আদব ও আমল

সালামের আদব সমূহ

মুসলমানদের পরস্পরের সাথে সাক্ষাৎ হ’লে কিভাবে অভিবাদন জানাবে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা রয়েছে ইসলামে। সেই সাথে কে কাকে সালাম দিবে এবং কখন, কিভাবে সালাম প্রদান করবে এ সম্পর্কিত সবিস্তার আদব বর্ণিত হয়েছে হাদীছে। এগুলি সাধ্যমত মেনে চললে পাস্পরিক সম্পর্ক সুদৃঢ় হবে এবং অগণিত নেকী অর্জিত হবে। নিম্নে সালামের আদবগুলি উল্লেখ করা হ’ল।-

১. সালামের শব্দ :

সালাম দেওয়ার ক্ষেত্রে ‘আস-সালামু আলায়কুম’ বলতে হবে। عليك السلام (আলায়কাস সালাম) বলা সুন্নাত নয়।

عَنْ أَبِى جُرَىٍّ الْهُجَيْمِىِّ قَالَ أَتَيْتُ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم فَقُلْتُ عَلَيْكَ السَّلاَمُ يَا رَسُوْلَ اللهِ. قَالَ لاَ تَقُلْ عَلَيْكَ السَّلاَمُ فَإِنَّ عَلَيْكَ السَّلاَمُ تَحِيَّةُ الْمَوْتَى.

আবূ জুরাই আল-হুজাইমী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট এসে বললাম, ‘আলায়কাস সালামু’ ইয়া রাসূলাল্লাহ! রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘আলায়কাস সালাম’ বল না। কারণ এটা হ’ল মৃতের প্রতি সালাম’।[1] অন্য বর্ণনায় এসেছে,عَنْ جَابِرِ بْنِ سُلَيْمٍ قَالَ أَتَيْتُ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم فَقُلْتُ عَلَيْكَ السَّلاَمُ. فَقَالَ لاَ تَقُلْ عَلَيْكَ السَّلاَمُ وَلَكِنْ قُلِ السَّلاَمُ عَلَيْكَ. জাবির ইবনু সুলাইম (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট এসে বললাম, ‘আলায়কাস সালাম’। তিনি বললেন, ‘আলায়কাস সালাম’ বল না, বরং ‘আসসালামু আলায়কা’ বল।[2]

প্রয়োজনে তিনবার সালাম দেওয়া যায়। যেমন সালাম দেওয়ার পর কেউ শুনতে না পেলে বা অনুমতির ক্ষেত্রে তিনবার সালাম দেওয়া যায়। হাদীছে এসেছে,

عَنْ أَبِى تَمِيْمَةَ الْهُجَيْمِىِّ عَنْ رَجُلٍ مِنْ قَوْمِهِ قَالَ طَلَبْتُ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم فَلَمْ أَقْدِرْ عَلَيْهِ فَجَلَسْتُ فَإِذَا نَفَرٌ هُوَ فِيْهِمْ وَلاَ أَعْرِفُهُ وَهُوَ يُصْلِحُ بَيْنَهُمْ فَلَمَّا فَرَغَ قَامَ مَعَهُ بَعْضُهُمْ فَقَالُوْا يَا رَسُوْلَ اللهِ. فَلَمَّا رَأَيْتُ ذَلِكَ قُلْتُ عَلَيْكَ السَّلاَمُ يَا رَسُوْلَ اللهِ عَلَيْكَ السَّلاَمُ يَا رَسُوْلَ اللهِ عَلَيْكَ السَّلاَمُ يَا رَسُولَ اللهِ. قَالَ إِنَّ عَلَيْكَ السَّلاَمُ تَحِيَّةُ الْمَيِّتِ إِنَّ عَلَيْكَ السَّلاَمُ تَحِيَّةُ الْمَيِّتِ. ثَلاَثًا ثُمَّ أَقْبَلَ عَلَىَّ فَقَالَ إِذَا لَقِىَ الرَّجُلُ أَخَاهُ الْمُسْلِمَ فَلْيَقُلِ السَّلاَمُ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَةُ اللهِ. ثُمَّ رَدَّ عَلَىَّ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم قَالَ وَعَلَيْكَ وَرَحْمَةُ اللهِ وَعَلَيْكَ وَرَحْمَةُ اللهِ وَعَلَيْكَ وَرَحْمَةُ اللهِ.

আবূ তামীম আল-হুজাইমী (রাঃ) হ’তে তার বংশের জনৈক ব্যক্তির সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী করীম (ছাঃ)-কে খোঁজ করে না পেয়ে বসে রইলাম। এরই মধ্যে আমি তাকে একদল লোকের মাঝে দেখতে পেলাম, কিন্তু আমি তাকে চিনতাম না। তাদের মাঝে তিনি মীমাংসা করছিলেন। কাজ শেষে কয়েকজন তাঁর সাথে উঠে দাঁড়াল এবং বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমি এটা দেখে তাকে বললাম, আলায়কাস সালামু ইয়া রাসূলাল্লাহ! আলায়কাস সালামু ইয়া রাসূলাল্লাহ আলায়কাস সালামু ইয়া রাসূলাল্লাহ! তিনি বললেন, আলায়কাস সালামু হল মৃত ব্যক্তির জন্য সালাম। এ কথাটি তিনি তিন বার বললেন। তারপর তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কোন ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের সাথে সাক্ষাতের সময় যেন বলে, আস-সালামু আলায়কুম ওয়া রহমাতুল্লাহ। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমার সালামের উত্তর দিলেন, ওয়া আলাইকা ওয়া রহমাতুল্লাহ, ওয়া আলাইকা ওয়া রহমাতুল্লাহ, ওয়া আলাইকা ওয়া রহমাতুল্লাহ।[3]

২. কথা বলার পূর্বেই সালাম দেওয়া :

কথা বলার আগেই সালাম দেওয়া মুস্তাহাব। রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِنَّ أَوْلَى النَّاسِ بِاللهِ مَنْ بَدَأَهُمْ بِالسَّلاَمِ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকটে উত্তম সেই ব্যক্তি, যে প্রথমে সালাম দেয়’।[4] অন্য বর্ণনায় এসেছে, আবূ উমামাহ্ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হ’ল, হে আল্লাহর রাসূল! দু’জন লোকের মধ্যে সাক্ষাৎ হ’লে কে প্রথম সালাম দিবে? তিনি বললেন, তাদের মধ্যে যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার বেশী নিকটবর্তী’।[5]

প্রথমে সালাম না দিলে রাসূল (ছাঃ) কথা বলার অনুমতি দিতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন,لاَ تَأْذَنُوْا لِمَنْ لَمْ يَبْدَأْ بِالسَّلاَمِ ‘যে ব্যক্তি আগে সালাম দেয় না তোমরা তাকে (কথা বলার) অনুমতি দিও না’।[6]

৩. সালামের পুনরাবৃত্তি :

তিনবার সালাম দেওয়া মুস্তাহাব। রাসূল (ছাঃ) কোন কোন কথা তিনবার বলতেন। আনাস (রাঃ) বলেন,كَانَ إِذَا تَكَلَّمَ بِكَلِمَةٍ أَعَادَهَا ثَلاَثًا حَتَّى تُفْهَمَ عَنْهُ، وَإِذَا أَتَى عَلَى قَوْمٍ فَسَلَّمَ عَلَيْهِمْ سَلَّمَ عَلَيْهِمْ ثَلاَثًا ‘নবী করীম (ছাঃ) যখন কোন কথা বলতেন তখন তা বুঝে নেয়ার জন্য তিনবার বলতেন। আর যখন তিনি কোন গোত্রের নিকট এসে সালাম দিতেন, তাদের প্রতি তিনবার সালাম দিতেন।[7]

৪. কে কাকে সালাম দিবে :

চলমান ব্যক্তি উপবিষ্টকে, আরোহী পদব্রজে ব্যক্তিকে, কম সংখ্যক লোক অধিক সংখ্যককে এবং ছোটরা বড়দেরকে সালাম দিবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন,يُسَلِّمُ الرَّاكِبُ عَلَى الْمَاشِى، وَالْمَاشِى عَلَى الْقَاعِدِ، وَالْقَلِيلُ عَلَى الْكَثِيرِ، ‘আরোহী পদচারীকে, পদচারী উপবিষ্টকে এবং অল্প সংখ্যক অধিক সংখ্যককে সালাম দিবে’।[8] অন্যত্র তিনি বলেন,يُسَلِّمُ الصَّغِيرُ عَلَى الْكَبِيرِ، وَالْمَارُّ عَلَى الْقَاعِدِ، وَالْقَلِيلُ عَلَى الْكَثِيرِ، ‘ছোটরা বড়দেরকে, পদচারী উপবিষ্টকে এবং অল্প সংখ্যক অধিক সংখ্যককে সালাম দিবে’।[9]

৫. সশব্দে সালাম ও উত্তর দেওয়া :

এমন শব্দে সালাম ও সালামের উত্তর দিতে হবে যাতে অন্যরা শুনতে পায়। তবে কোথাও ঘুমন্ত মানুষ থাকলে এমনভাবে সালাম দিবে যাতে জাগ্রত লোকেরা শুনতে পায় এবং ঘুমন্ত লোকের কোন অসুবিধা না হয়। মিক্বদাদ (রাঃ) বলেন,فَكُنَّا نَحْتَلِبُ فَيَشْرَبُ كُلُّ إِنْسَانٍ مِنَّا نَصِيبَهُ وَنَرْفَعُ لِلنَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم نَصِيبَهُ قَالَ فَيَجِىءُ مِنَ اللَّيْلِ فَيُسَلِّمُ تَسْلِيمًا لاَ يُوقِظُ نَائِمًا وَيُسْمِعُ الْيَقْظَانَ، ‘এরপর থেকে আমরা দুধ দোহন করতাম। আমাদের সবাই যার যার অংশ পান করতো। আর আমরা নবী করীম (ছাঃ)-এর জন্য তাঁর অংশ উঠিয়ে রাখতাম। মিক্বদাদ (রাঃ) বলেন, তিনি রাত্রে এসে এমনভাবে সালাম দিতেন যাতে নিদ্রারত লোক উঠে না যায় এবং জাগ্রত লোক শুনতে পায়’।[10]

৬. সমাবেশে প্রবেশ ও বের হওয়ার সময় সালাম দেওয়া :

কোন সভায় প্রবেশকালে ও বের হওয়ার সময় উপস্থিত সদস্যদের উদ্দেশ্যে সালাম দেওয়া সুন্নাত। রাসূল (ছাঃ) বলেন,إِذَا انْتَهَى أَحَدُكُمْ إِلَى مَجْلِسٍ فَلْيُسَلِّمْ فَإِنْ بَدَا لَهُ أَنْ يَّجْلِسَ فَلْيَجْلِسْ ثُمَّ إِذَا قَامَ فَلْيُسَلِّمْ فَلَيْسَتِ الْأُولَى بِأَحَقَّ مِنَ الْآخِرَةِ- ‘যখন তোমাদের কেউ মজলিসে পৌঁছবে তখন যেন সে সালাম করে। এরপর যদি তার সেখানে বসতে ইচ্ছা হয় তবে বসবে। অতঃপর যখন উঠে দাঁড়াবে তখনও সে যেন সালাম দেয়। শেষেরটির চাইতে প্রথমটি বেশী উপযুক্ত নয়’।[11]

এক সাথে অনেকে বা দলগতভাবে চলার সময় ঐ দলের পক্ষ থেকে একজন সালাম দিলে তা সকলের জন্য যথেষ্ট হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন,يُجْزِئُ عَنِ الْجَمَاعَةِ إِذَا مَرُّوْا أَنْ يُسَلِّمَ أَحَدُهُمْ وَيُجْزِئُ عَنِ الْجُلُوْسِ أَنْ يَرُدَّ أَحَدُهُمْ، ‘পথ অতিক্রমকালে দলের একজন যদি সালাম দেয় তাহ’লে তা সকলের জন্য যথেষ্ট। এমনিভাবে উপবিষ্টদের একজন তার উত্তর দিলে তা সকলের জন্য যথেষ্ট’।[12]

৭. বাড়ীতে বা গৃহে প্রবেশকালে সালাম দেওয়া :

বাড়ীতে বা গৃহে প্রবেশকালে প্রবেশকারী সালাম দিবে, যদিও ঐ ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কেউ ঐ ঘরে বসবাস না করে। আল্লাহ বলেন,فَإِذَا دَخَلْتُمْ بُيُوْتًا فَسَلِّمُوْا عَلَى أَنْفُسِكُمْ تَحِيَّةً مِنْ عِنْدِ اللهِ مُبَارَكَةً طَيِّبَةً- ‘অতঃপর যখন তোমরা গৃহে প্রবেশ করবে তখন পরস্পরে সালাম করবে। এটি আল্লাহর নিকট হ’তে প্রাপ্ত বরকমন্ডিত ও পবিত্র অভিবাদন’ (নূর ২৪/৬১)

অন্যের বাড়ীতে বা ঘরে প্রবেশকালেও সালাম দিবে। আল্লাহ বলেন,يَاأَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا لَا تَدْخُلُوْا بُيُوْتًا غَيْرَ بُيُوْتِكُمْ حَتَّى تَسْتَأْنِسُوْا وَتُسَلِّمُوْا عَلَى أَهْلِهَا ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُوْنَ- ‘হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদের গৃহ ব্যতীত অন্যের গৃহে প্রবেশ করো না, যতক্ষণ না তোমরা অনুমতি নিবে এবং এর বাসিন্দাদের সালাম দিবে। এটাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর’ (নূর ২৪/২৭)

রাসূল (ছাঃ) বলেন,

ثَلاثَةٌ كُلُّهُمْ ضَامِنٌ عَلَى اللهِ إِنْ عَاشَ رُزِقَ وَكُفِيَ وَإِنْ مَاتَ أَدْخَلَهُ اللهُ الْجَنَّةَ مَنْ دَخَلَ بَيْتَهُ فَسَلَّمَ فَهُوَ ضَامِنٌ عَلَى اللهِ وَمَنْ خَرَجَ إِلَى الْمَسْجِدِ فَهُوَ ضَامِنٌ عَلَى اللهِ وَمَنْ خَرَجَ فِيْ سَبِيْل الله فَهُوَ ضَامِنٌ عَلَى اللهِ.

‘তিন ব্যক্তি আল্লাহর যিম্মায় থাকে। যদি তারা বেঁচে থাকে তাহ’লে রিযিকপ্রাপ্ত হয় এবং তা যথেষ্ট হয়। আর যদি মৃত্যুবরণ করে তাহ’লে আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। যে ব্যক্তি বাড়ীতে প্রবেশ করে বাড়ীর লোকজনকে সালাম দেয়, সে আল্লাহর যিম্মায় থাকে। যে ব্যক্তি মসজিদের উদ্দেশ্যে বের হয়, সে আল্লাহর যিম্মায় থাকে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় বের হয়, সে আল্লাহর যিম্মায় থাকে’।[13]

এমনকি পরিত্যক্ত ঘরে প্রবেশ করলে বলবে,السَّلَامُ عَلَيْنَا وَعَلَى عِبَادِ اللهِ الصَّالِحِيْنَ- ‘আমাদের উপরে ও আল্লাহর সৎকর্মশীল বান্দাদের উপরে শান্তি বর্ষিত হোক’।[14]

৮. প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণকারী ব্যক্তিকে সালাম না দেওয়া :

প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণকারীকে সালাম দেওয়া উচিত নয়। আল-মুহাজির ইবনু কুনফুয (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, একদা তিনি নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট গিয়ে তাঁকে সালাম দিলেন। তখন নবী (ছাঃ) পেশাব করছিলেন। সেজন্য ওযূ না করা পর্যন্ত তিনি তার জবাব দিলেন না। অতঃপর (পেশাব শেষে ওযূ করে) তিনি তার নিকট ওযর পেশ করে বললেন, পবিত্রতা ছাড়া আল্লাহর নাম স্মরণ করা আমি অপসন্দ করি’।[15]

আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,أَنَّ رَجُلاً مَرَّ وَرَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَبُولُ فَسَلَّمَ فَلَمْ يَرُدَّ عَلَيْهِ. ‘জনৈক ব্যক্তি নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট দিয়ে অতিক্রমকালে তাঁকে সালাম করল, তিনি তখন পেশাব করছিলেন। তিনি তার সালামের জবাব দিলেন না’।[16]

৯. শিশুদের সালাম দেওয়া :

শিশুদের সালাম দেওয়া মুস্তাহাব। আনাস (রাঃ) একবার একদল শিশুর পাশ দিয়ে অতিক্রমকালে তাদের সালাম করে বললেন যে, নবী করীম (ছাঃ)ও অনুরূপ করতেন।[17]

১০. ইহূদী-নাছারাদেরকে আগে সালাম না দেওয়া :

ইহূদী-নাছারা ও বিধর্মীদেরকে আগে সালাম দেওয়া যাবে না। রাসূল (ছাঃ) বলেন, لاَ تَبْدَءُوا الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى بِالسَّلاَمِ ‘তোমরা ইহুদী-নাছারাদেরকে প্রথমে সালাম করো না’।[18] তবে তারা সালাম দিলে উত্তরে শুধু ‘ওয়া আলাইকুম’ বলতে হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন,إِذَا سَلَّمَ عَلَيْكُمْ أَهْلُ الْكِتَابِ فَقُوْلُوْا وَعَلَيْكُمْ ‘যখন কোন আহলে কিতাব তোমাদের সালাম দেয়, তখন তোমরা বলবে ওয়া আলায়কুম (তোমাদের উপরেও)’।[19]

১১. পরিচিত-অপরিচিত সকল মুসলিমকে সালাম দেওয়া :

মুসলিম মাত্রেই সালাম দেওয়া উচিত। সে আত্মীয় হোক বা অনাত্মীয়, পরিচিত হোক বা অপরিচত। রাসূল (ছাঃ) বলেন, تُطْعِمُ الطَّعَامَ، وَتَقْرَأُ السَّلاَمَ عَلَى مَنْ عَرَفْتَ وَمَنْ لَمْ تَعْرِفْ ‘তুমি খাদ্য খাওয়াবে ও পরিচিত-অপরিচিত সবাইকে সালাম দিবে’।[20]

১২. সালাম বহনকারী ও প্রেরণকারীর উত্তর দেওয়া :

কেউ কারো মাধ্যমে সালাম প্রেরণ করলে যে সালাম বহন করে নিয়ে আসবে, তাকে ও সালাম প্রদানকারীকে উত্তর দেওয়া উচিত। হাদীছে এসেছে,

عَنْ غَالِبٍ قَالَ إِنَّا لَجُلُوْسٌ بِبَابِ الْحَسَنِ إِذْ جَاءَ رَجُلٌ فَقَالَ حَدَّثَنِى أَبِى عَنْ جَدِّى قَالَ بَعَثَنِى أَبِى إِلَى رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ ائْتِهِ فَأَقْرِئْهُ السَّلاَمَ. قَالَ فَأَتَيْتُهُ فَقُلْتُ إِنَّ أَبِى يُقْرِئُكَ السَّلاَمَ. فَقَالَ عَلَيْكَ وَعَلَى أَبِيكَ السَّلاَمُ.

গালিব (রহঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা হাসান (রাঃ)-এর বাড়ির দরজায় বসা ছিলাম। এ সময় এক জন লোক এসে বলল, আমার পিতা আমার দাদার সূত্রে আমার নিকট বর্ণনা করেছেন যে, আমাকে আমার পিতা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট পাঠালেন। তিনি বললেন, তাঁর নিকট গিয়ে তাঁকে সালাম জানাবে। তিনি বলেন, আমি তাঁর নিকট পৌঁছে বললাম, আমার পিতা আপনাকে সালাম দিয়েছেন। তিনি বললেন, ‘আলায়কা ওয়া আলা আবীকাস সালাম (তোমার ও তোমার পিতার উপর শান্তি বর্ষিত হোক)’।[21]

১৩. ইশরায় সালাম ও উত্তর না দেওয়া :

ইশারায় সালাম দেওয়া যাবে না। তবে কেউ বোবা হলে কিংবা দূরে অবস্থানকারী হ’লে মুখে উচ্চারণসহ ইশারায় সালাম বা উত্তর দিতে পারে। অনুরূপভাবে বধিরকে সালাম দেওয়ার ক্ষেত্রেও মুখে উচ্চারণসহ ইশারায় সালাম বা উত্তর দেওয়া যাবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন,لاَ تُسَلِّمُوْا تَسْلِيْمَ الْيَهُوْدِ وَالنَّصَارَى فَإِنَّ تَسْلِيْمَهُمْ إِشَارَةٌ بِالكُفُوْفِ- ‘তোমরা ইহুদী-নাছারাদের সালামের ন্যায় সালাম দিও না। কেননা তাদের সালাম হচ্ছে হাত দ্বারা ইশারার মাধ্যমে’।[22]

১৪. মুসলিম পুরুষের সাথে মুছাফাহা করা :

মুসলমান পুরুষের সাথে সালাম বিনিময়ের পাশাপাশি মুছাফাহা করা মুস্তাহাব। রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَا مِنْ مُسْلِمَيْنِ يَلْتَقِيَانِ فَيَتَصَافَحَانِ إِلاَّ غُفِرَ لَهُمَا قَبْلَ أَنْ يَفْتَرِقَا ‘দু’জন মুসলিম একে অপরের সাথে মিলিত হয়ে মুছাফাহা করলে পরস্পর বিচ্ছিন্ন হওয়ার পূর্বেই তাদের ক্ষমা করে দেয়া হয়’।[23] মুছাফাহার ক্ষেত্রে নিজের হাত আগেই টেনে নেওয়া সমীচিন নয়। হাদীছে এসেছে, كان إذا صافح رجلا لم يترك يده حتى يكون هو التارك ليد رسول الله صلى الله عليه وسلم ‘রাসূল (ছাঃ) যখন কারো সাথে মুছাফাহা করতেন, তখন ঐ ব্যক্তির হাত ছাড়তেন না, যতক্ষণ না সে রাসূল (ছাঃ)-এর হাত ছেড়ে দিত’।[24] উল্লেখ্য, মুছাফাহা এক হাতে অর্থাৎ দু’জনের দু’হাতে হবে।[25] দু’জনের চার হাতে নয়।

১৫. সালামের সময় মাথা না ঝুঁকানো :

সালাম প্রদানের সময় কারো সামনে মাথা অবনত করা বা ঝুঁকানো যাবে না। আনাস বিন মালিক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, قَالَرَجُلٌ يَا رَسُولَ اللهِ الرَّجُلُ مِنَّا يَلْقَى أَخَاهُ أَوْ صَدِيْقَهُ أَيَنْحَنِى لَهُ قَالَ لاَ. قَالَ أَفَيَلْتَزِمُهُ وَيُقَبِّلُهُ قَالَ لاَ. قَالَ أَفَيَأْخُذُ بِيَدِهِ وَيُصَافِحُهُ قَالَ نَعَمْ. ‘কোন একসময় জনৈক ব্যক্তি প্রশ্ন করল, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের কোন ব্যক্তি তার ভাই কিংবা বন্ধুর সাথে দেখা করলে সে কি তার সামনে ঝুঁকে (নত) যাবে? তিনি বললেন, না। সে আবার প্রশ্ন করল, তাহ’লে কি সে জড়িয়ে ধরে তাকে চুমু খাবে? তিনি বললেন, না। সে এবার বলল, তাহ’লে সে তার হাত ধরে মুছাফাহা (করমর্দন) করবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ’।[26]

১৬. গায়র মাহরাম মহিলাদের সাথে মুছাফাহা না করা :

গায়র মাহরাম অর্থাৎ যাদের সাথে বিবাহ বৈধ এরূপ মহিলাদের সাথে মুছাফাহা করা হারাম। উমায়মা বিনতে রুকায়কা (রাঃ) বলেন, বায়‘আত হওয়ার উদ্দেশ্যে আমি কতক মহিলা সমভিব্যাহারে মহানবী (ছাঃ)-এর নিকট উপস্থিত হ’লাম। তিনি আমাদের বলেন, যতদূর তোমাদের সামর্থ্যে ও শক্তিতে কুলায়। আমি মহিলাদের সাথে মুছাফাহা (করমর্দন) করি না’।[27] অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বলেন,لأن يطعن في رأس أحدكم بمخيط من حديد خير له من أن يمس امرأة لا تحل له ‘নিশ্চয়ই তোমাদের কারো মাথায় লোহার হাতুড়ি দ্বারা আঘাত করা উত্তম, তার সাথে বৈধ নয় মহিলাকে স্পর্শ করা অপেক্ষা’।[28] অন্য বর্ণনায় এসেছে, আলক্বামাহ বিনতু ওবায়দ হ’তে বর্ণিত নবী করীম (ছাঃ) বলেন,لا أَمَسُّ أيدي النساء ‘আমি নারীদের হাত স্পর্শ করি না’।[29]

১৭. মুসলিম-অমুসলিম সম্মিলিত সমাবেশে সালাম দেওয়া :

কোন সভা-সমাবেশে মুসলিম ও অমুসলিম সম্মিলিতভাবে থাকলে সালাম দেওয়া যাবে। কিন্তু মুসলমানদের উদ্দেশ্য করতে হবে। উসামাহ বিন যায়দ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,مَرَّ فِىْ مَجْلِسٍ فِيْهِ أَخْلاَطٌ مِنَ الْمُسْلِمِيْنَ وَالْمُشْرِكِيْنَ عَبَدَةِ الأَوْثَانِ وَالْيَهُوْدِ، وَفِيهِمْ عَبْدُ اللهِ بْنُ أُبَىٍّ ابْنُ سَلُوْلَ، وَفِى الْمَجْلِسِ عَبْدُ اللهِ بْنُ رَوَاحَةَ، فَلَمَّا غَشِيَتِ الْمَجْلِسَ عَجَاجَةُ الدَّابَّةِ خَمَّرَ عَبْدُ اللهِ بْنُ أُبَىٍّ أَنْفَهُ بِرِدَائِهِ ثُمَّ قَالَ لاَ تُغَبِّرُوْا عَلَيْنَا. فَسَلَّمَ عَلَيْهِمُ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم- ‘নবী করীম (ছাঃ) এমন এক মজলিসের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, যেখানে মুসলিম, মুশরিক মূর্তিপূজক ও ইহূদী ছিল। তাদের মধ্যে আব্দুল্লাহ বিন উবাই বিন সালূলও ছিল। আর এ মজলিসে আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা (রাঃ)ও হাযির ছিলেন। যখন সাওয়ারীর পদাঘাতে বিক্ষিপ্ত ধূলাবালি মজলিসকে ঢেকে ফেলছিল, তখন আব্দুল্লাহ বিন উবাই তার চাদর দিয়ে তার নাক ঢাকল। তারপর বলল, তোমরা আমাদের উপর ধূলাবালি উড়িয়ো না। তখন নবী করীম (ছাঃ) তাদের সালাম করলেন’ (বুখারী হা/৬২৫৪; মুসলিম হা/১৭৯৮)

অতএব সালামের ক্ষেত্রে উপরোক্ত আদব বা শিষ্টাচার সমূহ মেনে চলা যরূরী। এর ফলে সমাজে যেমন সুশৃঙ্খল পরিবেশ বিরাজ করবে, তেমনি অশেষ ছওয়াব হাছিল হবে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে জীবনের সকল ক্ষেত্রে ইসলামী আদব বা শিষ্টাচার মেনে চলার তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!

 

ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম


[1]. আবূদাঊদ হা/৫২০৯; তিরমিযী হা/২৭২১; ছহীহাহ হা/১১০৯।

[2]. তিরমিযী হা/২৭২২, সনদ ছহীহ।

[3]. তিরমিযী হা/২৭২১; ছহীহাহ হা/১৪০৩।

[4]. আবূদাঊদ হা/৫১৯৭; ছহীহাহ হা/৩৩৮২; ছহীহুল জামে হা/৬১২১।

[5]. তিরমিযী হা/২৬৯৪; মিশকাত হা/৪৬৪৬।

[6]. ছহীহাহ হা/৮১৭; ছহীহুল জামে হা/৭১৯০।

[7]. বুখারী হা/৯৫; ছহীহাহ হা/৩৪৭৩।

[8]. বুখারী হা/৬২৩২-৩৩; মিশকাত হা/৪৬৩২।

[9]. বুখারী হা/৬২৩১।

[10]. মুসলিম হা/২০৫৫; আহমাদ হা/২৩৮৬৩।

[11]. তিরমিযী হা/২৭০৬; মিশকাত হা/৪৬৬০; ছহীহাহ হা/১৮৩।

[12]. আবূদাউদ হা/৫২১০; মিশকাত হা/৪৬৪৮; ইরওয়া হা/৭৭৮।

[13]. ছহীহ ইবুন হিববান হা/৪৯৯; আবূদাউদ হা/২৪৯৪; ছহীহ আত-তারগীব হা/৩২১, সনদ ছহীহ।

[14]. মুওয়াত্ত্বা হা/৩৫৩৫; আল-আদাবুল মুফরাদ হা/১০৫৫, সনদ হাসান।

[15]. আবূদাঊদ হা/১৭; নাসাঈ হা/৩৮; ইবনু মাজাহ হা/৩৫০; মিশকাত হা/৪৬৭।

[16]. মুসলিম হা/৩৭০।

[17]. বুখারী হা/৬২৪৭; মুসলিম হা/২১৬৮।

[18]. তিরমিযী হা/১৬০২, ২৭০০; ছহীহাহ হা/৭০৪; ইরওয়া হা/১২৭১।

[19]. বুখারী হা/৬২৫৮, ২৯৬২; মুসলিম হা/২১৬৩; মিশকাত হা/৪৬৩৭।

[20]. বুখারী হা/১২, ২৮, ৬২৩৬; মুসলিম হা/৩৯; মিশকাত হা/৪৬২৯।

[21]. আবূদাঊদ হা/৫২৩১; মিশকাত হা/৪৬৫৫।

[22]. ছহীহুল জামে‘ হা/৭৩২৭; ছহীহাহ হা/১৭৮৩।

[23]. আবূদাঊদ হা/৫২১২; তিরমিযী হা/২৭২৭; ইবনু মাজাহ হা/৩৭০৩; ছহীহাহ হা/৫২৫-২৬।

[24]. ছহীহাহ হা/২৪৮৫।

[25]. মুসলিম হা/২৭৬৯।

[26]. তিরমিযী হা/২৭২৮; ইবনু মাজাহ হা/৩৭০২; ছহীহাহ হা/১৬০; মিশকাত হা/৪৬৮০।

[27]. তিরমিযী হা/১৫৯৭; ইবনু মাজাহ হা/২৮৭৪; নাসাঈ হা/৪১৮১; ছহীহাহ হা/৫২৯।

[28]. ছহীহুল জামে হা/৫০৪৫; ছহীহ আত-তারগীব হা/১৯১০।

[28]. ছহীহুল জামে হা/৭১৭৭।

[29]. বুখারী হা/৬২৫৪; মুসলিম হা/১৭৯৮।

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button