম্প্রসারণ করছে। বিজ্ঞানীরা একে ‘শক্তি’ নাম দিয়েছেন, কিন্তু এটা আমাদের জানা কোনো শক্তির মতো কিছু নয়। একে নাম দেওয়া হয়েছে ‘ডার্ক এনার্জি’ বা অজানা-শক্তি।

সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন যে, মহাবিশ্বের যে তিনটি সম্ভাব্য পরিণতি হতে পারে, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা হচ্ছে মহাবিশ্ব একদিন ছিঁড়ে ফেটে যাবে ডার্ক এনার্জির কারণে। আমরা যদি তখনো বেঁচে থাকতে পারতাম, তাহলে আমরা দেখতাম যে, আকাশে নক্ষত্রগুলো ঝরে যাচ্ছে, পৃথিবী ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে, আকাশে ফাটল ধরছে, তারপর অণু-পরমাণুর গঠন ভেঙ্গে পুরো মহাবিশ্ব ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে—কুরআনে মহাবিশ্ব ধ্বংসের বর্ণনার সাথে যেন এক অদ্ভুত মিল!

আমরা যখন কোনো কিছুকে ‘ছিঁড়ে’ ফেলা কল্পনা করি, সাধারণত আমাদের কল্পনা হয় নরম কিছু টেনে ছিঁড়ে ফেলা। কেউ যদি বলে, একটি পাহাড়কে টেনে ছিঁড়ে ফেলা হবে —এই চিন্তা করাটা কষ্টকর। পুরো পৃথিবীকে টেনে ছিঁড়ে ফেলা হবে—সেটা চিন্তা করা আরও কষ্টকর। কিন্তু আকাশের মতো কল্পনাতীত বড় কিছুকে টেনে ছিঁড়ে ফেলা হবে! —কী ভয়ংকর পর্যায়ের ক্ষমতা দরকার এর জন্য, তা আমরা চিন্তাও করতে পারি না।

ইনশিক্বাক অর্থ টেনে ছিঁড়ে ফেলা, বিদীর্ণ করে ফেলা। একদিন আকাশকে টেনে ছিঁড়ে ফেলা হবে। কুরআনে আস-সামাআ অর্থাৎ আকাশ বলতে আমাদের মাথার উপরে যা কিছুই আছে, তার সবটাকেই বোঝায়— আকাশ এবং মহাকাশ। কল্পনাতীত বড় সময় ধরে এই জগতকে আকাশ আগলে রেখেছিল। এখন তার দায়িত্ব শেষ। সে ছিঁড়ে-ফেটে বিদীর্ণ হয়ে নতুন জগতের সূচনার পথ করে দেবে। —এই দিনের জন্যই আকাশকে তৈরি করা হয়েছে। সেই দিন আকাশ তার রবের আদেশ শুনে তার দায়িত্ব শেষ করবে।[১৪]

একদিন ভূমি তার ভেতরের সব কিছু বের করে দেবে। কল্পনাতীত লম্বা সময় ধরে সে বিপুল পরিমাণের বস্তু ধারণ করে রেখেছিল। এখন তার দায়িত্ব শেষ। এক নতুন জগত তৈরি হবে, যেখানে ভূমিকে প্রশস্ত করে সমতল করে ফেলা হবে, যেন সমস্ত মৃত মানুষ আবার উঠে দাঁড়াতে পারে, তাদের শেষ বিচারের জন্য। —সেই দিনের জন্যই ভূমিকে তৈরি করা হয়েছে। সেদিন ভূমি তার রবের আদেশ পালন করে তার দায়িত্ব সম্পূর্ণ করবে।[১৪]

এই আয়াতগুলোর মধ্য দিয়ে আল্লাহ تعالى মানুষকে তার অবস্থান কোথায় জানিয়ে দেন। বিশাল পৃথিবী, উপরে কল্পনাতীত বড় সৃষ্টিজগত, প্রকাণ্ড মহাবিশ্ব —যাদেরকে আমরা এত সমীহ করি, তাদেরকেই আল্লাহ تعالى টেনে ছিঁড়ে ফেলবেন। তাহলে মানুষের মতো নগণ্য সৃষ্টি কীভাবে এই প্রচণ্ড ক্ষমতাকে অবমাননা করার ধৃষ্টতা দেখায়?

মানুষেরা শোনো, তুমি প্রতিপালকের কাছে পৌঁছা পর্যন্ত খাটতেই থাকবে, তারপর তাঁর সাথে তোমার দেখা হবে।

কেউ সার্টিফিকেটের জন্য সংগ্রাম করে। কেউ বাড়ি-গাড়ি-জমির জন্য সংগ্রাম করে। কেউ সম্মান, ক্ষমতা, কর্তৃত্বের জন্য সংগ্রাম করে। অনেকের জীবনের লক্ষ্য শুধুই বিনোদন, আর বিনোদন। অনেকে জীবন শেষ করে দেয় সন্তানদের খায়েশ পূরণ করতে গিয়ে।

অন্যদিকে, অনেকে ধর্মের জন্য সংগ্রাম করে। কেউ আবার সংগ্রাম করে মানুষ, প্রকৃতির কল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার জন্য। —যে যেই লক্ষ্য নিয়েই সংগ্রাম করুক না কেন, চূড়ান্ত পরিণতি হচ্ছে যে, একদিন তার রবের সাথে গিয়ে দেখা হবে। জীবনে যে অল্প সময়টুকু সে পেয়েছিল, সেটা কেন সে তার রবের সাথে দেখা করার জন্য আরও বেশি করে ব্যয় করেনি, তার জন্য হা-হুতাশ করা ছাড়া আর উপায় থাকবে না। সেই চূড়ান্ত উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এই জীবনে কে কতটুকু পরিশ্রম করেছে, তার উপর নির্ভর করবে তার অন্তিম সফলতা, অথবা ব্যর্থতা।

তারপর যাকে আমলনামা ডান হাতে দেওয়া হবে, তার হিসেব হবে সহজ। সে তার স্বজনদের কাছে খুশি হয়ে ফিরে যাবে। —আল-ইনশিক্বাক ৭-৯

আমরা যখন মাদ্রাসা-স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটি পাশ করি, অনেক প্রতীক্ষার পর শেষ পর্যন্ত সার্টিফিকেট হাতে পাই, সবার আগে আমরা স্বজনদের কাছে ছুটে যাই। ফোন করে কাছের মানুষদের খুশির খবর জানিয়ে দেই। পরিবারের সাথে জীবনে কোনো বড় প্রাপ্তির সুসংবাদ উপভোগ করাটা আমাদের সহজাত স্বভাব। কিয়ামতের দিন যারা বিচারে পাশ করবে, সেটা হবে তাদের সারা জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি! এরচেয়ে বড় প্রাপ্তি মানুষের জীবনে আর কিছু হতে পারে না। সেদিন মানুষ স্বজনদের কাছে ছুটে যাবে তার সবচেয়ে বড় অর্জনের কথা জানাতে। তার আমলনামা খুশি হয়ে অন্যদেরকে দেখিয়ে বেড়াবে। সে যে জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষায় পাশ করে গেছে! আর কোনোদিন তাকে কোনো কিছুর জন্য দুশ্চিন্তা করতে হবে না! অনন্ত সুখ-শান্তি অপেক্ষা করছে তার জন্য!

আর যাকে আমলনামা পিঠের পেছনে দেওয়া হবে, সে চিৎকার করে ধ্বংস হয়ে যেতে চাইবে। সে জ্বলন্ত আগুনে দগ্ধ হবে। অতীতে সে তার স্বজনদের মধ্যে ভালোই আনন্দে ছিল। মনে করতো যে, তাকে আর ফিরিয়ে আনা হবে না —অবশ্যই তা হবে, তার রব ঠিকই সব দেখছিলেন। —আল-ইনশিক্বাক ১০-১৫

অপরাধীদের অপদস্ত করা শুরু হবে তার আমলনামা পিঠের পেছনে দিয়ে। তার বাঁ হাত পিঠের পেছনে বেঁধে তাতে আমলনামা ধরিয়ে দেওয়া হবে। এক অপমানকর ব্যাপার। আল্লাহর আদালতে দাঁড় করিয়ে তাকে খুঁটিনাটি জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এই ভয়ংকর আদালতে যাকেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে, সে-ই শেষ।[৭]

মনে করতো যে, তাকে আর ফিরিয়ে আনা হবে না —অবশ্যই তা হবে, তার রব ঠিকই সব দেখছিলেন।

এই হচ্ছে মানুষের পাপের মূল কারণ। মানুষ মনে করে যে, সে যখন অন্যায়ভাবে টাকা কামাচ্ছে, টেবিলের তলা দিয়ে ঘুষ নিচ্ছে, চুপচাপ ফোনে চুক্তি করে প্রজেক্ট থেকে কোটি টাকা মেরে দিচ্ছে, গোপনে মিটিং করে গরিবের হক, দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে —এগুলো কেউ দেখছে না। তার মনে ঠিকই পুলিশ, ডিজিএফআই, দুদক-এর ধরে নিয়ে যাওয়ার ভয় আছে; কিন্তু আল্লাহর تعالى সামনে দাঁড়ানোর ভয় নেই। মানুষ ভুলে যায় যে, আল্লাহ تعالى ঠিকই সব দেখছিলেন। সে ভুলে যায় যে, তার চূড়ান্ত পরিণতি হচ্ছে আল্লাহর تعالى সামনে দাঁড়ানো।

না! আমি শপথ করছি পশ্চিম আকাশের, আর রাতের এবং তা যা কিছুর সমাবেশ ঘটায় তার। শপথ করছি চাঁদের, যখন তা পূর্ণ হয়। অবশ্যই তোমরা এক ধাপ থেকে অন্য ধাপে আরোহণ করতে  থাকবে। — আল-ইনশিক্বাক ১৬-১৯

মানুষের জন্ম নেওয়ার মুহূর্ত থেকেই শুরু হয় তার পরিশ্রম। জন্ম নেওয়ার সময় তাকে চারিদিক থেকে পিষে সরু একটা সুরঙ্গ দিয়ে চেপেচুপে বের করা হয়। এরপর সে এসে পড়ে এক ভয়ংকর পরিবেশে। এতদিন এয়ারকন্ডিশন্ড পানির মধ্যে আরামে ভেসে বেড়াচ্ছিল। স্বয়ংক্রিয়ভাবে শরীরে পুষ্টি চলে যাচ্ছিল। খাওয়ার কষ্ট করতে হচ্ছিল না। এখন শুরু হলো তার ক্ষুধার কষ্ট। চিৎকার দিয়ে মা খুঁজে বের করে খাওয়ার জন্য পরিশ্রম করতে হয়। খেতে গেলে গলায় আটকে যায়। দম বন্ধ হয়ে যায়। হেঁচকি উঠে। তারপর মল ত্যাগের যন্ত্রণা। কিছুক্ষণ পর পর কাপড় ভিজিয়ে প্রস্রাব। তারপর উপর আছে ঠাণ্ডা এবং গরমের কষ্ট।

একদিন বসা শেখে। তারপর একদিন কোনোমতে দাঁড়াতে পারে। তারপর একটু একটু করে হাটা। দৌড়াতে গিয়ে পড়ে গিয়ে ব্যাথা পাওয়া। অনেক মাস সংগ্রামের পর একদিন গিয়ে নিজের দেহের উপর নিয়ন্ত্রণ পায়। একটা ধাপ সে পার করে।

তারপর শুরু বাল্যকাল। শত ব্যাথা-আনন্দ, ভালবাসা-বকা’র মধ্যে দিয়ে আরেকটি ধাপ সে পার করে কৈশোরে পৌঁছায়। মানবিক সম্পর্কের জটিলতার মুখোমুখি হয়। বাবা-মা, সমাজের শত আশা-আকাঙ্ক্ষার চাপ ঘাড়ে নিয়ে মানসিক চাপে দিন পার করে। জীবন সংগ্রামের জটিলতার কিছুটা রূপ সে প্রথমবার দেখে।

এরপরের ধাপে আসে তরুণ জীবন। নতুন কিছু অর্জনের আশা, পাওয়ার আনন্দ, হারানোর বেদনা, অপ্রাপ্তির হতাশা, ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে আরেকটি ধাপ পার করে সে যৌবনে পোছায়। এরপর শুরু হয় দায়িত্ব আর দায়িত্ব। পরিবার গঠনের দায়িত্ব। সন্তান পালনের দায়িত্ব। সংসার, সম্পদ, সম্মানের নিশ্চয়তা জোগাড় করার দায়িত্ব। তার দিকে চেয়ে থাকে অনেকগুলো মুখ। সবাইকে তার খুশি রাখতে হবে। সবার দাবি পূরণ করার চেষ্টা করতে হবে। একদিক ঠিক রাখতে গেলে আরেকদিক নষ্ট হয়ে যায়। একদিকে খুশি করতে গিয়ে অন্যদিকে কষ্ট দিতে হয়। দুই হাতে তাকে প্রতিনিয়ত শত চাহিদা সামাল দিতে হয়, শত সমস্যার সমাধান খুঁজে দিতে হয়। দিন শেষে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে কারো কাঁধে মাথা রেখে একটু বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগও সহজে মেলে না।

প্রবীণ বয়সে মানুষ এক জটিল ধাপে এসে পৌঁছায়। যৌবনের সেই সমস্যাগুলো, দাবিগুলো আরও জটিল আকার ধারণ করে। তার উপর শুরু হয় নিজের সাথে যুদ্ধ। জীবনে কী করলাম? কী পেলাম? কত কিছু করতে পারতাম? কাউকেই খুশি করতে পারলাম না? —এই সব গভীর উপলব্ধি মনকে ভারি করে তোলে। একইসাথে আছে সন্তানদেরকে তাদের জীবনের হাল নিজেদের হাতে ধরিয়ে বিদেয় দেওয়ার দীর্ঘ প্রস্তুতি এবং বেদনা।

তারপর বার্ধক্যে এসে গলা টিপে ধরে ভীষণ একাকীত্ব। এ সময়টা যেন এক ভয়ংকর কারাগার। একেকটি দিন পার করা পাহাড় বেয়ে ওঠার সমান। মাঝে মধ্যে কিছু খুশির মুহূর্ত আসে। জীবনে আবার আলো জ্বল জ্বল করে ওঠে। কিন্তু কিছু সময় পরেই আবার ডুবে যায় অন্ধকারে। সারাজীবনের সমস্ত ভুল সিদ্ধান্ত, ভুল কাজে সময় ব্যয়, অপ্রাপ্তির হতাশার সাথে হারিয়ে যাওয়া সময় এবং সুযোগ আর কোনোদিন ফিরে পেতে না পারার উপলব্ধি দম আটকে ফেলে।

—তারপর একদিন সব শেষ।

একজন মানুষের জীবনের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সংগ্রামের পর সংগ্রাম। পৃথিবীতে সে আসে কত দুর্বল, অসহায় অবস্থায়। কয়েকদিনের জন্য কিছু শক্তি, সামর্থ্য পায়। তারপর আবার দুর্বল, অসহায় অবস্থায় কিছুটা সময় পার করে একদিন মাটিতে গিয়ে কেঁচো, বিছা, ফাঙ্গাসের খাবারে পরিণত হয়।

এরপর একসময় সে উঠে দাঁড়াবে এবং দেখা হবে তার প্রতিপালকের সাথে।  জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত, তারপর মৃত্যু থেকে পুনরায় জন্ম, তারপর অনন্ত জীবনে যাত্রা— এভাবে ধাপে ধাপে প্রতিটি মানুষকে যেতে হবেই।

তাহলে তাদের সমস্যা কী যে তারা বিশ্বাস করে না? তাদের সামনে কুরআন পড়া হলেও তারা তার আনুগত্য করে না কেন? আসল কথা, অবিশ্বাসীরা সত্যকে জেনেশুনে অস্বীকার করে। তারা মনে মনে কী গোপন করে, আল্লাহ তা ভালো করেই জানেন। তাই তাদেরকে ভীষণ কষ্টকর শাস্তির সুসংবাদ দাও। তবে যারা বিশ্বাস করে এবং ভালো কাজ করে, তাদের জন্য রয়েছে নিরবিচ্ছিন্ন অনন্ত পুরস্কার। —আল-ইনশিক্বাক ২০-২৫

তাদের সামনে কুরআন পড়া হলেও তারা তার আনুগত্য করে না কেন?

অনেক অনুবাদে বলা হয়, “তারা সিজদা করে না কেন?” —এখানে সাজদা অর্থ মাটিতে মাথা দিয়ে আল্লাহর تعالى প্রতি সিজদা নয়, বরং এর অর্থ সম্মান করে অনুগত হওয়া, নম্রতা, বিনয় দেখানো। কারণটা পরিষ্কার, এই আয়াতে বলা হয়নি কুরআন তিলাওয়াত শুনলেই সিজদা করতে। এনিয়ে কোনো দ্বিমত নেই যে, কাউকে কুরআনের কিছু আয়াত তিলাওয়া করে শোনালেই তার জন্য সিজদা দেওয়াটা বাধ্যতামূলক হয়ে যাবে। বরং প্রসঙ্গের দিকে লক্ষ্য করলে পরিষ্কার করে বোঝা যায় যে, এখানে অবিশ্বাসীরা যে কুরআনকে শ্রদ্ধা করে না, কুরআনের বাণী বুঝেও তা মানে না —সেদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে।[৪]

তবে যারা বিশ্বাস করে এবং ভালো কাজ করে, তাদের জন্য রয়েছে নিরবিচ্ছিন্ন অনন্ত পুরস্কার।

১) যারা বিশ্বাস করে

প্রথম কাজ হচ্ছে আল্লাহর تعالى প্রতি ঈমান আনা। ঈমান না থাকলে একজন মানুষ যতই ভালো কাজ করুক, তা তাকে ক্ষতি থেকে রক্ষা করবে না। কারও উদ্দেশ্য যদি হয় লোক দেখানো কাজ, আল্লাহকে تعالى খুশি করা নয়, তাহলে সেই ভালো কাজগুলো করেও সে কোনো সওয়াব পাবে না। মাঝখান থেকে তাঁর মূল্যবান সময় এবং সম্পদ নষ্ট হয়ে যাবে। কারও উদ্দেশ্য যদি হয় মানুষের জন্যই মানুষের উপকার করা—“মানব ধর্মই আসল ধর্ম”, “জীবে প্রেম করে যেইজন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর”—তখন সে মানুষের উপকার করার এমন সব পদ্ধতি অনেক সময় বেছে নেবে, যা আল্লাহ تعالى পছন্দ করেন না। তখন তার কষ্টটাই মাটি। উপকার করতে গিয়ে তখন সে উল্টো অনেকগুলো গুনাহ কামিয়ে ফেলবে।

একারণে আল্লাহর تعالى প্রতি সঠিক বিশ্বাস আনাটা জরুরি। সেটা আনতে হলে কুর‘আন পড়তে হবে, ইসলামকে জানার আন্তরিক চেষ্টা করতে হবে। বাপ-দাদার অন্ধ অনুকরণ করা বন্ধ করতে হবে। প্রতিটা কাজের জন্য যে আল্লাহকে تعالى জবাব দিতে হবে, তা ভালোভাবে উপলব্ধি করতে হবে। ঈমানের যে ছয়টি অঙ্গ আছে, তা নিজের ভেতরে পাকাপোক্ত করতে হবে। তবে এটা করতে সময় লাগে। রাতারাতি কেউ মুমিন হয়ে যান না। তাছাড়া কেউ দাবি করতে পারবে না যে, “আমি আজকে সাচ্চা ঈমানদার হয়েছি।” বরং ঈমান একটা লম্বা সফর। আমাদের কাজ হচ্ছে ঈমান দৃঢ় করতে আজীবন চেষ্টা করে যাওয়া, যেন আল্লাহর تعالى কাছে গিয়ে বলতে পারি যে, আমাদের চেষ্টার কোনো ত্রুটি ছিল না। বাকি সব তাঁর হাতে। তিনিই تعالى জানেন আমাদের অন্তরে আসলে কী ছিল।

২) ভালো কাজ করে

‘আমাল সালিহ’ অর্থ হচ্ছে সৎকাজ, সংস্কার, ভুল কিছুকে ঠিক করা, ভাঙ্গা জিনিস জোড়া লাগানো, শান্তি প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি। সাধারণভাবে ইসলাম সমর্থিত যে কোনো ভালো কাজকেই ‘আমাল সালিহ’ বলা হয়।

আল্লাহর تعالى প্রতি বিশ্বাস আনার পর আমাদের কাজ হচ্ছে বেশি করে ভালো কাজ করা। কারণ আল্লাহর تعالى প্রতি বিশ্বাস আনার পরেও কেউ যদি ভালো কাজ না করে, তাহলে তার বিশ্বাস আসলেই আছে কিনা তা প্রশ্নের ব্যাপার। আর আমরা যখন ভালো কাজ করতে যাই বা করার পরিকল্পনা করি, তখন আমাদের উপর শুরু হয় শয়তানের কুমন্ত্রণা বৃষ্টি। সে সবদিক থেকে চেষ্টা করে আমাদেরকে আটকে রাখার। কিন্তু যখন কাজটা করে ফেলি, তখন শয়তান হেরে যায়, আর আমরা জিতে যাই। এভাবে শয়তান দুর্বল হয়ে যায়, আর আমরা শক্তিশালী হয়ে যাই। বার বার ভালো কাজ করার মাধ্যমে আমরা আমাদের শয়তানকে বার বার ঘায়েল করতে থাকি। নিজেদেরকে তার বিরুদ্ধে আরও বেশি শক্তিশালী করতে থাকি। এভাবে আমরা যত বেশি শয়তানকে দমিয়ে রাখার দক্ষতা অর্জন করবো, তত কম গুনাহ করবো। তখন জান্নাতে যাওয়া তত বেশি সহজ হবে।

– ওমর আল-জাবির


সূত্র: [১] বাইয়িনাহ এর কু’রআনের তাফসীর। [২] ম্যাসেজ অফ দা কু’রআন — মুহাম্মাদ আসাদ। [৩] তাফহিমুল কু’রআন — মাওলানা মাওদুদি। [৪] মা’রিফুল কু’রআন — মুফতি শাফি উসমানী। [৫] মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word Meaning of The Quran [৬] সৈয়দ কুতব — In the Shade of the Quran [৭] তাদাব্বুরে কু’রআন – আমিন আহসান ইসলাহি। [৮] তাফসিরে তাওযীহুল কু’রআন — মুফতি তাক্বি উসমানী। [৯] বায়ান আল কু’রআন — ড: ইসরার আহমেদ। [১০] তাফসীর উল কু’রআন — মাওলানা আব্দুল মাজিদ দারিয়াবাদি [১১] কু’রআন তাফসীর — আব্দুর রাহিম আস-সারানবি [১২] আত-তাবারি-এর তাফসীরের অনুবাদ। [১৩] তাফসির ইবন আব্বাস। [১৪] তাফসির আল কুরতুবি। [১৫] তাফসির আল জালালাইন। [১৬] লুঘাতুল কুরআন — গুলাম আহমেদ পারভেজ। [১৭] তাফসীর আহসানুল বায়ান — ইসলামিক সেন্টার, আল-মাজমাআহ, সউদি আরব [১৮] কু’রআনুল কারীম – বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর — বাদশাহ ফাহাদ কু’রআন মুদ্রণ কমপ্লেক্স। [১৯] তাফসির আল-কাবির। [২০] তাফসির আল-কাশ্‌শাফ।

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button