আদব ও আমল

হজ্জের ন্যায় ফযীলতপূর্ণ আমল

হজ্জ ইসলামের পাঁচটি রুকনের অন্যতম। এটি শারীরিক ও আর্থিক ইবাদত। আল্লাহ সামর্থ্যবান ব্যক্তির উপর জীবনে একবার হজ্জ ফরয করেছেন। পাশাপাশি হজ্জের মত ফযীলতপূর্ণ এমন কতিপয় আমল ও ইবাদত ইসলামী শরী‘আতে বিধিবদ্ধ করেছেন, যেন অসমর্থ ব্যক্তিরাও সেই আমল সম্পাদনের মাধ্যমে হজ্জের সমান নেকী লাভে ধন্য হ’তে পারে। এখানে ইসলামের মহানুভবতা ফুটে ওঠে। এ নিবন্ধে হজ্জের সমান নেকী পাওয়া যায়, এমন কিছু আমল সম্পর্কে আলোচনা করা হ’ল।-

হজ্জের ফযীলত :

হজ্জ এমন একটি ইবাদত, যার মাধ্যমে হজ্জ সম্পাদনকারী নিষ্পাপ হয়ে যায়। আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, مَنْ حَجَّ للهِ فَلَمْ يَرْفُثْ وَلَمْ يَفْسُقْ رَجَعَ كَيَوْمٍ وَلَدَتْهُ أُمُّهُ، متفق عليه- ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ্জ করেছে। যার মধ্যে সে অশ্লীল কথা বলেনি বা অশ্লীল কার্য করেনি, সে হজ্জ হ’তে ফিরবে সেদিনের ন্যায় (নিষ্পাপ অবস্থায়) যেদিন তার মা তাকে প্রসব করেছিল’।[1]

অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, أَنَّ الْحَجَّ يَهْدِمُ مَا كَانَ قَبْلَهُ، ‘নিশ্চয়ই হজ্জ পূর্বের সকল গুনাহকে ধ্বংস করে দেয়’।[2] শুধু তাই নয়, হজ্জ সম্পাদনকারীর একমাত্র প্রতিদান হবে জান্নাত। নবী করীম (ছাঃ) এরশাদ করেছেন,اَلْعُمْرَةُ إِلَى الْعُمْرَةِ كَفَّارَةٌ لِّمَا بَيْنَهُمَا وَالْحَجُّ الْمَبْرُوْرُ لَيْسَ لَهُ جَزَاءٌ إِلاَّ الْجَنَّةُ، متفق عليه- ‘এক ওমরাহ অপর ওমরাহ পর্যন্ত সময়ের (ছগীরা গোনাহ সমূহের) কাফফারা স্বরূপ। আর কবুল হজ্জের প্রতিদান জান্নাত ব্যতীত কিছুই নয়’।[3]

কবুল হজ্জের মাধ্যমে মুমিন বান্দা সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর মত নিষ্পাপ হয়ে যায় এবং আখেরাতে আল্লাহ তাকে জান্নাত দ্বারা পুরস্কৃত করবেন। এক্ষণে আমরা হজ্জের মত ফযীলতপূর্ণ কয়েকটি আমল সম্পর্কে আলোচনা করার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।

১. হজ্জের খালেছ নিয়ত করা :

কোন মুসলিম ব্যক্তি হজ্জের খালেছ নিয়ত করলে এবং সে কোন কারণে হজ্জে গমন করতে না পারলে আল্লাহ তার জন্য হজ্জের নেকী লিখে দিবেন। রাসূল (ছাঃ) বলেন,قَالَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ إِذَا هَمَّ عَبْدِى بِحَسَنَةٍ وَلَمْ يَعْمَلْهَا كَتَبْتُهَا لَهُ حَسَنَةً فَإِنْ عَمِلَهَا كَتَبْتُهَا عَشْرَ حَسَنَاتٍ إِلَى سَبْعِمِائَةِ ضِعْفٍ ‘আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আমার বান্দা যখন ভাল কাজের নিয়ত করে, কিন্তু তা সম্পাদন করে না, আমি তার জন্য একটি পূর্ণ নেকী লিখি। আর যদি ভাল কাজের নিয়ত করার পর তা বাস্তবায়ন করে, তাহ’লে আমি তার জন্য দশ গুণ হ’তে সাতশ’ গুণ পর্যন্ত নেকী লিখি’।[4] অন্য বর্ণনায় এসেছে, জাবির (রাঃ) বলেন, আমরা তাবূক যুদ্ধে নবী করীম (ছাঃ)-এর সঙ্গে ছিলাম। তখন তিনি বললেন,إِنَّ بِالْمَدِيْنَةِ لَرِجَالاً مَا سِرْتُمْ مَسِيْرًا وَلاَ قَطَعْتُمْ وَادِيًا إِلاَّ كَانُوْا مَعَكُمْ حَبَسَهُمُ الْمَرَضُ. ‘মদীনায় এমন কিছু লোক রয়েছে, যারা তোমাদের প্রতিটি পথ চলার এবং প্রান্তর অতিক্রমকালে তোমাদেরই সঙ্গেই ছিল (ছওয়াব লাভের ক্ষেত্রে)। রোগ-ব্যাধি তাদেরকে আটকে রেখেছিল’।[5] অন্যত্র তিনি বলেন, حَبَسَهم العُذْرُ ‘ওযর তাদেরকে আবদ্ধ রেখেছিল’।[6] তিনি অন্যত্র বলেন,إلاَّ شَرَكُوْكُمْ فِي الْأجْرِ، ‘তবে ছওয়াব লাভের ক্ষেত্রে তারা তোমাদেরই সঙ্গেই রয়েছে’।[7]

২. ছালাতের পরে তাসবীহ-তাহলীল করা :

দিনে-রাতে ছালাতের পরে নির্দিষ্ট হারে তাসবীহ-তাহলীল পাঠ করলে হজ্জের সমান নেকী লাভ করা যায়। হাদীছে এসেছে,

عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ رضى الله عنه قَالَ جَاءَ الْفُقَرَاءُ إِلَى النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالُوا ذَهَبَ أَهْلُ الدُّثُورِ مِنَ الْأَمْوَالِ بِالدَّرَجَاتِ الْعُلاَ وَالنَّعِيمِ الْمُقِيمِ، يُصَلُّوْنَ كَمَا نُصَلِّى، وَيَصُوْمُوْنَ كَمَا نَصُومُ، وَلَهُمْ فَضْلٌ مِنْ أَمْوَالٍ يَحُجُّونَ بِهَا، وَيَعْتَمِرُوْنَ، وَيُجَاهِدُوْنَ، وَيَتَصَدَّقُونَ قَالَ أَلاَ أُحَدِّثُكُمْ بِأَمْرٍ إِنْ أَخَذْتُمْ بِهِ أَدْرَكْتُمْ مَنْ سَبَقَكُمْ وَلَمْ يُدْرِكْكُمْ أَحَدٌ بَعْدَكُمْ، وَكُنْتُمْ خَيْرَ مَنْ أَنْتُمْ بَيْنَ ظَهْرَانَيْهِ، إِلاَّ مَنْ عَمِلَ مِثْلَهُ تُسَبِّحُونَ وَتَحْمَدُوْنَ، وَتُكَبِّرُوْنَ خَلْفَ كُلِّ صَلاَةٍ ثَلاَثًا وَثَلاَثِيْنَ. فَاخْتَلَفْنَا بَيْنَنَا فَقَالَ بَعْضُنَا نُسَبِّحُ ثَلاَثًا وَثَلاَثِينَ، وَنَحْمَدُ ثَلاَثًا وَثَلاَثِينَ، وَنُكَبِّرُ أَرْبَعًا وَثَلاَثِيْنَ. فَرَجَعْتُ إِلَيْهِ فَقَالَ تَقُولُ سُبْحَانَ اللهِ، وَالْحَمْدُ لِلَّهِ، وَاللهُ أَكْبَرُ، حَتَّى يَكُونَ مِنْهُنَّ كُلِّهِنَّ ثَلاَثًا وَثَلاَثِيْنَ.

আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, দরিদ্রলোকেরা নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট এসে বললেন, সম্পদশালী ও ধনী ব্যক্তিরা তাদের সম্পদের দ্বারা উচ্চমর্যাদা ও স্থায়ী আবাস লাভ করছেন। তাঁরা আমাদের মত ছালাত আদায় করছেন, আমাদের মত ছিয়াম পালন করছেন এবং অর্থের দ্বারা হজ্জ, ওমরাহ, জিহাদ ও ছাদাক্বাহ করার মর্যাদাও লাভ করছেন। একথা শুনে তিনি বললেন, আমি কি তোমাদের এমন কিছু কাজের কথা বলব, যা তোমরা করলে, যারা নেক কাজে তোমাদের চেয়ে অগ্রগামী হয়ে গেছে, তাদের পর্যায়ে পৌঁছতে পারবে। তোমাদের পরে কেউ তোমাদের নাগাল পাবে না। আর তোমাদের সামনে যারা আছে তাদের মধ্যে তোমরা সর্বোত্তম। তবে যারা পুনরায় এ ধরনের কাজ করবে তাদের কথা স্বতন্ত্র। তোমরা প্রত্যেক ছালাতের পর তেত্রিশ বার করে তাসবীহ্ (সুবহানাল্লাহ্), তাহমীদ (আলহামদু লিল্লাহ্) এবং তাকবীর (আল্লাহু আকবার) পাঠ করবে। (এ নিয়ে) আমাদের মধ্যে মতানৈক্য সৃষ্টি হ’ল। কেউ বলল, আমরা তেত্রিশ বার তাসবীহ্ পড়ব। তেত্রিশ বার তাহমীদ আর চৌত্রিশ বার তাকবীর পড়ব। অতঃপর আমি তাঁর নিকট ফিরে গেলাম। তিনি বললেন, ‘সুবহানাল্লাহ, আল-হামদুলিল্লাহ ও আল্লাহু আকবার’ বলবে, যাতে সবগুলোই তেত্রিশবার করে হয়ে যায়।[8]

৩. রামাযান মাসে ওমরাহ করা :

রামাযান বছরের শ্রেষ্ঠ মাস। এ মাসে সকল আমলের নেকী বান্দা দ্বিগুণ হারে লাভ করে। অনুরূপভাবে এই মাসে ওমরাহ সম্পাদনের মাধ্যমে হজ্জ করার সমপরিমাণ ছওয়াব অর্জন করা যায়।

আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হজ্জ থেকে ফিরে এসে উম্মে সিনান নামক এক আনছার মহিলাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কেন আমার সাথে হজ্জ পালন করলে না? তখন মহিলাটি বলল, ‘আমার স্বামীর দু’টি সেচের উট ছিল। একটি নিয়ে তিনি হজ্জে গেছেন। আরেকটি জমি সেচের কাজে নিয়োজিত আছে (সেই জন্য আমি হজ্জ করতে পারিনি)। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, فَإِنَّ عُمْرَةً فِيْ رَمَضَانَ تَقْضِيْ حَجَّةً أَوْ حَجَّةً مَعِيْ ‘রামাযান মাসে ওমরাহ করা হজ্জ করার ন্যায় অথবা আমার সাথে হজ্জ করার ন্যায়’।[9] অন্যত্র তিনি বলেছেন, إِنَّ عُمْرَةً فِىْ رَمَضَانَ تَعْدِلُ حَجَّةً، ‘নিশ্চয়ই রামাযান মাসের ওমরাহ একটি হজ্জের সমান।[10]

তবে এই ওমরাহ পালনে হজ্জের ফরযিয়্যাত আদায় হবে না; বরং হজ্জের সমপরিমাণ নেকী পাওয়া যাবে।

৪. নিজ অর্থ ব্যয়ে অপরকে হজ্জ করানো :

কোন ব্যক্তিকে হজ্জ করালে হজ্জের সমপরিমাণ নেকী লাভ করা যায়। এমনকি যদি কেউ তার মৃত পিতা-মাতার পক্ষ থেকেও হজ্জ সম্পাদন করেন, আল্লাহ হজ্জের নেকী সেই মৃতের কবরে পৌঁছিয়ে দেন।[11] সালাফে ছালেহীন নিজেরা হজ্জ পালন করার পাশাপাশি অপরকেও হজ্জ করার ব্যাপারে সহযোগিতা করতেন। কেননা রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ دَلَّ عَلَى خَيْرٍ فَلَهُ مِثْلُ أَجْرِ فَاعِلِهِ، ‘যে ব্যক্তি অন্য কোন মানুষকে কোন সৎ কাজের পথ দেখায় (উৎসাহিত করে), সে ঐ নেক কাজ সম্পাদনকারীর সমান ছওয়াব পাবে’।[12] সেকারণ তাদের অনেকেই রাসূল (ছাঃ)-এর নিম্নোক্ত আহবানে সাড়া দিয়ে বেশী বেশী হজ্জ ও ওরমাহ পালনের ব্যাপারে অতি আগ্রহী ছিলেন। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,

تَابِعُوْا بَيْنَ الحَجِّ وَالعُمْرَةِ، فَإِنَّهُمَا يَنْفِيَانِ الفَقْرَ وَالذُّنُوْبَ كَمَا يَنْفِي الكِيْرُ خَبَثَ الحَدِيْدِ، وَالذَّهَبِ، وَالفِضَّةِ، وَلَيْسَ لِلْحَجَّةِ المَبْرُوْرَةِ ثَوَابٌ إِلَّا الجَنَّةُ،

‘তোমরা হজ্জ ও ওমরাহ কাছাকাছি সময়ে আদায় করো (হজ্জ ও ওমরাহ একসাথে আদায় করো অথবা একটির পর আরেকটি আদায় করো)। কেননা হজ্জ ও ওমরাহ এমন ইবাদত, যা দরিদ্রতাকে দূর করে দেয় এবং পাপসসমূহ মুছে দেয়, যেমনভাবে কামারের হাঁপর লোহার মরিচা ও স্বর্ণ- রৌপ্যের যাবতীয় ময়লা দূরীভূত করে দেয়। আর কবুল হজ্জের প্রতিদান কেবলমাত্র জান্নাত’।[13]

এই হাদীছ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে প্রখ্যাত ফক্বীহ মুসলিম বিন ইয়াসার (রহঃ) প্রত্যেক বছরই তার নিকটতম ব্যক্তিদের নিয়ে হজ্জ করতেন।[14] প্রখ্যাত তাবেঈ আব্দুল্লাহ বিন মুবারাক (রহঃ) ধনী ব্যক্তি ছিলেন। তিনিও তাঁর আত্মীয়-প্রতিবেশীদেরকে হজ্জ করাতেন।[15]

৫. ইশরাক্বের ছালাত আদায় করা :

‘শুরূক’ শব্দের অর্থ সূর্য উদিত হওয়া। সূর্যোদয়ের পরপরেই দিনের প্রথম প্রহরের শুরুতে যে ছালাত আদায় করা হয়, তাকে ইশরাক্বের ছালাত (صلاة الإشراق) বলে। আনাস বিন মালেক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ صَلَّى الْغَدَاةَ فِيْ جَمَاعَةٍ ثُمَّ قَعَدَ يَذْكُرُ اللهَ حَتَّى تَطْلُعَ الشَّمْسُ، ثُمَّ صَلَّى رَكْعَتَيْنِ كَانَتْ لَهُ كَأَجْرِ حَجَّةٍ وَعُمْرَةٍ تَامَّةٍ تَامَّةٍ تَامَّةٍ. ‘যে ব্যক্তি জামা‘আতের সাথে ফজরের ছালাত আদায়ের পর সূর্যোদয় পর্যন্ত বসে আল্লাহর যিকিরে মশগূল থাকল, অতঃপর (সূর্যোদয়ের পর) দুই রাক‘আত ছালাত আদায় করল, তার জন্য একটি পূর্ণ হজ্জ ও একটি পূর্ণ ওমরার নেকী রয়েছে’।[16]

যদিও এই ছালাত প্রতিদিন আদায় করা আবশ্যক নয়। কিন্তু খুব কম সংখ্যক মানুষই এই সুন্নাতটির প্রতি আমল করে। ব্যস্ততা থাকলেও অন্তত সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে এই সুন্নাতের উপর আমল করে হজ্জ ও ওমরার নেকী একসাথে লাভ করা যায়। তাছাড়া কূবা মসজিদে নফল ছালাত আদায়ের মাধ্যমেও ওমরার নেকী লাভ করা যায়। সাহল বিন হুনাইফ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ تَطَهَّرَ فِيْ بَيْتِهِ ثُمَّ أَتَى مَسْجِدَ قُبَاءَ، فَصَلَّى فِيْهِ صَلَاةً، كَانَ لَهُ كَأَجْرِ عُمْرَةٍ، ‘যে ব্যক্তি বাড়ীতে ওযূ করে পবিত্র হয়ে মসজিদে কূবায় এসে ছালাত আদায় করবে, তার জন্য রয়েছে ওমরার সমপরিমাণ ছওয়াব’।[17]

৬. মসজিদে তা‘লীমী বৈঠক বা দরসে অংশগ্রহণ করা :

যে সকল মসজিদে তা‘লীমী বৈঠক, দ্বীনী আলোচনা বা দরস অনুষ্ঠিত হয়, এতে হাযির হ’লে পরিপূর্ণ হজ্জের ছওয়াব লাভ করা যায়। ছাহাবী আবু উমামা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ غَدَا إِلَى الْمَسْجِدِ لَا يُرِيْدُ إِلَّا أَنْ يَتَعَلَّمَ خَيْرًا أَوْ يَعْلَمَهُ، كَانَ لَهُ كَأَجْرِ حَاجٍّ تَامًّا حِجَّتُهُ. ‘যে ব্যক্তি দ্বীনী জ্ঞান অর্জন অথবা ঐ জ্ঞান বিতরণের জন্যই শুধু মসজিদে গমন করে, তার জন্য পরিপূর্ণ হজ্জের নেকী রয়েছে’।[18]

আমরা অনেক সময় বিভিন্ন অজুহাতে মসজিদের এই সকল দ্বীনী বৈঠকে উপস্থিত থাকতে চাই না। আবার অনেক সময় মনে করি ফেইসবুক লাইভে অথবা ইউটিউবে পরবর্তীতে আলোচনাটা শুনে নেব। এতে আমরা বিশাল ছওয়াব থেকে বঞ্চিত হয়ে যাই, যা ঐ বৈঠকে হাযির হওয়া ব্যতীত লাভ করা সম্ভব নয়। কারণ ফেরেশতামন্ডলী এই মজলিসগুলো ঘিরে রাখেন এবং সেখানে আল্লাহর রহমত নাযিল হয়।[19] আর উপস্থিত হওয়ার প্রতিদান হিসাবে হজ্জের নেকী তো আছেই।

৭. ফরয ছালাত মসজিদে আদায় করা :

পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আদায় করা যেমন ফরয, তেমনি এই ফরয ছালাত মসজিদে জামা‘আতের সাথে আদায় করাও অপরিহার্য। কারণ কোন শারঈ ওযর ছাড়া মসজিদে জামা‘আতে হাযির না হয়ে বাড়ীতে, দোকানে বা অফিসে একাকী ছালাত আদায় করা সিদ্ধ নয়।[20] আর যারা বাড়ী থেকে পবিত্র হয়ে মসজিদে এসে জামা‘আতের সাথে ছালাত আদায়  করে তার মর্যাদা হজ্জ সম্পাদনকারীর মত। উমামা বাহেলী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,

مَنْ خَرَجَ مِنْ بَيْتِهِ مُتَطَهِّرًا إِلَى صَلَاةٍ مَكْتُوْبَةٍ فَأَجْرُهُ كَأَجْرِ الْحَاجِّ الْمُحْرِمِ، وَمَنْ خَرَجَ إِلَى تَسْبِيْحِ الضُّحَى لَا يَنْصِبُهُ إِلَّا إِيَّاهُ فَأَجْرُهُ كَأَجْرِ الْمُعْتَمِرِ، وَصَلَاةٌ عَلَى أَثَرِ صَلَاةٍ لَا لَغْوَ بَيْنَهُمَا كِتَابٌ فِي عِلِّيِّيْنَ.

‘যে ব্যক্তি বাড়ী থেকে পরিত্র হয়ে ফরয ছালাত আদায়ের উদ্দেশ্যে মসজিদে গমন করবে, তার প্রতিদান ইহরাম পরিহিত একজন হজ্জ পালনকারীর ন্যায়। আর যে ব্যক্তি শুধুমাত্র চাশতের ছালাত আদায়ের উদ্দেশ্যেই মসজিদে গমন করে, তার প্রতিদান একজন ওমরাহ পালনকারীর ন্যায়। আর এক ছালাতের পর অপর ছালাতের মধ্যবর্তী সময়ে কোন অহেতুক কথা-কর্ম ত্যাগ করলে, তার আমলনামা ইল্লিয়ীনে রাখা হয়’।[21] অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَنْ مَشَى إلَى صَلاةٍ مَكْتُوبَةٍ فِي الْجَمَاعَةِ فَهِيَ كَحَجَّةٍ، وَمَنْ مَشَى إلَى صَلاةِ تَطَوُّعٍ فَهِيَ كَعُمْرَةٍ نَافِلَةٍ، ‘যে ব্যক্তি ফরয ছালাত জামা‘আতে আদায়ের জন্য (মসজিদে) গমন করে, সে হজ্জের সমান নেকী লাভ করে। আর যে ব্যক্তি নফল ছালাত আদায়ের জন্য (মসজিদে) গমন করে, সে নফল ওমরার সমান নেকী লাভ করে’।[22]

অতএব যে ব্যক্তি তার বাড়ীতে ওযূ করে পবিত্র হয়ে ফরয ছালাত আদায়ের উদ্দেশ্যে দৈনিক পাঁচ বার মসজিদে যায়, আল্লাহ তার আমলনামায় প্রতিদিন পাঁচটি হজ্জের ছওয়াব লিখে দেন। উপরন্তু প্রতি কদমে তার পাপ ঝরে যায়, মর্যাদা বৃদ্ধি করা হয়, ফেরেশতারা তার জন্য দো‘আ করে এবং একাকী ছালাত আদায় করার চেয়ে সাতাশ গুণ বেশী নেকী লাভ করে।[23] এর কারণ হ’ল বায়তুল্লাহর যিয়ারতকারী যেমন আল্লাহর মেহমান, অনুরূপভাবে মসজিদে আগমনকারী ব্যক্তিও আল্লাহর মেহমান। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ تَوَضَّأَ فِيْ بَيْتِهِ فَأَحْسَنَ الْوَضُوْءَ، ثُمَّ أَتَى الْمَسْجِدَ؛ فَهُوَ زَائِرُ اللهِ، وَحَقٌّ عَلىَ الَمَزُوْرِ أنْ يُّكْرَمَ الزَّائِرَ. ‘যে ব্যক্তি বাড়ীতে সুন্দর করে ওযূ করে মসজিদে আগমন করে, সে ব্যক্তি আল্লাহর মেহমান। আর মেহমানকে সম্মানিত করা মেযবানের কর্তব্য হয়ে যায়’।[24]

সম্মানিত পাঠক! একটু ভেবে দেখুন হজ্জ বা ওমরা পালন করতে হ’লে কত শ্রম, টাকা-পয়সা ও সময় খরচের প্রয়োজন রয়েছে। অথচ উপরোক্ত আমলগুলো সম্পাদনের মাধ্যমে আমরা ধনী-গরীব নির্বিশেষে সবাই হজ্জ বা ওমরাহর নেকী অর্জন করতে পারি। শুধু প্রয়োজন ইবাদতের ব্যাপারে একনিষ্ঠতা ও সচেতনতা। মহান আল্লাহ আমাদেরকে একনিষ্ঠভাবে তাঁর ইবাদত-বন্দেগী করার তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!

আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ


  • [1]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২৫০৭।
  • [2]. মুসলিম হা/১২১; মিশকাত হা/২৮।
  • [3]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/২৫০৮।
  • [4]. মুসলিম হা/১২৮।
  • [5]. মুসলিম হা/১৯১১।
  • [6]. বুখারী হা/২৮৩৯, ৪৪২৩; মিশকাত হা/৩৮১৫।
  • [7]. মুসলিম হা/১৯১১; ইবনু মাজাহ হা/২৭৬৫।
  • [8]. বুখারী হা/৮৪৩, ৬৩২৯; মুসলিম হা/৫৯৫।
  • [9]. বুখারী হা/১৮৬৩; ‘হজ্জ’ অধ্যায়, ‘মহিলাদের হজ্জ’ অনুচ্ছেদ।
  • [10]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২৫০৯।
  • [11]. আবূদাঊদ হা/২৮৮৩, সনদ হাসান।
  • [12]. মুসলিম হা/১৮৯৩।
  • [13]. তিরমিযী হা/৮১০; নাসাঈ হা/২৬৩১; মিশকাত হা/২৫২৪; সনদ ছহীহ।
  • [14]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৪/৫১২।
  • [15]. ঐ, ৭/৩৬৮-৬৯।
  • [16]. তিরমিযী হা/৫৮৬; মিশকাত হা/৯৭১, সনদ হাসান।
  • [17]. ইবনু মাজাহ হা/১৪১২, সনদ ছহীহ।
  • [18]. তাবারাণী, মু‘জামুল কাবীর হা/৭৪৭৩; ছহীহ আত-তারগীব হা/৮৬।
  • [19]. মুসলিম হা/২৭০০; তিরমিযী হা/৩৩৭৮; ইবনে মাজাহ হা/২২৫; মিশকাত হা/২২৬১।
  • [20]. ইবনু মাজাহ হা/৭৯৩, সনদ ছহীহ।
  • [21]. আবূদাঊদ হা/৫৫৮; মিশকাত/৭২৮, সনদ হাসান।
  • [22]. ছহীহুল জামে‘ হা/৬৫৫৬।
  • [23]. বুখারী হা/৬৪৫,৬৫৯; আবূদাঊদ হা/৫৬৩।
  • [24]. ছহীহুত তারগীব ওয়াত তারহীব হা/৩২২।

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button