ইসলামী পরিভাষা

দারুল হারব ও দারুল ইসলাম : পরিচিতি ও প্রকারভেদ

বর্তমান সময়ের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো ‘দারুল ইসলাম’ ও ‘দারুল হারব’-এর পরিচিতি ও প্রকারভেদ। গুরুত্বের বিচারে এটা অত্যন্ত জরুরি হলেও দুঃখের বিষয় যে, এ মাসআলার ব্যাপারে বর্তমানের অধিকাংশ মানুষ উদাসীন। সাধারণরা তো দূরে থাক; অনেক ভালো ভালো আলিমেরও এ বিষয়ে তেমন অধ্যয়ন নেই। আর এজন্য তাদের বিভিন্ন দলিলবিহীন কথার কারণে অনেক মানুষের মাঝে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়ছে। তাই দীর্ঘ সময় ব্যয় করে কুরআন, হাদিস ও চার মাজহাবের ফুকাহায়ে কিরামের রায় সামনে রেখে এ বিষয়ে দলিলসমৃদ্ধ একটি আর্টিকেল তৈরি করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিলাম, যাতে ‘দারুল ইসলাম’ ও ‘দারুল হারব’ নিয়ে সবার ভুল ধারণা দূর হয়ে এ বিষয়ে সঠিক ধারণা পাওয়া যায়। আল্লাহ-ই আমাদের সাহায্যকারী এবং তিনিই আমাদের উত্তম অভিভাবক।

এ বিষয়টি নিয়ে আমরা চারটি ভাগে আলোচনা করতে পারি। প্রথমত, ‘দারুল ইসলাম’ ও ‘দারুল হারব’ পরিভাষা দুটির শরয়ি ভিত্তি । দ্বিতীয়ত, দারুল ইসলাম ও দারুল হারবের সংজ্ঞা ও পরিচিতি। তৃতীয়ত, দারুল হারবের প্রকারভেদ। চতুর্থত, দারুল ইসলাম ও দারুল হারবের রূপান্তর। আমরা এ চারটি বিষয়কে চারটি পার্টে ভাগ করে আলোচনা করছি ইনশাআল্লাহ।

প্রথম আলোচনা : ‘দারুল ইসলাম’ ও ‘দারুল হারব’ পরিভাষা দুটির শরয়ি ভিত্তি
বর্তমানে কিছু মানুষকে দেখা যায়, তারা ‘দারুল ইসলাম’ ও ‘দারুল হারব’ পরিভাষা দুটিকে খুবই অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখে থাকে। তাদের ধারণা, এসব যেহেতু ইজাতহাদি বিষয়, তাই ‘দার’-কে দুভাগে সীমাবদ্ধ রাখা আবশ্যকীয় কিছু নয়; বরং এতে প্রকার আরও কমবেশ বা পরিবর্তন হতে পারে। অথচ এ পরিভাষা ও তার প্রকারভেদ সুদীর্ঘ বারো শতাব্দীকাল ধরে ফুকাহায়ে কিরামের মাঝে নিরবচ্ছিন্নধারায় চলে আসছে। আর তাই এটাকে একপ্রকার ইজমা দাবি করলেও অত্যুক্তি হবে না বোধহয়।

বস্তুত ‘দারুল হারব’ ও ‘দারুল ইসলাম’-এর শরয়ি উৎসমূল জানা থাকলে এসব পরিভাষা পরিবর্তন করে নতুন ইজতিহাদের দাবি করার দুঃসাহস কেউ দেখাত না। কেননা, হাদিস ও আসারের একাধিক বর্ণনা থেকে বুঝা যায়, ‘দার’ সাধারণত দু’প্রকারেরই হয়ে থাকে। বিভিন্ন বর্ণনায় স্পষ্টভাবে বা ইঙ্গিতে এ প্রকারভেদের দলিল পাওয়া যায়। আমরা সেসব বর্ণনা থেকে এখানে কতিপয় বর্ণনা তুলে ধরছি।

রাসুলুল্লাহ সা. একটি সেনাভিযানকালে সেনাপতিকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলতেন :
وَإِذَا لَقِيتَ عَدُوَّكَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ، فَادْعُهُمْ إِلَى ثَلَاثِ خِصَالٍ – أَوْ خِلَالٍ – فَأَيَّتُهُنَّ مَا أَجَابُوكَ فَاقْبَلْ مِنْهُمْ، وَكُفَّ عَنْهُمْ، ثُمَّ ادْعُهُمْ إِلَى الْإِسْلَامِ، فَإِنْ أَجَابُوكَ، فَاقْبَلْ مِنْهُمْ، وَكُفَّ عَنْهُمْ، ثُمَّ ادْعُهُمْ إِلَى التَّحَوُّلِ مِنْ دَارِهِمْ إِلَى دَارِ الْمُهَاجِرِينَ
‘আর যখন তোমার শত্রু মুশরিকদের সাক্ষাৎ পাবে, তখন তাদের তিনটি বিষয়ের দিকে আহবান করবে। তারা এগুলো থেকে যেটাই গ্রহন করুক, তুমি তাদের পক্ষ থেকে তা মেনে নেবে এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা থেকে বিরত থাকবে। (প্রথমে) তাদেরকে ইসলামের দিকে আহবান করবে। যদি তারা তোমার এ আহবানে সাড়া দেয়, তবে তুমি তাদের পক্ষ থেকে তা মেনে নেবে এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা থেকে নিবৃত্ত থাকবে। এরপর তুমি তাদেরকে তাদের ‘দার’ (এলাকা বা দেশ) থেকে মুহাজিরদের ‘দার’-এর দিকে চলে যাওয়ার আহবান জানাবে।’ (সহিহু মুসলিম : ৩/১৩৫৭, হা. নং ১৭৩১, প্রকাশনী : দারু ইহইয়াইত তুরাসিল আরাবিয়্যি, বৈরুত)

এ হাদিসে ‘মুশরিকদের দার’ আর ‘মুহাজিরদের দার’ বলে স্পষ্টত ‘দার’ দুটি হওয়ার দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। মুশরিকদের ‘দার’-কে বলা হয় ‘দারুশ শিরক’ বা ‘দারুল হারব’। আর মুহাজিরদের ‘দার’-কে বলা হয় ‘দারুল হিজরাহ’ বা ‘দারুল ইসলাম’।

রাসুলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন :
لَا يَقْبَلُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ مِنْ مُشْرِكٍ بَعْدَمَا أَسْلَمَ عَمَلًا، أَوْ يُفَارِقَ الْمُشْرِكِينَ إِلَى الْمُسْلِمِينَ
‘কোনো মুশরিক ইসলাম গ্রহণের পরও আল্লাহ তার কোনো আমল কবুল করেন না, যতক্ষণ না সে মুশরিকদের (এলাকা) ত্যাগ করে মুসলিমদের কাছে (এলাকাতে) চলে আসে।’ (সুনানুন নাসায়ি : ৫/৮২, হা. নং ২৫৬৮, প্রকাশনী : মাকতাবুল মাতবুআতিল ইসলামিয়া, হালব)

এ হাদিসেও ‘মুশরিকদের ভূমি’ আর ‘মুসলিমদের ভূমি’ বলে ‘দার’ দুটি হওয়ার দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে।
রাসুলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন :
عَقْرُ دَارِ الْإِسْلَامِ بِالشَّامِ
‘দারুল ইসলামের মূলভূমি হলো শামে।’ (আল-মুজামুল কাবির, তাবারানি : ৭/৫৩, হা. নং ৬৩৫৯, প্রকাশনী : মাকতাবাতু ইবনি তাইমিয়া, কায়রো)

আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. বলেন :
وَكَانَ مِنَ الْأَنْصَارِ مُهَاجِرُونَ لِأَنَّ الْمَدِينَةَ كَانَتْ دَارَ شِرْكٍ، فَجَاءُوا إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَيْلَةَ الْعَقَبَةِ
‘আর আনসারিদের মাঝেও কতিপয় মুহাজির ছিলেন। কেননা, (হিজরতের পূর্বে) মদিনা ছিল “দারুশ শিরক”। অতঃপর তথা হতে কতিপয় সাহাবি আকাবার রাতে (হিজরত করে) রাসুলুল্লাহ সা.-এর কাছে চলে আসেন।’ (সুনানুন নাসায়ি : ৭/১৪৪, হা. নং ৪১৬৬, প্রকাশনী : মাকতাবুল মাতবুআতিল ইসলামিয়া, হালব)

খালিদ বিন অলিদ রা. খলিফাতুল মুসলিমিনের পক্ষ থেকে হিরায় পাঠানো চিঠিতে লেখেন :
وَجَعَلْتُ لَهُمْ أَيُّمَا شَيْخٍ ضَعُفَ عَنِ الْعَمَلِ أَوْ أَصَابَتْهُ آفَةٌ مِنَ الآفَاتِ أَوْ كَانَ غَنِيا فَافْتَقَرَ وَصَارَ أَهْلُ دِينِهِ يَتَصَدَّقُونَ عَلَيْهِ طَرَحْتُ جِزْيَتَهُ وَعِيلَ مِنْ بَيْتِ مَالِ الْمُسْلِمِينَ. وَعِيَالُهُ مَا أَقَامَ بِدَارِ الْهِجْرَةِ وَدَارِ الإِسْلامِ؛ فَإِنْ خَرَجُوا إِلَى غَيْرِ دَارِ الْهِجْرَةِ وَدَارِ الإِسْلامِ؛ فَلَيْسَ عَلَى الْمُسْلِمِينَ النَّفَقَةَ عَلَى عِيَالِهِمْ.
‘আর আমি তাদের (জিম্মিদের) জন্য এটা নির্ধারণ করেছি যে, কোনো বৃদ্ধ যদি কাজকর্ম করতে অক্ষম হয়ে যায় অথবা কোনো বিপদে আক্রান্ত হয় অথবা সে ধনী ছিল, কিন্তু পরে দরিদ্র হয়ে গেছে এবং তার ধর্মের লোকেরা তাকে দান-সদকা করতে শুরু করে, তাহলে আমি তার জিজিয়া স্থগিত করে দেবো এবং বাইতুল মাল থেকে তার ও তার পরিবারের ভরণপোষণ দেওয়া হবে; যতক্ষণ পর্যন্ত সে “দারুল হিজরাহ” ও “দারুল ইসলাম”-এ অবস্থান করবে। যদি তারা “দারুল হিজরাহ” ও “দারুল ইসলাম” থেকে বের হয়ে যায়, তাহলে মুসলমানদের ওপর তাদের পরিবারের ভরণপোষণ বহন করার কোনো দায়িত্ব নেই।’ (আল-খারাজ, আবু ইউসুফ : পৃ. নং ১৫৭-১৫৮, প্রকাশনী : আল-মাকতাবাতুল আজহারিয়্যা লিত্তুরাস)

এসব বর্ণনা থেকে পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় যে, ‘দারুল ইসলাম’ ও ‘দারুল হারব’ পরিভাষা দুটি পুরোপুরি ইজতিহাদি নয়; বরং এ ব্যাপারে আলাদাভাবে নস পাওয়া যায়। এ নসগুলোতে যেমন ‘দারুল ইসলাম’ পরিভাষা ব্যবহৃত হয়েছে, তেমনই এটার পাশপাশি ‘দারুল হিজরাহ’ বা ‘দারুল মুহাজিরিন’ পরিভাষাও ব্যবহৃত হয়েছে। বস্তুত এগুলো সব একই ‘দার’-এর নাম। অনুরূপ এসব বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, ‘দারুল হারব’-কে ‘দারুশ শিরক’ ও ‘দারুল মুশরিকিন’-ও বলা হয়।

মোটকথা এখানে আমরা দুটি ‘দার’-এর অস্তিত্ব পরিষ্কারভাবে দেখতে পাই। এক : এমন দার, যেখানে হিজরত করা হয়। এটাকে ‘দারুল হিজরাহ’ বা ‘দারুল ইসলাম’ বলে। দুই : এমন দার, যেখান থেকে অন্য ভূমিতে হিজরত করে চলে আসতে হয়। এটাকে ‘দারুল হারব’ বা ‘দারুশ শিরক’ বলে।

এছাড়াও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মাঝে এটা সর্বজনস্বীকৃত যে, ইসলাম ও কুফরের মাঝে তৃতীয় কোনো স্তর নেই। ব্যক্তি হয়তো মুমিন হবে, নয়তো কাফির হবে। গোমরাহ মু’তাজিলারাই একমাত্র ফিরকা, যারা ইসলাম ও কুফরের মাঝে তৃতীয় একটি স্তর নির্ধারণ করে। তারা বলে, এমন কিছু মানুষও আছে, যারা মুমিনও নয় আবার কাফিরও নয়। কিন্তু এটা একটি ভ্রান্ত ধারণা। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকিদা হলো, মুমিন যতই গুনাহগার হোক না কেন, সে ইমানের গণ্ডি থেকে বের হয়ে যায় না। হ্যাঁ, যার থেকে স্পষ্ট কুফর বা শিরক প্রকাশ পাবে এবং তার মধ্যে তাকফিরের কোনো প্রতিবন্ধকতাও পাওয়া যাবে না, তাহলে সে পরিষ্কার কাফির। দারের বিষয়টিও ঠিক এরূপই। হয়তো দেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত থাকবে কিংবা কুফর-শিরক প্রতিষ্ঠিত থাকবে। যদি ইসলাম প্রতিষ্ঠিত থাকে; চাই সেটা পূর্ণাঙ্গ হোক বা অপূর্ণাঙ্গ হোক, সেটাকে ‘দারুল ইসলাম’ বলা হবে। আর যদি কুফর-শিরক প্রতিষ্ঠিত থাকে, সেটাকে ‘দারুল হারব’ বলা হবে। এ মাসআলাটি যার কাছে যতটা স্পষ্ট, তার কাছে ‘দারুল ইসলাম’ ও ‘দারুল হারব’-এর মাসআলাও ততটা স্পষ্ট হবে।

সুতরাং যারা মনে করে ‘দারুল ইসলাম’ ও ‘দারুল হারব’ নতুন দুটি পরিভাষা, কুরআন-হাদিসে যার কোনো অস্তিত্ব নেই, তাদের এসব নস ভালো করে দেখা উচিত। আর যারা মনে করেন, এসব পরিভাষা পরিবর্তনশীল, তাদের কাছে মূলত ইসলাম ও কুফরের বৈপরীত্য এবং ব্যক্তি ও ভূমির ওপর এর প্রায়োগিক দিকটি স্পষ্ট নয়। নতুবা ব্যক্তির ক্ষেত্রে যেমন মুমিন ও কাফির হওয়ার বাহিরে তৃতীয় কোনো অবস্থার কথা কল্পনা করা যায় না, ঠিক তেমনই ভূমির ব্যাপারেও ইসলামি ও কুফরি ভিন্ন অন্য কোনো গুণে গুণান্বিত করার কথা ভাবা যায় না। ব্যক্তি যেমন হয়তো মুমিন, নয়তো কাফির; ভূমিও তেমনি হয়তো ইসলামি, নয়তো কুফরি হবে।

দ্বিতীয় আলোচনা : ‘দারুল ইসলাম’ ও ‘দারুল হারব’-এর পরিচিতি
যেকোনো বিষয়ে ভালোভাবে জানতে বা বুঝতে হলে প্রথমে তার পরিচিতি ভালোভাবে জানতে হয়। তাই এ আলোচনায় আমরা ‘দারুল ইসলাম’ ও ‘দারুল হারব’-এর পরিচয় বা সংজ্ঞা তুলে ধরব। সংজ্ঞা বর্ণনার ক্ষেত্রে আমরা চার মাজহাবের ফুকাহায়ে কিরামের মতই তুলে ধরব, যাতে ‘দারুল ইসলাম’ ও ‘দারুল হারব’-এর ব্যাপারে সামগ্রিকভাবে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে। প্রথমে আমরা এর আভিধানিক অর্থ নিয়ে আলোকপাত করব, এরপর তার পারিভাষিক বা শরয়ি অর্থ নিয়ে ফুকাহায়ে কিরামের ভাষ্য তুলে ধরব ইনশাআল্লাহ।

আভিধানিক অর্থ :

এখানে আমরা এর শাব্দিক অর্থ এবং সমর্থক কিছু শব্দ উল্লেখ করব, যেন শব্দের ভিন্নতায় বা ভুল শাব্দিক অর্থের কারণে কাউকে বিভ্রান্ত হতে না হয়। ‘দারুল ইসলাম’ ও ‘দারুল হারব’ পরিভাষা দুটিতে তিনটি শব্দ আছে। যথা : ‘দার’, ‘ইসলাম’ ও ‘হারব’। আমরা শব্দ তিনটির আলাদা আলাদা অর্থ বর্ণনা করে পরে সমষ্টিগত অর্থও বর্ননা করব ইনশাআল্লাহ।
‘দার’ অর্থ আঙিনা, ঘর ও মহল্লা। বসবাসের স্থানকে ‘দার’ বলা হয়। সাধারণত ‘দার’ বলতে শহর বুঝানো হয়ে থাকে। ‘দার’-এর বহুবচন হলো ‘দিয়ার’। একাধিক শহর মিলে গঠিত দেশকে ‘দিয়ার’ বলা হয়।

আল-মাওসুআতুল ফিকহিয়্যা-তে বলা হয়েছে :
الدَّارُ لُغَةً اسْمٌ جَامِعٌ لِلْعَرْصَةِ وَالْبِنَاءِ وَالْمَحَلَّةِ. وَفِي كُلِّيَّاتِ أَبِي الْبَقَاءِ: الدَّارُ اسْمٌ لِمَا يَشْتَمِل عَلَى بُيُوتٍ وَمَنَازِل وَصَحْنٍ غَيْرِ مَسْقُوفٍ. وَهِيَ مِنْ دَارَ يَدُورُ، وَسُمِّيَتْ بِذَلِكَ لِكَثْرَةِ حَرَكَاتِ النَّاسِ فِيهَا وَاعْتِبَارًا بِدَوَرَانِهَا الَّذِي لَهَا بِالْحَائِطِ، وَجَمْعُهَا أَدْوُرٌ، وَدُورٌ، وَالْكَثِيرُ دِيَارٌ، وَهِيَ الْمَنَازِل الْمَسْكُونَةُ وَالْمَحَال. وَكُل مَوْضِعٍ حَل بِهِ قَوْمٌ فَهُوَ دَارُهُمْ، وَمِنْ هُنَا سُمِّيَتِ الْبَلْدَةُ دَارًا، وَالصَّقْعُ دَارًا. وَقَدْ تُطْلَقُ الدَّارُ عَلَى الْقَبَائِل مَجَازًا.
‘আরবিতে ‘দার’-এর আভিধানিক অর্থ আঙিনা, ঘর ও মহল্লা। ‘দার’ বলতে সাধারণত কয়েকটি ঘর, বাড়ি ও ছাদবিহীন আঙিনা মিলে গঠিত এরিয়াকে বুঝানো হয়ে থাকে; যেমনটি আবুল বাকা রহ.-এর কুল্লিয়াতে বলা হয়েছে। শব্দটি دَارَ يَدُوْرُ دَوْرًا ক্রিয়ামূল থেকে নির্গত হয়েছে, যার অর্থ আবর্তিত হওয়া, চক্কর দেওয়া। ঘরকে ‘দার’ এজন্যই বলা হয় যে, মানুষ ঘরে বারবার নড়াচড়া (আসা-যাওয়া) করে এবং ঘর দেয়ালের চতুর্দিক থেকে বৃত্তাকারে আবর্তিত হয়ে থাকে। এর বহুবচন হলো : أَدْوُرٌ، وَدُوْرٌ وَدِيَارٌ। যে স্থান বা ভূখণ্ডে কোনো জাতি বসবাস করে, সেটাকে তাদের ‘দার’ বলা হয়। এজন্যই শহর ও ভূখণ্ডকে ‘দার’ বলা হয়। রূপক অর্থে ‘দার’ শব্দটি কখনো গোত্রের জন্যও ব্যবহার হয়ে থাকে।’ (আল-মাওসুআতুল ফিকহিয়্যা : ২০/১৯৮, প্রকাশনী : অজারাতুল আওকাফ ওয়াশ শুয়ুনিল ইসলামিয়্যা, কুয়েত)

‘ইসলাম’ অর্থ আনুগত্য করা, আত্মসমর্পণ করা। এটা سلم থেকে নির্গত হয়েছে। সিন, লাম ও মিমযোগে গঠিত শব্দ অধিকাংশ সময় সুস্থতা ও নিরাপত্তার অর্থে ব্যবহৃত হয়। ইসলাম ধর্ম যেহেতু অস্বীকৃতি ও অবাধ্যতা থেকে মুক্ত হয়ে পূর্ণভাবে আনুগত্য করে চলার নাম, তাই অর্থের মূল ধারণ করায় ‘ইসলাম’ নামটি আভিধানিকভাবে যথার্থ।

ইমাম ইবনে ফারিস রাজি রহ. বলেন :
(سَلِمَ) السِّينُ وَاللَّامُ وَالْمِيمُ مُعْظَمُ بَابِهِ مِنَ الصِّحَّةِ وَالْعَافِيَةِ ; وَيَكُونُ فِيهِ مَا يَشِذُّ، وَالشَّاذُّ عَنْهُ قَلِيلٌ، فَالسَّلَامَةُ: أَنْ يَسْلَمَ الْإِنْسَانُ مِنَ الْعَاهَةِ وَالْأَذَى. قَالَ أَهْلُ الْعِلْمِ: اللَّهُ جَلَّ ثَنَاؤُهُ هُوَ السَّلَامُ ; لِسَلَامَتِهِ مِمَّا يَلْحَقُ الْمَخْلُوقِينَ مِنَ الْعَيْبِ وَالنَّقْصِ وَالْفَنَاءِ. قَالَ اللَّهُ جَلَّ جَلَالُهُ: {وَاللَّهُ يَدْعُو إِلَى دَارِ السَّلَامِ} [يونس: ২৫]، فَالسَّلَامُ اللَّهُ جَلَّ ثَنَاؤُهُ، وَدَارُهُ الْجَنَّةُ. وَمِنَ الْبَابِ أَيْضًا الْإِسْلَامُ، وَهُوَ الِانْقِيَادُ ; لِأَنَّهُ يَسْلَمُ مِنَ الْإِبَاءِ وَالِامْتِنَاعِ
‘(সালিমা)। সিন, লাম ও মিমযোগে গঠিত অধিকাংশ শব্দে সুস্থতা ও মুক্তির অর্থ রয়েছে। কখনো ব্যতিক্রমও হয়; যদিও এর সংখ্যা নিতান্তই কম। অতএব, سلامة (সালামাহ) অর্থ বিপদ ও কষ্ট থেকে মানুষের নিরাপদ থাকা। উলামায়ে কিরাম বলেন, আল্লাহ তাআলা হলেন سلام (সালাম)। যেহেতু তিনি দোষ, ত্রুটি ও বিনাশ হওয়া থেকে মুক্ত, যা মাখলুকের গুণাগুণ। আল্লাহ তাআলা বলেন, “আর আল্লাহ আহবান করেন শান্তি-নিরাপত্তার আবাসের দিকে”। [সুরা ইউনুস : ২৫] আল্লাহ হলেন শান্তি ও নিরাপত্তাদাতা এবং জান্নাত হলো তাঁর আবাস। এ শব্দ থেকেই এসেছে, الإسلام (আল-ইসলাম)। এর অর্থ মান্য করা, আনুগত্য প্রদর্শন করা। (সুস্থতা ও নিরাপত্তার অর্থের সাথে ইসলামের অর্থের পুরাই মিল রয়েছে।) কেননা, এটা অস্বীকৃতি ও অবাধ্যতা থেকে (মুসলিমকে) নিরাপদ করে।’ (মাকায়িসুল লুগাহ : ৩/৯০, প্রকাশনী : দারুল ফিকর, বৈরুত)

শরয়ি পরিভাষায় শেষ নবি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আনিত দ্বীন ও জীবনব্যবস্থাকে ‘ইসলাম’ বলে। রাসুলুল্লাহ সা. হাদিসে জিবরিলে এ ‘ইসলাম’-এর দিকে ইঙ্গিত করে বলেন :
الْإِسْلَامُ أَنْ تَشْهَدَ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَتُقِيمَ الصَّلَاةَ، وَتُؤْتِيَ الزَّكَاةَ، وَتَصُومَ رَمَضَانَ، وَتَحُجَّ الْبَيْتَ إِنِ اسْتَطَعْتَ إِلَيْهِ سَبِيلًا
‘ইসলামের সারমর্ম হলো, তুমি এ সাক্ষ্য দেবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই এবং মুহাম্মাদ সা. আল্লাহর রাসুল, নামাজ প্রতিষ্ঠা করবে, জাকাত আদায় করবে, রমজান মাসের রোজা রাখবে এবং সামর্থ্য থাকলে বাইতুল্লাহর হজ করবে।’ (সহিহু মুসলিম : ১/৩৬, হা. নং ৮, প্রকাশনী : দারু ইহইয়াইত তুরাসিল আরাবিয়্যি, বৈরুত)

সুতরাং যেকোনো আনুগত্যের নামই ইসলাম নয়; বরং আনুগত্য হতে হবে একমাত্র আল্লাহর দেওয়া বিধিনিষেধের ক্ষেত্রে। আবার শুধু বিধিনিষেধের ক্ষেত্রে আনুগত্য করাই যথেষ্ট হবে না, যতক্ষণ না তা শেষ নবি মুহাম্মাদ সা.-এর আনিত শরিয়তের অনুকূলে হবে। অতএব, প্রকৃত ইসলাম রাসুলুল্লাহ সা. কর্তৃক আনিত আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে চলার নাম। এতে যে কমবেশ করবে সে প্রকৃত ইসলামের গণ্ডি থেকে বের হয়ে যাবে।

‘হারব’ শব্দের সাধারণ অর্থ যুদ্ধ। তবে এর আরও একাধিক অর্থ আছে। যেমন একটি অর্থ হলো বিদ্বেষ ও দূরত্ব। ‘দারুল হারব’ কথাটিতে এ দ্বিতীয় অর্থই উদ্দেশ্য, প্রথম অর্থ নয়। কেননা, ‘দারুল হারব’ হওয়ার জন্য যুদ্ধ-কবলিত দেশ হওয়া জরুরি নয়; বরং তথায় কুফরি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত থাকলেই তা ‘দারুল হারব’ বলে গণ্য হয়। তাই সাধারণভাবে ‘দারুল হারব’ বলতে যুদ্ধ-কবলিত রাষ্ট্র হওয়ার যে ধারণা প্রচলিত আছে, তা পুরোপুরি সঠিক নয়।

ইমাম আবুল ফজল শামসুদ্দিন বা’লি রহ. বলেন :
قوله: “الحَرْبِيُّ” مَنْسُوْبٌ إِلَى الْحَرْبِ، وَهُوَ القِتَالُ، وَدَارُ الْحَرْبِ، أَيْ: دَارُ التَّبَاعُدِ وَالْبَغْضَاءِ، فَالْحَرْبِيُّ بِالْاِعْتِبَارِ الثَّانِيْ.
‘“হারবি” কথাটি “হারব”-এর দিকে সম্বন্ধিত। “হারব” অর্থ যুদ্ধ, আর “দারুল হারব” অর্থ পরস্পরে দূরত্ব ও বিদ্বেষের দেশ। সুতরাং “হারবি” বলা হয় দ্বিতীয় অর্থের দিকে লক্ষ করে।’ (আল-মুতলি’ আলা আলফাজিল মুকনি’ : পৃ. নং ২৬৯, প্রকাশনী : মাকতাবাতুস সাওয়াদি)

বুঝা গেল, ‘দারুল হারব’ হওয়ার জন্য তথায় যুদ্ধ চলমান থাকা জরুরি নয়। ‘হারব’-এর প্রসিদ্ধ অর্থ ‘যুদ্ধ’ হলেও এখানে তার প্রসিদ্ধ অর্থ উদ্দেশ্য নেওয়া হয়নি; বরং এখানে ‘দূরত’ ও ‘বিদ্বেষ’ অর্থ উদ্দিষ্ট। কাফির-শাসিত রাষ্ট্রের সাথে যেহেতু মুসলমানদের কোনো সম্পর্ক ও হৃদ্যতা নেই; বরং তাদের সাথে রয়েছে বিদ্বেষ ও শত্রুতার সম্পর্ক, তাই তাদের রাষ্ট্রকে ইসলামি পরিভাষায় ‘দারুল হারব’ বলা হয়।

অবশ্য ‘হারব’-এর প্রসিদ্ধ অর্থ ধরেও এর একটি ব্যাখ্যা করা যায়। সেটি হলো, ‘দারুল হারব’ অর্থ আমরা যুদ্ধের দেশ বা যুদ্ধ-কবলিত দেশও বলতে পারি। কেননা, এখানে বর্তমানে যুদ্ধ না থাকলেও এর উপযুক্ত হওয়াই তার এ নাম হওয়ার জন্য যথেষ্ট। কাফির-শাসিত রাষ্ট্র পদানত করে তথায় আল্লাহর কালিমা প্রতিষ্ঠা করা যেহেতু ইসলামের নির্দেশ, বিধায় সেটাকে রূপক অর্থে যুদ্ধের দেশ বলতে কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। অর্থাৎ বর্তমানে যুদ্ধ না থাকলেও সেটা যুদ্ধের উপযুক্ত একটি রাষ্ট্র। যেমন আমরা বলে থাকি, ‘ভাত রান্না হচ্ছে’। মূলত রান্না করা হয় চাল, কিন্তু সেটা যেহেতু শীঘ্রই ভাতে রূপান্তরিত হতে যাচ্ছে, বিধায় অগ্রীম তাকে ‘ভাত’ নামেও ডাকা হয়। কাফিরদের রাষ্ট্রের বিষয়টিও ঠিক এমনই। তথায় যুদ্ধ না থাকলেও ইসলামের দাবি অনুসারে শীঘ্রই তাদের সাথে যুদ্ধে জড়াতে হবে, সে হিসেবে অগ্রীম সে দেশকে ‘দারুল হারব’ বা যুদ্ধের রাষ্ট্র বলা পুরোপুরিই যৌক্তিক।

উল্লেখ্য যে, ‘দারুল হারব’-কে ফুকাহায়ে কিরাম ‘দারুশ শিরক বা ‘দারুল কুফর’ অভিধায়ও অভিহিত করে থাকেন। এ থেকেও প্রমাণ হয় যে, ‘দারুল হারব’ বলতে বাস্তবিক যুদ্ধ-কবলিত দেশ হওয়া জরুরি নয়। কেননা, পারিভাষিকভাবে ‘দারুশ শিরক’ বা ‘দারুল কুফর’ হলো তার সমর্থক শব্দ। আর এ দুটি শব্দের মধ্যে যুদ্ধের অর্থ নেই। অতএব, শুধু ‘দারুল হারব’ শব্দ দেখেই এ ধারণা করা ভুল হবে যে, দারুল হারব হওয়ার জন্য রাষ্ট্রকে প্রকৃতই যুদ্ধে লিপ্ত থাকতে হবে। এছাড়াও এ দুটি অতিরিক্ত শব্দ থেকে এর পারিভাষিক অর্থের ইঙ্গিতও পাওয়া যায়। কেননা, যেরকমভাবে ‘দারুল ইসলাম’ পরিভাষাটিতে ‘দার’ শব্দটিকে ইসলামের দিকে ইজাফত করা হয়েছে বিধায় তার সংজ্ঞায় বলা হয়, যে রাষ্ট্রে ইসলামি বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত থাকবে, সেটাই ‘দারুল ইসলাম’। অনুরূপ ‘দারুল কুফর বা ‘দারুশ শিরক’ পরিভাষাদ্বয়েও ‘দার’ শব্দটিকে কুফর বা শিরকের দিকে ইজাফত করা হয়েছে বিধায় তার সংজ্ঞায় বলা হবে যে, যে রাষ্ট্রে কুফরি বা শিরকি বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত থাকবে, সেটাই ‘দারুল কুফর’ বা ‘দারুশ শিরক’। বস্তুত ‘দারুল কুফর’, ‘দারুশ শিরক ও ‘দারুল হারব’―এ তিনটির মাঝে শাব্দিক ব্যবধান ছাড়া পরিভাষাগত কোনো পার্থক্য নেই।

পারিভাষিক অর্থ :

কোনো সন্দেহ নেই যে, ‘দার’-এর পরিচয়ের ক্ষেত্রে মূল দেখার বিষয় হলো, কর্তৃত্ব, শক্তি ও রাজত্ব কার। যার রাজত্ব ও শাসনব্যবস্থা জারি থাকবে, তার ভিত্তিইে ‘দার’-কে দারুল ইসলাম বা দারুল হারব বলা হবে। এখানে অন্য কোনো বিষয়, যেমন : নিজ ধর্মের জনসংখ্যা বেশি হওয়া, ধর্মের কিছু বিধান পালন করার সুযোগ থাকা ইত্যাদি বিবেচ্য হবে না। এগুলোর কারণে ‘দার’-এর বিধানে কোনোরূপ পরিবর্তন আসবে না। বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য আমরা এখানে ‘দার’-এর সংজ্ঞা নিয়ে ফুকাহায়ে কিরামের উক্তিগুলো তুলে ধরছি।

১. ইমাম মালিক রহ. মক্কা বিজয়ের পূর্বের মক্কার ব্যাপারে বলেন :
وَكَانَتْ الدَّارُ يَوْمئِذٍ دَارَ الْحَرْبِ لِأَنَّ أَحْكَامَ الْجَاهِلِيَّةِ كَانَتْ ظَاهِرَةً يَوْمئِذٍ.
‘আর সেসময় মক্কা ছিল দারুল হারব। কেননা, তখন (মক্কায়) জাহিলি যুগের (কুফরি) আইন ও সংবিধান প্রতিষ্ঠিত ছিল। (আল-মুদাওওয়ানাতুল কুবরা : ১/৫১১, প্রকাশনী : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরুত)

ইমাম জাসসাস রহ. বলেন :
حُكْمُ الدَّارِ إِنَّمَا يَتَعَلَّقُ بِالظُّهُوْرِ وَالْغَلَبَةِ، وَإِجْرَاءِ حُكْمِ الدِّيْنِ بِهَا، وَالدَّلِيْلُ عَلَى صِحَّةِ ذَلِكَ: أَنَّا مَتَى غَلَبْنَا عَلَى دَارِ الْحَرْبِ، وَأَجْرَيْنَا أَحْكَامَنَا فِيْهَا: صَارَتْ دَارَ الْإِسْلَامِ، سَوَاءٌ كَانَتْ مُتَاخِمَةً لِدَارِ الْإِسْلَامِ أَوْ لَمْ تَكُنْ، فَكَذَلِكَ الْبَلَدُ مِنْ دَارْ الْإِسْلَامْ، إِذَا غَلَبَ عَلَيْهِ أَهْلُ الْكُفْرِ، وَجَرَى فِيْهِ حُكْمُهُمْ: وَوَجَبَ أَنْ يَكُوْنَ مِنْ دَارِ الْحَرْبِ. وَلَا مَعْنَى لِاِعْتِبَارِ بَقَاءِ ذِمِّيٍّ أَوْ مُسْلِمٍ آَمِنًا عَلَى نَفْسِهِ؛ لِأَنَّ الْمُسْلِمَ قَدْ يَأْمَنُ فِيْ دَارِ الْحَرْبِ، وَلَا يَسْلِبُهُ ذَلِكَ حُكْمَ دَارِ الْحَرْبِ، وَلَا يُوْجِبُ أَنْ يَكُوْنَ مِنْ دَارِ الْإِسْلَامِ.
‘“দার”-এর হুকুম বিজয়, কর্তৃত্ব ও কোনো ধর্মের শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার সাথে সম্পর্কিত। এ দাবির পক্ষে দলিল হলো, আমরা যখন “দারুল হারব” এর ওপর বিজয়ী হই এবং তথায় আমাদের শাসনব্যবস্থা চালু করি, তখন সেটা “দারুল ইসলাম” হয়ে যায়; চাই সে রাষ্ট্রটি কোনো “দারুল ইসলাম” এর সংলগ্ন হোক বা না হোক। তাহলে অনুরূপ “দারুল ইসলাম”-এর কোনো শহরের ওপর যখন কাফিররা বিজয়ী হবে এবং তথায় তাদের কুফরি শাসনব্যবস্থা চালু হবে, তাহলে সেটা অবশ্যই “দারুল হারব”-এ পরিণত হয়ে যাবে। মুসলিম ও জিম্মিদের পূর্বের নিরাপত্তাচুক্তিতে তাদের নিরাপদ থাকাকে বিবেচনা করার কোনোই যৌক্তিকতা নেই। কেননা, মুসলমানও তো কখনও কখনও “দারুল হারব”-এ নিরাপদ থাকে; অথচ এর কারণে এটা রাষ্ট্রকে “দারুল হারব” হওয়া থেকে বের করে দেয় না এবং “দারুল ইসলাম”-এ রূপান্তরিত হয়ে যাওয়াকে আবশ্যক করে না।’ (শারহু মুখতাসারিত তাহাবি : ৭/২১৬-২১৭, প্রকাশনী : দারুল বাশাইরিল ইসলামিয়্যা, বৈরুত)

৩. ইমাম সারাখসি রহ. স্বীয় ‘মাবসুত’-এ সাহিবাইনের-এর পক্ষ থেকে দলিল দিয়ে বলেন :
الْبُقْعَة إنَّمَا تُنْسَبُ إلَيْنَا أَوْ إلَيْهِمْ بِاعْتِبَارِ الْقُوَّةِ وَالْغَلَبَةِ، فَكُلُّ مَوْضِعٍ ظَهَرَ فِيهِ حُكْمُ الشِّرْكِ فَالْقُوَّةُ فِي ذَلِكَ الْمَوْضِعِ لِلْمُشْرِكِينَ فَكَانَتْ دَارَ حَرْبٍ، وَكُلُّ مَوْضِعٍ كَانَ الظَّاهِرُ فِيهِ حُكْمُ الْإِسْلَامِ فَالْقُوَّةُ فِيهِ لِلْمُسْلِمِينَ.
‘স্থান আমাদের (মুসলমানদের) সাথে বা তাদের (কাফিরদের) সাথে সম্পৃক্ত হয় শক্তি ও বিজয়ের ভিত্তিতে। অতএব, যে জায়গায় শিরকের সংবিধান প্রতিষ্ঠিত থাকবে, বুঝতে হবে সেখানে মুশরিকদের শক্তি বিজয়ী; বিধায় সেটা হবে “দারুল হারব”। আর যে জায়গায় ইসলামের সংবিধান বিজয়ী থাকবে, বুঝতে হবে সেখানে মুসলমানদের শক্তি বিজয়ী।’ (আল-মাবসুত, সারাখসি : ১০/১১৪, প্রকাশনী : দারুল মারিফা, বৈরুত)

তিনি শারহুস সিয়ারে আরও বলেন :
الْمَوْضِع الَّذِي لَا يَأْمَنُ فِيهِ الْمُسْلِمُونَ مِنْ جُمْلَةِ دَارِ الْحَرْبِ، فَإِنَّ دَارَ الْإِسْلَامِ اسْمٌ لِلْمَوْضِعِ الَّذِي يَكُونُ تَحْتَ يَدِ الْمُسْلِمِينَ، وَعَلَامَةُ ذَلِكَ أَنْ يَأْمَنَ فِيهِ الْمُسْلِمُونَ.
‘যে স্থানে মুসলমানরা নিরাপদ নয়, সেটাও “দারুল হারব”-এর অন্তর্গত। কেননা, “দারুল ইসলাম” বলা হয় ওই জায়গাকে, যা মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে আছে। আর এর নিদর্শন হলো, তথায় মুসলমানরা নিরাপদে থাকবে।’ (শারহুস সিয়ারিল কাবির : পৃ. নং ১২৫৩, প্রকাশনী : আশ-শিরকাতুশ শারকিয়্যা)

তিনি আরও বলেন :
الْمُعْتَبَرَ فِي حُكْمِ الدَّارِ هُوَ السُّلْطَانُ فِي ظُهُورِ الْحُكْمِ
‘“দার” নির্ণয়ের ক্ষেত্রে মূল বিবেচ্য বিষয় হলো শাসন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে (ইসলাম বা কুফরের) কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা।’ (শারহুস সিয়ারিল কাবির : পৃ. নং ১৭০৩, প্রকাশনী : আশ-শিরকাতুশ শারকিয়্যা)

৪. ইমাম ইবনে হাজাম রহ. বলেন :
الدَّارَ إنَّمَا تُنْسَبُ لِلْغَالِبِ عَلَيْهَا، وَالْحَاكِمُ فِيهَا، وَالْمَالِكُ لَهَا.
‘দেশকে (ইসলাম বা কুফরের দিকে) সম্বন্ধিত করা হয় দেশটির বিজয়ী শক্তি, শাসক ও অধিকারীর ভিত্তিতে।’ (আল-মুহাল্লা : ১২/১২৬, প্রকাশনী : দারুল ফিকর, বৈরুত)

৫. ইমাম কাসানি রহ. সাহিবাইনের পক্ষে দলিল পেশ করতে গিয়ে বলেন :
أَنَّ قَوْلَنَا دَارُ الْإِسْلَامِ وَدَارُ الْكُفْرِ إضَافَةُ دَارٍ إلَى الْإِسْلَامِ وَإِلَى الْكُفْرِ، وَإِنَّمَا تُضَافُ الدَّارُ إلَى الْإِسْلَامِ أَوْ إلَى الْكُفْرِ لِظُهُورِ الْإِسْلَامِ أَوْ الْكُفْرِ فِيهَا، كَمَا تُسَمَّى الْجَنَّةُ دَارَ السَّلَامِ، وَالنَّارُ دَارَ الْبَوَارِ؛ لِوُجُودِ السَّلَامَةِ فِي الْجَنَّةِ، وَالْبَوَارِ فِي النَّارِ وَظُهُورُ الْإِسْلَامِ وَالْكُفْرِ بِظُهُورِ أَحْكَامِهِمَا، فَإِذَا ظَهَرَ أَحْكَامُ الْكُفْرِ فِي دَارٍ فَقَدْ صَارَتْ دَارَ كُفْرٍ فَصَحَّتْ الْإِضَافَةُ، وَلِهَذَا صَارَتْ الدَّارُ دَارَ الْإِسْلَامِ بِظُهُورِ أَحْكَامِ الْإِسْلَامِ فِيهَا مِنْ غَيْرِ شَرِيطَةٍ أُخْرَى، فَكَذَا تَصِيرُ دَارَ الْكُفْرِ بِظُهُورِ أَحْكَامِ الْكُفْرِ فِيهَا.
‘আমাদের “দারুল ইসলাম” ও “দারুল কুফর” কথা দুটিতে “দার”-কে ইসলাম ও কুফরের সাথে সম্পর্কিত করা হয়েছে। আর “দার”-কে ইসলাম ও কুফরের সঙ্গে সম্পর্কিত করা হয় তাতে ইসলাম কিংবা কুফর প্রতিষ্ঠিত থাকার কারণে। যেমন : জান্নাতকে “দারুস সালাম” এবং জাহান্নামকে “দারুল বাওয়ার” নামে ডাকা হয়; যেহেতু জান্নাতে সালাম বা শান্তি রয়েছে আর জাহান্নামে বাওয়ার বা ধ্বংস রয়েছে। আর ইসলাম ও কুফর প্রতিষ্ঠিত হয় তার আইনকানুন ও বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দ্বারা। অতএব, যখন কোনো ভূখণ্ডে কুফরি আইনকানুন ও বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত হবে, তখন তা “দারুল কুফর” হয়ে যাবে। তাই “দার”-কে এভাবে ইসলাম কিংবা কুফরের সাথে সম্পৃক্ত করাটা সঠিক। এজন্য ইসলামের বিধিবিধান প্রতিষ্ঠা লাভের দ্বারাই কোনো ভূখণ্ড “দারুল ইসলাম” হিসেবে গণ্য হয়। এই একটি মাত্র শর্ত ছাড়া এখানে আর কোনো শর্ত নেই। অনুরূপ “দারুল ইসলাম”-এ কুফরি বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দ্বারাই সেটা “দারুল কুফর”-এ রূপান্তরিত হয়।’ (বাদায়িউস সানায়ি : ৭/১৩০-১৩১, প্রকাশনী : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরুত)

৬. কাজি আবু ইয়ালা হাম্বলি রহ. বলেন :
كُلُّ دَارٍ كَانَـتِ الْغَلَبَةُ فِيْهَا لِأَحْكَامِ الْإِسْلَامِ دُوْنَ الْكُفْرِ فَهِىَ دَارُ الْإِسْلَامِ. وَكُلُّ دَارٍ كَانَـتِ الْغَلَبَةُ فِيْهَا لِأَحْكَامِ الْكُفْرِ دُوْنَ أَحْكَامِ الْإِسْلَامِ فَهِىَ دَارُ الْكُفْرِ.
‘প্রত্যেক এমন ভূখণ্ড, যেখানে ইসলামি বিধিবিধান বিজয়ী, কুফরি সংবিধান নয়, তা “দারুল ইসলাম”। আর প্রত্যেক এমন ভূখণ্ড, যেখানে কুফরি বিধিবিধান বিজয়ী, ইসলামি সংবিধান নয়, তা “দারুল কুফর”।’ (আল-মুতামাদ ফি উসুলিদ্দিন : পৃ. নং ২৭৬, প্রকাশনী : দারুল মাশরিক, বৈরুত)

৭. ইমাম ইবনে মুফলিহ মাকদিসি রহ. বলেন :
فَكُلّ دَار غَلَبَ عَلَيْهَا أَحْكَام الْمُسْلِمِينَ فَدَارُ الْإِسْلَام وَإِنْ غَلَبَ عَلَيْهَا أَحْكَام الْكُفَّار فَدَارُ الْكُفْر وَلَا دَارَ لِغَيْرِهِمَا
‘প্রত্যেক এমন ভূখণ্ড, যেখানে ইসলামের বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত, তা “দারুল ইসলাম”। আর যদি কোনো ভূখণ্ডে কুফরি বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত থাকে, তাহলে তা “দারুল কুফর”। এ দু’প্রকারের বাইরে আর কোনো “দার” নেই।’ (আল-আদাবুশ শারইয়্যা ওয়াল মিনহুল মারইয়্যা : ১/১৯০, প্রকাশনী : আলামুল কুতুব, বৈরুত)

৮. ইমাম ইবনে কাইয়িম জাওজিয়া রহ. অধিকাংশ ফকিহের মতামত উল্লেখ করত বলেন :
قَالَ الْجُمْهُورُ: دَارُ الْإِسْلَامِ هِيَ الَّتِي نَزَلَهَا الْمُسْلِمُونَ، وَجَرَتْ عَلَيْهَا أَحْكَامُ الْإِسْلَامِ، وَمَا لَمْ تَجْرِ عَلَيْهِ أَحْكَامُ الْإِسْلَامِ لَمْ يَكُنْ دَارَ إِسْلَامٍ، وَإِنْ لَاصَقَهَا، فَهَذِهِ الطَّائِفُ قَرِيبَةٌ إِلَى مَكَّةَ جِدًّا وَلَمْ تَصِرْ دَارَ إِسْلَامٍ بِفَتْحِ مَكَّةَ.
‘জমহুরে ফুকাহা বলেন, “দারুল ইসলাম” ওই ভূখণ্ডকে বলে, যেখানে মুসলমানরা বসবাস করে এবং তথায় ইসলামি বিধিবিধান চালু থাকে। আর যেখানে ইসলামি বিধিবিধান চালু থাকবে না, সেটা “দারুল ইসলাম” হবে না; যদিও তা দারুল ইসলামের সাথে লাগোয়া অঞ্চল হোক। দেখো এই যে মক্কার অদূরেই অবস্থিত তায়িফ, মক্কা বিজয় সত্ত্বেও সেটা “দারুল ইসলাম” হয়ে যায়নি।’ (আহকামু আহলিজ জিম্মাহ : ২/৭২৮, প্রকাশনী : রামাদি, দাম্মাম)

৯. আল্লামা মানসুর বিন ইউনুস হাম্বলি রহ. বলেন :
وَتَجِبُ الْهِجْرَةُ عَلَى مَنْ يَعْجِزُ عَنْ إظْهَارِ دِينِهِ بِدَارِ الْحَرْبِ، وَهِيَ مَا يَغْلِبُ فِيهَا حُكْمُ الْكُفْرِ
‘“দারুল হারব”-এ অবস্থান করে যে ব্যক্তি দ্বীন প্রকাশ্যে পালন করতে অক্ষম হবে, তার জন্য হিজরত করা আবশ্যক। আর “দারুল হারব” হলো এমন ভূখণ্ড, যেখানে কুফরের সংবিধান বিজয়ী।’ (কাশশাফুল কিনা’ আনিল ইকনা’ : ৩/৪৩, প্রকাশনী : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরুত)

১০. ইমাম আবুল হাসান আলাউদ্দিন মুরাদাবি রহ. বলেন :
وَدَارُ الْحَرْبِ: مَا يَغْلِبُ فِيهَا حُكْمُ الْكُفْرِ.
‘আর “দারুল হারব” ওই ভূখণ্ডকে বলে, যেখানে কুফরি সংবিধান বিজয়ী থাকে।’ (আল-ইনসাফ ফি মারিফাতির রাজিহি মিনাল খিলাফ : ৪/১২১, প্রকাশনী : দারু ইহইয়াইত তুরাসিল আরাবিয়্যি, বৈরুত)

১১. ইমাম ইবনে কুদামা রহ. বলেন :
وَمَتَى ارْتَدَّ أَهْلُ بَلَدٍ، وَجَرَتْ فِيهِ أَحْكَامُهُمْ، صَارُوا دَارَ حَرْبٍ فِي اغْتِنَامِ أَمْوَالِهِمْ، وَسَبْيِ ذَرَارِيِّهِمْ الْحَادِثِينَ بَعْدَ الرِّدَّةِ، وَعَلَى الْإِمَامِ قِتَالُهُمْ،
‘যখন কোনো শহরবাসী মুরতাদ হয়ে যাবে এবং তাদের মাঝে তাদের (কুফরি) সংবিধান চালু করবে তখন তাদের সম্পদ গনিমত হওয়া এবং মুরতাদ হওয়ার পর জন্মগ্রহণ করা সন্তান-সন্তুতিকে দাস-দাসী বানানোর ক্ষেত্রে তারা সবাই “দারুল হারব”-এর অধিবাসী বলে বিবেচিত হবে। আর মুসলিম খলিফার ওপর তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা আবশ্যক হয়ে যাবে।’ (আল-মুগনি : ৯/১৭, প্রকাশনী : মাকতাবাতুল কাহিরা, মিশর)

১২. আল্লামা শাওকানি রহ. বলেন :
اَلْاِعْتِبَارُ بِظُهُوْرِ اْلكَلِمَةِ فَإِنْ كَانَتِ الْأَوَامِرُ وَالنَّوَاهِيْ فِي الدَّارِ لِأَهْلِ الْإِسْلِامِ بِحَيْثُ لَا يَسْتَطِيْعُ مَنْ فِيْهَا مِنَ الْكُفَّارِ أَنْ يَتَظَاهَرَ بِكُفْرِهِ إِلاَّ لِكَوْنِهِ مَأْذُوْنًا لَهُ بِذَلِكَ مِنْ أَهْلِ الْإِسْلَامِ فَهَذِهِ دَارُ إِسْلَامٍ وَلَا يَضُرُّ ظُهُوْرُ الْخِصَالِ الْكُفْرِيَّةِ فِيْهَا لِأَنَّهَا لَمْ تَظْهَرْ بِقُوَّةِ الْكُفَّارِ وَلَا بِصَوْلَتِهِمْ كَمَا هُوَ مُشَاهَدٌ فِيْ أَهْلِ الذِّمَّةِ مِنَ الْيَهُوْدِ وَالنَّصَارَى وَالْمُعَاهِدِيْنَ السَّاكِنِيْنَ فِي الْمَدَائِنِ الْإِسْلَامِيَّةِ وَإِذَا كَانَ الْأَمْرُ الْعَكْسَ فَالدَّارُ بِالْعَكْسِ.
‘ধর্মের বিজয়ের ভিত্তিতে “দার” বিবেচ্য হবে। অতএব, যদি কোনো ভূখণ্ডে আদেশ-নিষেধ জাতীয় সকল আইন-কানুন মুসলিমদের হয়, তথায় অবস্থানকারী কাফিররা মুসলিমদের পক্ষ থেকে অনুমতিপ্রাপ্ত হওয়া ছাড়া কুফরি কোনো কাজ করার ক্ষমতা রাখে না, তাহলে এটা হলো “দারুল ইসলাম”। এ ভূখণ্ডে কিছু কুফরি কাজকর্মের অস্তিত্ব থাকায় “দারুল ইসলাম” হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হবে না। কেননা, এসব কুফরি কাজ কাফিরদের শক্তি ও দাপটের ভিত্তিতে প্রকাশ হয়নি; যেমনটি ইসলামি রাষ্ট্রে বসবাসরত ইহুদি, খ্রিষ্টান ও চুক্তিবদ্ধ অমুসলিম জিম্মিদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আর বিষয়টি যদি এর (তথা দারুল ইসলামের সংজ্ঞার) উল্টো হয়, তাহলে “দার”ও উল্টোটা (তথা “দারুল হারব”) হবে।’ (আস-সাইলুল জাররার : পৃ. নং ৯৭৬, প্রকাশনী : দারু ইবনি হাজাম)

১৩. সাইয়িদ কুতুব শহিদ রহ. বলেন :
يَنْقَسِمُ الَعَالَمُ فِيْ نَظَرَ الْإِسْلَامِ وَفِيْ اعْتِبَارِ الْمُسْلِمِ إِلَى قِسْمَيْنِ اثْنَيْنِ لَا ثَالِثَ لَهُمَا. اَلْأَوَّلُ : دَارَ الْإِسْلَامِ. وَتشْمِلُ كُلَّ بَلَدٍ تُطَبَّقُ فِيْهِ أَحْكَامُ الْإِسْلَامِ، وَتَحْكُمُهُ شَرِيْعَةُ الْإِسْلَامِ… فَالْمَدَارُ كُلُّهُ فِي اعْتِبَارِ بَلَدٍ مَّا دَارَ إِسْلَامٍ هُوَ تَطْبِيْقُهُ لِأَحْكَامِ الْإِسْلَامِ وَحُكْمُهُ بِشَرِيْعَةِ الْإِسْلَامِ. اَلثَّانِيْ : دَارُ الْحَرْبِ. وَتَشْمِلُ كُلَّ بَلَدٍ لَا تُطَبَّقُ فَيْهِ أَحْكَامُ الْإِسْلَامِ، وَلَا يُحْكَمُ بَشَرِيْعَةِ الْإٍسْلَامِ… فَالْمَدَارُ كُلُّهُ فِي اعْتِبَارِ بَلَدٍ مَّا دَارَ حَرْبٍ هُوَ عَدَمُ تَطْبِيْقِهِ لِأَحْكَامِ الْإِسْلَامِ وَعَدَمُ حُكْمِهِ بِشَرِيْعَةِ الْإِسْلَامِ.
‘ইসলাম ও মুসলিমদের বিবেচনায় পুরো বিশ্ব দু’ভাগে বিভক্ত, যার তৃতীয় কোনো প্রকার নেই। প্রথম হলো “দারুল ইসলাম”। এটা প্রত্যেক এমন ভূখণ্ডকে অন্তর্ভুক্ত করে, যেখানে ইসলামি বিধিবিধান বাস্তবায়ন করা হয় এবং ইসলামি শরিয়া অনুযায়ী বিচার-ফয়সালা করা হয়। …সুতরাং কোনো দেশ “দারুল ইসলাম” হওয়ার মূলভিত্তি হলো ইসলামি বিধিবিধান বাস্তবায়ন করা এবং শরিয়া অনুসারে বিচার-ফয়সালা করা। দ্বিতীয় হলো “দারুল হারব”। এটা প্রত্যেক এমন ভূখণ্ডকে অন্তর্ভুক্ত করে, যেখানে ইসলামি বিধিবিধান বাস্তবায়ন করা হয় না এবং ইসলামি শরিয়া অনুযায়ী বিচার-ফয়সালা করা হয় না। …সুতরাং কোনো দেশ “দারুল হারব” হওয়ার মূলভিত্তি হলো ইসলামি বিধিবিধান বাস্তবায়ন না করা এবং শরিয়া অনুসারে বিচার-ফয়সালা না করা।’ (ফি জিলালিল কুরআন : ২/৩৪৮, প্রকাশনী : আল-মাকতাবাতুশ শামিলা)

১৪. শাইখ মুহাম্মাদ সাদকি বিন আহমাদ গাজ্জি বলেন :
دَارُ الْحَرْبِ هِيَ الدَّارُ الَّتِيْ لَا يَأْمَنُ فِيْهَا الْمُسْلِمُوْنَ، وَلَا يُحْكَمُ فِيْهَا بِشَرْعِ اللهِ، فَكُلُّ مَكَانٍ لَا يَأْمَنُ فَيْهِ الْمُسْلِمُوْنَ، وَلَا يُحْكَمُ فَيْهِ بِشَرْعِ اللهِ فَهُوَ مِنْ جُمْلَةِ دَارِ الْحَرْبِ.
‘“দারুল হারব” হলো ওই ভূখণ্ড, যেখানে মুসলমানরা নিরাপদ নয় এবং যেখানে আল্লাহর শরিয়ত অনুসারে বিচার-ফয়সালা করা হয় না। অতএব, যে জায়গায় মুসলিমরা নিরাপদ নয় এবং যেথায় আল্লাহর শরিয়ত অনুযায়ী বিচার করা হয় না, তা “দারুল হারব”-এর অন্তর্ভক্ত।’ (মাওসুআতুল কাওয়ায়িদিল ফিকহিয়্যা : ৯/১৭৬, প্রকাশনী : মুআসসাসাতুর রিসালা, বৈরুত)

তিনি আরও বলেন :
فَالْمَكَانُ وَالْمَوْضِعُ وَالْبِلَادُ الَّتِيْ لَا يَأْمَنُ فِيْهَا الْمُسْلِمُوْنَ عَلَى إِقَامَةِ شَعَائِرِ دِيْنِهِمْ وَعَلَى أَنْفُسِهِمْ وَأَعْرَاضِهِمْ وَأَمْوَالِهِمْ، وَلَا يُقَامُ فِيْهَا شَرْعُ اللهِ هُوَ دَارُ الْحَرْبِ، وَالْمَكَانُ الَذِيْ يَكُوْنُ تَحْتَ يَدِ الْمُسْلِمِيْنَ، وَفِيْهِ يَأْمَنُوْنَ، وَيُحْكَمُ فَيْهِ بِشَرْعِ اللهِ هُوَ دَارُ الْإِسْلَامِ.
‘অতএব যে স্থান, জায়গা ও দেশে মুসলমানরা নিজেদের দ্বীন পালন, জান, ইজ্জত সম্মানের ক্ষেত্রে নিরাপদ নয় এবং যেখানে আল্লাহর আইন বাস্তবায়ন করা হয় না, সেটাই হলো “দারুল হারব”। আর যে স্থান মুসলমানদের হাতে থাকবে, মুসলিমরা তথায় নিরাপদ থাকবে এবং সেখানে আল্লাহর আইন অনুসারে বিচার-ফয়সালা করা হবে, সেটা হলো “দারুল ইসলাম”।’ (মাওসুআতুল কাওয়ায়িদিল ফিকহিয়্যা : ১১/১১৪৪, প্রকাশনী : মুআসসাসাতুর রিসালা, বৈরুত)

এসব ফকিহ ও উসুলবিদদের ভাষ্য থেকে ‘দারুল ইসলাম’ ও ‘দারুল হারব’-এর অর্থ স্পষ্ট হয়ে যায় যে, জনগণের আধিক্য বা কিছু ধর্মীয় বিধিবিধান পালনের সুযোগ থাকার কারণেই কোনো দেশকে ‘দারুল ইসলাম’ বা ‘দারুল হারব’ বলা হবে না; বরং মূলে দেখতে হবে যে, সে দেশের সংবিধান ও শাসনক্ষমতা কাদের হাতে। যদি শাসনক্ষমতা মুসলিমদের হাতে থাকে এবং দেশের সংবিধান ও বিচারব্যবস্থা শরিয়ামতে চলে তাহলে সে দেশকে ‘দারুল ইসলাম’ বলা হবে। এক্ষেত্রে এটা বিবেচ্য নয় যে, দেশের অধিকাংশ জনগণের ধর্ম কী। চাই সবাই জিম্মি কাফির হোক বা সবাই মুসলিম হোক কিংবা কমবেশ করে উভয় শ্রেণির জনগণ থাকুক। এসবের কারণে ‘দারুল ইসলাম’ হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব ফেলবে না। এর বিপরীতে যদি দেশের শাসনক্ষমতা কাফিরদের হাতে থাকে কিংবা নামধারী মুসলমানের হাতে থাকলেও কুফরি ও মানবরচিত আইনে দেশ পরিচালনা করা হয় এবং শরিয়ার পরিবর্তে এসব মানবরচিত আইনেই বিচার-ফয়সালা করা হয়, তাহলে এটাকে ‘দারুল হারব’ বলা হবে। যদিও দেশের সিংহভাগ নাগরিক মুসলমান হোক এবং দেশে ব্যক্তিগত বিভিন্ন ইবাদত পালনের সুযোগ দেওয়া হোক।

ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল রহ. বলেন :
الدَّار إِذا ظهر فِيهَا القَوْل بِخلق الْقُرْآن وَالْقدر وَمَا يجْرِي مجْرى ذَلِك فَهِيَ دَار كفر
‘কোনো ভূখণ্ডে যখন কুরআন মাখলুক হওয়ার মতবাদ, তাকদির অস্বীকার করার মতাদর্শ এবং এ জাতীয় অন্য কোনো কুফরি, শিরকি আকিদা বিজয়ী হবে, তখন সেটাকে “দারুল কুফর” বলা হবে।’ (আল-আকিদা, আবু বকর আল-খাল্লাল : পৃ. নং ১২৪, প্রকাশনী : দারু কুতাইবা, দামেশক)

তৃতীয় আলোচনা : দারুল হারবের প্রকারভেদ
সব ‘দারুল হারব’ এক ক্যাটাগরির নয়। শ্রেণিগতভাবে ‘দারুল হারব’-এর নানা ভাগ রয়েছে। প্রথমত ‘দারুল হারব’-এ কুফরি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দিক থেকে ‘দারুল হারব’-কে দুভাগে ভাগ করা যায়। যথা :
এক. দারুল হারবিল আসলি। দুই. দারুল হারবিত তারি।

‘দারুল হারবিল আসলি’ বলা হয় এমন কুফরি রাষ্ট্রকে, যেখানে পূর্ব থেকেই কুফরি শাসনব্যবস্থা চলে আসছে। আগে বা পরে কখনো তথায় ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। যেমন : আমেরিকা, রাশিয়া, জাপান ইত্যাদি।

আর ‘দারুল হারবিত তারি’ বলা হয় এমন কুফরি রাষ্ট্রকে, যেখানে কখনো ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু পরবর্তী কালে মুসলমানদের গাফলতি বা অন্য কোনো কারণে ইসলামি শাসনব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়ে কুফরি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যেমন : স্পেন, ফ্রান্স, ইটালি, চীন, উত্তর আফ্রিকা ও হিন্দুস্তান ইত্যাদি।
এরপর ‘দারুল হারব’-এ কাফির বা মুরতাদদের অনৈসলামিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার বিষয়টি আবার দু’প্রকারের হতে পারে। যথা : এক. ইসতি’লায়ে কামিল। দুই. ইসতি’লায়ে নাকিস

‘ইসতি’লায়ে কামিল’ বলা হয় এমন কর্তত্বকে, যা নিজেদের কুফরি আইন ও শাসনব্যবস্থার বিপরীতে ভিন্ন কোনো আইন বা বিধানের স্বীকৃতি দেয় না। বরং ভিন্ন কোনো আইন ও নিয়মকানুন অনুসরণ করলে তাকে হত্যা, বা বন্দী করা হয় এবং তাকে চরম নির্যাতনের সম্মুখীন হতে হয়। যেমন : চীন, উত্তর কোরিয়া ইত্যাদি রাষ্ট্রগুলোতে করা হয়ে থাকে।

আর ইসতিলায়ে নাকিস বলা হয় এমন কর্তত্বকে, যা নিজেদের কুফরি আইন-কানুন প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি ভিন্নধর্মীদের জন্য সীমিত পরিসরে ধর্ম পালন করার সুযোগও দিয়ে থাকে। তবে শর্ত হলো, সেটা তাদের কুফরি আইন-কানুন ও দর্শনের সাথে সাংঘর্ষিক হতে পারবে না। যেমন : তাতারিদের যুগে শাম ও পাশ্ববর্তী কিছু অঞ্চলের ক্ষেত্রে এমনটা দেখা গিয়েছিল এবং যেরকমভাবে বর্তমানে বিভিন্ন গণতান্ত্রিক কুফরি রাষ্টসমূহে দেখা যায়। মোটকথা, এসব অঞ্চলে যদিওবা ইসলামি কিছু বিধিবিধান পালনের সুযোগ থাকে, কিন্তু সেটা মুসলমানদের কর্তত্বের বলে নয়; বরং কাফির ও তাগুত শাসকেরা এর অনুমোদন দেওয়াতেই সেটা সম্ভব হয়। তাই এমন কিছু ইবাদত পালনের সুযোগ পাওয়াতে সে দেশকে ‘দারুল ইসলাম’ বলা যাবে না।

আল্লামা সিদ্দিক হাসান খান রহ. বলেন :
فمتى علمنا يقينًا ضروريًا بالمشاهدة أو السّماع المتواتر أنّ الكفّارَ استولوا على بلدٍ مِن بلاد الإسلام التي تليهم، وغلبوا عليها وقهروا أهلَها، بحيث لا يتمُّ لهم إبرازُ كلمة الإسلام إلا بجوارٍ مِن الكفّار: صارت دارَ حرب وإن أقيمت فيها الصّلاة.
‘অতএব, যখন আমরা সরাসরি পর্যবেক্ষণ বা পারম্পরিক ধারায় শ্রবণের মাধ্যমে সুনিশ্চিতভাবে জানতে পারব যে, কাফিররা তাদের পাশ্ববর্তী কোনো ইসলামি রাষ্ট্রের ওপর কতৃত্ব অর্জন করে বিজয় অর্জন করেছে এবং এর নাগরিকদের এমনভাবে পরাজিত করেছে যে, কাফিরদের নিরাপত্তাপ্রাপ্তি ছাড়া তাদের প্রকাশ্যে ইসলামের কালিমা বলারও সুযোগ নেই, তখন সেটা দারুল হারব বলেই বিবেচিত হবে; যদিও তথায় নামাজ প্রতিষ্ঠা করা হোক।’ (আল-ইবরাতু মিম্মা জাআ বিল-গাজবি ওয়াশ-শাহাদাতি ওয়াল-হিজরাহ : পৃ. নং ২৩৬-২৩৭, প্রকাশনী : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরুত)

উল্লেখ্য যে, দারুল হারব চাই আসলি হোক বা তারি, অনুরূপ তাতে ইসতিলায়ে কামিল থাকুক বা নাকিস―সর্বাবস্থায়ই এ দেশগুলোর সাথে ‘দারুল হারব’-এর মতোই আচরণই করা হবে। যদিও এসব দেশে বসবাস করা বা হিজরতের আবশ্যকীয়তার মাঝে এ প্রকারগুলো বিধানগত কিছুটা পার্থক্য সৃষ্টি করবে। অতএব, যারা কোনো দেশে শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম নাগরিক কিংবা দেশে কিছু ইসলামি বিধিবিধান পালনের সুযোগ থাকায় দেশকে দারুল ইসলাম বলে মনে করে, তাদের এ মাসআলায় বড় ধরনের ভ্রম ঘটেছে।

নিরাপত্তার দিক থেকে আবার ‘দারুল হারব’ দুপ্রকারের। যথা : দারুল খাওফ ও দারুল আমান। ‘দারুল খাওফ’ এমন কুফরি রাষ্ট্রকে বলা হয়, যাদের সাথে ইসলামি রাষ্ট্রের কোনো নিরাপত্তাচুক্তি নেই। এমন রাষ্ট্রে যেহেতু মুসলমানদের কোনো নিরাপত্তা থাকে না, তাই এটাকে দারুল খাওফ বা ভীতির রাষ্ট্র বলা হয়। আর ‘দারুল আমান’ এমন কুফরি রাষ্ট্রকে বলা হয়, যাদের সাথে ইসলামি রাষ্ট্রের কোনো নিরাপত্তাচুক্তি আছে। এর কারণে তথায় মুসলমানেরা নিরাপদে চলাফেরা ও ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারে।

উল্লেখ্য যে, ফিকহের কিতাবগুলোতে ‘দারুল আমান’ বলতে ‘দারুল হারব’-এর একটি প্রকার বুঝানো হলেও বর্তমানে কিছু মানুষ এটাকে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি ‘দার’ হিসেবে দাবি করে থাকে। অথচ এটা সম্পূর্ণ ভুল একটি দাবি, যা ফিকহের এসব অধ্যায়ের সাথে সামান্য সম্পর্ক রাখে, এমন যেকোনো তালিবুল ইলমের জানা থাকার কথা। বিষয়টি যেহেতু বেশ প্রসিদ্ধি লাভ করেছে, তাই এখানে সংক্ষেপে এটা নিয়ে সামান্য আলোচনা তুলে ধরছি।

দারুল আমান ও তার হাকিকত :

অধুনা সময়ের কিছু কিছু আলিমের মুখে শুনতে পাওয়া যায়, ‘দার’ তিন প্রকারের। এক. দারুল ইসলাম, দুই. দারুল হারব, তিন. দারুল আমান। এ প্রসঙ্গে আমরা দুটি বিষয় নিয়ে কথা বলব। প্রথমত, ফুকাহায়ে কিরামের পরিভাষায় ‘দারুল ইসলাম’ ও ‘দারুল হারব’―এ দুটির বাইরে ‘দারুল আমান’ বলে তৃতীয় কোনো ‘দার’-এর অস্তিত্ব আছে কিনা, সেটা দেখানো। দ্বিতীয়ত, ‘দারুল আমান’ বলতে কী বুঝায় এবং এটার প্রকৃত অর্থ কী।

প্রথম কথা হলো, শরিয়তের পরিভাষায় ‘দার’-এর প্রকারভেদ দুটিই। যথা : দারুল ইসলাম ও দারুল হারব। এখানে এ দুটির বিপরীতে ‘দারুল আমান’ বলে তৃতীয় কোনো ‘দার’ নেই। মানুষ যেমন হয় মুমিন, নয় কাফির হবে, এখানে তৃতীয় কোনো প্রকার নেই; অনুরূপ রাষ্ট্র হয় ‘দারুল ইসলাম’ হবে নয় ‘দারুল হারব’ হবে, এর তৃতীয় কোনো প্রকার নেই। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকিদামতে ইসলাম ও কুফরের মাঝে যেমন তৃতীয় কোনো স্তর নেই, ঠিক তেমনই ‘দারুল ইসলাম’ ও ‘দারুল হারব’ এর মাঝেও তৃতীয় কোনো স্তর নেই, যা ‘দারুল ইসলাম’ও হবে না, আবার ‘দারুল হারব’ও হবে না। এ ব্যাপারে আমরা ফুকাহায়ে কিরামের উক্তিসমূহ তুলে ধরছি।

কাজি আবু ইয়ালা হাম্বলি রহ. বলেন :
وَدَلِيْلُنَا مَا تَقَدَّمَ فِيْ مَسَائِلِ الْإِيْمَانٍ وًأًنًّ سًائِرَ الْمُكَلَّفِيْنَ لَا يَخْلُوْ مِنْ أَنْ يَكُوْنُوْا كُفَّارًا أَوْ مُؤْمِنِيْنَ كَامِلِي الْإِيْمَانِ أَوْ نَاقِصِي الْإِيْمَانِ أَوْ بَعْضُهُمْ كُفَّارًا وَبَعْضُهُمْ مُؤْمِنِيْنَ. وَلَا يَجُوْزُ كَوْنُ مُكَلَّفٍ لَيْسَ بِمُؤْمِنٍ وَلَا كَافِرٍ كَذَلِكَ الدَّارُ أَيْضًا لَا يَخْلُوْ مِنْ أَنْ تَكُوْنَ دَارَ كُفْرٍ أَوْ دَارَ إِسْلَامٍ.
‘আর আমাদের দলিল হলো যা ইমানের মাসায়িলের আলোচনায় বিগত হয়েছে। আরেকটি দলিল হলো, সকল মুকাল্লাফ (শরিয়তের বিধান মানতে আদিষ্ট ব্যক্তি) দুই অবস্থা থেকে মুক্ত হতে পারবে না। হয় সবাই কাফির হবে, নয়তো সবাই মুমিন হবে; চাই পরিপূর্ণ ইমানের অধিকারী হোক বা অপরিপূর্ণ ইমানের অধিকারী হোক। অথবা আংশিক কাফির আর আংশিক মুমিন হবে। কিন্তু এমনটা হওয়ার কোনোই অবকাশ নেই যে, কোনো মুকাল্লাফ মুমিনও হবে না আবার কাফিরও হবে না। ঠিক অনুরূপ “দার”ও দুই অবস্থা থেকে মুক্ত নয়। হয় তা “দারুল কুফর” হবে নয়তো “দারুল ইসলাম” হবে।’ (আল-মুতামাদ ফি উসুলিদ্দিন : পৃ. নং ২৭৬, প্রকাশনী : দারুল মাশরিক, বৈরুত)

ইমাম ইবনে মুফলিহ মাকদিসি রহ. বলেন :
فَكُلّ دَار غَلَبَ عَلَيْهَا أَحْكَام الْمُسْلِمِينَ فَدَارُ الْإِسْلَام وَإِنْ غَلَبَ عَلَيْهَا أَحْكَام الْكُفَّار فَدَارُ الْكُفْر وَلَا دَارَ لِغَيْرِهِمَا
‘প্রত্যেক এমন ভূখণ্ড, যেখানে ইসলামের বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত, তা “দারুল ইসলাম”। আর যদি কোনো ভূখণ্ডে কুফরি বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত থাকে, তাহলে তা “দারুল কুফর”। এ দু’প্রকারের বাইরে আর কোনো “দার” নেই।’ (আল-আদাবুশ শারইয়্যা ওয়াল মিনহুল মারইয়্যা : ১/১৯০, প্রকাশনী : আলামুল কুতুব, বৈরুত)

সাইয়িদ কুতুব শহিদ রহ. বলেন :
يَنْقَسِمُ الَعَالَمُ فِيْ نَظَرَ الْإِسْلَامِ وَفِيْ اعْتِبَارِ الْمُسْلِمِ إِلَى قِسْمَيْنِ اثْنَيْنِ لَا ثَالِثَ لَهُمَا. اَلْأَوَّلُ : دَارَ الْإِسْلَامِ. وَتشْمِلُ كُلَّ بَلَدٍ تُطَبَّقُ فِيْهِ أَحْكَامُ الْإِسْلَامِ، وَتَحْكُمُهُ شَرِيْعَةُ الْإِسْلَامِ… اَلثَّانِيْ : دَارُ الْحَرْبِ. وَتَشْمِلُ كُلَّ بَلَدٍ لَا تُطَبَّقُ فَيْهِ أَحْكَامُ الْإِسْلَامِ، وَلَا يُحْكَمُ بَشَرِيْعَةِ الْإٍسْلَامِ.
‘ইসলাম ও মুসলিমদের বিবেচনায় পুরো বিশ্ব দুভাগে বিভক্ত, যার তৃতীয় কোনো প্রকার নেই। প্রথম হলো “দারুল ইসলাম”। এটা প্রত্যেক এমন ভূখণ্ডকে অন্তর্ভুক্ত করে, যেখানে ইসলামি বিধিবিধান বাস্তবায়ন করা হয় এবং ইসলামি শরিয়া অনুযায়ী বিচার-ফয়সালা করা হয়। …দ্বিতীয় হলো “দারুল হারব”। এটা প্রত্যেক এমন ভূখণ্ডকে অন্তর্ভুক্ত করে, যেখানে ইসলামি বিধিবিধান বাস্তবায়ন করা হয় না এবং ইসলামি শরিয়া অনুযায়ী বিচার-ফয়সালা করা হয় না।’ (ফি জিলালিল কুরআন : ২/৩৪৮, প্রকাশনী : আল-মাকতাবাতুশ শামিলা)

তবে হ্যাঁ, শরিয়তে ‘দারুল আমান’ বা ‘দারুল আহদ’ নামে একটি পরিভাষা আছে, কিন্তু সেটা ‘দারুল ইসলাম’ ও ‘দারুল হারব’-এর বিপরীতে তৃতীয় কোনো প্রকার নয়; বরং তা ‘দারুল হারব’-এরই একটি প্রকার মাত্র। কেননা, ফুকাহায়ে কিরাম ‘দারুল হারব’-কে দুভাগে ভাগ করেছেন। একটি হলো, ওই ‘দারুল হারব’, যাদের সাথে মুসলমানদের কোনো চুক্তি নেই এবং সেখানে মুসলমানরা নিরাপদ নয়। এটাকে বলা হয় ‘দারুল খাওফ’ বা ভীতির দেশ। দ্বিতীয় প্রকার হলো, ওই দারুল হারব, যেখানে মুসলমানদের নিরাপত্তা দেওয়ার বিষয়ে চুক্তি আছে। এটাকে ‘দারুল আমান’ বা ‘দারুল আহদ’ বা ‘দারুল মুওয়াদাআ’ তথা নিরাপত্তার দেশ বলা হয়।

এ ব্যাপারে বিশ্বের অন্যতম সেরা ফিকহি বোর্ড ‘মাজমাউল ফিকহিল ইসলামি’ তাদের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত এভাবে তুলে ধরেছে :
وَلَا فَرْقَ بَيْنَ دَارِ الْعَهْدِ وَدَارِ الْحَرْبِ إِلَّا مِنْ حَيْثُ إِنَّ الْأُوْلَى بَيْنَهَا وَبَيْنَ الْمُسْلِمِيْنَ مُعَاهَدَةُ سَلَامٍ، عَلَى حِيْنٍ لَا يُوْجَدُ هَذَا بِالنِّسْبَةِ لِلثَّانِيَةِ فَكَانَتْ دَارَ الْحَرْبِ يَتَوَقَّعُ مِنْهَا الْاِعْتِدَاءُ فِيْ أَيِّ وَقْتٍ، وَهُمَا عَدَا هَذَا دَارٌ وَاحِدَةٌ تُقَابِلُ دَارَ الْإِسْلَامِ، فَهُمَا لَا يَعْتَرِفَانِ بِهَذَا الدِّيْنِ، وَلَا عِبْرَةَ بِمَا يَكُوْنُ مِنْ تَفَاوُتٍ فِي الْعَقَائِدِ بَيْنَ أَهْلِ دَارِ الْعَهْدِ وَدَارِ الْحَرْبِ، فَهَذَا لَا يُؤَثِّرُ فِيْ أَنَّهُمَا دَارٌ وَاحِدَةٌ غَيْرُ إِسْلَامِيَّةٍ.
‘বস্তুত “দারুল আমান” ও “দারুল হারব” এর মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। শুধু এতটুকু যে, “দারুল আমান”-এর ক্ষেত্রে তাদের ও মুসলমানদের মাঝে শান্তিচুক্তি থাকে। কিন্তু “দারুল হারব”-এর ক্ষেত্রে এমন কোনো চুক্তি থাকে না। এর কারণে তাদের পক্ষ থেকে যেকোনো ধরনের সীমালঙ্ঘনের আশঙ্কার ভিত্তিতে সেটাকে (“দারুল আমান” না বলে) “দারুল হারব” বলা হয়। এ পার্থক্য ছাড়া মূলত এ দুটি (“দারুল হারব” ও “দারুল আমান”) একই, যা “দারুল ইসলাম”-এর বিপরীতে আসে। এ উভয় প্রকার রাষ্ট্রই দ্বীন ইসলামকে স্বীকার করে না। আর “দারুল আমান” ও “দারুল হারব”-এর মাঝে আকিদা ও বিশ্বাসগত যে ব্যবধান আছে, তা তেমন বিবেচ্য নয়। উভয় প্রকারই অনৈসলামিক রাষ্ট্র হওয়ার ব্যাপারে এটা কোনো প্রভাব ফেলবে না।’ (মাজাল্লাতু মাজমাইল ফিকহিল ইসলামি : ৭/১৭১১, প্রকাশনী : আল-মাকতাবাতুশ শামিলা)

ইমাম মুহাম্মাদ রহ. বলেন :
وَلَوْ أَنَّ الْمُوَادَعِينَ لَمْ يَخْرُجُوا إلَيْنَا حَتَّى أَغَارَ عَلَيْهِمْ أَهْلُ دَارِ حَرْبٍ أُخْرَى فِي دَارِهِمْ فَأَسَرُوا مَعَهُمْ أَسِيرًا ثُمَّ ظَهَرَ الْمُسْلِمُونَ عَلَيْهِمْ فَاسْتَنْقَذُوهُمْ مِنْ أَيْدِيهِمْ، كَانُوا عَبِيدًا لِلْمُسْلِمِينَ؛ لِأَنَّهُمْ مَا كَانُوا أَصَابُوهُمْ مِنْ دَارِ الْإِسْلَامِ، فَإِنَّ دَارَ الْمُوَادَعِينَ دَارُ الْحَرْبِ، لَا يَجْرِي فِيهَا حُكْمُ الْمُسْلِمِينَ.
‘যদি চুক্তিবদ্ধ কাফিররা আমাদের নিকট না এসে থাকে (বরং তাদের দেশেই অবস্থান করে); ইতিমধ্যে অন্য কোনো “দারুল হারব”-এর কাফিররা তাদের দেশে আকস্মিক আক্রমন করে তাদের লোকদেরকে বন্দী করে নিয়ে যায়, অতঃপর মুসলিমরা ওই আক্রমণকারী কাফিরদের (সাথে যুদ্ধ করে তাদের) ওপর বিজয় অর্জন করে এবং ওই সব বন্দীদের মুক্ত করে আনে, তাহলে এসব বন্দী মুসলমানদের দাস হিসেবে বিবেচিত হবে। কেননা, মুসলমানেরা তো “দারুল ইসলাম” থেকে তাদের বন্দী করে আনেনি। যেহেতু চুক্তিবদ্ধ কাফিরদের দেশ তো (প্রকৃত অর্থে) “দারুল হারব”, যেখানে মুসলমানদের শাসন কার্যকর নয়।’ (আস-সিয়ারুল কাবির মাআ শারহিস সারাখসি :৫/১৮৯৩, প্রকাশনী : আশ-শিরকাতুশ শারকিয়্যা)

এ বর্ণনা থেকে অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে প্রমাণ হয় যে, ‘দারুল আমান’ বা চুক্তিবদ্ধ কাফির রাষ্ট্র আলাদা কোনো প্রকার নয়; বরং সেটাও ‘দারুল হারব’-এরই অন্তর্ভুক্ত। আমরা পূর্বে বলে এসেছি যে, ‘দারুল হারব’ মূলত দু’প্রকার। এক. ‘দারুল খাওফ’ বা ভীতির দেশ। অর্থাৎ কাফির-শাসিত যে রাষ্ট্রের সাথে মুসলমানদের নিরাপত্তাচুক্তি নেই, সেটা হলো ‘দারুল হারব’-এর প্রথম প্রকার ‘দারুল খাওফ’। দুই. ‘দারুল আমান’ বা নিরাপত্তার দেশ। অর্থাৎ কাফির-শাসিত যে রাষ্ট্রের সাথে মুসলমানদের নিরাপত্তাচুক্তি আছে, সেটা হলো ‘দারুল হারব’-এর দ্বিতীয় প্রকার ‘দারুল আমান’। অতএব, যারা ‘দারুল আমান’-কে ‘দারুল ইসলাম’ ও ‘দারুল হারব’-এর বিপরীতে তৃতীয় একটি প্রকার বলে প্রচার করে, তারা অজ্ঞতাবশত বা ভুল বুঝে এমনটা বলে থাকে, যার সাথে বাস্তবতার কোনো সম্পর্ক নেই।

চতুর্থ আলোচনা : দারুল ইসলাম ও দারুল হারবের রূপান্তর
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ‘দারুল হারব’ কখন ‘দারুল ইসলাম’-এ পরিণত হয় এবং ‘দারুল ইসলাম’ কখন ‘দারুল হারব’-এ পরিণত হয়, তা জানা। এ দুটির মধ্যে একটি মাসআলা মুত্তাফাক আলাইহি বা ঐকমত্যপূর্ণ। আরেকটি মাসআলা হলো কিছুটা মুখতালাফ ফিহ বা মতানৈক্যপূর্ণ। ঐকমত্যপূর্ণ মাসআলাটি হলো, কোনো ‘দারুল হারব’ মুসলমানদের হাতে আসার পর তাতে ইসলামি বিধিবিধান প্রতিষ্ঠা করলেই তা ‘দারুল ইসলাম’ হয়ে যাবে। এ ব্যাপারে কারও তেমন কোনো মতানৈক্য নেই। কিন্তু ‘দারুল ইসলাম’ কখন ‘দারুল হারব’ হবে, সে ব্যাপারে কিছুটা মতভেদ আছে।

‘দারুল ইসলাম’ কখন ‘দারুল হারব’ হবে, সে ব্যাপারে তিনটি মত পাওয়া যায়। এক : ইমাম মালিক রহ., ইমাম আহমাদ রহ., ইমাম আবু ইউসুফ রহ., ইমাম মুহাম্মাদ রহ.-সহ অধিকাংশ ফকিহের নিকট ‘দারুল ইসলাম’-এ কুফরি শাসনব্যবস্থা ও সংবিধান চালু হলেই তা ‘দারুল হারব’-এ পরিণত হয়ে যায়। দুই : ইমাম শাফিয়ি রহ.-এর মতে কোনো রাষ্ট্র ভূখণ্ড একবার ‘দারুল ইসলাম’ হয়ে গেলে তা আর কখনো ‘দারুল হারব’ হবে না; যদিও তথায় কুফরি আইন-কানুন প্রতিষ্ঠিত হয়। তিন : ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর নিকটে ‘দারুল ইসলাম’ ‘দারুল হারব’-এ পরিণত হওয়ার জন্য তিনটি শর্ত রয়েছে। এক. সে দেশে কুফরি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। দুই. সেটা অন্য আরেকটি ‘দারুল হারব’-এর সাথে লাগোয়া থাকতে হবে। তিন. ‘দারুল ইসলাম’ থাকাবস্থায় প্রজাদের যে নিরাপত্তাব্যবস্থা ও চুক্তি ছিল তা কার্যকর থাকবে না; বরং জনগণের নিরাপত্তার জন্য নতুন করে চুক্তি ও শর্ত ঠিক করে নেওয়ার প্রয়োজন হবে। এই তিনটি শর্ত যদি একসাথে পাওয়া যায়, তাহলেই কেবল কোনো ‘দারুল ইসলাম’ ‘দারুল হারব’-এ পরিণত হবে। (আল-মাওসুআতুল ফিকহিয়্যা : ২০/২০২, প্রকাশনী : অজারাতুল আওকাফ ওয়াশ শুয়ুনিল ইসলামিয়্যা, কুয়েত)

এ ব্যাপারে ইমাম শাফিয়ি রহ.-এর মতটি নিতান্তই দুর্বল, যার কারণে অনেক সময় দেখা যায়, এ ইখতিলাফের আলোচনায় তাঁর মতটি উল্লেখ না করে শুধু প্রথম আর তৃতীয় মতটিই উল্লেখ করা হয়। তাই আমরাও এখানে ইমাম শাফিয়ি রহ.-এর মত নিয়ে আলোচনা না করে শুধু জমহুর ও ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর মত নিয়ে আলোচনা করব। নিম্নে আমরা এ দু’মতের ব্যাপারে ফুকাহায়ে কিরামের ভাষ্য ও উভয় পক্ষের দলিলাদি সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ করছি।

ইমাম কাসানি রহ. বলেন :
لَا خِلَافَ بَيْنَ أَصْحَابِنَا فِي أَنَّ دَارَ الْكُفْرِ تَصِيرُ دَارَ إسْلَامٍ بِظُهُورِ أَحْكَامِ الْإِسْلَامِ فِيهَا وَاخْتَلَفُوا فِي دَارِ الْإِسْلَامِ، إنَّهَا بِمَاذَا تَصِيرُ دَارَ الْكُفْرِ؟ قَالَ أَبُو حَنِيفَةَ: إنَّهَا لَا تَصِيرُ دَارَ الْكُفْرِ إلَّا بِثَلَاثِ شَرَائِطَ، أَحَدُهَا: ظُهُورُ أَحْكَامِ الْكُفْرِ فِيهَا وَالثَّانِي: أَنْ تَكُونَ مُتَاخِمَةً لِدَارِ الْكُفْرِ وَالثَّالِثُ: أَنْ لَا يَبْقَى فِيهَا مُسْلِمٌ وَلَا ذِمِّيٌّ آمِنًا بِالْأَمَانِ الْأَوَّلِ، وَهُوَ أَمَانُ الْمُسْلِمِينَ. وَقَالَ أَبُو يُوسُفَ وَمُحَمَّدٌ – رَحِمَهُمَا اللَّهُ: إنَّهَا تَصِيرُ دَارَ الْكُفْرِ بِظُهُورِ أَحْكَامِ الْكُفْرِ فِيهَا.
‘আমাদের ফকিহদের মাঝে এ ব্যাপারে কোনো মতভেদ নেই যে, “দারুল হারব”-এ ইসলামি বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দ্বারাই তা “দারুল ইসলাম”-এ পরিণত হয়ে যায়। তবে তাঁরা “দারুল ইসলাম”-এর ব্যাপারে মতানৈক্য করেছেন যে, তা কখন “দারুল হারব”-এ পরিণত হবে। ইমাম আবু হানিফা রহ. বলেন, তিনটি শর্ত পাওয়া গেলে তবেই “দারুল ইসলাম” “দারুল হারব”-এ পরিণত হবে। এক. তথায় কুফরি বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত হওয়া। দুই. (পার্শ্ববর্তী অন্য) কোনো “দারুল হারব”-এর সাথে সংযুক্ত থাকা। তিন. মুসলমানদের (খলিফার) পক্ষ থেকে প্রদত্ত পূর্বের নিরাপত্তাচুক্তি অনুসারে কোনো মুসলমান বা জিম্মি থাকতে না পারা। আর ইমাম আবু ইউসুফ রহ. ও ইমাম মুহাম্মাদ রহ. বলেছেন, “দারুল ইসলাম”-এ কুফরি বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দ্বারাই তা “দারুল হারব”-এ পরিণত হয়ে যাবে।’ (বাদায়িউস সানায়ি : ৭/১৩০, প্রকাশনী : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরুত)

ইমাম কাসানি রহ. সাহিবাইনের পক্ষ থেকে দলিল দিয়ে বলেন :
وَجْهُ قَوْلِهِمَا أَنَّ قَوْلَنَا دَارُ الْإِسْلَامِ وَدَارُ الْكُفْرِ إضَافَةُ دَارٍ إلَى الْإِسْلَامِ وَإِلَى الْكُفْرِ، وَإِنَّمَا تُضَافُ الدَّارُ إلَى الْإِسْلَامِ أَوْ إلَى الْكُفْرِ لِظُهُورِ الْإِسْلَامِ أَوْ الْكُفْرِ فِيهَا، كَمَا تُسَمَّى الْجَنَّةُ دَارَ السَّلَامِ، وَالنَّارُ دَارَ الْبَوَارِ؛ لِوُجُودِ السَّلَامَةِ فِي الْجَنَّةِ، وَالْبَوَارِ فِي النَّارِ وَظُهُورُ الْإِسْلَامِ وَالْكُفْرِ بِظُهُورِ أَحْكَامِهِمَا، فَإِذَا ظَهَرَ أَحْكَامُ الْكُفْرِ فِي دَارٍ فَقَدْ صَارَتْ دَارَ كُفْرٍ فَصَحَّتْ الْإِضَافَةُ، وَلِهَذَا صَارَتْ الدَّارُ دَارَ الْإِسْلَامِ بِظُهُورِ أَحْكَامِ الْإِسْلَامِ فِيهَا مِنْ غَيْرِ شَرِيطَةٍ أُخْرَى، فَكَذَا تَصِيرُ دَارَ الْكُفْرِ بِظُهُورِ أَحْكَامِ الْكُفْرِ فِيهَا.
‘ইমাম আবু ইউসুফ রহ. ও ইমাম মুহাম্মাদ রহ.-এর মতের পক্ষে দলিল হলো, আমাদের “দারুল ইসলাম” এবং “দারুল কুফর” কথা দুটিতে “দার”-কে ইসলাম ও কুফরের সঙ্গে সম্পর্কিত করা হয়েছে। আর “দার”-কে ইসলাম ও কুফরের সঙ্গে সম্পর্কিত করা হয় তাতে ইসলাম কিংবা কুফর প্রতিষ্ঠিত থাকার কারণে। যেমন : জান্নাতকে “দারুস সালাম” এবং জাহান্নামকে “দারুল বাওয়ার” বলা হয়ে থাকে; যেহেতু জান্নাতে “সালাম” বা শান্তি রয়েছে আর জাহান্নামে “বাওয়ার” বা ধ্বংস রয়েছে। আর ইসলাম ও কুফর প্রতিষ্ঠিত হয় তার আইনকানুন ও বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দ্বারা। অতএব, যখন কোনো ভূখণ্ডে কুফরি আইনকানুন ও বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত হবে, তখন তা “দারুল কুফর” হয়ে যাবে। তাই “দার”-কে এভাবে ইসলাম কিংবা কুফরের সঙ্গে সম্পৃক্ত করাটা সঠিক। এজন্য ইসলামের বিধিবিধান প্রতিষ্ঠা লাভের দ্বারাই কোনো ভূখণ্ড “দারুল ইসলাম” হিসেবে গণ্য হয়। এই একটি মাত্র শর্ত ছাড়া এখানে আর কোনো শর্ত নেই। অনুরূপ কুফরি বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দ্বারাই “দারুল ইসলাম” “দারুল কুফর”-এ রূপান্তরিত হয়।’ (বাদায়িউস সানায়ি : ৭/১৩০-১৩১, প্রকাশনী : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরুত)

ইমাম কাসানি রহ. ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর পক্ষ থেকে দলিল দিয়ে বলেন :
وَجْهُ قَوْلِ أَبِي حَنِيفَةَ – رَحِمَهُ اللَّهُ – أَنَّ الْمَقْصُودَ مِنْ إضَافَةِ الدَّارِ إلَى الْإِسْلَامِ وَالْكُفْرِ لَيْسَ هُوَ عَيْنَ الْإِسْلَامِ وَالْكُفْرِ، وَإِنَّمَا الْمَقْصُودُ هُوَ الْأَمْنُ وَالْخَوْفُ. وَمَعْنَاهُ أَنَّ الْأَمَانَ إنْ كَانَ لِلْمُسْلِمِينَ فِيهَا عَلَى الْإِطْلَاقِ، وَالْخَوْفُ لِلْكَفَرَةِ عَلَى الْإِطْلَاقِ، فَهِيَ دَارُ الْإِسْلَامِ، وَإِنْ كَانَ الْأَمَانُ فِيهَا لِلْكَفَرَةِ عَلَى الْإِطْلَاقِ، وَالْخَوْفُ لِلْمُسْلِمِينَ عَلَى الْإِطْلَاقِ، فَهِيَ دَارُ الْكُفْرِ وَالْأَحْكَامُ مَبْنِيَّةٌ عَلَى الْأَمَانِ وَالْخَوْفِ لَا عَلَى الْإِسْلَامِ وَالْكُفْرِ، فَكَانَ اعْتِبَارُ الْأَمَانِ وَالْخَوْفِ أَوْلَى، فَمَا لَمْ تَقَعْ الْحَاجَةُ لِلْمُسْلِمِينَ إلَى الِاسْتِئْمَانِ بَقِيَ الْأَمْنُ الثَّابِتُ فِيهَا عَلَى الْإِطْلَاقِ، فَلَا تَصِيرُ دَارَ الْكُفْرِ، وَكَذَا الْأَمْنُ الثَّابِتُ عَلَى الْإِطْلَاقِ لَا يَزُولُ إلَّا بِالْمُتَاخَمَةِ لِدَارِ الْحَرْبِ، فَتَوَقَّفَ صَيْرُورَتُهَا دَارَ الْحَرْبِ عَلَى وُجُودِهِمَا مَعَ أَنَّ إضَافَةَ الدَّارِ إلَى الْإِسْلَامِ احْتَمَلَ أَنْ يَكُونَ لِمَا قُلْتُمْ، وَاحْتَمَلَ أَنْ يَكُونَ لِمَا قُلْنَا، وَهُوَ ثُبُوتُ الْأَمْنِ فِيهَا عَلَى الْإِطْلَاقِ لِلْمُسْلِمِينَ وَإِنَّمَا يَثْبُتُ لِلْكَفَرَةِ بِعَارِضِ الذِّمَّةِ وَالِاسْتِئْمَانِ، فَإِنْ كَانَتْ الْإِضَافَةُ لِمَا قُلْتُمْ تَصِيرُ دَارَ الْكُفْرِ بِمَا قُلْتُمْ. وَإِنْ كَانَتْ الْإِضَافَةُ لِمَا قُلْنَا لَا تَصِيرُ دَارَ الْكُفْرِ إلَّا بِمَا قُلْنَا، فَلَا تَصِيرُ مَا بِهِ دَارُ الْإِسْلَامِ بِيَقِينٍ دَارَ الْكُفْرِ بِالشَّكِّ وَالِاحْتِمَالِ عَلَى الْأَصْلِ الْمَعْهُودِ أَنَّ الثَّابِتَ بِيَقِينٍ لَا يَزُولُ بِالشَّكِّ وَالِاحْتِمَالِ، بِخِلَافِ دَارِ الْكُفْرِ حَيْثُ تَصِيرُ دَارَ الْإِسْلَامِ؛ لِظُهُورِ أَحْكَامِ الْإِسْلَامِ فِيهَا؛ لِأَنَّ هُنَاكَ التَّرْجِيحَ لِجَانِبِ الْإِسْلَامِ؛ لِقَوْلِهِ – عَلَيْهِ الصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ -الْإِسْلَامُ يَعْلُو وَلَا يُعْلَى فَزَالَ الشَّكُّ عَلَى أَنَّ الْإِضَافَةَ إنْ كَانَتْ بِاعْتِبَارِ ظُهُورِ الْأَحْكَامِ، لَكِنْ لَا تَظْهَرُ أَحْكَامُ الْكُفْرِ إلَّا عِنْدَ وُجُودِ هَذَيْنِ الشَّرْطَيْنِ – أَعْنِي الْمُتَاخَمَةَ وَزَوَالَ الْأَمَانِ الْأَوَّلِ – لِأَنَّهَا لَا تَظْهَرُ إلَّا بِالْمَنَعَةِ، وَلَا مَنَعَةَ إلَّا بِهِمَا وَاَللَّهُ – سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى – أَعْلَمُ
‘ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর বক্তব্যের কারণ হলো, “দার”-কে ইসলাম ও কুফরের সঙ্গে সম্পর্কিত করার দ্বারা আসলে তো ইসলাম কিংবা কুফরের হাকিকত উদ্দেশ্য নয়। (কেননা, “দার” বা ভূখণ্ড তো আর মুসলমান বা কাফির হয় না)। উদ্দেশ্য হলো আমান (নিরাপত্তা) ও খাওফ (ভীতি)। এর অর্থ হলো, যদি সাধারণভাবে মুসলমানদের জন্য আমান (নিরাপত্তা) থাকে, আর কাফিরদের জন্য স্বাভাবিকভাবে খাওফ (ভীতি) থাকে (পূর্ণ নিরাপত্তা পেতে হলে তাদের আলাদা চুক্তি করার প্রয়োজন হয়), তাহলে তা “দারুল ইসলাম”। আর যদি সাধারণভাবে মুসলমানদের জন্য খাওফ (ভীতি) থাকে আর কাফিরদের জন্য স্বাভাবিকভাবে থাকে আমান (নিরাপত্তা), তাহলে তা হবে “দারুল কুফর”। হুকুমের ভিত্তি হলো আমান ও খাওফের ওপর; বাস্তবিক ইসলাম ও কুফরের ওপর নয়। তাই আমান ও খাওফকেই বিবেচনায় নেওয়া উত্তম। তো যতক্ষণ পর্যন্ত মুসলমানদেরকে নিরাপত্তা প্রার্থনা করতে হবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত সাধারণভাবে আমান বহাল রয়েছে ধরা হবে। তাই তা “দারুল কুফর”-এ পরিণত হবে না। তেমনিভাবে সাধারণ নিরাপত্তা তখনই বিনষ্ট হওয়া সম্ভব, যখন সে অঞ্চলটা “দারুল হারব” সংলগ্ন হবে। তাহলে “দারুল ইসলাম” “দারুল হারব”-এ পরিণত হওয়ার জন্য দুটো বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল। এক. আমান (নিরাপত্তা) নষ্ট হওয়া। দুই. “দারুল হারব” সংলগ্ন অঞ্চল হওয়া। “দার”-কে ইসলামের দিকে নিসবত করার হেতু সেটাও হতে পারে, যা সাহিবাইন বলেছেন, আবার তা-ও হতে পারে, যা ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর পক্ষে আমরা বলছি। অর্থাৎ সাধারণভাবে মুসলমানদের জন্য নিরাপত্তা সাব্যস্ত থাকা। কাফিরদের জন্য নিরাপত্তা সাব্যস্ত হওয়ার জন্য আলাদা জিম্মাচুক্তি কিংবা ইসতিমান বা ভিসাচুক্তি প্রয়োজন। “দার”-কে ইসলামের সঙ্গে সম্পর্কিত করার হেতু যদি তা হয়, যা সাহিবাইন বলেছেন, তাহলে কোনো অঞ্চল “দারুল কুফর” হিসেবে গণ্য হবে সে কারণেই, যা তারা উল্লেখ করেছেন। আর যদি এই সম্পর্কিতকরণের হেতু তা হয়, যা আমরা বলেছি, তাহলে দেশ তখনই “দারুল হারব” হিসেবে গণ্য হবে, যখন আমাদের বর্ণিত শর্তগুলো পাওয়া যাবে। সুতরাং নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত “দারুল ইসলাম” শুধু সন্দেহ-সম্ভাবনার কারণে “দারুল কুফর”-এ পরিণত হবে না। কারণ, এ মূলনীতি স্বীকৃত যে, “যা সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণিত, তা সন্দেহ-সম্ভাবনার কারণে বিদূরীত হয় না।” কিন্তু “দারুল হারব”-এর বিষয়টি ভিন্ন। যেহেতু (আমরা জানি,) “দারুল হারব”-এ ইসলামি আইন ও শাসনব্যবস্থা চালু হলেই তা “দারুল ইসলাম”-এ পরিণত হয়ে যায়। এর কারণ হলো, এখানে ইসলামের দিকটিকে প্রাধান্য দেওয়ার বিষয় রয়েছে। কেননা রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, “ইসলাম (সর্বদা) বিজয়ী থাকবে, পরাজিত নয়।” অতএব, সকল সংশয় নিরসন হয়ে গেল। এছাড়াও (ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর পক্ষ থেকে) বলা যায় যে, (ইসলাম বা কুফরের সাথে) “দার”-এর সম্পৃক্তি যদি শুধু আইন ও শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার বিবেচনায়ও হয়, তবুও উপরিউক্ত দু’শর্ত―দারুল হারবের সংলগ্ন হওয়া ও পূর্বের নিরাপত্তাচুক্তি বাতিল হয়ে যাওয়া―না থাকলে কুফরি বিধিবিধান প্রতিষ্ঠা হওয়া সাব্যস্ত হয় না। কেননা, সামরিক বাহিনী ছাড়া (তাদের কুফরি আইন ও শাসনব্যবস্থা) প্রতিষ্ঠা হওয়ার কথা কল্পনা করা যায় না। আর সামরিক বাহিনী পূর্বের দু’শর্তের উপস্থিতি ছাড়া সম্ভব নয়।’ (বাদায়িউস সানায়ি : ৭/১৩০-১৩১, প্রকাশনী : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরুত)

এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ‘দারুল হারব’-এ ইসলামি বিধিবিধান প্রতিষ্ঠা ও চালু হয়ে গেলেই তা ‘দারুল ইসলাম’-এ পরিণত হয়ে যায়। তবে ‘দারুল ইসলাম’-এ কুফরি বিধিবিধান প্রতিষ্ঠা পাওয়ার দ্বারা সেটা ‘দারুল হারব’-এ পরিণত হওয়ার মাসআলায় কিছুটা মতানৈক্য পাওয়া যায়। এ মাসআলায় ইমাম আবু হানিফা রহ. একদিকে, আর এর বিপরীতে তাঁর দুই প্রধান শাগরিদ ইমাম আবু ইউসুফ রহ. ও ইমাম মুহাম্মাদ রহ. এবং পাশাপাশি ইমাম মালিক রহ. ও ইমাম আহমাদ রহ.-সহ অধিকাংশ ফুকাহায়ে কিরাম আরেকদিকে। অন্যান্য ইমাম এতে শুধু কুফুরি আইন ও শাসন চালু হওয়াকেই যথেষ্ট মনে করেন। আর ইমাম আবু হানিফা রহ. মনে করেন, শুধু এতটুকু হওয়ায়ই যথেষ্ট নয়; বরং এখানে মূল দেখার বিষয় হলো, এখানে কারা নিরাপত্তায় থাকতে পারছে আর কাদের ভয় ও আতঙ্কে থাকতে হচ্ছে। সুতরাং কোনো ‘দারুল ইসলাম-এর শাসক মুরতাদ হয়ে গেলে বা অন্য কোনো কাফির শাসক মুসলমানদের উদাসীনতায় ‘দারুল ইসলাম’-এর কোনো ভূখণ্ড দখল করে তথায় কুফরি আইন ও শাসনব্যবস্থা চালু করলেও তা ‘দারুল হারব’ হবে না, যতক্ষণ না এ প্রতিষ্ঠা শক্তিশালী ও সুদৃঢ় বলে প্রমাণিত হয়। আর এর জন্য দুটি বিষয় লাগবে। এক. এ রাষ্ট্রটির সীমান্ত অন্য কোনো ‘দারুল হারব’-এর সাথে সংযুক্ত থাকতে হবে। কেননা, রাষ্ট্রটির চারপাশে যদি ‘দারুল ইসলাম’-ই থাকে, তাহলে এ মধ্যবর্তী রাষ্ট্রে কাফিরদের প্রভাব ও অবস্থান শক্তিশালী হবে না। চারপাশ থেকে কাফিরদের সর্বদা এ আতঙ্কে থাকতে হবে যে, না জানি কখন ‘দারুল ইসলাম’ থেকে মুসলিম বাহিনী এসে আমাদের দেশ আক্রমণ করে বসে। দুই. ‘দারুল ইসলাম’ থাকাবস্থায় মুসলিম শাসক কর্তৃক জনগণকে যে নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছিল, তা বাতিল করে দিতে হবে। কেননা, কাফির শাসক যদি ‘দারুল ইসলাম’-এর দেওয়া নিরাপত্তাচুক্তি বাতিল করতে না পারে, তাহলে বুঝা যাবে, তার শক্তি ও সাহস দুর্বল। আর এমন দুর্বল অবস্থানের ভিত্তিতে কোনো ‘দারুল ইসলাম’-কে ‘দারুল হারব’ ঘোষণা দেওয়া ইসলামকে ছোট করার নামান্তর। তাই এ দু’শর্ত বা দু’শর্তের কোনোটি পাওয়া না গেলে সেখানে কাফিরদের অবস্থান শক্তিশালী ও প্রভাবপূর্ণ বলে প্রমাণিত না হওয়ায় সেটা ‘দারুল হারব’-এ পরিণত হবে না।
বাকি থেকে যায় এ সংশয় যে, যদি ‘দারুল ইসলাম’ ‘দারুল হারব’-এ পরিণত হওয়ার জন্য তিনটি শর্তের দরকার হয়, তাহলে তো ‘দারুল হারব’ ‘দারুল ইসলাম’-এ পরিণত হওয়ার জন্যও তিনটি শর্ত দরকার। এর উত্তরে ইমাম কাসানি রহ. বলেন, ‘দারুল হারব’-এর বিষয়টি ভিন্ন। কারণ, এখানে আরেকটি মূলনীতি কাজ করেছে। সেটা হলো, কোথাও ইসলাম ও কুফরের মাঝে প্রাধান্যের ব্যাপার আসলে সেখানে ইসলামের দিকটিকে প্রাধান্য দেওয়া নিয়ম। কেননা, রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, ইসলাম (সর্বদা) বিজয়ী থাকবে, পরাজিত নয়। অতএব, এতে এ সংশয় নিরসন হয়ে যায়। তিনি আরেকটি জবাব দিয়েছেন এ বলে যে, ইসলাম বা কুফরের সাথে ‘দার’-এর সম্পৃক্তি যদি শুধু আইন ও শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার বিবেচনায়ও হয়, অর্থাৎ কুফরি শাসনব্যবস্থা থাকলে ‘দারুল হারব’ আর ইসলামি শানব্যবস্থা থাকলে ‘দারুল ইসলাম’ বলে মেনেও নেওয়া হয়, তবুও উপরিউক্ত দু’শর্ত (তথা ‘দারুল হারব’-এর সংলগ্ন হওয়া ও পূর্বের নিরাপত্তাচুক্তি বাতিল হয়ে যাওয়া) না থাকলে কুফরি বিধিবিধান প্রতিষ্ঠা হওয়া সাব্যস্ত হয় না। কেননা, কাফিরদের সামরিক বাহিনী ছাড়া তাদের কুফরি আইন ও শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হওয়ার কথা কল্পনা করা যায় না। আর সামরিক বাহিনীর অস্তিত্ব পূর্বের দু’শর্তের উপস্থিতি ছাড়া সম্ভব নয়।

ইমাম সারাখসি রহ. তাঁর মাবসুতে ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর দলিলের মূলের দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন যে, মূলত কোনো দেশে শক্তি ও প্রভাবের ভিত্তিতেই ‘দারুল ইসলাম’ ও ‘দারুল হারব’ নির্ণীত হয়। এক্ষেত্রে ইমাম আবু হানিফা রহ. মনে করেন, তিনটি শর্তের উপস্থিতি ছাড়া কাফিরদের শক্তি ও প্রভাব পূর্ণতা পায় না, এজন্যই তিনটি শর্ত করা হয়েছে। আর অন্য ইমামগণ মনে করেন, কোনো দেশে কুফরি শাসনব্যবস্থা ও আইন প্রতিষ্ঠা হওয়ায়-ই প্রমাণ করে যে, সেখানে কুফর প্রতিষ্ঠিত; অতএব সেটা ‘দারুল হারব’ হবে।

ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর মতভিন্নতা ও তাঁর দলিলের উৎসের ব্যাপারে ইমাম সারাখসি রহ. বলেন :
وَلَكِنْ أَبُو حَنِيفَةَ – رَحِمَهُ اللَّهُ تَعَالَى – يَعْتَبِرُ تَمَامَ الْقَهْرِ وَالْقُوَّةِ؛ لِأَنَّ هَذِهِ الْبَلْدَةَ كَانَتْ مِنْ دَارِ الْإِسْلَامِ مُحْرَزَةً لِلْمُسْلِمِينَ فَلَا يَبْطُلُ ذَلِكَ الْإِحْرَازُ إلَّا بِتَمَامِ الْقَهْرِ مِنْ الْمُشْرِكِينَ، وَذَلِكَ بِاسْتِجْمَاعِ الشَّرَائِطِ الثَّلَاثِ؛ لِأَنَّهَا إذَا لَمْ تَكُنْ مُتَّصِلَةً بِالشِّرْكِ فَأَهْلُهَا مَقْهُورُونَ بِإِحَاطَةِ الْمُسْلِمِينَ بِهِمْ مِنْ كُلِّ جَانِبٍ، فَكَذَلِكَ إنْ بَقِيَ فِيهَا مُسْلِمٌ أَوْ ذِمِّيٌّ آمِنٌ فَذَلِكَ دَلِيلُ عَدَمِ تَمَامِ الْقَهْرِ مِنْهُمْ، وَهُوَ نَظِيرُ مَا لَوْ أَخَذُوا مَالَ الْمُسْلِمِ فِي دَارِ الْإِسْلَامِ لَا يَمْلِكُونَهُ قَبْلَ الْإِحْرَازِ بِدَارِهِمْ لِعَدَمِ تَمَامِ الْقَهْرِ، ثُمَّ مَا بَقِيَ شَيْءٌ مِنْ آثَارِ الْأَصْلِ فَالْحُكْمُ لَهُ دُونَ الْعَارِضِ كَالْمَحَلَّةِ إذَا بَقِيَ فِيهَا وَاحِدٌ مِنْ أَصْحَابِ الْخِطَّةِ فَالْحُكْمُ لَهُ دُونَ السُّكَّانِ وَالْمُشْتَرِينَ. وَهَذِهِ الدَّارُ كَانَتْ دَارَ إسْلَامٍ فِي الْأَصْلِ فَإِذَا بَقِيَ فِيهَا مُسْلِمٌ أَوْ ذِمِّيٌّ فَقَدْ بَقِيَ أَثَرٌ مِنْ آثَارِ الْأَصْلِ فَيَبْقَى ذَلِكَ الْحُكْمُ، وَهَذَا أَصْلٌ لِأَبِي حَنِيفَةَ – رَحِمَهُ اللَّهُ تَعَالَى -…وَكَذَلِكَ حُكْمُ كُلِّ مَوْضِعٍ مُعْتَبَرٌ بِمَا حَوْلَهُ فَإِذَا كَانَ مَا حَوْلَ هَذِهِ الْبَلْدَةِ كُلُّهُ دَارَ إسْلَامٍ لَا يُعْطَى لَهَا حُكْمُ دَارِ الْحَرْبِ كَمَا لَوْ لَمْ يَظْهَرْ حُكْمُ الشِّرْكِ فِيهَا، وَإِنَّمَا اسْتَوْلَى الْمُرْتَدُّونَ عَلَيْهَا سَاعَةً مِنْ نَهَارٍ.
‘কিন্তু ইমাম আবু হানিফা রহ. বিবেচনায় নিয়েছেন বল ও শক্তির পূর্ণতা। কেননা এই শহর ইতিপূর্বে মুসলমানদের রক্ষণকারী হিসেবে ‘দারুল ইসলাম’-এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। অতএব, সেই ইহরাজ (রক্ষণশক্তি) মুশরিকদের পূর্ণ প্রতাপ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মাধ্যমেই বিদূরিত হতে পারে। আর তা এই তিন শর্ত সম্মিলিতভাবে পাওয়া গেলেই কেবল সম্ভব। কেননা, যখন তা ‘দারুল হারব’ সংলগ্ন না হবে, তখন চারিদিক থেকে মুসলমানদের বেষ্টনীর মধ্যে থেকে তার অধিবাসীরা পরাভূত থাকবে। তেমনই সেখানে মুসলমান এবং জিম্মি যদি (পূর্বের নিরাপত্তার অধীনেই) নিরাপদ থাকে, তবে তা মুশরিকদের পূর্ণ প্রতাপ না থাকার প্রমাণ। এর দৃষ্টান্ত হলো এ মাসআলা যে, হারবিরা যদি ‘দারুল ইসলাম’-এ অবস্থানরত কোনো মুসলমানের সম্পদ আত্মসাৎ করে, তবে তাদের নিজেদের দেশে সংরক্ষণ করার পূর্ব পর্যন্ত তারা সেই সম্পদের মালিক হয় না; যেহেতু সেখানে পূর্ণ প্রতাপ নেই। যতক্ষণ মূলের নিদর্শনসমূহের একটিও বাকি থাকবে, ততক্ষণ মূলের জন্যই হুকুম প্রযোজ্য হবে, আপতিত বিষয়ের জন্য নয়। যেমন কোনো মহল্লা, যতক্ষণ তথায় একজন জমির মালিকও থাকবে ততক্ষণ তার মালিকানা ও কর্তৃত্বই বহাল থাকবে, নতুন আবাসগ্রহণকারী বা ক্রেতাদের নয়। এই ভূখণ্ড তো মূলত ‘দারুল ইসলাম’-এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাই যতক্ষণ তাতে কোনো মুসলিম কিংবা জিম্মি (পূর্বের নিরাপত্তার অধীনে নিরাপদ) থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত মূলের নিদর্শনসমূহের মধ্য থেকে একটি নিদর্শন তো বাকি থেকেই যাচ্ছে। সুতরাং সেই (পূর্বের) হুকুম (অর্থাৎ ‘দারুল ইসলাম’ বহাল থাকা এবং সেটা ‘দারুল হারব’-এ পরিণত না হওয়া) বাকি থাকবে। এটা ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর একটি মূলনীতি। …তেমনই প্রত্যেক জায়গার হুকুমের ক্ষেত্রে তার আশপাশের জায়গার অবস্থা বিবেচ্য। সুতরাং যখন এই ভূখণ্ডের চারিদিকে ‘দারুল ইসলাম’ তখন এই ভূখণ্ডের ওপর ‘দারুল হারব’-এর বিধান আরোপিত হবে না; যেমনিভাবে সেখানে শিরকি বিধান প্রতিষ্ঠিত না হলে তা আরোপ করা হতো না। মুরতাদরা এর ওপর দিনের কিছু সময়ের জন্য দখল নিয়েছে মাত্র (যার শক্তিশালী কোনো ভিত্তি ও সুদৃঢ় কোনো প্রতিরক্ষাব্যবস্থা নেই)।’ (আল-মাবসুত, সারাখসি : ১০/১১৪, প্রকাশনী : দারুল মারিফা, বৈরুত)

সার্বিক আলোচনার পর আমাদের দেখার বিষয় হলো, এখানে কোন মতটি অধিক শক্তিশালী। তো সবার দলিল ও যুক্তি সামনে রাখলে স্পষ্ট হয় যে, এ মাসআলায় জমহুরের মতটিই অধিক শক্তিশালী। কেননা, কোনো ভূখণ্ড ‘দারুল ইসলাম’ বা ‘দারুল হারব’ হওয়ার বিষয়টি এসেছে মূলত আল্লাহর জমিনে আল্লাহর আইন ও শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা থাকা বা না-থাকার ওপর ভিত্তি করে। অতএব, কোনো ‘দারুল হারব’ মুসলমানদের হাতে আসার পর তথায় আল্লাহর দ্বীন ও ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা হলে সেটা যে ‘দারুল ইসলাম’ হবে, তাতে কোনো সন্দেহ বা ইখতিলাফ নেই। অনুরূপ কোনো ‘দারুল ইসলাম’ কাফিররা দখল করে নেওয়ার পর তথায় কুফরি ও অনৈসলামিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করলে সেটাও ‘দারুল হারব’ হয়ে যাবে।

হানাফি মাজহাবের বিখ্যাত ফকিহ ইমাম জাসসাস রহ. শারহু মুখতাসারিত তাহাবি-তে ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর ফতোয়াকে তাঁর যুগের জন্য সাব্যস্ত করে সাহিবাইনের মতকে প্রাধান্য দিয়ে বলেন :
وَالَّذِيْ أَظُنُّ أَنَّ أَبَا حَنِيْفَةَ إِنَّمَا قالَ ذَلِكَ عَلَى حَسْبِ الْحَالِ الَّتِيْ كَانَتْ فِيْ زَمَانِهِ مِنْ جِهَادِ الْمُسْلِمِيْنَ أَهْلَ الشِّرْكِ، فَامْتَنَعَ عِنْدَهُ أَنْ تَكُوْنَ دَارُ حَرْبٍ فِيْ وَسَطِ دَارِ الْمُسْلِمِيْنَ، يَرْتَدُّ أَهْلُهَا فَيَبْقُوْنَ مُمْتَنِعِيْنَ دُوْنَ إِحَاطَةِ الْجُيُوْشِ بِهِمْ مِنْ جِهَةِ السُّلْطَانِ، وَمُطَوَّعَةِ الرَّعِيَّةِ. فَأَمَّا لَوْ شَاهَدَ مَا قَدْ حَدَثَ فِيْ هَذَا الزَّمَانِ، مِنْ تَقَاعُدِ النَّاسِ عَنِ الْجِهَادِ، وَتَخَاذُلِهِمْ، وَفَسَادِ مَنْ يَتَوَلَّى أُمُوْرَهُمْ، وَعَدَاوَتِهِ لِلْإِسْلَامِ وَأَهْلِهِ، وَاسْتِهَانَتِهِ بِأَمْرِ الْجِهَادِ، وَمَا يَجِبُ فِيْهِ، لَقَالَ فِيْ مِثْلِ بَلَدِ الْقَرَمَطِيِّ بِمِثْلِ قَوْلِ أَبْيِ يُوْسُفَ وَمُحَمَّدٍ، بَلْ فِيْ كَثِيْرٍ مِنَ الْبُلْدَانِ الَّتِيْ هَذِهِ سَبِيْلُهَا.
‘আর আমি যেটা মনে করি, ইমাম আবু হানিফা রহ. এসব শর্তের কথা বলেছিলেন তাঁর সময়কার অবস্থার দিকে তাকিয়ে, যখন মুসলমানরা মুশরিকদের সাথে জিহাদ করত। এজন্য তাঁর নিকটে এটা অসম্ভব মনে হয়েছে যে, চারপাশে দারুল ইসলাম থাকা সত্ত্বেও মাঝে একটি দারুল হারব থাকবে, তার অধিবাসীরা সবাই মুরতাদ হয়ে যাবে; অথচ মুসলিম শাসকের পক্ষ থেকে সেনাবাহিনী ও স্বেচ্ছাসেবক মুসলিম জনগণ এসে তাদেরকে অবরুদ্ধ না করে নিবৃত্ত থাকবে! কিন্তু তিনি যদি আজকের অবস্থা অবলোকন করতেন, যখন লোকেরা জিহাদ করার ব্যাপারে বিমুখতা প্রদর্শন ও শিথিলতা দেখাচ্ছে, শাসকরা দুর্নীতি করছে, ইসলাম ও মুসলমানদের সাথে শত্রুতা রাখছে, জিহাদ ও জিহাদ সংশ্লিষ্ট আবশ্যকীয় বিষয়াবলিকে অবজ্ঞা করছে, তাহলে তিনি অবশ্যই কারামতি (মুরতাদ কারামতি কর্তৃক দখলকৃত একটি দেশ) রাষ্ট্রের মতো দেশগুলোকে ইমাম আবু ইউসুফ রহ. ও ইমাম মুহাম্মাদ রহ.-এর মতোই ‘দারুল হারব’ বলতেন। শুধু তাই নয়; বরং যেসব রাষ্ট্রের এ অবস্থা, সবগুলোর ব্যাপারেই তিনি এমন ফতোয়া দিতেন।’ (শারহু মুখতাসারিত তাহাবি : ৭/২১৮, প্রকাশনী : দারুল বাশাইরিল ইসলামিয়া, বৈরুত)

প্রখ্যাত হানাফি ফকিহ আল্লামা ইবনে নুজাইম মিসরি রহ. তাতারদের দখলকৃত ‘দারুল ইসলাম’-এর রাষ্ট্রগুলোর ব্যাপারে সাহিবাইনের মতানুসারে ‘দারুল হারব’ হওয়ার ফতোয়া দিয়ে বলেন :
وَفِي زَمَانِنَا بَعْدَ فِتْنَةِ التَّتَرِ الْعَامَّةِ صَارَتْ هَذِهِ الْوِلَايَاتُ الَّتِي غَلَبُوا عَلَيْهَا وَأَجْرَوْا أَحْكَامَهُمْ فِيهَا كَخُوَارِزْمَ وَمَا وَرَاءَ النَّهْرِ وَخُرَاسَانَ وَنَحْوِهَا صَارَتْ دَارَ الْحَرْبِ فِي الظَّاهِرِ
‘আর আমাদের সময়ে তাতারিদের ব্যাপক ফিতনার পর খুওয়ারিজম, মা-ওরাউন্নাহার, খুরাসানসহ এ ধরনের যেসব অঞ্চলে তারা বিজয়ী হয়েছে এবং তথায় তাদের কুফরি বিধিবিধান চালু করেছে, জাহিরুর রিওয়ায়াত অনুসারে সব ‘দারুল হারব’-এ পরিণত হয়ে গিয়েছে।’ (আল-বাহরুর রায়িক : ৩/২৩০-২৩১, প্রকাশনী : দারুল কিতাবিল ইসলামি, বৈরুত)

বাকি থেকে যায়, এ রাষ্ট্রের চারপাশে যদি কোনো দারুল হারব না থাকে কিংবা দেশের জনগণের পূর্বের নিরাপত্তাচুক্তি বাতিল না করা হয় তাহলে তো তাদের কর্তৃত্ব পূর্ণাঙ্গ ও শক্তিশালী হয় না। সুতরাং এটাকে ‘দারুল হারব’ কীভাবে বলা হবে? এর উত্তরে বলা যায় যে, যখন একটা রাষ্ট্রে কেউ ভিন্ন আইন ও শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে ফেলে তখন চারপাশে যতই ‘দারুল ইসলাম’ থাকুক না কেন, বুঝাই যায় যে, তারা এদের প্রতিরোধ করতে সক্ষম নয়। যদি সক্ষমই হতো তাহলে তো এরা এ দেশ দখলই করতে পারত না কিংবা এ দেশে তাদের কুফরি আইন চালুও করতে পারত না। তাই শুধু চারপাশের ‘দারুল ইসলাম’ থাকার ভিত্তিতে সে দেশকে ‘দারুল ইসলাম’ বলার কোনো যৌক্তিকতা নেই। এর স্বপক্ষে আমরা কয়েকটি কারণ তুলে ধরছি :

প্রথমত, এটা খুবই স্বাভাবিক যে, কখনও আল্লাহ মুসলমানদের অন্তরে ভীতি বিস্তার করে দেন। তাদেরকে লাঞ্ছনার শাস্তি আস্বাদন করান। তখন উক্ত দখলকৃত ‘দারুল ইসলাম’-এর চারপাশেই শুধু নয়; বরং পৃথিবীর অর্ধেক জায়গাজুড়ে ‘দারুল ইসলাম’ থাকলেও দেখা যায়, সবাই মিলেও ওই মধ্যবর্তী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারে না। এর বাস্তব উদাহরণ হলো বর্তমানের ইসরাইল। মুসলমানদের মূলকেন্দ্র আরব রাষ্ট্রসমূহের মাঝে অবস্থিত ছোট্ট একটি জায়গায় তারা তাদের সব ধরনের কুফরি কর্ম ও বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের কাজ আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছে। অথচ তাদের বিরুদ্ধে কিছু করার সামরিক সক্ষমতা মুসলমানদের নেই। বর্তমান সময়ের এমন একজন হক্কানি আলিমকেও পাওয়া যাবে না, যে কিনা ইসরাইলকে ‘দারুল ইসলাম’ বলবে। অথচ তার চারপাশেই কিন্তু লক্ষ্-কোটি মুসলমানদের বসবাস!

দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রটি ‘দারুল হারব’ হওয়ার জন্য ‘দারুল হারব’-এর সাথে সংযুক্ত থাকা মূলত যৌক্তিক কোনো শর্ত নয়। কেননা, পার্শ্ববর্তী ‘দারুল হারব’ রাষ্ট্রটি হয়তো এমন দুর্বল হবে, যার থাকা বা না-থাকার মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। আর ইমাম আবু হানিফা রহ. তো নিঃশর্ত ‘দারুল হারব’-এর শর্তারোপ করেছেন, শক্তিশালী ‘দারুল হারব’ থাকার কথা বলেননি। অতএব, কোনো কাফিরদের দখলকৃত ‘দারুল ইসলাম’-এ কুফরি আইন-শাসন চালু হওয়া এবং খলিফার পূর্বের নিরাপত্তাচুক্তি বাতিল হওয়ার পর যদি দেখা যায়, তার পাশে সামরিকভাবে খুবই দুর্বল একটি ‘দারুল হারব’ আছে, তাহলে তাঁর শর্তানুসারে তো সেটা ‘দারুল হারব’ হয়ে যাওয়ার কথা; অথচ তাঁর এ শর্তারোপের মূলভিত্তি ছিল, পাশে ‘দারুল হারব’ থাকার কারণে এ রাষ্ট্রটির প্রভাব ও শক্তি সুদৃঢ় সাব্যস্ত করা। কিন্তু ইমাম আবু হানিফা রহ. বা তাঁর অনুসারী কোনো ফকিহ-ই দখলকৃত ‘দারুল ইসলাম’-এর পাশে এমন শক্তিশালী ‘দারুল হারব’ থাকার কথা বলেননি। তাহলে যে ভিত্তিতে এ শর্ত করা হলো, সেটাই যখন প্রযোজ্য হচ্ছে না, তাহলে এমন শর্ত করাটা অতিরিক্ত একটি বিষয় হবে, যা ‘দারুল হারব’ হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারবে না।

তৃতীয়ত, চারপাশে ‘দারুল ইসলাম’ থাকা সত্ত্বেও যখন কোনো ‘দারুল ইসলাম’-এ কাফিররা কুফরি আইন ও শাসন প্রতিষ্ঠা করবে, তখন প্রতীয়মান হবে যে, চারপাশের ‘দারুল ইসলাম’-এর শাসকরা হয় গাদ্দারি করে কাফিরদের সঙ্গ দিয়েছে, যদ্দরুন তারাও মুরতাদ হয়ে গিয়েছে, কিংবা দুর্বলতার দরুন তারা কাফিরদের প্রতিহত করতে পারেনি। সুতরাং এই যখন অবস্থা তাহলে চারপাশে অন্য কোনো ‘দারুল হারব’ না থাকায় কী-ই আর এমন সমস্যা হবে! তারা তো নির্দ্বিধায়ই তথায় তাদের খেয়াল-খুশি অনুসারে কুফরি আইন ও শাসন প্রতিষ্ঠা করবে। হ্যাঁ, এটা হতে পারে যে, পরবর্তী সময়ে অন্য কোনো শক্তিশালী মুসলিম সেনাপতির হাতে এ ‘দারুল হারব’-এর পতন ঘটবে। কিন্তু এর কারণে তো পূর্বের কাফির-শাসিত রাষ্ট্রকে আমরা ‘দারুল ইসলাম’ বলতে পারি না। কোনো রাষ্ট্র কুফরি শাসনব্যবস্থায় পরিচালিত হবে, আর শুধু চারপাশে দুর্বল ও নামকাওয়াস্তে ‘দারুল ইসলাম’ থাকায় সেটাকেও ‘দারুল ইসলাম’ বলতে হবে, এটা কোনো যুক্তিতেই সঠিক হতে পারে না।

চতুর্থত, দখলকৃত ‘দারুল ইসলাম’-এর কোনো সীমান্তে ‘দারুল হারব’ থাকলেও এটা খুবই সম্ভব যে, তারা হয়তো পার্থিব কোনো স্বার্থের কারণে এ দখলকারী কাফিরদের শত্রু হবে। হাদিসের ভাষ্যানুসারে যদিও কাফিরদের এক জাতি বলা হয়েছে, কিন্তু এর অর্থ এ নয় যে, তাদের মধ্যে কখনও শত্রুতা সৃষ্টি হবে না কিংবা তাদের একদল অন্য দলের বিরোধিতা করার জন্য কোনো মুসলিম রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্ব করবে না। এটা বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে বাস্তব একটি বিষয়, যা অস্বীকার করার কোনো অবকাশ নেই। হাদিসের অর্থ হলো, কাফিরদের কাউকে আমরা আপন ভাবব না। কোনো কারণে তারা আমাদের সাথে থাকলেও মৌলিকভাবে তারা আমাদের শত্রু। এখানে মূলত জিনস (জাতীয়তা) বুঝানো হয়েছে, যা ব্যাপকতা বুঝালেও ইসতিগরাক (সামগ্রিকতা) বুঝায় না। তাই তো ইতিহাসে দেখা যায়, অনেক সময় কোনো কাফির রাষ্ট্র অন্য একটি কাফির রাষ্ট্রের সাথে শত্রুতা থাকায় তার ক্ষতিসাধনের উদ্দেশ্যে মুসলমানদের সাথে বন্ধুত্ব ও চুক্তি করে। যেমনটি স্পেন বিজয়ের ইতিহাসে দেখা গিয়েছিল। অতএব, দখলকৃত ‘দারুল ইসলাম’-এ এমন শত্রুভাবাপন্ন কোনো ‘দারুল হারব’ থাকলে এতে দখলকারী কাফিরদের কোনোই লাভ নেই; উল্টো শত্রুতা থাকায় বরং তা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। ইমাম আবু হানিফা রহ. যে ভিত্তিতে এ শর্তারোপ করেছিলেন, দেখা যাচ্ছে শর্ত পাওয়া গেলেও সে মূলভিত্তিটি পাওয়া যাচ্ছে না। তাই এমন শর্ত করার দ্বারা আলাদা কোনো ফায়েদা নেই।

পঞ্চমত, আর ‘দারুল ইসলাম’ দখলে নিয়ে কাফিররা তথায় কুফরি শাসনব্যবস্থা চালু করলেও এটা হতে পারে যে, কোনো কারণবশত পূর্বের নিরাপত্তাচুক্তি তারা এখনও বহাল রেখেছে। কিন্তু এর অর্থ কখনো এ হওয়া জরুরি নয় যে, তারা ভীত হওয়ায় বা দুর্বল হওয়ায় পূর্বের নিরাপত্তাচুক্তি বাতিল করছে না। এমন হলে তো তারা এ দেশ দখলই করতে পারত না। আর নিরাপত্তাচুক্তি বাতিল করার চাইতে তথায় কুফরি শাসনব্যবস্থা চালু করা অনেকগুণে বেশি কঠিন ও সাহসের ব্যাপার। যখন তারা সে দেশে তাদের কুফরি শাসনব্যবস্থা চালু করতে পেরেছে, তখন পূর্বের নিরাপত্তাচুক্তি বাতিল করতে আর কতক্ষণের ব্যাপার! তাই এর ভিত্তিতে এ ফলাফল বের করা ভুল হবে যে, সম্ভবত তারা প্রবল ও শক্তিশালী না হওয়ায় পূর্বের নিরাপত্তাচুক্তি বাতিল করছে না। বরং এটার সম্ভাবনাই প্রবল যে, হয়তো অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাকায় এটা বাতিল করার চিন্তা পরে করবে বা এটা তাদের নীতি ও স্বার্থবিরোধী কিছু হচ্ছে না কিংবা এতে তারা অন্য কোনো কল্যাণ দেখছে; এমন বিভিন্ন কারণেই পূর্বের চুক্তি বাতিল না করার সম্ভাবনা আছে। তাই একটি সম্ভাবনাকে নিশ্চিত ধরে তার ভিত্তিতে কাফিরদের দুর্বল প্রমাণ করে সেটাকে ‘দারুল ইসলাম’ আখ্যায়িত করা দুর্বল যুক্তির কথা।

এছাড়াও আরও একাধিক কারণে প্রমাণ হয় যে, এ মাসআলায় ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর মতের চাইতে তাঁর দু’ছাত্র তথা ইমাম আবু ইউসুফ রহ. ও ইমাম মুহাম্মাদ রহ. এবং ইমাম মালিক রহ., ইমাম আহমাদ রহ.-সহ জমহুরের মত অনেক বেশি শক্তিশালী। অতএব, বর্তমানে আমরা জমহুরের মতের ভিত্তিতেই ‘দারুল হারব’ চিহ্নিত করব। শুধু দেখা হবে যে, সেখানে আল্লাহর আইনের বিপরীতে মানবরচিত আইনের শাসনব্যবস্থা চালু আছে কিনা। চালু থাকলে বুঝতে হবে সেটা ‘দারুল হারব’; যদিও তার অধিকাংশ প্রজা মুসলিম হোক। অনুরূপ কোথাও আল্লাহর আইন ও শাসনব্যবস্থা চালু থাকলে বুঝতে হবে, সেটা ‘দারুল ইসলাম’; যদিও তার অধিকাংশ জনগণ কাফির হোক। তবে উল্লেখ্য যে, এই ইখতিলাফ শুধু ওই সকল ভূখণ্ডের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যেখানে একবার ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়ে তারপর তাতে কুফর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অন্যথায় কোনো ভূখণ্ড যদি এমন হয়, যেখানে ইসলামের আবির্ভাবের পর কখনও ইসলাম প্রতিষ্ঠিত-ই হয়নি, তাহলে সেটা ‘দারুল হারব’ হওয়ার ব্যাপারে কারও কোনো মতভেদ নেই; যদিও তথায় উপরিউক্ত তিন শর্ত না পাওয়া যাক।

এ হিসেবে আমরা তাত্ত্বিকভাবে ভূখণ্ডকে চারভাগে ভাগ করতে পারি। এক. এমন ভূখণ্ড, যেখানে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর কখনো কুফরি আইন বা শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। দুই. এমন ভূখণ্ড, যেখানে কোনো কালেই ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়নি; বরং সর্বদাই সেখানে কুফরি আইন ও শাসনব্যবস্থা চলে আসছে। তিন. এমন ভূখণ্ড, যেখানে ইসলামের আবির্ভাবের পর প্রথমে কুফরি আইন ও শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল, পরে তথায় ইসলামি আইন বা শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। চার. এমন ভূখণ্ড, যেখানে একসময় ইসলাম প্রতিষ্ঠিত ছিল, এরপর আবারও তাতে কুফরি আইন ও শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সুতরাং প্রথম প্রকারটি সবার ঐকমত্যে দারুল ইসলাম। দ্বিতীয় প্রকারটি সবার ঐকমত্যে দারুল হারব। তৃতীয় প্রকারটি সবার ঐকমত্যে দারুল ইসলাম। আর চতুর্থ প্রকারটি হলো মতানৈক্যপূর্ণ। জমহুরের মতে এটাও ‘দারুল হারব’। আর এটাই বিশুদ্ধ মত। কিন্তু ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর মতে এতে আরও দুটি শর্ত (অর্থাৎ কোনো ‘দারুল হারব’-এর সীমান্তের সাথে মিলিত থাকা এবং পূর্বের নিরাপত্তাচুক্তি বাতিল করে দেওয়া) পাওয়া গেলে তবেই এটা ‘দারুল হারব’ হবে, অন্যথায় তা ‘দারুল ইসলাম’ বলে গণ্য হবে।

– মুফতি তারেকুজ্জামান

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button