আদব ও আমল

একটি নিয়ম

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম

এখানে আসার পরপরই আমাকে ‘ইনমেইট হ্যান্ডবুক( Inmate Handbook)’ নামে একটা বই ধরিয়ে দেওয়া হয়। এটা মূলত এই জেলের নিয়মকানুন নিয়ে পঞ্চাশ পৃষ্ঠার একটা বই। বইটির মধ্যে একটি নিয়ম ছিল এমন:

❛পরিষ্কার ও টানটান করে বিছানা গোছাতে হবে। বিছানার চাদর কুঁচকে থাকা চলবে না। মাথার দিক থেকে মোটামোটি ১৬ ইঞ্চি পর্যন্ত চাদর বিছিয়ে বাকিটুকু গুটিয়ে রাখতে হবে। সব বিছানা সকাল ৭.৩০ মিনিটের মধ্যে গুছিয়ে পর্যবেক্ষণের জন্য প্রস্তুত রাখতে হবে। ❜

এটা পড়ামাত্রই সালাফদের দৃষ্টিভঙ্গির একটি বিশেষ দিকের কথা আমার মনে পড়ে গেল। আলস্যকে সংজ্ঞায়িত করা হয় এভাবে: ‘কাজ, সক্রিয়তা বা প্রচেষ্টার প্রতি অনীহা’। আর এই আলস্যকে সালাফগণ তীব্রভাবে ঘৃণা করতেন।

❖ উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) বলেন, ❝দরকারি কিছু না করে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়ানোকে আমি ঘৃণা করি।❞

❖ ইবন মাস’উদ (রা) বলেন, ❝এই দুনিয়া বা পরবর্তী জীবনের জন্য কাজ না করে অলস বসে থাকে এমন ব্যক্তিকে আমি ঘৃণা করি।❞

স্বয়ং আল্লাহ্‌র রাসূল (সা) প্রতিদিন আল্লাহ্‌র কাছে এই দুআর মাধ্যমে দিন শুরু করতেন, ❛… আমি আলস্য থেকে তোমার কাছে আশ্রয় চাই…❜।[1] আসলে অলসতা সুন্নাহর এতটাই বিপরীতধর্মী একটা বিষয় যে, রাসূলুল্লাহ (সা) জীবনে একবারও হাই তোলেননি। ইবন হাজার উল্লেখ করেন: ❝নবীজির (সা) অনন্য বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে একটি ছিল এই যে, তিনি (সা) কক্ষণো হাই তোলেননি। ইয়াজিদ বিন আল-আসামের মুরসাল থেকে ইবনু আবি শায়বাহ এবং আল-বুখারি তাঁর তারিখ গ্রন্থে এটি লিপিবদ্ধ করেছেন।❞

তাই, জেলখানার নিয়ম হলেও এটা আসলে একটা ভালো নিয়ম। নানান রকম মানুষের সাথে বছরের পর বছর কাছাকাছি থাকার ফলে আমি নিশ্চিতভাবে জানি যে যে, যত সকালসকাল ঘুম থেকে উঠে দিন শুরু করা যায় দিনভর আলস্য ততোই কম হয়। ‘উমার (রা) একবার শামে পৌঁছে দেখেন যে, মুয়াবিয়া (রা) কিছুটা শ্লথ এবং মন্থর হয়ে পড়েছেন। তাই মুয়াবিয়াকে দেখে ‘উমারের প্রথম প্রশ্নটিই ছিল: ❝কী ব্যাপার মুয়াবিয়া? তুমি কি দুহার (সকালের শেষভাগ) সময় ঘুমোও?❞ সালাফদের দৃষ্টিভঙ্গী পর্যালোচনা করলে এটাই স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, তারা সকলেই বেশি ঘুমানোর অভ্যাসকে ঘৃণার চোখে দেখতেন – বিশেষ করে দিনের প্রথম ভাগে।

❖ সাখর আল-ঘামিদির সূত্রে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, ❝হে আল্লাহ্‌! আমার উম্মাহর ভোরের পাখিদের উপর তুমি রহম করো।❞[2] কোনো অভিযান বা সেনাবাহিনী পাঠানোর সময় তিনি (সা) সবসময় দিনের শুরুতেই তাদের প্রেরণ করতেন। সাখর নিজে একজন ব্যবসায়ী ছিলেন এবং তিনি ভোরবেলাতেই তাঁর ব্যবসায়িক কাজকর্ম শুরু করতেন। ফলে, একসময় তিনি অস্বাভাবিক রকমের ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হন।

❖ আলি ইবনে আবু তালিব বলেন, ❝সকালবেলা ঘুমানো অজ্ঞতার লক্ষণ।❞

❖ একবার একদল লোক ফজরের সালাতের পর ইবন মাস’উদের (রা) সাথে দেখা করতে আসে। ঘরে প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার পরও তারা ইবন মাস’উদের (রা) ঘরে প্রবেশ করতে ইতস্তত করতে থাকে। ইবন মাস’উদ (রা) তাদের এই অস্বস্তির কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা উত্তরে বলে যে, তারা এই ভেবে অস্বস্তিবোধ করছে যে হয়তো ওনার স্ত্রী এই সময় ঘরে ঘুমিয়ে আছেন। ইবন মাস’উদ প্রত্যুত্তরে বলেন, ‘ আপনারা কী মনে করেন আমার স্ত্রী এতটাই অলস?’ (ইবন মুফলিহ আল-হাম্বালি এই ঘটনার উপর মন্তব্য করে বলেন: ‘ এই ঘটনা থেকে শিক্ষণীয় বিষয় এই যে, সকালবেলার এই সময়টুকু অবহেলা করা উচিত না এবং এই সময়ে ঘুমোনোকে নিরুৎসাহিত করা হয়।’) বুখারি এবং মুসলিম উভয়েই এই ঘটনাটি তাঁদের গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন।

❖ ইব্‌ন আব্বাস (রা) একদিন তাঁর এক ছেলেকে সকালে ঘুমুতে দেখে বলেন: ❝উঠো! তুমি কি এমন সময় ঘুমাচ্ছ যখন রিযক বণ্টন হচ্ছে?❞

❖ একজন তাবি’ই বলেন, ❝কোনো আলিমকে ফজরের পর ঘুমোতে দেখলে পৃথিবী দুঃখে কেঁদে ওঠে।

❖ পূর্ববর্তী নবীগণও এমন মনোভাব পোষণ করতেন। নবী দাউদ (আ) সুলাইমানকে (আ) বলেছিলেন: ❝অতিরিক্ত ঘুমানোর ব্যাপারে সতর্ক হও। অন্যরা যখন কাজ করে তখন এই অভ্যাস তোমাকে দরিদ্র করে দিবে।❞

❖‘ঈসা ইবন মারইয়াম (আ) বলেছেন, ❝দুটি স্বভাবকে আমি ঘৃণা করি:

১) রাতে জেগে না থাকা সত্ত্বেও দিনের বেলায় ঘুমানো,

২) কোনো কারণে আনন্দিত হওয়া ছাড়াই উচ্চস্বরে হাসা।❞

❖ একজন কবি বলেন: ❝নিশ্চয়ই সকালবেলার ঘুম মানুষকে সন্দেহ-সংশয়ে ফেলে দেয়। আর বিকেলবেলায় ঘুমুনো তো পাগলামির নামান্তর।❞

ইবন মুফলিহ উপরোক্ত বাণীগুলোর উপর মন্তব্য করে বলেন, ❛সুতরাং দিনের বেলা ঘুমানো স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। কারণ এটা প্রাণোচ্ছলতা শুষে নেয় এবং শরীরের পেশিগুলোকে ধ্বংস করে দেয়। তাই শারীরিক সক্রিয়তার মাধ্যমে পেশিগুলোকে সচল রাখা উচিত।❜

কয়েক মাস আগে আমাকে CMU,Terre Haute থেকে এই জেলে( Marion CMU ) নিয়ে আসা হয়। এই ধরনের জেল বদল সাধারণত কোনোরকম পূর্বাভাস ছাড়াই করা হয়। এক ভোরে হঠাৎ ৫টার সময় একজন প্রহরী আমার সেলের তালা খুলে আমাকে অন্য এক জেলে স্থানান্তর করার খবর দিল। আরো বলল যে, আমার জিনিসপত্র গুছিয়ে নেওয়ার জন্য আমার হাতে এক ঘন্টারও কম সময় আছে। আমি বুঝতে পারলাম, এই জেলের ভাইদের সাথে হয়তো আর কখনো দেখা হবে না। তাই সিএমইউর নিকষ কালো অন্ধকার করিডোর ধরে হেঁটে হেঁটে আমি অন্যান্য সেলে থাকা ভাইদের সালাম দিয়ে বিদায় জানিয়ে আসতে গেলাম। এই সময়ে বেশিরভাগ কয়েদিরাই ঘুমিয়ে থাকে।

কিন্তু বেশ কয়েকটা সেলে আমি আলো জ্বলতে দেখতে পাই। পা টিপে টিপে আলোকিত সেলগুলোর কাছে গিয়ে আমি কুরআন তিলাওয়াতের মৃদু গুনগুন শুনতে পাই। সেলের দরজা গলে চোখের কোণ দিয়ে দেখতে পেলাম প্রতিটি সেলেই আমার ভাইয়েরা কিয়ামুল-লাইলে মগ্ন হয়ে আছে।

❖ আল্লাহ্‌র রাসূল (সা) বলেন, ❝জেনে রাখো, একজন মু’মিনের সম্মান হচ্ছে তাঁর কিয়ামুল লাইল।❞[3]

❖ তিনি (সা) আরো বলেন, ❝রাতের শেষ ভাগে বান্দা তার রবের সবচেয়ে নিকটবর্তী হয়, যদি তুমি সে সময়ে আল্লাহর যিকিরকারীদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারো, তাহলে তাদের অন্তর্ভুক্ত হও।

❖ তিনি (সা) বলেন, ❝আমাদের রব প্রতি রাতে দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন, যখন রাতের শেষ তৃতীয়াংশ বাকি থাকে। অতঃপর তিনি বলেন: কে আমাকে আহ্বান করবে, আমি যার ডাকে সাড়া দেব? কে আমার নিকট প্রার্থনা করবে, আমি যাকে প্রদান করব? কে আমার নিকট ইস্তেগফার করবে, আমি যাকে ক্ষমা করব? ফজর উদিত হওয়া পর্যন্ত অনুরূপ বলতে থাকেন।[4]

❖ রাসূলুল্লাহ (সা) আরো বলেন, ❝তোমরা রাতের সালাত আঁকড়ে ধর, কারণ এটা তোমাদের পূর্বের নেককার লোকদের অভ্যাস এবং তোমাদের রবের নৈকট্য দানকারী, গুনাহের কাফ্ফারা ও পাপ মোচনকারী। এটা শরীর থেকে রোগ-বালাই দূর করে দেয়।❞ (ইবন রজব এই হাদিসের ব্যাপারে মন্তব্য করেন, ‘এই হাদিসের একটি অন্যতম শিক্ষা হলো, কিয়ামুল লাইল এর ফলে সুস্বাস্থ্য লাভ করা যায়। এটি শরীরকে নীরোগ করে।’)

❖ তিনি (সা) বলেন, ❝এমনভাবে ইবাদাত করো যেন তুমি আল্লাহকে দেখছো। সেটা না পারলে জেনে রাখো যে তিনি তোমাকে দেখছেন। আর এটাই হচ্ছে ইহসান।[5]

কিয়ামুল-লাইল এর মাধ্যমে মানুষের কাছে সুনাম কুড়ানোর কোনো উপায় নেই। রাতের গভীরে জেলখানার সেলে বন্দী অবস্থায় কাউকে দেখিয়ে দেখিয়ে ইবাদাত করার কোনো উপায় নেই। তাই এই ইবাদাতে কোনোরকম কোনো পার্থিব ফললাভের আশা নেই। আর কিয়ামুল-লাইল তো বাধ্যতামূলকও নয়। বরং হাসান আল-বসরী বলেছেন, এটি হচ্ছে ‘সবচেয়ে কঠিন এবং প্রগাঢ়’ ইবাদাত। তাহলে বলুন, কী মানুষকে স্বেচ্ছায় এবং খুশীমনে শীতকালের প্রবল শীতের রাতে বিছানা ছেড়ে নেমে এসে বরফশীতল পানি দিয়ে ওযু করে এমন এক সত্তার ইবাদাত করতে প্রেরণা যোগায় যাকে সে দেখতেও পায় না?

❖ আবু সুলাইমান আদ-দারানি বলেন, ❝যারা বিনোদনে প্রমত্ত হয়ে রাত কাটায় তাদের চেয়ে যারা কিয়াম করে তারাই নিজেদের রাতগুলোকে বেশি উপভোগ করে। যদি রাত না থাকতো তাহলে আমি এই পৃথিবীতে থাকতে চাইতাম না।

❖ আল-ফুদাইল বিন ‘ইয়াদ বলেন, ❝রাতে কিয়াম আর দিনে সিয়াম পালন করতে না পারলে বুঝে নিও যে তোমার পাপকাজ তোমাকে বেঁধে রেখে বঞ্চিত করছে।❞

❖ সালাফদের একজন বলেছেন, ❝চল্লিশ বছর ধরে সূর্যোদয় ছাড়া অন্য কিছু আমাকে বিষণ্ণ করতে পারেনি। (কারণ সূর্যোদয়ের মাধ্যমেই কিয়াম এর সময় শেষ হয়ে যায়)

তারা সকলেই কিয়ামুল-লাইলকে অত্যন্ত কঠিন কাজ বলে স্বীকার করেছেন কিন্তু তাদের ঈমান এই কঠিন কাজকেই তাদের বিশেষত্ব-তে পরিণত করেছে। কপটতা, স্বার্থপরতা আর বস্তুবাদিতায় ডুবে থাকা পশ্চিমা সমাজের কাছে এমন চিন্তাধারা সম্পূর্ণ অপরিচিত। যা-ই হোক, প্রবন্ধের মূল বিষয়বস্তুতে ফিরে আসি। এই হাদিসটি নিয়ে ভাবুন:

ঘুমানোর সময় তোমাদের প্রত্যেকের মাথার শেষাংশে শয়তান তিনটি গিঁট দেয়। প্রত্যেক গিঁটের স্থানে সে মোহর এঁটে দিয়ে বলে: তোমার রাত এখনো অনেক বাকি, অতএব ঘুমাও। যদি সে জেগে উঠে আল্লাহর যিকর করে তখন একটি গিঁট খুলে যায়। যদি সে ওযু করে তো আরেকটি গিঁট খুলে যায়। যদি সে সালাত আদায় করে, তো তার সবকটি গিঁটই খুলে যায়, ফলে সে ভোরবেলায় প্রাণবন্ত ও প্রফুল্ল থাকে। অন্যথায় সে অবসাদ ও আলস্য অনুভব করে।❞

এই হাদিসটির ব্যাপারে ইবন হাজার বলেন, ❛এই হাদিস থেকে প্রতীয়মান হয় যে, মেজাজ ভালো রাখার গোপন চাবিকাঠি কিয়ামুল-লাইল এর মাঝে লুকিয়ে আছে।❜ বিভিন্ন হাদিসগ্রন্থে লিপিবদ্ধ বিভিন্ন ঘটনা থেকে এই বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ ব্যাপারে সব বর্ণনা বলে শেষ করা যাবে না, তবে নিচের ঘটনাগুলো নিয়ে একটু ভাবুন:

❖ ‘আইশাহ (রা) বর্ণনা করেন যে, ❝আল্লাহ্‌র রাসূল (সা) কক্ষণো কিয়ামুল-লাইল ত্যাগ করতেন না। অসুস্থ বা ক্লান্ত হলেও তিনি বসে বসে তা আদায় করতেন। অথচ কিয়ামুল-লাইল এর কারণে তিনি কখনো ক্লান্ত হননি বরং এর প্রভাব এমন ছিল যে তিনি (সা) কখনো হাই পর্যন্ত তোলেননি। রাতভর কিয়ামুল-লাইলের পরেও দিনের প্রথম প্রহরেই যুদ্ধের জন্য বেরিয়ে পড়তে তাঁর উদ্যমের অভাব হতো না।❞

❖ ইবরাহিম বিন শাম্মাস বলেন, ❝আমি আহমাদ ইবন হাম্বালকে ছোটবেলা থেকেই চিনি। সে কৈশোর থেকেই সারারাত কিয়ামুল-লাইল করতো। জীবনের এই সময়ের কথা বলতে গিয়েই ইমাম আহমদ বর্ণনা করেন যে, তিনি কত আগে আগে তাঁর দিন শুরু করতেন। তিনি বলেন, ‘ আমি হাদিস শুনার জন্য তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়তে চাইতাম। তখন আমার মা আমার জামা টেনে ধরে বলতেন, ‘ অন্তত ফজরের আযান হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করো। আগে মানুষজন ঘুম থেকে উঠুক!❞

[দ্রষ্টব্য: যুহর এবং আসরের মধ্যবর্তী সময়ে একটু ঘুমিয়ে নেওয়াটা (কাইলুলা) সুন্নাহর অংশ। একারণেই ইমাম আহমাদ কিয়াম এর জন্য উঠতে পারতেন। তাঁর ছেলে আবদুল্লাহ বর্ণনা করেন, ❝শীতগ্রীষ্ম সবসময়েই আমার বাবা দুপুরবেলায় একটু ঘুমিয়ে নিতেন। তিনি কখনো এটা ছাড়তেন না এবং আমাকেও এই অভ্যাস রপ্ত করতে উৎসাহিত করতেন। তিনি উমার ইবনুল খাত্তাবের (রা) উদ্ধৃতি দিয়ে বলতেন, ❝কাইলুলা অর্থাৎ দুপুরবেলা একটু ঘুমিয়ে নাও কারণ, শয়তানরা তা করে না।❞ আনাস, ইবন আব্বাস প্রমুখ সাহাবিরাও (রাদিয়াল্লাহু আনহুম ) এ ব্যাপারে উৎসাহ দিয়েছেন। কিয়াম এর জন্য সহায়ক আরেকটি অভ্যাস রয়েছে। তা হলো ‘ইশার সালাতের আগে না ঘুমানো এবং ‘ইশার পর কথা না বলা এবং জেগে না থাকা। কারণ হাদিসে এসেছে যে, ❝নবীজি (সা) ‘ইশার আগে ঘুমানো অপছন্দ করতেন এবং ‘ইশার পর জেগে থেকে কথা বলাও অপছন্দ করতেন।❞

এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, কিয়ামুল-লাইল এর মানে এই নয় যে সারারাত কিংবা রাতের একটা নির্দিষ্ট সময় জেগে থাকতে হবে। বরং, সুবহে সাদিকের আধাঘন্টা আগে জেগে উঠে দুই রাকাত সালাত আদায় করলে সেটাও কিয়ামুল-লাইল বলে গণ্য হবে। ]

আমি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাইদের সাথে থেকেছি। তাদের মাঝে যারা কিয়ামুল-লাইল এর ব্যাপারে নিয়মিত ছিল তাদেরকেই আমি সবচেয়ে মনোযোগী এবং সময়ের সদ্ব্যবহারকারী হিসাবে পেয়েছি। তারা কদাচিৎ হাই তুলতো, সতর্কতার সাথে তাঁদের শব্দ চয়ন করতো এবং জেলের জীবনযাত্রার মানদণ্ডেও তাঁদের পার্থিব সম্পদ ছিল সবচেয়ে কম। তাঁদের চিন্তা-চেতনা সর্বদা সুন্দরতম বিষয়গুলো ঘিরে আবর্তিত হতো।

এই সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলোই অতীতের মুজাহিদদেরকে ইতিহাসের গতিপথ পাল্টে দিতে সাহায্য করেছিল। “বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ” গ্রন্থে ইবনে কাসীর ইয়ারমুকের যুদ্ধের বিবরণে ইতি টানার সময় একটি বিশেষ মুহূর্তের কথা উল্লেখ করেছেন। তখন লাঞ্ছিত অপদস্থ রোমান সৈন্যদের অবশিষ্টাংশ যুদ্ধের বিবৃতি দিতে অ্যান্টিয়কে তাদের সম্রাট হিরাক্লিয়াসের কাছে ফিরে গিয়েছিল। তারা যুদ্ধক্ষেত্রে খালিদ বিন ওয়ালিদের সেনাবাহিনীর হাতে চূড়ান্তভাবে অপদস্থ হওয়ার কথা হিরাক্লিয়াসকে জানায়। তা শুনে হিরাক্লিয়াস বলে উঠলো: “লানত তোমাদের ওপর! যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করেছে, তাদের সম্পর্কে আমাকে বলো। তারা কি তোমাদের মতোই মানুষ নয়?”

তারা জবাব দিলো: “হ্যাঁ।”

হিরাক্লিয়াস জিজ্ঞেস করলো: “তোমাদের সংখ্যা বেশি, নাকি তাদের?”

তারা উত্তরে বললো: “বরং আমরা তো প্রতিটি যুদ্ধেই সংখ্যার দিক থেকে তাদেরকে বহুগুণে ছাড়িয়ে গেছি।”

হিরাক্লিয়াস প্রশ্ন ছুঁড়লো: “তাহলে, কেন তারা তোমাদের পরাজিত করলো?”

তখন, তাদের এক উচ্চপদস্থ ব্যক্তি এগিয়ে এসে বললো: ❝কারণ তারা রাতে জেগে উঠে নামাজ পড়ে, দিনের বেলায় রোজা রাখে, ওয়াদা পূরণ করে, সৎ কাজে উৎসাহ দেয়, মন্দ কাজে বাধা দেয়, এবং তারা একে-অপরের সাথে উত্তম ব্যবহার করে। অন্যদিকে আমরা মদ খাই, ব্যভিচার করি, নিষিদ্ধ কাজে মত্ত হই, চুক্তি ভঙ্গ করি, অন্যায় ও অত্যাচার করি, আমাদের রবকে রাগান্বিত করে এমন কাজে উৎসাহ দিই, আর যা তাকে সন্তুষ্ট করে তাতে বাধা প্রদান করি এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় ছড়িয়ে বেড়াই।❞

হিরাক্লিয়াস বললো: “তুমি সত্য বলেছো।”

____

[1] বুখারিন, আস-সাহিহ, দুআ অধ্যায়, হাদিস নং- ৬০০৬

[2] আবু দাউদ, আস-সুনান, জিহাদ অধ্যায়, হাদিস নং- ২৬০৮

[3] হাকিম, আল-মুস্তাদরাক আলাস্কার সাহিহাইন, হাদিস নং- ৭৯২১; তাবারানি, মু’জামুল আওটাত, হাদিস নং- ৪২৭৮

[4] মুসলিম, আস-সাহিহ, হাদিস নং- ১৮০৯; বুখারিন, আস-সাহিহ, হাদিস নং- ১০৯৪

[5] বুখারি, আস-সাহিহ, ইমান অধ্যায়, হাদিস নং- ৫০; মুসলিম, আস-সাহিহ, হাদিস নং- ১০২


বইঃ কখনও ঝরে যেও না

— তারিক মেহান্না

 

মন্তব্য করুন

Back to top button