কল্পকাহিনী

শেষ বাঁশি


ভাসমান স্কাইস্ক্র্যাপারের ৩৪৭ নম্বর ফ্লোরে থাকে টুশি। ৩৪৭ ফ্লোর ও ইচ্ছা করেই নিয়েছে। ৩৪৭ ওর অন্যতম প্রিয় প্রাইম নম্বার। স্বচ্ছ জানালা দিয়ে পর্বতটা ঠিক দেখা যাচ্ছে।

পর্বত ঘেরা এই শহরে ভূতত্ববিদদের মতে সবচেয়ে নিরাপদ এই পর্বতটাই। একটু পরপর যেখানে ভুমিধ্বস আর পর্বতের ধাক্কায় স্কাইস্ক্র্যাপারগুলো ভেংগে পড়ছে সেখানে টুশির কাটছে নির্ভাবনার দিন। এখানে থাকার জন্যে ক্রেডিট কার্ডের অর্ধেক লিমিট শেষ, তবু তো নিরাপদ হঠাৎ মৃত্যু থেকে। ওর স্কাইস্ক্রাপারের কৃত্রিম চৌম্বকক্ষেত্র পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের সাথে হালকা একটা বিকর্ষণ তৈরী করায় শূন্যে ঝুলে আছে। অতীতে পৃথিবীতে অনেক বড় বড় ভূমিধ্বস হয়েছিল। তারপর থেকে ডেভেলপারসরা তাদের প্ল্যানিং নিয়ে আরো সচেতন হয়ে গেছে। প্রকৌশলীরা তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে পৃথিবীর মানুষকে আরো নিরাপদ রাখতে।

সবচেয়ে কাছের রেস্তোরার সাথে সংযুক্ত ক্যাবল কারে টুশির সকালের কফি এসে পৌছেছে। কফি নিয়ে উত্তরের জানালার ধারে বসল ও।

অটোমেটেড হেলিকপ্টার করে এক জুটি যাচ্ছে। স্বচ্ছ হেলিকপ্টারে দেখা যাচ্ছে, তারা একান্তে সময় কাঁটাচ্ছে। ছেলেটাকে চিনতে পেরেছে টুশি। এর সাথে কিশোরী থাকা অবস্থায় কিছুদিন ছিল ও। আসলে এই শহরের সব ছেলেকেই টুশি চিনে। হাতে গোনা কয়টা ছেলে আছে। যদিও অনেকে লিঙ্গ পরিবর্তন করে ছেলে হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু খুব একটা লাভ হচ্ছে না। আসলে প্রকৃতি যেভাবে তৈরী করেছে তার বাইরে গিয়ে খুব বেশি লাভ নেই। সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী নয় টুশি। ও জানে ও প্রকৃতির বিক্ষিপ্ত ঘটনার ফল মাত্র। শুধু ও কেন কেউই আর পৃথিবীতে বোধহয় নেই যে সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী।

যেদিন ওর মা টা মরল সেদিন ও হাফ ছেড়ে বেঁচেছিল। ওর মাও যে খুব সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করতো তা নয়। কিন্তু হুটহাট করে একটা মন্ত্রের মত পড়ত। কি বলতো অতটা মনেও নেই। কখনো মনে রাখার চেষ্টা করেনি মায়ের ওই আবোল তাবোল বকা। ধমকে উঠত টুশি। ওর মা ওকে খুবই ভয় পেতো। মিনমিন করে বলতো, “আপনার নানাকে পড়তে শুনতাম। এর অর্থ আমি জানি না। কিন্তু আমিও পড়ি।“ অতীতের কিছু মানুষ কতটা অযৌক্তিক ছিল তাই ভাবে টুশি!

হেলিকপ্টার থেকে চোখ ফিরিয়ে নিল টুশি। নাহ! ওই ছেলেটাকে দেখে একটুও মন কেমন করেনি। আসলে এসব চিন্তার প্রশ্নই আসে না। এতগুলো মেয়ের জন্য কয়টা মাত্র ছেলে। এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। সিরিঞ্জ পুশ করে গায়ে কফি ইঞ্জেক্ট করল। আহ! কি স্বাদ ছড়িয়ে গেল সারা মুখে। মাথার ভার ভার ভাবটা কেঁটে গেল। ছেলেদের সাথে সময় কাটাতে এখন আর আগ্রহ পায় না সে। এরচেয়ে পৃথিবীর অতীত ইতিহাস ওকে টানে। সেইদিনই ব্রেইনে হিস্ট্রি নলেজ চিপ বসালো সে। ওর সবচেয়ে প্রিয় ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের বড় ভাস্কর্য ওর লিভিং রুমে। কোঁকড়া চুলের সুদর্শণ যুবক। একটা চোখ কানা, চোখ ফোলা আঙ্গুরের মত। ক্ষমতাবান কাকে বলে তার যথার্থ উদাহরণ। মাটির নিচের খনিজ সম্পদ সব ছিল তার হাতের মুঠোয়। যখন তখন বৃষ্টি, খরা তৈরী করতেন ইচ্ছা হলেই। এখনকার আবহাওয়াবিদরা অবশ্য কৃত্রিম বৃষ্টি নামাচ্ছে প্রয়োজনে, কিন্তু গুণগত মানে পার্থক্য অনেক।

টুশির ছেলে হয়ে যেতে ইচ্ছা করে। প্লাস্টিক সার্জারি করে চোখগুলোকে ঠিক তার প্রিয় মানুষটার মত করবে। চুল হবে কোঁকড়ানো।তার মত ক্ষমতা না থাকলেও কল্পনায় নিজেকে অনেক ক্ষমতাবান মনে হচ্ছে। রোমাঞ্চিত হয় টুশি। এমন ক্ষমতাধরকে অযথা জীবন দিতে হয়েছিল। ভাবতেই খারাপ লাগে। বিজ্ঞান অনেক উন্নত হলেও মৃত্যুকে ঠেকাতে পারছে না এখনো। জীবন একটাই, যতটা পারে উপভোগ করে যেতে চায় টুশি।

হলোগ্রাফিক স্ক্রীন চালু করে ইতিহাসের জগতে ডুব দিল টুশি। নতুন নলেজ চিপটায় অনেক কিছু জানার আছে। হঠাৎ স্ক্রিনে লোমশ বীভৎস এক জন্তু চলে আসলো। লাফ দিয়ে উঠে বসে টুশি। জন্তুটা একটা গেইম অফার করছে। গেইমের নাম আল্টিমেট ডেস্টিনেশান। গেইমটা চ্যুজ করবে কি করবে না ভাবতে ভাবতে ক্লিক করে ফেলল টুশি। দেখা যাক অতীতের ওরা কেমন গেইম খেলত। অনেকসময় সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসীরা ইতিহাস চ্যানেল হ্যাক করে নিজেদের অখাদ্য এড করে দেয়। অমন কিছু হলে পুরো সময়টাই নষ্ট হবে টুশির। গেইম প্লেয়ার একটা সাদা আলখেল্লা পড়া লোক। রাস্তায় দুটো ছেলেমেয়ে একান্ত মূহুর্তে আছে। তাদের অতিক্রম করে যেতে হবে। টুশি ওয়েলডান বাটনে ক্লিক করে ওদের পাশ কাঁটাতে চাইতেই রেড লাইট জ্বলে উঠলো। পরের স্টেজে যেতে পারছে না সে। ওদের সামনে একটা দেয়াল তুলে দিলে কিছু পয়েন্ট পাবে আর একটা অপশন ওদের আলাদা করে দেয়া, এটাতে সবচেয়ে বেশি পয়েন্ট। খুব বিরক্তিকর ব্যাপার।

সেই নীতিজ্ঞানসহ বুড়োটার কথা মনে পড়ল। রাস্তায় টুশি আর স্যাম ছিল একসাথে। লোকটা বারবার ওদের স্কাইস্ক্র্যাপারের আড়ালে যেতে বলছিল। লজ্জায় মরে যাচ্ছিল যেন। টুশি তখনই লোকটাকে খুন করতে চাচ্ছিল। মেরেও ছিল, মরেনি লোকটা। টুশির কখনো মিস হয় না। এর আগেও বেশ কয়েকটা খুন করেছে। ওইবারই শুধু পারলো না। তারপর একদিন ওই যে ভীষণ একটা বাতাস আসলো। যাকে বিজ্ঞানীরা বিশ্লেষণ করতে পারলো না। মা, ওই লোকটা আর আরো কিছু মানুষ ; যারা বেশি নীতি কপচাতো, মরেই গেল। কিন্তু কেমন হাসতে হাসতে মরল ওরা। মা সেই মন্ত্রটাও পড়লো মারা যাওয়ার আগে। যাই হোক, মরেছে টুশি বেঁচেছে।

পরের স্টেইজে যেতে যা করলে পয়েন্ট বাড়বে তাই করছে টুশি। একটা অদ্ভুত কাজ করাতে হয় সাদা আলখেল্লা পড়া লোকটাকে দিয়ে। কেউ একজন খালি গলায় গানের মত গায়, আর সেই সময় যার থেকে গানের আওয়াজটা আসে তার পিছনে দাঁড়াতে হয়।

সাদা পোশাকের পাশে পা এ পা লাগিয়ে আরো অনেকে দাঁড়ায়। তারপর কিছুক্ষণ উঠা-বসা, মাটিতে মাথা ঠেকানো। এই কাস্টমটা ফুলফিল করতে পারলে অনেক পয়েন্ট। কিন্তু ঠিক ওই সময়ই মুভি দেখা, মাঠে খেলার অপশান আসে। সেগুলো ভুলে ক্লিক করলেই পয়েন্ট কমে যায়। সাদা আলখেল্লার প্লেয়ারটার মাকে কেয়ার করলে পয়েন্ট অনেক বাড়ে। স্বভাবসুলভ টুশি প্লেয়ারটাকে দিয়ে ঘুষি দিইয়েছিল ওর মাকে। রেড এলার্ট চলে এসেছিল।

তারপর আরো কিছু স্টেজ আছে। জুয়া খেললে, ড্রিংকস করলে পয়েন্টস কমে। টুশি বুঝেছে নীতিবাগিশদের খেলা এটা। কিন্তু সময় কাটাতে খেলে যাচ্ছে। নিজের আর্ন করা পয়েন্টের ২.৫% গরীব কাউকে দিলে পয়েন্ট আরো বেড়ে যায়।

আরও আছে যুদ্ধক্ষেত্রের স্টেজ। যুদ্ধে গেলে পয়েন্ট বাড়ে, মরলে তো আরো পয়েন্ট। হাস্যকর নিয়ম! যুদ্ধ ক্ষেত্রে মৃত্যুর আগে টুশির প্লেয়ার বলে ওঠে সেই মন্ত্রটা। টুশি চমকে উঠে। মা এই মন্ত্রটা বলতো না? আরো কয়েকবার গেইমটা খেলে। ইচ্ছা করে করে মরে। আর শুনে, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ! ভেতরটায় কেমন একটা হুহু করে ওঠে টুশির। হঠাৎ ঘড়ির শব্দে সৎবিৎ ফিরে পায়।

দুইদিন পার হয়ে গেছে এই ফালতু গেইমটা খেলে। সময় এখন এতটাই দ্রুত যায়! নিউট্রিশানের ডোজগুলো দেয়া ছিল বলে ক্ষুধা টের পায়নি।হরমোনাল ট্রিটমেন্ট করে ঘুমটা অনেকদিন আগেই ও এডজাস্ট করে নিয়েছিল। যখন ইচ্ছা ঘুমাতে পারে ও এখন।


মস্তিষ্কের লজিক ড্রাগ্‌সটা তো ঠিকমতোই নিচ্ছে, তবু এমন হচ্ছে কেন টুশির। একই গেইম দুইদিন খেলার ফল আসলে। সেই গানটা মিস করছে। ভাসমান রাস্তায় হাটতে গিয়ে একটা খুন হতে দেখে থামাতে ইচ্ছা করছিল। প্লাস্টিক সার্জারির চেয়ে আগে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে ট্রিটমেন্ট দরকার। সে মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী। ঠিকঠাক ড্রাগ পড়লেই সব ঠিক হয়ে যাবে। যুক্তিগুলো জায়গা করে নিবে, বিশ্বাসরা ধোঁয়ার মত বের হয়ে যাবে।

হঠাৎ পা এর নিচে রাস্তা কেঁপে উঠল। জমিনে পেরেকের মত গাঁথা তার নিরাপত্তাদায়ী পর্বতটা কি একটু টলে উঠল না? চৌম্বকক্ষেত্র কি কাজ করছে না? চোখের সামনে সব স্কাইস্ক্র্যাপার ঢলে পড়ছে কেন? পর্বত! নিরাপদতম পর্বত পড়ে যাচ্ছে! অসংখ্য মেয়েরা রাস্তায় ছুটছে পাগলের মত। অপ্রতিরোধ্য মৃত্যু কি এসে পড়ছে! শেষ বাঁশি বাজলেও টুশির কানে তা আসেনি।

জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে টুশি। জ্ঞান হারানোর আগে বলতে ইচ্ছা করছে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। বলবে না, বলবে না সে কোনোভাবেই। সে কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের মত “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” বলবে না। মৃত্যু জড়িয়ে ধরেছে টুশিকে আষ্টেপৃষ্টে। ও জানতো না এই সময় “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” কোনো কাজে আসবে না। জানলে মরার আগে ওর মস্তিষ্ককে এত দোটানায় ফেলতো না।

 

– উম্মে লিলি

#রৌদ্রময়ী_সাইফাই

মন্তব্য করুন

Back to top button